।। ইমরান আল হাদী ।।
জামিল হোসেন সি এন্ড বি রোড ক্রস করে পোলের পাশ দিয়ে বাইপাস ধরে কাউনিয়া রোডে যাবে। সেখানে কেষ্ট আছে তারে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে যাবে। এরকম পথের নিশানা ধইরা আগাইতে থাকে জামিল হোসেন। বাইপাসে নেমে সুব্রত নিজেরে ছেড়ে দেয়।
তারা রাস্তার পাশে পড়ে থাকলে কে যেন বলে,
—এই দিকে নিয়া আসেন মসজিদের বারান্দায় উনাকে বসান।
জামিল হোসেন দ্যাখে, বগুড়া নথুল্লাবাদ জামে মসজিদের খতিব সাহেব।
জামিল হোসেন সুব্রতরে হাঁচড়ে পাঁচড়ে নিয়ে ওঠে মসজিদের বারান্দায়। খতিব সাহেব সুব্রতরে ধরে শোয়ায়ে দেয়। এবং কী মনে করে জামিল হোসেন কে বলে,
—ওনাকে ধরেন মসজিদের ভিতরে নিয়ে যাই। এসি আছে তাতে উনার সুবিধা হবে।
জামিল হোসেন বলে, না থাক এখানেই ভলো আছে।
—ধরেন আমিও ধরি একটু সুস্থির হইক তারপর নিয়া যাইয়েন।
খতিব সাহেব বলার পরে জামিল হোসেন ক্ষীণ কণ্ঠে কেবল বলতে পারে,
—সে মোসলমান না তারে মসজিদের ভিতরে নেওয়া কী ঠিক হইবে।
—জীবন বাঁচানো ফরজ। আপনি ধরেন উনারে ভিতরে নিয়ে যাই। ভিতরে এসি আসে তাতে উনি একটু সুস্থির হবেন।
ছত্রিশ জুলাই, সোমবার
১.
রক্ত মাথা মুখ— ভয়ে, আতঙ্কে কুঁজোঁ হয়ে গেছে। একহাতে পতাকার দণ্ডটি ধরা অন্য হাত দিয়া হয় তো ফিরতি মার ঠেকাতে চাচ্ছে মেয়েটা। এই ছবিটার লগে আরো নানান ধরনের ছবি ফেসবুকে বারবার আসতে থাকলে জামিল হোসেনের দিনটা খারাপ হয়ে যায়।
কান্নাটা পেট থিকা মোচড় দিয়ে গলার কাছে আইসা দলাপাকায়ে গেল। জুতমতো কাঁন্দন গেলে একটু সুস্থির হওয়া যাইতো। জামিল হোসেন কাঁনতে জানে। পোষা বিলাইটার অসুখে কাঁন্দে। বিলের মধ্যে একাকিনী দাঁড়াইয়া থাকা হিজল গাছের ডালগুলা কেটে নেড়া করলে কাঁন্দে। আরো নানায় ছুতায় কাঁন্দে। তবে তার কাঁন্দন টুকো একান্ত ব্যক্তিগত ও নিভৃত বিষয়। কাঁন্দন টুকো জমায়ে আন্ধার ঘরে ফোঁপায়ে ফোঁপায়ে কাঁদার পরে জামিল হোসেনের সুস্থির লাগে। তার সুবিধা এই যে তার কাঁন্দন কাউরে দেখতে হয় না। একলা মানুষ, একলা বাড়ি, একলা ঘর একলা সংসার। বউটা এ কাঁদুনে স্বভাবের জন্য ছাইড়া গেল কি না কে জানে। তবে মেয়েটারে রাখতে পারলে সুবিধা হইতো। বাপ বেটি মিলে মনের আস মিটায়ে কানতে পারতো।
তার মেয়েটাও ঐ মেয়েটার বয়সী হয় কিনা–
নিজ মেয়ের মুখ মনে করার চেষ্টা করে জামিল হোসেন। তা আর পারে কই কত আগে দেখা হইছিল। সেই শেষবার — মেয়ের মা কাছে আসতে দেয় নাই।
