আজ রবিবার, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৫শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

প্রাসঙ্গিক কাজী নজরুল, চক্ষুশূল নজরুল ইসলাম

সেই কবেই ‘আমার কৈফিয়ৎ কবিতায় কবি তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানকে তুলে ধরতে সামাজিক-রাজনৈতিক বাইনারিকে কটাক্ষ করে কলম ধরেছেন। কিন্তু তারপর ইতিহাসের বহু বহু ঘাতপ্রতিঘাত, গঙ্গার জল পদ্মায় আর পদ্মার পানি গঙ্গায় মিশে গেলেও বাইনারি আর ভেদ-বিভাজনের রাজনীতি সমানে জারি আছে। যদিও আমরা এমন এক কালযাপন করছি, যখন কাজী নজরুল একইসঙ্গে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নতুন করে প্রাসঙ্গিক উঠেছেন এবং কারও কারও চোখে হয়ে উঠেছেন চক্ষুশূল। প্রসঙ্গিক হয়ে ওঠার বড় কারণ, একদিকে জাতিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবন‌্যায় প্লাবিত হয়ে যাওয়া বাঙালি জাতি বা বাংলাভাষী মানুষকে তার ঐতিহ্যের মর্মোপলব্ধি ফেরানোর ক্ষেত্রে কাজী নজরুলের কাব্য ও সঙ্গীত বড় আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে। আর তাই নজরুল নতুন করে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন হিন্দুত্ববাদ ও মুসলিম জাতিবাদের চোছে। সম্প্রতি ভারত-পাক যুদ্ধের আবহে রিপাব্লিক বাংলা নামক একটি বিকৃত বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সাংবাদিক যেভাবে নজরুলের কবিতাকে কটাক্ষ করে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন, তাতে স্পষ্ট হয়ে গিয়ে মোদিপন্থি ভারতীয় বাংলাবিদ্বেষী মিডিয়া-সহ হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি মতবাদের দৃষ্টিকোণে নজরুল কতটা ‘খতরনাক্‌’! আবার এই হিন্দুত্ব বয়ানের পাল্টা মুসলিম জাতিবাদী বয়ানও যে নজরুলকে বাংলা ভাব পরম্পরা থেকে বিযুক্ত করতে তৎপর, তা বোঝা যায় ফেসবুকে গজিয়ে ওঠা ‘অ‌্যান্টি ফেমিনিস্ট কমিউনিটি’ নামক একটি মুসলিম জাতিবাদী ফেসবুক গ্রুপে কাজী নজরুলের ছবিকে বিকৃত করে কবির নামে বিষোদগারমূলক পোস্ট এবং তার তলার কমেন্টসমূহ দেখেও। ভারতের আরএসএস-বিশ্বহিন্দু পরিষদের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে মাথাচাড়া দেওয়া আল্ট্রা রাইটউইং গ্রুপগুলির কেউ কেউ কাজী নজরুল ইসলামের বাংলাদেশের জাতীয় কবির ছিনিয়ে নিতেও তৎপর বলে সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। যদিও এইসব আল্ট্রা রাইটউইং ইসলামিস্ট গ্রুপগুলি এতদিন নজরুলকে ইসলামপন্থী কবি হিসাবে তুলে ধরার হাজারও চেষ্টা করেছে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এখন নজরুলের সাহিত্যকর্ম এবং তাঁর ভাব ও স্মৃতিকে মুছে দিতে তৎপর।

‘‘মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল-লা’রা কন হাত নেড়ে,
‘দেব -দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জা’ত মেরে!
ফতোয়া দিলাম– কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!’
“আমপারা” পড়া হাম্ বড়া, মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে।’
হিন্দুরা ভাবে, ‘ফার্শী- শব্দে কবিতা লেখে ও পা’ত নেড়ে!’

আনকোরা যতো ননভায়োলেন্ট নন্-কো’র দলও নন খুশী।
‘ভায়োলেন্সের ভায়োলিন্’ নাকি আমি বিপ্লবী- মন্ তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চরকার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কনফুসি!
স্বারাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের অংকুশি’!

