আজ বৃহস্পতিবার, ২৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সিজ্জিল, পর্ব-২

।। শাদমান শাহিদ ।।

 শেখ মুজিব অবশ্য আরও বড়কিছু চেয়েছিল, মুজিব চেয়েছিল প্রভু হয়ে বসতে। বাংলা-বাঙালির প্রভু। প্রভু হতে হলে তার একটা ধর্ম লাগে। যেমনটা ছিল লেনিন-স্টালিনের, যেমনটা ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর, মাও-এরও একটা ধর্ম ছিল, ছিল কামাল পাশারও। ধর্ম ছাড়া প্রভুত্ব দাবি করা চলে না। আর প্রভু না হতে পারলে অনন্তকাল টিকে থাকাও সম্ভব নয়।এজন্যেই সব এজেন্ডা পায়ে ঠেলে দিয়ে মুজিব বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিল। তোমাদের জানা উচিত, বাকশাল ছিল একটা ধর্মের নাম। যে ধর্মের প্রভু শেখ মুজিব। এ ধর্মে মুজিবের কথাই সব। কুন ফায়াকুন। এর ব্যত্যয় ঘটানোর ক্ষমতা কারো ছিল না। সে সবকিছু করবে, যা ইচ্ছে করবে। যাকে ইচ্ছে দেবতা ঘোষণা করবে, যাকে ইচ্ছে শাস্তি হিসেবে পাঠিয়ে দেবে নরকে। আর এখানেই মহাপ্রভুর সাথে তার দ্বন্দ্বটা বেঁধে গেল। মহাপ্রভু দেখল মুজিবের কিছু কিছু পদক্ষেপ ঘুমের বেঘাত ঘটিয়ে দিচ্ছে, হয়তো কোনো একসময় তালগোল পাকিয়ে বিপদেই ফেলে দেবে। ফলে তিন বছরের ঘোলাপানিতে আলকতরাই ঢেলে দিল, শেষে কেউ কিচ্ছুটি দেখতে পেল না। না বাকশাল না জনগণ। ফাঁকে নাই হয়ে গেল মাছ।  

দুই

আশ্চর্যের বিষয়˗ পরদিন জটাধারী সন্ন্যাসী আসার আগেই সিজ্জিল এসে উপস্থিত।

জ্বীনের সাথে কথা বলব, সিজ্জিলের ব্যাপারে খোঁজখবর নেব, ব্যাপারটা নিয়ে যখনই ভেবেছি, একটা বাড়তি উত্তেজনা কাজ করেছে। যে কারণে অফিসে কোনো কাজই করতে পারিনি। বিকেল থেকে ফাইলপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে কোনোরকম সন্ধ্যাটা হতেই বেরিয়ে পড়লাম। অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাব, এমনসময় দেখি সিজ্জিল। আমার ক্লাসমেট সিদ্দিক কামালের বেশ ধরে সামনে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই আমার অবস্থা ঘাম দিয়ে জ্বর সারল যেন। একেই বলে আপনজন, বন্ধু। যাকে দেখলে অকূলে কূল পাওয়া যায়। পরিস্থিতি যত ভয়াবহই হোক যার উপস্থিতিতে একদম নির্ভার থাকা যায়। আমার সিজ্জিল তেমনই একজন। ও সামনে থাকলে আমি অনেককিছুই হয়ে যাই। বললাম, সিজ্জিল! তুমি!