জামিল হোসেন এখন কাঁনতে পারলে একটু হালকা হইতে পারতো –তা পারে ক্যামনে। হাজারে বিজারে মানুষের যাতায়াত। আবার কেষ্ট আইসা পড়তে পারে এখনি।
প্রতিদিন সকালে কেষ্ট পানের গোতা নিয়ে আসে। সাজি ডালা কুলা আর একটা নীচু জলচৌকি থাকে জামিল হোসেনের ফার্মেসির পিছন দিকে। কেষ্টর দোকান সাজানো হয়ে গেলে। জামিল হোসেন নিয়ম করে বলতে থাকে–
—কেষ্ট, কাল থিকা তুমি এই হানে আর দোকান করতে পারবা না। ফার্মেসির সামনে পান দোকান মানায় না।
কেষ্টর তাতে কোনো হেলদোল লক্ষ্য করা যায় না। সে বছর দুই এই একই কথা শুনে আসছে। সে হয়ত বলতে থাকবে—
—ডাক্তার, এই মৌসুমে সুবারি ( সুপারি) রাহি হইররা রাহা গ্যলে লাব হইতো। আপনের গাছের সুবারি কোলো একটাও ব্যাচবেন না। খালি পলিটিনে ভইররা রাকপেন। হের পর কী হরা লাগে মুই দেখমু।
এইভাবে আলাপটারে নিয়া যায় কোনো দিন পানে, পান থিকা চুনে, চুন থিকা ইলিশ মাছে— মাছ থিকা চায়ে। শ্রী কেষ্ট চা খাইতে বড় ভালো পায়। চা তার খাওয়া লাগে। লগে জামিল হোসেনরেও খাইতে হয়। তবে তারা কে কারে যে চা খাওয়ায় তা তারাও জানেনা।
আর খায় দুপুরের ভাত কয়টা— এক লগে। ভাত নিয়া আসে জামিল হোসেন। স্ব-পাকে শাকভাত ফুটায়ে নিয়ে আসে জামিল হোসেন। কেষ্ট মাঝে সাজে একটু ব্রয়লার মুরগী মাংস অথবা চাষের পাঙাশ মাছ, পাশের সস্তা হোটেল থিকা নিয়া আসে। তাতে জামিল হোসেন কিছু বলে না। তার আমিষ রান্ধনের সুযোগ হয়ে ওঠে না– কেষ্টর উছিলায় একটু খাওয়া হয়। জামিল হোসেন আর কেষ্টর আরেকটু মিল হইলো তারা পাশাপাশি গ্রামের লোক। নিকট প্রতিবেশী না হইলেও তাদের পূর্ব চিন-পরিচয় আছে। গ্রাম দেশে মানুষের দূরান্তে পরিচিত হইতে বাধা নাই। এবং জীবিকার উদ্দেশ্যে নিয়া তারা এই শহরে আসে।
আজকে কেষ্টর যেন দেরি হইলো। কেষ্ট আসলে জামিল হোসেনও যেন নিয়মের ব্যত্যয় করলো। কোন কথা না বইলা গম্ভীর হয়ে বইসা থাকে।
–আইজ গো কেত্তনখোলার (কীর্তনখোলা) খ্যাওয়া পারাইয়া আইতে অইছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাস্তা আটকাইয়া দেছে। বিরিজ বন্ধ।
–ক্যা! বিরিজ বন্ধ ক্যা।
কেষ্টরে জিজ্ঞেস করে জামিল হোসেন।
–ঢাকার ছাত্র গো আমলীগ মারছে, হেইর লইগ্যা…
কেষ্ট আরো কি সব বলতে থাকে তা জামিল হোসেন কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। সে আবার ফেসবুকে ঠুইকা পড়ে।
২.
