যবন এশেকে বলে ‘তারা’!

।। সোমনাথ রায় ।।

আমাদের গান কবিতার মধ্যে বা আমাদের যাবতীয় সাহিত্যের মধ্যে, পাশ্চাত্যপ্রভাব আসার আগে অবধি, এই গুণটা বিদ্যমান ছিল। ফরহাদ মজহারের কাব্যের মাধুর্য এটাই যে তিনি সেই গুণটির উপাসনা করেন। রামপ্রসাদের গান সিরাজ-উদ-দৌল্লা শুনেছিলেন, আবার সমাজবিপর্যয়ে রামপ্রসাদের গানগুলি যখন প্রচলিত আসরে পাওয়া যাচ্ছে না, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বরিশালের মাঝিমাল্লার কাছ থেকে সেই গান উদ্ধার করেন। অর্থাৎ, কাব্যের যে ডিসকোর্সমূলক কায়ার কথা উপরে উল্লেখ করলাম তার পাশাপাশি সমাজে আপামর মানুষের কাছে পৌঁছানোর শক্তিও এই সাহিত্যের ছিল। ফরহাদ মজহার বাংলার ভাবধারার এই দ্বৈত শক্তির হদিশ আমাদের দিয়ে যান। জন্মদিনে কবিকে শ্রদ্ধা।

আদরিনী শ্যামাঙ্গিনী দারুণ রূপসী মেয়ে ওকে
যতনে হৃদয়ে রাখি। তসবিতে জননীর নাম
সতত জিকির করি। প্রভূ তাঁকে পাবো বলে আমি
প্রথমে ‘যতনে’ লিখি, লিখে ফের সবুজ কালিতে
তাঁকে কাটি। ভেবে দেখো কালো কালি দিয়ে কি কালিকে
কাটা যায়? অত:পর সবুজাভ অক্ষরের পাশে
‘সতত’ শব্দটি লিখি। কাটাকুটিসহ সব কিছু
ঠিকঠাক রেখে দেই, মোটেও মুছি না। সব থাকে।

আমি কি রামপ্রসাদ? অন্ধ ভক্ত? আমি কালো রূপে
মজেছি আদ্যার্থসহ। অনাদি জননী যন্ত্রে নিজে
নিজেকেই পয়দা করি। প্রভু শুধু কর্মজ্ঞানে নয়
কালজ্ঞান দৃঢ় রেখে পূজা করি। শ্যামার পূজায়
দুটোই একসঙ্গে লাগে জেনে ম্লেচ্ছ আমি দিশেহারা-
হিন্দু কবে ভুলে গেছে, যবন এশেকে বলে ‘তারা’!

[এবাদত নামাঃ ৪৫ ।। ‘কবিতাসংগ্রহ’, ফরহাদ মজহার ]

উপরের কবিতাতে কমলাকান্তের একটি শাক্তপদের ডিকন্সট্রাকশন হচ্ছে। যে পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে কবি নিজের পরিচিতিকে পুনর্নির্মাণ করছেন। শাক্ত পদাবলী-র ধারা এমনিতেও তো সেকরকম-ই। এই পরিচিতির নির্মাণ এবং প্রতিষ্ঠিত ভাবনার বিনির্মাণ রামপ্রসাদ তাঁর বহু কালীকীর্তনেই করেছেন। কিন্তু, রামপ্রসাদের গানকে আমরা পাশ্চাত্যের প্রথা মেনে তাত্ত্বিক ডিসকোর্স হিসেবে দেখি না। গান হিসেবে দেখি, আত্মস্থ হওয়ার আধার হিসেবে দেখি।

