।। পীযূষকান্তি মুখোপাধ্যায় ।।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যশিল্প শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট অ্যাণ্ড ক্র্যাফটস প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার বাংলার শিল্পচর্চা অন্য খাতে বইবার পথ পাকা হয়ে যায়। চিরাচরিত শিল্পচর্চার পর্বটি চিরদিনের মতো স্তব্ধ হয়ে যায় এই অর্থে যে লোকজীবনের বিশেষত গ্রামে দৈনন্দিন লোকজীবনের সাথে শিল্পীর অংশগ্রহণ ও শিল্পচর্চার যে সুযোগ ও প্রথা ছিল তার আর অস্তিত্ব থাকল না। এরপর লোকশিল্পের কিছু ধারা বিংশ শতাব্দী অবধি বাংলার গ্রামেগঞ্জে টিকে ছিল যেমন পট, সরা, মুখোশ, মৃৎশিল্প (পাঁচমুড়া, কেঁদরা), চিত্রিত তাস, ইত্যাদি যেগুলির কোন কোনওটি একবিংশ শতাব্দীতেও কোথাও কোথাও ক্ষীয়মাণ অবস্থায় টিকে আছে। কিন্তু পারম্পরিকশিল্প ব্যতীত উচ্চমার্গের যে শিল্পচর্চা যেমন শাস্ত্রীয়ও মিশ্র ঐতিহ্যের বাংলার নিজস্বতা নিয়ে প্রবহমান ছিলো তা বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই চিরদিনের মতো বিদায় নিয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের তথাকথিত পুনরুজ্জীবনবাদী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলার সেই ধারার পুনরুজ্জীবন আর ঘটে উঠল না।
শিল্প ও সমাজ : কিছু প্রাথামিক কথা
ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমান বঙ্গভাষী ভূখণ্ডের এলাকায় মানুষের যাত্রাপথে শিল্পের সাথে সমাজের সম্পর্ক বিষয়টি কালানুক্রমিকভাবে যদি স্মরণ করি তবে দেখব যে মানুষ যখন আদিবাসী পর্বে ছিলেন তখন নিশ্চিতভাবে তার অঙ্গভঙ্গি, মুখের অভিব্যক্তি, হাতের মুদ্রা, বিভিন্ন প্রকারের কণ্ঠনির্গত ও শরীরের বিভিন্ন অংশে হাতের চেটো বা তালু দিয়ে আঘাত করে যে সব ধ্বনি ও শব্দ তৈরি হত, সেগুলিই তার শিল্পমাধ্যমে ছিল। অন্য সবজায়গার আদিবাসী সমাজের মতোই। অন্যত্র যেমন, এখানেও নিশ্চয়ই তেমন-ই অঙ্গভঙ্গি, মুখের অভিব্যক্তি ও মুদ্রা থেকে নাচ ও নাট্যকলা; ধ্বনি ও শব্দ থেকে বাচ্যভাষা এবং সঙ্গীতের উৎপত্তি হয়েছে। মানুষরা আদিবাসী-উপজাতি পর্যায়ে থাকাকালীন সময়েই।
বাচ্যভাষা তৈরি হওয়ার পরে এসেছে সাহিত্য বিশেষত অন্তমিলযুক্ত ও ছন্দোময় কাব্য। কাব্য, সঙ্গীতকে পুষ্ট করেছে বাণী দিয়ে। বাংলার সীমায় নাটক ও নাচ দৃশ্যশিল্পের প্রথম অভিব্যক্তি না কি তারও আগে বা তাদের সাথে একই সময়ে কারুনকশার মাধ্যমে শিল্পকলা আবির্ভূত হয়েছিলো তার কোন প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ খুব সম্ভবত নেই।
দৃশ্যশিল্পের মধ্যে কারুনকশার প্রথম প্রমান পাওয়া যায় পাণ্ডুরাজার ঢিবি প্রত্নক্ষেত্র থেকে। মাটির কৌলালের গায়ে যে কারুনকশা পাওয়া যায় তাতে কাটাকুটি চিহ্ন দিয়ে আঁকা জালের মতো নকশা, মাছের চিত্র অঙ্কন, প্রভৃতি পাওয়া গেছে। এসবই খ্রিষ্টের জন্মের পনরো-ষোলো শত বছর আগেকার ব্যাপার। তারপর মাটির টেপা পুতুলের হাতে ধরে মাটির ভাস্কর্য এসেছে।
বুদ্ধের প্রায় সমসাময়িক সময়ে থেকে যেসব বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠতে থাকে পুণ্ড্রেও রাঢ়ে তাকে আশ্রয় করে প্রথম পোড়ামাটির স্থাপত্য অনুসারী (Architectonic) শিল্পকৃতির সুত্রপাত হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। বাংলার সেই প্রথমযুগের কোন শিল্পকৃতির কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ আছে কি না তা জানা নেই। তয়ে অন্ততপক্ষে কোনও ভিত্তি ভাস্কর্যের প্যানেল বা দ্বারের খিলানে কোনও ভাস্কৰ্য গড়ে ওঠে নি তা নিশ্চিত। কেবলমাত্র কিছু ধর্মীয় চিহ্ন এবং ফুললতাপাতার আলঙ্কারিক নকশা কিছু হয়তো বানানো হত। এইসব স্তূপ, বিহার, সঙ্ঘারাম তৎকালীন শিল্পীদের নিজেদের গড়া প্রাথমিকস্তরের শিল্পকৃতিগুলি সমাজের কাছে তুলে ধরার মাধ্যম বা মঞ্চ ছিল।
