।। জেসমিন নাহার ।।
বর্ষাকাল, চারিদিকে থইথই পানি। কাঞ্চনপুরের ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজ থেকে ফিরে এই থইথই পানিতে গোসল করে। স্কুল কলেজে কী ঘটে তা তারা বাড়ি ফিরে ভুলে যায়। তারা দুপুরের পরে পানিতে গোসল করাটাকে উৎসবে পরিণত করে ফ্যালে। কিন্তু আজ তাদের উৎসব অন্য রকম। তারা তাদের পাড়ার সব শিশু কিশোর মিলে গোসল করছে আর গাইছে,
—তুমি কে, আমি কে?
—রাজাকার, রাজাকার।
—কে বলেছে? কে বলেছে?
—স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।
ভ্রূণ
এক
—খানকির ছেলে তোর আমার তাতে হব ক্যান, তুই মাগির কাছে শুগে যা। তোর এখন আমার গর্ত আর ভালো নাগে না। তুই তোর নাঙের সাথে চুদাগে যা। হ্যাগো তুমরা হুনোচে আমার মিনসে নতুন মাগি ধইরাছে।
শরিফা ঘরের ভেতরে তার বরের সঙ্গে কথা বলছে। এটাকে মূলত ঝগড়া বলা যায় না। কারণ তাদের শারীরিক সম্পর্ক শুরু হয় গালি দিয়ে, শেষও হয় গালি দিয়ে। কিন্তু আজ রফিক রেগে যায়,
—মাগি সত্যিই নাঙ পাইছি। কদবেল তলার রইমার সাথে পথো দ্যাখা। হাতে কডা ভাজা আছিল তাই তারে হাতে ধরায়া দিয়া খুব কইরা দুধ টিইপা দিলাম। আন্ধার আছিল কেউ বোঝেনি। দ্যাহেনি। কিন্তু সে কী! হাত ধরে টেনে নিয়ে গ্যাল। কইল কী জানো হুইতে হুইতে মাগি? বলে কী না, আরে ভালো কইর্যা দেও, রহিম মিয়া মালেশিয়া যাওয়ার পরে আর কেউ পারছে না। তুমিই একটু দিয়ে যাও দেখি ভালো কইর্যা।
—কী কইল্যা, বেশ্যা মাগি অহন তোমারে ধরছে? ওর রস আমি মাঠত করমু। হকালডা হোক।
—আস্তে কও শরিফা, মেয়ে পাশের ঘরে, হুনব।
শরিফার গলা নীচে নেমে আসে। শরিফা কতটা কষ্ট পেল বোঝা গেল না। সে স্বামীকে বরং জড়িয়ে ধরল অষ্টেপৃষ্ঠে। স্বামীকে অন্যের কোলে দেখলে যেমন প্রতিটা নারী সতর্ক হয়ে স্বামীকে যত্নআত্তি বেশি বেশি করে। রাতে জড়িয়েই তাই ঘুমায়। পাশের ঘরে তাদের দুই মেয়ে মিনি আর চিনি ঘুমাচ্ছে। শুয়ে আছে তারা। চিনি ঘুমাচ্ছে আর মিনি তার বাবা-মায়ের নিঃশব্দ হবার অপেক্ষায় আছে। রফিকের তিন মেয়ে, এক ছেলে। বড়ো মেয়ে পরি। তার বিবাহ হয়েছে। বয়স তার এখন বাইশ। মিনি ক্লাস নাইনে পড়ে। চিনি সেভেনে। ছেলের বয়স তিন বছর। মিনি তার বাবা-মায়ের ঘুম নিশ্চিত করে। চিনির দিকে তাকায়, ফিসফিস করে,
—ঘুমাইছোস?
—না, ক্যান?
—জানালাডা খোল দিহি।
—ক্যান, এতা রাত্রে জানালা খুলমু ক্যান?
—রিপন আমার জন্যি অপেক্ষা করতাছে। যাওন লাইগব আমার। যাই?
রিপন কাঞ্চনপুর গ্রামের ঘানি বাড়ির ফটিক মিয়ার ছেলে। লেখাপড়া ছেড়েছে বেশ আগে, বয়েস বিশ-একুশ। বিদেশ যাবার আশায় আছে কাজের সন্ধানে।
—তোর ইচ্ছে, তুই গেলে গা যা। কিন্তু আমি জানলাম যে এইডা যেন শুধুই আমি জানি। কিছু হইলে কিন্তু আমারে জড়ান যাব না।
রফিকের ইটের পোতার উপরে দুটো টিনের ঘর। বারান্দায়ও আছে দুটো ছোট ঘর। একটাতে রফিকের মা ঘুমায়। আরেকটাতে তারা রান্না করে। তাদের ঘরের জানালার শুধু দুটো ডানা। মধ্যে কিছু নাই। চারিদিকে থইথই পানি। বর্ষাকালে ডুবে যায় সমস্ত কাঞ্চনপুর গ্রাম। পুংলি নদীর প্রবাহে। ঘরের পেছনে জীবন গাছে বাঁধা নৌকা। মিনি নিঃশব্দে জানালা দিয়ে বের হয়ে গেল। নৌকার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দূরে স্কুলের পেছনে একটা আলো জ্বলছে। রিপন তার ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে মিনিকে জানান দিচ্ছে তার অবস্থান। মিনি নৌকার গলুইয়ে বসে বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা চালানো শুরু করে। পাঁচ মিনিটে পৌঁছে যায় স্কুলের পেছনে। নৌকা থেকে নেমে দাঁড়ায় রিপনের সম্মুখে।
—এতা দেরি ক্যান? হাড়াহাড়ি স্কুল ঘরত চলো। একটা ক্লাসরুম খুইল্যা ফেলছি আমি। আহো হাড়াহাড়ি।
মিনি রিপনের নির্দেশ পালন করে। তারা টিনশেডের একটা ক্লাসরুমে ঢোকে। রিপন বেঞ্চ সাজায়ে রাখছে পাশাপাশি। মিনি ক্লাসরুমে ঢুকে আলগোছে রিপন থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।
—দূরে দাঁড়াই আছো ক্যান? কাছে আহো।
মিনি কথা বলতে গেলে কথা অস্পষ্ট হয়ে যায়।
—কাছে আইসো না। কা ছে আ ই সো না। ধ ই রো না।
রিপন কাছে টেনে নেয়, চুমু খেতে থাকে মুখে চোখে নাকে। হাত বুকে ঘোরাতে থাকে।
মিনি বাধা দিতে চায়৷ কিন্তু পারে না। রিপন তার হাত চেপে ধরে ঠোঁটে চুমু খায়। মিনি মুখ সরিয়ে নেয়, দূরে ছটকে যায়,
—কেউ দেখব।
—দেহুক। দেখলে বিয়া দিয়া দিব।
চারিদিকে স্তব্ধতা। শুধু পানিতে মাছের ঘাই মারা শব্দ। রিপন জড়িয়ে ধরে মিনিকে। মিনি ধীরে ধীরে নরম হয়ে যায়। ধরা দেয় রিপনের বাহুডোরে। ওরা কতক্ষণ দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে আছে জানে না। হঠাৎ দুটো পিটুল একই সাথে পানিতে পড়ে। রিপন ভয়ে উঠে দাঁড়ায়। মিনি রিপনকে বসানোর চেষ্টা করে।
—মানুষ দেহুক, বিয়া দিয়া দিব।
রিপন খেপে ওঠে। বলে শখ কত। যা বাড়িত যা। মানুষ দেখব। রিপনের হঠাৎ পরিবর্তনে মিনির খারাপ লাগে। সে বেঞ্চ থেকে উঠেই রিপনকে খামচি দেয়।
—তুই আমার সাথে খেলছস?
