আজ রবিবার, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

একটা দেশকে চিনতে গেলে তাকে বুঝতে হয়

।। সৌমিত্র দস্তিদার ।।

ভারতে থাকলে আমার বাংলাদেশের জন্য মন কেমন করে। আবার উল্টোটা হয় ওদেশে থাকলে। এখন এসব সত্যি কথা বলা বা মনের আবেগকে সামনে নিয়ে আসাও রাষ্ট্রদ্রোহিতা কিনা! বলতে পারবনা।

কিন্তু যে কারনে কথাটা বলছি, তা বড় দুঃখে। এপারের মিডিয়া যেভাবে ওপারের জনপদকে অন্ধকার ভুখণ্ড করে বলে বলে জনগনের মন বিষিয়ে দিচ্ছে তাতে বড় অস্বস্তি হচ্ছে আগামী দিনে বাংলাদেশের জনতার মুখোমুখি হব কিভাবে তা নিয়ে। এ পর্যন্ত পড়েই অনেক তথাকথিত ভদ্দরলোক হা হা করে বলে উঠবেন, ওরা কি ধোয়া তুলসী পাতা!! নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু এদেশে যেভাবে পরিস্থিতি বিষাক্ত করে তোলা হচ্ছে তার কাছে বাংলাদেশ দুগ্ধ পোষ্য শিশু।

কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশকে দেখছি বলে দাবী করব না, আমি ওই দেশের বিশেষজ্ঞ। শুধু বলতে পারি, দেশটাকে বোধহয় কিছুটা ভালবাসি। কতশত জনপদ যে ওই পারে দেখেছি, তার হিসেব নেই। কত চমৎকার সব শান্ত নদী। টাঙ্গাইলের লৌহজং, বরিশালের কীর্তনখোলা, খুলনার রূপসা কিম্বা ভুরুঙ্গামারীর দুধকুমার। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি না আমার বাংলাদেশ তালিবানি রাষ্ট্র হতে চলেছে। চিলমারী বন্দর লাগোয়া জেলেপাড়ার এক নিভন্ত দুপুরে এক বৃদ্ধা সখেদে বলেছিলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের জল কমছে, চড়া পড়ছে। ফলে আগামী দিনে আমাদের বাসা বদলাতে হবে। সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটায় সন্ধের বাজার বসেছে। চায়ের দোকান জমজমাট। হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বসে আড্ডা মারছে।

কত কাল ধরে এই আড্ডা চলেই যাচ্ছে। আরও যাবে। শুধু প্রজন্ম বদলে যাবে। গরমের দুপুরে বরিশালের আটঘরকুড়িয়ানায় বৈশাখী মেলার ঝলমলে মুখগূলো চোখের সামনে থেকে থেকে ভেসে ওঠে। যশোরের ছিয়ানব্বই গ্রামে আজও সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের নিশ্চিন্ত যাপন। খুলনার বহু পাড়ায় বা কুষ্টিয়া সদরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর হরেক উৎসব। শ্রীমঙ্গলের বিস্তৃত এলাকায় কীর্তন শুনেছি বহু রাত পর্যন্ত। আসলে জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশ নিশ্চিত কিছু সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। যেকোনও বিপ্লব বা সমাজ পরিবর্তনের পর কিছুটা অস্থিতিশীল অবস্থা যে তৈরি হয়, ইতিহাস তার সাক্ষী। এক্ষেত্রেও তেমনই। তার মানে কখনও এটা নয় যে দেশটা উগ্র মৌলবাদী হয়ে গেছে। মৌলবাদ কী, তা নিয়েও তো আলোচনা হতে পারে। ভারতের আরএসএস, বজরং দল, হিন্দু মহাসভা সম্পর্কেও নির্ধিদ্ধায় মৌলবাদী ট্যাগ লাগানো যায়। শেখ হাসিনা রেজিমের পতন আমার দেশের, বিশেষ করে পশ্চিবঙ্গের হিন্দু বাঙালীদের, বড় অংশকে হতাশ করেছে। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, হাসিনা ছিলেন হিন্দু জনগোষ্ঠীর ত্রাতা। অথচ হাসিনা ও তাঁর বাবার আওয়ামী লীগের হাতেই হিন্দু সম্পত্তি দখল হয়েছে সবথেকে বেশি। এ সম্পর্কে অজস্র প্রমাণ রয়েছে। পাকিস্তান সরকারের শত্রু সম্পত্তি আইন বলে যে হিন্দু জনগোষ্ঠীর পক্ষে মারাত্মক আইনটি কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান বাতিল করেন নি। নামটা পাল্টে তা বহাল রেখেছিলেন।

১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের পিছনেও ভূমিকা ছিল হিন্দু আপার কাষ্টের। এখনও কলকাতার বাবু ভদ্দরলোকদের কাছে বাংলাদেশ আদতেই তাদের হারিয়ে যাওয়া খাসতালুক। জুলাই অভ্যুত্থানে তারা যেন জমিদারি হারিয়ে পথের ভিখারি হয়ে গেছেন। ভারত বাংলাদেশ দ্বন্দ্বের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মানসিকতার। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকার পিছনেও একই কারন। কোনও কোনও প্রশ্নের মীমাংসা আজও হয়নি। তারমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ১৯৪৭ । দ্বিজাতিতত্ত্বের কারনেই বঙ্গভঙ্গ এটা আদৌ একমাত্র কারন বোধহয় নয়। জমির প্রশ্ন পাকিস্তান জন্মের অন্যতম কারন। বর্ণহিন্দু আধিপত্যবাদী মানসিকতা আজও আমাদের বাবু ভদ্দরলোকদের অস্থিমজ্জায়।

