আজ বৃহস্পতিবার, ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

চৈত্রসংক্রান্তি ও চৌদ্দ রকমের শাক

।। ফরিদা আখতার ।।

“চৈত্র সংক্রান্তিতে চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। আধুনিক নারীবাদ যখন নারীকে বুর্জোয়া ব্যক্তি অধিকার আদায়ের এজেন্সিতে পর্যবসিত করে বাংলার নারীর সংকল্প তার বিপরীত। ব্যক্তি শুধু নয়, ব্যক্তির বিকাশ দরকার। কিন্তু নারী মানুষকেন্দ্রিক – অর্থাৎ পুরুষালি হানাদার জীবনব্যবস্থাকে পালটা চ্যালেঞ্জ করে। দুনিয়া শুধু মানুষের জন্য সৃষ্টি হয় নি। মানুষের হানাদারির কারণে প্রকৃতির বিনাশ ঘটানোকে সভ্যতা বলে না। বিশ্ব নিখিল সকল প্রাণের বিকাশের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে যে কৃষি ব্যবস্থায় অনাবাদী জাত বা প্রজাতির ধ্বংস হয় তার বিরোধিতা করবার সংস্কৃতি হিশাবে চৌদ্দ রকম অনাবাদী শাক খাওয়ার রীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করবার জন্যই এই রীতি গড়ে উঠেছে। চৌদ্দ রকম অনাবাদী শাক কুড়ানো নারীর মধ্য দিয়ে আমরা নতুন নারীমূলক কর্তাসত্তা আবিষ্কার করি। যার মধ্যে দিয়ে স্বয়ং প্রকৃতির উদ্বোধন ঘটছে। এহেন সংস্কৃতিতে নারী মানে যারা চৌদ্দ রকম অনাবাদী শাক চেনে এবং চৌদ্দ সংক্রান্তিতে সেই শাক তুলতে ও রান্না করতে জানে। একই সঙ্গে অনাবাদী ক্ষেত্রের হালহকিকত— অর্থাৎ প্রকৃতির অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা নির্ণয় করতে যারা সক্ষম। এই জ্ঞানচর্চা এবং নারীমূলক কর্তার উদ্বোধন নারী থেকে নারীতে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। মা থেকে মেয়ে, বোন থেকে বোন, পাড়া-প্রতিবেশীরা জন্ম পরম্পরায় পুরুষতান্ত্রিক হানাদারি জীবন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিঃশব্দে লড়তে শেখে।”

চৈত্রের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তি বা মহাবিষুব সংক্রান্তি। এই দিন অতিক্রান্ত হলে ১৪২৮ বাংলা বছর পার হয়ে বৈশাখের পয়লা তারিখে নতুন বছর ১৪২৯ আসবে। সকলকে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের শুভেচ্ছা।

চৈত্রসংক্রান্তি পালনের বিষয়টি বছর শেষ ঘোষণার জন্য নয়, কিম্বা পরদিন নতুন বছর শুরু হচ্ছে বলে ‘নববর্ষের’ প্রস্তুতিও নয়। গ্রামের কৃষক পরিবারগুলোতে দিনটি তার বিশেষ তাৎপর্যের জন্যই পালন করা হয়। গ্রামে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি মানুষের শরীর ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্বন্ধ রচনার একটা বোধ চৈত্রসংক্রান্তি পালনের পেছনে কাজ করে। মানুষের শরীর ও প্রকৃতির মধ্যে সম্বন্ধ রচনার চর্চা এই নদীমাতৃক সবুজ বদ্বীপে বহু দীর্ঘকাল ব্যাপী জারি রয়েছে, শহরের অনেক মানুষ সেটা জানেন না। আধুনিকতার প্রতি অতি আকর্ষণে গ্রামীন চর্চার সারার্থ আড়াল হয়ে থাকে। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির প্রাণবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত সম্বন্ধ রচনার চর্চা বাংলার কৃষক, বিশেষ করে নারী, হাজার বছর ধরে করে আসছেন। আমাদের দেহ বা জীবাবস্থার সঙ্গে গ্রহনক্ষেত্র, গাছপালা, জীবঅণুজীবসহ সকল প্রাণ এবং অপ্রাণের সম্বন্ধ রয়েছে। চৈত্রের মহাবিষুব সংক্রান্তি পালনের পেছনে যে জ্ঞানকলা, বিজ্ঞানবুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি – বিশেষত কৃষিকাজের মধ্য দিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির পুনরুৎপাদন ও বিকাশের অতি আবশ্যিক কর্তব্য পালনের রীতি – কোনো অবস্থাতেই আমরা যেন তা ভুলে না যাই।