—না, খেলি নাইঙ্কা। বাড়িত যাগা।
মিনি উঠে জামাকাপড় পরে নেয়। তাড়াতাড়ি বাইরে বের হয়। কেউ নেই তবুও আশেপাশে চেয়ে দেখে। ফুটফুটে জ্যোৎস্না। পগারের পানি চিকচিক করছে। রিপন মিনিকে নৌকা পর্যন্ত হাত ধরে নিয়ে আসে। জ্যোৎস্না ছাড়া আপাতত ওদের কেউ দেখছে না। এটাই ওদের শান্তি।
—যা গা নৌকায় উঠ হাড়াহাড়ি। মানষে দেখব।
—দেহুক।
নৌকার গলুইয়ে বসে মিনি নৌকা টান দিল। রিপন বাড়ির দিকে দৌড় দিল। মিনি জীবন গাছের নিচে নৌকা বেঁধে জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। চিনি তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। পাশের ঘর থেকে রফিকের নাক ডাকার শব্দে জ্যোৎস্না আর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারছে না।
দুই
—ওই তাবাসসুম বুতুম কোনহানকার চোহে দেখস না আমারে! কেমন পড়ছোত আইচকা?
—ম্যাডাম, নিশা কিছু জিগাইলেই আঙ্গো নামের পরে বুতুম কয়। ক্লাসো অনেক বেয়াদব বেয়াদব বকাও দেয়। আপনেরা তো হুনুন-ই না। এহনও আমারে বুতুম কইল।
কাঞ্চনপুর হাইস্কুল। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা চলছে। ক্লাস সেভেনে দুই শিক্ষার্থী। একজন আরেকজনের নামে অভিযোগ জানাচ্ছে।
—বুঝলাম না, বুতুম কী?
—বুতুম মানে ম্যাডাম, ক্যামনে কমু। বুতুম শরমের জায়গা।
—আপনে অহনও জানুন না ম্যাডাম বুতুম মানে যে শরমের জায়গা!
—জানি না মানে জানি না। কিন্তু নিশা, ব্যাগের নীচে মুখ লুকাচ্ছ কেন?
—হাস আইল, তাই মুখ লুকাইলাম।
—এই তাবাসসুম, ও আর কী বলে তোমাদের?
—আঙ্গো হুদাই খানকির পোলাপান কয়, ধোনের পোলাপান কয়।
—এই তুরা চুপ করবি? ম্যাডামের সাথে এঙন্যা কথা কইতাছোস। শরম নিহি তোগো?
পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীরা সকলে উপস্থিত হয়েছে, মিনি তাদের বকা দেয়। ম্যাডাম মিনির দিকে তাকায়।
—মিনি, তোমার মুখ এত শুকনা কেন?
মিনি হঠাৎ লজ্জা পায়। পাশ থেকে তার বান্ধবী শিমু জবাব দেয়,
—ইংরেজি ম্যাডাম, হে মনো হয় হারারাত জাগছে।
—দূর, হুদা কামে জাগমু ক্যারে?
ক্লাস সেভেনের শিক্ষার্থীরা সব উৎসুক। তারা আজ নিশার নামে অভিযোগ জানানোর সুযোগ পেয়েছে। লিয়া ইংরেজি ম্যাডামকে ডাক দেয়,
—ম্যাডাম, হুনুন, নিশা কয়, দুধ মানে পুষ্টি সেটা হোক গাভীর অথবা ভাবির। তাবাসসুম তুই ক এল্যা। সত্য কি না।
নিশা ভয় পায়।
—আমি আর কমু না। তোমরা কও না! হবায় তোমরা হগলে সাধু?
—কী কইছি আমি! তাবাসসুম আর তুই দুই মোড় থেইক্যা আমারে হুদাই টানতাছিলা। আমার ব্যাগ পইড়া গেল, পরে কইলাম ছেইড় দে, ছেইড় দে, ছাড়িস না, পরে কইছি হোত বাল ছেইড় দে।
—পাগল চুদা কুনহানকার।
—এই নিশা, এসব কী কথা, আমি আছি মানছ না। খারাপ ভাষা কইতাছ।
—আচ্ছো ম্যাডাম, ভালো কথা কইতাছি, খাতা দিন চে ম্যাডাম। কত বাইজা গ্যাছে, এহনতরি খাতা দিচুন না।
—হ, ম্যাডাম খাতা দশ মিনিট আগে দিলে পরে কিছতা অইত না। না দিলে কইলাম ঢাহা যামু। আবু সাঈদের মতো শহিদ হমু।
স্কুলের হলভরতি পরীক্ষার্থী। তারা সমস্বরে তাবাসসুমের কথা শেষ হতই বলে ওঠে,
—হ, ম্যাডাম, ২০২৪ সালে যুদ্ধে যামু আমরাও। আপনে যাইবেন নিহি আঙ্গো সাথ?