কীর্তনখোলা — উত্তর দিক থিকা নামতে নামতে পাশ ফিরে শোয়ার ভঙ্গিমায় কুকুর কুণ্ডলী পাকায়ে দক্ষিণে নাইমা গেছে। বরিশাল নগরীরে রাখছে সেই কুণ্ডলীর মধ্যে। যেন-বা সে এক পোয়াতি নদী — তার নাভিকুণ্ডল থেকে নগরের শরীরে ছড়ায়ে গেছে বহু খাল। যদিও সেই সব খাল অনেকেই নাই — কিছু মৃত প্রায়। তেমনি এক পচা ক্ষত শরীর নিয়া বেঁচে আছে জেল খাল।
জেল খালের মধু মিয়ার পোলের উত্তর পাশে ছাত্র মেস আছে অনেক কয়টা। এর একটা মেসে থাকে সুব্রত মণ্ডল। বাড়ি খুলনার দাকোপ থানার বাজুয়া ইউনিয়নের কচা গ্রামে। এই তথ্য টুকু পাওয়া যাবে তার রুমের দেয়ালে সাঁটা একটা কাগজে। কালো কালির প্রিন্টে করা কাগজে এই সব তথ্যের সাথে আছে একটি ফোন নাম্বার — নাম্বরটির আগে লেখা ‘বুনডি’। সে সদ্য এই কাগটি ছাপিয়েছে। মোট পাঁচ কপি, এক কপি মানি ব্যাগে রাখছে। দেয়ালে এক কপি তিন কপি আছে টেবিলের ড্রয়ারে।
সুব্রত সম্পর্কে আরেকটা তথ্য পাওয়া যা যে, সে স্বজাতি দ্বারা বাস্তুচ্যুত। তার অপরাধ এই যে সে সনাতনী হয়ে বি এন পি র রাজনীতির করে। তার স্বজাতিরা হয়তো এইটাই মানতে পারেনা হিন্দু হয়ে একজন কী করে বিএনপি করে। দাকোপ যদিও সনাতন অধ্যুষিত তবু তারে পালিয়ে আসতে হয় বরিশালে— সুব্রত এই নগরে দূরাগত ছাত্র।
সুব্রত প্রথম মার খায় ষোলই জুলাই। মসজিদ গেট থিকা ছোট মিছিলটায় ভিড়ে যায় সে। মিছিলটা ঘিরে ফেলে তিন দিক দিয়া। দুই দিক দিয়া ছাত্রলীগ সামনে থিকা পুলিশ। কলা ভবনের চত্বরে পৌঁছলে মার শুরু হয়। যেহেতু সে চিরায়ত আউটসাইডার এই মিছিলে এই নগরে এই ক্যাম্পাসে। তাই তারে পলায়নে কেউ তাড়া দেয় না। তা মধ্যে সেই তাড়নাও ছিল না মনে হয়। সেই এলোমেলো মিছিলটায় তার কন্ঠটাই শেষতক শোনা যায়। সেই বুজি শুধু নিজের স্বর শুনতে পায়।
সুব্রত মন্ডল —রোগা কালো একহারা গড়নের ছেলেটাকে বড়ই নির্লিপ্ত মনে হবে। কারো কাছে কোনো অভিযোগ নাই। যার সব অভিযোগ স্রষ্টার কাছে। সে এমনি অদ্ভুত ভক্ত — প্রার্থনায় তার সমস্ত অভিযোগ পেশের পর সকল মত পথের ঈশ্বরকে ভর্ৎসনায় নাজেহাল করে দেয়। তবু আজ এই নির্মম নিপীড়নের পরে ঈশ্বরকেও এড়িয়ে গেল যেন। এরপর জুলাইকে অনন্ত ধরে মিছিলে নেমে গেছে। সে ছিলো না কোন সিদ্ধান্তে প্রদানে বা সিদ্ধান্ত পালনে। সে এক স্বতঃস্ফূর্ত অমোঘ উদ্দেশ্যর দিকে ধাবিত হইতেছে।
৩.
