আজ মঙ্গলবার, ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

জায়ানিজমের উপমহাদেশীয় সাংস্কৃতিক তর্জমা হিন্দি-হিন্দুত্ব: দু’টি ছায়াছবি

সম্প্রতি বহির্বিশ্বের আকাশ ঢেকে গিয়েছিল যুদ্ধের অগ্নি-ফুলকিতে। তাই আমরা দেখেছি মিসাইলে মিসাইলে আকাশ ঢেকে যাওয়ার দৃশ্য। আমরা গ্লোবাল মিডইয়ায় চোখ রেখে ফের একবার প্রত্যক্ষ করেছি ফিলিস্তিনীয় শিশু-জনতার রক্তখাওয়া নেতা নেতানিয়াহু ও তার পৃষ্ঠপোষক ডোনাল্ড ট্রাম্পের আস্ফালন থেকে বাফুনবৃত্তি… আর দেখেছি, গাজার মজলুম জনতার স্বপক্ষে দাঁড়ানো একজন পারসিক শিয়া ধর্মগুরুর রুহানি চেহারা। দেখেছি, পারস্য জাতির পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের নিরন্ন, নিপীড়িত, আর্ত মানুষের হয়ে ইনসাফ কায়েমের চেষ্টা। পাশাপাশি আমেরিকা, ইওরোপের দাদাগিরি ও আধিপত্যের অবসানের আকাঙ্খায় ও রুশ ঐতিহ্য ধরে রেখে সংগ্রামী ও প্রতিরোধী ইরানের পাশে বন্ধুতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া পুতিন এবং চিরায়ত মার্কিন বিরোধিতা ও একমেরু বিশ্বব্যবস্থার অবসানের লক্ষ্যে আলি খোমাইনি ও পুতিনের পাশে থাকার চৈনিক বার্তা… এভাবেই চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে ইওরো-জায়ানিস্ট-মার্কিনি একমেরু বিশ্বব্যবস্থার বদলে যেতে চলা দৃশ্যের কোলাজ…

এহেন রণ-রক্ত দুনিয়াদারি জারি যখন, ঠিক তখনই ঘরের রঙবাহারি দুনিয়ায় ফের সে শ্বাপদের চেহারা স্পষ্ট। যেভাবে জায়ানিস্ট সেটেলররা ফিলিস্তিনের ইতিহাস, জনবন্দ্যোবস্ত, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দাউদ তারার প্রতীক সম্বলিত পতাকায় লুঠ করেছে ভূমি, জানমালী, ভাষা, কলা, কৃষ্টি ও রুহানি পরিসর, যেভাবে তারা খুন করেছে দায়, দরদ, শৈশব, যৌবন-সহ ফিলিস্তিনি গণমানুষের জীবন, ঠিক সেভাবেই বৃহৎ বঙ্গকে বহুকাল ধরে লুঠ করতে চাওয়া হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্ববাদের সঙ্ঘি (আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ) বয়ান ও তাদের ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম নতুন করে সামনে আসছে। সেই সেন আমল থেকে বৃহৎ বঙ্গকে উচ্চবর্ণের সেটেলাররা দখলের চেষ্টা চালালেও তা ঔপনিবেশিক আমলে অনেকাংশে কার্যকরী হয় আধুনিক হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দি-হিন্দু জাতিবাদের বদৌলতে। এবং ক্রমে তা মৃদুগতিতে আগ্রাসী চেহারা নিতে শুরু করে। ২০২৪ সালে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির দ্বিতীয় পর্বের শাসনকাল শুরু হওয়ার পর থেকে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের হাত ধরে এই আগ্রাসী চেহারা প্রায় সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। এবং সমসাময়িক পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যকে একদিকে যেমন লুঠ করতে মরিয়া, ঠিক সেভাবেই বৃহৎ বঙ্গের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে নিকেষ করে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি জাতিবাদকে উপমহাদেশব্যাপী কায়েম করার প্রয়াস ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে।

