আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সকাল হতে এখনও বাকি

।। বৈশাখী নার্গিস ।।

এখনও বাওবাবের চারা আনা হয় নি। নাইটিংগেল পাখির গান শুনব বলে কবে থেকে ঠিক করে রেখেছি। ভেবেছি এবার শীতে বরফের দেশে যাবো। পাহাড় ডিঙিয়ে, মেঘের ভেতর। মেপল গাছের সারির মাঝখান দিয়ে হাঁটব। এত তাড়া কিসের? এই তো সবে শিশির ফুটল ভোরের বাতাসে। সকাল এখনও হতে বাকি।

ভালো মানুষ 

থার্মোমিটারে চড়চড় করে পারদ উঠছে। বোধহয় বাওবাবের দেশে যাওয়া হল না। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে এক-দুই-তিন গুনছি। বিছানা কাঁপছে, মনে হচ্ছে ভূমিকম্প, না নিজের শরীর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বরফ নামছে। চাদর বালিশে জড়াজড়ি করে আত্মরক্ষার ঢাল বানাচ্ছি। তবু শিহরণ, চাঁদটা জানালার এক কোণে অসহায়ভাবে তাকিয়ে। বিরক্ত! এক গ্লাস জলও গড়িয়ে নিতে পারছি না। তবু ফিরব না। কথা দিয়েছি। শুনলাম, কোথায় যেন মেঘ ভেঙে পড়েছে। এখানে খটখটে রোদ্দুর। মৌতাতে মেতে আছে শহর। বাসে ট্রামে জমজমাট। সামনেই উৎসব, সবার এত চাহিদা কিসের। এত এত জিনিস। তবু আরও চাই আরো। ভাবছি, এবার বর্ষায় রেইনকোট কিনব। পুরোনো ছাতাটা দিয়ে দেব ভালো মানুষটাকে। যার কাছে পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ পাগল, একা সেই ভালো। প্রতি পূর্ণিমারাতে তার ঘোর লাগে। আউড়ে যায় স্তালিন, মুসোলিনি আর মাও যে দং-এর বুলি। একসময় ঘোর থেমে এলে দোকানের ভাঙ্গা বেঞ্চটায় শুয়ে পড়ে। পাশের কুকুরটা বিরক্ত হয়ে একবার তাকিয়ে আবার ঘুমোয়।

গোলকধাঁধা 

জ্বরের ঘোরে অনবরত একটার পর একটা পাজল সলভ করছি। সব কেমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট, বাড়ি, মানুষ এবং আমিও, গড়াতে গড়াতে চলছি। যেন এক বড় মেশিনের ভেতর ঘুরছি। এরকম কেন হয় জানি না! লন্ডনের গলি পথ ধরে কতটা এগোলাম ভাবছি। মনের ভেতর কল্পনার পাহাড় গড়া। আমার একটা পোষা কাঁকড়া ছিল। অনেক দিন অফিসফেরত তাকে পোকামাকড় খাওয়াতাম। মেঝের উপরে বসে গল্প জুড়ে দিতাম। তারপর একদিন এসে দেখলাম, বোতল খালি করে কেঊ হাফিস করেছে তাকে। একজন কথা শোনার মতো ছিল, সেও গেল।

হুঁশ

ভেবেছিলাম মাতাল হবো, গত পূর্ণিমায় বসে গিলছিলাম নদীর ধারে, অনেক্ষন পর চাঁদটাও এলো। গান গাইলাম উচ্চাঙ্গ স্বরে। কী মনে হল ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধও করলাম খালি হাতে। এত ক্ষোভ কিসের বুঝি না। রাগটা ক্রমশ জ্বর হয়ে উঠল, আগুন নিয়ে ঘুরছি সারাক্ষণ! বিড়ি সে তো পকেটে থাকে। তাপে পুরে যাচ্ছি ক্রমাগত। অফিস করছি, খাচ্ছি-ঘুমোচ্ছি— কোনো হুঁশ নেই। আজ পাঁচমাথার মোড়ে দুম করে মন হল আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে, আমি শূন্যে উড়ছি। বৃষ্টির ফোঁটা চোখ ভিজিয়ে যাচ্ছে। মেঘের ঠাণ্ডা হাত আমার কপাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। আমি শান্ত হয়ে আবার ফিরে পাচ্ছি নিজেকে।