আকাশ য্যান উপর করা তপ্ত কড়াই। পাইন দেওয়া দাঁ যেমন পানিতে ডুবালে ছ্যান-ছ্যান করার পর সুরমা রং ধরে —আকাশে তেমন রং ধরেছে। সূর্য কই আছে চোখে মালুম হয় না। যেন সারা আকাশে সূর্যটা লেপ্টে গেছে। গরম গুমট বাতাস। জামিল হোসেন ফার্মেসিতে যাবার সময় ডান দিকের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল দালান গুলার দিকে চোখ বুলায়ে যায়। বাম দিকের জোড়া ছাতিম গাছ দুইটারে দেখে। চলতি পথে চোখের সামনে শিশু গাছ দুইটা যুবতী হইয়া উঠছে। আজকে এ সমস্ত দেখার ফুরসত মেলে না। আজ দেখা পায় সার বাধা মিনি ট্রাক। এইগুলা রিকুইজিশনে আনা। তাতে সব বিজিবি বসা। আরেক পাশে পুলিশের গাড়ি৷ পুলিশগুলা এদিক সেদিক ছড়ায়ে ছিটায়ে আছে।
—’কুত্তা গুলায় জানে না ছাত্ররা আইজ এইহানে থাকবে না হেরা চইলা গেছে রূপাতলী-আমতলার মোড়-হাতেমা আলী চৌমাথা-নথুল্লাবাদের দিকে’ জামিল হোসেন ভাবতে থাকে…….
প্রথম কয়েক দিন সকাল থিকা গভীর রাত পর্যন্ত অবরোধে করে রাখতো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রাস্তাটা। এরপর কারফিউ দিল, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা হইল, হল বন্ধ হইল। তাতে কী ছাত্ররা দইমা গেল— তা তো না। তাতে –তারা বরং শহরের অন্য সব স্কুল কলেজের ছাত্র গো লগে মিলে গেলে।
ছাত্র-জনতার মূল ব্যাটেল ফিল্ড নথুল্লাবাদ। জামিল হোসেনের ফার্মেসি নথুল্লাবাদ লাগোয়া কাউনিয়া সড়কের গোড়ার দিকে। এই দিকে বেশির ভাগ ছাত্রদের বসবাস। তার কাস্টমার ছাত্ররাই বেশি। কেষ্ট আজ আগে আসছে।
—আইজগো পালা ভালোনা একটা খুনাখুনি অয় নাহি।
জামিল হোসেন রে দেইখা কেষ্ট বলতে থাকে।
জামিল হোসেনও খেয়াল করেছে বাস স্ট্যান্ড পুলিশ বিজিবিতে ভরা। লগে ছাত্রলীগের কুত্তাগুলা । সাদেকর পালা শুয়োর মান্না আবার পুলিশের মতো জ্যাকেট, বুট পরছে। হাতে বন্দুক আছে।
—তুমি আইজ তোমার দোকান মেইলো না। আমিও আজকে দোকান খুলমু কিনা ভাইবা দেখতেছি। জামিল হোসেন কেষ্টরে বলতে ছিল।
—আইজ দোহান খুলুম না। মুইও আইজ মিছিলে যামু।
—কার লগে যাবা? জামিল হোসেন জিজ্ঞেস করে কেষ্টরে।
— সুব্রতর লগে! ক্যা চেনতে পারেন নায়। মোঙ্গল বার চিহিস্যা হরলেন। মাতা ফাডা রুগী সেলাই দেতে চাইলেন দেলো না। কলেজে মাইর খাইয়া আইলো।
এখন চিনতে পারছে জামিল হোসেন। চিকিৎসা শেষে ছেলেটার লগে কেষ্টরে দিয়ে দিছিলো পৌঁছায়ে দিতে।
‘মোর মোবাইলের ডিসপ্লে ডা একটু লাল হইররা দেতে পারেন, হগলে নাহি লাল হইররা রাখছে।’
