আজ বৃহস্পতিবার, ২৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

পাখি

।। জেসমিন নাহার ।।

সাতশো চুয়াল্লিশটি জাতের পাখি এখন আর নাই। অনেকগুলো বিলুপ্ত। তবে কাগজে কলমে আছে। গত দুইশো বছর আগের অনুসন্ধান অনুযায়ী যে সব পাখি বাংলাদেশে আছে বলে সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে, তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তালিকায়। কিন্তু বহু পাখি এখন স্রেফ অক্ষর। তালিকায় নাম্বার মাত্র। বাস্তবে নাই। বর্তমানে যাদের আছে দাবি করা হয় তাদের সংখ্যা ৬৫০। আবার ৬৫০টি পাখির মধ্যে ৩০টি বাংলাদেশে বর্তমানে বিলুপ্ত। তারা নাকি অতীতে ছিল। এখন বাংলাদেশে নাই। ৩০টি পাখির মধ্যে ২৯টি অন্য দেশে এখনও নাকি পাওয়া যায়। কিন্তু একটি গোলাপি শির হাঁস সম্ভবত সারা দুনিয়া থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। গোলাপি শির হাঁসের জন্য ম্যাডামের মন খুব খারাপ হয়ে যায়। ৬২০টি প্রজাতির যেসব পাখি সম্প্রতিকালে বাংলাদেশে দেখা যায় তারা বাংলাদেশে থাকে বা আসে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই ৬২০টি প্রজাতির মধ্যে ১৪৩টি প্রজাতির পাখিকে বাংলাদেশে ‘অনিয়মিত’ আখ্যায়িত করা হয়েছে। কারণ কালেভদ্রে এদের দেখা যায়।

পাখি

এক

—রেজবি, তুই কি পাখি ধরস?
—হ, আমার কাছে চেরটা পাখি আছে। একটা মইর‍্যা গ্যাছে গা। দুইটা ঠুকরিয়ে খায়, আরেকটা খাওয়াইয়া দেওন লাগে।

নিবিড় এবং রিজভি নূরানী ক্লাসে কথা বলছে, সকলেই ওদের কথা শুনতে পাচ্ছে। নূরানী ক্লাসের শিক্ষকও আছেন। হুজুর মানুষ। হুজুর জিজ্ঞাসা করেন,

— আমারে দিয়া হারবি দুইটা?

হঠাৎ হুজুরের পূর্বে একটা পাখি ধরে আয়েশ করে খাওয়ার কথা মনে পড়ে। সেই পাখি খাওয়ার সাক্ষী ছিল নিবিড়। তাই নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে হুজুরের পাখি ভোগের স্মৃতি মনে পড়ে। কথা বলার সময় হুজুরের জিহ্বায় নানান প্রকার শব্দ হয়। নিরীহ পাখির পাখা ঝাপ্টানোর মতো শব্দ। হুজুর বলতে থাকেন।

— হেই যে দিছিলি হেই পাখির নাগাল চাবাইয়া হাড্ডি-গুড্ডি গুরা কইর‍্যা ফিনিশ কইর‍্যা হালামু। নিবিড়গো ঘরের পেছনে একটা আম গাছ আছে। ঐ আম গাছের মধ্যে ঘুঘু বাসা বেঁধেছে। হেইগুনা বাচ্চা দিছে। রেজবি তুই ওইডা পাইড়্যা নিস। নইলে আমারে দিয়া দিস। পাললে পালুমনি, নইলে খাইয়া ফেলুমনি।

হুজুর এমনভাবে বলে যো মনে হয় কাঁচা পাখি এখনই খেয়ে ফেলবে।
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একজন ছাত্রী প্রতিবাদ করে,

— হুজুর পাখি ধরন লাগে না । পরিবেশের ক্ষতি হয়।
— দূর, কিছুই হয় না।

এই সময় জোব্বা পাঞ্জাবি পরা হুজুরকে মোটামুটি চরম অপুষ্টিতে ভোগা বাংলাদেশের গ্রামের সমান পুষ্টিহীনতায় ভোগা খোক্কসের মতোই মনে হয়।

— না হুজুর , ম্যাডামও কইছে, অন্যান্য এলাকায় বলে এঙনা পাখি নাইঙ্কা। আমাগো এলাকাত আছে, তাও ধরেন কিন নাইজ্ঞা? পাখি ধরন এবং ধইর‍্যা খাওন কি ঠিক?
— কোন হাদিসে লেইখ্যা আছে পাখি খাওন যাবো না? পর্দা ছাড়া ম্যাডামে তোরে পাখি পালবার না করছে?

সব ছাত্র সমস্বরে,
— হ, হ হুজুর, ওইডিই কইছে।

ছাত্রী চুপসে যায়।

মাদ্রাসা শেষে কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী মিলে তাদের ম্যাডামের কাছে যায়।

— ম্যাডাম, পাখি ধরন বলে জায়েজ। খাওয়াও নাকি জায়েজ। নুতন মসজিদের হুজুর কইছে নুরানি ক্লাসে। আপনি হুদাই শাসন করলেন আমাগো। খায় তো খায়, হে তো আবার হাড্ডি-গুড্ডি চিবাইয়া বলে এক কইর‍্যা ফালায়। আপনি খালি হুদাই। উ উ উ…।

ছাত্রছাত্রীদের কন্ঠে অনুযোগ।
ম্যাডাম তবু তার ছাত্রছাত্রীদের বোঝায়, পাখি ধরা খারাপ। দণ্ডনীয় অপরাধ।

বাচ্চারা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। ‘দণ্ডনীয়’ কঠিন কথা। তারা জায়েজ আর না জায়েজ বোঝে। ধর্মের চোখে কোনটা ঠিক আর বেঠিক এটা ধর্ম ঠিক করে দেয়, আর নূরানী হুজুর সেটা চাকদহ গ্রামে প্রয়োগ করে। এই ধর্ম কে কীভাবে আনলো বা বানালো কিম্বা কে তার ব্যাখ্যা করলো সেটা চাকদহে প্রশ্ন করার নিয়ম নাই। এখানে সমাজ আর ধর্ম একাকার হয়ে যায়। সমাজের অধিপতিরা যা বলে ধর্মও সেটা বলে। কিম্বা সমাজের বিধিবিধান ও ক্ষমতার কাঠামো টিকিয়ে রাখাই ধর্মের কাজ। ঢাকা শহর থেকে চাকদহ দূরের কোন দুর্গম অঞ্চল না। কিন্তু এখানে সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন খাটে না। তাই রাষ্ট্র কিভাবে আইনে বিভিন্ন ‘অপরাধ’ আইন দ্বারা বানায়, আর সেই আইন না মানলে সেটা কেন ‘দণ্ডনীয়’ হয় এই সকল বোরিং কঠিন বিষয় পক্ষীদের প্রতি সর্বক্ষণ উৎসাহী বাচ্চাদের বোঝার কথা না। তাই ‘দণ্ডনীয় অপরাধ’ কথাটা বলে ম্যাডাম থমকে যায়। বাচ্চাদের ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকায়। অথচ পাখি ধরা বা না ধরা বিষয় জায়েজ আর নাজায়েজের বিষয়ও না। কোরানে তো পাখি ধরা ও পাখি খাওয়ার বিষয়ে কোন নিষেধ নাই। ম্যাডাম বিপদে পড়ে যায়। তবু প্রাণপণ বোঝাতে চেষ্টা করে।

