।। অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় ।।
এনআরসি হলে আমাকে কুথায় পাঠাবে গো বাবু? এই দেশে, না ওই দেশে? নাকি বর্ডারকে এক্কেবারে বর্ডারের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেবে গো? আমি ট্রাফিক পুলিশের মতো নাকি কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকব সেখেনে। বাংলাদেশের মরদ এসে আমার একদিকের বুক টিপবে, আর ইন্ডিয়ার মরদ এসে আরেকদিকের বুক টিপবে। হেব্বি মজা হবে গো বাবু।
এরপর সেই হোটেলের অন্ধকার ঘরে, প্রায় ভোররাতের দিকে, আমরা যখন ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত, শুয়ে আছি পাশাপাশি ও উলঙ্গ; হঠাৎ সে বলে ওঠে, ‘‘ও কীসের আওয়াজ?’’ আমি একটু কান পেতে শুনে আশ্বস্ত হই। দূরে কিছু লোকের হইচই। কোনও পিকনিক বা পুজো।
‘‘তুমি কী ভেবেছিলে?’’ আমি বলি।
বর্ডার বলে, ‘‘পুলিশ।’’
বর্ডারের আরেকটা সুন্দর নাম আছে। ম্যাগি! বর্ডার নামের কারণ জানলেও তার নাম কী করে ম্যাগি হলো তা ম্যাগি জানে না। কেউই জানে না। ম্যাগির জন্ম নিয়েই একটা ফিল্ম হয়ে যেতে পারে। ম্যাগি যখন মায়ের পেটে, ওর মা ব্যথা উঠলে ছিটমহলের ঘর থেকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে ফুলবাড়ি বর্ডারের দিকে নিজেকে টেনে আনে। তখন রাত। রক্তের দাগ ঘর থেকে বর্ডার অবধি টানা। বর্ডারের সামনে এসে করবি তো কর একেবারে র্যা ডক্লিফ সাহেবের লাইনটার ওপর ম্যাগির মা ম্যাগিকে বের করে। বের হওয়ার মাঝামাঝি সময়ে, ম্যাগির মাথা যখন ইন্ডিয়ার ভেতর, শরীরের বাকি অংশ তখন বাংলাদেশে। পয়দা করে হুঁশ ছিল না ম্যাগির মায়ের। ম্যাগিও নাকি টু শব্দও করেনি। গরুচোরের দল যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। তারা একটা গরুর পিঠে উঠিয়ে নেয় আধ ন্যাংটো ম্যাগির মাকে। ম্যাগি ভারত-বাংলাদেশের মাঝখানে শুয়ে থাকে। কান্নাহীন। ওপরে আকাশের তারা। তার কি বা ভারত, কি বা বাংলাদেশ।
তখন বর্ডার সিনেমা হিট চলছে। রাতারাতি নাম হয়ে যায় বর্ডার। পরে খুব সম্ভবত বিএসএফের লোকেরাই ওর নাম দেয় ম্যাগি। ওর ঝালর-ঝুমরো চুল দেখে। তবে ম্যাগির সে চুল আমি দেখিনি। আমি দেখেছি ম্যাগির চুল মোমোর মতো। ঝুমকো আর থোকা থোকা। ম্যাগিকে যখন প্রথম দেখি, সেটা বিডন স্ট্রিটের মুখে সোনাগাছি থেকে বের হওয়ার সময়। ওর জন্মের সময় ওর মায়ের মতো ভঙ্গিমায় শুয়ে ছিল ম্যাগি। কোমর অবধি শরীরের অংশ ফুটপাতের স্ল্যাবে রাখা। ফুটপাত আর রাস্তার মাঝখান দিয়ে খুব সরু নালা। ফুটপাত থেকে অল্প নীচুতে রাস্তায় পা দুটো ছড়িয়ে প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ম্যাগি। ফ্রিদা কাহলোর ঠিক এরকম একটা ছবি আছে। তবে সেটা সাদা চাদরের বিছানায়। ম্যাগির চুল আমি ম্যাগির মতো দেখিনি। ম্যাগির মুখে শুনেছি, সে চুলে লাখো আশিক কতল হয়েছে। তবে যে বাচ্চার জন্ম দিল ম্যাগি, তার চুল হুবহু ম্যাগির গল্পের চুলের মতো। সেই প্রথম আমি ম্যাগিকে দেখি। তখনও চিনি না। ওর ম্যাগি-চুলের গল্পটা বিশ্বাস করেছিলাম, ওর বাচ্চাকে দেখেই। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ম্যাগি হামেশাই বলত, ‘‘আমি হলাম সস্তায় পুষ্টিকর গরিবের খাবার। পাঁচ মিনিটেই আমাকে খাওয়া হয়ে যায়।’’
পরে যখন ম্যাগির সঙ্গে পরিচয় হয়, তখন ওর সঙ্গে বাচ্চাটাকে দেখিনি কখনও। ম্যাগি একদিন এক গল্প বলে আমায়। অনেক গল্প সে আমায় বলেছিল। তার মধ্যে এই গল্পটি শাবলের মতো গেঁথে আছে। ম্যাগির একটা কুত্তা ছিল। দেশি নেড়ি। গাড়ি চাপা পড়ে তার সামনের বাঁ পা হাঁটু থেকে কাটা পড়ে। তিন পায়ে লাফিয়ে হাঁটত ওয়াইওয়াই।