কেষ্টর এই কথায় জামিল হোসেন য্যান চমকায়ে গেল। প্রৌঢ়ত্বের শেষে বৃদ্ধ সমাগত — এই বয়সের একটা মানুষের কাছে য্যান জামিল হোসেন হাইরা গেল। অথবা মনের অতলে অবদমিত ইচ্ছা উসকে উঠলো। ফেসবুকে ঢুকে প্রোফাইল পিকচার লাল করে দিলো জামিল হোসেন। এবং সেও সিদ্ধান্তটা নিয়া নিছে।
ছাত্ররা ছোট ছোট দলে জমায়েত হইতেছে। গুলতির বাটের মত দুই দিকের রাস্তার সংযোগে জমায়েত গভীর হচ্ছে। প্রথম দিকেই সুব্রত হাজির হয়। এবং জমায়েতে ঢোকার আগে পেয়ে যায় জামিল হোসেন আর শ্রী কেষ্ট বাড়ইকে।
—কাগু আপনেরে আমার দরকার আছে। আমার ফোন নন্বরটা রাখেন। কুত্তা লীগের পোলাপান বা পুলিশ এই দিক দিয়া আসলে ফোন দিবেন।
সুব্রত কেষ্ট রে বলতে ছিল। কেষ্ট যেন আশাহত হইলো। সুব্রত কথা দিছিল তো মিছিলে নিবে — কেষ্ট এই কথাই ভাবতেছে নাকি কে জানে। নম্বারটা কেষ্টর মোবাইলে জামিল হোসেন তুলে নেয়।
—কী নামে সেইভ রাখবা? কেষ্টর কাছে জানতে চায় জামিল হোসেন। তাতে কেষ্ট কয় — বউয়ের ডা ১ নোম্বরে সেইভ আছে। হেইডা কাইড্ড্যা ১ লেইখ্যা সেইভ দেন। হেইলে মুই হপালে পামু আনে।
৪.
পুলিশ হারামিরা হ্যান্ড মাইকে কী সব বালছাল য্যান কইতে থাকে। ছাত্ররা উপচায়ে উঠছে, শুধু বাঁধটা ভাঙার অপেক্ষা। তাও হইয়া ওঠলো। গোল চত্বরের পুলিশ সি এন্ড বি রোডের দিকে মুভ করতে থাকলে কলেজ রোডের ছাত্ররা সামনে আগায়। বোর্ডের দিক থেকে আরেক দল ছাত্র জনতা আগাতে থাকে। সি এন্ড বি রোডের দিকে সাউন্ড গ্রেনেড টিয়ার সেল ফাটতে থাকে।
জামিল হোসেন সুব্রতরে নজরে রাখতে ছিল। ছেলেটা যেই দিকে যাবে সেও সেই দিকে যাবে। ছাত্ররা নানা স্লোগান দিতে থাকে। জামিল হোসেনের সে সব শ্লোগানের সাথে গলা মিলাতে কেমন যেন একটু শরম লাগতে ছিল। সেই শরম ভাঙতে সময় লাগলো না তার। মিছিলটা চত্বরে পৌঁছাতে সময় নেয় না। পুলিশ আর ছাত্রলীগ দুই দিকের ছাত্রজনতার মধ্যে পড়ে যায়। পুলিশ গুলি চাইতে থাকলে ছাত্রার গুলিবিদ্ধ হয়। আগুন ধোঁয়া-গুলি -টিয়ার সেলে জায়গাটা নরকে পরিণত হয়। জামিল হোসেন সুব্রতরে নজর ছাড়া হইতে দেয় না। সুব্রত দল ছাড়া হইয়া বেশি সামনে গিয়া পড়ে লগে জামিল হোসেনও। গুলি চলতে থাকে সমানে।
মিছিলে গেলে সঙ্গী লাগে। জামিল হোসেন সুব্রতরে সঙ্গী ভাইবা মিছিলে গেছে। সুব্রত তা কী জানে? তা না জানুক ওরে নিয়া আপাত নিরাপদ জায়গায় যাওয়া দরকার। তাও জামিল হোসেন দেরি করলো কি-না কে জানে। বা দেরিই করলো বুঝি — সুব্রতর গতি মন্থর। জামিল হোসেন সুব্রতরে টাইনা নিয়া চলছে — তারা দলছুট বা তারা কোনো দলেই ছিল না। বা এই দুজনেই এতটা দল। তিন জন হবে —কেষ্ট আছে তো। ওরা দুইজন জিয়া সড়কে ঢুকে পড়ে। রাস্তায় বসে পড়ে সুব্রত।
