।। হুমায়ূন শফিক ।।
মেয়েটিকে দেখে তার মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে যেন তার বয়স আরও কম লাগছে। একটু আগেই মনে হয়েছিল, বয়সটা ২৬-২৮। এখন মনে হচ্ছে ২০-২২।
মেয়েটি তখন বলে, আপনার বাড়িতে নিয়ে যান, আপনার সঙ্গে থাকব, আমার তো যাবার জায়গা নেই।
কথাটা শুনেই সে ভয় পেয়ে যায়, একে তো রাত প্রায় এগারোটা। নদীর পাড়ে এত রাতে কেউ আসেও না। ভূত না তো!
শ্লোক ১
আগুনের চারপাশে বরফ দিয়ে ঢেকে দিলেও সেই আগুন তীব্রবেগে বরফকে গলিয়ে পানি করে বের হয়ে আসে। নারী-পুরুষের ভিতরেও আগুনের উত্তাপ মাঝে মাঝে এতটাই বেড়ে যায় তা দমিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব।
গল্পের প্রয়োজনে প্রধান চরিত্রের একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করা যাক— মিথেন। রসায়নশাস্ত্রে মিথেনের ব্যাপক প্রভাব— যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন। পাঠ্যবইয়ের দিকে আমরা কিছুতেই গমন করব না, কারণ প্রত্যেক পাঠ্যবই সেই ছোটোবেলা থেকে আমাদের নিকট অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, এমনকী প্রাণনাশীও বলা চলে।
শ্লোক ২
মিথেন এমন একজন মানুষ তার পরিচয় দেওয়া প্রায় দুরূহ। কারণ তাকে না বলা যাবে পুরুষ, না নারী, না বলা যাবে উভলিঙ্গধারী, না বলা যাবে কমন জেন্ডার। সিদ্ধান্তে আসা কোনোভাবেই সম্ভব না। তাকে বলা যেতে পারে সবকিছুর সম্মিলিত একটা রূপ। এর একটা নাম দেওয়া প্রয়োজন, কিন্তু সেই নামটা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব রকমের অস্বস্তিকর বা বিব্রতকর। তবু মিথেন হিসিবেই তাকে চিনি ধরে নিন। তাকে সব কয়টি রূপেই দেখা যায়, (১)‘বায়ু যেমন ফুলের গন্ধ নিয়ে অন্যত্র গমন করে, তেমনিই এই জগতে জীব এক স্থূল শরীর থেকে অন্য স্থূল শরীরে তার জীবনের ধারণাগুলি নিয়ে যায়’ এই শ্লোকটি তার জন্য পারফেক্ট। গীতার এই শ্লোকটি নিশ্চয়ই বোঝা গেছে। না গেলে তাকেও চেনা যাবে না।
শ্লোক ৩
নীচের পরিচ্ছেদে মিথেনের গল্পগুলো বলা হবে। ১ম থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে পড়তে হবে। কারণ নীচে যেসব গল্প পড়বেন, তা একদম সত্য। বিশ্বাস-অবিশ্বাস আপনাদের ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত যদি ধৈর্য ধরে না পড়েন তাহলে রহস্যজনক মানুষটা আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। সমস্যা হচ্ছে সম্পূর্ণ পড়লেও যে বুঝবেন তা বলাও মুশকিল। কারণ একেক জনের বোঝার ক্ষমতা একেক রকম। তাহলে চলুন— মিথেনের ছোটো দুনিয়ায়…
১ম পরিচ্ছেদ
চাঁদের আলোয় সেদিন জোৎস্না ছিল না, পৃথিবী থেকে দাঁড়িয়ে চাঁদকে আলোকিত মনে হলেও সে আলো পৃথিবী অবধি পৌঁছায় না, অদৃশ্য মায়ায় আটকে ছিল হয়তো বা। এমনই একটি দিনে মিথেনের পৃথিবীতে আগমন হয়। ইছামতী নদীর পাড়ে তাকে প্রথম লক্ষ করে মরা জাইল্যা (মরণ চাঁদ-জেলে)। নিশিতে সে মাছ ধরে, মাঝে মাঝে গেরস্থের পুকুর থেকে চুরি করে জাল ফালায়। চুরি করতেও ওস্তাদ, চুরি মাঝে মাঝে করেও, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে গ্রামের ও আশেপাশের অন্যান্য গ্রামের সবাই জানে সে নাম্বার ওয়ান চোর, তাই তেমন সুবিধা করতে পারে না। সেদিন কাঁধে জাল ফেলে বাড়ি থেকে রাতের খাবার খেয়ে বের হয়ে আসে। নদীতে এসেই দেখতে পায় একজন মানুষ নদীর পাড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সে চোর হলেও মায়া-মমতা অনেক, কেউ যদি বিনয় করে কথা বলে তাহলে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চায়। তবে বেশিরভাগ মানুষই তাকে কিছু বলার আগেই গালি দেয়। গালিটা এখন গা সওয়া হয়ে গ্যাছে, তেমন লাগে না। তবু সে একজন মানুষ তো, মানুষ মানুষকে এভাবে গালি দেয় বলে তার খুব দুঃখ। সে মনে মনে ভাবে, আমি চুর, তয় মানুষ তো। কারও বিপদেও সবার আগেই পৌছে যায়। যা-ই হোক, সে মানুষটার কাছাকাছি যায়, আগে বুঝে নেয় লোকটা বেঁচে আছে নাকি মরে গ্যাছে, যখন বুঝতে পারে বেঁচে আছে, তখন তাকে ধরে চিত করে শুইয়ে দেয়। দেখে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না। বাড়ি থেকে বউ বলে দিয়েছে: যাইতেছ যাও, মাছ না পাইলে খবর আছে। মানুষটাকে দেখে তার প্রথমে কেমন যেন মনে হয়। অন্ধকারের ফলে তেমন ঠাওরও করতে পারে না, বউয়ের কথা মনে হতেই তার শরীরে কাটা দেয়। মাছ না পাইলে তার যে খবর আছে বোঝে সে, দেরি করা উচিত হবে না। কিন্তু মানুষটাকে এইভাবে ফেলে রাখতেও তার মনে সায় দিচ্ছে না। অন্যদিকে মাছ না ধরলে বউ তার সঙ্গে রাতে শোবে না।
দোটানায় পড়ে মরা। তার মিনি টর্চটা জ্বেলে মানুষটার মুখ দ্যাখে। মুখটা তার চোখে পড়তেই আতকে উঠে, এত সুন্দর রূপ কোনো নারীর হতে পারে সে কল্পনাই করেনি। ধীরে ধীরে মুখ থেকে গলায় তার টর্চ নামতে থাকে, স্তন যুগল, পেট থেকে পায়ে। সে চিন্তায় ডুবে যায়, অন্ধকারে তাহলে কী দেখছে, কাপড় পরা এই মেয়েটিকে দেখে আগে কেন বুঝতে পারেনি পুরুষ নয় নারী। চিন্তা না করে সে তাকে ডাকে, আফা, ও আফা, হইছে কী?
তার ডাকের সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকায়। তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা মলিন চোখে দ্যাখে তাকে। তারপরে বলে, কী হইছে আমার?
– আপনে তো শুইয়া আছেন? শইল্যা তো পানিও নাই। মাতা ঘুইন্যা দিয়া পড়ছিলেন নি?
– হতে পারে।
– যাইবেন কই?
মেয়েটিকে দেখে তার মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে যেন তার বয়স আরও কম লাগছে। একটু আগেই মনে হয়েছিল, বয়সটা ২৬-২৮। এখন মনে হচ্ছে ২০-২২।
মেয়েটি তখন বলে, আপনার বাড়িতে নিয়ে যান, আপনার সঙ্গে থাকব, আমার তো যাবার জায়গা নেই।
কথাটা শুনেই সে ভয় পেয়ে যায়, একে তো রাত প্রায় এগারোটা। নদীর পাড়ে এত রাতে কেউ আসেও না। ভূত না তো!
– কী বলেন আফা। আমি গরিব মানুষ, আপনারে কেমনে রাখব।
– দু’বেলা খেতে দিবেন, তাতেই হবে।
কিন্তু… মরা তখন কিন্তু কিন্তু করে। মেয়েটি ততক্ষণে দাঁড়িয়ে যায়। তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার শরীরের সুঘ্রাণে সে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফ্যালে। কিছুই বলতে পারে না। চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোট সামনে এগিয়ে আনে, মরার ঠোটের সঙ্গে ঠোট লাগায় মেয়েটি। মরা এই চুম্বনের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু সে সেখান থেকে সরে যেতেও পারে না, যেন মাটির হাত গজিয়েছে, সেই হাত তার পা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। কতক্ষণ চুম্বন স্থায়ী হয় সে বুঝতে পারে না। মেয়েটি যখন বলে, হয়েছে হয়েছে, এবার বাড়ি চলো। একেবারে আপনি থেকে তুমি বলে সম্বোধন করে।
মরা মাছ ধরবে কী, সবকিছু যেন উলটপালট হয়ে যায়। সে জম্বির মতো মেয়েটির পিছন পিছন যেতে থাকে। যেন মেয়েটি তার কত আগের চেনা।
–বাড়ির উঠানে আসতে মরার বউ বের হয়ে আসে।
–মাছ কই? মায়াডা কেডা?
