আজ শনিবার, ১৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৩১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ভারতে বৈদিক আগ্রাসন

ভারতে বৈদিক আগ্রাসন

আজকাল ভারতে খুব ঘনঘন ‘হিন্দুরা বিপদে আছে’— এমন কথাবার্তা শোনা যায়। এমন নয় যে, এসব কথা শুধু এখনই শোনা যাচ্ছে, আগে যেত না। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের নেতৃবর্গের দাবি মেনে নিলে যা দাঁড়ায়, সেই আশি শতাংশ জনসংখ্যার দেশে খোদ হিন্দুরাই যে কেন বিপদের মধ্যে আছে তা বুঝে ওঠা যদিও খুবই দুষ্কর ব্যাপার। হিন্দুত্বের কুশীলবরা এ ব্যাপারে প্রধানত দায়ী করে থাকেন মুসলমানদের। মুসলমানদের ক্রমাগত আগ্রাসনই নাকি আজকের ভারতে হিন্দুদের প্রধান বিপদ। এ কথা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা সত্যমিথ্যায় ভরা নানা রকমের গালগল্প বাজারে চালায়, যার অধিকাংশই কিন্তু হিন্দু জনগণের মধ্যে অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করে থাকেন। অনেকে এসব কথা প্রকাশ্যে আলোচনা করে থাকেন। অনেকে করেন না। কিন্তু হিন্দু জনতার বিপুল অধিকাংশ মানুষ এসব গালগল্পে যে বিশ্বাস রাখেন, তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে আমরা ভালোই বুঝতে পারি। অথচ, ভারতে হিন্দু তথা বৈদিক আগ্রাসন নিয়ে আলোচনা একেবারেই হয় না। যদিও এটা খুবই সত্য যে প্রাচীনকাল থেকে অবিভক্ত ভারতে মূলত বৈদিক আগ্রাসনই চলেছে। এই আগ্রাসন এমনই যে তাদের বিরোধী বহু সম্প্রদায় ভারতের বুক থেকে চিরতরে মুছে গেছে। এই প্রবন্ধে আমাদের আলোচ্য বিষয় এটাই।

আজকাল হিন্দু ধর্ম এবং বৈদিক ধর্মকে একই জিনিস বলে ভেবে নেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাপারটা অনেক বেশি জটিল। এই জটিলতার মধ্যে আগ্রাসন এবং আত্মসাৎ উভয়েই আছে। প্রথমে আমাদের এই ব্যাপারটিকে একটু বুঝে নেওয়া দরকার। ‘হিন্দু ধর্ম’ কথাটা খুব প্রাচীন নয়। এটি একটি নতুন কথা। ভারতে মুসলমান শাসন গেঁড়ে বসার পর মুসলমান জনসংখ্যাও বাড়তে শুরু করে৷ মুসলমানদের থেকে প্রাক্‌মুসলমান ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে পৃথক করার জন্যে ‘হিন্দু’ নামটিকে গ্রহণ করা হতে থাকে। তার আগে হিন্দু নামটি ভারতীয়দের বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়েছে। বেদ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল বৈদিক ধর্ম, যা প্রধানত উপনিষদকেন্দ্রিক ধ্যানধারণার সাথে জুড়ে ছিল। কিন্তু খ্রিস্টীয় সময়ে এসে বৈদিক ধর্ম যত না বেদকেন্দ্রিক থেকেছে, তার থেকে অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়েছে মনু সংহিতা, গীতা এবং বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রের ওপর। অবশ্য এই সকল শাস্ত্রগুলি বেদকে মান্যতা দিয়েই তৈরি হয়েছিল। এই বৈদিক ধর্মের প্রধান জায়গা হিসাবে দেখা দিয়েছিল চতুর্বর্ণ প্রথা। যার ফলে ঋগ্‌বেদে পরবর্তীকালে চতুর্বর্ণের বিভাজনের বিষয়টিকে প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। এই প্রথার সাহায্যেই ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়রা সমাজের সম্পদ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিল এবং তা ধরে রেখেছিল। বৈদিক ধর্মের প্রধান অঞ্চল ছিল উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত। বৈদিক আর্যরা যেহেতু এই অঞ্চলেই তাদের ঘাঁটি তৈরি করেছিল, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলই ছিল বৈদিক ধর্মের উদ্ভবভূমি এবং তার প্রধান দুর্গ। আজও এই অঞ্চলে জাতপাতভিত্তিক হিন্দুত্ব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে অনেক শক্তিশালী।

একটা সময়ের পর বৈদিক আর্যরা ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথম প্রথম এই অঞ্চলগুলির সাথে আর্যরা সরাসরি সংঘাতে যেত৷ যেমন প্রথম দিকে তারা এই অঞ্চলগুলিকে সম্পূর্ণ বয়কট করার কথা বলত। যদি কেউ আর্যাবর্ত থেকে এই অঞ্চলগুলিতে যেত, তাহলে তাদের ফিরে গিয়ে প্রচুর জরিমানা দিতে হত। বিশেষ করে চিকিৎসকরা এবং বণিকরা এর দ্বারা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতেন৷ কিন্তু ধীরে ধীরে এই অবস্থা পালটাতে থাকে৷ সমাজ প্রগতির ধারাতেই এক সময়ে বৈদিক আর্যদের এই অঞ্চলগুলির সাথে একটা নেগোসিয়েশনে আসতে হয়৷ এখন এই অঞ্চলগুলিতে আর্যরা এবার সম্মুখীন হল বিভিন্ন ধরনের বিচিত্র ভাবতন্ত্রের। প্রথম দিকে বৈদিকরা এই ভাবতন্ত্রগুলির সাথেও সংঘাতে যেতে শুরু করে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারে যে এই বিভিন্ন বিচিত্র ভাবতন্ত্রগুলিকে মুছে দেওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং, মুখোমুখি সংঘাতে না গিয়ে ভালো রাস্তা হচ্ছে ওগুলিকে আত্মসাৎ করে একটি বৃহৎ পরিবারের মধ্যে নিয়ে আসা। আচার্য শংকরের সময় থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং কালে কালে তা হিন্দু ধর্মের চেহারা পায়। সুতরাং, হিন্দু ধর্ম বলতে কোনো একটি ধর্মকে বোঝায় না। এটি একটি বৃহৎ ধর্ম পরিবারের নাম যার মধ্যে বিভিন্ন বিচিত্র ধর্মীয় ও আধা-ধর্মীয় বিশ্বাসগুলি সমবেত হয়েছে, যেগুলির মধ্যে আবার বিভিন্ন টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব-সংঘাতও রয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় বৈদিক ধর্ম হিন্দু ধর্মে বিবর্তিত হল, তা একটি চিত্তাকর্ষক ও প্রণিধানযোগ্য বিষয়। তার মধ্যে আত্মসাৎ ও আগ্রাসনের একটি সযত্নরচিত কাহিনির সন্ধান পাওয়া যায়। ভারতে বৈদিক আগ্রাসনের অন্যান্য বিষয়গুলিতে যাওয়ার আগে আমরা প্রথমেই হিন্দু ধর্ম গড়ে ওঠার মধ্যেকার এই প্রক্রিয়াটি সংক্ষেপে দেখে নেব।