—যাওগা তোমরা যুদ্ধো, আমার অতা শখ নাই। এখন খাতা নাও। চুপ কইর্যা সবাই লিখ চাইন। কোনো সাউন্ড হব না।
ইংরেজি ম্যাডাম শিক্ষার্থীদের খাতা দিয়ে দেয়। প্রত্যেকে খাতা নেয় কিন্তু তাদের মাঝে চাপা উত্তেজনা দেখা যায়। তাবাসসুম ইংরেজি ম্যাডামকে অনেকটা রাগান্বিত হয়ে বলে,
—ম্যাডাম, আপনে নিশারে শাসন করতাছুন না। বাংলা ম্যাডাম আইলে কমু ম্যাডামের সাথ। হে শাসন ঠিকই করব।
—কইয়ো চে। অহন লিখো। ম্যাডামের ডিউটি নাইঙ্কা। বাংলা ম্যাডাম আজ আইব না।
শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা চলছে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেকেরই অঙ্ক পরীক্ষা চলছে। অষ্টম শ্রেণির মারিয়াম একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে তাদের বাংলা ম্যাডাম আসবে না দেখে। কিন্তু হল রুমের অন্যান্য পরীক্ষার্থীরা বেশ আনন্দিত হয়। তারা হাতে তালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। চিৎকার করে, আইচকা পরীক্ষা ভালা অইব। মারিয়াম চিন্তিত,
—চুপ থাক তরা, ম্যাডাম না আইলে নকল অইব। না পারা গুলি ভালা মার্ক পাইব।
—তুই চুপ থাক। আইচকা ইদ আঙ্গো।
যখন শিক্ষার্থীরা ইদ উদ্যাপনে ব্যস্ত, তখন তাদের বাংলা ম্যাডাম পরীক্ষার হলে ঢোকে। জিজ্ঞাসা করে,
—সবার কেমন অবস্থা?
যেন জোঁকের মুখে লবণ পড়ে। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ দেখা যায়। ইংরেজি ম্যাডাম একটু খুশিই হয় বাংলা ম্যাডামকে দেখে।
—আইছুন, আহেন চে প্রশ্নগুলান দিয়ে দিই।
দু’জন ম্যাডামই প্রশ্ন দিতে শুরু করেন। মারিয়ামের কাছে প্রশ্ন দিতে গেলে মারিয়াম ফিসফিস করে।
—ম্যাডাম, আইচকা আপনের ডিউটি নাই, তা-ও আপনে থাহুন চাইন। নয়তো নকল অইব।
—আমার কাজ আছে অফিসে। আমি থাকতে পারব না। তবে আসব মাঝে মাঝে।
পরীক্ষা দিতে থাকে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজন লিখছে আড়াইশো বাচ্চার মধ্যে। আর সকলে একে অপরকে দেখে লিখছে। তাবাসসুম লিমাকে দেখতে যায়। লিমা খাতা সরায়ে নেয়। তাবাসসুম আপসোস করে,
—কী যে অয় কইতো পারমু না। কাইলকা টাঙ্গাইল থেইক্যা বাইত্তে আহার সুম ভাবছি, পড়তে পড়তে একেবারে এক নিয়াই ছাড়ুম। পরে বাইত্তে আয়া নিয়া ভাবতাছি যে থাইক সকালে পড়ুমনি।
মারিয়াম মিনি আর রাবু তাবাসসুমের কথা শুনে হাসে। মারিয়াম ফিসফিস করে বলে,
—আমারও ইমুন অয়। ভাবি যে, সমর এত পড়তাছে, আমার তো পড়ন নাগবই। আরো কত কী ভাবি, এহন যদি না পড়ি তাহলে পরীক্ষার হলে কান্দন নাগব। রোল একের থেইক্যা তিনে যাব গা। তহন ভাবি আমার পড়ন নাগব। এহনই উঠি। উঠি, পড়বার বহি, তারপর মনে হয় এহন পড়বার পারমু না। ভাল্লাগতাছে না। যা হইবার হব। রাত্রে পড়ুমনি।
মিনির পরিক্ষায় কোনো মন নাই। তাদের কারওরই মন নাই। তারা কিছু পারেও না। মারিয়াম তার অভিজ্ঞতা বলছে কিন্তু সাথে অঙ্কও করছে।
মিনি মারিয়ামকে জিজ্ঞাসা করে,
—তারপরে কী অয় মারিয়াম?
—অমনি মাগরিবের আজান হয়। আজান শেষ হয়। অমনেই টিভি জুইড়া বয়া পড়ি। টিভি দেহা শুরু করি।
—তর আব্বু আম্মু কিছু কয় না?
—আম্মু নামাজ পইড়া আইসা কয় তর কি পড়ালেহা নাই! এহন না পড়লে এহন কিছু কমু না। আমারও সময় আইব, তহন মজা কারে কয় বুঝাইয়া দিমু। রেজাল্ট দিব না?
—তর রাগ হয় না?
—আবার জিগেস করে। তহন আমি চিল্লাই কই হারা বছর আমার রোল এক থাকন নাগব? সমরেরও তো শখ জাগে এক হবার, হোগগা ওর রোল এক, একবার। তারপর একতালা টিভি দেহি। আব্বু তহন বকে। টিভি বন্ধ কইর্যা দেয়। কই এহনই পড়মু। আধাঘণ্টা পড়ি। সাড়ে নয়টা থেইক্যা দশটা।
তাদের ফিসফাস কথাবার্তায় হঠাৎ ছেদ পড়ে। সমর ইংরেজি ম্যাডামকে ডাকে। ফিসফিস করে,
—ম্যাডাম, তাবাসসুমেরা কথা কয়। আর আমার বড়ো অঙ্কের উত্তরগুলা ক্যামনে কয়া দিবেন?
—এই তাবাসসুম, কথা কইবা না৷ পরীক্ষার হলে এত কথা ক্যান?
নীরব হয় সকলে। লিখতে থাকে পুরোদমে। কিন্তু হঠাৎ মারিয়াম চিৎকার করে ওঠে।
—ইংরেজি ম্যাডাম, আপনে সমররে অঙ্ক কয়্যা দিতাচুন ক্যারে? হে আপনের কাছত প্রাইভেট পড়ে দেইখ্যা?
—কেমন বেয়াদপ দ্যাখছ? কই কয়্যা দিতাছি?
পরীক্ষার হলে গোলযোগ দেখা দেয়। অঙ্ক শিক্ষক এবং বাংলা শিক্ষক গোলযোগ শুনে প্রবেশ করে হলে। জিজ্ঞাসা করে উত্তেজিত মারিয়ামকে,
—কী হইছাল মারিয়াম? এত জোরে পরীক্ষার হলে কথা কইল্যা ক্যান?
—ইংরেজি ম্যাডাম আজ অঙ্ক পরীক্ষা, আঙ্গো ঘাড় ঘুরাইবার দিতাছে না। সমর অঙ্ক পারতাছে না। ম্যাডামরে জিগাইছে, ম্যাডাম এইডা কেমুন হব? ম্যাডাম ওরে কইছে তিনডা গুণ করবার পরে যে উত্তর হব, ওডাই।
—কেমুন বেয়াদপ দ্যাখছুন স্যার, কেমুন বেয়াদপ? ক্লাসে আর স্টুডেন্ট নাই? তুমি একা আছো?
