।। সাঈদ উজ্জল ।।
ফকির লালনকে পুনরায় কোনও মঞ্চসজ্জিত ভাবের প্রতীক হিসেবে নয় বরং মানুষ ভজনার ভাবধারার সাধু লালন সাঁইয়ের ভক্তির ধারার প্রাণ-প্রকৃতির-সম্মিলনের ভাবের ফলিত রূপ মূর্ত করাই আমাদের দায়িত্ব। নদিয়ার ভাবকে পুনরুদ্ধার করা মানে অতীতকে স্মরণ নয়, বর্তমান সংগ্রামের ভিত নির্মাণ। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি যদি সত্যিই কিছু অর্থ বহন করে, তবে তা লালন ধাম থেকে বিতাড়িত মানুষের অংশগ্রহণেই প্রকাশ পাবে না হলে স্মৃতিহীনতার বালু সব ঢেকে দেবে। লালন শাহর তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ায় গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের আগমন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই দাবি তোলার এক বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে, কিন্তু কাজে না লাগালে সেটাও সাজসজ্জার উপকরণে পরিণত হবে। এই দায় এড়ানোর উপায় নেই। এখনই না বুঝলে লালন আর ফেরা সম্ভব হবে না, তিনি হয়ে উঠবেন আরেকটি বিক্রয়যোগ্য নাম, আর নদিয়ার ভাব চাপা পড়ে যাবে নিছক মেলা আর কৃষ্টির বোঝাপড়ায়।
এই প্রথমবার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস ‘পহেলা কার্তিক’ আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হচ্ছে। বহুদিন ধরে যে দিনটি ভাবচর্চার দিন হিসেবে নদিয়ার ফকিররা পালন করে এসেছেন, সেটাই এখন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পালন করা হচ্ছে। এর সঙ্গে আরও তাৎপর্যপূর্ণ খবর হচ্ছে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের ছেঁউড়িয়ায় উপস্থিতি, বিশ্বমাপের একজন চিন্তাবিদ, যিনি ঔপনিবেশিকতা, ভাষা, নিন্মবর্গ ও দেহরাজনীতি নিয়ে গভীরভাবে কাজ করেছেন। ফলে এ বছরের আয়োজনকে নিছক উৎসব বা প্রশাসনিক রীতি হিসেবে দেখলে ভুল হবে। বরং প্রশ্ন হল, রাষ্ট্র যখন অবশেষে স্মরণে বাধ্য হচ্ছে এবং একটি আন্তর্জাতিক বৌদ্ধিক উপস্থিতি ছেঁউড়িয়ায় আসছে, তখন এই সুযোগ চিন্তার পুনঃস্থাপনে ব্যবহৃত হবে, নাকি বিকৃতির নতুন মোড় তৈরি করবে?
কারণ এতদিন রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক কাঠামো এই দিনটিকে মেলা ও পর্যটন প্রদর্শনীতে নামিয়ে এনেছে। ভাবের উত্তরসূরী ফকির-দরবেশেরা ছেঁউড়িয়ার মূল ধাম থেকে কার্যত নির্বাসিত লালনের উত্তরাধিকার আজ আমলাতন্ত্রের হাতে বন্দি। লালন একাডেমি ও সরকারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাঁর ভাবমূর্তি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে; ভাবচর্চার মানুষরা বাদ পড়েছেন। যাঁর জীবন ছিল দেহ-মানুষের রূপান্তর ও সমতার সাধনা, তাঁকে বানানো হয়েছে সাংস্কৃতিক পণ্য।
সবচেয়ে প্রকট বিকৃতি হলো তাঁকে ‘বাউল সম্রাট’ নামে প্রচার করা। লালন নিজেকে সবসময় বলেছেন ‘ফকির’; তিনি কোথাও নিজেকে বাউল বলেননি। ‘বাউল সম্রাট’ শব্দবন্ধ তাঁকে ভাববিপ্লব থেকে সরিয়ে এনে মাদক, আতর, দেহতন্ত্র ও লোকনৃত্যের সঙ্গে গেঁথে দেয়—যা তাঁর সাধনার পরিপন্থী। এমনকি নন্দলাল বসুর আঁকা কল্পিত প্রতিকৃতিকেও আজ ‘আসল ছবি’ বলা হয়, যদিও লালন কোনও ছবি রেখে যাননি এবং তাঁর ধারায় প্রতিকৃতি বা মাজার-সংস্কৃতি স্বীকৃত নয়। ফকিরদের কাছে লালন সাঁইয়ের আশ্রম ‘লালন ধাম’ হিসাবে পরিচিত। একদিকে লালন যেমন উত্তর ভারতীয় বৈদিক পরম্পরার সাধক নন, তেমনই তিনি ইসালামিক সুফি সাধকও নন।