একটা সময় ছিল যখন ভারতের প্রায় সকল ধারার প্রধান দার্শনিকরা দর্শন ও তত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়ে বেদান্ত, মীমাংসা, ন্যায়, বৈশেষিক, চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন ও সাংখ্য—  প্রধানত এগুলি নিয়েই আলোচনা করতেন। এঁরা ছিলেন আর্য গোষ্ঠীভুক্ত। বোঝা যায় যে, আর্যরা তখনও পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করতে পারেনি। ফলে এতদ অঞ্চলের ধর্মীয় ও তাত্ত্বিক অনুশীলনগুলি নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজন তাঁদের হয়নি। অথবা দার্শনিকরা এই বিশ্বাসগুলিকে আলোচনা করার যোগ্য মনে করেননি। তাঁদের আলোচনায় তখনও অন্য কিছু ছিল না। যেমন চতুর্থ শতকের জৈন পণ্ডিত হরিভদ্র সুরি যখন ভারতের দর্শনগুলিকে দুই মলাটের মধ্যে আনার চেষ্টা করেছেন, তখনও কিন্তু তিনি উক্ত ছয়টি দর্শন নিয়েই মূলত আলোচনা করেছেন। হরিভদ্র বিরচিত ষট দর্শন সমুচ্চায় দ্রষ্টব্য। হরিভদ্র ষট দর্শন বা ছয়টি দর্শন বলতে যা আলোচনা করেছেন তাতে পূর্ব মীমাংসা (মীমাংসা) আর উত্তর মীমাংসা (বেদান্ত)-র মধ্যে কোনো পার্থক্য করেননি। তাই মীমাংসা নামে একসাথে আলোচনা করেছেন। অন্যদিকে তিবি চার্বাক দর্শনকে তার নাস্তিক বক্তব্যের জন্যে মূল ধর্মীয়-দার্শনিক আলোচনায় আনেননি। এর বাইরে কিছু আলোচনা করার কথা তাঁর ভাবনাতেও আসেনি। তাঁর কথায়, “বৌদ্ধং নৈয়ায়িকং সাংখ্যং জৈনং বৈশেষিকং তথা/জৈমিনীং চ নামানি দর্শনানাম্মূন্যহো।।”

হরিভদ্রের ষট দর্শন সমুচ্চায়-র সাথে আমরা যদি ত্রয়োদশ শতাব্দীর দ্বৈত বেদান্তবাদী পণ্ডিত মাধবাচার্যের সর্ব দর্শন সংগ্রহ গ্রন্থটির তুলনা করি, তাহলে দেখব প্রায় ন’শো বছর পর ভারতের মূলধারার ধর্ম, দর্শন ও তত্ত্ব আলোচনায় এমন অনেক বিশ্বাস ও অনুশীলন জায়গা করে নিয়েছে যা আগে কখনো আলোচনা করার প্রয়োজন হয়নি, অথবা আলোচনার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। মাধব সর্বমোট পনেরোটি সিস্টেম বা তন্ত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন, যার মধ্যে শৈব তন্ত্র, পাশুপত তন্ত্র, রসেস্বর তন্ত্র, প্রত্যয়বিজ্ঞান তন্ত্র প্রভৃতি রয়েছে। বোঝা সম্ভব যে, পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে আর্য ক্ষমতা বিস্তার ও সংহতিকরণের সাথে সাথে এতদ অঞ্চলের প্রধান প্রধান বিশ্বাস ও অনুশীলনগুলি নিয়েও দার্শনিকদের চর্চা করতে হচ্ছে। প্রসঙ্গত মাধব নিজেও ছিলেন কর্ণাটকের মানুষ। 

বিষয়টি বোঝার জন্যে শৈব বিশ্বাস নিয়ে কয়েকটি কথা আলোচনা করা যেতে পারে। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শৈব বিশ্বাস প্রধান স্থান দখল করে আছে। এই বিশ্বাসের প্রধান দেবতা বলে যাঁকে মানা হয়, সেই শিব হলেন প্রকৃতপক্ষে পশুপতি। মানুষ যখন মূলত পশুচারণ করত, তখন থেকে পশুযূথের রক্ষণাবেক্ষণের আকাঙ্ক্ষা থেকে শিব নামক দৈবে বিশ্বাস ভারতীয় সমাজে দেখা যায়। অনেক দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক মনে করেছেন এই বিশ্বাসের মূল নিহিত আছে প্রাক্-আর্য সমাজে। মহেঞ্জদারোতে আবিষ্কৃত পুরুষ মূর্তিকেও অনেকে পশুপতি বলে মনে করে থাকেন। যা-ই হোক না কেন, আর্যরাও ভারতে যখন প্রথম আসে, তারাও ছিল পশুপালক। কিন্তু তাদের মধ্যে আমরা পশুপতি নামক কোনো দেবতার অস্তিত্ব দেখি না। সমগ্র বেদেও শিব বলে কোনো দেবতা নেই। স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই এটা মনে  করেছেন যে, শিব একজন অনার্য দেবতা যার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে শিব মূলত অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের দেবতা। শিব চরিত্রটিও সমাজের উচ্চ অংশের মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করে না। শৈব দর্শনেও আমরা জগৎ নির্মাতা ঈশ্বরের ধারণার বিরোধিতা দেখতে পাই। মাধবাচার্যও তাঁর সর্বদর্শন সংগ্রহ-তে এই দার্শনিক দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন। মাধবের কথায়, “Certain, however, of the Maheswara sects receiving the system of truth authoritatively laid down in the Saiva Agama, reject the forgoing opinion that ‘the Supreme Being is a cause as independent of our actions, etc.,’ on the ground of its being liable to the imputation of partiality and cruelty. They, on the contrary, hold the opinion that ‘the Supreme Being is a cause in dependence on our actions, etc.,…’” অর্থাৎ, পরম ভগবানকে যেভাবে আমাদের (মানুষের) কার্যকলাপের থেকে স্বাধীন এক সত্তা বলে দেখানো হয়, শৈব আগম তার বিরোধিতা করে বলেছে যে, পরম সত্তা মানুষেরই ক্রিয়ার ফল। এই প্রতিস্পর্ধী তত্ত্ব আসলে শেষ পর্যন্ত জগৎ নির্মাতা ও নিয়ন্ত্রণকারী ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কেই যে প্রশ্ন তুলে দেয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এখন এই শৈব বিশ্বাসকে কালে কালে ওই তথাকথিত হিন্দু ধর্মের ছাতার তলায় নিয়ে আসা হল এবং শিবকে একজন হিন্দু দেবতা আর শৈবদের হিন্দু বলে চালিয়ে দেওয়া হল। একরকম আত্মসাৎ করা হল। বহু প্রজন্ম পরে এসে শিবপূজারিরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের হিন্দু বলে ভাবতে ও পরিচয় দিতে শুরু করে দিল। বর্তমানে অবশ্য ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শৈব লিঙ্গায়াতরা নিজেদের হিন্দু পরিচয় থেকে আলাদা করতে চাইছেন। আদিবাসীদের একটা বড়ো অংশ যেমন নিজেদের সারনা ধর্মের স্বীকৃতির জন্যে লড়াই শুরু করেছেন, তেমনই লিঙ্গায়াতরাও স্বতন্ত্র লিঙ্গায়াত ধর্মের স্বীকৃতির জন্যে লড়াই করছেন। ফ্যাসিবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দমন অত্যাচারের মুখে স্থানে স্থানে এই লড়াই কখনো কখনো হিংসাত্মক চেহারাও নিচ্ছে। 

