আজ শনিবার, ৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

একাত্তরই চব্বিশ, চব্বিশই একাত্তর

ইতিহাসের কালপর্বে ১৯৭১ কেবলমাত্র বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা নয়, বরং বৃহৎ বঙ্গের ইতিহাসচেতনায় একাত্তর একটি প্যারাডাইম শিফট—আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমাজভাবনায় একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

আর ২০২৪—ইতিহাসের সেই গতিপথকে সম্পূর্ণতা দেয়।

মনে রাখা দরকার, একাত্তর থেকে চব্বিশ ইতিহাসে কোনো বিচ্ছিন্ন কালপ্রবাহ নয়, আকাশ থেকে ধূলির ধরায় এইমাত্র নাযেল হওয়া একটিমাত্র খণ্ডিত একাকী ঘটনা নয়, বরং এই ধারাবাহিকতার উৎসমুখ ১৯৪৭। ঔপনিবেশিকতা বিরোধী ইতিহাসচর্চার পাঠ উন্মুক্ত করে সাতচল্লিশের ব্রিটিশ বিরোধী আজাদী থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান। এ প্রসঙ্গে আরও বলতে হবে যে এই সাতচল্লিশ-একাত্তর-চব্বিশের অন্দরেই লুকিয়ে আছে ১৯৫২, ১৯৬৯ এবং ১৯৯০ এর বপন করা বীজ। আর আধুনিক ও ঔপনিবেশিক সময়পর্বের ভেতরে দ্রোহের যে ন্যারেটিভ তাকে কিন্তু খণ্ডিতভাবে দেখার সুযোগ নাই, বরং এই ন্যারেটিভ ধারণ করে উপনিবেশপূর্ব স্বাধীন ও সমৃদ্ধ বড় বাংলার বিপুল ঐশ্বর্য্যশালী পরম্পরা—যা কিনা দিল্লির সমান্তরালে বঙ্গের সুলতানদের গৌরবোজ্জ্বল স্বতন্ত্র শাসনের গৌরবের ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়। যা কিনা মনে করিয়ে দেয় জুলুম ও বর্ণবাদী বিত্তবাদী ও লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে অটল দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীচৈতন্য, নিত্যানন্দ, অদ্বৈতচার্যদের নেতৃত্বে নদীয়ার ধূলিময় পথে-পথের ভাবান্দোলনকে, যা কিনা মনে করিয়ে দেয় দিল্লি কর্তৃক বঙ্গের ওপর খবরদারি আর এখতিয়ার বহির্ভূত নাক গলানোর বিরুদ্ধে বারো ভূঁইয়ার প্রতিরোধের কথা, মনে করায় স্বাধীন নবাবদের শাসনামল। স্মৃতি ও সত্তায় ভেসে ওঠে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষনের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মজলুম জনতার প্রতিরোধের চিরভাস্মর লড়াই আর সামন্তবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের উত্তাল সব দিনের গল্প; ‘সাহেব’দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীন সংগ্রাম, দুর্ভিক্ষ আর মহামারির সঙ্গে লড়াই একদিকে (১৯৪৩), অন্যদিকে পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতি (১৯৪৬) মোকাবিলা করে ভারত-পাকের সমান্তরালে সমাজতান্ত্রিক যুক্তবঙ্গ গঠনের প্রস্তাব বা বেঙ্গল প্যাক্টের মতো অজস্র প্রস্তাবের কথা। সুতরাং উপনিবেশ পূর্ব সময়কাল থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক, কর্তৃত্ববাদী ও সম্প্রসারণবাদী সময়কালে আমরা দেখি বৃহৎ বঙ্গ প্রথমে অখণ্ডিতভাবে, পরে খণ্ডিতভাবে যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশ হিসাবে বহু ঝড় বহু ঝঞ্ঝা অতিক্রম করে কীভাবে আজ, এই ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪-এ এসে দাঁড়িয়েছে।

তাই উপনিবেশ পূর্ব সময়কালে এই বৃহৎ সংগ্রামের ইতিহাসে ওপরে উল্লেখিত তারকাদের পাশাপাশি ঔপনিবেশিক সময়কাল এবং তার পরবর্তী সময়ে মনে রাখতে হবে একে ফজলুল হক, যোগেন মণ্ডল, শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশংকর রায়, আবুল হাশেম, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার সহ বায়ান্নর সকল শহীদ, হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী, তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্নেল এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, মেজর জিয়াউর রহমান, সিরাজ শিকদার, মণি সিংহ, কর্নেল আবু তাহের ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উজ্জ্বল অবদানের কথা। তবে স্মরণীয়দের তালিকা এখানেই শেষ নয়। এই তালিকার মধ্যে রয়ে গেছেন ৭১-এর শহীদ বুদ্ধীজীবীরা, রয়ে গেছেন অগণিত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের অগণিত শহীদেরা। আর এই তালিকা দীর্ঘ হতে হতে ইতিহাসের ফাঁকে রক্ত মেখে হাজির হয়েছেন শহীদ নূর হোসেন। এবং এই সকল আত্মত্যাগের পথ ধরে জুলুমশাহীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চলমান রেখে ইতিহাসের পাতায় এসে আবির্ভূত হয়েছেন আবু সাঈদ, মুগ্ধ, দীপ্ত দে, হৃদয় তারুয়ারা।

