আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে

।। বিশ্বেন্দু নন্দ ও অত্রি ভট্টাচার্য ।।

এই অভদ্রবিত্ত-ভদ্রবিত্তদের জোটের মনে হয়েছে ঢাকার বুকে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে রিক্সাচালকদাদাদের সক্রিয় সলিডারিটি, গার্মেন্টস কর্মীদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত এই ধরণের আন্দোলনকে আরও বেশি গণমুখী করবে, আরও বড় সফলতার দিকে ঠেলে দেবে। ভদ্রবিত্তীয় আন্দোলনের কর্মী হিসেবে জুড়ে থাকার অভিজ্ঞতায় লেখক দেখেছেন সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ার এই ধরনের দাবিদাওয়ার আন্দোলনে অভবিত্তদের অংশগ্রহণ প্রায় থাকে না। থাকলেও সেটা প্রতীকী উপস্থিতির বাইরে বের হতে চায় না। পশ্চিমবঙ্গের নতুন অভদ্রবিত্ত-ভদ্রবিত্ত জোটের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে বর্তমান লেখক মনে করে ভদ্রলোকের শুরু করা রাজনীতিতে অভদ্রলোকেদের সক্রিয় অন্তর্ভূক্তি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকে অন্যমাত্রায় তুলে নিয়ে গিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ছেয়ে গেছে ছাত্র-যুবদের আন্দোলনকে সালাম দেওয়া রিক্সাচালকদাদাদের স্থির ছবি আর ভিডিও। এই প্রবন্ধ লিখতে লিখতে খবর এক বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন, ‘ছাত্র-জনতাদের সাথে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে সকল গার্মেন্টসের শ্রমিক জনতা…’। স্পষ্টভাবে আমরা অভদ্রবিত্ত-ভদ্রবিত্তদের নতুন ধরণের ব্যতিক্রমী এক জোটের পক্ষ থেকে মনে করি গত কয়েকদিনের ভদ্রবিত্ত ছাত্র-যুবার এই আন্দোলন আর শুধুই ভদ্রবিত্তের দাবিদাওয়ায় আটকে রইল না – এই আন্দোলন জনগণের আন্দোলনে পরিণত হল।

‘পদত্যাগ’ নয়, ‘পতন ও অভ্যুত্থান’-এর কথা বলুন। পাশাপাশি এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাতের পর আমরা কিভাবে নিজেদের নতুন ভাবে গঠন করতে চাই তার রূপ বা প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা শুরু করুন।’’

ফরহাদ মজহার, ১ আগস্ট, ২০২৪

ফরহাদ ভাইয়ের কলাম পড়তে পড়তেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যতিক্রমী ছবি ভেসে এল – ঢাকার শহীদ মিনার রিক্সাচালকদাদাদের গায়ে কাঁটা দেওয়া যুথবদ্ধ শ্লোগানে উত্তাল। যৌবনকাল থেকেই অভদ্রবিত্তের সংগঠনের সর্বক্ষণের কর্মী থেকেছি। এই ভিডিও দেখে কারিগর সংগঠনের কর্মী হিসেবে আবেগকে বশে রাখতে পারি নি। মাথায় রাখতে হবে আমরা, চাষী কারিগর হকারেরা সেই পলাশীর পর থেকেই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার। ১৯৪৭এর পর সংবিধান বজায় রেখেই গ্রাম থেকে ২৫ কোটির বেশি কারিগর চাষী হকারকে উচ্ছেদ করেছে ভারতীয় জাতিরাষ্ট্র-কর্পোরেট-কুলাক [বড় চাষী] জোট। বাংলাদেশের ‘বৈষম্য বিরোধী’ আন্দোলনের ওপরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজোটে রাস্তায় নেমেছি, স্ট্রিট কর্নার করেছি, মিছিল করেছি, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালিখিও করেছি নিয়মিত। বামপন্থী দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা বাংলাদেশ দূতাবাস অভিযান মিছিলে ‘টোকেন’ গ্রেফতার হয়েছে।