আসলে জায়ানিজম ও হিন্দুত্ববাদের মধ্যে বিরাট সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মিল। সেকারণেই বিজেপি এখন সরাসরি ইজরায়েলের সমর্থক। এমনকী ভারতের পররাষ্ট্রীয় বা বৈদেশিক নীতির ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে ইজরায়েলের পক্ষ নিয়েছে দিল্লির ইউনিয়ন সরকার। ফিলিস্তিনকে যেভাবে জায়ানিস্ট সেটেলাররা দখল করেছে, সেভাবে বৃহৎ বঙ্গকে দখল করতে চেয়েছে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি রাজনীতি। জায়ানিস্টরা যেভাবে ফিলিস্তিনিয়দের ভূমিতে বসবাস করেও ফিলিস্তিনীয়-সহ আরব জাতিসমূহকে ঘৃণার চোখে দেখে, পাশাপাশি পোষণ করে ইসলামবিদ্বেষ, ছড়িয়ে দেয় সেই ইসলামোফোবিয়ার সাংস্কৃতিক ঘৃণার রাজনীতি দুনিয়াব্যাপী, সেভাবেই সেন আমল থেকে ভূমিমানুষের বঙ্গে উচ্চবর্ণের সেটেলারদের সম্প্রসারণ ঘটেছে, সেভাবেই উত্তর উপনিবেশিক সময়কালে পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে থাকা বৃহৎ বঙ্গের প্রদেশগুলি আস্তে আস্তে সেটেলর হিন্দি-হিন্দুত্বের জনপরিসরের দখলে চলে গিয়েছে বা যাচ্ছে। যেভাবে জায়ানিস্টরা ইহুদি জাতিবাদের রেসিস্ট সুপ্রিমেসির প্রচার চালায়, সেভাবেই বর্ণহিন্দুত্বের সুপ্রিমেসি তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্য কায়েম করতে চায় হিন্দি-হিন্দুত্বের রাজনীতির। বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তের জাতিবাদী ইহুদীদের জড়ো করে ফিলিস্তিনে নিয়ে এসে জায়ানিস্টরা যেভাবে রাষ্ট্রগঠন করেছিল এবং ফিলিস্তিনীয়দের করে তুলেছিল ‘অপর’, সেভাবেই হিন্দি-হিন্দুত্বের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরায় বাঙালি তথা বাংলাভাষীদের ‘অপর’ করে তুলতে মরিয়া। যেভাবে অ্যান্টি-সেমেটিক হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও সংগঠনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ায় জায়ানিস্টরা, সেভাবেই ‘সনাতন বিরোধী’ ট্যাগ দিয়ে একইরকম বিদ্বেষের রাজনীতি চালায় হিন্দুত্ববাদীরা। এছাড়া জায়ানিস্টদের ডেভিড স্টার সিম্বল যেভাবে রাষ্টের পরিধি সম্প্রসারণের পূর্বইঙ্গিত জনমানসের সামনে হাজির করেছে, সেভাবেই উপনিবেশপূর্ব উপমহাদেশের মানচিত্রকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে ‘অখণ্ড ভারত’ প্রোজেক্টকে সামনে আনে হিন্দুত্ববাদীরা। এবং উভয় শক্তিই ইতিহাস বিকৃতি ও বিদ্বেষ সংস্কৃতি প্রচার করে। যেমন ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ ও ‘কেশরী চ্যাপ্টার-২’ নামক দু’টি বলিউডি ছবির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। এই ছবি দু’টিকে ঘিরেই এই আলোচনা।

এরই মাঝে সম্প্রতি দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে দুটি ডিজিটাল বলিউডি হিন্দি সিনেমা নিয়ে শোরগোল পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের কিয়দংশের মানুষের মধ্যে৷ এবং একাংশের সংবাদমাধ্যমেও বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে৷ এই দু’টি ছবির মধ্যে একটি ছবি শারদ উৎসবের সময় মুক্তি পাবে, আরেকটি ছবি ইতোমধ্যেই ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে। এই ছবি দু’টি স্পষ্টতই পশ্চিমবঙ্গ-সহ বৃহৎ বঙ্গের কাছে এক ধরনের কালচারাল থ্রেট! কারণ, আজকের পশ্চিমবঙ্গ-সহ অতীতের অখণ্ড বাংলা ও বিদ্যমান বড় বাংলার সামাজিক বিন্যাস, ইতিহাস ও সমসাময়িকতাকে সম্পূর্ণ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে দু’টি হিন্দি ছবিতে৷ না, কেবল বিকৃতিই নয়৷ বরং বঙ্গের অস্তিত্বকেই অনেকাংশে খারিজ করার চেষ্টা হয়েছে ছবি দু’টিতে। যদিও এ নিয়ে কলকাতার কয়েকটি গোষ্ঠীর সামান্য প্রতিবাদ, সমাজমাধ্যমে গুটিকয়েক মানুষের লেখালেখি ও গুটিকয়েক পশ্চিমবঙ্গীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া ব্যাতীত বৃহৎ পরিসরে কোনো বিক্ষোভ, প্রতিবাদ এখনও অবধি সংগঠিত হয়নি৷ হবে কি না তা নিয়ে ঢেড় সন্দেহ আছে৷ কেননা আত্মবিস্মৃতি ও নিজসত্তা সম্পর্কে অজ্ঞানতা। এই অজ্ঞানতাই গ্রাস করেছে যেভাবে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরু বাঙালি হিন্দুকে, তাতে অবলীলায় বাংলার স্মৃতি-সত্তা ও ভবিষ্যৎ লুঠ হয়ে যাওয়াটাই পরিণতি হয়তো-বা৷ এসব প্রসঙ্গে আরও কিছু কথায় আসছি৷ আসছি শিকড় ধরে নাড়া দিয়ে তার কালিক পরিণতিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার বিষয়েও৷ ক্লোরফর্মে নিমজ্জিত অনন্ত শৈত্যঘুমে কালকাটানো পশ্চিমবঙ্গীয় অধিবাসী বাবু বাঙালির মৃদু গাত্রে চিমটি কেটে নিদ্রাভঙ্গের চেষ্টাতেও এবারেও কোনো খামতি থাকবে না ইনশাল্লাহ৷ যদিও সব কিছু নষ্টদের দখলে চলে যাওয়া পরিসরে, রামহানাদারদের সামনে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, প্রজ্ঞা, সমাজবোধকে বিকিয়ে দেওয়া মধ্যমেধার জনপরিসরে এই চেষ্টাও যে ব্যর্থ হবে তা ভালোই জানি৷ তবু কিছু কথা সময়ের দলিলে তো লিখে রাখতেই হয়৷ যাতে ভাবীকাল উদাসীনতার অভিযোগ না আনতে পারে৷ যাইহোক, প্রথমে দুটি ছবির কথা গোটা বিশ্বের তিরিশ কোটি বাঙালি ও বাংলাভাষীকে অবগত করতে উল্লেখ করে, বাকি আলাপের বিস্তারে অগ্রসর হচ্ছি।

