আজ শনিবার, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২২শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

খাঁচায় পুরে ভাবের ধারা রুখবে বলো কোন শালায়

‘এই গানই তো আমার সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিকতা’

বয়াতি সম্রাট আবুল সরকারের উপরের এই কথাটির মধ্যেই তাঁর পরিচয় লুকিয়ে আছে। তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ভাবের গান গেয়ে আসছেন, গাইছেন পালাগান। তিনি একজন গুণী শিল্পী হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি তাঁর পালাগানে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রথমেই এই গ্রেফতারির কড়া নিন্দা জানাচ্ছি আমরা। বয়াতি মহারাজ আবুল সরকারকে বিনা-শর্তে মুক্তির দাবি জানাচ্ছি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে।

বাংলায় ফকিরি, বয়াতি, ‘বাউল’, মুর্শিদি, কীর্তন , পালা ইত‌্যাদি ধারার ভাবের গান মূলত আধ্যাত্মিক। ভাবের ধারার এসব গানে কোনো উস্কানি থাকেন না কোনো কোনো সহিংসতার বার্তা প্রকাশ পায় না; বরং শান্তি, ভালোবাসা ও সহনশীলতার কথা বলা হয় এইসব গানে গানে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় মানুষ রাজপথে নেমেছিল বৈষম্যহীন সমাজ ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার দাবিতে। ৫ই আগস্ট ২০২৪ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার পালিয়ে যায়। অন্তর্বতী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা দেখলাম বাংলার ইসলাম প্রচারকারী অনেক অলি-আউলিয়ার মাজারে হামলা হয়েছে, অনেক মাজার ভাঙচুর করা হয়েছে। আক্রান্ত হচ্ছেন সাধকরা, শিল্পীরা। গ্রেফতারও করা হচ্ছে। এই প্রবণতা আমাদের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর সরাসরি আঘাত। শুধুই আঘাত নয়, বরং এহেন ঘটনা প্রমাণ করে, বৃহৎ বঙ্গে ইসলামের যে চরিত্র হাজির রয়েছে, ইসলামের সেই রূপকে খণ্ডন করে একমাত্রিক ও বৈচিত্র বিরোধী জাতিবাদী ইসলাম কায়েম করার চেষ্টা শুরু হয়েছে প্রবলভাবে। মনে রাখা দরকার বঙ্গের ইসলাম একদিকে মূলগতভাবেই নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর ভাবাদর্শের অনুসারী যেমন, ঠিক তেমনই বঙ্গের ভাব, ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রকৃতিজগতের সঙ্গে এই ইসলামের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদের অুনপ্রবেশ ও ঔপনিবেশিক লুন্ঠন একদিকে যখন বাংলার গণমানুষকে গোত্রবাদী-জাতিবাদী ও অর্থনৈতিক শ্রেণি ভেদাভেদের ভিতরে ঠেলে দিয়েছে, তখন ইসলাম বঙ্গের ভূমি ও প্রকৃতির ভাবের সঙ্গে একাত্মতা স্থাপন করে হয়ে উঠেছিল শূদ্র ও মজলুমের শান্তির ছত্রছায়া। ভেদাভেদমুক্ত, শান্তি, মৈত্রী, সাম‌্য ও সহবস্থানের সমাজ কায়েম করার লক্ষে‌্যই অলি-আউলিয়াদের হাত ধরে বাংলায় ইসলামের প্রসার হয়েছে। আর বাংলার আউলিয়া, বয়াতি, ফকির, ‘বাউল’-রা যুপগ-যুগ ধরে শান্তি, সাম‌‌্য, মৈত্রী ও সহাবস্থানের সহজ সমাজের কথাই প্রচার করে এসেছে যুগ-যুগান্ত ধরে। ফলে ফকিরি-বয়াতি-মারেফতি সমাজের সঙ্গে স্থূল জাতিবাদী মোল্লারা শরিয়া তথা ইসলামের যে বিরোধ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তা নিতান্তই ভুয়া। বাংলার ফকিররা মোটেও ইসলাম বিরোধী নয়। বরং তাঁরা সঠিকভাবেই জাতিবাদের বিরোধী, বর্ণবাদ ও গোত্রবাদের বিরোধী। ইসলামও মূলগতভাবে গোত্রবাদ, বর্ণবাদ ও জাতিবাদের বিরোধী।