পরবর্তীকালে বিভিন্ন উত্থানপতনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে চন্দ্রকেতুগড়ের নগরসভ্যতায়, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় শতক অবধি সময়কালে-নগরসভ্যতার প্রয়োজনে টেরাকোটা মৃৎফলক ও ভাস্কর্যের যে জোয়ার এসেছিল তা তাম্রলিপ্তির মৃৎশিল্পের কেন্দ্রগুলি থেকে বেড়াচাপা চন্দ্রকেতুগড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে শুধু পড়ে না, বাণিজ্যিক উৎপাদনের বিরাট বড় কেন্দ্রে পরিণত হয় চন্দ্রকেতুগড়। বিশেষ করে উল্লেখ করার মতো বিষয় হল তাম্রলিপ্তে এবং চন্দ্রকেতুগড়ে ছাঁচের মাধ্যমে শত শত শিল্পীর মৃৎফলক ও মূর্তি পাইকারীহারে উৎপাদন করা হত বাণিজ্যিক চাহিদাকে সামাল দিতে। এখানে শিল্পীরা অচেনা অদেখা ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে প্রচুর উৎপাদন করতেন। পটচিত্রও সেইসঙ্গে তৈরি হত এমনটা অনুমান করা অমূলক হবে না।
এরই মধ্যে অত্যন্ত সুসংবদ্ধ সামাজিক গোষ্ঠী হিসাবে বাংলার বিখ্যাত সূত্রধর গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে গেছে। যাঁদের জানা নেই তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলা যায় যে সুত্রধররা কৌমসমাজ থেকে উদ্ভূত এমন একটি গোষ্ঠী যাদের মধ্যে থেকে ‘সুত্রধর’ নামক পেশাদার গড়ে উঠত। একজন সুত্রধর এমন একজন মানুষ, যিনি একাধারে কাঠমিস্ত্রী, ধাতুশিল্পী, রাজমিস্ত্রী, কারুশিল্পী, চারুশিল্পী, গণিতবিশারদ, প্রকৌশলী, স্থপতি, বাস্তুশাস্ত্রী, কাব্য-ছন্দ-অলঙ্কার বিশারদ, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। শুধু তাই নয়, তিনি কাঠ, পাথর, ধাতু ও মাটি এই চারটি মূল শিল্প উপকরণ ও শিল্পমাধ্যমের উপাদান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। প্রতিটি করণ (Tool) তিনি নিজে হাতে বানাতে জানেন এবং সেসমন্ধেও উচ্চ জ্ঞানের অধিকারী। সূত্রধর কেবলমাত্র একজন পুরুষই হতে পারতেন, এহেন সুত্রধর গোষ্ঠীতে একজন প্রধান সূত্রধরের অধীনে কয়েকজন সুত্রধর এবং শিক্ষানবিশ স্তরে থাকা আরও কিছু যুবক কিশোররা থাকত। এঁরা একটি পারবারিক গোষ্ঠী এবং পূর্ববর্তী যুগের (বুদ্ধের সময় থেকে মৌর্য্যযুগ পর্যন্ত) কারিগর ও অন্যান্য বিভিন্ন পেশাদারদের যে গিল্ডগুলি ছিল, তার ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। গিল্ডের সাথে এদের পার্থক্য হল যে এঁরা একটি-ই মাত্র পারিবারিক গোষ্ঠী, কিন্তু অনেক পারিবারিক গোষ্ঠীর লোকরা গিল্ডে থাকতেন। এই সূত্রধররা বড়-মাঝারি মন্দির, বিহার ইত্যাদি বানাতেন, তবে তাঁরা কিন্তু পোড়ামাটির ছোট ছোট ফলক, বা ছোট ছোট ভাস্কর্য বানাতেন না যেগুলি একটি একটি করে বিক্রি হতো। সেগুলি ‘রূপদক্ষ’ বা ভাস্কররা বানাতেন ও বানিয়ে বিক্রয় করতেন। বড়ো স্থাপত্যের পরিকল্পনার অর্ন্তগত বিভিন্ন রিলিফ প্যানেল বা অন্যান্য মুক্ত (freestanding) যে সব ভাস্কৰ্য থাকত কেবলমাত্র সেগুলি-ই সূত্রধরেরা গড়তেন।’
এই সময়কাল থেকে খ্রিষ্টিয় অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলার শিল্পী ও সমাজের আন্তঃসম্পর্কে কোন মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। শিল্পীরা হয় রাজন্যপৃষ্টপোষণায় বিভিন্ন স্থানে বহুবিঘা জমির বড় বড় স্টুডিও বানিয়ে সেখানে বাস করেছেন ও কাজ করেছেন। অথবা স্বাধীন শিল্পী হিসাবে গিল্ডের সাথে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন। সূত্রধরেরা কখনো স্বাধীনভাবে, আবার রাজন্যের বরাত দেওয়া অজুরা পেলে