বাংলাদেশের ভাববৈঠকীর পশ্চিমবঙ্গের সমান্তরাল ভাবনার গবেষক একটিভিস্টদের হকার, কারিগর চাষী আর ছাত্রদের ব্যতিক্রমী যৌথ দল জ্ঞানগঞ্জ, উপনিবেশ বিরোধী কর্পোরেট বিরোধী চর্চার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশাল মিছিল করেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের লাগোয়া এইট-বি বাসস্ট্যান্ডে আজ থেকে প্রায় দুসপ্তাহ আগে ২০ জুলাই, কমরেড লেনিন মূর্তির সামনে দেড় ঘন্টা কারিগর সংগঠনের কর্মী, জ্ঞানগঞ্জ আর নয়া চিন্তা যৌথ স্ট্রিট কর্নার করছে – ডাক ছিল ‘বাংলাদেশের চলমান গণআন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীদের সংহতিতে, গণহত্যাকারী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে, আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসন নিপাত যাক।’ বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন – যদিও তাঁর উদ্বেগের প্রকাশভঙ্গী হিন্দি-হিন্দু-হিন্দিস্তানি দলগুলোর থেকে অনেকটাই আলাদা।

শুরু করেছিলাম ভদ্রবিত্ত ছাত্র-যুবদের এই আন্দোলনে অভদ্রবিত্তদের অংশ নেওয়া চিহ্নিত করে। পশ্চিমবঙ্গে জ্ঞানগঞ্জ এবং নয়া চিন্তা, অভদ্রবিত্ত-ভদ্রবিত্তদের নতুন ধরণের ব্যতিক্রমী এক জোট বানিয়ে আন্দোলনে নেমেছে, তারা উপনিবেশকে নতুন করে বুঝতে চাইছে। এই যে উপনিবেশিক জাতিরাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কর্পোরেট পশ্চিমা রাজনীতি, তাকেও গত ২৬৭ বছরের লুঠের প্রেক্ষিতে দেখতে চাইছে। তারা আন্দোলনকে নতুন চোখে দেখা, বোঝার উদ্যম নিয়েছে।

এই অভদ্রবিত্ত-ভদ্রবিত্তদের জোটের মনে হয়েছে ঢাকার বুকে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে রিক্সাচালকদাদাদের সক্রিয় সলিডারিটি, গার্মেন্টস কর্মীদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত এই ধরণের আন্দোলনকে আরও বেশি গণমুখী করবে, আরও বড় সফলতার দিকে ঠেলে দেবে। ভদ্রবিত্তীয় আন্দোলনের কর্মী হিসেবে জুড়ে থাকার অভিজ্ঞতায় লেখক দেখেছেন সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ার এই ধরনের দাবিদাওয়ার আন্দোলনে অভবিত্তদের অংশগ্রহণ প্রায় থাকে না। থাকলেও সেটা প্রতীকী উপস্থিতির বাইরে বের হতে চায় না। পশ্চিমবঙ্গের নতুন অভদ্রবিত্ত-ভদ্রবিত্ত জোটের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে বর্তমান লেখক মনে করে ভদ্রলোকের শুরু করা রাজনীতিতে অভদ্রলোকেদের সক্রিয় অন্তর্ভূক্তি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকে অন্যমাত্রায় তুলে নিয়ে গিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ছেয়ে গেছে ছাত্র-যুবদের আন্দোলনকে সালাম দেওয়া রিক্সাচালকদাদাদের স্থির ছবি আর ভিডিও। এই প্রবন্ধ লিখতে লিখতে খবর এক বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন, ‘ছাত্র-জনতাদের সাথে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে সকল গার্মেন্টসের শ্রমিক জনতা…’। স্পষ্টভাবে আমরা অভদ্রবিত্ত-ভদ্রবিত্তদের নতুন ধরণের ব্যতিক্রমী এক জোটের পক্ষ থেকে মনে করি গত কয়েকদিনের ভদ্রবিত্ত ছাত্র-যুবার এই আন্দোলন আর শুধুই ভদ্রবিত্তের দাবিদাওয়ায় আটকে রইল না – এই আন্দোলন জনগণের আন্দোলনে পরিণত হল। এর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল ৪/৫ দিন আগের রিক্সাচালক দাদাদের ছোট মিছিলে। আজকের ঢাকার শহীদ মিনারের রিক্সাচালকদাদাদের মিছিল বিশাল, রিক্সাচালকদাদাদের সক্রিয় শ্লোগান দেওয়ার ভঙ্গীমার বিশ্বরাজনীতিতে অভিঘাত ব্যাপক – অবশ্যই রাজনৈতিক পরিবর্তনের যথেষ্ট ইঙ্গিত বহনকারী। একই সঙ্গে জুড়লেন গার্মেন্টসের কর্মীরা। মনে পড়ে যাচ্ছিল সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাটকের কথা, এই রিক্সাচালকদাদারা, গার্মেন্টেস কর্মীরা প্রত্যেকেই যেন এক একজন নুরুলদিন হয়ে আবির্ভূত হচ্ছেন,

নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়
ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।

আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে;
যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে,
তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।
নূরলদীনের কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, “জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?