আমরা মনে করি, বয়াতি আবুল সরকারের গ্রেফতারের ঘটনা জুলাই সনদের ঘোষিত লক্ষ্য ও রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষিত প্রতিশ্রুতির প্রতি সরাসরি আঘাত। আমরা যখন বলি যে নতুন রাষ্ট্র এবং নতুন সমাজ গড়ে তুলব, তখন সাধক, শিল্পী ও নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষা করা সেই প্রতিশ্রুতির মৌলিক অংশ হতে হবে। একটি আধুনিক রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শিল্প-সংস্কৃতির স্বাধীনতা ও আধ্যাত্মিক চর্চার স্বাধীনতা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। একজন বয়াতি-ফকির কিংবা ‘বাউল’ যদি নিরাপদে গান গাইতে না পারেন, যদি তাঁর আধ্যাত্মিক পালাগানের জন্য তাঁকে থানায়-আদালতে যেতে হয়, তবে আমরা যে নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলি, তা বাস্তবে দুর্বল হয়ে পড়ে। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই পুরোনো কলোনিয়াল আইনের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। যে আইন ব্রিটিশ শাসনের সময় মানুষের মতপ্রকাশ দমনের জন্য তৈরি হয়েছিল, সেই আইন আজও শিল্পীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা আমাদের জন্য লজ্জার। রাষ্ট্র যদি সত্যিই পরিবর্তনের পথে হাঁটতে চায়, তবে প্রথম কাজ হওয়া উচিত এই ধরনের আইন সংস্কার বা বাতিল করা, নতুন করে এগুলোর ওপর ভর করা নয়। নচেৎ এধরনের ঘটনা এই রাষ্ট্রব‌্যবস্থাকে ভিতর থেকেই ভঙ্গুর করে দেবে। মনে রাখা উচিত একজন সাধককে, একজন শিল্পীকে, একজন চিন্তাশীল মানুষকে এভাবে খাঁচায় পুরে রেখে অগ্রগতির ভাবনা নেহাতই বাতুলতা। আর জেলে-গারদে পুরে ভাবের ধারার প্রসরতা রুখে দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। সে তিনি যত বড়ই ব্রাহ্মণ্যবাদী অথবা ওয়াহাবি-সালাফি মোল্লা জাতিবাদী হোন কেন! এমনকী তিনি যদি রাষ্ট্রপ্রধানও হন, তাঁর পক্ষেও এটা সম্ভব নয়। এটা যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে।

আমরা মনে করি, বাংলার সুফি, বয়াতি, ফকিরি, সহজিয়া, বৈষ্ণব ইত্যাদি ধারাকে সন্দেহের চোখে দেখা বা হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করা ভুল এবং বাস্তবতাবিরুদ্ধ। বরং ভিন্নধর্মী চিন্তা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের প্রতি সহনশীল মানসিকতা না গড়লে কোনো সমাজেই স্থায়ী শান্তি ও স্থিতি আসতে পারে না। ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে আমরা মহারাজ আবুল সরকারের গ্রেফতারের নিন্দা জানাই এবং তাঁকে বিনা-শর্তে সসম্মানে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানাই।

একজন শিল্পীর গান গাওয়ার অধিকার কোনো দয়া নয়, এটি তাঁর নাগরিক অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একজন বাউল শিল্পীকে গ্রেফতার করে রেখে মুক্ত রাষ্ট্র বা গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিকে বিশ্বাসযোগ্য রাখা সম্ভব নয়। আমরা আবারও বলছি মহারাজ আবুল সরকারকে দ্রুত মুক্তি দিন, সাধককে সাধনায় থাকতে দিন। শিল্পীকে গান গাইতে দিন।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top