জালিওয়ানাবাগ গণহত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকাল ও ব্রিটিশ বিরোধী স্ট্রাগলকে উপজীব্য করে করণ সিং ত্যাগী নামে এক বলিউডি পরিচালক নির্মাণ করেছেন ‘কেশরী চ্যাপ্টার-২’ নামে একটি কাহিনীচিত্র। মুখ্য অভিনয়ে রয়েছেন অক্ষয় কুমার, অনন্যা পাণ্ডে ও আর মহাদেবন প্রমুখ। এই ছবিতে একটি জায়গায় দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের বাংলার বীর ক্ষুদিরাম বসুকে ক্ষুদিরাম সিং হিসাবে পরিচয় দিতে। এমনকী ক্ষুদিরামের সহযোদ্ধা প্রফুল্ল চাকীর নাম হয়েছে শুধু বীরেন্দ্র সিং। আর বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, সাপ্তাহিক ‘যুগান্তর’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা, অরবিন্দ ঘোষের দাদা, তাঁকে এই ছবিতে বলা হচ্ছে বারীণ কুমার! আর ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল চাকীর হাতে যিনি বোমা তুলে দিয়েছিলেন, সেই হেমচন্দ্র কানুনগোর নাম হয়েছে কৃপাল সিং। ছবিতে এই কৃপাল সিংই নাকি নায়ক! কিন্তু বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগোর নাম পরিবর্তন করে যে নাম দেওয়া হয়েছে এই ছবিতে, সেই কৃপাল সিং নামেও ইতিহাসে এক নেতিবাচক অর্থ গুরুত্বপূর্ণ এক ব‌্যক্তি রয়েছে্‌ন। ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের একজন মোনাফেক, বিশ্বাসঘাতক, যিনি বাঙালি বিপ্লবীদের পরিকল্পনার কথা ফাঁস করেছেন বিট্রিশ শাসকের কাছে, ইতিহাাসের তেমনই এক গদ্দার কৃপাল সিং। ইতিহাস স্মরণ করলে দেখা যায়, রাসবিহারী বসুর সহযোগিতায় জার্মানি থেকে অস্ত্র আমদানি করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তার তথ্য কৃপাল সিংয়ের কারণেই ব্রিটিশদের কাছে ফাঁস হয়েছিল। যার জেরে অস্ত্রবোঝাই জাহাজ শুধু ধরাই পড়েনি, বরং এর পরিণতিতেই বালেশ্বরে বুড়ি বালামের যুদ্ধে শহিদ হতে হয় বাঘাযতীনকে। গ্রেফতার হতে হয় শচীন সান্যালকে। তো একদিকে বাঙালি বিপ্লবীদের নামের পদবি বিকৃত করে তাদের হিন্দুস্তানি ও বিহারী বানানোর চেষ্টা, অন্যদিকে এক বাঙালি বিপ্লবীর নামকে মুছে তাঁর ওপর নাম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের একজন বিশ্বাসঘাতকের। অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতককে দেশপ্রেমিক বানানো এবং বিপ্লবীর নামকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া, এই হচ্ছে এ ছবির ‘মহিমা’! এই ছবির আধার করণ সিং ত্যাগী ও অমৃত পাল সিং বিন্দ্রা রচিত ‘দ্য কেস দ্যাট শুক দ্য এম্পারার বাই রঘু পালাত অ্যান্ড পুষ্পা পালাত’ বইটি। ছবিটি তৈরি হয়েছে, জালিওয়ানাবাগ হত্যাকাণ্ডের ১০৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে। আগে আমরা দেখেছি, ভারত সরকার কর্তৃক আন্দামানের সেলুলার জেলে বাঙালি বিপ্লবীদের স্মৃতি ধ্বংস করতে। অথচ আন্দামানের সেলুলার জেলে সবচেয়ে বেশি বন্দি ছিলেন বাংলার বিপ্লবীরাই। ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই বাংলার হিন্দু-মুসলমানের অবদানই তো সবচেয়ে বেশি। আর যে সাভারকর ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দিয়ে কারাবাস থেকে মুক্ত হয়েছিসেন, যে সাভারকার ব্রিটিশ বিরোধী স্ট্রাগেলকে ভিতর থেকে খারিজ করতে হিন্দুত্ববাদের বিষ বপন করেছিলেন, তাঁকেই ‘বীর’ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে মোদিফায়েড ভারতের সর্বত্র।