–আমি উনার স্ত্রী। আপনি কে?
–এই মাইয়া বলে কী, ফাজিল, তুমি যাও, যেখান থিকা আইছ, সেইখানে যাও। আমার সংসারে আগুন ধরাইবা, দেইখা তো ভদ্রই মনে অয়, এমন কতা কও কেমনে, হু?
– হ্যাঁ, এটাই সত্যি। আপনি চলে যান, না হলে কিন্তু…
কী করবি তুই? বলেই কোমরে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি। মেয়েটি কিছু না বলে হাসে। ধীরে ধীরে মরার বউ মানে স্বপ্না নিশ্চুপ হয়ে যায়, যেন কোনো জাদুমন্ত্র তাকে চুপ করিয়ে রেখেছে।
স্বপ্নার সামনে যায় মেয়েটি। ঠোট বাড়িয়ে দেয় তার ঠোটের দিকে, তাকে দীর্ঘ এক চুম্বন দেয়। স্বপ্নাও কিছু বলতে পারে না আর। মেয়েটি তখন হাসে।
চলো, সবাই ঘরে যাই।
একসাথে ঘরে চলে যায়, সবাই। যেন কিছুই হয়নি, সবাই সবাইকে অনেক দিন থেকেই চেনে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
মরার শোবার ঘর দু’টি থাকলেও খাট একটি। অন্য ঘরে একটি মাচা পাতা। সেখানে কোলা থেকে শুরু করে কলস, বড় বড় হাড়ি রেখে দেওয়া হয়েছে। তারা কে কোথায় শোবে যেন আগে থেকেই ঠিক করা। মেয়েটি খাটের উপর শুয়ে পড়ে, তার ডান পাশে মরা ও বাম পাশে স্বপ্না।
শোনো, আমার নাম মিথেন, নাম তো জিজ্ঞেস করো নাই, তাই বললাম।
মিথেন, আরে তুমার নাম কি আমি জানি না ভাবতেছ। স্বপ্না তাকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলে। স্বপ্নার কাছে মনে হয় কোন সুঠাম দেহের পুরুষকে সে জড়িয়ে ধরল। সেই পুরুষ ছিল তার স্বপ্নের পুরুষ, যার সঙ্গে মনে মনে কতদিন রাত কাটানোর কথা চিন্তা করেছে। স্বপ্ন যে কোনোদিন সত্য হবে ভাবেনি। সে তার স্বপ্নের পুরুষের সারা শরীরে হাত বোলাতে থাকে। মিথেন তখন স্বপ্নার স্তন ধরে আলতো চাপ দেয়। স্বপ্না কিছুটা লজ্জা পায়, মিথেনের পাশেই তার স্বামী মরণ চাঁদ। মরণ চাঁদ ততক্ষণে মিথেনের বুকে হাত দেয়, সে-ও এক হাত স্তনে দেয়, অন্য হাত নাভির নীচে। মিথেন তখন ডান হাত দিয়ে মরণ চাঁদের লিঙ্গ স্পর্শ করে। সারারাত একে-অন্যের সঙ্গে রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকে।
ফজরের আজান কানে আসতেই সবাই শান্ত হয়, তৃপ্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করে মরণ চাঁদ ও স্বপ্না। মিথেন তখনও জেগে থাকে, তার ঘুমের প্রয়োজন নেই। সে উঠে পড়ে। বাইরে এসে টিউবওয়েল থেকে পানি পান করে।
মিথেন হাঁটতে বের হয়, হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের মসজিদের সামনে আসে। তার শরীরে তখন পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। মসজিদে প্রবেশ করে, তখনও ইমাম ছাড়া অন্য কেউ আসেনি, ইমাম কোরান তেলওয়াত করছিল। তাকে দেখে তেলওয়াত বন্ধ করে। কোনো পুরুষের যে এমন রূপ হতে পারে কোনোদিন সে ভাবতেও পারেনি, সে কিছুটা ভয় পায়, জিন নয় তো। কিন্তু না… গ্রামের অন্যান্য মুসল্লিরা এসে পড়াতে তার ভয় কেটে যায়, সবাই একসঙ্গে নামাজ পড়ে যার যার গন্তব্যে চলে যায়।
কিন্তু মিথেন মসজিদ ছেড়ে যায় না, ইমামের সামনে বসে থাকে। ইমাম কিছুক্ষণ আল্লার জিকির করে, তার সঙ্গে তাল মেলায় মিথেন। জিকির শেষ করে ইমাম তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার বাড়ি কোথায়? আগে তো দেখি নাই এই গ্রামে।
–বাড়ি-ঘর নাই হুজুর, মৃদু হেসে উত্তর দেয় সে।
– যাবেন কই?