চোখে-মুখে ফুটে ওঠা আমার উচ্ছ্বাস দেখে সেও বেশ পুলকিত হয়। 

জানতে চাইলাম, কোথায় ছিলে এতদিন?
– আমার খবর পরে লও। আগে বলো তুমি কেমন আছো?
– ভালো না।
– কেন!
– গাড়িতে ওঠে বসো। যেতে যেতে বলি।

বলতেই সিজ্জিল সিদ্দিক কামালের মতোই চট করে গাড়িতে ওঠে বসল। 

– সিদ্দিক কামালের কথা তাহলে এখনও মনে আছে তোমার?
– থাকবে না কেন, সে এখন  কেমন আছে?
– আছে ভালোই। মাস্টার্স শেষ করে কোথাও কোনো সুবিধা করতে না পেরে ঢাকাতেই একটি প্রাইভেট কলেজ দিয়ে বসেছে। দারুণ ব্যবসা। বাংলাদেশে এই একটি ব্যবসা, যেখানে কোনো ঝুঁকি নেই।  
– এভাবে বলছো কেন? সারাবিশ্বই তো শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করছে। 
– তা অবশ্য মিথ্যে বলোনি। বিশ্ব জুড়েই শিক্ষা নিয়ে এ ধরনের গলাকাটা ব্যবসা চলছে। বাংলাদেশে তো কমই, বহির্বিশ্বে আরো বেশি। তুমি তো অনেককিছুই বলতে পারো, বলোতো, অস্ট্রেলিয়ায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কত?
– কত?
– তুমিই বলো না। তুমি তো সবজাস্তা।
–আমি বলতে গেলে একটু সময় লাগবে। গুনে বলতে হবে। 
– তাহলে থাক, আজাইরা পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই। আমিই বলি, অস্ট্রেলিয়ায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার।
– আড়াই হাজার! বলো কী!
– এবার বুঝো ওখানে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
– এই আস্তে চালাও। এমন ব্যস্ত রাস্তায় আরো সতর্ক হয়ে টার্ন করতে হয়। গাড়ি কি তুমি কিনেছো?
– আর কার হবে?
– তাহলে তো তোমার বেশ উন্নতিই হয়েছে বলা যায়। চাকরি নিলে কখন?
– বছর দুয়েক হলো। অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেই ঢুকেছি।
– অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলে নাকি!
– গিয়েছিলাম মানে!  স্কলার্শিপ নিয়ে পুরো পাঁচ বছর কাটিয়ে এসেছি। দেশে এসেই গাড়িটা কিনলাম। গাড়ি দেখে আব্বা খুব খুশি হয়েছিল। 
– ভালো কথা মনে করেছ, বাসায় খালাম্মা-খালু তাঁরা ভালো আছে তো?
– তাঁরা কেউ নেই।
– কী বলছো!
– আব্বা ইন্তেকাল করেছেন প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। আব্বার পরপরই আম্মা চলে গেলেন।
– নাসিমা, আশা, ওরা?
– ওদের দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। নাসিমার জামাই আইটি বিশেষজ্ঞ। ওরা কানাডায় থাকে। 
– আর আশা!
– আশা অধ্যাপনা করে।
– কোথায়?
– সরকারি বাংলা কলেজে। 
– বাহ! গুড নিউজ তো, কত লেগেছে?
– আর বলো না। এখানেই মরেছি। দু দুবার বিসিএস ভাইভায় পর্যন্ত যেয়ে বাদ পড়েছে। একে তো কোটার হিসাব তারউপর আবার রাজনীতি। সবমিলিয়ে সরকারির চাকরির আশা ছেড়েই দিয়েছিল, শেষে আমার পত্রিকার প্রকাশক আলহাজ্ব বাবুল হোসেন এমপি মহোদয় হেল্প করলেন। তারপরও দশ লক্ষ গুণতে হয়েছে।