নর ভাবে, আমি বড় নারী- ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী!
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী- বন্ধু ক’ন,’এই তব বিদ্যে ছি!’
ভক্তরা বলে ‘নবযুগ রবি’!
যুগের না হই, হুযুগের কবি
বটি তো রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’শে কশি হৃদ-পেশি!
দু’কানে চশমা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্ বেশী।’’

‘আমার কৈফিয়ত’

কবির ছবিকে বিকৃত করে তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম জাতিবাদীদের অসভ‌্যতা।
কাজী নজরুল ও তাঁক কবিতাকে বিকৃত করা, হিন্দুত্ববাদের প্রচারক বিকৃতমনস্ক ময়ূখরঞ্জন

অথচ নজরুল একদিকে আধুনিকতাবাদী সেক্যুলার চিন্তাপ্রক্রিয়া ও অন্যদিকে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা (Theocratic), এই দুটি বিষয়েরই সমান্তরালে অবস্থান করেছেন। বরং তিনি বাংলার ভাব ও ধর্মাপনের বহুত্ব ও সম্প্রীতির ঔদার্য্যকে ধারণ করেছেন বৃহৎ বঙ্গের পারম্পরিক সংস্কৃতির অন্তর্জগৎ থেকেই। বাংলা কাব্যের মধ্যে ঔপনিবেশকিতা সূত্রে অনুপ্রবেশ করা আধুনিকতার দ্বারপ্রান্তে নজরুল আবির্ভূত হয়েছিলেন ভাবান্দোলন পরম্পরার একজন কবি হিসাবে। কাজী নজরুল ইসলাম ভাবান্দোলন পরম্পরার একজন কবি। তাঁর কালী-কৃষ্ণ গীতি কিম্বা আল্লাহ-নবীর আশিকানায় বাঁধা গান- সবটাই বঙ্গের ভূমিমানুষের ভাব-বস্তুর যুগল দ্বৈতাদ্বৈত সম্পর্কের অভিসন্দর্ভ থেকে। আধুনিকতাবাদীরা নজরুলকে আধুনিক করে তুলতে চেয়েছেন বটে, কিন্তু নজরুল কখনোই বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের কবি নয়, তিনি বড় বাংলার। যে বঙ্গে ভাব ও বস্তু মিশে থাকে একে অপরের সাথে, আর তৈরি হয় লীলা। নজরুল সেই লীলার অন্তর্জগতে মিশে যেতে পেরেছিলেন। আর তাই নজরুলের ইসলামিক গজল ও শ্যামাগীতিগুলো আজ আমাদের ফের নতুন করে ভাবায়। ইওরোপের কেতাবি আলোকায়ন আর তার জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যের পরিকাঠামোর সমান্তরালে বঙ্গের তথা উপমহাদেশের মৌখিক পরম্পরা ও জ্ঞানতত্ত্ব বিরোধী অভদ্রবিত্ত সো-কল্ড সাব-অল্টার্ন ঐতিহ্যকে কীভাবে আমলে নিয়েছেন কাজী নজরুল, যা কিনা একইসাথে পশ্চিমা আলোকায়নের পাশাপাশি বৈদিক জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যবাদী পরিকাঠামো ও ইসালমিক রাষ্ট্রবাদের (মওদুদির রাষ্ট্রপ্রকল্প) বিরুদ্ধাচার। কী বলছেন নজরুল?

আমার হাতে কালি মুখে কালি, মা
আমার কালিমাখা মুখ দেখে মা
পাড়ার লোকে হাসে খালি।।

মোর লেখাপড়া হ’ল না মা,
আমি ‘ম’ দেখিতেই দেখি শ্যামা,
আমি ‘ক’ দেখতেই কালী ব’লে
নাচি দিয়ে করতালি।।

কালো আঁক দেখে মা ধারাপাতের
ধারা নামে আঁখিপাতে,
আমার বর্ণ পরিচয় হ’লো না মা
তোর বর্ণ বিনা কালী।

যা লিখিস মা বনের পাতায়
সাগরজলে আকাশ খাতায়,
আমি সে লেখা তো পড়তে পারি
মূর্খ বলে দিক্‌ না গালি মা,
লোকে মূর্খ ব’লে দিক্‌ না গালি।।

