
।। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন ।।
একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে
রাজার দোহাই দিয়ে
এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি,
মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি–
ঘাতক সৈন্যে ডাকি
‘মারো মারো’ ওঠে হাঁকি ।
গর্জনে মিশে পূজামন্ত্রের স্বর–
মানবপুত্র তীব্র ব্যথায় কহেন, হে ঈশ্বর !
এ পানপাত্র নিদারুণ বিষে ভরা
দূরে ফেলে দাও, দূরে ফেলে দাও ত্বরা ।।
অদ্ভুত আঁধারের এই দিনকাল, দিকে দিকে পুড়িয়ে ও পিটিয়ে মারার উৎসব, বিরুদ্ধমতের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে নিকেষ করার উৎসবে উন্মত্ত এপার-ওপার। হয়তো-বা চরাচর জুড়ে এই ক্রোধ ও হিংসার উদযাপন চলছে। সহবৎ-সহাবস্থান, সম্প্রীতি ও ইনসাফের প্রসঙ্গগুলি ক্রমেই ফিকে হয়ে গিয়েছে। এরই মাঝে এল যীশুখ্রিস্টের আবির্ভাব দিবস। যদিও রুশ অর্থোডক্স চার্চ অনুগামী-সহ বিশ্বের অনেক খ্রিস্টানরাই বিশ্বাস করেন না যে ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টের আবির্ভাব দিবস৷ আর তিনি যাদের কাছে নবী ঈসা, এমনকী ঈসানাথ যাদের কাছে, তারাও কেউ বা অনেকেই বিশ্বাস করেন না যে গ্রেগরিয় দিনপঞ্জির ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখ তাঁর আবির্ভাব দিবস। তথাপি যাঁহারা বিশ্বাস করেন এইটাই নিপীড়িতের মুক্তিদাতা খ্রিস্টের জন্মদিন, তাঁদের কেউ, যিনি দূর নির্জনে প্রান্তিক কোনো গীর্জায় পরমের এবাদত করেন আর নবী ঈসাকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন মা মরিয়মকেও, আমি সেই যীশুর আশিককে ‘বড়দিন’-এর শুভেচ্ছা জানাই।
সমাজমাধ্যম খুললেই দেখা যাচ্ছে, ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খ্রিস্টিয় সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ে গিয়ে ‘বড়দিন’ উদযাপন করছেন! একদিকে যখন এই চিত্র, তখনই আশেপাশে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক হামলারও খবর উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। আরএসএস-বিশ্বহিন্দু পরিষদ-বজরং দল-সহ উগ্র-দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা দিকে খ্রিস্টিয় ধর্মাবলম্বী মানুষের ওপর এবং তাঁদের চার্জে, গীর্জায় চলেছে সংগঠিত গৈরিক হামলা। এ অবশ্য নতুন কিছু নয়, এই বজরং দলই তো গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনসদের পুড়িয়ে মেরেছিল। এবং সেই হত্যাকে এইভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল যে খ্রিস্টিয় মিশনারীরা আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করছে! এই অভিযোগ কতটা সত্য তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, এ কথাও বলা উচিত যে যদি কেউ জোর করে বা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তকরণের চেষ্টা করে, সেটা নিন্দনীয় এবং বিচার্য। কিন্তু তারজন্য পুড়িয়ে মারা ঘটনা নিতান্তই বর্বর। কতটা বর্বর সেটা তো আমরা নানা সময়েই দেখেছি এবং দেখছি। আমরা সম্প্রতি দেখলাম, বাংলাদেশের তরুণ তুর্কি ওসমান হাদিকে প্রকাশ্য দিবালোকে দুষ্কৃতী গুলি করে পালাল। মৃত্যু হল হাদির। আর ঠিক তারপরেই ট্রেড ইউনিয়নের শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী ও গার্মেন্টস শ্রমিক দীপুচন্দ্র দাসকে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে মারা হল। পুড়িয়ে মারা হল আয়েষাকে। সেখানেই থামল না ঘটনা। ভারত জুড়েও পরপর চলতে থাকল পিটিয়ে মারার ঘটনা। যা শুরু হয়েছিল মোহাম্মদ আখলাখকে পিটিয়ে খুন করার মধ্য দিয়ে। আর তারপর সম্প্রতি গোটা ভারত জুড়ে বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশবিদ্বেষের রাজনীতকে সামনে রেখে ‘বাংলাদেশি’ ট্যাগ দিয়ে মবলিঞ্চিংয়ে ঘটনা ঘটেই চলেছে। এমনকী গীতাপাঠের আসরেও তো কর্মজীবী দুই প্রান্তিক মানুষকে কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে শারীরীকভাবে হেনস্থা করল হিন্দুত্ববাদীরা। এধরনের হামলা, এ ধরনের জাতিবাদী সংগঠিত সাম্প্রদায়িক হামলা, থেকে শুরু করে মব ভায়োলেন্সের পিছনে একদিকে বর্ণবাদী অন্যদিকে উপনিবেশিক মনন ও চিন্তাক্রমের সক্রিয়তা প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল। আজ এসবের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে কর্পোরেট পুঁজির সামাজিক বিন্যাস ও গোলকায়ন নিভর্র রাজনৈতিক বিনির্মাণ। যা আধিপত্য ও জুলমের ইতিহাসের পরম্পরাকেই স্থানভেদে অ্যাক্টিভ করে তুলছে। তৈরি করছ বিন্যাস-বিভাজনের সমাজ এবং প্রবল শক্তিশালী হয়ে উঠেছে উত্তর-সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠনের নীল নকশা।
এহেন অতি-দখিনা রাজনীতির বিশ্বচরাচরে ক্রুসেডিয় জায়গা থেকে নয় বরং মুক্তিকামী মানুষের আশেক নবী ঈসাকে স্মরণ করি। এমনকী যে ক্যাথলিক যাজক ক্রুসেডের ইতিহাসকে তোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনের মজলুমের পক্ষে দাঁড়ান, যাঁর ক্রশ হয়ে ওঠে মানুষ ভজনার ঈমান দণ্ড আর আগ্রাসনবাদী ইজরায়েলের বিরুদ্ধে জেহাদের ডাক, সেই ক্যাথলিক যাজককে ‘বড়দিন’-এর শুভেচ্ছা জানাই। সর্বহারা যেসব বাপ-মা কমদামী এক টুকরো কেক পরম যত্নে তুলে দেন তাঁদের শিশুসন্তানের মুখে, আমি সেই সকল বাপ-মাকে ‘বড়দিন’-এর শুভেচ্ছা জানাই। শতসহস্র এতিম/ অনাথ/ হতভাগা শিশু ও কিশোর যারা, যাদের নাম নাই, ধাম নাই কিংবাা সেইটুকু থাকলেও জীবনে কোনো বড়দিন নাই, আলো নাই- সেইসব যীশুদের জন্য মঙ্গল প্রার্থনা ও দোয়ার মধ্যে ‘বড়দিন’-এর সকালকে স্বাগত জানাই। এবং স্মরণ করি ও শ্রদ্ধা জানাই সেই গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনসদের। গেরুয়া সন্ত্রাসের আগুনে যারা পুড়ে মরেছিলেন। তাঁদের খুনের পালটা প্রত্যাঘাতে যেন রামরাজ্যের কোণায় কোণায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে, কেয়ামতের আগে সপ্তম আকাশের আড়াল হতে দুনিয়ায় ফের হাজির হবেন নবী ঈসা-খ্রিস্টের এই পপুলিস্ট জন্মদিনের মিথের ভিতরেও তাঁকে স্মরণে রেখে সেই অগ্নিজেহাদের প্রার্থনা করি খোদাতালার কাছে। প্রার্থনা করি যেন দীপুচন্দ্র দাসের খুনিরা অই দুনিয়ার দোজখের আগুনেই পুড়ে খাক হয়ে যায়। প্রার্থনা করি যেন ওসমান হাদীর খুনের পরিকল্পনাকারীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় উপমহাদেশ থেকে, প্রার্থনা করি আওয়ামী-জামাতি ও সংঘ সন্ত্রাসীদের যেন কবর তৈরি হয় মানুষের ভূমিতেই।
এছাড়া ‘বড়দিন’ নিয়ে আমাদের অন্য কোনো আদিখ্যেতা নাই। বড়দিনের আদিখ্যেতাকে বাজারবাদী মনে করি চিরদিন। যা ঔপনিবেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের সংস্কৃতির অংশ। নবী ঈশা বা যীশুখ্রিষ্টের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের বা ক্রুসেড সংস্কৃতি বা খ্রিস্টধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। খ্রিস্টধর্মের রাজনীতি বাদ দিলে ওই ধর্ম নিয়েও কোনো সমস্যা নেই। না থাকাই উচিত। দিনটিকে বড়দিন বলা হচ্ছে গ্লোবের আহ্নিক ও বার্ষিক ঘূর্ণনের কারণে, এই দিনটি থেকে দিনের দৈর্ঘ্য ক্রমে বড় হতে শুরু হবে, কিন্তু এই অর্থে বড় নয় যে ক্যাথলিক এম্পায়ারগণ দুনিয়ায় সবার বড়! যদিও এই ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম খ্রিস্টের নয়, বরং পোপ পলের৷ এই ক্যাথলিক খিস্টধর্ম অনুসারী পশ্চিমা এম্পায়ারগণ আসলে বিকৃতই করতে চেয়েছে নবী ঈসা বা ঈসানাথকে৷ ঈসা খ্রিস্টিয় আধিপত্যের কেউ নন৷ তিনি মুক্তিকামী মানুষের, তিনি আত্মভুবন চেনার তরিকার একজন সিদ্ধসাধক, একজন নবী, তিনি একজন যুগপুরুষ৷ আমরা অপেক্ষায় আছি তাঁর ফেরত আসার৷ কেয়ামতের আগে কোনো এক সময় ফ্যাতনা ও ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী মুদ্রাদানব, জাতিরাষ্ট্রজাত ও পুঁজিবাজারজাত দাজ্জালকে তিনি নিকেষ করতে নেমে আসবেন আকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তর হতে আবার৷ আমরা গেয়ে উঠবো আবারও রবি ঠাকুরের গান, ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়/ তোমারই হউক জয়৷