রাজদত্ত রাজকীয় স্টুডিও ব্যবহার করে শিল্পসৃষ্টি করেছেন। যখন শিল্পীভাস্কররা নগরের খোলাবাজারে বিক্রির জন্য শিল্পকর্ম সৃজন করেছেন তখন অজ্ঞাতপরিচয় ক্রেতার জন্য সৃষ্ট শিল্পকর্ম নিজের পছন্দমাফিক, নিজকে খুশী করতে সৃষ্টি করেছেন। আর অজুরার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট অজুরাদাতার রুচির, পছন্দের ছাপ পড়েছে শিল্পকর্মে। বিশেষতঃ বিষয়নির্বাচনে। গ্রামজীবনে প্রতিটি পালাপার্বণে ধর্মীয়জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকতেন শিল্পীরা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরাজদের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার আগে পরে এই ব্যবস্থা জোর ধাক্কা খায়। তার প্রতিক্রিয়ায় বাংলার ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় থেকে (ইং – ১৭৬৯-১৭৭১খ্রীঃ) তৃতীয় / চতুর্থ দফার মন্দির তৈরির যে তরঙ্গ আসে, যখন পূর্ববর্তী তরঙ্গগুলির মতোই সারা বাংলা জুড়ে শত শত মন্দির তৈরি হতে শুরু করে তার রেশ-চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩ খ্রিঃ)-র ফলে নতুন বাহির্বাসী, নব্যধনী, ভূমিপুত্র নয় এমন জমিদার; প্রজাদের প্রতি যাদের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি ছিল না, তাদের অস্তিত্ব সত্ত্বেও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় গোটাটা জুড়ে চলতে থাকে।
কিন্তু প্রদীপ নিভবার আগে যেমন শেষদীপ্তি নিয়ে শেষবারের মতন জ্বলে ওঠে এটা যেন সেইকরম ঘটনা ছিল। আসলে ঊনবিংশ শতাব্দীতেই বাংলার শহর ও গ্রামজীবনে এমন পরিবর্তন ঘটলো যাতে গ্রামের লোকায়ত জীবনের সাথে শিল্পীদের যে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা বন্ধন ছিল তা ভেঙে পড়ল। কী গ্রামে কী নগরে-শহরে দেশীশিল্পীদের মিশ্রিত দেশীশিল্পধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র বলতে শুধুমাত্র নির্ণীয়মান কিছু মন্দিরগুলির টেরাকোটা ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রঙ দিয়ে আঁকা ভিত্তিচিত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে ক্রমে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য এই ঊনবিংশ শতাব্দীতেই নাগরিক পটের উত্থানও ঘটে কলকাতা নগরীতে। কালীঘাটে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠানে যখন শিল্পসৃষ্টি করতেন শিল্পীরা, তখন সেই ধর্মের প্রচারণা মুখ্য উদ্দেশ্য থাকত। ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় নিয়েও, যেমন জনজীবনের উপস্থাপনা ধর্মীয় স্থাপত্যে জায়গা করে নিত। যেখানে জনগণের ও পৃষ্ঠপোষাকের নান্দনিক চাহিদা মেটানো উদ্দেশ্য থাকতো। আর বাণিজ্যিক উৎপাদনের সময় জনগণের নান্দনিক রুচিকে সন্তুষ্ট করা শিল্পীর উদ্দেশ্য থাকত।
এদিকে আবার ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যশিল্প শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট অ্যাণ্ড ক্র্যাফটস প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার বাংলার শিল্পচর্চা অন্য খাতে বইবার পথ পাকা হয়ে যায়। চিরাচরিত শিল্পচর্চার পর্বটি চিরদিনের মতো স্তব্ধ হয়ে যায় এই অর্থে যে লোকজীবনের বিশেষত গ্রামে দৈনন্দিন লোকজীবনের সাথে শিল্পীর অংশগ্রহণ ও শিল্পচর্চার যে সুযোগ ও প্রথা ছিল তার আর অস্তিত্ব থাকল না। এরপর লোকশিল্পের কিছু ধারা বিংশ শতাব্দী অবধি বাংলার গ্রামেগঞ্জে টিকে ছিল যেমন পট, সরা, মুখোশ, মৃৎশিল্প (পাঁচমুড়া, কেঁদরা), চিত্রিত তাস, ইত্যাদি যেগুলির কোন কোনটি একবিংশ শতাব্দীতেও কোথাও কোথাও ক্ষীয়মাণ অবস্থায় টিকে আছে। কিন্তু লোকশিল্প ব্যতীত উচ্চমার্গের যে শিল্পচর্চা যেমন শাস্ত্রীয়ও মিশ্র ঐতিহ্যের: বাংলার নিজস্বতা নিয়ে প্রবহমান ছিলো তা বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই চিরদিনের মতো বিদায় নিয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের তথাকথিত পুনরুজ্জীবনবাদী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলার সেই ধারার পুনরুজ্জীবন আর ঘটে উঠল না।
কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের পরে নন্দলাল যে নতুন ধারাতে শান্তিনিকেতনে কাজ ও শিল্পশিক্ষা শুরু করলেন তার ধারাবাহিকতা তাঁর দুই বিখ্যাত শিষ্য রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারীর দ্বারা রক্ষিত হয়েছিলো। তাঁদের ছাত্রশিষ্যরা ও সহকর্মীরা যেমন সুরেন কর, বিনায়ক মাসোজী, কে.জি সুব্রক্ষ্যণন, এবং অন্যান্য শিল্পীরা এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কাজ করেছেন। যে কারণে এঁদের উল্লেখ এই প্রসঙ্গে করা হলো তা হচ্ছে নন্দলাল রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছাও সন্মতিক্রমে শিল্পকে ব্যাপক জনসাধারণের মধ্যে নিয়ে আসার প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে, উভয়ের দুরত্ব ঘোচাবার জন্য শান্তিনিকেতন আশ্রমের বিভিন্ন অংশে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনে ও ছাত্রাবাস-ছাত্রীআবাসে ভিত্তিচিত্র ও ভাস্কর্য সৃজনের একটি শিল্প আন্দোলন শুরু করেন। সোমনাথ হোড়ের মতো শিল্পী, যিনি এই ধারার শিল্পী ছিলেন না, কিন্তু আন্দোলন শুরু হওয়ার কয়েক দশক পরে কর্মসূত্রে শান্তিনিকেতনে থাকার সময়ে তিনিও চলমান এই আন্দোলনে যোগদান করেন ও কলাভবনে দু’টি ভিত্তিচিত্র সৃজণ করেন।
এঁরা এই উদ্দেশ্যে কোথায় কোথায় কি কি শিল্পসৃষ্টি করেছেন তা সর্বজনবিদিত ও বহুচর্চিত হওয়ার ফলে তার অনুপুঞ্জে প্রবেশ এখানে অনাবশ্যক।
বরং তার ফলাফল কী হল, সে বিষয় দু’একটা পর্যবেক্ষণ পাঠকদের সাথে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। এই আন্দোলনের ফলে, যাঁরা সেইসময় শান্তিনিকেতনে বাস করতেন, তাঁরা তাঁদের শান্তিনিকেতনের বাসগৃহে কলাভবনের শিক্ষক বা ছাত্রদের দিয়ে ভিত্তিচিত্র সৃজণ করাতে শুরু করলেন। এইভাবে তাঁরাও এই শিল্পআন্দোলনে যোগদান করলেন। ছাত্রদের ক্ষেত্রে তাঁরা ন্যূনতম একটা সাম্মাণিকও দিতেন খরচখরচার অতিরিক্ত। শুধু তাই নয়, নিজবাসগৃহে নিজে বা উদীয়মান ছাত্রশিল্পীদের দ্বারা ভিত্তিচিত্র ও ভাস্কর্য্যে শিল্পীত করাটা এখানে একটা প্রথার মতো হয়ে দাঁড়ালো, পরবর্তীকালে যাঁরা শান্তিনিকেতনে বসবাসের উদ্দেশ্যে বাসগৃহ বানালেন তাঁদেরও অনেক এই প্রথা অনুসরণ করলেন এবং এখনো কেউ কেউ করেন। পশ্চিমবঙ্গে আর কোনও শহরে এত বেশি সংখ্যার স্থাপত্য ভিত্তিচিত্র বা ভাস্কৰ্য্য শোভিত নয়। জানি না ভারতীয় উপমহাদেশে আর কোনও আধাশহুরে জনবসতি আছে কি না যেখানে এতো সংখ্যায়
শিল্পকর্মের নিদর্শন রাস্তায় চলতে চলতে প্রত্যক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ হিসাবে একটা কথা কিন্তু বলে রাখা ভালো যে, শিল্পকর্মের উচ্চমান সম্পর্কে মূল শিল্পীরা যেরকম অনমনীয় ছিলেন পরবর্তীতে ছাত্রশিল্পীরা যারা বিভিন্ন বাসগৃহে শিল্পসৃষ্টি করেছেন, তারা সেই উচ্চমান ধরে রাখতে পারেননি। তা তাদের পক্ষে সম্ভবও নয় কারণ তাঁরা তো শিক্ষার্থী।