— প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পাখি অন্যতম ভূমিকা পালন করে। প্রাণ প্রকৃতি হুমকির মুখে। এগুলো রক্ষা করা আমাদের গুরু দায়িত্ব। জায়েজ জায়েজ চিৎকার করে আমরা আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য পূর্ণ গ্রাম ধ্বংস করতে পারি না। পশু পাখিকে নির্বিচারে নির্বিবাদে হত্যা করতে পারি না। খেতে পারি না। পুষতে পারি না। পশু পাখি ঘরে পোষার জিনিসও না। আল্লাহ আমাদের আশরাফুল মাখলুকাত হিশেবে তৈরি করেছেন। প্রাণ প্রকৃতি রক্ষা করবার জন্য আমাদের প্রত্যেককে একেকজন খলিফা হিশেবে পাঠিয়েছেন। যার যার স্থান থেকে আমাদের পৃথিবীকে রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এটুকু আমরা করতে পারবো না? কথাগুলো বলতে পেরে ম্যাডামের ভালোলাগে।

‘আশরাফুল মাখলুকাত’ কথাটা বাচ্চাদের ভাল লাগে। তারা বুঝতে পারে এটা আরবি শব্দ। আর কোরান আরবিতে নাজিল হয়েছে। তাই এই শব্দ ও শব্দের বরাত মেনে নিতে তাদের আগ্রহ দেখা যায়। তারা সমস্বরে বলে

— হ, খুব পারব।

ছাত্রছাত্রীরা ম্যাডামের পক্ষ নেয়। তারপর বাড়ি ফিরে যায়।

দুই

আচ্ছা, বাংলাদেশে পাখির প্রজাতি কয়টা? সরকারি হিশাবে মোট ৭৪৪টি পাখি অন্তর্ভুক্ত। কারা এই পাখির তালিকার করলো ম্যাডাম সেটা এখন আর মনে করতে পারলো না। ম্যাডাম বাংলার শিক্ষিকা, পখিবিদ্যা তাঁর বিশেষ নাই, কিন্তু পাখি দেখলে ভালোলাগে। কেন লাগে বুঝিয়ে বলা মুশকিল। পাখিদের রক্ষা করবার একটা কর্তব্য কী করে, কীভাবে মাথায় চেপে বসলো সেটা ব্যাখ্যা করা মুশকিল। সেটা হয়েছে এই অজ চাকদহ গ্রামে এসে। এখানে এসে মনে হয়েছে এখনও পাখিরা আছে। তারা মানুষদের ছেড়ে যায়নি। ঢাকা থেকে মোটামুটি বিতাড়িত হলেও চাকদহে তাদের দেখা যায়। ম্যাডামের ছাত্রছাত্রীদের জীবনে পাখি নিত্যদিনের বিষয়। পাখি তাদের বিনোদনেরও বিষয়। এক সময় মানুষের মধ্যে যে আদিম শিকারির স্বভাব আমরা দেখেছি ম্যাডামের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেই আদি পূর্বপুরুষকে চেনা যায়। ম্যাডাম চিনতে পারেন।

এক সময় নিশ্চয়ই পাখিরা ঢাকায় ছিল। ঢাকা থেকে তাদের আসতে বিশেষ কষ্ট হয়নি। কিন্তু ম্যাডামের আসতে খুব কষ্ট হয়। কষ্ট লাঘবের জন্য ম্যাডাম তাঁর দুই কাঁধে দুটি ডানা উপলব্ধি করতে থাকেন। কিন্তু ওই টুকুই। মানুষের ডানা গজায় না।

সাতশো চুয়াল্লিশটি জাতের পাখি এখন আর নাই। অনেকগুলো বিলুপ্ত। তবে কাগজে কলমে আছে। গত দুইশো বছর আগের অনুসন্ধান অনুযায়ী যে সব পাখি বাংলাদেশে আছে বলে সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে, তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তালিকায়। কিন্তু বহু পাখি এখন স্রেফ অক্ষর। তালিকায় নাম্বার মাত্র। বাস্তবে নাই। বর্তমানে যাদের আছে দাবি করা হয় তাদের সংখ্যা ৬৫০। আবার ৬৫০টি পাখির মধ্যে ৩০টি বাংলাদেশে বর্তমানে বিলুপ্ত। তারা নাকি অতীতে ছিল। এখন বাংলাদেশে নাই। ৩০টি পাখির মধ্যে ২৯টি অন্য দেশে এখনও নাকি পাওয়া যায়। কিন্তু একটি গোলাপি শির হাঁস সম্ভবত সারা দুনিয়া থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। গোলাপি শির হাঁসের জন্য ম্যাডামের মন খুব খারাপ হয়ে যায়। ৬২০টি প্রজাতির যেসব পাখি সম্প্রতিকালে বাংলাদেশে দেখা যায় তারা বাংলাদেশে থাকে বা আসে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই ৬২০টি প্রজাতির মধ্যে ১৪৩টি প্রজাতির পাখিকে বাংলাদেশে ‘অনিয়মিত’ আখ্যায়িত করা হয়েছে। কারণ কালেভদ্রে এদের দেখা যায়।

পরের দিন ম্যাডাম যখন ক্লাসে যায় ক্লাস সেভেনের শিক্ষার্থীদের সবাই পাখির মতো কিচিরমিচির শুরু করে। তাদের পরস্পরের প্রতি বিস্তর অভিযোগ। তারা তাদের অভিযোগ ম্যাডামকে জানাতে থাকে।

—ম্যাডাম, আয়েশা আর আনিশা আম চুরি করবার গ্যাছাল। আর আমি আম খুটপার নইছিলাম। আলীমের বোনে আয়া নয়া বকছে, কইছে, আম খায়া পয়দা করে নাইঙ্কা? খালি মানষের গাছের আম পাড়বার আহস, নটিরা। ওগো দুজনের নাইজ্ঞা আমি বকা খাইছি। ওরা কইছাল সাদিয়াগো বাইত্তে যামু। না যায়া আম চুরি করবার গ্যাছে।

আয়েশা প্রতিবাদ করে,

— ম্যাডাম নাহিদও আম চুরি করবার গ্যাছাল। শুধু আমরা এলকা না। বকা না দিলে ওইতিও চুরি করত ঐতিও গাছে উঠপার নইছিল।
– ম্যাডাম, এহন মিছা কথা দিতাছে ওরা ধরা খাইছে কয়া, হে হে হে। বাড়িতে আঙ্গো আম গাছের অভাব নাই, চুরি করবার ঠ্যাকা নাই।

নূর হঠাৎ বলে,
— হুনুন চে ম্যাডাম, কথাই আছে না। চুরির আম মিষ্টি বেশি। এহন আপনে ওগো কথা রাহুন চে, আমার কথা হুনুন।

ম্যাডাম ওদের শাসন করে। কিছু নীতি কথাও সবক দেয়।

— আম চুরি করবা না। তোমাদের বান্ধবী মাইশা। ওদের বাড়ি গেলে তো তোমাদের একটা আম চাইলে গাছের সব আম পেড়ে দেয়। আমি তো ওকে চিনি। মাদ্রাসার আশেপাশে প্রতিবেশিদের আম পাড়বার কোনও দরকার আছে?