বাংলায় সময়ের ধারণার নিজস্ব তাৎপর্য রয়েছে। যার সঙ্গে ঘড়িতে টিকটিক করে সময় চলে যাওয়া বা শেষ হয়ে যাওয়া যেমন বোঝায় না, তেমনই সময় সরল রেখার মতো অনন্ত থেকে এসে আবার অনন্তের দিকে চলে যায় না। আমাদের ভাষার মধ্যে এই ধারণা নিহিত রয়েছে। যাকে আমরা ‘ঋতু’ বলি। ঋতুর যে ভাব বা ধারণা কৃষি সংস্কৃতিতে প্রবল সেখানে সময় কখনই শেষ হয়ে যায় না, কিংবা আবার নতুন শুরুও হয় না, একই ঋতু বারবার ফিরে আসে। চিত্রা নক্ষত্রের রাশি চক্র অতিক্রম করে যাবার সময়টা চৈত্রের সংক্রান্তি, কিন্তু নভোমণ্ডলে নিজের কক্ষ পরিভ্রমণ শেষে সেই একই চিত্রা ফিরে আসবে আবার আগামী চৈত্রে। নতুন নক্ষত্র নয়, পুরানা নক্ষত্রই ফিরবে। চক্রাবর্তে প্রত্যাবর্তনের এই ধারণা সংক্রান্তিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংক্রান্তিতে তাই মানুষের সম্বন্ধ গ্রহ নক্ষত্রের সঙ্গে সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই তারই উদযাপন। মানুষ মূলত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গেই যুক্ত। সেই সম্বন্ধের অক্ষপথ বৃত্ত। সরলরেখা নয়। বিপরীতে আধুনিক ও কলোনিয়াল সময়ে নতুন বছরের ধারণা ঘড়ি ও ক্যালেন্ডার থেকে উৎপন্ন হয়েছের। আমরা ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে গ্রহ নক্ষত্রের কথা ভুলে গিয়েছি। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাতে তাকে ভুলে গিয়েছি সময় ছাপাখানার অক্ষরের মতো স্থির কিছু না। চাঁদ-সুর্য দেখে দিন-রাত বোঝার চর্চাও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সময় বলতে আমরা সরলরেখা বুঝি, বৃত্ত কিংবা প্রত্যাবর্তনের ধারণা আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে প্রকৃতি ও গ্রহ নক্ষত্রের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ ঝালিয়ে নেবার দিন। আমরা জীব হিসাবে বিশ্বপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নই এটা উপলব্ধি করা, জানা এবং সেই উপলব্ধিকে চরিতার্থ করবার জন্যই নানান আচার, উৎসব ও উদযাপন কৃষি সভ্যতার মধ্যে গড়ে উঠেছে । খাদ্য ব্যবস্থা তার অন্যতম দিক। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে বিশেষ বিশেষ খাবার পরিকল্পিত ভাবে খাওয়া নিয়ম। এই দিন প্রাণীজ আমিষ নিষিদ্ধ।

তাছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চর্চা রয়েছে: আবাদি ফসল আমরা তো সারা বছরই খাই, চৈত্রসংক্রান্তিতে তাই অনাবাদি শাকশব্জি খাওয়াই রীতি; অর্থাৎ চাষের শাকশব্জি না, বরং কুড়িয়ে এনে চৌদ্দ রকমের শাক এবং চৈতালি মৌসুমের সবজি, পাতা, মুড়া ইত্যাদি খেয়ে চৈত্র সংক্রান্তি পালন করতে হয়। যারা প্রাচীন কৃষকদের নিয়ে কাজ করেন তাদের চোখে এই দিকটা খুব সহজেই চোখে পড়ে। গ্রামের কৃষকের স্মৃতি ও জ্ঞানচর্চার দিবস হিশেবে সবারই প্রায় অলক্ষ্যে দিনটি পালিত হয়ে যায়। চৈত্রসংক্রান্তির মহিমা এখানেই। এখনও গ্রামের মানুষ তার জ্ঞান অনুযায়ী যা পাবার কথা ছিল তা খুঁজে না পেলে আফসোস করেন। আমাদের বাপ-দাদার সময়ে যা দেখেছি, কিংবা মায়েরা যে সব শাক শব্জি দিয়ে চৈত্রসংক্রান্তি করতেন, তা এখন নাই। রাস্তাঘাট হয়েছে, বড় বড় দালান কোঠা হয়েছে, তাই অনাবাদী শাক শব্জি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব আছে কি নেই সেটা জেনে আমাদের প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে কিভাবে সতর্ক হতে হবে সেটা নির্ধারণের জন্য হলেও চৈত্রসংক্রান্তি পালন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলার কৃষক নারী চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘরের পাশে আলান পালান মাঠের আনাচে কানাচে শাক কুড়াতে বেরোয়। নিয়ম আছে তাকে চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হবে। আবাদি নয় কিন্তু, অনাবাদী; অর্থাৎ রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে, চকে আপনজালা শাক তুলতে হবে। অর্থাৎ যে শাক লতাপাতা কেউ আবাদ করেনি, আপনা থেকেই গজিয়েছে = নিজে থেকে হয়ে ওঠা শাক। এই মৌসুমে যা টিকে থাকে। এই শাক তোলার অধিকার কৃষক নারীর থাকে। তার দেখার বিষয় হচ্ছে যেই শাক তাঁরা খুঁজছেন সেই শাক গ্রামে আছে কিনা। ধনী পরিবারের নারীরা নিজে শাক তুলতে বের না হলেও তার আশে পাশে যারা গরীব নারী আছে্ন তাঁদের মাধ্যমে শাক তুলিয়ে আনেন। মনে রাখতে হবে বলা হয় ‘শাক তোলা’ শাক ‘কাটা’ নয়। কখনোই তারা পুরো গাছটি উপড়ে ফেলে শাক আনবেন না। অতি যত্ন করে পাতাটি তুলে আনবেন। গাছ যেমন আছে তেমনই থাকবে।