পৃথিবীতে এরকম দু’টি নগর আছে বলে আমার জানা আছে, যেখানে প্রায় প্রতিটি স্থাপত্যে বাইরে শিল্পকর্ম বিশেষত ভিত্তিচিত্র প্রচুর আছে – তার একটি মেক্সিকো মহানগরী এবং অন্যটি চিলির ভালপারাইসো শহর। আজকালকার যুগে, শিল্পী ও সমাজের আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রটিতে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হস্তক্ষেপ এমন একটা ব্যাপক পৰ্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ (ধর্ম, বাজার, রাজনীতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) তার বিশেষত্ব দিয়ে, খুঁটিনাটি পদ্ধতি প্রকরণ দিয়ে শিল্পীকে বাঁধতে যে সব অপকৌশল প্রয়োগ করে তার চাপও যেন এমন তুঙ্গে উঠেছে যে শিল্পকে নিয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা যে কোন সৎশিল্পীর কাছে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাঁরা বাণিজ্যিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গ্যালারীর সাথে যুক্ত নন তাঁদের পক্ষে। শিল্পও সমাজ, গ্রন্থের গ্রন্থকার অ্যাডোলফো সানচেষ ভাকোয়েজ যখন তিনটি অধ্যায় পেরিয়ে যাওয়ার পর চতুর্থ অধ্যায় স্বীকার করেন যে শিল্প প্রায় মানুষের সমান প্রাচীন, অর্থাৎ প্রায় সমাজের সমান পুরোনো। – তখন তিনি বাস্তবতাকে প্রায় স্পর্শ করেন। এই বইটির আগের অধ্যায়গুলি আলোচনা প্রসঙ্গে একই কথা আমি এর আগে বারবার উল্লেখ করেছি। শিল্প হচ্ছে সেই জাদুকাঠি যা শুধুমাত্র একসঙ্গে বসবাসকারী মানুষদের দঙ্গলকে সমাজে রুপান্তরিত করতে সক্ষম।
শিল্প ও সমাজের সম্পর্কের আলোচনায় শিল্প ও শিল্পীদের পুঁজিবাদি ব্যবস্থা কর্তৃক সহযোজিত করা, উৎকোচ- প্রলোভন-অনাহার প্রভৃতির দ্বারা নিজেদের পক্ষে টেনে নেওয়ার বিষয়ে কিছুই আলোচনা করা হয়নি যা আজকের যুগে সততার সাথে শিল্পচর্চার একটা সমস্যা।
যখন শিল্প ও শিল্পীকে প্রচলিত ব্যবস্থা সহযোজিত করে, নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নেয়, শিল্প তার সামাজিক তাৎপর্য্য হারায়। যখন তা সহযোজিত হয় না, শিল্প ও শিল্পী সমাজনির্জিত বিচ্ছিন্ন ‘হয়ে একপাশে পড়ে থাকে এবং সমাজের কাছে পৌঁছবার কোন মঞ্চ পায় না।
পঞ্চম অধ্যায় লেখক যেমন বলেছেন-আসলে বোধহয় ঘটনাটা সেরকম নয়, সশ্লেষণে সক্ষম, মানে সাধারণ অদীক্ষিত শিল্পদর্শকের সাথে সন্বেষণে সক্ষম শিল্পভাষাটা বোধহয় আসল সমস্যা নয়। ব্রেখট এবং ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের মত অনুযায়ী জনগণ যেকোনও সৃজনধর্মী পরীক্ষণকে মেনে নিতে প্রস্তুত থাকেন, তা যতই নতুনরকমের হোক না কেন – যতক্ষণ তাঁরা তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা কোনও না কোনওভাবে সেই শিল্পকর্মটির মধ্যে খুঁজে পেয়ে মেলাতে পারেন। (ফ্রেডরিক) জেমসনের মত অনুযায়ী সহযোজনের সমস্যা বা ব্যবস্থা কতৃক শিল্পী ও শিল্পকর্মেক প্রচলিত ব্যবস্থয়ে শামিল করে নেওয়ার সমস্যাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আমি জেমসনের সাথে সহমত, শুধু সমস্যাটির আলোককেন্দ্র বা ফোকাস একটা বিশেষ ক্ষেত্রে হওয়া উচিত বলে মনে হয় তা হল সৎ শিল্প ও শিল্পীরা যাঁরা আধিপত্যকামী শৈল্পিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির বাইরে নিষ্ঠভরে উচ্চমানসম্পন্ন শিল্পচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন, ব্যাপক সমাজের কাছে পৌঁছবার জন্য একটি / একাধিক যথাযোগ্য অবাণিজ্যিক মঞ্চের অভাবের বিষয়েই ফোকাসটা হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়। পাশ্চাত্যে (ইউরোপে ও আমেরিকায়) জনগণ এই সমস্যাটি মোকাবিলার জন্য অনেকরকম চেষ্টা করেছেন যার মধ্যে শিল্পমেলার সূত্রপাত ঘটানোটা অন্যতম। এখন পাঁচটি মহাদেশের বেশিরভাগ রাষ্ট্রে সরকারী বা বেসরকারি উদ্যোগে শিল্পমেলা আয়োজিত হচ্ছে। কিন্তু আধিপত্যকামী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির হস্তক্ষেপের ফলে শিল্পমেলাগুলির চরিত্রও পরিবর্তিত হয়ে গেল। এখন সেগুলোও বহিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন পক্ষপাত, এবং সহযোজনের গ্যাঁড়াকলে পরিণত হয়েছে। ফলে, সত্যিকারের শিল্প ও শিল্পীর জন্য অবিচারের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদি কেউ বলেন যে শিল্পে দীক্ষিত নয় এমন মানুষজনের কাছে শিল্পভাষাকে গ্রহণযোগ্য হতেই হবে, তাহলে আবারও তা সার্বজনীনতার ওপরে বিশেষতার আধিপত্যের উদাহরণ ছাড়া আর কিছুই হবে না। মোটের ওপর শিল্পের একটা ভাষা আছে যেটা ধৈর্য্য ধরে শেখারও একটা ব্যাপার থেকেই যায়। প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে এমন একধরনের বোধ যাকে পরিশীলনের মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্পভাষার বেশ কিছু গুচ্ছ – যা সামূহিক এবং ব্যক্তিগত উভয়ধরনের-ই হতে পারে, তাদেরকে অধিগত করা যায়। আধুনিক শিল্পের ক্ষেত্রে, প্রত্যেক শিল্পী-ই তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিগত শিল্পভাষা সৃজন / নির্মাণ করেন যা আবার সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে। তাঁর একেবারে নিজস্ব (বিষয়ীগত) দৃশ্য অবধারণার অভিব্যক্তির প্রয়োজনে শিল্পী পৃথক ব্যক্তিগত দৃশ্যভাষা সৃজন করেন, যা নান্দলিক বোধ দ্বারা উন্মোচিত বা অর্থউদ্ধার করা হলে তার সার্বজনীনতা প্রকাশিত হয়।
সুতরাং দর্শকেরও নিজেকে পরিশীলিত, প্রশিক্ষিত করার একটা দায়িত্ব থেকেই যায়। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে গত পনেরো-কুড়ি বছর যাবৎ শিল্পীআবাস (Artist residency) বলে একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যার সম্পর্ক কিছু বলে রাখা প্রয়োজন আছে। শিল্পী আবাস এমন একটি ব্যবস্থা যাতে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে পরিকল্পিতভাবে তৈরী করা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট ছোট আবাস একক থাকে। একেকটি আবাস এককে স্টুডিওসমেত থাকার ও শিল্পচর্চার ব্যবস্থা থাকে। শিল্পচর্চার উপকরণ যথা ক্যানভাস, কাগজ, রঙ-তুলি, ইজেল, ভাস্কর্য্যগড়ার বিশেষ ধরনের স্টুল প্রভৃতি সবই উদ্যোক্তা সরবরাহ করেন। সাধারণতঃ বড় বড় গ্যালারী বা একাধিক গ্যালারীর সমূহ উদ্যোক্তা হয়। শিল্পীদের সেখানে থেকে কাজ করবার সুযোগ পাওয়ার জন্য আবেদন করতে হয়। দরখাস্তের সাথে সাম্প্রতিক কাজের বৈদ্যুতিন প্রতিলিপি বা ফোটোগ্রাফ পাঠাতে হয়। তার ভিত্তিতে শিল্পীদের একটি নির্দিষ্ট কালসীমার জন্য মনোনয়ন হয় (তিনমাস / ছয়মাস / একবছর)। খাওয়াদাওয়া ও অন্যকিছু খরচা বহন করে উদ্যোক্তা সংস্থা। আগে থেকে হওয়া চুক্তিমাফিক এক বা একাধিক শিল্পকর্ম মেয়াদ শেষে উদ্যোক্তাদের দিয়ে যেতে হয় শিল্পীকে।
উদ্যোক্তাসংস্থা সেই প্রদত্ত শিল্পকর্মগুলির নান্দনিক উপভোগের জন্য খুব কমসংখ্যক কাজ-ই ব্যবহার করেন, বেশিরভাগই ব্যবসায়িক কাজে লাগান। এই ব্যবস্থাতে সেইসব শিল্পীর পক্ষে কাজ করা সম্ভব, যাঁরা নির্দিষ্ট আবাসিক সময়ের মধ্যে, যতগুলি কাজ উদ্যোক্তাসংস্থাকে দিতে হবে তার চেয়ে বেশি কাজ করতে পারবেন। যাঁদের কাজ করতে একটু বেশি সময় লাগে তাঁদের পক্ষে এই ব্যবস্থা লাগসই হবে না। এই ব্যবস্থাতে শিল্পী সুন্দর এবং শিল্পচর্চার অনুকুল পরিবেশে থেকে শিল্পচর্চার সুযোগ পান। তাঁর শিল্পচর্চায় কেউ খবরদারী করে না, বা কারো কাছে তাঁর অনুমোদনও নিতে হয় না। তাঁর প্রয়োজনে তিনি যেকোন জায়গায় যেতে পারেন। উপরন্তু আরও কিছু সৃজণশীল শিল্পীর সাহচর্য্য তিনি চাইলেই পেতে পারেন।