—পানি খাওয়ান একটু। চোখে ময়লা গেছে মনে হয়৷ বিষে চোখ মেলতে পারতেছি না।
সুব্রত বলতে থাকলে, তার মুখের দিকে তাকাবার ফুরসত মেলে জামিল হোসেনের। দেখে রক্তঘামে মুখমাখা। ছর্ গুলি কপালে কালো টিপের মত ফুটে আছে। বাঁ চোখ আধ বোঝা, ফুলে আছে।
জামিল হোসেনের যেন দেজা ভ্যু হল। যেন এই দৃশ্য সে কোথাও দেখেছে। অথবা খরাপ খোয়াবে আটকে গেছে। তাদের বাঁচতে হলে এই দৃশ্য থিকা বের হইতে হবে। তা কীভাবে পারবে তারা— সি এন্ড বি রোডের ঐ দিকটায় পুলিশে ভরা। তাদের সেই পুলসিরাত পেরোতে হবে। বাস স্ট্যান্ডের দিকে একটা শোরগোল সি এন্ড বি র দিকে আগাইতেছে যেন। সুব্রত আর জামিল হোসেন সামনে আগায়। তারাদের চলন বড় মন্থর, আরো মন্থর হয় ছাত্র-জনতাকে ঠেলে পথ আগাতে হয় বলে। ছাত্রজনতা পথের দখল নিয়ে নিছে!
জামিল হোসেন সি এন্ড বি রোড ক্রস করে পোলের পাশ দিয়ে বাইপাস ধরে কাউনিয়া রোডে যাবে। সেখানে কেষ্ট আছে তারে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে যাবে। এরকম পথের নিশানা ধইরা আগাইতে থাকে জামিল হোসেন। বাইপাসে নেমে সুব্রত নিজেরে ছেড়ে দেয়।
তারা রাস্তার পাশে পড়ে থাকলে কে যেন বলে,
—এই দিকে নিয়া আসেন মসজিদের বারান্দায় উনাকে বসান।
জামিল হোসেন দ্যাখে, বগুড়া নথুল্লাবাদ জামে মসজিদের খতিব সাহেব।
জামিল হোসেন সুব্রতরে হাঁচড়ে পাঁচড়ে নিয়ে ওঠে মসজিদের বারান্দায়। খতিব সাহেব সুব্রতরে ধরে শোয়ায়ে দেয়। এবং কী মনে করে জামিল হোসেন কে বলে,
—ওনাকে ধরেন মসজিদের ভিতরে নিয়ে যাই। এসি আছে তাতে উনার সুবিধা হবে।
জামিল হোসেন বলে, না থাক এখানেই ভলো আছে।
—ধরেন আমিও ধরি একটু সুস্থির হইক তারপর নিয়া যাইয়েন।
খতিব সাহেব বলার পরে জামিল হোসেন ক্ষীণ কণ্ঠে কেবল বলতে পারে,
—সে মোসলমান না তারে মসজিদের ভিতরে নেওয়া কী ঠিক হইবে।
—জীবন বাঁচানো ফরজ। আপনি ধরেন উনারে ভিতরে নিয়ে যাই। ভিতরে এসি আসে তাতে উনি একটু সুস্থির হবেন।
কেষ্ট জামিল হোসেনের ফোন পেয়ে আসছে। সেই এই প্রথম কোনো প্রার্থনালয়ে ঢুকতে পারে। কেষ্ট ফোঁপায়ে ফোঁপায়ে কাঁদতেছে। কেন কাঁদতেছে সেই জানে।
খতিব সাহেব জোহরের নামাজের জামাতে দাঁড়ায়ে গেছেন। জামাতে লোক কম। এক অতিশীপর বৃদ্ধ খোনা গলায় ইকামাত দিতেছে,
হাইয়া আলাল ফালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ…
ইমরান আল হাদী
কবি, কথা সাহিত্যিক। জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সাল। বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানাধীন বোয়ালিয়া গ্রামে। সে গ্রামেই বসবাস। প্রকাশিত বই ‘হায়াতুননেছা’ (কবিতা ২০২১)