–আপনি যদি একটু আশ্রয় দেন, সেই আশায় এখানে আসা।
– দ্যাখেন বাবা, আমি নিজেই এদের আশ্রিত। কীভাবে আশ্রয় দিব? আপনি বরং গ্রামের মাতব্বরের কাছে যান, আমিই নিয়ে যাচ্ছি চলুন।
মিথেন উঠে না, বসেই থাকে। ইমামের দিকে তাকাতেই তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হয়, কী করবে না করবে নিজেই বুঝতে পারে না। মিথেন দাঁড়িয়ে ইমামকে বলে, চলুন, আপনার বাড়ি যাই।
ইমামও দাঁড়ায়। কিছু বলতে পারে না। মিথেনকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা শুরু করে। গন্তব্য তার নিজের বাড়ি।
ইমামের বাড়িতে দুই ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী। ছেলেটির বয়স আট, মেয়েটির বারো। তার আর একটি ছেলে ছিল, ছয় বছর বয়সেই মারা যায়। রেহানা বেগম সেই ছেলেটিকেই সবচেয়ে বেশি আদর করতেন। ইমামও। প্রথম সন্তান বলেই বোধহয় আদরটা একটু বেশি। রাজপুত্রের মতন চেহারা ছিল। ইমাম বলতেন, মুহাম্মদ আলিকে বড়ো মাওলানা বানাব। লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে খুতবা দিবে। সেই খুতবা নিজেও শুনবেন। কিন্তু ভাগ্যের লীলা, মুহাম্মদ আলি একদিন বাড়ি থেকে খেলতে বের হয়ে আর ফিরে আসল না। অনেক দিন পরে পুলিশ তাদের খবর দিল, একটা ছেলের লাশ পাওয়া গ্যাছে, দেখে যান। ইমাম কাঁপতে কাঁপতে সেখানে চলে গেল। এক নজর দেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। তার স্ত্রীর একই অবস্থা হল। এইসব ঘটনা অনেক দিন আগের। তবু ছেলের কথা মনে পড়লে তার বুক হুহু করে উঠে।
মিথেন ইমামের পিছু পিছু হাঁটছে। তার কোনো ক্লান্তি নেই যেন। যেতে যেতে ইমাম একবার পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখল তার ছেলে মুহাম্মদ আলি। প্রথমে কিছুটা বিস্ময়বোধ হলেও, পরে তেমনটা হল না। কারণ এখন সে জানে তাদের সবচেয়ে প্রিয় পুত্র মুহাম্মদ আলি ফিরে এসেছে। তাকে সঙ্গে করেই বাড়িতে যাচ্ছে।
বাড়ির সামনে আসতেই লক্ষ করল বাড়িটাকে নতুন করে সাজানো-গোছানো হয়েছে। তাদের একটি গাভী আছে, গাভীর গলায় মালা পরানো হয়েছে। উঠান করা হয়েছে ঝকঝকে। সেখানে জুতা পরে হাঁটতে ইতস্তত বোধ করছে সে। গোয়ালঘর দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে তৈরি করা হয়েছে। ঘরগুলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তার স্ত্রী নতুন কাপড় পরে দাঁড়িয়ে আছে উঠানে, যেন আগে থেকেই জানত তাদের পুত্র ফিরে এসেছে। ছেলে-মেয়ে দুটাও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের বড়োভাই এল বলে।
ইমাম বাড়িতে ঢুকেই তার স্ত্রীকে ডাকল।
– দ্যাখো ছেলেকে নিয়ে আসলাম। দেখি রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতেছে।
– ভালো করেছ। মিথেনকে জড়িয়ে ধরে বলল, একা একা আর বের হবা না। চিন্তায় আমরা মরি।
– ঠিকাছে মা। বলেই হাসল।
– আলি ভাই, কই গেছিলা তুমি। ফাতেমা জিজ্ঞেস করল। ফয়সাল কিছু বলল না। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। এতেই বোঝা যাচ্ছে সে যথেষ্ট খুশি।
– তাকে ঘরে নিয়ে খাটের উপর বসিয়ে তার মা বলল, কী খাবি? তোর প্রিয় মুকশালা পিঠা বানাইছি। আনি।
–আনো। সবাইকে দাও। আমি একা খাব কেন?
