আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

পুরীর মন্দির ও শ্রীচৈতন্যের হত্যা রহস্য

।। অতনু সিংহ ।।

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ বইটি শ্রীচৈতন্যের হত্যা রহস্যের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ। যদিও এই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশটি প্রকাশ পাওয়ার আগেই খুন হতে হয় জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে। চৈতন্যকে হত্যা করা হয়েছিল পুরীর মন্দিরে। সেই হত্যা রহস্য উন্মোচনে ফের পুরীতেই খুন হতে হয় জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে।

পুরীর মন্দির ও শ্রীচৈতন্যের হত্যা রহস্য

জগন্নাথ হিন্দু দেবতা নয়। শবর দেবতা। শবররা হিন্দু নয়। হিন্দু নামক পরিচয় ঔপনিবেশিক আমলের। বৈদিকতার আধারে অবৈদিক নানা সনাতনী ধর্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক স্কুলকে একত্রে নিয়ে এসে হিন্দু পরিচয়ের উদ্ভব। অর্থাৎ হিন্দু ধারণার মধ্যে বৈদিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং কর্তৃত্বের জায়গা নিয়ে আছে। শবররা চুড়ান্ত অবৈদিক। আবার পুরীর মন্দিরটিও কোনো বৈদিক বা হিন্দু মন্দির নয় আদতেই। এটি ছিল মূলত বৌদ্ধ মঠ। শবরদের পৃথক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বৈদিক আগ্রাসনে গ্রাস করে বৈদান্তিক বর্ণাশ্রমের আওতায় নিয়ে আসার যে প্রক্রিয়া, বৌদ্ধ মঠ দখল করার বিষয়টিও সেই প্রক্রিয়াই অংশ। বৌদ্ধ গণহত্যার পরম্পরাতেই শঙ্করবাদী বা শঙ্করাচার্যের ফলোয়ারদের হাতেই পুরীতে অধিষ্ঠিত বৌদ্ধমঠটিকে দখল করে বৈদান্তিক মন্দিরে রূপান্তর করা হয়। হ্যাঁ পুরীর মন্দিরটি বৌদ্ধ মঠ এবং মন্দিরের প্রধান দেবতা জগন্নাথ আসল শবর জনজাতির নীল মাধব।

জগন্নাথ মন্দির একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। এটিকে এবং অন্যান্য বৌদ্ধ মন্দিরকে হিন্দু মন্দির করিয়া লইয়াছি। এইরূপ ব্যাপার আমাদিগকে অনেক করিতে হইবে।

স্বামী বিবেকানন্দ(স্বামী বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা- পঞ্চম খণ্ড, ‘ভারতের মহাপুরুষগণ (১৪৮ পৃষ্ঠা) উদ্বোধন প্রকাশনা, বেলুড়মঠ -১৩৬৯ বঙ্গাব্দ বা ১৯৬২-৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত-)