যারা আম চুরি করেছো তাদের প্রতি একজন বলে ওঠেছে, ‘তোদের আম খাইয়া পয়দা করে নাই? এই কথাটা বেশ অসম্মানজনক কথা। ওই কথার মানে, যে সব বাচ্চারা চুরি করে আম পাড়ে তাদের মায়েরা বাচ্চা পেটে থাকার সময় নাকি আম খায়নি।

কিন্তু এর ফয়সালা হবার আগেই ফাল্গুনী হঠাৎ জোরে বলে ওঠে,

— ম্যাডাম হুনুন চে, রেজবি পাঁচটা ঘুঘু ধরছে। চোখ ফুটে নাই। আঙ্গো বাগের নগে বাগ। কইতরের তলে দিয়া রাখছে।

নুর ফাল্গুনীর কথায় সায় দেয়,

— হ, ম্যাডাম, হাছাই। রেজবি আমারে ঘুষ দিবার চাইছ্যাল। কইছ্যাল, তরে একটা ঘুঘু দিবো, ম্যাডামরে কইস না য্যান!
— ম্যাডাম, আমরা যে রেজবির কথা কইছি ওরে কয়েন না চে, বেত্তে গেলে তাইলে আঙ্গো ধরবো। আমরাই তো মানে আমি আর নুর তো কাছের।

একে অপরের অনুপস্থিতিতে অভিযোগ করে, ভয়ও পায়। ম্যাডাম ওদের আশ্বস্ত করে। জিজ্ঞাসা করে, আর কারো কোনও অভিযোগ আছে কি? না থাকলে যেন তারা ক্লাসে ফিরে যায়।

অভিযোগ শেষ হয়। বাচ্চারা ক্লাসে মনোযোগ দেয়। রেলগালি, প্রিয় খেলা এবং বর্ষাকাল নিয়ে উপস্থিত বক্তৃতা দেওয়া শিখছে তারা। তারা নিজ নিজ বক্তৃতা উপস্থাপন করতে থাকে। লটারির মাধ্যমে উপস্থাপন করতে করতেই ঘন্টা পড়ে।

ক্লাস থেকে বিদায় নিয়ে ম্যাডাম বেরিয়ে যান। কিন্তু বাচ্চাদের ছেড়ে একটু একা হওয়ার পরপরই ম্যাডামের মনে বাকি ৪৭৭ প্রজাতির পাখির কথা মনে পড়ে। বাংলাদেশে এদের নিয়মিত দেখা যায়। এই ৪৭৭ প্রজাতির মধ্যে ৩০১টি বাংলাদেশের ‘আবাসিক’ পাখি । যারা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বাস করে। পারমানেন্ট রেসিডেন্ট। বাকি ১৭৬টি বাংলাদেশের বেড়াতে আসে, আবার চলে যায়। তারা অল্প সময়ের জন্যই বাংলাদেশে আসে। তবে নিয়মিতই আসে। নিয়মিত আসা যাওয়ার ১৭৬ প্রজাতির পরিযায়ীর মধ্যে ১৬০টি আসে শীতে, বাকি ৬টি গ্রীষ্মে বাংলাদেশে থাকে, আর বাকি ১০টি বসন্তে।

আহা আজি এ বসন্তে,কত ফুল ফোটে, এত বাঁশী বাজে, এত পাখি গায়।

তিন

সাতই মে, মঙ্গলবার। যথারীতি রুটিন মেনে ম্যাডাম ক্লাস সেভেনে উপস্থিত। কুশলাদি জিজ্ঞাসা করবার পরে, দুজন ছাত্রী দাঁড়ায়।

— ম্যাডাম, কাইলকা আমি আর সুমাইয়া পিরাইভেট পইড়্যা ফাল্গুনীগো বেত্তে গেছিলাম। রেজবিরে কইছি ম্যাডাম তোগো বেত্তে আইবো। তুই পাখি ধরছোস তার লাইগ্যা। ও কইছ্যাল, খানকির মাইয়ারা কনেকার, আহুক, তোগো কী! ম্যাডাম, হে আপনেরে গাইল দিছে।

ম্যাডাম রিজভিকে জিজ্ঞাসা করেন, ব্যাটা, এইটা কী ভাষা। আমি কার মেয়ে?
— ম্যাডাম, আমি কইছি খানকির মাইয়্যারা, ম্যাডাম আহুক চাইন তোগো কী? হ্যারা মিছা কথা কয়।
— সে তুমি যাকেই বলো, ওদের তো বললে। খারাপ ভাষা তো এইটা, তাই না?

মামুন ডাকে,

— ম্যাডাম, ওই ঘুঘু ধরছে তিনটা। হুইন্যাই নূরানীতে বয়া কইছি ম্যাডাম জানলে তোরে খালব ধইর‍্যা, তুই ও কাম করছত ক্যা? ম্যাডাম মারব। ও কইছ্যাল, ম্যাডাম মারলে,আমিও ম্যাডামরে মারুম।

নূর মধ্যে থেকে ফোঁড়ন কাটে,

— ও পালে, পেলে বলে বেচব ম্যাডাম।
— তুই মিছা কথা কস ক্যা নুর? ম্যাডাম একটা হাছা কথা কই, নুর আমারে কইছে তিলা ঘুঘুর ছাও নেবে।
— না নিমুনা, ও মিছা কথা কয়, নুরানি ক্লাসের আগে ওগো দোকানে গেছিলাম, হুজুর আয়া পড়ছাল, তারপর আমিও আইবার নইছিলাম। ও আমারে একাই ডাইকা নইছে, কয়, তোরে তিলা ঘুঘু দিমুনে। তুই ম্যাডামরে কইস না।
— আমি অমন কইনাই ম্যাডাম। কইছি আমার কাছে একদিন ঘুঘু আছাল। সিয়াম দুইরাত ধইর‍্যা আমার কাছে দিয়া গ্যাছে গা। নুরই সিয়াম কাকুরে কইছে, কুটা টান দিয়া দেখছি সিয়াম কাকু। আমাদের কি দলে নিবা নাকি? পাখি দু তিন দিনের ভেতরে ঘুসি (বাচ্চা) দিব।

সত্য সামনে উঠে আসায়, নূর ভয় পেয়ে যায়।
— হ্যাঁ, আমি কইছিলাম। কিন্তু বাদ, এহন আমি বাদ।

রিজভি সুযোগ পেয়ে যায়,
— এহন বাদ ক্যা? ম্যাডাম নুর আর মুজাহিদ গ্যাছাল, ওই যে মাদরাসার পেছনের গাছের ছাও নিবার। কয় যেদিন কা ছাও পাড়বি, সেদিনকা আমারে নিয়া পাড়বি। ছাও নিমু।

মামুন রাগ দেখায়,
— তুই যে বাসা থেইকা আনছত পাহির ছাও, তুই সেই বাসাত দিয়াইবি।
— চিকন বাহা,আঙ্গো বাড়ির পেছনে বড়ো গাছ থেইকা যা পাড়ছিলাম, কাইলকা রনি আমার থেইকা তার দুইডা পাখির ছাও নিয়া গেলো। একটা হরিকেল আছে কইতরে বড়ো কইর‍্যা ফেলছে। উইড়া যাবো গা। তহন মারদাসাত আইনা ছাইড়া দিমু। সিয়াম পাড়ছে এক গাছ থেইকা, আমি পাড়ছি আরেক গাছ থেইকা,ওরডা ও ছাইড়া দিকগা। আমারডা আমি দিমনি।

টিফিনের ঘন্টা পড়ে ম্যাডাম বলেন,
— চলো রিজভি তোমাদের বাড়িতে যাবো। তুমি আমার সামনে পাখিগুলো তাদের মা পাখির কাছে দিয়ে আসবে।

মামুন, নূর, আশরাফুল আর রিজভিকে নিয়ে রিজভিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে ম্যাডাম রওনা হয়। পথে যেতে ঘুঘুদের বসতবাড়ি অর্থাৎ পাতায় ছাওয়া গাছগুলো দেখতে দেখতে যায়। নূর দুটো ঘুঘুর দিকে তাকিয়ে বলে,
— ম্যাডাম, কাইলকা একটা বিলাই এরকম দুইটা ঘুঘু মাইর‍্যা আনছাল। এহন বিলাইয়ের বিচার করবো কে?