হা ভগবান 

চোখ মেলে দেখি বিছানায়। আমার জামা কাপড় ভেজা। উৎসুক কয়েক জোড়া চেনা চোখ। উঠতে গিয়ে আবার ধপাস। ঘুম জুড়ে এলো চোখে। কতদিন ঘুমইনি। কতদিন মা গান শোনায়নি। অন্ধকার রাত আর জনালায় চাঁদ সাক্ষী। অশরীরী হতে চেয়েছি অনেকবার। বুনোলতার মতো বেড়ে উঠতে গিয়ে ছেঁটে ফেলেছে কত পরিচিতজন। দ্রুত নির্বাক হয়েছি। চলচ্চিত্রের মতো সবকিছু সামনে ভেসে উঠছে। আজ যারা চ্যাঙদোলা করে তুলে এনেছে তাঁরা আমার ভগবান। যেহেতু ওসবে বিশ্বাস বা অভক্তি কিছুই নেই। মনে হলো আমি কিছু ভালো করেছি নিশ্চিত। একটা কথা ঠিক সব কিছুরই একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। আকর্ষণ থাকে। এ তারই ফল। আহত পাখির মতো ছটফট করি, ডানা কোথায় যে ঊড়ব!

কাঠ-মানুষ 

দেয়ালে কান পেতে শোনার চেষ্টা করি। কেঊ ফিস্‌ফিস্‌ করছে। একবার খরার দেশে গিয়েছি। ফিরতি পথে ট্রেনে হামলা জলচোরদের। বাপের জন্মে কখনও শুনিনি জলও চুরি হয়। রোদ্দুরে ফুটিফাটা মাঠের মাঝখানে ট্রেন হঠাৎ থেমে গেল। কৌতূহলী হয়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়েছিল কাঠ-মানুষেরা। শুধুমাত্র জল। আর কিছু না। দেখলাম একটা গল্প তৈরি হয়ে গেল অলক্ষ্যে। মনের ওপর জোর খাটাতে গিয়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হল।

তবু বাকি অনেক 

অনেক লোকের ভিড়েও যেমন কষ্ট হয়। তেমনি একটা ফাঁকা ঘরেও কষ্ট বুকে চেপে বসে। গোলগোল কিছু চারদিকে ঘুরতে থাকে। স্পষ্ট হয় না। তবে কি চোখ গেল? গলা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। একবার মনে হল কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে সরু-মিহি গলায় ডাকছে। না কেউ নয়। গভীর জলের ভেতর ডুবে যাচ্ছি। জলের কুলকুল শব্দ কানে খুব জোরেই বাজছে। আমি নামছি। আস্তে আস্তে। গভীর আরো গভীরে। নির্ভেজাল সত্যের মতো আঁকড়ে ধরতে চাইছি কিছু একটা। না নেই, হাতড়ে কিছুই পেলাম না। উল্টে হাত বিছানার চাদরে ঠেকলো। ভিজে সপসপ করছে ঘামে। এই মুহূর্তে নিদারুন কষ্ট হল। কাঁদতে চাইলাম, পারলাম না। নিজের কষ্ট কাউকে দেখাতে নেই বলে, ভয় পেয়ে গেলাম। তবে কী শেষ মুহূর্ত না তা কী করে হয়। এখনও বাওবাবের চারা আনা হয় নি। নাইটিংগেল পাখির গান শুনব বলে কবে থেকে ঠিক করে রেখেছি। ভেবেছি এবার শীতে বরফের দেশে যাবো। পাহাড় ডিঙিয়ে, মেঘের ভেতর। মেপল গাছের সারির মাঝখান দিয়ে হাঁটব। এত তাড়া কিসের? এই তো সবে শিশির ফুটল ভোরের বাতাসে। সকাল এখনও হতে বাকি।

ছবি- লুবনা চর্যা

বৈশাখী নার্গিস

কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘অদ্বিতীয়া’ পত্রিকার সহ-সম্পাদিকা এবং তৃতীয় পক্ষ সম্পাদিকা। চাকরীসূত্রে কলকাতায় বসবাস। পড়াশুনো এবং জন্মস্থান উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি। নেশা এবং পেশা দুটোই লেখালিখি।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top