আজ রবিবার, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

এ পথেই তুমি…

কবিতা সিরিজ

।। স্বাগতা দাশগুপ্ত ।।




আস্ত একটা ফুল, কাচবাক্সে

তোমার জন্য কোনও মালা হয় না। তুমি নিজেই একটা আস্ত ফুল। টুকটুক করে চলে যাও কাচের গাড়িতে চড়ে। আমাকে একটু বসতে দাও তোমার কাঁচবাক্সে। একটুখানি। আমি কাঁদব না, মা। আমি কি আর অত ছোট আছি যে সব্বার সামনে কাঁদব! চুপ করে বসে থাকব তোমার যে হাঁটুতে ব্যথা ছিল তার পাশে আমার গাল রেখে। আমার গায়ের গন্ধ তোমার গা বেয়ে বেয়ে উঠে যাবে তোমার মনে। তোমার মন কোথায় মা? আমাদের ভাড়া বাড়ির সিঁড়ির পাশের গন্ধরাজ গাছটায় ঝুলিয়ে রেখে এসেছিলে না? বালি সুড়কি জমে জমে যে গাছে ফুল হোতো না কোনোদিন। কিন্তু আমরা চলে আসার সময় হঠাত একঝাঁক ফুল দিয়েছিল। গন্ধে গন্ধে ভরে গেছিল বারান্দার চৌকিটা… আর তোমার মন ডগমগ করে দোল খাচ্ছিল সুঁটকে গাছটায়। আমরা চলে আসার পর কে তোমার যত্ন করেছিল জানি না। পরের ভাড়াটেদের গাছটাছের শখ ছিল কিনা কে জানে! হয়তো বা ছিল ওই রুনুর বাবার। তখন পরপুরুষের আদর তোমার ভাল্লাগতো? নাকি তোমার মন তখন হাওয়ার ধাক্কায় উড়ে গিয়ে পড়েছে ওই কোণের বাড়িটার ভাড়ার ঘরে। তারপর পাক খাচ্ছে কালি পড়া স্টোভটার চারপাশে। ওখানে তোমার ভাল্লাগবে না, জানি। ওদের বাড়িতে ঝগড়া চলে সারাদিন। ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে এ ওকে গালমন্দ করে। তার চেয়ে শিবমন্দিরের পাশের পুকুরপাড় তোমার জন্য ভালো। একটু পিছল হলেও ওখানে অন্যপাড়ার ছেলেরা ভোর-ভোর চানে আসে মা। ওদের দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ো। দেখো, ওরা সাড়া দেবে…


এই পথেই?

২৪ নম্বর এস. এম. বোস রোড। জীবন বুঝি এখান দিয়েই বয়ে গ্যাছে? উঠতি কচিকাঁচাগুলো সাইকেল চড়ে কলকল করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। সাবধান হচ্ছে ফুচকার গাড়ি। মাঠ থেকে মাঝেমাঝেই লাফ দিচ্ছে ফুটবল, আঢাকা নর্দমায়। উঠে গিয়ে ভেঙে দিচ্ছে কাদের বাড়ির কাঁচ। সূর্য ডোবার আগে দু’মিনিট দাঁড়িয়ে দেখে নিচ্ছে ওদের।

এই পথেই তুমি চলে গেছিলে। কাচের গাড়িতে চড়ে। একটা ঝলমলে সকালে…


কল্পকামত্রিভূজ

আজ সেই আগুনের কাছে এ কথা বলার। যে আগুন সব নেবে একদিন। যদি নাভি পড়ে থাকে অদাহ্য, তবে তার কাছে এ কথা বলার। কিংবা সেই মাটি। যে একদিন মিশিয়ে নেবে সব। তুমি বলেছিলে, জীবনে যা সম্ভব হলো না, তা যদি লেখাতেও না হয় তো কী! যদি কল্পনাতেও না হয়। তার চলে যাওয়ার কয়েকমাস পর আমরা আশ্চর্য কল্পনার মধ্যে জ্বালিয়ে রেখেছিলাম তার উপস্থিতি। গভীর রাতে আমরা একটা হাত বাড়িয়ে দিতাম পরস্পরের দিকে। কল্পনার হাত। অপর হাতে আমরা তুলে এনেছিলাম আমার মৃতা জননীকে। মৃত শরীর থেকে তার কামগন্ধ মুছে যায়নি। এ জীবনে অতৃপ্ত থাকা প্রতিটা খিদে জ্বলজ্বল করছিল তার হা-মুখে। আর তুমি, আমার আদিম পিতা, আমার সমস্ত অন্ধকার শেষের আলো, তুমি ছাড়া কে পূর্ণ করতে পারে ওই অভুক্ত সরোবর? এমন কল্পনার সঙ্গী আর কে হতে পারে তুমি ছাড়া? কে মেটাতে পারে তার সারা জীবনের লাঞ্ছনা আর অপমানের যন্ত্রণা? এসো, এসো, তুমি মুখ রাখো ওই অগ্নিগর্ভে। প্রবেশ করো। উন্মাদ হও। আমাকেও নাও তোমাদের মিলনপ্রক্রিয়ায়। শুধু সাহায্যকারী নই। আমার ভেতরেও প্রবেশ করো তুমি। পূর্ণ করো এই কল্পকামত্রিভূজ। এ ওকে সাহায্য করছি আমরা, গভীর থেকে গভীরতম সুখে। তুমি ঢেলে দিচ্ছ বীজ প্রাণহীন পিশাচিনীর ভেতর। মৃতা জননীর গর্ভে জন্ম নিচ্ছি আমি, একদিন এইসব কিছু লিখে রাখব বলে…



প্রচ্ছদের নামাঙ্কণ: বৈশালী



স্বাগতা দাশগুপ্ত

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। জন্ম ১৯৮৪ সালে পড়াশুনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায়। বেশ কিছু সময় ইঞ্জিনিয়ারব হিসাবে পেশাজীবী ছিলেন। বর্তমানে শিক্ষকতা করেন। তাঁর কবিতায় নারীবাদের বিশেষ একটি চলন দেখতে পাওয়া যায় দেহ ও প্রেমকে কেন্দ্র করে। কবি অতনু সিংহ পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্যের স্বাধীন চলচ্ছবি ‘প্রিয় মরফিন’-এর অন্যতম অভিনয়শিল্পী হিসাবে তাঁকে দেখা গেছে। তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ ‘জিনস পরী’, ‘কুক্কুরী ও তাহার প্রেমিক’, ‘ওড টু মাই মাদারস জিগোলো’ ইত্যাদি। এখন অবধি প্রকাশিত মোট কাব্যগ্রন্থ ৭টি।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top