আমরা শৈব বিশ্বাস নিয়ে কিছু আরও কথায় ফিরে আসব। তার আগে আমাদের সাংখ্য নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে একটা কথা আমাদের বারেবারে বোঝানো হয় যে, আমাদের প্রধান ছয়টি দর্শন বেদ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এই ছয়টি দর্শন হল বেদান্ত, মীমাংসা, সাংখ্য, বৈশেষিক, ন্যায় ও যোগ। এই বক্তব্য পরিষ্কারই অতিকথন। শুধু তা-ই নয়, এটি এক পরিষ্কার মিথ্যাচার। এই ছয়টি দর্শনের মধ্যে অন্তত দুইটি দর্শন বেদ বহির্ভূত। সাংখ্য এবং বৈশেষিক। সাংখ্য দর্শন শুধু বেদ বহির্ভূতই নয়, তা বেদ-বিরোধী। বেদান্ত গুরুরা সাংখ্যকেই তাঁদের প্রধান শত্রু মানতেন। এর কারণ কী? কারণ হল, বেদান্ত ছিল ভারতে ভাববাদের পাণ্ডা। ভাববাদী শিবিরের প্রধান নেতা। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, এই জগৎ-সংসার এক পরম চৈতন্যের দ্বারা সৃষ্ট। আমাদের দেশে যখন ভাববাদ এবং বস্তুবাদ প্রথম প্রথম তৈরি হচ্ছে, তখন তাদের মধ্যে প্রধান বিতর্ক ছিল ওই জগৎ-সংসারের সৃষ্টি নিয়ে, বা সৃষ্টিতত্ত্ব (cosmogony) নিয়ে। আমরা আগেই বলেছি যে, ভাববাদী দর্শন যখন প্রথম গড়ে ওঠে তখন তা বেদের মান্যতা লাভ করার জন্যে পরবর্তীকালে বেদ সংহিতায় অনেক কিছু প্রক্ষিপ্ত হয়। বিশেষ করে ঋগ্‌বেদে। ঋগ্‌বেদের দশম মণ্ডল, যেখানে দর্শন নিয়ে কিছু কথা বলা হয়েছে, তার গোটাটাই পরবর্তীকালের সংযোজন বলে সমাজতত্ত্ববিদরা মনে করেন। এই দশম মণ্ডলে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধীয় কয়েকটি সূক্ত আছে। তার মধ্যে নাসাদীয় সূক্ত এবং হিরণ্যগর্ভ সূক্ত অতি পরিচিত। হিরণ্যগর্ভ সূক্ততে বলা হয়েছে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদিতে ছিল হিরণ্যগর্ভ অর্থাৎ সোনার ডিম। সেখান থেকেই সকল কিছুর উৎপত্তি হয়।

“হিরণ্যগর্ভ সমবর্তনাগ্রে ভূতস্য জাতঃ..”

অর্থাৎ, সমগ্রের অগ্রে বা আদিতে ছিল হিরণ্যগর্ভ।

হিরণ্যগর্ভকে পরবর্তীকালে প্রজাপতি বলা হয়েছে এবং আরও পরে উপনিষদে এসে তাকে বলা হয়েছে ব্রহ্ম। সুতরাং, ভাববাদী (বেদান্ত) সৃষ্টিতত্ত্বের মূল বক্তব্য হল, ব্রহ্মই সকল উৎপত্তির কারণ। অন্যদিকে, আমাদের দেশে বস্তুবাদী দর্শনের প্রারম্ভ সাংখ্য দর্শন থেকে। সাংখ্য অনুযায়ী জগৎ-সংসারের উৎপত্তি দেহ থেকে। ব্রহ্মকে যেহেতু পরমাত্মা বলা হয়, তাই সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বেদান্ত ও সাংখ্য-র বিতর্ক আত্মাবাদ বনাম দেহবাদের বিতর্ক নামেও পরিচিত।

দেহ থেকে উৎপত্তি মানে? মানে মিলন থেকে। কার মিলন? বিপরীতের মিলন। লৌকিক ক্ষেত্রে নরনারীর মিলন। বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও পুরুষের মিলন। প্রকৃতি হল মাটি, জল, বাতাস, অগ্নি। প্রকৃতি নারীকল্পনা। আর পুরুষ হল মানবিক ক্রিয়া (শ্রম)। বৈদান্তিকরা প্রথম প্রথম সাংখ্য-র সাথে সরাসরি সংঘাতে যেত। অদ্বৈত বেদান্ত গুরু আচার্য শংকরের রচিত ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-তে বেদান্ত-বিরোধী সকল মতামতকে খণ্ডনের চেষ্টা হয়েছে। তবে শংকর প্রধানত গুরুত্ব দিয়েছেন সাংখ্যকে। সাংখ্য-র বিরুদ্ধেই তিনি প্রধান যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সাংখ্যকেই ‘মল্লভূমিতে প্রধান মল্ল’ বলে অভিহিত করেছেন। এবং সাংখ্যমত খণ্ডন করে বহু ক্ষেত্রে “এতদ দ্বারা অন্য (বিরোধী) মতগুলিও খণ্ডিত হল”— এমন ঘোষণা করেছেন। মুখোমুখি সংঘাতে সাংখ্য-র সাথে কিন্তু বেদান্ত এঁটে উঠতে পারেনি। ফলে এক সময়ে এসে এই সাংখ্যকেই নিজেদের ঘরের লোক বলে দাঁড় করাবার চেষ্টা বেদান্তিদের করতে হয়েছে। এর পেছনে এক ভয়ঙ্কর আগ্রাসনের ইতিহাস রয়েছে। নানা ছলাকলায় শেষ পর্যন্ত বৈদিকরা সাংখ্যকে আত্মস্থ করে নেয়। বিতর্কে তারা কখনোই পারে নি। ফলে অন্য রাস্তা নিতে হয়েছিল। শাসক শ্রেণির লোকেরা চিরকাল যা করে থাকে। কপিলের সাংখ্যকারিকা গ্রন্থকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। সে সময়ে পুঁথির যুগ। গোটে বিশেক হাতে কপি করা তালপাতার পুঁথি পুড়িয়ে দেওয়া কঠিন ছিল না। তারপর তারাই লিখল নতুন সাংখ্য। সাংখ্যসূত্র

সাংখ্যকারিকা ধ্বংস হল। সে জায়গায় দেখা দিল সাংখ্যসূত্র। কারিকাতে প্রকৃতি এবং পুরুষের মধ্যে প্রকৃতিই প্রধান। পুরুষ অপ্রধান। পুরুষ যেহেতু মানবীয় কর্মের দ্যোতক, তাই পুরুষ বহু। কিন্তু ‘সূত্র’-তে পুরুষকে এক বলা হল। অর্থাৎ গোটা কনসেপ্টটাকে ব্রহ্মের কাছাকাছি নিয়ে আসা হল। পুরুষকেই প্রধান বলা হল। মিলনের ব্যাপাটা রইল বটে, কিন্তু তার দেহবাদী ধারণা রইল না। মিলন ব্যাপারটা জাগতিক না থেকে স্বর্গীয় চরিত্র ধারণ করল। কালে কালে তাকে হিন্দু আচারে সাথে জুড়ে দেওয়া হল। পাপ, পুণ্য, স্বর্গ, পাতাল ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। আর সাংখ্য যে বেদপন্থী দর্শন, তা তো আগেই ছাপ্পা মেরে দেওয়া হয়েছে। অতীতে পাঠশালায়, আজ কলেজে কলেজে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে এসবই শেখানো হয়।