ম্যাডাম জবাব দেয়,
— বিলাই ঘুঘু মারে নাই। মানুষ ঘুঘু মেরে ফেলে দিয়েছে, বিলাই ঘাড়ে করে তা বসতবাটিতে বয়ে এনেছে।

রিজভিদের বাড়ি পৌঁছে যায় ম্যাডাম। রিজভির মা তাদের শোবার ঘরে ম্যাডামকে বসতে দেয়। ম্যাডাম রিজভিকে, আশরাফুলকে আর নুরকে সিয়ামের কাছ থেকে পাখি আনবার নির্দেশ দেয়। কিছু মহিলা রিজভিদের বাসায় জড়ো হয়।
— পাহি তো এহন বাসাত দিয়াইলে পাহি নিবো না। ফালাইয়া দিবো। মানষের হুয়া(ছোঁয়া) তা পাহি নেয় না।
— হ, হাছা কথা। পাখি উড়বার শিহুক। পাহা মেলুক। রেজবি উড়াইয়া দিব।

রিজভি তার বন্ধুদের নিয়ে ফিরে আসে। সিয়াম এবং রনি তাকে পাখি দেয় না। ম্যাডাম আবারো তাকে পাখি আনতে পাঠায়। কিন্তু তারা পাখি দেয় না। রনি আসে একপর্যায়ে। ম্যাডাম জিজ্ঞাসা করে,
— ঘুঘু কোথায়?
— ম্যাডাম,ভাগের ঘুঘু। আমি এক জোড়া পাড়ছিলাম। রিজভি দুই জোড়া পাড়ছাল আর সিয়াম একজোড়া পাড়ছাল। সব এহন সিয়াম গো বাগে। হে দিবো না।

ম্যাডাম জিজ্ঞাসা করে,
— কে দিচ্ছে না? কি বলছে ঘুঘু চাইলে?

রনি দৌড়ে চলে যায়। রিজভি জবাব দেয়,
– ম্যাডাম, সিয়াম আইবার চাইছিল কিন্তু ওর বড়ো ভাই জিহাদ ওরে গালাই। কয়, এই বোকাচোদা তুই কই যাইতাছোস? পাখি দিয়া দ্যাখ বোকাচোদা। অর্থাৎ জিহাদ হুমকি পাড়ল।

ম্যাডাম বুঝতে পারে, পাখি গুলো বিক্রয় হয়ে যাবে, নয়তো মারা যাবে। রিজভিদের ঘরে তাই গায়ের জড়ানো ওড়নাটা খুলে স্বাভাবিক ভাবে গায়ে দিয়ে বসে। তার দুই ছাত্রের সাথে কথা বলে। মামুন ম্যাডাম কে তার মনের কথা বলে,
— আহুন ম্যাডাম, যাইগা। দিবো না হ্যারা। ছাইড়্যা দিলে এতোক্ষনে আনতো এইহানে ঘুঘু।
— দাঁড়াও একটু। যদি আনে।

মনে আশা নিয়ে বিশ্রাম নেয় রিজভিদের ঘরে। এরকম সময় ঘরে চারজন বেটা মানুষ এবং কয়েকজন শিশু এবং কয়েকজন মহিলা প্রবেশ করে। তারা প্রবেশের অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়ে। এবং একটার পরে একটা কথা বলতে থাকে।
— হ্যাঁ, আমি সিয়াম, ঘুঘু ধরছি, কি কইরবেন আপনে? ছাত্রত্ব বাতিল কইর‍্যা দিবেন? দ্যান গা। ঘুঘু ছাড়মু না। পালমু, দরকার হয় খামু নইলে ছাইড়্যা দিমু। আপনের কী?॥
— আপনে এই দুপুরে বাচ্চাগো নিয়া রঙ তামাশা করতে আইছুন। মারদাসার আরো শিক্ষক তো আছে তাগো উশ পিশ নাই ঘঘু লয়া, আপনের কি ঠ্যাকা? ঘুঘু ধইর‍্যা, ডেক ধইর‍্যা মানুষ খায়, বিক্রি করে তহন আপনে কই থাহেন? এহন আইছুন রঙ দেখাইতো।

জিহাদ খুব ডাকাতি ভাব দেখাই,

— ঘুঘু আমার, হরিকেল আমার। আমি আপনের ছাত্র ছিলাম না। পড়াইছুন মারদাসাত আমারে আপনে। ছাত্রত্ব দেখাইতে আইছুন। ঘুঘু ধর‍্যা যাবো না। পাখি ধর‍্যা যাবো না। আমি ধরমু। ধরেছি। এহন আপনে কি কইরবেন কইর‍্যা নুন। যান গা। অ্যা, আইছে পাখি ছাইড়্যা দিবার। পড়াইছুন আমারে?

হঠাৎ সকলে বিদ্রোহ করে, নুরের চাচা চিৎকার করে, অনেকটা মেয়েদের প্রতি রোকপাক না সামলাতে পারা বিষয়ের মতো,

— পাখি ধরছে হেই বাড়ির সিয়ামো। হ্যাঁ এই বাড়িত আয়া বইসা রইছে ক্যা? পাখি কি এই বাড়ির পুলাপানে ধইরছে। আজাইরা আয়া বইয়্যা রইছে।
– হ্যাঁ, আপনে আইছুন ক্যা? আপনি দণ্ডনীয় অপরাধ কইতাছুন। ধরেছি যান গা। আচ্ছো,পাহি এহন ছাইড়্যা দিমু। মইর‍্যা গেলে গা আপনের নামে কেস দিমু। পাহি যহন বেঁচে মানুষ তহন কই থাহুন?

ম্যাডাম সবার কথা শোনে। জবাব দেয়,
— এখানে আমি কারোর ছাত্রত্ব বাতিল করতে আসিনি। টিচারগিরি দেখাতেও আসিনি। ছাত্রত্বগিরিও দেখতে আসিনি,এখানে আমি আমার ছাত্ররা পাখি ধরেছে সেই পাখির ছানা, মা পাখির বাসায় ফেরত দেবার জন্য এসেছি। যা অপরাধ তা না করবার শিক্ষা অবশ্যই আমি আমার ছাত্রদের দেবো। আর আপনারা তো দেখছি বেশ জ্ঞানী। তা যখন বাচ্চারা পাখি ধরে, পাখি খায় এবং পাখি বেঁচে তখন বারণ করেন না কেন? বলেন না কেন এটা অপরাধ? আমি তো যেই মুহূর্তে জেনেছি সেই মুহূর্তে আমার বাচ্চাদের সতর্ক করতে এসেছি। মা পাখির কাছে ছানাকে ফিরিয়ে দিতে এসেছি।

ছেলেগুলো চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে চলে যায়। ম্যাডাম তার বাচ্চাদের নিয়ে মাদ্রাসায় ফিরে আসবার জন্য প্রস্তুতি নেয়। ওড়নাটা আবার গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে নেয়। রিজভির আম্মা ম্যাডাম কে এক গ্লাস লেবুর সরবত দেয়। ম্যাডাম খেতে চায় না। কিন্তু জোর করে খাওয়ায়। ভাত খাবার জন্য পীড়াপীড়ি করে কিন্তু ম্যাডাম মাদ্রাসার পথ ধরে। পথে দেখে চিল্লাপাল্লা করা লোকদের ভেতরে একজন। তিনি বলেন,

— ম্যাডাম, না বুইঝা পাখি পাড়া, ধরা ভুল হয়া গেছে বাচ্চাগো। এবং আপনের সাথে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করাটা। সরি ম্যাডাম। মনে রাইখেন না।

ম্যাডাম তার ছাত্রদের নিয়ে মাদ্রাসায় ফেরে। অফিসরুমে বসে মোস্ট সিনিয়র পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে রাগ দেখায়। সিনিয়র কলিগদের রাগ দেখায়।
— বিএসসি স্যার, আপনার এলাকায় মানুষ পাখি ধরে আপনি কিছু বলেন না কেন?
— আমীর আঙ্কেল, আপনার পুতা পাখি ধরে আপনি কিছু বলেন না সেজন্য আপনার শ্বাসকষ্ট হয়েছে।
— মিজান স্যার, আপনাদের এলাকার মানুষেরা তো মানুষ না সব অমানুষ। পাখি ধরে খায়।
— তোফাজ্জল স্যার, আপনি দেখি সব জাগায় চেয়ারে লর্ড স্টাইলে বসে থাকেন। পাখি মারে, চারটা শেয়ালকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে কিছু বললেন না কেন?