এ তো গেল বাংলার ব্রিটিশ বিরোধী ইতিহাস বিকৃতির নমুনা। এবার দ্বিতীয় ছবিটির কথা উল্লেখ করতে হয়, যেটি আরও মারাত্মক, বাংলা সম্পর্কে মারাত্মক অপপ্রচারের পরিপূর্ণ। শুধু তাই নয়, ট্রেলার দেখা স্পষ্ট হচ্ছে বঙ্গের অসাম্প্রদায়িক ও সামাজিক সহাবস্থানের চরিত্রকে কলুষিত করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়িয়ে দেওয়াই এই ছবির বৈশিষ্ট্য। এর আগে ‘কাশ্মীর ফাইলস’ তৈরি করে ঠিক যে কায়দায় কাশ্মীরের জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে খর্ব করার চেষ্টায় সেখানকার ইতিহাস ও সামাজিক বিন্যাসকে বিকৃত করা হয়েছিল, ঠিক সে কায়দাতেই বলিউডি স্ক্রিনে তৈরি হওয়া সেই বিকৃত ‘কাশ্মীর’-এর সঙ্গে এবার তুলনা টানা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের। জ্বী হ্যাঁ কথা হচ্ছে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে। ট্রেলারের শুরুতেই ভয়েস ওভারে বলতে শোনা যায়, “আমি একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত, তাই হলফ করে বলতে পারি যে বাংলা আরেকটা কাশ্মীর হতে চলেছে। কেন স্বাধীনতার ৮০ বছর পরেও আমাদের সেই একই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে! সত্যিই কি আমরা স্বাধীন হয়েছি?” এরপর ছবির ট্রেলার দেখে বোঝা যাচ্ছে, ছবিতে ‘সেই একই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’র কথা বলতে পরিচালক মুসলিম পরিচয়বাদী রাজনীতির কথা বুঝিয়েছেন। এবং হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস থেকে শুরু করে কংগ্রেসের রাইট উইং অংশ-সহ হিন্দি-হিন্দুত্বের রাজনীতি কথিত ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’ ও পাকিস্তান আন্দোলনের সময়কার উত্তপ্ত কলকাতার কথা বোঝানো হয়েছে। আর হিন্দুত্ববাদীদের তৈরি হিস্টোরিক্যাল ন্যারেটিভের রেফারেন্স টেনে বলা হচ্ছে আজকের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিও লাকি মুসলিম লীগের জাতিবাদী রাজনীতির লিগ্যাসি বহন করছে এবং আজও কলকাতা-কেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গে ‘হিন্দু খঁতরে মে হ্যায়!’ ছবিটি উঠে এসেছে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ও নোয়াখালি দাঙ্গা। ফলে এই ছবিতে অথণ্ড বাংলা ও ব্রিটিশ ভারতের বেশ কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র রয়েছে। যেমন, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ, শহিদ হোসেইন সোহরাওয়ার্দী থেকে ছেচল্লিশের গোপাল পাঁঠা (যাকে আমরা ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে একজন কুখ্যাত হিন্দু্ত্ববাদী সন্ত্রাসী হিসাবে চিনি)। এই ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে জলন্ত দুর্গাপ্রতিমাকে। ছবিতে ভারতী বলেও একটি চরিত্র রয়েছে। চরিত্রটি রূপায়িত হয়েছে হিন্দুত্ববাদীদের তৈরি ‘ভারত মাতা’র ‘আইকন’কে সামনে রেখে। এর আগে ‘দ্য তাসখন্দ ফাইলস’ ও ‘কাশ্মীর ফাইলস’ নামে দুটি ছবি করেছেন এই ছবির নির্মাতা বিবেকরঞ্জন অগ্নিহোত্রী। সেই সিক্যুয়েলেই এবার ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’। দেখা যাচ্ছে এই ছবিতে অভিনয় করেছেন মিঠুন চক্রবর্তী (যিনি এখন বিজেপি নেতা), শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, সৌরভ দাস, অনুপম খের, পল্লবী যোশী প্রমুখ। এই ছবির প্রচারে বলা হচ্ছে, ‘যদি কাশ্মীর আপনাকে দুঃখ দিয়ে থাকে, তাহলে বাংলা আপনাকে তাড়া করবে।’