সাংখ্য থেকে উৎপত্তি হল তন্ত্রের। তন্ত্রমত ও আচার পূর্ব ও মধ্য ভারতের একটি শক্তিশালী আধা-ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলন। এই তন্ত্রসাধনা আসলে নারীসাধনা তথা মাতৃসাধনা। তাই এই মতের সমস্ত দেবতা হলেন নারী, যার মধ্যে প্রধান হলেন কালী। এছাড়া, দুর্গা, গৌরী, তারা ইত্যাদি রয়েছেন। বৈদিকরা ওই তন্ত্রকেও নিজেদের লোক বলে প্রচার করতে শুরু করে, যদিও তন্ত্রের সাথে বৈদিক মতের তীব্র বিরোধ রয়েছে। কিন্তু কালে কালে যে হিন্দুধর্মের ছাতাটি গড়ে উঠল তাতে শৈবমতের মতোই শাক্তমতকেও ঢুকিয়ে দেওয়া হল। এভাবেই মধ্য এবং পূর্ব ভারতের তন্ত্রমতকে হিন্দু মত হিসাবে যখন ধরে নেওয়া হল, তখন এক আদি দ্বন্দ্বের সমাধান করা হল তন্ত্রকে আত্মসাৎ করে। তন্ত্রের আদি উৎস যে সাংখ্য মত, যাকে শংকর নিজেই তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-এ সর্বাপেক্ষা আক্রমণ করেছেন এবং মল্লভূমিতে প্রধান মল্ল বলে অভিহিত করেছেন, পরবর্তীকালে সেই সাংখ্যের বিষদাঁত উৎপাটন করে গীতায় প্রক্ষিপ্ত করে দেখানো হল, আহা, দ্যাখো, সাংখ্য বেদান্ত ভাই ভাই। ফলে তন্ত্রাচার কালে কালে হিন্দুধর্ম হয়ে দাঁড়াল। কালীর আরাধনা অবশ্যই তন্ত্রাচার, কারণ তা শক্তিসাধনা। তাকে ঈষৎ সংস্কৃত করে যতই বৈদিকঘেঁষা বানানোর চেষ্টা হোক না কেন, কালীসাধনা প্রকৃতপক্ষে তন্ত্রাচারই। তন্ত্রের বামাচার নিয়ে বৈদিকদের যদিও প্রচণ্ড ঘৃণা আছে। তন্ত্রাচার আসলে পাঁচটি ম-এর উপর প্রতিষ্ঠিত। মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা এবং মৈথুন। এমনিতেই মাংস ভক্ষণ নিয়ে উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য তথাকথিত উচ্চ বর্ণীয়দের প্রভূত আপত্তি আছে। তদুপরি তান্ত্রিক যৌনতা তো চক্ষুশূল। পূর্ব এবং মধ্য ভারতের মন্দিরগাত্রে কেন যৌনতার ছড়াছড়ি, তা নিয়ে প্রথম থেকেই তাদের মাথাব্যথা। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিজেপির ছোটো, বড়ো নানা নেতা নানা সময়ে মন্দির ধ্বংসের নিদান দিয়েছেন। সেইসব মন্দির, যেখানে তন্ত্রাচারী কামাচার খোদিত হয়েছে। সুতরাং শুধু মসজিদ নয়, মন্দিরও তাঁদের লক্ষ্য। প্রখ্যাত মার্কসবাদী দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছিলেন ভারতে তন্ত্র-সাংখ্য-চার্বাক— এই ধারাবাহিকতাতেই প্রোটো-বস্তুবাদ থেকে বস্তুবাদের বিকাশ ঘটেছে। তা আবার একইসঙ্গে বৈদিক পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে তান্ত্রিক বামাচারী নারীবাদের বিদ্রোহও বটে। তন্ত্রের কাম-ধারণা তাই বৈদিক কাম-ধারণার থেকে চিরকালই আলাদা থেকেছে। বৈদিক দেবতারাও যে পুরুষপ্রধান, তা তাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন। অন্যদিকে তান্ত্রিক কামাচার মূলত বামাচার। ‘বামা’ শব্দের অর্থ নারী। তান্ত্রিক কামাচার তাই নারীর নেতৃত্বে পরিচালিত এক সাধনা হিসাবে বিরাজ করেছে, যার লক্ষ্য জৈবিক লিঙ্গ নির্বিশেষে সাধকের নারীত্বপ্রাপ্তি। “বামা ভূত্ত্বা যজেৎ পরম!” কারণ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে উদ্ভূত তান্ত্রিক কামাচার বিশ্বাস করেছে যে, চৈতন্যে নারী হয়ে উঠতে না পারলে সমাজের প্রকৃত উৎপাদক হয়ে ওঠা যায় না। মদ্য, মাংস, মৎস্য হল কামাচারের অংশ, যা নারীশক্তির (কুলকুণ্ডলিনী) উত্থানের মধ্যে দিয়ে পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনের ফলে সর্বচৈতন্যকে এক পরম নারীত্বে বিলীন করে দেওয়া। এই হল শক্তিসাধনার মূল কথা। কালীসাধনা তারই এক বিশেষ রূপ মাত্র। অথচ শৈব শাক্ত ধর্মমতকে এই আগ্রাসী বৈদিকতন্ত্র আত্মসাৎ করে তাকেও বৈদিক বা পুরাণ ঘেঁষা করে তুলতে সর্বদাই মরিয়া।

এই প্রশ্নে আবার একবার আমাদের শৈব দর্শন আলোচনায় ফিরতে হবে। আমরা বর্তমানে কালীর যে মূর্তি দেখতে পাই, তা পুরাতন মূর্তি নয়। বর্তমান মূর্তিতে শিব শুয়ে আছেন আর তাঁর বুকে পা দিয়ে নগ্নিকা কালী দণ্ডায়মান। তাঁর হাতে খাঁড়া, গলায় মুণ্ডমালা। তিনি অসুর হত্যায় বেরিয়েছেন৷ আসলে এসবই আদত তান্ত্রিক শাক্তমতের ওপর পৌরাণিক কল্পনার আগ্রাসন চাপিয়ে দেওয়ার বৈদিক ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। আদত কালীমূর্তি ছিল শিবের কোলে তান্ত্রিক যৌনাচারের ভঙ্গিমায় কালীমূর্তি। এখানে শিব তন্ত্রযোগিনী কালীর সাধন সঙ্গী। এই মূর্তি আজও বঙ্গ ও কলিঙ্গের মন্দিরগাত্রে খোদিত আছে। তার অনেকগুলিকেই হাতুড়ি দিয়ে মেরে ভেঙে দেওয়া হয়েছে, চেঁছে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তবুও কিছু রয়ে গেছে। শৈব দর্শন তাই আসলে সাংখ্য তন্ত্রেরই একটি প্রকারভেদ। মাধবাচার্য সর্বদর্শন সংগ্রক-এর ভূমিকায় তাই শৈব দর্শনকে আস্তিক সাংখ্য (Theistic Samkhya) বলে অভিহিত করেছেন।

সাংখ্য এবং তন্ত্র যখন এক পরিপূর্ণ বস্তুবাদী দর্শনের জন্ম দিল, তখন তা পরিচিত হল চার্বাক দর্শন নামে। এই দর্শন লোকায়ত নামেও পরিচিত। দেহবাদ অভিযোজিত হল ভূতচতুষ্টয় তত্ত্বে। চার্বাকদের বস্তুবাদী সৃষ্টিতত্ত্ব বলতে শুরু করল, চারটি মৌলিক পদার্থই হল আদি এবং সনাতন। তা শাশ্বতও বটে। এর রূপান্তর সম্ভব কিন্তু ধ্বংস সম্ভব নয়। এই চারটি মৌলিক পদার্থ হল, অগ্নি, বায়ু, জল ও মাটি। এই মত বিশ্বসংসার সৃষ্টির পেছনে কোনো সচেতন আত্মা বা পরমাত্মাকে আদি কারণ হিসাবে মানতে অস্বীকার করেছে। যেহেতু চার্বাকদের মতে জড় থেকেই চৈতন্যের উৎপত্তি, সেহেতু জড়ই হল আদি কারণ। চেতনা নয়। তাই তাঁরা যে কোনো ধরনেরই চেতনকারণবাদকে অস্বীকার করেছেন। পৃথিবীর যেখানে যেখানে সর্বপ্রথম জড় থেকে জীবনের উদ্ভব অনুমিত হয়েছিল, তার একটা হল ভারত। আত্মাবাদী বা ব্রহ্মবাদী দার্শনিকরা যখন এই বিতর্ক করেছেন যে, যদি আত্মাবাদকে অস্বীকার করা হয় তবে চেতনার উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করা যাবে কী করে, তখন তার উত্তরে চার্বাকপন্থীরা নির্দ্বিধায় বলেছেন যে জড় থেকেই জীবনের বা চৈতন্যের উৎপত্তি হয়েছে। যেমন তণ্ডুল ইত্যাদি খাদ্যবস্তুর বিশেষ পরিবর্তনের ফলেই মদ তথা মাদকাসক্তির উদ্ভব ঘটে, গাছপালা থেকেই ঔষধাদি গুণের উৎপত্তি হয়, তেমনি ভূতচতুষ্টয়েরই বিশেষ বিশেষ সমুদয় (পারমুটেশন অ্যান্ড কম্বিনেশন) থেকেই জীবন তথা চৈতন্যের উৎপত্তি হয়। আবার প্রাণের বিলুপ্তির সাথে সাথে চৈতন্যেরও বিলয় ঘটে, নিত্যআত্মা বলে কিছু হয় না।