– ঠিকাছে। তোর জন্যই অপেক্ষা করতেছিলাম।
রেহানা বেগম তখন পিঠা আনতে খাবার ঘরে চলে গেল। ফয়সাল আর ফাতেমা ভাইয়ের গা ঘেষে বসে পড়ল। ইমাম সন্তানদের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই রকম আনন্দঘন দিন ফিরে আসবে ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেনি।
ভাই-বোন মিলেমিশে পিঠা খাচ্ছে। রেহানা বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছে, হঠাৎ তার মনে হল চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কিন্তু কারণ তার জানা নেই।
কিছুক্ষণ পরে ইমাম এসে আলিকে বলল, বাবা তোমাকে খুব শীঘ্রই মাদ্রাসায় ভরতি করিয়ে দিব। তুমি কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করবে। তোমাকে আল-আজহারে পড়াতে পাঠাব।
– তুমি চিন্তা কইরো না, আমি ভালো মতো পড়ুম। আচ্ছা আব্বা, তুমি কি আল-আজহারে গেছিলা?
– নারে পাগল। আমার কি আর সেই ভাগ্য! কিন্তু তুই যাবি। যত কষ্টই হোক আমাদের।
– আব্বা, আল–আজহার কোথায়?
– মিশরে। সেখানে দেখার মতোও অনেক কিছু আছে। বড় হলেই বুঝবি।
– ঠিকাছে আব্বা।
– তাদের পিঠা খাওয়ার পর্ব শেষ হলে, ভাই-বোনদের সাথে খেলতে চলে যায় আলি। ইমাম ও তার স্ত্রী দু’জনে বসে বসে গল্প করতে থাকে। তাদের ছেলে-মেয়েদের কীভাবে বড়ো করবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে! এইসব ভাবতে ভাবতে ইমামের মনে হয়, তাকে মসজিদে ফিরতে হবে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মিথেন ইমামের বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। ইমাম ও তার স্ত্রী তখন মোহাম্মদ আলির কথা ভুলে যায়। কিন্তু তাদের মাঝে কেমন যেন একটা ভালো লাগার আবেশ কাজ করতে থাকে, অনেক চেষ্টা করেও আলি যে ফিরে এসেছিল তা মনে করতে পারে না। অন্যদিকে মরা ও তার স্ত্রীও ভুলে যায় রাতে তাদের সাথে কী ঘটেছিল। শুধু সারারাত যে তারা রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত ছিল সেইটুকুই তাদের স্মৃতি।
মিথেন আবার হাঁটতে থাকে, সামনে একটি বাচ্চা ছেলেকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। কারণ বাচ্চা ছেলেটি তাকে দেখে মনে মনে বলছিল, তোমাকে তো চিনি, হে বহুরূপী। মিথেন তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিথেন এখন একজন পূর্ণবয়স্ক যুবক। তার উদ্দেশ্য ছিল কোনো দুঃখী মায়ের কাছে যাওয়া। এবং সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সেই মায়ের দুঃখ পুরোপুরি লাঘব করবে। কিন্তু এই বাচ্চা ছেলেটা কে? তাকে এক নজর দেখেই চিনে ফেলল।
বাচ্চাটিকে সে বলল, তুমি কে?
– আমার নাম বাবু। আর কিছু জানতে চাও?
মিথেন কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। ভাবে ছেলেটা হয়তো তার সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানে। কিন্তু সাধারণ কোনো মানুষ হলে তো তাকে চেনা তো দূরের কথা, বুঝতেও পারবে না সে আসলে কী বা কে!
– জানতে তো অনেক কিছুই চাই। প্রথম জানতে চাই, তুমি আমাকে চিনলে কীভাবে?
– তোমাকে তো আমি চিনি না।
–চিনো না!