আমাদের গান কবিতার মধ্যে বা আমাদের যাবতীয় সাহিত্যের মধ্যে, পাশ্চাত্যপ্রভাব আসার আগে অবধি, এই গুণটা বিদ্যমান ছিল। ফরহাদ মজহারের কাব্যের মাধুর্য এটাই যে তিনি সেই গুণটির উপাসনা করেন। রামপ্রসাদের গান সিরাজ-উদ-দৌল্লা শুনেছিলেন, আবার সমাজবিপর্যয়ে রামপ্রসাদের গানগুলি যখন প্রচলিত আসরে পাওয়া যাচ্ছে না, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বরিশালের মাঝিমাল্লার কাছ থেকে সেই গান উদ্ধার করেন। অর্থাৎ, কাব্যের যে ডিসকোর্সমূলক কায়ার কথা উপরে উল্লেখ করলাম তার পাশাপাশি সমাজে আপামর মানুষের কাছে পৌঁছানোর শক্তিও এই সাহিত্যের ছিল। ফরহাদ মজহার বাংলার ভাবধারার এই দ্বৈত শক্তির হদিশ আমাদের দিয়ে যান। যে শক্তির খোঁজ কলাকৈবল্যবাদী পশ্চিমের প্রবলতায় থাকে না। আমরা যখন শিক্ষাদীক্ষা শব্দটা ব্যবহার করি, যার তুলনীয় শব্দ পশ্চিমি অ্যকাডেমিক্সে নেই, আমরা জ্ঞানের সেই দ্বিবিধ ভূমিকার প্রসারের কথাই বলে ফেলি। একদিকে, তা পরমাপ্রকৃতির সঙ্গে ব্যক্তির নিজস্ব সম্পর্ক, পরমকে নিজের ভিতরে বাইরে অনুধাবনের কথা বলে। অপরদিকে তাকে ব্যবহারিকতায় ব্যাপক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করে। চর্যার ভাষাকে সাহেবদের স্কুলে সন্ধ্যাভাষা নাম দেওয়া হয়েছিল। বাউল-ফকিরের গান তাই আজও নাকি ‘মিস্টিক’। আমাদের শহরের গায়করা শব্দ বদলে নেন, কারণ ব্যাপক মানুষের কাছে অন্তরের কথা পৌঁছানো যায় না। “ শীতলং ফকিরে কইন দম কর সাধন/ দমের ভিতর আছে পাখি করিও যতন।“ তাঁদের ভাষ্যে হয়ে যায়- “শীতালং ফকিরে বলে মনে আলাপন / আরে, যাইবার কালে যাও রে পাখি দিয়া দরশন”- কারণ দমে কী সাধন হয় তা আমরা জানি না। অথচ ফরহাদ মজহার নদীয়ার ভাবের কথা বলেন। যেখানে দমের সাধন ব্যাপক মানুষকে শেখানোর সূত্র নির্মাণ হয়। পণ্ডিতপ্রবর নিমাই-অদ্বৈতর ভিটে থেকে যে শিক্ষাদীক্ষা ছড়িয়ে পড়ে অক্ষরচিহ্নজ্ঞানহীন বাউল ফকিরে আখড়ায়- মিশে যায় অন্ত্যেবাসী শ্রমজীবীর জীবনে, দর্শনে, বিনোদনেও। আবার, সেই নদীয়ার ভাব সে শিক্ষা করে যে পৃথিবীর একনম্বর কারিগর হয়ে ওঠে তার সময়ে দাঁড়িয়ে। ফরহাদ এই বিনির্মিত শ্যামাসঙ্গীতে নিজের পরিচিতি লেখেন ‘যবন’ – যবন মানে প্রাচীন Ioniaর লোক, পাশ্চাত্যের প্রতিনিধি এই সভ্যতায়। আমরা কে যবন নই? আমরা কে নই বহিরাগত এই বাংলার ভাবে? তবুও হৃদয়ে তাকাতে পারলে দেখি কাটাকুটির খেলা শেষে প্রেম জাগে, অহেতুকই।

বিবিধ অন্ধকারের মধ্যে, পরিচিতির বিবিধ নিগড়ে হাট ঘষটাতে ঘষটাতে বাংলার ভাব, নদীয়ার ভাবধারার এই আলো আমরা ফরহাদ মজহারের সাহিত্যে পাই। শুভ জন্মদিন কবি, দীর্ঘদিন আলো জ্বালিয়ে রাখুন।

সোমনাথ রায়:

উপনিবেশপূর্ব বাংলার সামাজিক গঠন অধ্যয়নে উৎসাহী। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ঘেন্নাপিত্তি, রেলিং জড়িয়ে প্লাস্টিক, অরূপ বৃন্দাবন ও অন্যান্য পদ।

Share