– দশ লক্ষ! এত!
– দশ লক্ষ শুনে যেভাবে লাফিয়ে উঠেছো, তাতে তো মনে হচ্ছে দেশ সম্পর্কে তুমি কোনো ধারণাই রাখো না, ঘটনা কী? কোথায় ছিলে এতদিন?
– বলব, সবই বলব। এখন তোমার কথা আগে শেষ করো। আশা তো শিক্ষকতা করছে, সরকারি চাকরি ভালো বেতন, আর ওর জামাই?
জামাই রাজনীতি করে। ঢাকাতেই এক ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক।
– কোন দল?
– বিএনপি।
– তবে তো বড় নেতা-ই।
–বড় নেতা হয়েই তো ঠেকছে। একশো সাতাশটা মামলা মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে আছে। ধরা পরলেই বিপদ। ডাইরেক্ট গুলি করে দেবে। 
– বলো কী! এ অবস্থা!
–যে অবস্থায় আছি, বলার মতো না। সারাক্ষণ একটা টেনশনে থাকি। কখন জানি কী ঘটে যায়!
–টেনশন করো না। সরকার বদল হলে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
–সরকার বদল! হাসালে তুমি। এসেছ যখন থাকো কিছুদিন, টের পাবে, বাংলাদেশে কেমন দুর্দিন যাচ্ছে। 
–এ আর নতুন কী বলবে, তোমাদের বাংলাদেশে চিরকালই দুর্দিন ছিল। মুষ্ঠিমেয় কজন ছাড়া আর সবাইকে দাঁতে কামড় দিয়েই বাঁচতে হয়েছে। সুখ-সমৃদ্ধি কী জিনিস, এ জাতি কোনোকালেই দেখেনি। আবার আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তোমরা প্রতিশোধ পরায়ণও নও। যুদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিংবা হুট করে কিছু করে ফেলা, এসব এ জাতি কোনোকালেই পছন্দ করেনি। এমনকি একাত্তরেও না। একাত্তরে আমি দেখেছি হাতেগোনা কজন ছাড়া আর সবাই পর্যবেক্ষণের পথকেই বেছে নিয়েছিল। 
–তাই নাকি! কারণ?
–কারণ অনেকগুলোই ছিল, তবে উল্লেখ করার মতো কারণটা হলো, তারা বুঝে ফেলেছিল যে, এই যুদ্ধ তাদের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের জন্যে নয়, ওটা ছিল অন্য একটা বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যে। এবং শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছিল। যুদ্ধের গতি জনগণের দিকে মোড় নিতেই তড়িঘড়ি করে ইতি টেনে ফেলল। আর জাতি হয়ে গেল অপাংক্তেয়, হয়ে গেল হাতে তুলে খাওয়ানোর অবুঝ। হাতের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তোমাদের। 
– মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকেই এভাবে বিশ্লেষণ করে থাকে। কতটুকু প্রমাণসিদ্ধ তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। তবে এটা ঠিক, সত্যিই আমরা অবুঝ হয়ে গেছি। আমাদের কারো কিচ্ছুটি করার নেই। যা করার কেবল সরকারের। সবকিছুতেই সরকার এমন এক কর্তৃত্বশীল ভ’মিকা জারি করে রেখেছে। ফলে মানুষ নিজে থেকে কিছু করতে পারছে না, ভয় পায়। গায়ে মশাটা বসলে পর্যন্ত হাত লাগাতে সাহস পায় না, সরকারের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফলে চাহিদার তুলনায় পায় মাত্র দোআনা, বাকি চৌদ্দআনার জন্যে থাকে অপমান আর খোটা।