বিএসসি এবং মিজান স্যার কোন কথা বলেন না। কিন্তু আমীর আঙ্কেল বলেন,
— শিয়াল মারবো না, হেরা কুইরকা ধইর‍্যা হাঁস ধইর‍্যা খায়। পাখি বাচ্চারা ধরবো না!

তোফাজ্জল স্যার বলেন,
— শিয়াল গুলো আমার বাড়ির জন্য বেশ ভালোছিল।

আমির দপ্তরী প্রতিবাদ করে,
— বেশ ভালো ছিলো, আমার দুটো মুরগি খাইয়্যা গেল।

ম্যাডাম চিৎকার করেন,
– খাবে না মুরগি। তাদের খাদ্য খাবার প্রয়োজন নেই? আপনার যদি বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে খাদ্য দরকার হয়, শেয়ালেরও হবে। আপনার যেমন বেঁচে থাকা অধিকার তেমনই শিয়াল এবং পাখি এমনকী ছোট যে পিঁপড়া তারও বেঁচে থাকবার অধিকার আছে।

কথাগুলো বলে ম্যাডাম ক্লাসে চলে যায়। ক্লাস করাতে করাতে অষ্টম ঘন্টা বেজে যায়। ম্যাডাম বাড়ি ফিরে আসে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। বাড়ি ফিরে খাওয়ার পরে রাগ শান্ত হলে ভাবে, আমীর আঙ্কেলকে তার শ্বাসকষ্ট মানে তার দুর্বল জায়গাটায় আঘাত করে কথা বলা উচিত হয়নি।

চার

বাচ্চারা প্রায়ই নতুন মসজিদের হুজুর অর্থাৎ নুরানি হুজুরের উদাহরণ দেয়,
— হুজুরে কইছে পাখি খাওন যাবো, ধরন যাবো। পালন যাবো।

তাই বুধবার মাদ্রাসায় ম্যাডাম একটু তাড়াতাড়ি যায়। উদ্দেশ্যে নুরানি হুজুরের সঙ্গে কথা বলবেন।

ম্যাডাম অফিসরুমে ব্যাগ রেখে বেশ আশা নিয়ে নুরানি ক্লাসরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে হুজুরের অনুমতি নেয়।
— হুজুর আসবো? আপনার সঙ্গে এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটু কথা ছিলো।

মুখটা একটু বেজার, হুজুরের থুতনি বিরক্তিতে ঝুলে পড়ল। মুখ খানিকটা চোঙা করে বললেন,

— আসুন।

ম্যাডাম ক্লাসরুমে প্রবেশ করেন,
– রিজভি এবং নুর দাঁড়াও।

ছাত্রছাত্রীরা সবাই জিহাদকেও দাঁড় করায়।

— ম্যাডাম, এঙনা জংলা কইতর ধরে। এগুলারেও খারাইতে কন।

রিজভি, নূর এবং জিহাদ দাঁড়ায়।
— হুজুর, এরা পাখি ধরে, পাখি খায় এবং পাখি পোষে। পাখি আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। ওদের আপনি একটু বারণ করবেন। যেন ওরা পাখি না ধরে। পাখি না খায়। পাখি ধরা দণ্ডণীয় অপরাধ। এই দেখুন, আমি ওদের পড়েই শোনাচ্ছি।

“পাখি শিকার দণ্ডনীয় অপরাধ। ১৯৭৪ সালে বন্য প্রাণী রক্ষা আইন ও ২০১২ সালে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে দণ্ডের বিধান রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছর জেল, এক লাখ টাকা দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণের বিধানও রয়েছে।”

হুজুরের মেজাজ চড়াও হয়ে যায়,
— কেন? পাখি খাওয়া জায়েজ। কোরানে আছে পাখি খাওন যাবো। তাহলে ওরা খাইবো না ক্যা? ধরবে না ক্যা? মানুষ খুন করছে মানুষ তাই কিছু হইতাছে না। আর আইছে পাখি লয়া। আপনে পর্দা ছাড়া ঘুইর‍্যা বেড়াইতাছুন এইহানে আইছুন, এটা হইলো গিয়া নাজায়েজ। আপনে আইছুন পাখি নিয়া কথা কইতো।
— আপনি পর্দা সম্পর্কে কী জানেন?
— কে কইছে আপনের কইতর খাওয়া যাইবো না। ডেক খাওন যাইবো না। ঘুঘু খাওন যাইবো না। বক খাওন যাইবো না? কোরান এগুলো খাওন জায়েজ করছে। খাওন যাবো না চিল শকুন, টিয়া।

হুজুর ক্ষিপ্ত হওয়ায় ম্যাডাম বিরক্ত হয়। প্রত্যাশা ছিল আলোচনা হয়তো সম্ভব।

— কোরানের কোন আয়াতে আল্লাহ এই কথা বলেছেন, “হে বান্দা, তোমরা ঘুঘু খাও, ডাহুক খাও, বক খাও?”

এইবার হুজুর তার মনোবাসনা পরিষ্কার প্রকাশ করে। তার পেটে লুকিয়ে থাকা আসল গুপ্ত কথাটা বলে ফেললেন।

— আগিলা দিনে মোহাম্মদ নয় বছর বয়স্ক মেয়ে বিয়ে করবার কথা কয়া গেছে, আর এহন আইন কইর‍্যা আঠারো বছর করছে। মেয়েরা পাপ কইর‍্যা উদ্ধার কইর‍্যা দিতাছে। ত্রিশ বছর পার হইতাছে মাইয়্যারা বিবাহ করতাছে না। আইছে জায়েজ পাখি খাওয়া নিয়া কথা কইতো।

কথাটা অবশ্য ম্যাডামকে উদ্দেশ্য করেই বলা। নুরানি হুজুর জানে চাকদহে ম্যাডামকে ঘায়েল করতে হলে বিবি আয়েশার বিয়ের বয়স নিয়ে মুখরোচক কথাটা বলা মোক্ষম। ম্যাডামকে এভাবে হামলার অবশ্য উপযোগিতাও আছে। এই গ্রামের হুজুর পারলে নয় বছরের মেয়েও বিয়ে করতে পারেন। এটা জায়েজ। নবী যখন পেরেছেন, নূরানি হুজুর কেন পারবেন না। হুজুর বক বক করতে থাকে। ম্যাডাম উত্তর দিতে বাধ্য হয়।
— মোহাম্মদ নয় বছরের মেয়ে বিয়ে করছে, অথচ আইন করে সেটা আঠারো বছর করা হয়েছে। এখন বন্যপ্রাণী রক্ষার আইন করে পাখি ধরা পাখি খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এইগুলা কোরান বিরোধী আইন। এগুলো আমাকে বলে লাভ নাই, শুধু আপনি আমার বাচ্চাদের শিখাবেন না যে পাখি খাওয়া ভালো। শেখাবেন, বন্য প্রাণী ধ্বংস করা দণ্ডনীয় অপরাধ। আপনি দেশের আইন ভঙ্গ করছেন, মাদ্রাসায় বাচ্চাদের নুরানী শিক্ষা দেন, মসজিদে ইমামতি করেন অথচ সরকারের আইন ও নির্দেশ মানেন না। শুধু তাই না বাচ্চাদের বনে পশু পাখি ধরা ও হত্যার উস্কনি দিচ্ছেন। কোরান বিরোধী মত প্রচার করছেন। কোরান ‘জায়েজ’ বলা মানেই বন্য পাখি পশু ধরা, হত্যা করা ও খেতে বলার নির্দেশ না। কোরান উল্টোটা বলেছে। মানুষ আল্লার খলিফা, তার মানে নিরীহ পশপাখির আবাস রক্ষা করা, তাদের প্রাণের জিম্মাদারি নেওয়া, বন ও বনের আবাসী পশুপাখি জীবজন্তুর সুরক্ষা ঈমানের অংশ। যারা সেটা করে না তারা আল্লাহ মানে না। বাচ্চারা আপনার উদাহরণ দেয় যে, হুজুরেও তো খাইবার চাইছে ঘুঘু।