এই মাগি-গণ্ডার দিনে বিনামূল্যে দামি-দামি উপকরণ যতখুশি ব্যবহারের সুযোগও নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু শিল্পীর জীবন এখানে জনজীবনের মূলস্রোত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকে। তাঁর নিজের গ্রাম / শহর / পাড়া এলাকা / পরিচিত গণ্ডীর সম্পূর্ণ বাইরে টবের গাছের মতো কৃত্রিম ব্যবস্থাপনা নির্ভর সামাজিক বৃত্তে তাঁকে কাটাতে হয়। আবাসে উদ্যোক্তাদের ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তি ও সংস্থাগত শিল্পসংগ্রাহকরা পায়ের ধুলো দেন। তাঁরা প্রতিটি শিল্পীর কর্মশালা বা স্টুডিও ঘুরে ঘুরে দেখেন। তাঁদের সাথে শিল্পীদের আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়। এতে শিল্পীদের অপরিসীম উপকার হয়। নতুন নতুন ব্যবসায়িক যোগাযোগ তৈরী হয়। যা শিল্পচর্চার নির্বিঘ্ন ভবিষ্যতের সুযোগ এনে দেয়।
এছাড়া কলা-সমালোচকদের কারো কারোকে আনা হয়। নিয়মিত আলোচনা সভা, শিল্পবিষয় অন্যান্য প্রদর্শন প্রভৃতি হয়।
কিন্তু যাঁরা ভূদৃশ্য (Landscape) নিয়ে কাজ করেন বা যাদের কাজ ধারণামূলক (Conceptual) তাঁদের পক্ষে সুবিধাজনক হলেও, নিয়মিত লোকালয়ে করা স্কেচ থেকে যাঁরা দৃশ্যকল্প সৃজন করেন (যেমন সমাজবাস্তববাদীরা) তাঁদের পক্ষে এরকম ব্যবস্থায় কাজ করতে একটু অসুবিধা হওয়ারই কথা। সর্বোপরি গ্রামীণ / মফস্বলী / নাগরিক জীবনের মূলস্রোত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থেকে শিল্পচর্চা করা স্বল্পসময়ের জন্য সম্ভবপর হলেও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা হিসাবে কতোটা প্রয়োগসাধ্য (Viable), তা ভেবে দেখার আছে।
তবে, যত যাই হোক, একথা বলতেই হবে, যে শিল্প পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থার আওতায় আসার পর থেকে শিল্পকর্মের পণ্যভবন ও বস্তুকল্পায়িত সামাজিক সম্পর্কের (Reified Social Relations) মধ্যে শিল্পীর দুরুহ জীবনযাপনের যুগে শিল্পীর পক্ষে এর থেকে বেশি সুবিধাজনক কোন ব্যবস্থা পুঁজিবাদ গড়ে তুলতে পারে নি। এখনো পর্যন্ত । শিল্পীদের কাছে এটাই পুঁজিবাদের মানবিকতম মুখ।
কিন্তু এতো সব ব্যবস্থা শিল্পের উন্নতির জন্য নয়। পণ্যায়িত শিল্পদ্রব্যের আরো উদ্বৃত্তমূল্য যাতে যোগ হয় তার জন্য। আরও একটা কথা হচ্ছে যে সমসময়ে প্রচলিত সামাজিক মতাদর্শগত গণ্ডি শিল্পচর্চার মাধ্যমে পেরিয়ে যাওয়ার যে ব্যাপারটি থাকে, যেটা সর্বযুগে সর্বত্র সারা পৃথিবীতে শিল্পীরা বিশেষত শিল্পের কাছে সৎও সার্থক শিল্পীরা ঘটিয়ে এসেছেন, সেটা এই ব্যবস্থায় কতটা সম্ভবপর হবে তা সময়ই বলতে পারে।
পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যস্থায় শিল্পসৃজণের ক্ষেত্রে এটা আদৌ কোনও বিকল্প কি না, অথবা কতটা বিকল্প তাও বুঝতে আরো কিছুটা সময়ের প্রয়োজন আছে।
স্থানীয় তৃণমূল স্তরে প্রতিটি পঞ্চায়েতে, এমনকি সম্ভব হলে প্রতিটি গ্রামে, মহকুমা সদর শহরে একটা করে হলঘর সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বানানো যেতে পারে যেখানে স্থানীয় শিল্পীরা নিয়মিতভাবেই তাঁদের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী করতে পারেন। জনগণ ও শিল্পের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ঘোচাবার এটা একটা উপায় হতে পারে। আমাদের একটা বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতেই হবে, যে-ব্যাপক জণগণের সকলেই কখনোই দৃশ্যশিল্পের প্রতি আগ্রহী থাকবে না, কিন্তু একটা অংশকে অবশ্যই আগ্রহী করে তোলা যেতেই পারে যদি স্থানীয় স্তরে নিয়মিত প্রদর্শনী হতে থাকে। প্রদর্শনীগুলির পূর্বাপর প্রচার ও তার সাথে সাথে সেগুলির সন্মন্ধে আলোচনায় ব্যবস্থা রাখলে শিল্প সম্পর্কে চর্চার একটা সাধারণ পরিমণ্ডল গড়ে তোলা যেতে পারে অদীক্ষিত সাধারণ দর্শকদের মধ্যে। এই ব্যবস্থা শিল্পের পক্ষে উপকারী হবে।