– এটাই হওয়ার কথাছিল। শেখ মুজিবও এটাই চেয়েছিল। শেখ মুজিব অবশ্য আরও বড়কিছু চেয়েছিল, মুজিব চেয়েছিল প্রভু হয়ে বসতে। বাংলা-বাঙালির প্রভু। প্রভু হতে হলে তার একটা ধর্ম লাগে। যেমনটা ছিল লেনিন-স্টালিনের, যেমনটা ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর, মাও-এরও একটা ধর্ম ছিল, ছিল কামাল পাশারও। ধর্ম ছাড়া প্রভুত্ব দাবি করা চলে না। আর প্রভু না হতে পারলে অনন্তকাল টিকে থাকাও সম্ভব নয়। এজন্যেই সব এজেন্ডা পায়ে ঠেলে দিয়ে মুজিব বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিল। তোমাদের জানা উচিত, বাকশাল ছিল একটা ধর্মের নাম। যে ধর্মের প্রভু শেখ মুজিব। এ ধর্মে মুজিবের কথাই সব। কুন ফায়াকুন। এর ব্যত্যয় ঘটানোর ক্ষমতা কারো ছিল না। সে সবকিছু করবে, যা ইচ্ছে করবে। যাকে ইচ্ছে দেবতা ঘোষণা করবে, যাকে ইচ্ছে শাস্তি হিসেবে পাঠিয়ে দেবে নরকে। আর এখানেই মহাপ্রভুর সাথে তার দ্বন্দ্বটা বেঁধে গেল। মহাপ্রভু দেখল মুজিবের কিছু কিছু পদক্ষেপ ঘুমের বেঘাত ঘটিয়ে দিচ্ছে, হয়তো কোনো একসময় তালগোল পাকিয়ে বিপদেই ফেলে দেবে। ফলে তিন বছরের ঘোলাপানিতে আলকতরাই ঢেলে দিলো, শেষে কেউ কিচ্ছুটি দেখতে পেল না। না বাকশাল না জনগণ। ফাঁকে নাই হয়ে গেল মাছ।  
– তাহলে জিয়া?
– জিয়া ছিল আরো বিধ্বংসী। জিয়া শেখ মুজিব থেকেও শক্তিশালী ছিল। জিয়ার সামরিক শক্তির সাথে যোগ হয়েছিল আরেকটা শক্তি। যার নাম আতরগন্ধ। যা ছিল মহাপ্রভুর কাছে বাকশাল থেকেও আতঙ্কের। মহাপ্রভু বুঝে গেল এই গন্ধটা বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে, তার পরিণতি অনিবার্য। অতএব ওটাকেও দূর করতে হবে। শুরু হলো আতরগন্ধ দূর করার পালা। যেখানেই ওটা নাকে এসে ধাক্কা খায়, সেখানেই তার প্রতিনিধিরা দশহাতে ময়লা-আবর্জনা নিয়ে নেমে পড়ে এবং এ ক্ষেত্রে যে-ই বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তার গায়েই ছিটিয়ে দেয় যত ময়লা আবর্জনা।
– তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো, জিয়াকে তারাই হত্যা করেছে!