—মারিয়াম, শান্ত হয়্যা অঙ্ক করো। ম্যাডাম সমর থেইক্যা দূরে থাহুন। সমর থেইক্যা দূরে থাহুন।
—কী মিছা কথা কয়, কী মিছা কথা কয়। তুমি আরবি ছুইয়্যা কইতা পারবা? আমি সমররে কইয়্যা দিইছি?
—হ পারমু।
ম্যাডাম ক্লাস থ্রির একটা আরবি প্রশ্ন অফিস রুম থেকে আনে। প্রশ্নটা মারিয়ামের হাতে দেয়। মারিয়াম প্রশ্নটা হাতে নিয়ে বলে,
—সমর ম্যাডামের চোখ মুখে চাইয়্যা কইল ম্যাডাম! ম্যাডাম মোবাইল থেইক্যা ফোন বাইর কইর্যা বারবার সমরের খাতার দিকে চাইল। ফোন থেইক্যা সমরকে অঙ্কের উত্তর বইল্যা দিল। সমরকে অঙ্ক তুলতে সাহায্য করল।
—চুপ থাহো বেয়াদপ।
ইংরেজি ম্যাডাম বাংলা ম্যাডামের দিকে চেয়ে বলে,
—কেমুন মিথ্যা কইতো পারে দ্যাখছুন?
বাংলা ম্যাডাম রাগ করে,
—হইছে, এবার বাচ্চাদের লিখতে দ্যান।
মারিয়াম বাংলা ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বলে, ওই মামুন তো সমরের পাশে। হ্যারে জিগান ম্যাডাম। বাংলা ম্যাডাম মামুনকে জিজ্ঞাসা করে,
—মামুন বলো, নয়তো এই মেয়ে অঙ্ক করতে পারছে না।
মামুন উঠে দাঁড়াতে যায়। ম্যাডাম নির্দেশ করে, অঙ্ক করতে করতেই বলো।
—ইট্টু ইট্টু কিছু হুনছি ম্যাডাম। কিছুক্ষণ আগে যা হইছে ইট্টুহানি জানি।
—ইংরেজি ম্যাডাম ওকে অঙ্ক করে দিয়েছে কি না জানো?
—সমর আমার মোবাইল ঘড়ির ক্যালকুলেটর দিয়া সব অঙ্কের উত্তর বের কইর্যাছে। কিন্তু তিনটা অঙ্ক গুণ কইর্যা মেইন উত্তর আইব যে ওইটা আইতাছাল না। তাই ম্যাডামের ওইতি ইশারা দিয়া কইছে, তাই ম্যাডাম ফোনে তিন অঙ্কের উত্তর মোবাইলে গুণ কইর্যা মেইন উত্তরটা দেখাইছে সমররে। সমর ওডাই লেখছে। ওডার জন্যিই চোখ ইশারায় ডাকছে।
বাংলা ম্যাডাম জবাব দেয়,
—আচ্ছা, এবার অঙ্ক করো। সবাই অঙ্ক করো। এখন কেউ কাউকে বলে দেবে না। কোনো টিচারও কোনো স্টুডেন্টকে বলে দেবে না। আর ইংরেজি ম্যাডাম, বাচ্চাদের অঙ্ক আপনি বাচ্চাদের করতে দ্যান। আপনার কারও পাশে যেতে হবে না।
অঙ্ক মূলত শিক্ষার্থীরা আর কেউ করল না। পরীক্ষার হল আধ ঝিমুনো আর আধ উত্তপ্ত। শিক্ষার্থীরা মারিয়ামকে ফিসফিসিয়ে বলে,|
—আইচকা ইট্টু জব্বর কাজ করছোস। ইংরেজি ম্যাডামের দুর্নীতি সবার সামনে কইয়্যা দিছোস।
দশম শ্রেণির দু’জন শিক্ষার্থী ইংরেজি ম্যাডামকে পছন্দ করে। তারা রেগে যায়,
—এই তরা অঙ্ক করতে পারতাছোস না?
—ওরে চামচা।
হাসাহাসি শুরু হয়ে যায়। কেউ আর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দেয় না। চাপা ক্ষোভ আর উত্তেজনায় পরীক্ষা শেষ করে মারিয়াম। আর অন্য শিক্ষার্থীরা তাকে বাহবা দিতে দিতে বের হয়। তিন ঘণ্টা কেটে যায়। ইংরেজি ম্যাডাম সমরের কাছে যায়। বলে,
—দাঁড়াইয়ো চে, এক লগে বাসাত যামু।
সমর জিজ্ঞাসা করে,
—কী হব ম্যাডাম? স্যারোরা যুদি এই প্রশ্নে আবার পরীক্ষা নেয়।
—আরে কিচ্ছু অইতো না। নির্ভয়ে থাহো। এই মাদ্রাসাত আবার কইয়্যা দিবার ভয় পামু।
ইংরেজি ম্যাডাম খাতাপত্র বাঁধে। বেঁধে অফিসরুমে নিয়ে যায়। সেদিনের মতো পরীক্ষা শেষ হয়।
তিন
বর্ষাকাল, চারিদিকে থইথই পানি। কাঞ্চনপুরের ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজ থেকে ফিরে এই থইথই পানিতে গোসল করে। স্কুল কলেজে কী ঘটে তা তারা বাড়ি ফিরে ভুলে যায়। তারা দুপুরের পরে পানিতে গোসল করাটাকে উৎসবে পরিণত করে ফ্যালে। কিন্তু আজ তাদের উৎসব অন্য রকম। তারা তাদের পাড়ার সব শিশু-কিশোর মিলে গোসল করছে আর গাইছে,—তুমি কে, আমি কে?
—রাজাকার, রাজাকার।
—কে বলেছে? কে বলেছে?
—স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।
এই দৃশ্য তাদের বাংলা ম্যাডামকে দেখাবে বলে তারা ডাক দেয়।
—ম্যাডাম, ও বাংলা ম্যাডাম, যুদ্ধে যামু। আপনে কি চইল্যা গ্যাছেন? না দিয়াসমু নৌকাত কইর্যা?
ম্যাডাম কোনো কথার জবাব দেয় না। ওদের কাণ্ড দেখে চুপ করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। ম্যাডামের বাসার চারিদিকে শিক্ষার্থীরা গিজগিজ করছে। তাদের একদল বলছে,
—তুমি কে? আমি কে?
বলেই পানিতে ডুব দিচ্ছে, আরেক দল বলছে,
—রাজাকার, রাজাকার।
ততক্ষণে আরেক দল পানির নীচ থেকে উঠে যাচ্ছে। এবং বলছে,
—কে বলেছে? কে বলেছে?.
—স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।
এই খেলা চলছে। এবং ম্যাডামের ভাড়া বাসার চারিদিকে ঘুরছে। হঠাৎ এক বাসা থেকে বকাবাদ্যর শব্দ শোনা যায়।
—এই মারিয়াম, এই সেতু উঠোস না ক্যারে? আর কত? আর এইগুলা কি ছাইপাশ কওয়া ধরছোস?
—তুমি বুঝবা না। যুদ্ধে যামু। আবু সাঈদ মারা গ্যাছে। দ্যাহো না নেট স্লো হয়্যা গ্যাছে। ফেইসবুকত ঢুকন যায় না। ম্যাডাম বাসাত থাকলে ম্যাডামের লগে ঢাহা যামু। ও ম্যাডাম!
ম্যাডাম কোনো কথা বলে না। এই অজ পাড়াগাঁইয়ে শহর ও জাতীয় রাজনীতির কোলাহলের বাইরে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেম দ্যাখে। মারিয়ামের মা মারিয়াম ডাকা মাত্র চারিদিক থেকে সকলের মা বাবা-ই ডাকতে শুরু করে। মায়েদের সাথে বাচ্চাদের তর্কাতর্কি হয়। মারিয়াম বলে,
—না, উঠমু না আমরা। কাইলকা ঢাহায় শিক্ষার্থীগো অবরোধ। আঙ্গো যাইতে দাও, আমরাও আন্দোলন করমু।
—তরা গিয়া কী করবি? ডরাবি, তোগো দিয়া কোন কাজ হব? শহরে মানুষ মানুষ মারতাছে, এইহানে বইসা দোয়া কর, তাতেই কাজ হব।
—আম্মা, শেখ হাসিনা কতোহানে ঘুরবার যায়, আঙ্গো গ্রামো একটু আয়া হারে না! বর্ষাকাল এহন, আমরা এট্টু নৌকাত কইর্যা ঘুরতো নিয়া যামু, সেতু, চিনি আর মিনি আপুরে শিকাইলামু যে মাঝনদীতে নৌকা দুলাইবার। বলমু, নুন, একটু নৌকা কইর্যা ঘুরায় নিয়্যা আসি গা ম্যাডাম, পরে হে গেলো, চিনিরা নৌকা দুলাইল, শেখ হাসিনা নৌকা থেইক্যা পইড়্যা গেল গা, তহন তারে আমি পা দিয়্যা যাইতা ধরমু ঘাড় পাতিলে, কমু মর তুই, তুই আঙ্গো দেশটারে কী করছোস? লেহাপড়া ছিকাই তুলছোস, জিনিসপত্রের দাম বাড়াই দিছোস, তুই মর।
শিক্ষার্থীদের কথা শুনে ঘরে ম্যাডাম হাসে জোরে জোরে, তাদের গার্ডিয়ানরা হাসে না। বাচ্চারা শেখ হাসিনার মৃত্যু কল্পনা করে খুশি হয়, তাতে তারা যেন ভয় পায়। চিনির বাবা ধমক দেয়,
—এঙন্যা ভেবে তরা খুশি থাক। এহন উঠ হাড়াহাড়ি পগার থেইক্যা।
সাইফুলের বাবা ধমক দিতে দিতে বলে,
—আইচ্ছো, বুঝলাম তোগো গ্রামে শেখ হাসিনা আইল, কিন্তু হের লগে যে এক গাট্টি পুলিশ, আর্মি, র্যাব আইব, হেরা তো তোগো পাচা পাতিলা গুলি করব, তহন তরা কী করবি? তোগো স্বপ্ন নিয়্যা তরা বইয়্যা থাক, এহন হাড়াহাড়ি উইঠ্যা আঙ্গো উদ্ধার কর।
বাচ্চারা সকলে বিদ্রোহ করে,
—উঠমু না।
জোরে জোরে চিৎকার করে, ডুব দেয় আর ওঠে, ওদের থামানো যায় না কিছুতেই,
—তুমি কে? আমি কে?
—রাজাকার, রাজাকার।
—কে বলেছে? কে বলেছে?
—স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।
চার
—হ্যালো…
—তুই ফোন তোলস না ক্যারে?
—বাড়িত কাম আছে না, সারাক্ষণ কথা কইলে হব? তুমি কোনো কাম করো না? লেহাপড়া করো না নিহি? ফোন দিতেই থাহো। আজাইরা।
—আজাইরা নিহি! সারাক্ষণ কথা অয় না, তুই ফোন তোলস না, আমারে এড়ায়ে চলতাছোস।
—আরে পাগল, বাড়িতে কাজ থাহে, কথা কমু ক্যামনে? এহন তুরি পাসপোর্ট হাতে পাইনি। চিন্তাত আছি।
—কিচ্ছু জানি না আমি, আমি যহনই ফোন দিমু তুলতে অইব, কথা কওন নাগবই। এড়ায়ে চলস তুই আমারে, আমি মানমু না।
—আইচ্ছো কমু। আজ রাত্র আইতে পারবা স্কুলো?
—শখ কত! কথা কয় না, ফোন ধরে না, আবার আমি ফোন দিলেই পিরিত জেগে ওঠে। তর শুধু আমার দেহ চায়, আমি বুঝছি।
—তেইলে, তর বুঝি চায় না, তুই আইবি যে তর ফোনের বহর দেখেই কইতে পারি আমি।
—যাম না, যাম না, কহনো যাম না। তুই হেই আশাত বয়া থাক গা।
রিপন একটা বছর মিনির দিকে হা করে চেয়ে দেখত। কিন্তু তাকে ভালোবাসি বলতে পারত না। মিনি তাদের বাড়ির সামনের খোলায় কাজ করত তার দাদি এবং মায়ের সাথে। রিপন স্কুলের পেছনে রউফের দোকানে বসে মিনিকে দেখত। মিনির এটা দ্বিতীয় প্রেম। প্রথম প্রেম ভুলতে সে দ্বিতীয় প্রেম করতে চায়। তার প্রথম প্রেম ছিল কাজিবাড়িতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে আসা এক কিশোর রাজমিস্ত্রির সাথে। মিনি তার সঙ্গে কথা বলত মোবাইল ঘড়ির মাধ্যমে। ঘড়িটা তার কাকা পাঠায়েছিল বিদেশ থেকে। বয়ঃসন্ধির প্রেমে পাগল হয়ে সে বাড়ি ছেড়ে প্রেমিকের হাত ধরে পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু হয়নি। বাড়ি থেকে মানুষ গিয়ে তাকে পথ থেকেই ধরে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। তারপর প্রেমিকের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। প্রথম প্রেমের ক্ষত ভুলতে দ্বিতীয় প্রেমে মগ্ন হয়। তার সহপাঠী জাকিরকে বলে একদিন,
—ভাই জাকির, তুই তো সকলের কাম কইর্যা দ্যাস, আমারে এক কাম কইর্যা দে, রিপনের ফোন নম্বরটা আইন্যা দে। হে খালি আমার দিকে চায় ক্যা আমি জিজ্ঞাসা করবার চাই।
—আইচ্ছো, কাইলক্যা আইন্যা দিম। কাউরে কইস না য্যান, আওরাকাওরা বাইদ্যা যাব কিন্তু। .