চার্বাকদের নিয়ে বৈদিকদের বড় সমস্যা ছিল যে এঁদের আত্মসাৎ করার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। প্রকৃতপক্ষে আত্মসাৎ করার কোনো উপাদানই চার্বাকমতে বৈদিকরা খুঁজে পায়নি। ফলে চার্বাকদের ক্ষেত্রে বৈদিকদের একমাত্র নীতিই ছিল তাঁদের শারীরিকভাবে ধ্বংস করা। এছাড়া আর অন্য কোনো উপায় বৈদিকদের ছিল না। ফলে দেখা যাবে যে, চার্বাকদের একটিও পুঁথি পরবর্তীকালে খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদিও ভারতের প্রাচীন অ্যাকাডেমিক আলোচনায় বারেবারেই চার্বাক মত উল্লিখিত হয়েছে এবং তার পুঁথির কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু একটিও এমন পুঁথি এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বেদান্ত পেতে অসুবিধা হয় নি, রামায়ণ মহাভারত পেতে অসুবিধা হয়নি। মীমাংসা, ন্যায়, যোগ, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র— সবই পাওয়া গেছে কিন্তু চার্বাক টেক্সট্‌ পাওয়া যায়নি। একটিও নয়। এটি একটি আশ্চর্যকারী ঘটনা। এখান থেকে অনেক সমাজতাত্ত্বিক মনে করেন যে, চার্বাকদের পুঁথিগুলি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বা বিনষ্ট করে ফেলা হয়েছিল।

চার্বাকদের ওপর যে ব্যাপক দমনপীড়ন বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদীরা চালিয়েছিল, তার ইঙ্গিত ভারতীয় বিভিন্ন শাস্ত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মার্কসবাদী দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মহাভারত থেকে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। মহাভারতের শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠির যখন বিজয়ী হয়ে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করছিলেন, তখন তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে ব্রাহ্মণরা রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মধ্যে চার্বাক নামক এক ব্রাহ্মণও ছিলেন। এখানে বলে রাখি চার্বাকমতের প্রতিষ্ঠাতা কে তা নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যে চার্বাকমতের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বৃহস্পতির নাম শোনা যায়। কথিত আছে যে বৃহস্পতি ছিলেন দেবগুরু। কিন্তু দেবতারা (অর্থাৎ আর্যরা) যখন অসুরদের (অর্থাৎ ভারতের অনার্য অধিবাসীদের) সঙ্গে কিছুতেই যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারছিলেন না, তখন বৃহস্পতি একটা কাজ করলেন। তিনি একটা ভুল দর্শন অসুরদের মধ্যে প্রচার করেন। অসুররা সেই ভুল দর্শনকে গ্রহণ করে এমনই দুর্বল ও দিশাহীন হয়ে গেল যে যুদ্ধে তারা দেবতাদের কাছে হেরে গেল। এই ভুল দর্শনটির নামই হল চার্বাক দর্শন। চার্বাক সমর্থকরা এই মত মানেন না। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য যে, চার্বাক নামক এক দার্শনিকের নামানুসারেই চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শনকে খণ্ডন করে তিনি চার্বাক দর্শনকে জনপ্রিয় করেছিলেন। এখন মহাভারতেও আমরা চার্বাক নামের একজন ব্রাহ্মণকে পাই যিনি বিজয়ী যুধিষ্ঠিরের রাজধানীতে প্রত্যাগমনের রাস্তায় অন্যান্য ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সকল ব্রাহ্মণরা যখন যুধিষ্ঠিরকে আশীর্বাদ করছিলেন, তখন চার্বাক তাঁকে ভর্ৎসনা করেন এবং অভিশাপ দেন কারণ তিনি ভ্রাতৃহত্যা করেছেন। ওই ঘটনার অভিঘাতে অন্যান্য ব্রাহ্মণরা এবং পাণ্ডব সৈন্যরা চার্বাককে পুড়িয়ে মারে। এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় চার্বাকদের ওপর শারীরিক দমনপীড়নের সম্ভাবনার কথা বলেছেন।

এসবের ফলে এটা অনুমিত হয় যে চার্বাকদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে তাঁদের পুঁথিপত্রগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। এখানেই না থেমে বৈদিকরা চার্বাকদের মতামতকে বিকৃত করে প্রচার করা শুরু করে। চার্বাক পুঁথিগুলি না থাকার কারণে চার্বাকমতের কোনো অথরিটিও থাকে না যা এই বিকৃত প্রচারকে বাধা দিতে পারত, আর শারীরিকভাবে চার্বাকদের অস্তিত্ব না থাকার কারণে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সাথে তর্কে প্রবৃত্ত হবারও কেউ থাকল না। এভাবেই চার্বাকমতের বিকৃত প্রচার আমরা দেখতে পাই। এই বিকৃতির অনেক উদাহরণ আছে। আমরা সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও জনবোধ্য একটি বিকৃতির কথা উল্লেখ করছি। চার্বাকমত প্রচারকালে ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈদিকরা মানুষকে বোঝাত যে, চার্বাকরা নাকি বলেছেন যে, “যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ/ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ”, ইত্যাদি। অর্থাৎ, যতদিন বাঁচবে সুখে বাঁচা উচিত/ঋণ করেও ঘি খাওয়া উচিত! কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেছে যে, চার্বাকরা অত কাঁচা কথা বলেননি। তাঁদের প্রকৃত বক্তব্যটি ছিল এইরকম: “যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেন্নাস্তি মৃত্যুরোগোচরো/ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ?” অর্থাৎ, যতদিব বাঁচবে সুখেই বাঁচা উচিত, কারণ মৃত্যুর অগোচরে কিছুই নেই/ দেহ একবার ভস্মীভূত হয়ে গেলে তা আর কোথা থেকেই বা ফিরে আসে?

ভারতের সমগ্র ইতিহাসে বৈদিকরা যাঁদের সাথে সর্বাপেক্ষা তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে লিপ্ত থেকেছেন, তাঁরা হলেন বৌদ্ধরা। বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে বৈদিক আগ্রাসনের তুলনা পাওয়া কঠিন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে তীব্রতায় বৈদিকরা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়েছেন, ততখানি ধূর্ততায় আবার বৌদ্ধতন্ত্রকে আত্মসাৎ করার চেষ্টাও তাঁরা করেছেন। চার্বাক-বৈদিক সংঘাতের মতই বৌদ্ধ-বৈদিক সংঘাতও ভারতীয় শ্রেণিবিভক্ত সমাজের পরস্পর যুযুধান শ্রেণিগুলির তীব্র শ্রেণি সংগ্রামেরই দার্শনিক অভিব্যক্তি। এর ফলেই এই দার্শনিক সংগ্রামগুলি এইরকম সুতীব্র মারকাটারি, ধ্বংস ও উৎপাটনের চিহ্ন বহন করে। প্রাচীন শ্রেণিহীন আর্য সমাজ শ্রেণিতে শ্রেণিতে বিভক্ত হবার পর দেখা গেল ভারতীয় সমাজে শ্রেণিগুলি বর্ণের চরিত্র ধারণ করে গড়ে উঠেছে। বর্ণ বিভাজনই আসলে শ্রেণি বিভাজন। সমাজের একদিকে উৎপাদক ও শ্রমদানকারী শ্রেণি হিসাবে গড়ে উঠেছে বৈশ্য ও শূদ্ররা। অন্যদিকে ফলভোগকারী শাসক শ্রেণি হিসাবে গড়ে উঠেছে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের দার্শনিক বিশ্ববীক্ষা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদ। ব্রাহ্মণ্যবাদের নেতৃত্ব করত বৈদিক বেদান্তিরা। অন্যদিকে বৈশ্য-শূদ্রদের বিশ্ববীক্ষা ছিল শ্রমণবাদ। শ্রমণবাদের নেতৃত্বকারী গোষ্ঠী ছিল বৌদ্ধরা। ফলে বাস্তব শ্রেণি সংগ্রাম যেমন যেমন তীব্র তীক্ষ্ণ হয়ে উঠত, তাদের দার্শনিক লড়াইও তেমনই মারকাটারি হয়ে উঠত।