নূুরুলদীনের কথা মনে পড়ে যায় – সৈয়দ শামসুল হক


প্রসঙ্গত বলা যাক, গত ৩০ জুলাই এই ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকাতেই জ্ঞানগঞ্জের সাথী, রাস্তার লড়াইএর বন্ধু নজরুল আহমেদ ও অতনু সিংহ লিখেছেন

‘মনে রাখা দরকার, এই আন্দোলন বাংলাদেশের কোটা সংস্কারের প্রেক্ষিতে তৈরি হলেও আজ আর তা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধার দাবিদাওয়ার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নয়। এই আন্দোলন বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ বিরেধিতায় মুখর। এই আন্দোলন সমাজ বিপ্লবের ডাক নিয়ে এসেছে। কমরেড বদরুদ্দীন উমর যথার্থই বলেছেন, ১৯৫২ থেকে বাংলাদেশে যতগুলো গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, তার মধ্যে ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান ব্যাপক। এই আন্দোলনের কেবলমাত্র বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বড় বাংলায় ছড়িয়ে গিয়েছে এই অভ্যুত্থানের জোশ। মনে রাখা দরকার বাংলাদেশের বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিবাদের ‘ফুয়েল দিল্লির ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি’ জাতিবাদের এক্সটেইনশন মাত্র। এবং দিল্লির ফ্যাসিবাদের পিছনে মদত দিয়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী গায়েবি বৈশ্বিক পুঁজি। মনে রাখা দরকার, দিল্লি একদিকে তাদের সম্প্রসারণবাদকে ক্রমেই বাংলাদেশে যেভাবে উপনিবেশবাদের চেহারায় পর্যবসিত করেছে, অন্যদিকে সেই উপনিবেশবাদী জুলুমের বাইরে নয় পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরা। এই তিনটি রাজ্য দিল্লি নিয়ন্ত্রিক ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই অবস্থিত’।’

বাংলাদেশে আইনের শাসন আজ নয়, আন্দোলনের শুরুর আগে থেকেই লোপ পেয়েছে। নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি আর তাদের তাত্ত্বিক নেতা চিতপাবন বামুনদের হিন্দু-হিন্দি-হিন্দিস্তানীদের সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ যেভাবে কার্যত ভারতে অলিখিত জরুরি অবস্থা জারি করেছে, সংখ্যালঘুদের জান-মাল ধ্বংস করেছে, বাংলাদেশের শাসক শেখ হাসিনাও বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অলিখিত জরুরি অবস্থা জারি করেছেন, সেখানকার সংখ্যালঘুর ওপরে অত্যাচার নামিয়ে এনেছে আওয়ামি লিগ, এই আন্দোলনে ট্যাঙ্ক নেমেছে, পুলিশ মিলিটারির গুলিতে ৩০০র কাছাকাছি আন্দোলনকারী শহীদ হয়েছেন। বাংলাদেশ জুড়ে নেমে এসেছে গণহত্যার ঢল। শোনা যাচ্ছে ব’কলমে র’য়ের এজেন্টরা সরকারপক্ষীয়দের আন্দোলন দমনে পরামর্শ দিচ্ছেন। তাতেও খুব কিছু কাজ যে হচ্ছে না সেটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার।

এই আন্দোলন এখন জনজাগরণে পরিণত হয়েছে। দূরদর্শী চিন্তক ফরহাদ মজহার লিখেছেন, ়

‘আন্দোলন শুরুর পরপরই তরুণ শিক্ষার্থীরা এটা বুঝতে পারে। তারা একে স্রেফ কোটা সংস্কার বা চাকুরী পাওয়ার আন্দোলন হিশাবে হাজির করে নি। এই ক্ষেত্রে তাদের চিন্তাশীলতা এবং দূরদর্শিতার প্রশংসা করতে হয়। তারা একে নাম দিয়েছে ‘বৈষম্য বিরোধী’ আন্দোলন। এর দ্বারা শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সীমিত চরিত্রকে সহজে একটি সর্বজনীন চরিত্র দান করতে সমর্থ হয়েছে। ফলে অতি দ্রুত তা জনপ্রিয় আন্দোলনে রূপ নিতে পেরেছে। শুধু সাধারণ ছাত্রদের সমর্থন লাভে শেষ হয় নি, সমাজের সাধারণ মানুষের সমর্থনও লাভ করেছে’।