বন ও বনের আবাসী পশুপাখি জীবজন্তুর সুরক্ষা ঈমানের অংশ। কথাটা ম্যাডামের নিজের কথা তার নিজের কানেও খুব শক্তিশালী ঠেকে। এবার হুজুর ভয় পেয়ে যায়। তিনি ঈমান হারাতের রাজি না।

— কহন আমি খাইবার চাইছি! আমি পুষবার চাইছি।

রিজভি জবাব দেয়,
— হ, ম্যাডাম, হুজুর পুষবার চাইছিল।
— মিথ্যা বলছ কেন? কিসের ভয়ে রিজভি?

ছাত্রদের মধ্যে থেকে মুজাহিদুল দাঁড়ায়,
— হুনুন ম্যাডাম, আমরা কোরানের কথা হুনুম, আপনের কথা হুনুম না। শেখ হাসিনা আইলেও না।
— আমি কোরানের কথাই বলছি। পাখি প্রাণ প্রকৃতি রক্ষা করে। মুজাহিদুল, পাখি মারবে না। ধরবে না। খাবে না।

হুজুর যোগ করে,
— পাখি খাওয়া জায়েজ। আপনে হাদিস কোরান জানুইন না, আমারে আইছেন শিখাইতে।
— বনের পাখি ধরা জায়েজ না। আমি পাখি খাওয়া জায়েজ কী জায়েজ না সেই তর্ক করতে আসিনি। আমি বনের পাখি ধরা আইনে নিষিদ্ধ এবং সেটা কোরানের আদর্শ বিরোধী সেটা আপনাকে জানাতে এসেছি। বাচ্চাদের গুনাহর কাজ করতে উস্কানি দেবেন না। হাদিস কুরান না জানলে আমি মাদ্রাসার শিক্ষক কেন? আপনি আমার বাচ্চাদের পাখি মারতে নিষেধ করবেন এটাই বলতে এসেছি আপনাকে। দেশের আইনের কথা বলে যাচ্ছি। জায়েজ নাজায়েজ হাদিস কোরান কোন কিছুই আপনাকে শিখাইতে আসিনি। নিজের লোভের ওপরে নিজের বিবেককে স্থান দিতে শিখুন।

হুজুর রুক্ষ হয়ে ওঠে।

— আপনার বাচ্চাদের আপনি দণ্ডনীয় অপরাধ শেখান। আমি আমার নুরানির বাচ্চাদের জায়েজ শেখাবো। পাখি খাওয়া, ধরা, পোষা জায়েজ
— না, আপনি উত্তেজিত হয়ে আমার বাচ্চাদের প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস করতে শেখাবেন না।

ম্যাডাম এবং হুজুরে তর্কবিতর্কের মধ্যে ক্লাস টেনের তিনজন ছাত্রী যায় ম্যাডাম কে ডাকতে,
— ম্যাডাম, আপনার জন্য দুধ আনছেন এক আন্টি। আপনাকে ডাকছেন।

ম্যাডাম চলে আসবার পথে আবার ফিরে দাঁড়ায়, শুনতে পাই,
— হে নিজে পর্দা ছাড়া থাহে, পাখি খাইতে নিষেধ করতো আহে।

বাচ্চারা হুজুরকে সতর্ক করে,
— হুজুর, ম্যাডাম হুনতো পাইতাছে।

ম্যাডাম তার ক্লাস টেনের শিক্ষার্থীদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে কমলা আন্টির কাছ থেকে গরুর দুধ নিয়ে দুধের টাকা মেটায়।

পাঁচ

সপ্তম পিরিয়ডে সপ্তম শ্রেণিতে ক্লাস নিতে গিয়ে ম্যাডাম রিজভি কে দাঁড়াতে বলেন,
— ব্যাটা, তুমি সকালে আমাকে কি বলেছিলে?
— কইছিলাম পাখি ছাড়মু না।
— আর কি বলেছিলে?
— আপনে কী করবেন কইর‍্যা নুন গা।
— তারপর?
— আপনের ক্লাস আমি করলাম না তো কি হবো, আপনে আমাকে বকেছিলেন যে তাই রাগ কইর‍্যা এডি কইছিলাম ম্যাডাম।
— হ্যাঁ, আমি তোমাকে বকেছিলাম। এই পাঁচমাসে লেখাপড়ার জন্য আমি তোমাকে কয়দিন বকেছি?
— লেহাপড়ার জন্য আর দুষ্টামির জন্য তিন দিন বকা খাইছি এই পাঁচ মাসে।
— আর আজ কতোবার বকা খেয়েছো?
— তিনবার।
— তিনবার বকা দিয়েছি তাতে তুমি আঘাত পেয়েছো। সহ্য করতে না পেরে তুমি আমাকে অসম্মান করেছো। এখন ভাবো, তুমি যখন হরিয়াল পাড়ছিলে হরিয়ালের মা তখন কি করছিলো?
— ডাকাডাকি করছাল। এ ডাল থেইকা ওই ডালে।
— ঘুঘুর মা কী করছিল?
— এই ডাল থেইক্যা ওই ডালে ছুটছাল। কিন্তু ডাকছাল না।
— তুমি আমার বকা সহ্য করতে না পেরে আমাকে হুমকি দিয়েছো। আর মা পাখিটা তার হৃদয়ে আঘাত পেয়েছে। সে ছটফট করে তোমাকে হুমকি দিয়েছে। অভিযোগ জানিয়েছে স্বয়ং খোদার কাছে। এখন বলো তার ফরিয়াদ কি তোমার কাছে অভিশাপ রূপে আল্লাহ ফেরত দিতে পারে না? তোমার হাতে যদি ব্যথা পাও এর চেয়ে দ্বিগুন ব্যথা নিয়ে মা ঘুঘু, মা হরিয়াল দিন পার করছে। তোমার আনন্দ তাতে শুধু খয় হচ্ছে। আমার সোনার ছেলে তুমি। পাখি যদি সত্যিই তার বাচ্চাকে না নেয় তবে পালক উঠা মাত্র তাকে ছেড়ে দিও। সেদিন মাদ্রাসায় আমরা অনুষ্ঠান করে পাখি অবমুক্ত করে দেব। ঠিক?
—আচ্ছা ম্যাডাম, আমার কাছে তো শুধু হরিকালির ছাওডা আছে। হেরে আমি ছাইড়্যা দিমু।
— আর ঘুঘু?
— সিয়ামে যদি দেয়, তাইলে দিমু।
— এইতো আমার সুন্দর ছেলে। তোমার বন্ধুদের দিকে তাকাও। দেখো, এই রোদ্রে ওরা গাছে চড়ে পাখি পাড়ে না। ঘরে বসে খেলে, বই পড়ে। তাই ওরা কতো সুন্দর হয়েছে। আর তুমি শুকনা কালো হয়ে গেছো। এখন থেকে পাখি পাড়ার সময়টুকু আমরা পড়ব, ঘরে বসে খেলব। রোদ পড়লে,বিকাল হলে মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল খেলবো। তাই না বাচ্চারা?
— জ্বি, ম্যাডাম।