সম্রাট অশোকের সময় থেকেই মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় কিছু গুণগত পার্থক্য দেখা দিতে থাকে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়দের আধিপত্য কমে যায়। শূদ্ররা এই প্রথম জমির মালিকানা পায়। ঐতিহাসিক ডিএন ঝা তাঁর Ancient India গ্রন্থে মৌর্য সাম্রাজ্য সম্পর্কে লিখেছেন, “It founded new settlements and sought to rehabilitate the decaying ones by moving people out of overpopulated regions. The shudras for the first time were aided by the state to settle as farmers in these settlements….. In order to bring virgin soil under the plough, the shudra settlers were granted fiscal exemptions or concessions by way of the supply of cattle, seeds and money in the hope of future repayment.” 

স্বাভাবিকভাবেই, মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈদিকদের চক্ষুশূল। শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে তাঁর ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ এক প্রতিবিপ্লবী কুদেতা ঘটান এবং শুঙ্গ বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা রাজক্ষমতায় পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। শুঙ্গ শাসন বৌদ্ধদের উপর প্রথম বড় আকারে দমনপীড়ন নিয়ে আসে। বহু বৌদ্ধ স্তূপ ধ্বংস করা হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পাইকারি হারে হত্যা করা হয়। বৌদ্ধ উপাসনাস্থল ও বিহারগুলি দখল করে সেগুলিকে বৈদিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বদলে ফেলা হয়। বৌদ্ধ সাহিত্যে এর বিস্তৃত বর্ণনা আছে। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, এই পুষ্যমিত্র শুঙ্গের প্রধান পুরোহিত সুমতি ভার্গব মনু ছদ্মনামে কুখ্যাত মনুস্মৃতি রচনা করেন। শুঙ্গ শাসনের পতনের পর একটা লম্বা সময় অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ অবস্থা চলে। এই পর্বে বৌদ্ধরা তাঁদের প্রভাবাধীন এলাকার বিপুল বিস্তার ঘটাতে সমর্থ হন। এই পর্বেই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে, যার মধ্যে নালন্দা, ওদন্তপুরী, বিক্রমশীলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

কিন্তু ৭০০ খ্রিস্টাব্দে আচার্য শংকরের জন্ম এবং বেদান্তগুরু হিসাবে তাঁর আগ্রাসী ও উসকানিমূলক নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসাবে ফের বৌদ্ধদের ওপর ব্যাপক দমনপীড়ন শুরু হয়। এবারে তা একেবারে বৌদ্ধ নির্মূলীকরণ অভিযানে রূপান্তরিত হয়। নালন্দা-সহ প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করা হয়। পুঁথিপত্র জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আধুনিক সময়ের ইতিহাস রচয়িতারা এই কাজকর্মগুলির দায়ভাগ মুসলমান লুঠেরাদের ওপর চাপানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয় না। যেমন নালন্দার ধ্বংস নিয়ে প্রচলিত মত হল ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি নালন্দা আক্রমণ ও ধ্বংস করেছিলেন। কিছুদিন আগে নবগঠিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি এই প্রচারকেই মান্যতা দিয়ে প্রভূত বাজার গরম করে এসেছেন। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস আলাদা। ইতিহাস বিকৃতি এবং বৌদ্ধদের ওপর  বৈদিক আগ্রাসনের একটি উদাহরণ হিসাবে নালন্দা নিয়ে দু’-একটি কথা বলা দরকার।

নালন্দায় খননকার্য থেকে এটা প্রমাণিত যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। ছাইয়ের একটা অত্যন্ত পুরু স্তর সেখানে দেখা যায়। বোঝা যায় একটা ধ্বংসলীলা চলেছিল। খননকার্য থেকে এসবই প্রমাণিত হয়। তাহলে এখন প্রশ্ন হল এই আগুন লাগাল কারা, এই ধ্বংস চালাল কারা? তাহলে কি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু বন্ধুই ছিল না, গোপন ও প্রকাশ্য শত্রুরাও ছিল, যারা বাইরে থেকে নয়, দেশের ভেতর থেকেই উঠে এসেছিল? যে ঐতিহাসিকের বক্তব্য থেকেই সকলে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে বখতিয়ারই নালন্দা ধ্বংস করেছিল, একমাত্র যে ব্যক্তি এই কথা বলেছেন, তাঁর নাম মিনহাজ-ই-সিরাজ জুঝানি। ১১৯৩ সালে মধ্য এশিয়ার বর্তমান আফগানিস্তানের ঘুর প্রদেশে তাঁর জন্ম। অর্থাৎ, যে সময়ে বখতিয়ার নাকি নালন্দায় আগুন লাগাচ্ছেন বলে অভিযোগ, সেই সময়ে মিনহাজের জন্ম হচ্ছে নালন্দা থেকে বহু দূরে। অতি-উৎসাহী ব্রাহ্মণ্যবাদীরা মিনহাজকে বখতিয়ারের আগুন লাগানোর প্রত্যক্ষদর্শী বলেও উল্লেখ করেন। গল্পের গোরু শুধু কলতলাতেই গাছে ওঠে না, ‘শিক্ষিত’ মানুষের স্টাডিরুমেও ওঠে! মিনহাজ জুঝানির পেশা ছিল রাজারাজড়াদের ফরমায়েশ অনুযায়ী যুদ্ধজয়ের ইতিহাস লেখা। ঘুর অঞ্চলের ঘুরিদ রাজবংশের ওপরও তিনি লিখেছেন তাদের কাহিনি। ১২২৭ সাল নাগাদ তিনি প্রথমে বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাবে এবং আরও পরে দিল্লি আসেন। দিল্লিতে সেই সময়ে সুলতান বংশের শাসন চলছিল। দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের ফরমায়েশ অনুযায়ী এখানকার একটি ইতিহাস লেখেন, যা তবাকাতনাসিরি নামে পরিচিত। এই বইটি লেখা হয় ১২৬০ সালে, অর্থাৎ মিনহাজের মৃত্যুর ৬ বছর আগে। অর্থাৎ, তিনি বাঙলা-বিহারে এসেছিলেন অন্তত ১২৫০-এর পর। মানে, বখতিয়ারের তথাকথিত নালন্দা আক্রমণের অন্তত অর্ধশতক পর। স্বাভাবিকভাবেই, এখানে এসে লোকমুখে যা শুনেছিলেন তাতে সম্ভবত কিছু রং চড়িয়ে (সুলতানদের খুশি করার জন্যে) লিখে ফেলেছিলেন ইতিহাস। আর তার আরও কয়েকশো বছর পর হিন্দু সাম্প্রদায়িক মননে তা-ই প্রকৃত ইতিহাস হিসাবে পূজিত হতে লাগল।

