।। সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় ।।
‘প্রতিপক্ষ’তে লেখার কথা ছিল পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কবি সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ‘দিচ্ছি, দেবো’ ক’রে তাঁর আর লেখা দেওয়া হল না। মাত্র একটি সন্ধ্যায় কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রতিপক্ষ’র নির্বাহী সম্পাদকের সঙ্গে বড় বাংলার কবিতা নিয়ে বেশ কিছুটা সময় কথা হয়েছিল তাঁর। পরিকল্পনাও যথারীতি, কিন্তু পরিকল্পনা পড়ে রইলো। তাঁর কবিতার মতোই। তাই অগত্যা আন্তর্জালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাঁর কবিতাগুলো থেকে একগুচ্ছ প্রকাশিত হল আমাদের ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকায়, যখন তিনি ঘরে ফিরছেন হয়তো-বা। যে ঘর নাকি কবিতার মতোই…
“কে যেন চলে গেছে, তার যাওয়াটুকু পড়ে আছে হাওয়ায়
শহরে বিদ্যুৎ, মেঘ , কবিতার উড়ে যাওয়া পাতা
কে যেন চলে গেছে, তার থাকাটুকু মনে রেখে গাছ
তোলপাড় হতে হতে কান্না লুকোয়
গাড়ি ফেরে বাড়ি তবু বাড়ি তো জোনাকি
আমাদের আমরাই ভুলে যাবো নাকি
বহুতলে আজ আবার কে কাকে কাঁদালো
রাস্তায় ঝরে পড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো আলো …”
প্রতিধ্বনির দিনে
এমনও তো হতে পারে , আনমনা ফাল্গুনে
কেউ এসেছিল, বাগানের ঘাসে তার চিঠি পড়ে আছে
এমনও তো হতে পারে, পুরোনো কাঠের সিঁড়ি
উঠে গেছে ধুলোপড়া ছবিদের দেশে
কেউ এসেছিল, বারান্দায় হেসেছিল সাদাকালো রোদের টি- পট
হাওয়া এসে খুলেছিল দরজা , দূর থেকে অভিমান এঁকেছিল ছায়া
প্রতিধ্বনির দিনে বহু পথ পেরিয়ে যে এসেছিল
আলোময়ী ফিরবেনা , এই কথা জেনে
এলোমেলো ফাল্গুনে ফিরে চলে গেছে …
দেশলাই
দেওয়াল, দেওয়াল চারিদিকে ।
উনিশশো আটানব্বই সালে
আমি হারিয়ে ফেলেছি দেশলাই বাক্স,
তাও আজ হয়ে গেল অনেক বছর ।
মাথা তুলতে গিয়ে দেখি
ধুন্ধুমার মেঘ আকাশে,
আর মাথার ওপর দশপনেরোতলা সেপিয়া ।
এই এতদিন ধরে
কী-ই বা হল, ভাবি…
বিস্ফোরণের সরঞ্জাম বা দেওয়াল ভাঙ্গার হাতুড়ি
রাখা নেই ড্রয়িং রুমের আলমারিতে,
সবুজ সোফাসেটে নির্বিকার পানপাত্রের সন্ধে ।
উনিশশো আটানব্বই সালে
দেশলাই বাক্স হারিয়ে ফেলেছি,
সাবলীল ভুলে গেছি বারুদদিবস ।
অনেক বছর পরে
তারপর উনি একটা কিং-সাইজ ধরিয়ে বললেন,
পড়ো, শুনি তোমার কবিতা।
দু চোখ বোজা, সোফায় নির্লিপ্ত হেলান,
আমার তিনটে কবিতা ধোঁয়ার রিং-এ উড়ে গেল।
আজ অনেক বছর পরে দেখা –
একই মঞ্চে, পাশাপাশি।
উনি আমাকে একটা কিং-সাইজ বাড়িয়ে বললেন,
আমি প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম,
তোমার হবে।
বুঝলাম, উনি সেই দিনের কথা
ভুলে যেতে চাইছেন
যেদিন ওনার কাছ থেকে ফেরার সময়
ছিঁড়েখুঁড়ে গিয়েছিল আমার কবিতাডানা,
আর কলকাতার রাস্তায় টুকরো টুকরো পড়েছিল
অগুনতি মার্ডার হয়ে যাওয়া অক্ষরজাতক।
শিমুলবন জংশন
আসন্ন বসন্তে শিমুলবন জংশনে দেখা হবে
ঝমঝম ট্রেন ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দূরে চলে যায়
সবুজ, গভীর পথে দুলে ওঠে গুলাল-ইশারা
ভুল ঠিকানায় এখনও কি চিঠি পৌঁছে দিচ্ছে হাওয়া?
গতজন্মের কথা থাক, আসন্ন বসন্তে
শিমুলবন জংশনে দেখা হবে, আকাশের গায়ে
নতুন ছবি এঁকে দেবে লিপগ্লস
অচেনা আততায়ী এসো, মুখোশ খোলার আগে
আমাকে নিবিড় ইকেবানা শেখাও
শিমুলবন জংশনে সুগভীর গুলাল-ইশারা
খুন হবার জন্যে এ সময় আর একবার বেঁচে ওঠা যায় …
এখন, দিনরাত
বিবর্ণ বিকেলের কালচে রাজপথ
যেন অলস, পুরনো অজগর
সময়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে
আমরাও পুরনো হয়ে চলি
সরু গলি, কবেকার মরচে অ্যান্টেনা
সেইসব বাড়ীতে আর কেউ থাকেনা এখন
সাদাকালো ফটো-অ্যালবামে
শুধু পড়ে আছে কিছু
যুবতী বনভোজন, আর হুটোপাটি হাসিগান ছবি
কলকাতায় বসন্ত নেই বহুকাল
একটা গভীর, নীলচে শীতকাল
নিঝঝুম বসে আছে জানলায়
কোন আতসবাজী নেই একশো বছর
ইতিহাসনির্ভর আলতো টিকে থাকা –
বন্ধুদের কথা ভাবতে ভাবতে
একটা ধূসর, ঠান্ডা জামা পরে
আমি নিয়মমাফিক ভেসে যাচ্ছি দিনরাত…
আলো
কে যেন চলে গেছে, তার যাওয়াটুকু পড়ে আছে হাওয়ায়
শহরে বিদ্যুৎ, মেঘ , কবিতার উড়ে যাওয়া পাতা
কে যেন চলে গেছে, তার থাকাটুকু মনে রেখে গাছ
তোলপাড় হতে হতে কান্না লুকোয়
গাড়ি ফেরে বাড়ি তবু বাড়ি তো জোনাকি
আমাদের আমরাই ভুলে যাবো নাকি
বহুতলে আজ আবার কে কাকে কাঁদালো
রাস্তায় ঝরে পড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো আলো…
সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কবি। কবিতা ছিল তাঁর যাপিতজীবনের একটা ফোর্স। কবিতায় বাঁচতেন। বসবাস ছিল কলকাতা মহানগরীতে। বেশ কয়েকটি কবিতার বই রেখে গেছেন। কবিতা লেখা ছাড়াও অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্র-সহ দৃশ্যশ্রাব্যের একাধিক মাধ্যমে। ২০২৩-এর সূচনার শীতে তিনি চিরতরে ঘুমিয়ে গেছেন।