ছয়

বৃহস্পতিবার সকাল,নুরানি ক্লাস চলছে। হুজুর বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে করে বক্তব্য দিচ্ছেন।

— হুন তরা সব পর্দা কইর‍্যা থাকবি। পর্দা ছাড়া ম্যাডাম যদি কিছু কয়, যদি কয় নেকাব খুইল্যা হ্যাল দে তেইলে তরা কবি আপনের ক্লাস আমরা করুম না। এই ইসরাত, আয়েশা তরা নেকাব পরস নাই ক্যারে?
— হুজুর, ম্যাডাম আমাগো ক্লাসে নেকাব খুইল্যা রাখতো কয়। তাই মাস্ক পইর‍্যা আহি। আর ম্যাডাম না মারদাসাত শাড়ি পিন্দে আহে।

মাইশা আয়েশাকে জবাব দেয়,
— আয়েশা, ম্যাডাম কি খালি শাড়ি পিন্দে আহে! হিজাব পইর‍্যাও আহে।

হুজুর তার ফতোয়া জারি করে,
— যদি জালনা তালা দিয়া বন্ধ কইর‍্যা থোস,আর যদি দরজা রাতে খুইল্যা থুইয়্যা ঘুমাইয়া পরস তাহলে কি চুর চুরি করবার পারব না? ধর তুই হিজাব পইর‍্যা, বোরকা পিন্দা, মুখ খুইল্যা ঘুরোস, মানষে তরে চিনব না? একদিন আমার বইনে হিজাব পইর‍্যা মুখ বিন্ধ্যা আমার চোহের সামন দিয়া গ্যালো, আমি দি চিনবার পারি নাই। তাহলে বুঝ হিজাবের কেমুন মূল্য।

মুজাহিদুল উঠে দাঁড়ায় হুজুরের কথা শুনে,
— হ, মেয়েরা তরা না হুজুরের কথা হুনবি। ওই তার ছেড়া ম্যাডামের কথা হুনবি না। ম্যাডাম জানুন, ঐ পাগল ম্যাডামের কাছে না হ্যারা ব্যাক কিছু বিচার দেয়।

আয়েশা উচ্চশব্দে কথা বলে,
—ওই ম্যাডামের কথা ক্যাডা হোনে, কে ভয় পাই ওডিরে। হুজুর আমাগো শক্তি বাড়াইয়া দিলো। এহন আমাগো ইচ্ছামতো চলমু।

শিক্ষার্থীরা একে একে ম্যাডামের নামে অভিযোগ দিতে থাকে, তাহমিনা উঠে দাঁড়ায়, সে ক্লাস ফোরে পড়ে। অথচ ম্যাডাম ক্লাস ফোরে ক্লাস নেয় না।

— হ, হুজুর ম্যাডাম না খোলামেলা থাকতে পছন্দ করে। আমারে একদিন কইছাল এই বোরকা চলব না। তোমাদের বড়ো আপু আছে না, যে বোরকা পরে ঐ বোরকা পইর‍্যা আসবা।
— হ, হুজুর, ওডি গ্যাঞ্জি পইর‍্যা, প্লাজো পইর‍্যা, ওড়না ছাড়া মারাদাসাত আহে। হুজুরগো সামনে পিন্দে ঘুরে।
—হ, হুজুর হে, না উড়না খুইল্যা থুইয়্যা আমাগো সামনে চুল আচড়ায়।
— হ, হুজুর ম্যাডাম মাস্ক পরতে বারণ করছাল।

হুজুর বাচ্চাদের চুপ করান,

—মাস্ক পরবি না তরা, নেকাব পরবি। নেকাব যদি খুলতো বলে আস্তে কইর‍্যা বের হয়্যা সুপারের কাছে কমপ্লেন জানাবি। আমিও সুপার হুজুরের কাছে কমপ্লেন করব। ঐ তার ছেড়া ম্যাডামের কথা আর হুনবি না
— হ, হুজুর ওই ম্যাডামের কথা আর হুনিনা। ওরে দেইখ্যা আর ডরাই কিডা!
— হের অবস্থা হইলো, আগলা গরু বাইন্ধ্যা থুইছে, ছুটাছুটি করতাছে।

ক্লাস ফাইভের সুমাইয়া দাঁড়ায়, একই কথার দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তি করে,
—ম্যাডাম, ক্লাসরুমে ওড়না ছাড়া চুল আঁচড়ায়, গেঞ্জি আর প্লাজো পইর‍্যা মারদাসায় আহে, হুজুরগো দেইখ্যা মাথায় কাপড় দেয় না।

হুজুর যেন ম্যাডামকে চোখে দেখতে পায়, চোখ লালসায় চক চক করে। আরো জোরে ফতোয়া দেয়,
— তরা নেকাব খুলবি না। কইলে কমপ্লেন জানাবি আমার কাছো।

ম্যাডাম যথারীতি ক্লাসে গেলে রুটিন অনুযায়ী দ্বিতীয় ঘন্টায় ক্লাস সেভেনে যায়। ক্লাসে ঢুকে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করা মাত্র শিক্ষার্থীরা ঝড়ের বেগে হুজুর এবং তাদের কথাগুলো বলতে থাকে। ম্যাডাম প্রত্যেক ক্লাসের শিক্ষার্থীকে একজায়গায় ডাকে। জিজ্ঞাসা করে এক এক করে, প্রত্যেকে প্রত্যেকের ঘাড়ে দোষ চাপায়।

—ম্যাডাম আমি শুধু কইছি, হেই ও তো কইছে।

ম্যাডাম জিজ্ঞাসা করে, তোমরা আমার নামে মিথ্যাচার করলে কেন? জানোনা মিথ্যা বলা মহাপাপ?
সকলে সমস্বরে জবাব দেয়,
—ম্যাডাম হগলে কইতাছিল তাই আমিও কইয়্যা হালাইছি। অন্যের কথাইও হ হ করছি।

নুর দাঁড়ায়,
—ম্যাডাম, তহন হুজুগে পাইছাল। মনে করছিলাম পাইছি ম্যাডাম রে। কয়া নুই। মাতাল হয়্যা গেছলাম।
— হ, মাডাম আমিও কইছি যে, হুজুর ম্যাডামরে কইছি, দরকার পড়লে আপনের ক্লাস করমু না। তবু পাখি ছাইড়্যা দিমু না। ভাল্লাগছাল তহন কইতে সবার লগে লগে। এই মামুন রাও তো তহন হ হ কইছে।
— হ, ম্যাডাম, শুধু আমাগো মাইয়াগো দোষ না। পুলাগোও দোষ আছে। হেরা আমাগো লগে হ করছে হগল কথাত।

পড়ানো হয় না কিছুই। ম্যাডাম বাচ্চাদের আচরণে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে। ঘন্টা পড়ে। ক্লাস থেকে বাইরে বের হয়ে আসে।
সাত