পুরীর মন্দিরের সাধারণ যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তার মধ্যেকার পৌরাণিক উপাদানগুলির আলো-আঁধারি কাটিয়ে যদি ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমের দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে নীলাঞ্চল পর্বতের গুহায় নীল মাধবের যে মূর্তির উপাসনা করত শবর জনজাতি, সেই শবরদের আধ্যাত্মিক পুরুষ বিশ্ব বসুর কাছ থেকে নীল মাধবের মূর্তিটি চুরি করেন ইন্দ্র যুগ্ম নামক এক রাজার অনুগত ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি। রাজা যেহেতু চুরির বরাত দিয়েছেন, সেই চুরির বরাতকে সফল করার উদ্দেশ্যে ‘নীচু জাত’-এর শবর সাধু বিশ্ব বসুর কন্যাকে বিবাহও করেন বৈদিক ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি। পুরীর মন্দিরের ইতিহাসে এই চুরির ঘটনা স্বীকার করতে গিয়েও এক আধিভৌতিক পৌরাণিক আখ্যানকে ইতিহাসের ফ্যাক্টের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, মূর্তি চুরির ঘটনায় বিশ্ব বসু অত্যন্ত মনোকষ্ট পেলে ভগবান নীল মাধব বা বিষ্ণু ইন্দ্র যুগ্মকে স্বপ্নাদেশে মূর্তিটি ফিরিয়ে দিতে বলেন। রাজা তা ফিরিয়ে দেন। এবং ভগবানের ইচ্ছাতেই ব্রাজার জন্য অনুরূপ একটি মূর্তি ‘পুরীর মন্দির’-এর গর্ভগৃহে নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করেন দেবতা বিশ্বকর্মা। তাঁর শর্ত ছিল, মূর্তিটি যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে ততক্ষণ কেউ যেন ভুলেও গর্ভগৃহে প্রবেশ না করেন। কিন্তু রাজার পত্নী অধৈর্য্য হয়ে মূর্তি তৈরির কাজ দেখতে গর্ভগৃহে প্রবেশ করায়, বিশ্বকর্মা কাজ অর্দ্ধেক বাকি থাকতেই মন্দির পরিত্যাগ করেন। তাই জগন্নাথ ও ভাই-বোনের মূর্তি হস্ত-পদবিহীন। তো পৌরাণিক এই কাহিনীর আবরণে বৈদিকান্তিকদের দ্বারা শবরদের কাঠের নীল মাধব মূর্তিটি চুরি করা এবং বৈদন্তানিক সংস্কৃতির সমান্তরালে যুগ-যুগ ধরে বিকাশমান শবর জনজাতিকে বর্ণাশ্রম প্রথার মধ্যে নিয়ে আসার রাজনীতিকে আড়াল করার চেষ্টা চালানো হলেও সেই চেষ্টা আজ ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষত শ্রীচৈতন্য হত্যারহস্য নিয়ে কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই পুরীর মন্দির ও দারুব্রহ্ম জগন্নাথ মূর্তির ব্যাপারে নানা তথ্য সামনে চলে আসে।

শ্রীচৈতন্য, নিত্যানন্দ, অদ্বৈতাচার্য- নদীয়ার এই তিন পাগল বঙ্গের সুলতানি আমলে যে ভাবান্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই আন্দোলন ছিল জাত-পাত, গোত্রবাদ, বর্ণবাদ, লৈঙ্গিক বিভাজন ও বিত্তবাদী বৈষম্যের বিরোধী। তাছাড়া শঙ্করাচার্যের ভুয়া মায়াবাদ যা আসলে বিভ্রমবাদ, সেই অদ্বৈতবাদী মায়াদর্শনকে অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্বে খণ্ডন করেন শ্রীচৈতন্য। দেব-পুরাণ, শাস্ত্র-কিতাবকে পুরুষ-প্রকৃতির যুগল অভিন্নতার প্রেমে ও ভক্তিরসে খারিজ করে দেন নদীয়ার প্রথম ফকির নিমাইচাঁদ। কিন্তু সুলতানি শাসকের মন্ত্রীসভায় যে গোস্বামী ব্রাহ্মণ ভাইয়েরা ছিল, তাঁরা চৈতন্যকে সুকৌশলে বঙ্গ থেকে সরিয়ে উৎকল দেশে বা আজকের উড়িষ্যায় নিয়ে যান। যদিও উৎকল দেশে গিয়েও নিমাই সেখানেও তাঁর বিপ্লব চালিয়ে যান। পুরীর মন্দিরকে কেন্দ্র করে বৈদান্তিকদের বাণিজ্য ও বর্ণাশ্রম প্রথার দ্বারা সমাজের প্রান্তজনেদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদের যে আস্ফালন তার বিরুদ্ধে স্বভাবতই রুখে দাঁড়ান ভাববিপ্লবী শ্রীচৈতন্য। একটা সময় পুরীর রাজা চৈতন্যের ভাব আন্দোলনে নিজেকে সারেন্ডার করেন। তিনিও সাম্রাজ্য-সম্পদ বিলাতে শুরু করেছিলেন। ফলে বৈদিক পান্ডারা আর রাজার তোষামোদকারীরা বুঝতে পেরেছিলেন, রাজা নিজেই যদি চৈতন্যের প্রভাবে রাজতন্ত্র ভেঙে ফেলেন, তাহলে রাজতন্ত্রের প্রভাবে যারা করে কম্মে খাচ্ছেন, তাদের অবস্থা শোচনীয় হবে। তাই শেষমেশ মন্দিরের ভিতর চৈতন্যকে ঢুকিয়ে খুন করা হয়। প্রচার করা হয়, চৈতন্য জগন্নাথে বিলীন হয়েছেন। আবার কেউ কেউ প্রচার করতে শুরু করেন, চৈতন্য সমুদ্রে মিশে গ্যাছেন কৃষ্ণের সাক্ষাৎ পেয়ে। বেশ কয়েক বছর আগেও এইসব নিয়ে যারা লেখালিখি করছিলেন, তাঁদের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। অথবা নিরুদ্দেশ হয়ে যান কেউ কেউ।