বঙ্গের শাস্ত্রবিরোধিতা, জ্ঞানতাত্ত্বিক শোষণ-পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে জেহাদ ও প্রাণ-প্রকৃতি-পরমের সহাবস্থানের যে ভূমিনিবিড় চেতনা, যা বঙ্গের ভাবান্দোলনের মধ্যে মূর্ত হয়েছিল নজরুল তা লালন করে গেছেন তাঁর চিন্তায়, জীবনচর্যায়। আধুনিকতার সকল চিহ্ন-প্রকরণের অন্দরের মধ্যে বসবাস করেও ঔপনিবেশিক চিন্তা, ঔপনিবেশিক জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিকাঠামো ও আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন। বরং বাংলার ভাবান্দোলন পরম্পরাকে আধুনিক পরিসরে ছড়ায়ে দিয়ে গেছেন অবলীলায়। তিনি বহন করেছেন সৈয়দ সুলতান, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, রামপ্রসাদ, লালন সাঁই প্রমুখ মহাজনের পরম্পরা। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নানা সময় নান্দনিক ক্ষেত্রে প্রভাবিত করেছে কিন্তু ভাব ও ভাবনায় তিনি রাবিন্দ্রীক হয়ে যাননি, যদিও রবীন্দ্রনাথ বাংলার মানুষের জীবন সহিত সম্পর্কিত কথা ও কাব্যকেই সাহিত্য বলেছেন তাই তাঁকেও আমরা আধুনিকতার পঙ্কিল আবর্তে ছুঁড়ে ফেলি না। আধুনিকতার যে রণ-রক্তপূর্ণ, ক্রূরতার ক্লান্ত-ভারাক্রান্ত , আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠে আধুনিকতার লাশকাটাঘর চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ ( যা তাঁর সমসাময়িক কেউই পারেননি, না তো সুধীন্দ্রনাথ, না তো বিষ্ণু দে, না তো বুদ্ধদেব বসু) এবং বের হয়ে যেতে চেয়েছিলেন কলকাতাময় ঘিনঘিনে আধুনিকতা থেকে, রূপসী বাংলার প্রান্তরে নাটোরে ফিরে গিয়ে মুখোমুখি বসতে চেয়েছিলেন বনলতা সেনের… অন্যদিকে নজরুল এই আধুনিকতার ভাবসংঘ থেকে নিজেকে পৃথক রেখে গেছেন, বরং তিনি মুজফফর আহমেদের সঙ্গে দিনবদলের আলাপ করেছেন, সক্রিয় হয়েছেন নিজেও দিনবদলের দ্রোহ-অধ্যায়ে। এবং তাঁকে ভাষা জুগিয়েছে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, কোরআন, ত্রিপিটক, আবেস্তা, বেদ। আর তাই তিনি ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, হয়ে উঠেছিলেন চির-বিস্ময় তিনি বিশ্ববিধাতৃর… উপনিবেশবাদী আধুনিক কবিরা আধুনিকতার নামে যখন অবলীলায় বাংলা ভাষা থেকে বাদ দিয়ে গেছেন আরবী, ফার্সী শব্দ আর চাপিয়ে দিয়েছেন তৎসম, তদ্ভব শব্দ রাশি রাশি, তখন তার সমান্তরালে আরবী-ফার্সি অক্ষুণ্ণ রেখে রেফারেন্সে নজরুল কোরআন, পুরাণ- সব কিছুকে পেশ করে গেছেন চির উন্নতশিরে। অন্যদিকে বাংলার ধর্মবিবেচনার দার্শনিক পর্যবেক্ষণ, আল্লাহ থাকেন বান্দার মনের অন্দরে বা সাঁই আছেন আপন অন্তঃপুরে… যা কি না মানুষ ভজনার নিগূঢ় ভাব, তা নজরুলের কাব্যে, গীতিতে চিরকাল প্রতিফলিত হয়েছে।

বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্‌ এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মস্‌জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহাগীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।

তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছে বাংলার বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গের যুগল থেকে এক হয়ে ওঠার অচিন্ত্যভেদাভেদ ও দ্বৈতাদ্বৈতভাব, প্রেরণা জুগিয়েছে পুরুষ ও প্রকৃতির একাত্বভাবের রূপপ্রকাশ রাধাকৃষ্ণ, তিনি বাংলার ভাবের অন্দরের বসে নারী ও পুরুষের লৈঙ্গিক সাম্যের গানও গেয়েছেন। তিনি তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ। একদিকে কৃষ্ণ অন্যদিকে মোহাম্মদ। যেভাবে বঙ্গের ভাষা, ভাব ও ইতিহাসের বিস্তার-অগ্রসরতায় ইসলাম অবদান রেখেছে ইতিবাচক, যেভাবে জাতপাত,-বর্ণবিভাজনের বিরুদ্ধে ও ইনসাফ-সমানাধিকারেরে পক্ষে ইসলামের ঝাণ্ডা পতপত করে উড়েছে এই বৃহৎ বঙ্গে আর বাংলার কালীকৃষ্ণের মাথায় ছাতা ধরে থেকেছে পরম মাবুদের নাম… বাংলার মানুষ ভজনা ও মানুষের রূপভজনার সিলসিলায় তাই বারবার প্রেরণা হয়েছে ইসলাম, প্রেরণা হয়েছেন নবী মোহাম্মদ (সা.), আর তাই বড় বাংলার কবি কাজী নজরুলেরও প্রেরণা ইসলাম। তিনিও নবীজীর আশিকানায় পরিপূর্ণ।

তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম
ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি, খোদায়ী-কালাম
ঐ নামের দামন ধ’রে আছি- আমার কিসের ভয়
ঐ নামের গুণে পাবো আমি খোদার পরিচয়
তাঁর কদম মোবারক যে আমার বেহেশতী তান্জাম
মুর্শিদ মোহাম্মদের নাম।।
আল্লাহকে পেতে হলে রসূলের অছিলা চাইতে হবে। কবি বলেন-
আল্লাকে যে পাইতে চায় হযরতকে ভালবেসে
আরশ কুরসি লওহ কালাম না চাইতেই পেয়েছে সে।।
রাসূল নামের রশি ধরে
যেতে হবে খোদার ঘরে।।

কিংবা

আমি বুঝি না কো কোনো ইজম
কোনো রূপ রাজনীতি
আমি শুধু জানি আমি শুধু মানি
এক আল্লাহর প্রীতি।
তার শক্তিতে জয়ী, হবে লয়ে আল্লার নাম, জাগো
ঘুমায়ো না আর, যতটুকু পার শুধু তার কাজে লাগো।
ভেদ বিভেদের কথা বলে যারা তারা শয়তানী ঢেলা
আর বেশি দিন নাই, শেষ হয়ে এসেছে ওদের খেলা।

ভেদ-বিভাজনের বিরুদ্ধে ইসলাম যুগে যুগে যুগে যে জেহাদ চালিয়েছে আর প্রেমের দাওয়াত দিয়ে গেছে মানুষের মাঝে, কাজী নজরুল সেই দাওয়াত গ্রহণ করেছেন প্রাণ ভরে, তিনিও পাঠকের মাঝে রেখেছেন সেই দাওয়াত কাব্যে, গীতিতে। তিনিও মানুষ ভজনার ভাবের মধ্যেই উচ্চারণ করেছেন ইসলামি সেইসকল শিক্ষা।

