।। অতনু সিংহ ।।
সবটুকুতেই বিদায় নিয়ে উপনিবেশ সড়ক থেকে
হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে, তৃণভূমে
যাবে নাকি— হ্রেষার শেষে নীরবতা
যেখানে খুব হাসনুহানা, করবী ফুল…
মধুমতীর পাশেই নাকি আসন তোমার
মাটির ভিতর, শিকড় পাতা!
আসা যাওয়ার মাঝে তারে বেঁধেছিলেম গানে
যারা থেকে গেছে ভিতরে ভিতরে
তবু সরে গেছে দূরগামী ট্রেনে
লাল পদ্মপায়ে কোনো এক অশ্রুগোধূলি জুড়ে,
দূর উঠানেতে গাছের আড়ালে
বাজিয়াছে নূপুর কাহার
যারা চলে গেছে মেঘ পার করে
তবু থেকে গেছে, অবয়ব ধুয়ে ফেলে,
ভিতর পুকুরপাড়ে নিশিডাক কুয়াশায়
অনন্ত ঝিঁঝির রাতে যেন
বৃষ্টি ঝরিতেছে হেমন্তে আমার
তাহাদের ছায়ালিপি ভেসে আসে আধোজাগরণে
সব ঘড়ি গলে যায়, তবুও তো
মধুরিমা-খেলাঘর ভিজে যায় গানে
তারা থাকে সুরের মধ্যিখানে, চলে যায় তারা
প্রদেশের ট্রেনে,
ভেসে ভেসে মেঘের বিমানে
উত্তরপুরুষ
কশুর ভাষার দেশে আলো হয়।
বর্গীদের ঠেকিয়ে দিয়েছে রক্তফুলেরা,
তাদের প্রেমের দিনে ওযু হয় আমাদের শ্বাস,
সারাদিনমান তির বাঁধি
রাবাব, নৌকাবাড়ি,
আপেল ফুলের দেশে সাঁঝ
যেন আমাদের পাড়ার নোলক মেয়েটি
আজন্ম সংগ্রাম করে তৃণভূমি পেয়ে যাবে
আমার সন্তান।
বর্ণনাতীত
এখানে আসন পেতে বসেছি
গাছের পাতা থেকে
তুলে নিয়েছি ধ্বনি
বর্ণমালা বইছে দ্যাখো
এখানে কালো নেমে এলে
ভালোবাসছি
মুছে দিচ্ছি ঘিরে ধরা কালিমা
ক্ষতের ওপরে যাতে ঝরে পড়ে গান,
দু’দণ্ড সেবা
খুঁজে আনছি বনের ভেতর থেকে
লিখে রাখছি তোমাকে
হে ভাষামুখ প্রিয়তমা…
হ্যালো ডিয়ারেস্ট লুজার
আবার তুমি পিছল খেলে
ঝুলবারান্দার অদূরে যেই উপনিবেশ
চিহ্নগুলি সাজায়ে রেখে
আরাম করে খাড়ায়ে আছে
তার থেকে ঠিক একটু দূরে
ব্যস্ত একটা অফিস পাড়ায়
হোঁচট খেলে ভীষণ জোরে
কোথায় গেলে ডিয়ার লুজার
কলোনিয়াল প্রহর শেষে
বাহ্য তোমার মোসাহেবি,
কায়েতপনা থেকে এবার,
বাহির হয়ে নৌবহরে,
মগ্ন হতে সন্ধেবেলায়, স্কন্ধে নিয়ে লোটাচাদর,
একটি খাতা, মাউথঅর্গ্যান— ব্যাগের ভিতর
যত্নে রেখে, এক কবুতর দুই কবুতর
শার্সি দিয়ে ঝুঁকে পড়া
রোদের বাহার, আলমারিটি,
বইপত্তর, আদর বেড়াল…
সবটুকুতেই বিদায় নিয়ে উপনিবেশ সড়ক থেকে
হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে, তৃণভূমে
যাবে নাকি— হ্রেষার শেষে নীরবতা
যেখানে খুব হাসনুহানা, করবী ফুল…
মধুমতীর পাশেই নাকি আসন তোমার
মাটির ভিতর, শিকড় পাতা!
কিংবা তুমি স্থলপদ্ম থেকেই এবার
ঝরে গেলে, আছাড় খেলে দুপুরবেলায়
উপনিবেশ থেকেই তুমি
আবার তুমি গড়িয়ে গেলে,
কালের জলে ভাগীরথে
ঘুমের ভিতর ভেসে ভেসে
কোথায় যাচ্ছ পিছলকুমার
এই ঘাটেতে আইসো না আর, এই প্রদেশে
আইসো না আর, উপনিবেশ লজ্জা পাবে!
কোনো এক দোলপূর্ণিমায়
তারপর স্ক্রিনে এই অকালের ধারাপাত,
যখন আলো ধরার আলাপ বুনে বুনে একটি
আবছা বুনোটে তুমি ঘুমিয়ে গিয়েছ
আর বেসিনে অনর্গল বয়ে যাওয়ার শব্দ
পাশের বাসার উঠোনে এই সবুজ ভোরেও কেন
পাতা ঝরে যায়, এক-দুই-তিন পাতা ঝরে যায়
যেভাবে আলাপের মাঝখানে অচেনা
অর্গ্যান বেজে ওঠে হঠাৎ, আর পর্দায়
ভেসে ওঠে দোল!
ভাসে কি না জানা নাই, হয়তো ভাসার কথা ছিল—
একটি ফাগুন মেখে হ্যাভলকে
চাঁদের চতুর্পাশ থেকে হয়তো বা ঝরে যেত
অজস্র তারার ঝোড়ো আলাপ…
আর জঙ্গলে জঙ্গলে ম্যাজিক হ্যাটের নাচ,
আদিগন্তে গাছ, গাছেদের হুইসেল
চমকে ওঠার বদলে তুমি কামড়ে খেতে আঠালো
জাদুর অদ্ভূত ফল, জাহাজেরা ফিরে যেত
তাহাদের নিজস্ব সভ্যতায়!
অথচ দ্যাখো গল্পের পরিণতি হয় না কখনও
অপরিণামের ঘড়ি পরিণাম হয়
রঙের পর্দা ছাপিয়ে ভোর
অন্ধকার মায়া হয়ে আসে,
বেড়াল ঝিমিয়ে পড়ে লেখার খাতায়!
আমাদের সকল কল্কা, অবাক বুনোট
ভোরবেলা সকলেই ঘুমিয়ে পড়ে
প্রার্থনা ভেসে যায়, অকালের পাতা ঝরে
জল পড়ে পাতা নড়ে গল্প ফুরায়!
অতনু সিংহ
কবি, গদ্যকার। ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। ১৯৮২ সালে জন্ম। বসবাস পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। প্রকাশিত পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ ও একটি ছোটগল্প সংকলন রয়েছে।