আসুন, আমরা এবার অন্য এক ঐতিহাসিকের কথাও শুনি। ইনি বৌদ্ধ। তীব্বতদেশীয় পণ্ডিত ঐতিহাসিক তারানাথ। তারানাথের খুব গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ History of Buddhism in India-তে তিনবার নালন্দার ওপর হামলার কথা বলা আছে। বিংশতিতম অধ্যায়ের নাম, Account of the Period of the Third Hostility to the Doctrine and of its Restoration, অর্থাৎ, “মতবাদের ওপর তৃতীয় শত্রুতা ও তার পুনঃস্থাপনা কালের বিবরণী”। তারানাথ নালন্দা মহাবিহারকে Sri Nalendra বলে অভিহিত করেছেন। এটা পরিষ্কার যে, তারানাথ নালন্দার ওপর হামলাকে বৌদ্ধ দর্শন, সংস্কৃতি ও শিক্ষার ওপর আক্রমণ বলেই মনে করেছেন, তাই “Hostility to the Doctrine” কথাটা ব্যবহার করেছেন। কী বলছেন তারানাথ এই অধ্যায়তে? আমি সরাসরি কয়েকটি লাইন ওঁর গ্রন্থ থেকে হাজির করতে চাই।

Kakutsiddha, a minister of the King, built a temple at Sri Nalendra. During its consecration he arranged for a great ceremonial feast for the people. At that time, two beggars with tirthika views came to beg. The young naughty sramanera-s threw slops at them, kept them pressed inside door panels and set ferocious dogs on them. These two became very angry. One of them went on arranging for their livelihood and the other engaged himself to the surya-sadhana…. Thus he attained siddhi through the endeavour of twelve years.
He performed a sacrifice (yajna) and scattered the charmed ashes all around. This immediately resulted in a miraculously produced fire. It consumed all the eghtyfour temples, the centres of the Buddha’s Doctrine.
The fire started burning the scriptural works that were kept in the Dharmaganja of Sri Nalendra, particularly in the big temples called Ratnasagara, Ratnadadhi, and Ratnarandaka, in which were preserved all the works of Mahayana pitaka-s…. Many temples in other places were also burnt and the two tirthika-s, apprehending punishment from the King, escaped to Ha-sa-ma [Assam] in the north.

একটা বড় অংশ উদ্ধৃত করতে হল কারণ ইতিহাসের এত বিকৃতি এই নির্লজ্জ ফ্যাসিবাদীরা ঘটায় এবং তা দিয়ে বাজার গরম করে যে প্রয়োজন হয়ে পড়ে আসল সত্যকে তুলে আনার ও বোঝার খাতিরে কিছুটা কষ্ট স্বীকার করা। তা হলে, কী দাঁড়াল তারানাথের কথায়? মন্ত্রী কুক্কুটসিদ্ধ নালন্দা মহাবিহার চত্বরে একটি বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সেই উপলক্ষ্যে একটি ভোজসভা চলছিল। সেখানে দুজন তীর্থিকও এসেছিলেন। অল্পবয়সি দুষ্টু শ্রমণরা তাদের গায়ে কাদা ছোঁড়ে, দরজার ফাঁকে আটকে রাখে, হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দেয়। তাতে এই দু’জন প্রচণ্ড রেগে যান এবং একজন ভিক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নেন, অন্যজন সূর্যসাধনা শুরু করেন। বারো বছরের সাধনায় সিদ্ধি আসে। তখন তাঁরা মন্ত্রপূত ছাই দিয়ে একটা ভয়ঙ্কর ঐন্দ্রজালিক আগুন তৈরি করেন। ওই আগুন নালন্দা মহাবিহারের চুরাশিটি মন্দিরে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে বিপুল গ্রন্থাগার ছিল। আর শাস্তির ভয়ে তীর্থিক দু’জন আসামের দিকে পালিয়ে যান।

এখন কথা হল তীর্থিক কারা? ভারতে মুসলমানদের আগমনের সময় থেকে এদেশের লোকেদের সামগ্রিকভাবে তারা হিন্দু নামে ডাকতে থাকে বলে অনেকেই অভিমত দিয়েছেন। এইসব লোকেরা নিজেদের অবশ্য তা বলত না। বৌদ্ধ, জৈন, শৈব, বিষ্ণুমতের বৈষ্ণব প্রভৃতি নানা কিছু তারা নিজেদের সম্পর্কে বলত। ইতিমধ্যে প্রাচীন বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম পৌরাণিক ধর্মে অভিযোজিত হয়েছিল। আচার্য রামানুজের দ্বৈত বেদান্ত এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করেছিল। কালক্রমে এই পৌরাণিক ধর্মানুসারীরাই হিন্দু নামে পরিচিত হন। তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করতেন বলে বৌদ্ধরা ব্যঙ্গ করে এঁদের তীর্থিক নামে অভিহিত করত। সন্মাত্রানন্দের তাত্ত্বিক উপন্যাস নাস্তিক পণ্ডিতে ভিটা থেকে নীচের কথাগুলি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ভারত থেকে নেপাল হয়ে তিব্বত যাওয়ার পথে অতীশ দীপঙ্করের শ্রমণ দলটির সাথে ভারতীয় সীমার মধ্যে পাহাড়ি অঞ্চলে দেখা হয়েছিল কয়েকজন হিন্দু সন্ন্যাসীর। তাঁদের কথোপকথন নিম্নরূপ:

যাত্রীদল সেইসব গুহাসম্মুখে উপনীত হলে এক গুহামুখে জনৈক গৈরিক বাস পরিহিত মুণ্ডিতমস্তক সন্ন্যাসী আবির্ভূত হলেন। মাঙ্গলিক বাক্য উচ্চারণ করে সেই ব্যক্তি বললেন, “ভদ্রমন্ডলী আপনারা কারা? কোথা হতে এলেন? এই দুর্গমপন্থায় কোথায়ই বা চলেছেন?”

পুরোবর্তী ক্ষিতিগর্ভ উত্তর দিলেন, “আমরা বৌদ্ধ শ্রমণ। সম্প্রতি নেপাল অভিমুখে চলেছি। আপনারা?”

উত্তর এল, “আমরা হিন্দু সন্ন্যাসী। এ আমাদিগের মঠ। আপনারা আমাদিগকে ব্যঙ্গ ভরে ‘তীর্থিক’ উপাধিতে ভূষিত করেন।” শেষ বাক্যটি উচ্চারণকালে সন্ন্যাসীর কণ্ঠে পরিহাস ও বিরুদ্ধতার ঝাঁজ ফুটে উঠল।

নালন্দায় আগুন লাগানোর যে ঘটনাটি তারানাথ বলেছেন, তা খুবই আগ্রহোদ্দীপক। তীর্থিকদের সাথে বৌদ্ধদের সংঘাত কতটা বিদ্বেষপূর্ণ ছিল তা উক্ত ঘটনায় দেখা যায়। সন্মাত্রানন্দও উক্ত বিদ্বেষের কথা পুনরুক্ত করেছেন। পারস্পরিক এই বিদ্বেষ এবং প্রতিযোগিতা এতটাই তীব্র ছিল যে বৌদ্ধদের ভোজসভায় দু’জন তীর্থিক এসে হাজির হলে অল্পবয়সি (ফলত অবিবেচক) শ্রমণরা তাদের উত্ত্যক্ত করে। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় তীর্থিকরা যা করলেন তা আপাতদৃষ্টিতে লঘু পাপে গুরু দণ্ড বলেই প্রতীয়মান হয়। তাঁরা গোটা নালন্দা মহাবিহারে, বিশেষ করে নালন্দার গ্রন্থাগার অবস্থিত ছিল যে মন্দিরগুলিতে, তাতে এক ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ড ঘটালেন। এই অগ্নিকাণ্ড কিন্তু সাধারণ অগ্নিকাণ্ড নয়। এর জন্যে তাদের বারো বছর অপেক্ষা করতে হল। তথাকথিত সূর্যসাধনা বলে যা বলা হয়েছে, তা আসলে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা এক কুটিল ষড়যন্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। নিশ্চিতভাবেই এই অনুমান করা যায় যে, এর পেছনে বহু লোক যুক্ত হয়েছিলেন। এমনভাবে আগুন লাগানো হয়েছিল যে তা সহজে নির্বাপিত করা সম্ভব হয়নি। নালন্দার সুবিখ্যাত বিপুল গ্রন্থাগারের অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে যায়। এই শত্রুতাও শুধু একদিনের কিছু কিশোর শ্রমণের দুষ্টুমির প্রতিক্রিয়ায় ঘটতে পারে না। এর পেছনে দু’টি শত্রুতাপূর্ণ শিবিরের দীর্ঘদিনের সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে।