ম্যাগির পাড়ার ছেলেরাই তার ওই নাম দিয়েছিল। ম্যাগির কুত্তার নাম ওয়াইওয়াই। সেই ওয়াইওয়াই নাকি প্রায়ই তার সামনের বাঁ পায়ের নখের জায়গাটা, যেখানটা আসলে শূন্য, কিছু নেই; সেখানে জিভ দিয়ে চাটত। যেন কাটা পড়া দেশে ফেলে আসা তুলসি মঞ্চের কথা ভাবছে হরিদাসী বালা। গর্তের মুখে ফিরে যাওয়া সাপের মতো আমি বারবার ফিরে যাই ম্যাগির সেই গল্পের কাছে।
কিন্তু না। তার গল্পের চরিত্রেরা, গল্পের আবহেরা, এমন এক দুর্গম অন্ধকারমালা বিছিয়ে রেখেছে, রেখে বলছে, ‘‘বাইরে দাঁড়াও। ভেতরে তোমার প্রবেশ অধিকার নেই।’’ আমি চেষ্টা করি তার গল্পের কোনও চরিত্রকে ঘুষ দিয়ে পটিয়ে-পাটিয়ে ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র যদি জোগাড় করতে পারি। হচ্ছে না। আমি এখানে প্রকৃতই বহিরাগত। ফলে ম্যাগিকে নিয়ে ম্যাগির মতো করে গল্প লেখা আমার হয়ে ওঠেনি। এখন আমি যেটা লিখছি, এটা সেই গল্পের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চরিত্রদের ভাসা ভাসা গলার মৃদু আওয়াজ পেয়ে লিখছি। আমার অযোগ্যতাই এই গল্পের বিষয়। দক্ষতা নয়, আমার অদক্ষতাই এ গল্পের চালক। আমার জানা নয়, আমার অজানাই এর রহস্য। রাতের তারার আলোয় আমি যে ম্যাগি ও তার গল্পের চরিত্রদের সামান্য অবয়বটুকু দেখেছি, সেটাই বলি। লেখক হয়েছি বলে খামোকা তারার আলোয় দেখা চরিত্রকে দিনের শাদা আলোয় দেখার ভান কেন করব!
পুলিশের ভয় নেই শুনে ম্যাগি ফের ম্যাক্সি তুলে বুকের কাছে রাখে। বলে, ‘‘পুলিশে খুব ভয় গো বাবু। পোঁদ দিয়ে কোনও মরদের বাঁড়া নয়, পুলিশের ডান্ডা ঢুকেছিল পেত্থম।’’ বলে উপুড় হয়ে শোয়। ইশারা স্পষ্ট। আমি তবু পাশে চুপ করেই শুয়ে থাকি। নিজেই বলতে থাকে, ‘‘পুলিশ মানে তো দেশ গো বাবু? আমাকে তাইলে কোনও মরদের বাচ্চা নয়, এই দেশটা চুদেছিল বলো?’’ ব্যাগ হাতড়ে ভোটের কার্ড বের করে খিলখিল হাসতে থাকে ম্যাগি। ‘‘এনআরসি হলে আমাকে কুথায় পাঠাবে গো বাবু? এই দেশে, না ওই দেশে? নাকি বর্ডারকে এক্কেবারে বর্ডারের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেবে গো? আমি ট্রাফিক পুলিশের মতো নাকি কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকব সেখেনে। বাংলাদেশের মরদ এসে আমার একদিকের বুক টিপবে, আর ইন্ডিয়ার মরদ এসে আরেকদিকের বুক টিপবে। হেব্বি মজা হবে গো বাবু।’’
ম্যাগির কথা যে এভাবে সত্য হবে ভাবিনি। গোটা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে এনআরসি হলে দেখা যায়, তাতে শেষতম নাম ম্যাগি ওরফে বর্ডারের। ম্যাগিকে সীমান্তে পাঠানো হয়। বিডন স্ট্রিটে রাস্তার মুখে যে বাচ্চাটার জন্ম দিয়েছিল ম্যাগি, সেটা মেয়ে ছিল। তার কোনও খোঁজ আমি পাইনি। শুনেছি পরেও ম্যাগির আরও বাচ্চা হয়েছে। তারা কোথায়, কীভাবে এখন, তা-ও জানতে পারিনি। ম্যাগি এখন ফুলবাড়ি বর্ডারে র্যা ডক্লিফ লাইনে দাঁড়িয়ে পাখি তাড়ায়। ও বাংলার দোয়েলের সঙ্গে যেন এ বাংলার ফিঙের দেখা না হয়।
অলঙ্করণ: বৈশালী
লেখক পরিচিতি:
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের অন্যতম কবি, গদ্যকার, গল্প লেখক ও ঔপন্যাসিক। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘২০ মিনিটের জন্য সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়’। প্রথম উপন্যাস ‘বঙ্কিমচন্দ্র’। পেশায় সাংবাদিক। বসবাস ভারতের উত্তরবঙ্গে।