—কাওরে কমু না, তুই খালি আইন্যা দে ভাই, আমি রিপনের লগে ইট্টু কথা কইবার চাই।
জাকির বন্ধুদের প্রতি দায়িত্ববান। পরবর্তী দিন ক্লাসে রিপনের নম্বর মিনিকে ঠিকই এনে দেয়। মিনি খুব খুশি হয়ে রিপনকে সেভেন আপ খাওয়ায়। ক্লাস ফাঁকি দেয় সেদিন। বাড়ি ফিরে বাবার ফোন নিয়ে রিপনকে কল দেয়,
—রিপন, তুমি আমার দিকে চায়া থাহো ক্যারে? তুমি কি আমায় ভালোবাসো?
—হ, বাসি। অনেক আগে থেইক্যা। কিন্তু তুমি আমারে পাত্তা দিসো না। রাজমিস্ত্রিরে মন দিসো। তবু এহনতুরি তোমারে আমি ভালোবাসি।
—রাজেরে মন দিসিলাম ঠিকই, কিন্তু এহন আমিও তোমারে ভালোবাসি।
মিনি এবং রিপন প্রেমে পড়ল। কাঞ্চনপুরের মানুষের শুকনা মৌসুমের ধানের কাজ শেষ না হতেই ভরা বর্ষার আগমন না হতেই পুংলি নদী ফুলেফেঁপে কাঞ্চনপুর গ্রাম পানির উপরে ভাসিয়ে দিল। তাদের হাঁটতে হাঁটতে দেখা হবার সম্ভাবনা রইল না আর। দেখা হয় স্কুলে, নৌকায় ঘুরতে গেলে হঠাৎ। কথা চলে ফোনে ফোনে। রাতে স্কুলে দেখা হবার পরে মিনি পাগল হল বেশি রিপনের প্রতি কিন্তু রিপন উদাসীন হয়ে গেল। মিনি কষ্ট পায় রিপনের উদাসীনতায়, তাই রাতে দেখা করবার কথায় সে কড়া ভাষায় জবাব দেয়। রিপনও কড়া ভাষায়ই বলে,
—আইবি না কইতাছোস যে বড়ো, তুই থাকতে পারবি? রাতো আমার আগেই আয়া বয়া থাকবি। দেহের জোড়ন আমার থেইক্যা তর বেশি আমি জানি!
—যাম না, তুই দেইখ্যা লস। এড়াইবি আবার খাইতেও চাইবি, তা হব ক্যান!
রিপন নরম হয়,
—আয়ো প্লিজ, সোনা আমার।
মিনির এই একটুতেই মন গলে যায়। সে রাজি হয় যাবার জন্য।
—আইচ্ছো, এহন ঢং করা নাগব না। কিন্তু কথা দেওন নাগব, আমার লগে কথা কইবা। উধাও হইয়্যা যাইবা না।
মিনির কথা শেষ হয় না। রফিক ঘরে ঢোকে। মিনি ফোন কেটে দেয়।
—গেদি আমার ফোন কইরে? ফোনের ইন্টারনেট নাহি বন্ধ কইর্যা দিসে হাসিনা সরকার। দে দেহি, ইট্টু চেক করি।
—হাচাই দিসে আব্বা। কথা কওন যায় না নেটো। তুমি হাড়াহাড়ি কাকাই ট্যাহা পাঠাইছে তুইল্যা আনো মিয়াবাড়ি থেইক্যা।
রফিক মিয়া মিনির হাত থেকে ফোন নিয়ে ঘর থেকে নৌকার বৈঠাটা বের করে। লুঙ্গিতে দারুণভাবে ফোনটা বাঁধে। চিনি বারান্দায় বসে তার ভাইকে কোলে করে বসে আছে। চিনিকে বলে যায়,
—চিনি তর মাকে কইস আমার আইতে ইট্টু দেরি হব। দুদু মিয়া তাগো বাড়িত ইট্টু যাইবার কইছে।
শরিফা কাজ করছিল রান্নাঘরে। রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে।
—দুদু মিয়া না, কও রইমাই তোমারে যাইবার কইছে। আমি মরমু।
—মর, মাগি। বেশি কইর্যা মর।
চারিদিকে না চেয়ে, বৈঠা হাতে বাড়ির পেছনে চলে যায় রফিক। জীবন গাছ থেকে নৌকা খুলে দুদু মিয়ার বাড়ি পুবপাড়ার দিকে নৌকা চালাতে থাকে। ঘরের বারান্দায় বসে শরিফা গালি দেয় বরকে,
—উলাউটো, নরপিচাশ, তর মরণ হয় না ক্যান? তর মুখে রক্ত উঠে মরবি।
শরিফা কাঁদে আর গালি দেয়, মুন্নি দৌড়ে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি মেয়েকে ধরে। চিনিও ভাইকে রেখে বোনকে ধরে তোলে। শরিফা বলে, দুর্বল।
—চিনি, হাড়াহাড়ি দুটো ডিম সিদ্ধ দে তো।
—দিই।
চিনি রান্নাঘরে পা বাড়ায়। মুন্নি ভাবে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল কেন।
পাঁচ
—আর রাতে আইতে পারমু না। শরীর ভালা না আমার। আইচকা মাথা ঘুইর্যা পইড়্যা গেছিলাম। বমি অইছে দুইবার।
—আইবি কি না পরে দেখা যাবে। এখন বুকে আয়। কী! বমি অইছে? গাইড় মারছে। না তো, এত হাড়াহাড়ি কারও বাচ্চা পেটে আহে না। আয় তো চিন্তা দিস না।
—তুই শুধু আমার শরীর চাইস। কিন্তু তুই ভালোবাসিস অন্য মানুষকে।
—সেতু তরে কয়া দিসে? তার আর আমার প্রেম চলতাছে যে।
—যা কুত্তার বাচ্চা, তুই মর গিয়ে।
—তরে বিয়া করার লাগি প্রেম করমি ক্যান? আগের প্রেমিকের সাথে শুসনি যে কে কব। আমি তো তরে চাওয়া মাত্র পায়ে গেলাম।
—চুপ, চুপ কর। তুই আমারে ঘৃণা করস তা আমার সাথে শুলি ক্যান?