বেঙ্গল ফাইলস ছবির পোস্টারে জলন্ত দুর্গাপ্রতিমা

এক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে বলা দরকার, ১৯৪০-এর দশককে নিজেদের মতো করে তুলে ধরে ইতিহাস বিকৃতি যে হিন্দুত্ববাদের গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডা মেশিনারি করবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কলকাতার ভদ্রবিত্তের তথাকথিত ‘সেক্যুলার’ রাজনীতিও তো হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বয়ানকেই ইতিহাস বলে অনেকাংশেই প্রচার করে। তাই সোহরাওয়ার্দীকে কলকাতাকেন্দ্রিক বঙ্গের ইতিহাসচর্চা ‘ভিলেন’ হিসাবে দেখায়। এক্ষেত্রে আবারও পাকিস্তান আন্দোলনের কথা উল্লেখযোগ্য। বাবু বর্ণহিন্দু বাঙালি ও ভারতীয় জাতিবাদীদের একক আধিপত্যের বিরুদ্ধে যে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল, তা হিন্দু জাতিবাদের পালটা উত্তর ভারতীয় মুসলমানের পরিচয়বাদী প্রস্তাব যতটা না ছিল, তার চেয়েও বড়ভাবে হাজির হয়েছিল বাংলার ভূমিহীন বাঙালি কৃষকের শ্রেণীভাষ্য ও শ্রেণীর ক্ষমতায়ণ হিসাবে। বাংলার ভূমিহীন কৃষকের বড় অংশই ছিল বাঙালি মুসলিম ও বাঙালি নমঃশূদ্র, তারা হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার, শোষণ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন থেকে থেকে মুক্তি পেতেই পাকিস্তান প্রস্তাবে সায় দিয়েছিল বাধ্য হয়েই। কিন্তু সম্পূর্ণভাবেও নয়। কেননা, পাকিস্তান প্রস্তাবের পাশাপাশিই ভারত ও পাকিস্তানের সমান্তরালে যুক্ত-বাংলা রাষ্ট্র প্রস্তাব পেশ হয়েছিল বাংলার আইনসভায়। পেশ করেছিলেন শহিদ হোসেইন, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রায়। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও তাঁর বেঙ্গল প্যাক্টের রাজনৈতিক উত্তরসূরী। ভারত-পাকিস্তানের সমান্তরালে স্বাধীন, সমাজতান্ত্রিক বাংলা রাষ্ট্র গঠনের এই প্রস্তাবে সায় দিয়েছিল গোটা বাঙালি মুসলিম সমাজ ও বাঙালি নমঃশূদ্র সমাজ। কিন্তু বর্ণহিন্দু বাঙালিদের বড় অংশ ও তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় হিন্দু মহাসভা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল চরমভাবে। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের সমর্থন দিয়েছিলেন যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, তিনি ফের চরমভাবে এই প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেন। এবং প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়ান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল বা আরএসপি বাদে অন্য কমিউনিস্ট পার্টি-সহ অন্য কোনো কাস্তে-হাতুড়িওয়ালাদেরও এই প্রস্তাবের পক্ষে সায় দিতে দেখা যায়নি। একমাত্র অ-স্তালিনীয় বামপন্থী শিবির আরএসপি সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বোসদের পক্ষে সায় দিয়েছিল। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় সোহরাওয়ার্দীকে এক তরফা দায়ী করেন কলকাতার বাবু প্রগতীবাদী সমাজ। অথচ সোহরাওয়ার্দী কলকাতার লালবাজারের কন্ট্রোল রুমে বসে দাঙ্গা থামানোর সবরকম চেষ্টা করেন। পুলিশ ব্রিটিশের যেহেতু, সোহরাওয়ার্দী তাই ফেইল করেছিলেন বলা যায়। ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাকও হিন্দু নিধনের জন্য দেওয়া হয় নাই। বরং প্রত্যক্ষ সক্রিয়তার স্লোগান ছিল ব্রিটিশ বিরোধী এবং কংগ্রেস বিরোধী রাজনৈতিক স্লোগান এবং তা হিংসাকে উস্কে দেওয়ার জন্যে ছিল না। কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী অংশ, হিন্দু মহাসভা, হিন্দুস্তানি ও বিহারী মুসলিমদের বড় অংশ এবং সুভাষের মতাদর্শ থেকে চ্যুত ফরোয়ার্ড ব্লকের দক্ষিণপন্থী অংশের দ্বারাই দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করে। এছাড়া, ছেচল্লিশের এই ঘটনা, পাকিস্তান প্রস্তাব এগুলো নিয়ে আলাপের আগে মাথায় রাখা উচিত বিড়লা গোষ্ঠী, জোতদার-জমিদার এবং অতি অবশ্যই ব্রিটিশ প্রভুদের সৌজন্যে বঙ্গে ঘটে যাওয়া তেতাল্লিশের মন্বন্তুরের প্রসঙ্গও। 

১৯৪৬, দাঙ্গাবিধ্বস্থ কলকাতা ও ইনসেটে হিন্দু সন্ত্রাসী গোপাল মুখোপাধ্যায় ওরফে গোপাল পাঁঠা।