– শুধু জিয়া নয়, এরশাদকেও করতো। এরশাদের শরীরেও আতরগন্ধ ছিল। কিন্তু যখন দেখল সে একটা মেরুদÐহীন। ক্ষমতা নয়, ভোগের দাস। ভোগের শর্তে ক্ষমতা একবার নয়, সত্তরবার ছেড়ে দিতে রাজি এবং তাই করলো। খালেদা-হাসিনা ঘুরে দাঁড়াতেই এরশাদ কোনোপ্রকার প্রতিরোধ ছাড়াই ক্ষমতা থেকে নেমে গেল। মহাপ্রভুও তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ রাখল খালেদা-হাসিনার উপর। তারা রমণী। রমণী মাত্রই প্রসাধনী-পারফিউম ইত্যাদি প্রিয়। আতর নয়, প্রসাধনী-পারফিউমই তাদের শরীর রক্ষার মহৌষধ। তারপর থেকে খালেদা-হাসিনা মানে মহাপ্রভুরই রাজত্ব। আতরমুক্ত সরকার ব্যবস্থা।
–আচ্ছা বাদ দাও এসব। নিজের কথা বলো। কোথায় ছিলে, ওটা বলো।সিজ্জিল তখন কী যেন ভাবে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলেĮ
–জেলে, জেলে ছিলাম।
–জেলে! তোমাদেরও জেল-পুলিশ আছে!
–থাকবে না কেন, তোমাদের থাকলে আমাদের থাকবে না কেন? তুমি কি আমাদেকে গরু-ছাগল মনে করো নাকি?
–না, তা হবে কেন?
– তাহলে জেনে রাখো, তোমাদের যা আমাদেরও তাই নিয়ম-নীতি। পার্থক্য শুধু এই, তোমরা আমাদেরকে দেখতে পাও না।
– আরো আছে।
– আর কী!
–আমরা মানুষ তোমাদের মতো বহুরূপ ধরতে পারি না।
– কে বলেছে? তোমরা আমাদের চেয়ে হাজারগুণ বেশি ছদ্মবেশী। এবং কৌশলীও। আমাদের বেশ ধারনের মধ্যে আমাদের সমাজে কোনো গোপনীয়তা বা ছলনা থাকে না। সবকিছু সবার কাছে স্পষ্ট। কিন্তু তোমরা বড়ো ধূর্ত। তোমাদের ছদ্মবেশ কেউ ধরতে পারে না। এমনকী আমরাও না।
– আচ্ছা বাদ দাও ওটা, এখন বলো জেলে ছিলে কেন? কী করেছিলে?
– খুন করেছিলাম।
– খুন! তুমিও খুন করতে পারলে?
–কেন পারব না?
– তোমার মতো একজন জ্ঞানী-গুণী খুনের আসামী হয়ে জেল খাটবে, এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে!
– এটা কোনো কথা হলো না, খুন করার প্রয়োজন হলে পীর-দরবেশ, জ্ঞানী-গুণী সবাইকে খুনী হতে হবে। ডারউইনের একটা থিউরি আছে, সারবাইবেল অবটা ফিটেস্ট। টিকে থাকাই সার, সেটা যেভাবেই হোক।
– তাহলে তেলাপোকা টিকে আছে কীভাবে, সেও কী খুন করে?
–তেলাপোকাও যুদ্ধ করেই টিকে আছে। তার যুদ্ধ মরণে। সে মরতে মরতে টিকে থাকে। একজনের প্রস্থানে হাজারটা জন্ম দিয়ে যায়। যেমন তোমরা, তোমরা মরতে মরতে টিকে আছো। এত মার এত শোষণ-নির্যাতনের পরও তোমরা টিকে আছো, দিনদিন তোমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ওটাই তোমাদের জয় এবং টিকে থাকা। যাক এসব। একদিনে সব কথা ফুরিয়ে কাজ নেই। এবার অনেকদিন থাকব। প্রতিদিনই কথা হবে। এখন তোমার কথা বলো। তোমার অবস্থা কী, বিয়ে-টিয়ে নিশ্চয় এতদিনে–
– এবার ঠিক জায়গায় হাত দিয়েছো। এ ক্ষতই কুরে কুরে খাচ্ছে…
– বুঝলাম না। স্পষ্ট করে বলো।
– তুমি যে কী, সব বুঝ এটা বুঝো না!
– এটা আবার কেমন কথা! সব বুঝবো কী করে? আমি কি সবজান্তা আল্লাহ? খোদা?