সাম্প্রতিককালে গণমাধ্যমে বা মিডিয়া, বিশেষ করে বৈদ্যুতিন মাধ্যম বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া সাধারণ জীবনে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমেও এই ব্যাপারে একটা ভূমিকা নিতে পারে নিয়মিত এইসব শিল্প প্রদর্শনী স্থানীয় চ্যানেলে দেখিয়ে। তার সাথে সাথে শিল্পীদের সাক্ষাৎকার, বিশেষতঃ সেইসব শিল্পীদের সাক্ষাতকার যাঁরা আধিপত্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলির বাইরে থেকেও উচ্চমানের শিল্পচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন, প্রচার করতে পারে। শিল্প সম্পর্কে আলোচনার প্রচার করে জনগণের নন্দতাত্ত্বিক চেতনা উন্নীতকরণে ভূমিকা নিতে পারে। জনগণকে সরাসরি শিল্পীদের কাছে থেকে ছবি কিনতে উৎসাহ দিতে পারে কোন মধ্যবর্তী দালাল ছাড়াই।
একদা শিল্প ও সমাজের পরস্পরের কাছাকাছি আসবার একটা সম্ভবনা ইন্টারনেট বা আন্তর্জাল খুলে দিয়েছিলো। কিন্তু কায়েমী স্বার্থচক্র সেই সম্ভবনাকে বানচাল করে দিয়েছে। শিল্পসামগ্রীর ক্রেতাদের যে তালিকা একসময়ে কিছু দিনের জন্য আর্ন্তজালে লভ্য ছিল তা কারা যে গায়েব করে দিল তা বুঝতে খুব একটা বেশি বৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না। আর্ন্তজালের যুগে, শিল্প ও শিল্পীর ওপর শিল্পব্যবসায়ী এবং ওইধরণের সংস্থা প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রণ মিলিয়ে যাওয়ার বদলে, স্ববিরোধীভাবে, শক্ত হয়েছে এবং ক্রমাগত দৃঢ়তর হয়ে চলেছে।
শিল্পবস্তুর ইলেকট্রনক বাণিজ্য আরেকটা নন্দনবিরোধী সংস্কৃতিবিরোধী প্রক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে যেখানে শিল্পী বা ক্রেতা, কেউই নিজেদের মধ্যে কোন মানবিক সম্পর্কের পরোয়া করে না। তারা পরস্পরের প্রতি কেবল উপযোগীতাতেই, কেবল ব্যাবহার করার উদ্দেশ্যেই আগ্রহী এবং শিল্পকর্মের প্রতি তাদের আগ্রহ কেবল কেনাবেচার বস্তু হিসাবে। আরো বলা যায় এই ব্যবস্থায় শিল্পকর্মের বৈদ্যুতিন প্রতিরুপ (Electronic image) গুলি মূল শিল্পকর্মগুলি চাক্ষুষ করবার জন্য বাছাই করবার সোপান নয়, বরং যেন পথের শেষ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ কেউই মূলশিল্পকর্ম দেখবার বা দেখাবার কোন তাগিদ অনুভব করছে না। কিন্তু এটা ঠিক নয়, কারণ আমরা জানি যে, যে কোন বস্তু (এক্ষেতে শিল্পকর্মটি) যে দৃশ্যপ্রৈতির (Visual impulse) সৃষ্টি করে তার সমতুল্য দৃশ্যউদ্দীপনা বা অভিঘাত তার কোনওরকমের কৃত্রিমভাবে পুনরুৎপাদিত প্রতিরুপের দ্বারা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়।
ক্রেতারা শিল্পীর সাথে মেলামেশা করে তার শিল্পকর্মের বিষয়ীগত পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে শিল্পীর সাথে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে বা মূল শিল্পকর্মগুলি দেখবার সময় পান না ব্যাস্ততার কারণে ! তার বদলে একগুচ্ছ কাজের বৈদ্যুতিন প্রতিলিপি দেখে তার মধ্যে থেকে দুই-একটি পছন্দ করে তাঁরা দরদাম করতে শুরু করে দিয়ে বেশি খুশী থাকেন। এবং এই ব্যবস্থাতে শিল্পীও খুবই খুশী ও সন্তুষ্ট। এই অমানবিক, আনান্দনিক ব্যবস্থা এখন শিল্পকলার জগতে প্রচলিত যেটা নিঃসন্দেহে শিল্পও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। অতত্রব, একটা অ-বাণিজ্যিক, মধ্যস্বত্বভোগী দালালবিহীন – শিল্পকলাপ্রদর্শন ও সরাসরি শিল্পীর কাছ থেকে কেনার একটা ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত একটা প্রয়োজনীয়তাই থেকেই গেছে এবং তা মেটেনি।
পীযূষকান্তি মুখোপাধ্যায়
চিত্রকর, প্রাবন্ধিক। বিশ্বভারতীর কলাভবনের প্রাক্তনী। বসবাস বোলপুরে।