১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ এই কালপর্বে বাংলার দুর্ভিক্ষ ও দাঙ্গাকে ঘিরে কাজ রয়েছে বিশিষ্ট গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক জনম মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর বই ‘হাংরি বেঙ্গল’-এ এই সময়কালকে তিনি পুঙ্খানপুঙ্খ তুলে ধরেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনমের পোস্ট ডক্টরাল থিসিস ছিল এই ‘হাংরি বেঙ্গল’, যেটি পরে বই হিসাবে প্রকাশিত। সম্প্রতি ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জনম বলছেন, ‘‘আসলে সোহরাওয়ার্দী সে সময় চিফ মিনিস্টার হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে, ১৬ আগস্ট সব বন্ধ থাকবে, কারণ ডেমনস্ট্রেশন হবে। তখন হিন্দু মহাসভা বলছিল, এই কর্মসূচি তো মুসলিম লিগের ব্যাপার, এটা সরকারি ব্যাপার নয় যে সোহরাওয়ার্দী হরতাল ঘোষণা করে দেবেন। আসলে সোহরাওয়ার্দীর চিন্তা ছিল যে হিংসার ঘটনা ঘটতে পারে, সেই কারণেই হরতাল। তো সেই ১৬ আগস্ট সকাল থেকেই চারদিক থেকে মুসলমানরা ময়দানের দিকে যাচ্ছিল। আর অন্যদিকে হিন্দু মহাসভা হরতালের বিরোধিতা করার জন্য সব দোকানপাট খোলানোর চেষ্টা করছিল। কাজেই সেদিন সকাল থেকেই মারামারি বেধে গেল। মুসলমানরা যখন মিছিল করে যাচ্ছিল, তখন তারা দেখতে পাচ্ছে যে পাড়ায় পাড়ায় লোকে হরতাল মানছে না। তাছাড়া হিন্দু পাড়া দিয়ে যখন মুসলমানরা মিছিল করে যাচ্ছিল, তখন কিছু কিছু হিন্দু বাড়ির ছাদ থেকে তাদের উপর ইট ছোড়া হচ্ছিল। এইসব কারণেই বলছি যে এই দাঙ্গার সঙ্গে দুর্ভিক্ষের সম্পর্ক আছে। কারণ লোকের মানসিকতাটাই হয়ে গিয়েছিল টেরিটোরিয়াল। আসলে শুরুতে হিংসার উপলক্ষ্যটা ছিল এই যে, ওরা আমাদের পাড়ায় আসছে। একদিকে ময়দানের মতো একটা বিরাট পাবলিক স্পেস, সেখানে হয়তো প্রায় দু’ লক্ষ কি আরও বেশি লোক জমজমায়েত  হয়েছে, তাই ময়দান সেদিন ভরতি হয়ে গিয়েছিল। আবার অন্যদিকে সেদিন সকাল থেকে হাসপাতালও ভরতি হয়ে গিয়েছিল— হিন্দু, মুসলমান দু’পক্ষই আহত হয়ে হাসপাতালে আসছিল। তারপর যখন ময়দানে মিটিং হচ্ছে, ততক্ষণে একটা গুজব রটে গিয়েছিল যে বিভিন্ন জায়গায় হিংসার ঘটনা ঘটেছে— মুসলমানরা মিছিল করে ময়দানের সভায় যাওয়ার সময় তাদের উপর ইট ফেলা হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় মারামারি হয়েছে ইত্যাদি। গোটা মিটিং জুড়ে সেইসব গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল। তারপর মিটিং শেষ হওয়ার পর লোকে যখন ফিরছিল, তখন দাঙ্গা আরও বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ মুসলমানরা যখন মিছিল করে বাড়ি ফিরছে, ততক্ষণে চারিদিকে সংঘর্ষ হচ্ছে— ভবানীপুর, মানিকতলা, এসপ্ল্যানেড, কলেজস্ট্রিট, টালিগঞ্জ, গার্ডেনরিচ, মোমিনপুর, খিদিরপুর— সর্বত্র দাঙ্গা বেধে গিয়েছিল। অনেকের মধ্যেই একটা ধারণা আছে যে সোহরাওয়ার্দী একটা চক্রান্ত করেছিলেন, তিনিই পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ইত্যাদি। কিন্তু আসলে সেদিন খুব অল্প সময়ের মধ্যে গোটা কলকাতা জুড়ে একটা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটেছিল। সর্বত্র প্রবল অ্যানার্কি, চারিদিকে লুঠপাট হচ্ছে— ব্রিটিশদের দফতরে, সোনার দোকানে, রেশন দোকানে। এসব লুঠপাটের মধ্যে কিন্তু কোনো সাম্প্রদায়িক ব্যাপার ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশরা তাদের নিজেদের এলাকাগুলো প্রাণপণে রক্ষা করছিল। একটা এমার্জেন্সি প্ল্যান স্কিম করা হয়েছিল। লোকে সেনট্রাল ব্যাংক লুঠ করতে গিয়েছিল, স্টেট্‌সম্যান বিলডিংয়ের দরজা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, গ্র্যান্ড হোটেলেও হামলা হয়েছিল। এইসব জায়গা কিন্তু ব্রিটিশরা সফলভাবে রক্ষা করতে পেরেছিল। সোহরাওয়ার্দী ময়দানের জমায়েতের আগেই গভর্নরকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, চারদিকে এসব ঘটনা ঘটছে, কোথাও আইন-শৃঙ্খলা নেই। তিনি সেনা ডাকতে চেয়েছিলেন। লোকে বলে যে সোহরাওয়ার্দী-ই সেনা ডাকতে রাজি ছিলেন না। সেটা একেবারেই সত্যি