–তোমাকে জানাবো সে সাধ্য কী আমার আছে? আমি মাটির মানুষ। তোমার মতো গতি থাকলে এক নিমিষে জানিয়ে আসতাম। বরং তোমারই উচিত ছিল এত বছরের মধ্যে একবার হলেও আমার খবর নেওয়া। সেই যে আমিও পরীক্ষার হলে ঢুকে গেলাম আর তুমিও হাওয়া হয়ে গেলে। তোমাকে খবর দেব সে ক্ষমতা কি আমার ছিল কখনো? অতঃপর তোমাকে ছাড়াই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো। তারপর বছর পেরুতে না পেরুতেই ট্র্যাজেডি।
– ট্র্যাজেডি! কিসের ট্র্যাজেডি?
– ও আমাকে রেখে চলে গেছে।
– কোথায়?
– কবরে।
– কবরে! কী হয়েছিল?
– লিভার সিরোসিস।
– সরি বন্ধু। অসময়ে তোমাকে দুঃখ দিলাম।
– সরি বলতে হবে না। তুমি এসেছ ভালোই হয়েছে। সারাক্ষণ মন মরা হয়ে থাকি। কোনো কিছুতেই ভালো লাগে না। বাইরে যদিও একটা ঝলমলে ভাব দেখতে পাচ্ছো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি বড় নিঃসঙ্গ। এখন তোমাকে পেয়েছি আর ভাবনা নেই।
– কেন, মেয়ে কি আর নেই? ভালো একজন দেখে বিয়ে করে নিতে পারতে?
– দেখেছি অনেক, মন মতো হচ্ছে না বলেই করিনি। এখন তুমি এসেছ, আশা করছি সব ঠিক হয়ে যাবে।
– তাহলে তো সত্যিই তোমার দুর্র্দিন যাচ্ছে। আচ্ছা, ভেবো না। এসেই যখন পড়েছি, তখন তোমার একটা গতি করেই যাব। এখন বলো চাকরির বাইরে আর কী করো, নাকি নিঃসঙ্গতা ঢাকতে এখনো আগের মতোই বন্ধুদের সাথে তাস পেটিয়ে বেড়াও।
– তোমার তো দেখছি সবই মনে আছে। না, ওসব আর এখন জমে না। মাঝেমধ্যে সিদ্দিক কামালরা আসে বটে, তবে ওরকমভাবে আর হয়ে ওঠে না। আমার সংসার না থাকতে পারে, ওদের তো আছে। মাঝেমধ্যে আসে, কিছুক্ষণ গালগল্প হয়। তবে আমিও যে ব্যস্ত ছিলাম না, তা নয়। একটা অনলাইন পোর্টাল খুলেছিলাম। নিজে যা বুঝি প্রকাশ করতাম, সমমনা চিন্তাশীলরাও লেখা-টেখা পাঠাত, এভাবে পরিচিত মহলে একটা সাড়া-ই পড়েছিলো বলা যায়, পরে মনে হলো যেকোনো সময় বিপদে পড়ে যাব। সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, যেকোনো সময় দুষ্ট হ্যাকাররা আমাকে বিপদে ফেলে দিতে পারে। তাই বন্ধ করে দিলাম। এখন চাকরির খাতিরে কিছুটুক-টাক লিখলেও সত্তরবার ধুয়ে-মুছে নিই।
– এটা ভালো করোনি। কৌশল করে হলেও ওটা ধরে রাখার দরকার ছিল। এত ভয় পেলে চলে? তাছাড়া এটাও জেনে রেখো, দানব যতোই সর্বভুক হোক, বেঁচে থাকার তাগিদে সেও খাবার জিইয়ে রাখে। 
–এদ্দূর কৌশল এখনো করছি বটে। একটু-আধটু রেখে-ঢেকে গল্প লিখে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে বেশ কটা বইও প্রকাশ হয়ে গেছে।
– তাই নাকি! কী ধরনের বই?
– গল্পগ্রন্থ একটি, তিনটি উপন্যাস, দুটি প্রবন্ধের। 
– মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু লেখেছো?
– না, ওটার মধ্যে আর রস নেই। সুবিধাভোগীরা ওটাকে চিবুতে চিবুতে এমনই চোবড়া করে ফেলেছে, এখন তা কারো সামনে পরিবেশন করতে গেলে নাক-মুখ চেপে ওঠে যাবে। 