সাম্যের কবি কবি কাজী নজরুল, প্রেমের কবি কাজী নজরুল, জেহাদের কবি কাজী নজরুল কমিউনিষ্ট পার্টি গড়ে ওঠা কিংবা তার আগে-পরে কমিউনিষ্টদের সঙ্গে সখ্যের সম্পর্ক রেখেছেন, তাঁদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন কিন্তু পার্টির মেম্বার হন নাই কখনও। কারণ, একদিকে হয়তো বা বোহেমিয়ান কাজী নজরলের পক্ষে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার রেজিমেন্টশনে থাকা সম্ভব ছিল না, এমনটা হতে পারে। কিন্তু তার থেকেও অনেক বড় কারণ, কমিউনিষ্ট পার্টি শুরু থেকে বহুদিন যাবত এই বৃহৎ বঙ্গের পার্টি হতে পারেনি, উপমহাদেশের পার্টি হয়ে উঠতে পারেনি, জার্মান ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের উত্তর-মার্ক্সবাদী এরিক ফ্রমরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কে সমালোচনার ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে দেশ-কাল নিরপেক্ষ একবগগা পর্যালোচনা ও বস্তুবাদের নামে অতিবস্তুমুখীনতার অভিযোগ এনেছিল, সেই ভাবনাটা বোধহয় অনেকের মধ্যেই ছিল এই অখণ্ড বাংলায়। যাঁরা কমিউনিষ্টদের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেও পার্টি মেম্বার হয়ে উঠতে পারেননি, কারণ কমিউনিষ্ট পার্টিও বাংলার হয়ে উঠতে পারেনি অন্তত ষাটের দশকের শুরু অবধি। বাংলা ভাগের বিশ বছরের মাথায় পশ্চিমবঙ্গের তরাই অঞ্চল নকশালবাড়িতে সামন্ততন্ত্র আর ঔপনিবেশিক পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে ছোটলোকেরা যে বিদ্রোহের সূচনা করেছিল, সেটাই ছিল কমিউনিষ্ট পার্টির ইতিহাসের সফল অর্জন এবং বাংলার ভূমিমানুষের নিজস্ব দল হয়ে ওঠা, যদিও ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি বড় অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছিল নকশালপন্থীদের এর পরেই। বাংলার ছোটলোকের বিদ্রোহকে ধারণ করার জন্যে নকশালপন্থীদের সঙ্গে একযোগে থাকতে পারেননি সংসদীয় এলিট কমিউনিষ্টরা, যাদের অধিকাংশ এখন বিজেপির সাফল্য কামনা করেন মনে-মনে… নজরুলের মতো কবি বঙ্গীয় সাম্যবাদী হয়েও কমিউনিষ্ট তকমা পান নাই, কেননা তিনি বাউন-কায়েত ও উচ্চমধ্যবিত্ত নন, বিলাত-ফেরত নন। নজরুল কমিউনিষ্ট ইন্টারন্যাশনালের বঙ্গীয় ভাবানুবাদ রচনা করেছেন কিন্তু হুবহু তর্জমা করেন নাই, কারণ বাংলার দল বাংলার কাব্য বাংলার স্লোগান, বাংলার সাম্যবাদী অ্যান্থাম বাংলার মতো হবে। প্রথমে বঙ্গীয় হতে না পারলে বিশ্বজনীন হওয়ার উপায় নাই, বুঝেছিলেন নজরুল। হুবহু অনুবাদ না হওয়ায় নজরুলের ভাবানুবাদ গ্রহণ করেনি কমিউনিষ্ট পার্টি। নজরুল ব্রাত্য থেকে গেছেন ব্রাত্যজনের মুক্তি আন্দোলনেও, কারণ সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে থেকেছে ইওরোসেন্ট্রিক বাবুরা। যেভাবে তিরিশের দশকের কমিউনিস্টরা ব্রাত্য করেছিল নজরুলকে। আজ দরকার বাংলার নিজস্ব শ্রেণীর বয়ানকে পুনরুদ্ধার ও বৈশ্বিক শ্রেণী রাজনীতির সঙ্গে তার সম্বন্ধ স্থাপন করা, স্থানিকতাকে আমলে নিয়ে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার প্রত্যয়ে। এই কারণে নজরুল আজও আমাদের কাছে দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক তাঁর সৃষ্টিসুখসম্ভারের ভিতর থেকেই।

রাষ্ট্রনৈতিক ও জাতিবাদী বিভাজনের যুগে, একই সঙ্গ মুসলিম জাতিবাদের উত্থান ও তার পাল্টা ইসলামোফোবিয়ার যুগে, এই হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি আধিপত্যের যুগে, ইসলামের নাম ভাঙানো মুসলিম জাতিবাদীদের উত্থানের যুগে কাজী নজরুল ইসলাম আজ বড়ই প্রাসঙ্গিক এই বড় বাংলায়। বাংলার ভাব-বস্তুর লীলাজগতে, ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ডের সম্বন্ধ স্থাপনের দার্শনিকতায়, মুক্তির ইস্তেহার নির্মাণে বঙ্গের ভূমিজনতার কাছে নজরুল চিরপ্রাসঙ্গিক এক কবি।


জাগো অনশন-বন্দী, ওঠরে যত
জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত।
যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি
হাঁকে নিপীড়িত জন-মন-মথিত বাণী,
নব জনম লাভ অভিনব ধরণী,
ওরে ঐ আগত॥

আদি শৃঙ্খল সনাতন শাস্ত্র আচার
মূল সর্বনাশের এরে ভাঙিব এবার!
ভেদি দৈত্য-কারা
আয় সর্ব্বহারা!
কেহ রহিবে না আর পর-পদ আনত

নব ভিত্তি’ পরে
নব নবীন জগৎ হবে উত্থিত রে!
শোন্ অত্যাচারী! শোন্ রে সঞ্চয়ী।
ছিনু সর্বহারা, এই সংগ্রাম-মাঝ
ওয়ে সর্বশেষের এই সংগ্রাম-মাঝ
নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ!
এই ‘অন্তর-ন্যাশানাল সংহতি’ রে
হবে নিখিল-মানব-জাতি সমুদ্ধত॥

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top