নয়, সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিলেন সেনা নামানো হোক। কারণ তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে, কলকাতার উপর তাঁর বা তাঁর সরকারের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। আর এ ধারণাও ঠিক নয় যে তিনি পুলিশ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। পুলিশ বাহিনী তখন সরাসরি হামলা মুখে পড়েছিল। সরকারি দলিল থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, সেনাবাহিনী নিজেই আসতে চায়নি, কারণ তারা জানত যে তারা রাস্তায় নামলে তারাই দাঙ্গার নিশানা হয়ে উঠবে। কাজেই দাঙ্গা যতক্ষণ বাঙালিদের মধ্যে, ভারতীয়দের সীমাবদ্ধ থাকবে, ততক্ষণ তারা সে অবস্থা খুশিমনেই মেনে নেবে। তারপর যত দিন যেতে লাগল, ক্রমশ ঘটনাটা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার চেহারা নিল। প্রথম দিকে কিন্তু হিংসাটা ছিল নৈরাজ্যের হিংসা, অর্থনৈতিক হিংসা, লুঠপাটের ব্যাপারটা ছিল এই হিংসার একটা বড় অংশ। তারপর ১৬ আগস্টের পরের দিন থেকে সেটা ক্রমশ সাম্প্রদায়িক দিতে চলে যেতে লাগল। আস্তে আস্তে মুসলমানরাও দল পাকাচ্ছিল, হিন্দুরাও দল পাকাচ্ছিল। কাজেই পুরো জিনিসটা একটা গণহত্যার চেহারা নিয়েছিল। কিন্তু যদি ব্রিটিশরা এতটা সাবধানি না হত, তারা যদি রাস্তায় সেনা নামাত, তাহলে খুব সম্ভবত তারাই হয়ে উঠত মানুষের আক্রমণের প্রধান নিশানা। তার কারণ, ৪৩-এর দুর্ভিক্ষের মতো ঘটনায় মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল। তারা সেই অবস্থাটার জন্য মুখিয়ে ছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের তো কলকাতায় তাদের জায়গাটা ধরে রাখতে হত। অন্যদিকে মানুষের মধ্যে এত চাপা রাগ ছিল, ক্ষোভ ছিল, যে সেটাই নৈরাজ্য হয়ে আছড়ে পড়েছিল। সেই ক্ষোভটা ব্রিটিশদের দিকে চালিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তাকে সফলভাবে প্রতিহত করা হয়েছিল। কাজেই কলকাতা তখন ফুটছিল। এই যে হিংসাটা শেষমেশ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে হিংসার ভয়াবহ চেহারা নিয়েছিল, তার পিছনে সোহরাওয়ার্দীর মোটেই কোনো হাত ছিল না। এমনকী ডিরেক্ট অ্যাকশন কর্মসূচিও এই হিংসার খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ নয়। কলকাতায় টেরিটোরিকে কেন্দ্র করে যে মানসিকতা তৈরি হয়েছিল, এই হিংসা ছিল তারই প্রত্যক্ষ ফল। তাই এই হিংসা অনেকাংশেই টেরিটোরিয়াল প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেহারা নিয়েছিল— বিশেষ করে পাঁচমেশালি পাড়াগুলোতে। যে সমস্ত পাড়ায় হিন্দু-মুসলমানের অনুপাত প্রায় ৫০:৫০, সেখানে প্রচুর বাড়ি পোড়ানোর ঘটনা ঘটছিল। মুসলমানরা হিন্দুদের পাড়াছাড়া করতে চাইছে, তাহলে তারা সেই এলাকাটাকে কলকাতা শহরে নিজেদের এলাকা বলে দাবি করতে পারবে। তারা ভাবছিল যে, এটাই পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ; তারা যদি এ কাজ করে, তাহলে শহরের মধ্যেই ছোট ছোট জায়গায় পাকিস্তান হবে। কোথাও হিন্দুরা ভাবছিল যে, আমরা যদি মুসলমানদের আমাদের পাড়া থেকে তাড়িয়ে দিতে পারি, তাহলে মুসলমান ‘অপর’-এর হাত থেকে আমরা রক্ষা পাব। তাছাড়া আমার মনে হয়, এই গোটা সময়টা জুড়ে কলকাতায় থাকার, এই শহরে টেরিটোরি দাবি করার যে প্রবল চাপ, এটা তার প্রত্যক্ষ ফলাফল। এই চাপটা তখন হয়ে উঠেছিল জীবন-মরণের প্রশ্ন। তাই হিংসার একটা বড় অংশের লক্ষ্য ছিল স্থাবর সম্পত্তি— ঘরবাড়ি পোড়ানোর ঘটনা প্রচুর পরিমাণে ঘটেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল অন্য সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ধ্বংস করা— যাতে তাদের উচ্ছেদ করা যায় এবং সেই সম্পত্তি দখল করে নেওয়া যায়। কাজেই এই দাঙ্গার পিছনে গভীর সাম্প্রদায়িক ঘৃণা নির্মাণের প্রক্রিয়া নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু তার পাশাপাশি দাঙ্গা হওয়ার পিছনে আরও বিভিন্ন কারণ ছিল। সেসব কারণের কথা আমরা জানতে পারি না।’’ (পড়ুন- মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ ও বাংলাভাগ প্রসঙ্গে)।