–কী বলছো, এতোই পানসে করে ফেলেছে!
– হুজুগে বলতে বাঙালির একটা দুর্নাম আছে না? ওটা কি এত সহজেই মুছে যাবে? যেই তারা বুঝে গেল, সরকার টিকে গেছে। আর তখনই ওঠে পড়ে লেগে গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। বছর পেরোতে না পেরোতেই কয়েকহাজার বই লেখা হয়ে গেছে। যার পঁচানব্বই ভাগই অখাদ্য কুখাদ্য। চরিতচর্বণ এবং আবেগপ্রবণ। আবার এসব লিখেই শেষ না, প্রতিটি বইয়ে উচ্চ দাম লিখে পাঠক বা সাধারণ মানুষকে গিলতে নানাভাবে বাধ্য পর্যন্ত করেছে কেউ কেউ। ফলে মানুষ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠে। এ অবস্থায় আমি ভালো কিছু লিখলেও পাঠক সমাজ ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখবে বলে মনে হয় না। ভাববে আমিও বুঝি ধান্ধাবাজি শুরু করে দিয়েছি। আবার ওটারও ভয় আছে। ভালো কিছু করতে গেলেই বস্তুনিষ্ঠ লিখতে হবে, তখন দেখা যাবে অনেকেরই তলা ফুটো হয়ে গেছে। তখন শুরু হবে আরেক বিপদ। রাজাকার তকমা দিয়ে ঢুকিয়ে দেবে চৌদ্দ শিকে। এমনিতেই ইতোমধ্যে অনেককিছু ফুটো হয়ে গেছে। আমেরিকা থেকে শর্মিলা বসু নামে এক ভদ্র মহিলা  না ডেড রেকনিং মে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এক বই লিখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। যে শাঁখারীবাজারের গণহত্যার বর্ণনা শুনে এতদিন বেদনার্ত হতাম, এই মহিলা দেখালেন, সেখানে গণহত্যা তো দূরের কথা কেউ আহতও হননি। এখানেই বুঝো কতবড় গলদ হয়ে গেছে আমাদের গবেষণায়। শুধু এখানেই নয়, তিনি হাত দিয়ে বসেছেন শহিদদের সংখ্যার হিসাবেও। ত্রিশ লক্ষ শহিদ হয়েছে বলে এতদিন যে তথ্য আমরা জানতাম, এই ভদ্র মহিলা এসে এমনসব তথ্য ও রিপোর্ট বের করেছেন, রীতিমতো সকলেই চক্ষুচড়কগাছ। 
– কী বলছো তুমি! এই বই মার্কেটে আছে?
– এতক্ষণ তাহলে কোন আশঙ্কার কথা শোনালাম! এই বই মার্কেটে থাকতে পারবে! ওটা অনুবাদ হয়ে আমেরিকা থেকে আসার আগেই ব্যান হয়ে গেছে।
– এই দাঁড়াও। আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও।
– কেন, বাসায় যাবে না?
– এখন নয়। রাতে দেখা হবে।
– রাত মানে এগারটায় তো!
– হুম, তুমি জানলে কী করে!
– আর বোলো না, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঝামেলা বোধহয় আবার ঘাড়ে চেপে বসতে যাচ্ছে। একটা জটাধারী সন্ন্যাসী দীর্ঘদিন ধরে আমার বাড়িকে ফলো করছে, তার মতিগতি দেখে তো অনেকটা ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম বলা যায়। পরে জানলাম, সে কিনা আমার বাড়িতে একজন জ্বীনকে খুঁজে পেয়েছে, আর সে জ্বীন কিনা অন্যদিনের মতো আজকেও আমার বাড়িতে আসবে। সন্ন্যাসী তাকে ধরতে চায়।
– বিষয়টা আমি জানি। 
– জানো! তুমি চেনো তাকে?
– হুম।
– তাহলে!
– আসতে দাও। আমিও তাকে খুঁজছি। শালা বেটাকে আজকেই একটা কিছু করে ফেলব।
– একটা কিছু করে ফেলবে মানে! কী করবে!
– খুন।
– কী বলছো! তুমি কি আমাকে জেলে পাঠাতে চাও নাকি?
– এত ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তো আছি, নাকি?
– না, বিষয়টা বেশ গোলমেলে লাগছে। তুমি এখনই বাসায় চলো, বিষয়টা আগে আমাকে খোলাসা করে বলো, তারপর অন্য কোথাও যেয়ো।
– আচ্ছা, ঠিক আছে। আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে যাও। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসব।
– এসো কিন্তু। আর আমাকে না জানিয়ে লোকটাকে কিছু করতে যেয়ো না।
– আচ্ছা।

সিজ্জিল-প্রথম পর্ব

শাদমান শাহিদ

কথাশিল্পী। বসবাস, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাংলাদেশ।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top