আসলে ২০২৪ না এলে পূর্ববঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের এই সংগ্রামের অখণ্ড বয়ান থেকে আমরা বিস্মৃতই থাকতাম। কেননা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে একপাক্ষিক এক বয়ান তৈরি করে বাকি প্রায় সকল উজ্জ্বল জাতীয় তারকার নাম মুছে দিয়ে কেবলমাত্র, এবং কেবলমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানকেই এককভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সেই একরৈখিক জাতীয়তাবাদী বয়ান আসলে দিল্লির সম্প্রসারণবাদ দ্বারাই তৈরি। সেই বয়ান আওয়ামী ফ্যাসিবাদের, পরিবারতন্ত্রের, সেই বয়ান লুটপাটের, গুমখুনে্র, সকল কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করা কল্পনা চাকমা আর বিডিআর হত্যাকাণ্ডের, আয়নাঘরের, শাপলা চত্বরে নির্বিচারে গুলি করে মারা নিরাপরাধ সাধারণ মুসলমানের রক্তের ওপর জুলুমশাহী প্রতিষ্ঠার, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনের আধিপত্যের, সমস্ত আদিবাসীকে বাঙালী হয়ে যেতে বলার কুৎসিত জাতিবাদী আস্পর্ধার, সেই বয়ান আজকের গেরুয়া ফ্যাসিজম তথা হিন্দি-হিন্দু হিন্দুস্তানের মিথ্যাচারের। মুক্তিযুদ্ধের সেই একরৈখিক বয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশের সংগ্রামের ইতিহাস কিংবা একদা অখণ্ডবঙ্গের ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নাই। ইতিহাসের সেই আধিপত্যবাদী বয়ানকে খারিজ করে মুক্তিযুদ্ধ-সহ বড় বাংলার আত্মমর্যাদার ভাষ্যকে সামনে এনেছে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান। একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়নকে প্রতিহত করে স্বাধীনতা, সাম্য ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার যে ঝাণ্ডা তুলে ধরা হয়েছিল এবং যে ঝাণ্ডা লুট করতে চেয়েছিল আওয়ামী পরিবারতন্ত্র, সেই পতাকাকে রক্ত ঝরিয়ে, পঙ্গু হয়ে, চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে সসম্মানে আবার উড্ডীন করেছে চব্বিশের তরুণ ছাত্র জনতা।

হ্যাঁ, সাতচল্লিশ ও একাত্তরের চেতনাকে চব্বিশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে সত্য। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি একদিকে দিল্লির সম্প্রসারণবাদ, গোয়েবলসিয় মিডিয়াকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ভুয়া প্রপাগান্ডা আর অন্যদিকে সেই প্রপাগান্ডাকে জাস্টিফাই করতে বাংলাদেশের ভেতরে একদল মূর্খ প্রতিক্রিয়াশীল ধান্দাবাজ ও পরাজিত অপশক্তির দোসর আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হওয়া সদ্য জমিদারী হারানোর উদ্বাহু ক্রন্দনরোলে জাতীয় পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। আমরা দেখতে পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের গণমানুষের এগিয়ে আসার পরম্পরাকে বহন করে নিয়ে চব্বিশের বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছিল কলকাতাও। ফের তৈরি হয়েছিল ভাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধনের সম্ভাবনা। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে অতি তৎপর দিল্লিপোষিত প্রোপাগান্ডাবাজ ভারতীয় গণমাধ্যম। একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানের গণমাধ্যমও হয়তো এমন উদ্ভ্রান্ত সব-হারানো পাগলামোর আচরণ করেনি, যা আজকে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের প্রভু গেরুয়া ফ্যাসিস্ট ও তাদের মিডিয়া বাহিনি করে চলেছে। আসলে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান তো কেবলমাত্র ফ্যাসিস্ট আওয়ামী রেজিমের পতন নয়, বরং ভারত রাষ্ট্রের সামনে নতজানু হয়ে বসে থাকা মিঁউমিঁউরত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দাসযুগের অবসান, বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের নিজ রাষ্ট্রকে বিকিয়ে দেওয়া দালালির অবসান। সীমান্তে ঝুলে থাকা ফেলানি খাতুনের লাশের প্রতি কসম খেয়ে বাংলাদেশের জল-জমি-জঙ্গল লুট করে মোদি-শাহ-আদানিতন্ত্রের অবসানের সূত্রপাত। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান হাজির হয়েছে বৃহৎ বঙ্গ সহ গোটা উপমহাদেশে গৈরিক ফ্যাসিবাদের কবর খুঁড়তে।

একাত্তরে যেসব প্রশ্ন মীমাংসা হতে পারত, যা হতে দেওয়া হয়নি, যা হওয়ার সমস্ত সুযোগ অঙ্কুরে নষ্ট করা হয়েছিল, ইনকিলাবের স্পর্ধায় চব্বিশ সেই সকল প্রশ্নের মীমাংসা করবে বলে হাজির হয়েছে। তাই কান পাতলে আমরা শুনতে পাবো চব্বিশের ইনকিলাবের ধ্বনি বাংলাদেশের পাশাপাশি গোটা উপমহাদেশের নিপীড়িত মজলুম জনতা, শ্রমিক-কৃষক-হকার-কারিগর-কৃষি মজুর-ছাত্র-যুবক-নারী-প্রান্তিক-যৌনতার মানুষের ক্ষমতায়ন ও বহুত্বের স্বরকে একত্রিত করার সুর বাজাতে শুরু করেছে।

দ্রিম। দ্রিম। দ্রিম।

একাত্তর জিন্দাবাদ। চব্বিশ জিন্দাবাদ। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

সকলকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top