রোববারে যথারীতি ম্যাডাম মাদ্রাসায় যায়। সকাল সাড়ে দশটায় ক্লাস সেভেনে উপস্থিত হয়। সেভেনের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ গুলো বড়ো। তারা সব তাদের বাংলা ম্যাডামের জন্য জমা করে রাখে কিনা জানা যায় না। কারণ অন্য শিক্ষকদের ক্লাসগুলো ম্যাডাম দেখতে পায় না। ক্লাসে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নেয়া মাত্র তাদের কথার ঝড় শুরু হয়। তাসলিমা এবং ফাল্গুনি কথার তুবড়ি ছোটায়,
—ম্যাডাম, রেজবি ওগো বেত্তে যে হরিকালির ছাও রাখছাল হেডি মারা গ্যাছে গা। হে মাইরা স্যানা আমাগো দুষ দেয়, তাসলিমার আর আমার।

তাসলিমা সায় দেয়,
— হ, ম্যাডাম, হাছাই।

ওদের অভিযোগ থামে না। ম্যাডাম জিজ্ঞাসা করে,তোমরা পাখির বাচ্চা স্পর্শ না করলে সে তোমাদের দোষ কিভাবে দেয়? তোমরা অবশ্যই স্পর্শ করছো।

সাথে সাথে রিজভি কথা বলবার সুযোগ পায়,
— হ্যারা ধরছাল আমার পাহির ছাও। ধইর‍্যা জুরে টিপি দিসে মইর‍্যা গ্যাছে গা।
— আমরা শুদ্যা হরিকালি ধরছি, ঘুঘুর ছাও তেইলে মরলো কিমুন কইর‍্যা?
— ম্যাডাম, আর ছাও ধরমু না। কানে ধরছি। আমারে আশরাফুল কইছাল ড্যাক ধরবার লাগি। আমি হেরে না কইছি।

শিক্ষার্থীরা সবাই কথা বলে,
— ম্যাডাম, আশরাফুল হ্যারে কইছাল ডাহুক ধরিগ্যা, যাবি?

হে কয় না, পাখি ধরন কোরানে জায়েজ ঠিকই, কিন্তু পাখি ধরলে পাখি অভিশাপ দেয়।

রিজভি তার সহপাঠীদের কথা শুনে লাজুক ভঙ্গিতে হাসে। যেন সে তার কথা দ্বারা সহপাঠীদের মন জয় করে নিয়েছে। ম্যাডাম ক্লাসে ফিরে যায়। তাদের ঘোষ অঘোষ এবং অল্পপ্রাণ মহাপ্রাণ ধ্বনি পড়ানো শুরু করে। শিক্ষার্থীরা পাঠে মনোযোগ দেয়।

ক চ ট ত প
খ ছ ঠ থ ফ
গ জ ড দ ব
ঘ ঝ ঢ ধ ভ

ক্লাসে পাঠের শব্দ শোনা যায়। পাশাপাশি দুটো রুম। একরুমে নুরানি হুজুরের ক্লাস চলে, আরেক রুমে ম্যাডামের। হুজুর জোরে জোরে পড়ান, তায়াম্মুমের তিন ফরজ। মনে মনে নিয়ত করা,পাক মাটিতে হাত মারিয়া, হাতে হাতে টুকা দিয়া সমস্ত মুখ একবার মাসেহ করা।

ম্যাডাম শেখান ঘর কেটে কেটে

ক চ ট ত প
খ ছ ঠ থ ফ
শ স হ

ঘন্টা বাজে, ম্যাডাম বোর্ড মুছে,উপকরণ গুলো নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ জানিয়ে শ্রেণীকক্ষ ত্যাগ করে। শিক্ষার্থীরা বসে সালাম দেয়।

বিকালে ডাহুক ডাকছে। ডাহুকের ডাকের মধ্যে একটা কাতর আর্তনাদ আছে। সেই আর্তনাদের মধ্যে আরও নানান পাখির ডাক মিলে মিশে একাকার হয়ে একটা মস্ত হাহাকারে পরিণত হতে চেষ্টা করে। একটি বড় জলাভূমি বা দহকে কেন্দ্র করে চাকদহ গ্রাম গড়ে উঠেছে। প্রকৃতি এখানে পুরাপুরি ধ্বংস হয় নি। তাই পাখপাখালির আওয়াজ আছে। পাখিদের ডাক হাহাকারে পরিণত হতে দিতে ম্যাডাম রাজি না।

মাদ্রাসা ছুটির পরে বাসায় ফিরে ঘরে ঢুকেই দেখলো একটা বড় প্যাকেট। বই এসেছে। মোড়ক খুলে এ কয়দিন যার জন্য অপেক্ষা সেটা হাজির হয়েছে। চিন্তে সহজ হয় তেমনি ছবি দিয়ে উপমহাদেশের পাখিদের চেনাবার জন্য সলিম আলীর বিখ্যাত বই, A Pictorial Guide to the Birds of the Indian Subcontinent.

ম্যাডামের সংকল্প দৃঢ় হয়। বাচ্চারা তাদের এলাকার পাখিদের চেনে, কোথায় কোন পাখি কোন গাছে ডিম দেবে, দিচ্ছে বা দেবে তার খবর রাখে। পাখিদের সঙ্গে তাদের জীবনের একটা যোগ আছে। সেটা শুধু খাদ্য খাদকের না। এই বাচ্চাদের মধ্যে হয়তো বড় কোন পাখিতত্ত্ববিদ সুপ্ত রয়েছেন। সব বাচ্চাদের চেহারা ম্যাডামের চোখের ওপর ভাসতে থাকে।

বাচ্চারা আকাশে উড়ছে। তাদের সবারই পাখা গজিয়ে গিয়েছে। এটা সলিম আলী কি করলেন? বাচ্চাদের মা বাবাদের ম্যাডাম কি জবাব দেবেন ভেবে আতংকিত হয়ে উঠলেন। কিন্তু বাচ্চারা উড়ছে, হাসছে, খেলছে।

— ম্যাডাম, নুরানি হুজুরকে বলে দিয়েন যেন আমাদের হাড্ডিগুড্ডি চাবাইয়া খাইয়া না ফালায়। পাখি ধরা দণ্ডনীয় অপরাধ।

বাচ্চারা চাকদহের বিস্তৃর্ণ জলাভূমির ওপর উড়তে থাকে। আজ তো শুক্রবার না। মাদ্রাসা খোলা। কিন্তু মনে হচ্ছে এখন থেকে সব বারই শুক্রবার। মাদ্রাসা চিরকালের জন্য বন্ধ। ওদের এখন ঘরে ফিরতে বলবে এই সাধ্য কারো নাই।

বাচ্চাদের ডাকতে গিয়ে ম্যাডাম নিজেও পাখি হয়ে যায়। হিজাব দিতে ভুল হয়। বাতাসে সারা আকাশে তার সস্তা প্রিন্ট শাড়ীও উড়তে থাকে। বাচ্চারা ছুটে ছুটে এসে ম্যাডামের শাড়ীর আঁচল ধরে উড়তে থাকে।

নীচে সলিম আলী তাঁর বিখ্যাত বাইনাকুলার দিয়ে ম্যাডাম এবং তার বাচ্চাদের পাখিদের উড়াউড়ি দেখে। এই প্রজাতির পাখির কথা তাঁর গ্রন্থে নাই।

তাতে কি? ম্যাডামের চোখে ঘুম নামে। পালক, পাখা ও দক্ষিণের বাতাস একাকার হয়ে চাকদহে রাত্রি নামে।

জেসমিন নাহার

তরুণ গল্পকার। উপন্যাস লিখনেও হাত দিয়েছেন। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকাতে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যশোহর জেলার শার্শা উপজেলায় বাড়ি। গোরপাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম (রহঃ) চিশতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। সেই কারণে ফকিরি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছ। মা রওশানারা বেগমের সঙ্গে বাস করেন জেসমিন। আধুনিকতার মধ্যে নামসাকিন হারিয়ে বিমূর্ত হতে চান না। প্রকৃতির মাঝে যাপিত জীবনকে মূর্তভাবে প

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top