পশ্চিমবঙ্গের অভদ্রবিত্ত-ভদ্রবিত্তের হকার-কারিগর-চাষী-ছাত্রদের জোট জ্ঞানগঞ্জ উপনিবেশ-বিরোধী কর্পোরেট-বিরোধী চর্চা হকার কারিগর চাষী ছাত্র শহুরে গরীবদের পক্ষ থেকে ‘বৈষম্য বিরোধী’ আন্দোলনে সলিডারিটি প্রকাশ করছে। নতুন রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাকেও স্বাগত জানাচ্ছি খোলা হৃদয়ে। হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ সীমান্তের দুই পারেই পরাজিত হবে এই আশাকরি। অতীতে এই জোট বাংলাদেশের চালু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে মিটিং মিছিল আন্দোলন করেছে। আমরা আরও লক্ষ্য করছি, যে ছাত্র-জনতাদের সাথে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শ্রমিকবর্গ, বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত গার্মেন্টসনির্মাতা শ্রমিক জনতা। এহেন শ্রেণি-ঐক্য সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধেই পরিলক্ষিত হয়েছিল- যখন ভারতের নকশালপন্থী আন্দোলনের নেতা চারু মজুমদারকে তাদের ‘ভ্রাতাপার্টি’, পূর্বপাকিস্তানের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির কমরেডরা চিঠিতে লিখছিলেন,

এহেন ভাষ্য ‘শ্রেণি শত্রু খতমকে দ্রুততর ও ব্যাপকতর করার চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি মাও চিন্তাধারা ও ক্ষমতা দখলের রাজনীতির প্রচার জোরদার করার, পার্টির গোপন সংগ্রামকে মজবুত করার, আর সব কাজের জন্য গরিব ও ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে পার্টির ভিত্তি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করার চেষ্টা করছি।’ (৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১) অথবা ‘আমাদের এখানকার বিপ্লবী ও সচেতন জনগণ তাই লড়াই চালাচ্ছেন বীর বিক্রমে। ইতিমধ্যে ১৬টি action হয়েছে; বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, রাজশাহী জেলায় অ্যাকশন ছড়িয়ে পড়েছে।…জীবনদানের চলছে প্রতিযোগিতা।’

(১৫ই মার্চ, ১৯৭১)


এই চিঠি দুটি দেশব্রতীতে লিখিত চারু মজুমদারের ৪ঠা মার্চের ‘পূর্ববাংলা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা জুয়া খেলছে’ শীর্ষক চিঠির সাথে মিলিয়ে পড়া যায়। ২৮ এপ্রিল ১৯৭১, নকশালপন্থী তাত্ত্বিক সরোজ দত্ত তার ‘ভারত সরকার পাকিস্তান থেকে হাত ওঠাও, পাকিস্তানের জনতাকে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে দাও’ নিবন্ধে পূর্ববঙ্গের সংগ্রামী জনতার প্রতি লেখেন- ‘তারা যেন মনে রাখেন পূর্ববাংলার সাম্রাজ্যবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদকে আমদানি করছে, এই শ্রেণী সংগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য।’ অবশ্য নকশালপন্থীদের তৎকালীন অবস্থানকে অনেকেই ইয়াহিয়ার ঘৃণ্য শাসনের মতাদর্শিক অস্ত্র মনে করেছেন, চারু মজুমদার নিজেই জারি করা বক্তব্যে বলেছিলেন

ইয়াহিয়া কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি করে রেখেছে, শুধু তাই নয়, জমিদার শ্রেণীর উপর নির্ভর করেই সে তার শক্তিকে সংহত করার চেষ্টা করছে এবং তার হাতিয়ার উগ্র ধর্মান্ধতা। একদিকে সে যেমন, মার্কিনি চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে আত্মরক্ষার তাগিদে, অন্য দিকে সে মার্কিনিদের কাছে দরবারের জন্য লোক পাঠাচ্ছে।’

২৯ জুন, ১৯৭১)

বাংলাদেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী সম্পর্কেও সম্ভবত, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও এই কথা খাটে। দুই দেশের নকশালপন্থী গেরিলাদের প্রতি সুনীতিকুমার ঘোষ তার ‘লিবারেশনের পক্ষে সৌম্যের বক্তব্য’তে জানিয়েছিলেন- ‘নিজের দেশে বিপ্লব করেই পার্টি ও জনগণ চীনবিরোধী ও বিশ্ববিপ্লব বিরোধী চক্রান্তকে ব্যর্থ করতে পারেন- বিপ্লবের পথ পরিত্যাগ করে নয়।