আমরা আগেই বলেছি যে, বাংলা বা বঙ্গের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে বৈদিক আর্যদের মৌলিক সংঘাত আছে। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক অশোককুমার মিশ্র তাঁর বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন,

প্রাচীন বঙ্গদেশের অধিবাসীদের সম্পর্কে আর্যদের প্রবল অবজ্ঞা ও দারুন ঘৃণার কথা জানতে পারি ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে। এদেশের মানুষদের ভাষাকে আর্যগণ ‘বায়াংসি’ অর্থাৎ পাখিদের কিচিরমিচির ডাক বলে উপহাস করতেন। এমনকি আর্যরা এদেশে এলে ব্রাত্য হয়ে যেতেন— সামাজিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে তাঁদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। প্রাচীন বঙ্গদেশে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষা প্রচলিত ছিল বলে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন। এদেশে আর্যদের অধিকারভুক্ত হবার পর এদেশের ধর্মকর্ম, জীবনাচরণ, এমনকি ভাষার ক্ষেত্রেও এক গভীর পরিবর্তন সাধিত হয়। আর্যদের বঙ্গদেশে আগমনের পূর্বে খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে পাণিনি আর্যদের বৈদিক ভাষার সংস্কার সাধন করেন। এই সংস্কারপ্রাপ্ত ভাষাই হল সংস্কৃত ভাষা। এই সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে পূর্বভারতীয় প্রাচীন ভাষাগুলির মৌলিক সংস্পর্শে সৃষ্টি হল মাগধী প্রাকৃত ভাষার। মুখের ভাষা বার বার পরিবর্তিত হয়, মাগধী প্রাকৃত থেকে জন্ম হল মাগধী অপভ্রংশের।  বাংলাদেশে সংস্কৃত ভাষার চর্চার কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস নেই, প্রাকৃত ভাষাতেও খুব বেশি গ্রন্থ রচিত হয়নি। কিন্তু পাল রাজবংশের আমলে এদেশে অপভ্রংশ ভাষার খুব চর্চা হয়েছিল। এই অপভ্রংশের পরবর্তী পরিবর্তিত স্তরই হল বাংলা।

অধ্যাপক মিশ্রের এই বক্তব্য থেকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাই। বৈদিকরা বঙ্গদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত ঘৃণার মনোভাব পোষণ করত। এর কারণ বৈদিক ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে বঙ্গের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির সুতীব্র সংঘাতের মধ্যে নিহিত আছে। আমরা আগেই বলেছি বঙ্গ ছিল তন্ত্রের জায়গা। বৈদিকরা ব্রহ্মবাদী তথা আত্মাবাদী। বঙ্গের মানুষ দেহবাদী। বৈদিক সমাজ ছিল পুরুষপ্রধান, বঙ্গ ছিল নারীপ্রধান। বৈদিকদের গাত্রবর্ণ ছিল গৌর কিন্তু বঙ্গের মানুষ প্রধানত অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় হবার কারণে তাঁদের গাত্রবর্ণ ছিল কৃষ্ণ। বৈদিক আর্যরা (আর্যদের অন্য অনেক গোষ্ঠীর মধ্যে এ জিনিস দেখা যায় না) মানসিকভাবে ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণমনা ও পরবিদ্বেষী। ফলে তারা বঙ্গদেশের অধিবাসীদের ঘৃণার চোখে দেখত। কিন্তু বঙ্গদেশ অধিকার করার পর তারা এখানকার ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাসগুলিকে ক্রমশ নিজেদের অনুকূলে পরিবর্তিত করতে থাকে। যাঁরা এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে চাননি, তাঁদের ওপর নেমে আসে ব্যাপক দমনপীড়ন। এই আত্মসাৎ, পরিবর্তন ও দমনের ত্র্যহস্পর্শে বঙ্গ বৈদিক অধিকৃত হয়।

তন্ত্রসাধনা ছিল বেদ-বিরোধী। বৌদ্ধরাও ছিলেন বেদ-বিরোধী। ফলে বঙ্গদেশে খুব স্বাভাবিকভাবেই বৌদ্ধতত্ত্বের সঙ্গে তন্ত্রতত্ত্বের সংশ্লেষ ঘটে। এর ফলে বঙ্গদেশে বজ্রযান বৌদ্ধতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতে বহু খ্যাতনামা বাঙালি বৌদ্ধ আচার্যরা ছিলেন তন্ত্রসাধক। পরবর্তীকালে তাঁরা বৌদ্ধতত্ত্বে দীক্ষিত হলে তাঁদের হাতেই তন্ত্র ও বৌদ্ধমতের মিলন ঘটে এবং বজ্রযানের উৎপত্তি হয়। এর মধ্যে বিরুপ, নারোপ, তিলোপ, অতীশ দীপঙ্কর, কমলশীল, ত্রৈলক্যচন্দ্র, চন্দ্রগোমিন প্রভৃতি আচার্যরা স্বমহিমায় ভাস্বর থেকেছেন। কিন্তু (বৌদ্ধ) পাল বংশের পতনের পর ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন বংশের শাসনে বৌদ্ধ ও তন্ত্রসাধকদের ওপর ভয়ানক দমনপীড়ন নেমে আসে। অনেকেই নেপাল এবং তিব্বতে পালিয়ে যান। বাঙালির প্রথম লিখিত সাহিত্যকীর্তি চর্যাপদ এই বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের রচনা। এই রচনা সাংকেতিক সান্ধ্যভাষায় রচিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এই সাহিত্য ছিল এক ধরনের আত্মগোপনকারী (আন্ডারগ্রাউন্ড) সাহিত্য, যা সেন রাজবংশের দমনমূলক রাজত্বের শ্বাসরোধী জমানাকেই চিহ্নিত করে।

ভারতের ইতিহাসের বৈদিক আগ্রাসন স্বাধীনতা-উত্তর যুগে তীব্র সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ হিন্দুত্ববাদে রূপান্তরিত হয়। গোটা শ্রমণ ধারা ও চার্বাক-লোকায়ত ধারাকে হত্যা করার পর এদের বর্তমান প্রধান লক্ষ্য হল মুসলমানরা। বৈদিক আগ্রাসনকে যুগে যুগে বিভিন্ন শক্তি প্রতিনিধিত্ব করেছে। কখনো ষ্যমিত্র শুঙ্গ, কখনো শংকরাচার্য, কখনো শশাঙ্ক, কখনো বা সেন বংশীয়রা। আজ বর্তমান ভারতে বৈদিক আগ্রাসনের প্রধান প্রতিনিধি হল ফ্যাসিবাদী আরএসএস, বিজেপি বা সংঘ পরিবার। কেন্দ্রের সরকারে আসীন হওয়ার ফলে জবরদস্তি ধর্মস্থান পরিবর্তন, মুসলমানদের খোলাখুলি শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা, তাঁদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা— এ সবই তাদের রাজনীতির ভিত্তি। মনে রাখতে হবে বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়েই যে নয়া-ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠছে, তার আদর্শনৈতিক ভিত্তি হচ্ছে ইসলামোফোবিয়া বা মুসলমান-বিদ্বেষ। ভারতবর্ষে এই গৈরিক রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের চরিত্র অনুধাবন করতে গেলে ভারতের ইতিহাসের বৈদিক আগ্রাসন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। তা না থাকলে এই ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সত্যিকারের আদর্শনৈতিক লড়াইয়ের ভিত গড়ে তোলা যাবে না।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top