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ বইটি শ্রীচৈতন্যের হত্যা রহস্যের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ। যদিও এই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশটি প্রকাশ পাওয়ার আগেই খুন হতে হয় জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে। চৈতন্যকে হত্যা করা হয়েছিল পুরীর মন্দিরে। সেই হত্যা রহস্য উন্মোচনে ফের পুরীতেই খুন হতে হয় জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে।

পুরীতে রথ উপলক্ষ্যে যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস, রথযাত্রার এই ভক্তিবাদী প্লাবন সব দিক থেকেই নদীয়ার তিন পাগল নিমাই-নিতাই আর অদ্বৈতার্যের ভক্তি আন্দোলন থেকে উৎসারিত। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্রীচৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য নামকীর্তনে কার্নিভাল শূদ্র-যবনের যে প্রতিস্পর্ধি কার্নিভাল পলিটিক্সের সূচনা করেছিলেন, সেই স্পিরিট রথযাত্রার অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ- এই উভয় ক্ষেত্রেই প্রবাহমান। কিন্তু, পুরীর মন্দির কর্তৃপক্ষ, শঙ্করাচার্যীয় পরম্পরা পুরীকে ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরোহিততন্ত্রের আখড়ায় পর্যবসিত করেছে। পুরীর মন্দিরে কোনো মুসলমানের প্রবেশাধিকার নেই সেই চৈতন্যের সময় থেকেই। চৈতন্যের সহযোগী/ শিষ্য যবন হরিদাসকেও মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় নাই। তাই তো শ্রীচৈতন্য বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন এই পুরীর মন্দিরের ব্রাহ্মণ্যবাদী হেজিমনির বিরুদ্ধে। যে কারণে তাঁকে খুন হতে হয়। কিন্তু সেই ইতিহাসও চেপে রাখা হয়েছে। ইতিহাস উন্মোচনের চেষ্টা করলেই জয়দীপ বা আরও কয়েকজনের জীবনের মতো নিষ্ঠুর অন্তিম পরিণাম নেমে আসতে পারে। ব্রাহ্মণ্যবাদ আজও রণ-রক্ত চক্ষু মেলে খাড়ায়ে আছে কল্পিত হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি ‘নেশন’ (?) জুড়ে। কবে মোকাবিলা করা হবে এই খুনীদের? কবে একত্রে সোচ্চার হবে শবর, যবন ও শূদ্রেরা?

তনু সিংহ

কবি, গদ্যকার। ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। ১৯৮২ সালে জন্ম। বসবাস পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। প্রকাশিত চারটি কাব্যগ্রন্থ ও একটি ছোটগল্প সংকলন রয়েছে।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top