(২৯ জুন, ১৯৭১)

এই মতাদর্শিক অবস্থানের রেশ ধরেই বাংলাদেশে বিপ্লবী বামপন্থী রাজনীতির অন্যতম নেতা সিরাজ শিকদার তার ঐতিহাসিক দলিল ‘পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস’ (১৯৬৮) নিবন্ধে স্বাধীনতা-উত্তর কালে কী কী দ্বন্দ্বের নিরূপণ বাংলাদেশের জনগণকে করতে হবে, সেই বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন,

পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব ছাড়াও ভবিষ্যতে উত্থাপিত হবে জনগণের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব, এবং ভারতীয় ‘সম্প্রসারণ’বাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব। এই ঐতিহাসিক প্রসঙ্গগুলি উত্থাপন করার কারণ এই যে, জ্ঞানগঞ্জের তরফ থেকে আমরা মনে করি ভারত রাষ্ট্রনৈতিক ভাবে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশকে অলিখিত ‘উপনিবেশ’ হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। বাংলাদেশের তরুণদের কাছে আমাদের অনুরোধ মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পতাকাকে আরও ঊর্ধ্বে ধারণ করুন, যাতে ভারতের হিন্দুত্ববাদী স্বৈরশাসকদের মতাদর্শিক ভিতও নড়ে যায়।

আন্দোলন নিয়ে তাহমিদাল জামি’র গভীর তাত্ত্বিক বক্তব্য দিয়ে প্রবন্ধ আমরা শেষ করলাম; আদতে আন্দোলন কম কেন্দ্রিভূত বলেই নেতা নির্ভর ছিল না, কেন্দ্রিভূত ক্ষমতার পক্ষে তাকে দমন করাও সমস্যার ছিল ,

“সম্ভবত জুলাইয়ের এই গণআন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম কেন্দ্রীভূত ও সবচেয়ে আনুভূমিক গণআন্দোলন। এতে একক বা মুষ্টিমেয় ভার্টিকাল নেতা নাই। সমাজের যেসকল বর্গ ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের সবারই হিস্যা আছে এই আন্দোলনে।

রাষ্ট্র ব্যবস্থা অচল করে আকাশে ওড়া ক্ষমতাবানদের মাটিতে নামিয়ে আনা, স্থিতিশীলতা ভাঙার জন্যে হাজারো প্রশ্ন তোলা, জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা দেখানো ইত্যাদি খুব জরুরি কাজ ছিল – বাংলাদেশ জুড়ে আন্দোলনের কর্মীরা সেটা নিজেদের হাতে করে দেখিয়েছেন – প্রাণও দিয়েছেন অকাতরে বুলেটের সামনে কার্যত বুক পেতে – সেই তিয়েনআনমেন স্কোয়ার থেকেই দেখছি। দল করি না বলেই, জনতার অংশ বলেই আন্দোলনের শেষ কোথায় জানি না – বা বলতে গেলে – আন্দোলনের কোনও শেষ নেই বলেই মনে হয় – আন্দোলন ধারাবাহিক বিশ্বপ্রক্রিয়া – এক আন্দোলন শেষ হবে সরকারে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই – সে জাতিরাষ্ট্রের অংশ হবে – এডিপ্টেড হবে। তার পিঠেপিঠি নতুন আন্দোলন শুরু হবে সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভাঙার বিরুদ্ধে, সেই স্থিতিশীলতা চুরমার করতে। আন্দোলনের জেতা বা ঠিকঠাকভাবে এগোনো এ সব যারা ক্ষমতায় যাওয়ার কথা ভেবে আন্দোলনে যোগ দেন তাদের চিন্তা। আমরা জনগণ, যারা আন্দোলনের পর আন্দোলনে অংশ নিই দলে দলে, তারা আন্দোলনেই থাকব – ১০০০ বছর আগে কৈবর্ত লড়াইতে ছিলাম, এখনও বাংলাদেশের মাটিতে আছি, ভবিষ্যতে রাস্তাতেই থাকব। কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহারকে উদ্ধৃত করে তাই বলব,

আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে/এখন আমার আর ফেরার উপায় নেই

লড়াই দীর্ঘজীবী হোক। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নিপাত যাক। উপনিবেশের পতন হোক। ড়বাংলার চাষী-হকার-কারিগর-ছাত্র ঐক্য, বিকেন্দ্রিভূত উৎপাদন ব্যবস্থা দীর্ঘজীবী, সফল হোক।

Share