—শুলাম, ভালো নাগল। বিয়া করমু সেতুরে। চোদাচুদি করলাম তর সাথে।
মিনির হঠাৎ শরীর গুলিয়ে ওঠে। বমি করে।
—গাইড় মারছে। পানিতে মুখ ধুইয়া আয়।
মিনি মুখ ধোই। ধুয়ে দৌড়ে ফিরে যেতে যায় ঘরে। কিন্তু রিপন ধরে ফ্যালে। জোর করে স্কুলঘরে নিয়ে যায়।
—আমি সেতুকে ভালোবাসি তাই কি। তরেও ভালোবাসি। তরে বিয়া করমু না। ওরে করমু বিদ্যাশ থেইক্যা আয়া সাইর্যা। অবা করস ক্যা? আয় বুকে আয়।
—ছাড় লাগছে। আর এসব করমু না। তুই আমাকে ঘৃণা করস যে আগে বলা উচিত আছাল। এরকম বিপদ অইত না।
—তা তুই কেমনে ভাবলি, তরে বিয়া করমু। তর আগে তো প্রেম আছাল। সারা গ্রাম জানে। এই সম্পর্ক তো কেউ জানব না। আমি মরবার পরেও কেউ জানব না। এহন চল কাজ সারি।
—ছাইড়্যা দেও। যাইতে দ্যাও রিপন।
রিপন ফিরতে দেয় না মিনিকে। জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করে। মিনির অনিচ্ছায়। মিনি বমি করে আরেকবার। রিপন জিজ্ঞাসা করে,
—পেটে বাচ্চা তর? যদি আগে খসাইলাবি। এমনিই রাজমিস্ত্রির করছিলি প্রেম। এহন এসব পাড়াত জানাজানি অইলে তর বিয়া হব না। আর ভুলেও আমার কথা কাউরে কইস না। আমি কিছু টাকা দিমু। টাঙ্গাইল গিয়া খসাবি। সেতুরে কিছু কবি না।
মিনি স্কুলঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকে। পেছনে নৌকায় উঠে বাড়ি চলে যায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাঁদে, চিনির ঘুম ভেঙে যায়। চিনি জানে না তার বোন কোন ব্যাথায় কাঁদে। সে বোঝে দেশের পরিস্থিতি ভেবে তার নরম মনের বোন কাঁদছে।
—আমারও মন খারাপ নাগতাছে মিনি। ফাইয়াজ ছেলেডারে কেমনে মারল দস্যু জানোয়ারের দল। তাই না?
—হ, ওর বাবা মা বোনের কষ্ট নাগতাছে আঙ্গো থাইক্যা বেশি। ঘুম পড়। ফাইয়াজের জন্য আমার বেদনা কইম্যা গ্যালে গা আমিও ঘুমামু।
কাঁদে মিনি কিন্তু মিনির ঘুম আসে না। সে চুপি চুপি তার বাবা-মায়ের ঘরে গিয়ে ফোন আনে। ফোন দেয় রিপনকে। রিপন তখনও স্কুলঘরে। সে সেখানেই ঘুমাবে ঠিক করে।
—তুই সেতুর সাথে প্রেম করস, আমি যেদিন তোকে ফোন দিসিলাম বলস নাই ক্যান?
—এই মাগি, তরে কওন নাগব ক্যান? তরে ভালোবাসি চুদাচুদির জন্যি। আর সেতুরে বিবাহ করবার লাগি। তুই জানস সেতু কতা ভালা মাইয়্যা? হে আমারে বর ডাকে। আমার বাবা মারে মা বাবা ডাকে। ছুডো মাইয়্যা সেতু। তুই তারে লয়্যা কোনো নোংরা কথা কবি না। তু যেবা নোংরা হগল রে তেমন নোংরা ভাবিস। তুই রাজমিস্ত্রির সাথে হুইছোস, আমার লগে হুইছোস। তুই মনে করছোত হে তর লাহান। খানকি তুই একটা হে ভালো। তুই হেরে কিছতা কবি না। হে আমারে জিজ্ঞাস করছাল মিনির সাথে কী কথা কও। কইছি হে হের প্রেমিকের খবর লইছাল। তুই হুনসি তর জানতে তার সাথে দেখা করছোত। তেরিবেরি করবি তো সব কইয়্যা দিয়া বিদ্যাশ চইল্যা যাম। .
—ওরে খানকির ছেলে, তর মিথ্যা কথার লাগি হে তার ফেইসবুকত থেইক্যা আমারে ব্লক মারছে?
—খবরদার গালাবি নে। তুই তো একটা বেশ্যা মাগি। তর পুরানো প্রেমিক তো সবার সাথে তর কথা কইয়্যা বেড়াই। তুই আমার কথা সেতুরে কইবার লাগিই তো হের ফেইসবুকে ফ্রেন্ড হবার চাইছিলি। গোয়েন্দাগিরি লাগাইছিলি। তুই ভাবছিলি সেতু জানব না। হে চালাক, ভালো মাইয়্যা। তর মতো বেশ্যা না। তুই ভাবছোস তুই আমার কথা তারে জিগাবি, হে আমারে তর কথা জিগাবে আর আমি তর হয়্যা ডিফেন্ড করমু। পাগলে চুদেছে তো আমারে।
—তুই সবার সাথে প্রেম কর, আমার তাতে দুঃখ নাই। আমাকে বললে তো আমার সতীত্ব খোয়াইতাম না।
—ওরে খানকি, সতীত্ব চুদাচ্ছে। তর অনেক প্রেমিক। তুই তাগো ফোন দিগে যা। তবু সেতুরে কিছু কইবি না। তুই কী কইছোস, কী করছোস সব আমার কাছে আছে। আমি সেভ রাখছি, মেসেজ এবং কল। তুই তর পুরানো প্রেমিকরে ফোন দে।
—তুই আমারে আগে কইলেই হইত। তর সেতুর লগে প্রেম। আমি তর সাথে জড়াতাম না।
—হ, প্রেম। তুই শারীরিক সম্পর্ক করতে চাইলে আমার লগে থাকতে পারস। কিন্তু বিয়ের লাগি না। তরে আমার দরকার নাই। কিন্তু সেতু আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। হে কথা দিছে মোরে, আমি যা কমু হে অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। তুই খানকি পারবি। যা তর পুরানো প্রেমিকো কাছে যা। চুদাগে যা। খবরদার কোনো ফোন মেসেজ দিবি না। সেতু আঙ্গো মা বাবারে মা এবং বাবা কয়। ছুডো মানুষ। ভালোবাসে আমারে। আমিও তারে। তুই তর পুরানো প্রেমিকগো কাছে যা গা। পথ পরিষ্কার আমার।
মিনির আর কিছু বলবার থাকে না। সে তার দাদির ঔষধের প্যাকেট থেকে ঘুমের ঔষধ খেয়ে সে গর্ভবতী হয়ে গেল কি না ভাবতে ভাবতে ঘুমের অপেক্ষা করে। ভাবে গর্ভবতী হলে তো মরতেই হবে। বাঁচতে পারবে না। কিশোরী মনে সে সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকায় যাবে। চিনি তখন আবারও জাগে।
—মিনি তুই এহনতুরি জাগনা?