গান্ধীজীর সঙ্গে বৈঠক সোহরাওয়ার্দী।

শুধু জনম নয়, জয়া চট্টোপাধ্যায়দের মতো ঐতিহাসিকও দেখিয়েছেন, বাংলা ভাগ ও তাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করা পিছনে মুসলিম লীগ ও সোহরাওয়ার্দীর ঘাড়ে যে দায় চাপানো হয়, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। জয়ার ‘Bengal divided (Hindu communalism and partition- 1932-1947)’ বইটি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দেয়। আসলে উপনিবেশবাদের পাশাপাশি উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বাংলায় সম্প্রসারণের যে জাতিবাদী দিল্লি-রাজনীতি, তার জেরেই ভাগ হয়েছিল বাংলা। দিল্লিকেন্দ্রিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তথা হিন্দি-হিন্দু্ত্বের বাংলাকে ভাগ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, ভারতের মধ্যে থেকে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে লুঠ করেছে সাতচল্লিশের পর থেকে। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র সাংবাদিক রণজিৎ রায় তাঁর ‘Agony of Bengal’ বইতে দেখিয়েছেন, কীভাবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্র দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গকে দশকের পর দশক ধরে অর্থনৈতিকভাবে লুঠ করা হয়েছে মাশুল সমীকরণের ও রাজস্ব পূর্ণবণ্টনের মতো বিষয়গুলির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক নীতিপ্রণয়নের মাধ্যমেই। এটা চলেছে দশকের পর দশক। পরে বাম ও তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রের এনডিএ ও ইউপিএ সরকারের অংশীদার হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কিছু কাজ করলেও শিল্পে, কৃষিতে এ রাজ্যের পুনর্গঠনে তারাও অপারগ থেকে যায়, কারণ বাংলাবাদী রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে তখনও মাথা তোলেনি এবং ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বৈমাতৃকসুলভ আচরণের কোনো পরিবর্তন হয়নি ইউনিয়ন সরকারের। তারপরেও একভাবে পশ্চিমবঙ্গ নিজের সমৃদ্ধির উত্তরাধিকার সূত্রেই মাথা তুলে থেকেছে। কিন্তু মোদি-শাহদের রাজনীতি ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার পর থেকে শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গের প্রতি পূর্ণ অর্থনৈতিক বঞ্চনা। এবং পাশপাশি পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক বিন্যাস ও ভারসাম্যকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার প্রয়াস। একইসঙ্গে বাংলাবিদ্বেষ গোটা ভারতে ব্যাপক আকার নিতে শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্দরে থাকা বৃহৎ বঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঈশানবঙ্গকে (অসম) বাঙালিশূন্য করার প্রক্রিয়া। দেখতে পাই এনআরসির মাধ্যমে সেখানকার ১৮ নাক বাঙালির রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার মতো ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম। আমরা থ হয়ে দেখি, নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতো অসমে ডিটেইনশন ক্যাম্প তৈরি করে সেখানে লাখো বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিমদের আটক করে রাখা হয়েছে। অসমের পর এই প্রক্রিয়া পশ্চিমবঙ্গেও চালু করতে উদ্যত ভারত সরকার। সেজন্যই মোদিফায়েড গোয়েবলসীয় মিডিয়া-সহ হিন্দুত্ববাদের প্রতিটি মাউথপিস থেকে লাগাতার প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী নাকি ভরে গিয়েছে! একইভাবে আমরা দেখি বাংলাবিরোধী কার্যক্রমহেতু বাংলাদেশের বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী লীগ সরকারের মাধ্যমে সেখানকার রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টার পাশাপাশি পূবের বাংলার জল-জমি-জঙ্গল দখলের প্রক্রিয়া ২০২৪-এর জুলাই অবধি দিল্লির সরকারকে চালিয়ে যেতে। এবং আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরে পরাজিত ও পলাতক শেখ হাসিনাকে দিল্লির শেল্টারে রেখে দিয়ে বাংকাদেশ সম্পর্কের ভুয়া প্রোপাগান্ডা চালানোর প্রক্রিয়াও একইভাবে পরিলক্ষিত হয়। শুধু তাই নয় ভারতের অন্দরে বাংলাবিদ্বেষ ও ভারতীয় বাঙালি, বাংলাভাষীকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলিম (ভারতীয় নাগরিক) পরি্যায়ী শ্রমিকদের ঘাড় ধরে সীমান্তের ওপারে পুশব্যাক করানোর মতো ঘটনা এখন নিত্যমিত্তিক বিষয় হয়ে উঠেছে।

জনম মুখোপাধ্যায় বিরচিত হাঙরি বেঙ্গল’

সম্প্রতি মুম্বই ও হরিয়ানা থেকে এরকমই কিছু ভারতীয় নাগরিক পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘বাংলাদেশি’ অনুপ্রবেশ হিসাবে দাগিয়ে তাঁদের কাছ থেকে ভারতীয় নাগরিকত্বের যাবতীয় নথি কেড়ে নিয়ে বিএসএফের মাধ্যমে বাংলাদেশে পুশব্যাক করিয়েছে দিল্লির সরকার। এঁদের মধ্যে বেস কয়েকজনকে ফের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে ভারত সরকার। দিল্লির এহেন বীভৎস কারবারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সংগঠিত করে মুসলিমবিদ্বেষ ও হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের খেলাতেও নতুন করে মেতে উঠেছে বিজেপি। বাইরে থেকে লোক ভাড়া করে এনে মুর্শিদাবাদে দু’জন হিন্দুকে খুন করিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সংগঠিত করতে চেয়েছে বিজেপি ও তাদের মিডিয়াসন্ত্রাসীরা। দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা হয়েছে খোদ কলকাতার খিদিরপুর, মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলেও। এসবই করছে হিন্দুত্ববাদীরা। তাদের লক্ষ্য, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভূমিসম্পৃক্ত বাঙালিদের ভূমি থেকে উৎখাত করে হিন্দিভাষীদের দিয়ে, ফ্যানাটিক হিন্দুত্ববাদীদের দিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে কব্জা করা এবং পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে সম্পূর্ণ নিকেষ করা। তারা বুঝে গেছে বাংলাদেশ আপাতত তাদের বশ্যতায় আর নেই। তাই নিজের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে থাকা পশ্চিমবঙ্গকে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বদলে দিয়ে এখানে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি সেটেলারদের চিরস্থায়ী বন্দ্যোবস্ত কায়েম করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি। হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি এটাই। যেমনটা জায়ানিজম। ফিলিস্তিনি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমৃদ্ধিকে লুঠ ও ধ্বংস করে জায়ানিস্টরা যেভাবে গাজাভুখণ্ডকে সম্পূর্ণ দখল নিতে মরিয়া, হিন্দুত্ববাদীরাও সেভাবেই পশ্চিমবঙ্গ-সহ বড় বাংলাকে দখল নিয়ে তাদের সম্প্রসারণবাদী রাজনীতির পূর্ণতা অর্জন করতে চায়। আর সেই লক্ষ্যেই ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ ও ‘কেশরী চ্যাপ্টার-২’-এর মতো ফিল্মের মাধ্যমে নিজেদের সাংস্কৃতিক অস্ত্রকে ধারালো করতে উদ্যত হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top