লালন নিয়ে বিকৃতিকে বোঝার জন্য ফিরে তাকাতে হয় নদিয়ার ভাবান্দোলনের ঐতিহাসিক উৎসে। সুলতানি বাংলার সামাজিক রূপান্তরের ভিতরে চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্যের যে ভাববিপ্লব গড়ে উঠেছিল, তা জাতপাত ও ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। লালন ছিলেন সেই ধারার সর্বাপেক্ষা রূপান্তরমুখী উত্তরাধিকারী। নদিয়ার মূলে ছিল প্রশ্ন, মানুষ কি কেবল শরীর? শরীর কি কেবল উপকরণ? প্রাচীন তন্ত্র শরীরকে কামনার বস্তুতে আর বৈষ্ণবধারা তাকে পাপশুদ্ধির যন্ত্রে পরিণত করলেও নদিয়ার উত্তর ছিল ভিন্ন: মানুষ একই সঙ্গে জীব ও পরম, বর্তমান দেহই চর্চার ক্ষেত্র। লালনের ভাব ছিল দেহ, প্রেম, সমতা ও প্রাণ-প্রকৃতি-পরমার্থের এক সম্মিলনের ভক্তিবাদী রাজনীতির নতুন সংলাপ। তিনি নব্যতন্ত্রের গুহ্য চর্চা ও বৈষ্ণব প্রার্থনার উভয় সংকট চিনেছিলেন। তাঁর পথ ছিল ‘রসতত্ত্ব থেকে ভাবতত্ত্বে’ উত্তরণ, যেখানে জাতপাত, নারী-পুরুষ, ভোগ-নিরাসক্তি, প্রকৃতি-মানব সব প্রশ্ন একসূত্রে বাঁধা। আজ পরিবেশ ও দেহরাজনীতির যে ভাষা আমরা খুঁজি, নদিয়া ভাব বহু আগে তার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
কিন্তু রাষ্ট্র, তথাকথিত বিধিবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতা ও পুঁজিবাদী সংস্কৃতি এই ধারাকে ভাঙছে। ধাম থেকে ফকিরদের সরিয়ে দিয়ে আমলাতন্ত্র লালনের জায়গা দখল করেছে। শোক ও ভাবচর্চার দিনকে বানানো হয়েছে মেলা ও অর্থনির্ভর প্রদর্শনী। ‘বাউল’ তকমা দিয়ে তাঁর বিপ্লবী অবস্থান আড়াল করা হচ্ছে। কালীগঙ্গার বুকে যেমন বালু জমে শুকিয়ে গেছে, তেমনই বৃহৎ নদিয়ারও ভাব আজ বিলুপ্তির পথে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে লালন সাঁইয়ের স্মরণ এবং গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের উপস্থিতি দুটোই সুযোগ ও বিপদ, উভয়ই। যদি রাষ্ট্রমাত্রিক উৎসবের আড়ালে ভাবচর্চাকারীদের আবার প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়, তবে এই আয়োজন আরেকটি বাজারোপযোগী প্রদর্শনী ছাড়া কিছু হবে না। আর যদি এই সদ্যপ্রাপ্ত স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে ভাবের ধারকরা তাঁদের অবস্থান ও অধিকারের দাবি তোলেন, তবে নদিয়া ভাবের পুনর্জাগরণ সম্ভব।
ফকির লালনকে পুনরায় কোনও মঞ্চসজ্জিত ভাবের প্রতীক হিসেবে নয় বরং মানুষ ভজনার ভাবধারার সাধু লালন সাঁইয়ের ভক্তির ধারার প্রাণ-প্রকৃতির-সম্মিলনের ভাবের ফলিত রূপ মূর্ত করাই আমাদের দায়িত্ব । নদিয়ার ভাবকে পুনরুদ্ধার করা মানে অতীতকে স্মরণ নয়, বর্তমান সংগ্রামের ভিত নির্মাণ। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি যদি সত্যিই কিছু অর্থ বহন করে, তবে তা লালন ধাম থেকে বিতাড়িত মানুষের অংশগ্রহণেই প্রকাশ পাবে না হলে স্মৃতিহীনতার বালু সব ঢেকে দেবে। লালন শাহর তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ায় গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের আগমন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই দাবি তোলার এক বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে, কিন্তু কাজে না লাগালে সেটাও সাজসজ্জার উপকরণে পরিণত হবে। এই দায় এড়ানোর উপায় নেই। এখনই না বুঝলে লালন আর ফেরা সম্ভব হবে না, তিনি হয়ে উঠবেন আরেকটি বিক্রয়যোগ্য নাম, আর নদিয়ার ভাব চাপা পড়ে যাবে নিছক মেলা আর কৃষ্টির বোঝাপড়ায়।