—হ, চল চিনি আমরা ঢাহাত যাই। খবরে যে নাহিদ আসিফ তাবাসসুমরে দেখায়, আরও আরও অনেক ছেলেগো, ওগো সাথে আমরাও আন্দোলন করমু। আবু সাঈদের মতো আমরাও মরমু।
—হ, ঠিকই কইছোস। কিন্তু সকালে উইঠ্যা রিপনের মুখ দেখলে ভুইল্যা যাবি।
মিনি কাঁদে। চিনিকে বলে সব ঘটনা। চিনি ভীষণ রেগে যায়।
—দাঁড়া, বুতুমের ঘরের বুতুমরে উচিত শিক্ষা দিমু।
—না, ও যা কইছে আমারে আমি অতা খারাপ না। ওকে ক্ষমা কইর্যা দিসি। ওর সাথে আর সম্পর্ক নাই। ভাবছি বাচ্চা পেটে আইলে তুই আমারে সাহায্য করবি।
—করমুনে, ঘুমা। হে সেতুরে পছন্দ করে। সেতুরে কওন নাগব খুইল্যা।
—না, সেতুর কষ্ট নাগবো।
–তেইলে, হের মতো খারাপ পুলার নগে সেতুর বিয়া হব আমি তো মানতো পারুম না।
—আমাগো কী, সেতু হের বাবা মারে মা বাপ ডাহে, সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। আঙ্গো কথা বিশ্বাস হব না ওর। হুদাই পাঁচ কান হব।
—আইচ্ছো। নে এবার ঘুমাই। যা হবার হব পরে। গ্যাসের লাগিও তর বমি অইতো পারে।
দুই বোন ঘুমিয়ে পড়ে। চিনি স্বপ্ন দেখে মিনি রিপনকে ভুলে গেছে। তারা ঢাকায় যাবার জন্য রওনা দিয়েছে। চারিদিকে পানি, নৌকা সারি সারি বাঁধা। কিন্তু তারা মাঝপাড়ার ছেলেমেয়েরা সকলে হেঁটে যাচ্ছে পানির উপর দিয়ে। মিয়াবাড়িতে পৌঁছে দেখে হঠাৎ মিনি গর্ভবতী। চিনি তাকে বলে,
—সমস্যা নাই। আমরা আছি না।
দৌড়ে তাদের সাথে যোগ দেয় মারিয়াম। মিনিকে দেখে বলে,
—বাচ্চা আমি পালমু মিনি। আগে যুদ্ধ কইর্যা আহি।
হঠাৎ মিনির উঁচু পেট সমান হয়ে যায়। চিনি সকলকে হাত ধরে সিএনজিতে উঠায়। মিনি, মারিয়াম, সাইফুল, রামিন, সামিন-সহ শিশু আরাফাত এবং আবদুর রহমান। তারা মুহূর্তে টাঙ্গাইল পৌঁছায়। টাঙ্গাইলে গুলি গুলা ইট পাটকেল ছুড়াছুড়ি হয়। সিএনজিওয়ালার হাতে ইট লেগে হাত খুলে যায়। তারা হাঁটতে থাকে। হেঁটে পৌঁছবে ঢাকায়। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সবার। হঠাৎ মারিয়ামের ফোনে এসএমএস আসে। মারিয়াম চিল্লায়,
—নেট আইছে, নেট আইছে।
চিনি চিৎকার করে,
—ফেইসবুকো ঢুকো।
মারিয়াম ফেইসবুকে ঢুকে দেখে, সকলে শেখ হাসিনা পালাইছে স্টেটাস দিচ্ছে। মারিয়াম চিৎকার করে,
—পালাইছে, পালাইছে, খুনি হাসিনা পালাইছে রে।
মারিয়ামের চিৎকারে সকলে চিৎকার করে ওঠে। চিনির ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমভাঙা ভোরে সে ঘুমের ঔষধ খাওয়া মিনিকে জোর করে জাগায়,
—দেহিস, ঢাকাত ছাত্রগো জয় হব। হাসিনা পালাইব। তুই গর্ভবতী হবি না। তোর বিয়া হব ভালা ছেলের লগে। স্বপ্ন দেহিছি আমি।
মিনি টালমাটাল ঘুমে। চিনির কথায় বিড়বিড় করে কিন্তু বুঝা যায় না কিছু। মাথা বালিশে রাখে, অতল ঘুমে তলিয়ে যায়। ঘুমের ঔষধ একটা না কয়টা বুঝা যায় না। তবে তার ঘুম আর কখনো ভাঙে না। দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয় অবশ্য কিন্তু মেয়েদের শরীর অশৌচ মুক্ত করতে পারে না কোনো বীর কোনো বিপ্লবী কোনো দার্শনিক এবং কোনো লেখক। শরীর তা সে বেশ্যার হলে সমস্যা নাই। কিন্তু সঙ্গী হতে হবে পবিত্র প্রথমা প্রিয়তমা। যাকে যত্র তত্র পরিচয় করানো যাবে। মা মেয়ে বোন এবং স্ত্রী হিসেবে। দেশ তাই মুক্ত হয়েও জড়িয়ে থাকে কলঙ্কে। হাজারো মিনির ছোট্ট ভ্রূণের রক্তে।