
।। ফকির লালন সাঁই ।।
প্রতিদিন ভোরে ব্রাহ্মমুহূর্তে, ফজরের আজানের পরেই আখড়ায়, ফকির আশ্রমে গাওয়া হয় আটটি গোষ্ঠগান। যেগুলির পদ বেঁধেছিলেন ফকির লালন শাহ। শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠলীলার গান এগুলি। ধেনু চড়ানোর সময় ভগবানের লীলা, এই গানগুলির সঙ্গে প্রাণ-প্রকৃতি-সমাজের সঙ্গে পরমের অভিন্নতার বিষয়গুলি মূর্ত হয়ে ওঠে। ফকির লবান শাহ ও তাঁর শিষ্য ফরহাদ মজহারের নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে এই গানগুলি প্রতিদিন ভোরে গাওয়া হয়। লালন শাহ ফকির বিরচিত এই আটটি গোষ্ঠগানের পদগুলির পাশাপাশি ইউটিউব লিঙ্ক পাঠকের দরবারে পেশ করা হল, জন্মাষ্টমী উপলক্ষে। জয়গুরু।
এক
অনাদির আদি শ্রীকৃষ্ণনিধি
তার কি আছে কভু গোষ্ঠ খেলা॥
ব্রহ্মরূপে সে অটলে বসে
লীলাকারি তার অংশকলা॥
সত্যাসত্য সকল বেদ-আগমে কয়
সচ্চিদানন্দ রূপে পূর্ণ ব্রহ্ম হয়
জন্ম মৃত্যু যার নাই ভবের পর
সেতো নয় স্বয়ং কভু নন্দলালা॥
পূর্ণচন্দ্র কৃষ্ণ রসিক সেজন
শক্তিতে উদয়, শক্তিতে সৃজন
গোষ্ঠ ভাবে সব চিত্ত আকর্ষণ
বৃহদাগমে তারে বিষ্ণু বলা॥
গুরুকৃপা বলে কোনো ভাগ্যবান
দেখেছে সেরূপ পেয়ে চক্ষুদান
সেরূপ হেরিয়ে সদা যে অজ্ঞান
লালন বলে সেতো প্রেমের ভোলা॥
দুই
লয়ে গোধন গোষ্ঠের কানন
চল গোকুলবিহারী
গোষ্ঠে চলো হরিমুরারি॥
তুই আমাদের সঙ্গে যাবি
বনফল সব খেতে পাবি
আমরা ম’লে তুই বাঁচাবি
তাই তোরে সঙ্গে করি॥
ওরে ও ভাই কেলে সোনা
চরণে নূপুর দে না
মাথায় মোহন চূড়া নে না
ধড়া পর বংশীধারী॥
যে ত্বরাবে এই ত্রিভূবন
সে যাবে আজ গোষ্ঠের কানন
ঠিক রেখো মন অভয় চরণ
লালন ওই চরণের ভিখারি॥
তিন
বলাই দাদার দয়া নাই প্রাণে
গোষ্ঠে আর যাবনা মাগো
দাদা বলাইয়ের সনে॥
বড় বড় রাখাল যারা
ও মা, বসে বসে থাকে তারা
আমায় করে জ্যান্তে মরা
বলে ধেনু ফিরা’ নে॥
ক্ষুধাতে প্রাণ আকুল হয় মা
ধেণু রাখার বল থাকে না॥
বলাই দাদা বোল বোঝে না
কথা কয় হেনে॥
বনে যেয়ে রাখাল সবাই
বলে এস খেলি কানাই
হারিলেই স্কন্ধে বলাই
চড়ে তখনে॥
তোরা যা সব রাখালগণে
আমি তো যাবো না বনে
খেলব খেলা আপন মনে
ফকির লালন তাই ভণে॥
চার
বল রে বলাই তোদের ধরণ কেমন হারে
তোরা বলিস সব রাখাল ঈশ্বর গোপাল
সেই গোপালকে মানিস কৈ রে॥
বনে যেয়ে বনফল পাও
এঁটো করে গোপালকে দাও
তোদের এ কেমন ধর্ম, বল সেই মর্ম
আজ আমারে॥
আমারে বোঝারে বলাই
ৰতোদের তো সেই ভাব দেখি নাই
তোরা ঈশ্বর বলিস যার, কাঁধে চড়িস তার
কোন বিচারে॥
গোষ্ঠে গোপাল যে দুঃখ পায়
কেঁদে কেঁদে বলে আমায়ে
লালন বলে তার, ভাব বুঝা ভার
এ সংসারে॥
পাঁচ
ও মা যশোদে তা আর বল্লে কি হবে
গোপালকে যে এঁটো দেই মা
মনে যে ভাব ভেবে॥
কান্ধে চড়ায় কান্ধে চড়ি
যে ভাব ধরায় সে ভাব ধরি
এসবই বাসনা তারি
বুঝেছি পূর্বে॥
মিঠার জন্যে এঁটো দিই মা
পাপ-পূণ্যের জ্ঞান থাকেনা
গোপাল খেলে হই সন্ত্বনা
পাপ পূণ্য কে ভাবে॥
গোপালের সঙ্গে যে ভাব
বলতে আকুল হয় মা তা সব
লালন বলে পাপ পূণ্য লাভ
ভুল হয় গোপালকে সেবে॥
ছয়
বনে এসে হারালাম কানাই
কি বলব মা যশোদায়।।
খেললাম সবে লুকালুকি
আবার হল দেখাদেখি।।
মোদের কানাই গেল কোন মুল্লুকি
খুঁজে নাহি পাই॥
ছিদাম বলে নেব খুঁজে
লুকাবে কোন বন মাঝে।।
দাদা বলাই বলে আর বুঝি সে
দেখা দেয় না ভাই ॥
সুবল বলে পল মনে
বলেছিল একদিনে।।
কানাই যাবে গুপ্ত বৃন্দাবনে
আজ গেলেন বুঝি তাই।
খুঁজে খুঁজে হলাম সারা
কোথা গেলি মনচোরা।।
আর বুঝি দিবি না ধরা
লালন বলে একি হল হায়।।
সাত
কোথা গেলি ও ভাই কানাই
সকল বন খুঁজিয়ে তোরে
নাগাল পাইনা ভাই ॥
বনে আজ হারিয়ে তোরে
গৃহে যাব কেমন করে।।
কি বলবো মা যশোদারে
ভাবনা হল তাই ॥
মনের ভাব বুঝতে নারি
কি ভাবের ভাব তোমারি।।
খেলতে খেলতে দেশান্তরি
ভাবে তো দেখতে পাই ॥
আজ বুঝি গো চারণখেলা
খেলবি না রে নন্দলালা।।
লালন বলে চরণবালছা
পাই না বুঝি ঠাই ॥
আট
সকালে যাই ধেণু লয়ে
এই বনে ভয় আছে ভাই
মা আমায় দিয়েছে কয়ে ॥
আজকের খেলা এই অবধি
ফিরা’ নে ভাই ধেণু আদি।।
প্রাণে বেঁচে থাকি যদি
কাল আবার খেলব আসিয়ে ॥
নিত্য নিত্য বন ছাড়ি
সকালে গিয়েছি বাড়ি।।
আজ মোদের দেখে দেরি
মা আছে পথ পানে চেয়ে ॥
বলেছিল মা যশোদে
কানাই দিলাম বলাইয়ের হাতে।।
ভালমন্দ হলে তাতে
লালন কয় কি বলব যেয়ে॥