মিথেন এবার অবাক হয়। কারণ সে নিশ্চিত ছেলেটা মনে মনে বলেছে, সে তাকে চিনে। সমস্যা হচ্ছে অন্যান্য মানুষকে দেখে মিথেন সেকেন্ডেই বুঝে যায় মানুষ কে; মূলত সেই মানুষের নাড়িনক্ষত্র সবই জেনে ফেলে, কিন্তু এই বাবু নামের বাচ্চা ছেলেটিকে সে চিনতেও পারছে না, বারবার তার ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে।মিথেন ভাবল, যে কাজে এসেছি, সেটাই গিয়ে করি। তখন ছেলেটির কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করে। আর বাবু নামে ছেলেটি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সাথে সাথে পাখির রূপ ধারণ করে উড়াল দেয়। মিথেন পিছন ফিরে দ্যাখে ছেলেটি হাওয়া। একটি কমলা রঙের পাখি আকাশে উড়তে দ্যাখে। মিথেন এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে যায়।
মিথেন বাবু নামক ছেলেটির কথা ভাবতে থাকে। সে ভেবেছিল তার মতো শক্তিশালী কেউ নাই। কিন্তু বাবুকে দেখে সে ভড়কে গেল। কারণ বাবু হয়তো তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। কিন্তু বাবু তার কাছে কী চায়? এসব ভাবতে ভাবতে সে সন্তানহারা এক মায়ের খোঁজ পেয়ে যায়। নিজেকে সেই সন্তান হিসেবে উপস্থাপন করে সেই মায়ের সামনে। মা-ও তাকে আদর করে। এমন আদর একটু আগেই আরেক মায়ের কাছে পেয়েছিল সে। মিথেন জীবনে অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু মায়ের যে আদর, এর উপরে যেন কিছু নেই। এই জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোনো না কোনো মায়ের কাছেই থাকবে সে। আর যদি সব মায়ের কাছেই সে থাকতে পারত, কতই না ভালো হত।
যখন এমন চিন্তা সে করছিল, তখন বাবুও তার দিকে লক্ষ রাখছিল। বাবু জানে মিথেন যদি চায় তাহলে টুকরো টুকরো হয়ে সব মায়ের কাছেই সে চলে যেতে পারবে। বা দুঃখী মানুষদের সাথেও যেতে পারবে। তাহলে পৃথিবীতে দুঃখ বলে কিছু থাকবে না। তখন পৃথিবীর যে ভারসাম্য তা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সে চিন্তা করল মিথেনকেই ধ্বংস করবে। মিথেন তখন ঠিকই ভাবছিল দুনিয়ার সবার দুঃখমোচন করবে। বাবুও তার এই চিন্তায় হাসছিল।
নতুন মাকে জড়িয়ে ধরে মিথেন বলল, মা, ও মা। পিঠা খাব। ভাপা পিঠা।
– বানাইতেছি। আমার বাপ। তুই-ই তো খাবি।
এমন সময় বাবু কী যেন করল, মিথেনের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করা মাত্র মিথেন ধীরে ধীরে বাতাসের সাথে মিশে যেতে লাগল। আর মিথেনের মা নিজের ছেলের এই অবস্থা দেখে কান্না জুড়ে দিল। কষ্টে যেন তার বুক ফেটে যাচ্ছিল। নিজের সন্তানের এই অবস্থা দেখলে কোন মায়ের মাথা ঠিক থাকে।
বাবু তখন এই মায়ের কষ্ট দেখে ভাবছিল, পৃথিবীর ভারসাম্য ঠিক রাখাই লাগবে। মিথেনকে যে কাজ দেওয়া হয়েছিল, তার থেকে অতিরিক্ত করে ফেলছিল সে। যা-ই হোক, মিথেনের মতো আরেকজনকে তৈরি করতে বলা লাগবে। তবে লিমিটের মধ্যে রাখা লাগবে তাকে।
বাবু আবারও পাখির মতো আকাশের দিকেই উড়াল দিল।।
তথ্যসূত্র:
১. (শ্রীমদ্ভগবদগীতা: অধ্যায়: ১৫, পুরুষোত্তমযোগ, শ্লোক আট)
হুমায়ূন শফিক
জন্ম ১৯৯৪ সালে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নবাবগঞ্জে। পড়ালেখা করছেন টেক্সটাইলে। গল্প, উপন্যাস লেখেন, অনুবাদ করেন।