এই যে জুলাই পরবর্তী আহাজারি তার পেছনেও আছে একধরনের ঔপনিবেশিক মানসিকতা। শেখ হাসিনা ছিলেন বাবু ভদ্দরলোকদের পছন্দের। তাদের ইচ্ছেমতো সব শর্ত তিনি মেনে চলতেন। ফলে আজ তাঁর বিদায়ে ভেঙ্গে পড়েছেন আপামর ভদ্দরলোক। হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়না এটা কখনো বলিনি। বলব না। কিন্তু যেভাবে তিলকে তাল করা হয় তা আপত্তিকর। ঠিক এই গুজব ছড়ানো হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ এর সময়ে। ভদ্দরলোক বাঙ্গালীর দ্বিচারিতা অসহ্য লাগে, যখন দেখি, শেখ মুজিবুর রহমান তাদের চোখে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক, অথচ তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী সাহেব এ বঙ্গে খলনায়ক। পশ্চিমবঙ্গে বসে বাংলাদেশের যে ছবি নির্মাণ করা হচ্ছে তা শুধু মিথ্যে নয়, ক্রিমিনাল অফেন্স। আর করছে কারা! যারা প্রতিনিয়ত নিজের দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চালায়।

বাংলাদেশের অজস্র গ্রাম জনপদে আমি ঘুরে বেড়াই। মালো পাড়া, জেলে বসতি, তাঁতীদের মহল্লা। তাদের সংখ্যালঘু হিসেবে একধরনের উদ্বেগ নিশ্চিত সবসময় কাজ করে মনের ভেতরে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ওদেশে সবসময় তাদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। একটা দেশকে চিনতে গেলে তাকে বুঝতে হয়। যেটা কখনো সাধারনভাবে আমরা করিনা। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নেই বলব না। কিন্তু তুলনামূলকভাবে তা অনেক কম। ভারতে ইদানীং যেভাবে রোজ ঘুম থেকে উঠলেই শুনতে পাই, অমুক মসজিদের নীচে মন্দির পাওয়া গেছে। তা ও দেশে হয়না। এটা এক অদ্ভুত প্রহসন। সন্দেহ করে কেউ মামলা করলেন, সঙ্গে সঙ্গে কোর্ট পুরাতাত্ত্বিক বিভাগকে খননের আদেশ দিলেন। এবং পরবর্তীতে অবশ্যম্ভাবী সেখানে মন্দির আবিষ্কার। এই যে কোর্ট প্রশাসন, সরকারি বিভাগ, মিডিয়া — সন্মিলিত উদ্যোগে মুসলিম জনগোষ্ঠিকে কোনঠাসা করা, তা এখনও বাংলাদেশে দেখিনি। এখনও বাংলাদেশে যেটুক যা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে তার পিছনে সরাসরি সরকারের কোথাও কোন যোগ আছে বলে কেউ, এমনকি কট্টর হিন্দু কোনও সংগঠন অবধি অভিযোগ করেনি। ইস্কন নিছক সেবামূলক সংস্থা না উগ্র ধর্মীয় সংগঠন সে তর্কে আপাতত যাবনা। কিন্তু জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশে যা যা ঘটেছে, বিশেষ করে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে যেভাবে শোরগোল তোলা হচ্ছে তার সঙ্গে কখনো ইস্কন বাদে অন্যান্য হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনগুলো গলা মেলাননি। আশ্চর্যজনকভাবে রামকৃষ্ণ মিশনের মতো আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সংগঠন পর্যন্ত চুপচাপ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে রাজনৈতিক কোনও খেলা হলেও অবাক হব না। আসলে ভারতের বিদেশনীতির প্রবক্তারা একতরফাভাবে আওয়ামী লীগ অনুসারী হলে তা দুদেশের জনসাধারণের পক্ষেই বিপদজ্জনক। দুদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত না হলে, যুদ্ধংদেহী মনোভাব আখেরে দুদেশের পক্ষেই ক্ষতিকর।

কয়েকদিন যাবত অবশ্য অবস্থা সামান্য হলেও বদলাচ্ছে মনে হয়। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় একটু হলেও বরফ গলার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। পিপলস ইনিশিয়েটিভের কথাও উঠছে এখানে সেখানে। ফলে আশা করতে দোষ নেই, আগামী দিনে জমাটবাঁধা এই অন্ধকার কেটে যাবে। তবে তা চিরস্থায়ী হবে না। হতে গেলে খোলা মনে একাধিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে। অপ্রিয় ইতিহাস না এড়িয়ে তাকে নতুনভাবে সামনে আনতে হবে। নতুন উন্নয়নের মডেল, নয়া অর্থনীতি, ভারত বাংলাদেশের নতুন সমীকরণ না ঘটলে দক্ষিণ এশিয়ার পক্ষেও খারাপ।

পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। লেখক, তথ্যচিত্র নির্মাতা।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top