কৃষক নারী খবর নিতে চায় প্রকৃতির যে অংশ অনাবাদী – যে অংশ কৃষি সংস্কৃতির সংরক্ষণ করে রাখার কথা, নইলে প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ অসম্ভব -সেই অনাবাদী প্রকৃতি ঠিক আছে কিনা। যেসব গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণী ‘আবাদ’ করতে গিয়ে আবাদি জায়গায় কৃষক তাদের দমন করেছে, উঠতে দেয় নি, থাকতে দেয় নি, কিষাণি মেয়ে এই দিনে খবর নেয় তারা সব ঠিকঠাক আছে তো? তাই চৈত্রসংক্রান্তি আবাদি ও অনাবাদি ক্ষেত্র আমাদের পার্থক্য করতে শেখায়। কৃষি মানে শুধু আবাদি ক্ষেত্রের আবাদ নয়, বরং একই সঙ্গে অনাবাদি ক্ষেত্র সুরক্ষা করা। মানুষ যেন তার নিজের স্বার্থে অনাবাদী ক্ষেত্র নষ্ট না করে চৈত্রসংক্রান্তির চর্চা সেই জ্ঞান এবং আচারকে জীবন্ত রাখা।

চৈত্র সংক্রান্তিতে অনাবাদি শাক অন্বেষণ, তোলা, রান্না করা এবং খাওয়া এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। চৈত্রসংক্রান্তিতে চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। আধুনিক নারীবাদ যখন নারীকে বুর্জোয়া ব্যক্তি অধিকার আদায়ের এজেন্সিতে পর্যবসিত করে বাংলার নারীর সংকল্প তার বিপরীত। ব্যক্তি শুধু নয়, ব্যক্তির বিকাশ দরকার। কিন্তু নারী মানুষকেন্দ্রিক – অর্থাৎ পুরুষালি হানাদার জীবনব্যবস্থাকে পালটা চ্যালেঞ্জ করে। দুনিয়া শুধু মানুষের জন্য সৃষ্টি হয় নি। মানুষের হানাদারির কারণে প্রকৃতির বিনাশ ঘটানোকে সভ্যতা বলে না। বিশ্ব নিখিল সকল প্রাণের বিকাশের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে যে কৃষি ব্যবস্থায় অনাবাদী জাত বা প্রজাতির ধ্বংস হয় তার বিরোধিতা করবার সংস্কৃতি হিশাবে চৌদ্দ রকম অনাবাদী শাক খাওয়ার রীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করবার জন্যই এই রীতি গড়ে উঠেছে। চৌদ্দ রকম অনাবাদী শাক কুড়ানো নারীর মধ্য দিয়ে আমরা নতুন নারীমূলক কর্তাসত্তা আবিষ্কার করি। যার মধ্যে দিয়ে স্বয়ং প্রকৃতির উদ্বোধন ঘটছে। এহেন সংস্কৃতিতে নারী মানে যারা চৌদ্দ রকম অনাবাদী শাক চেনে এবং চৌদ্দ সংক্রান্তিতে সেই শাক তুলতে ও রান্না করতে জানে। একই সঙ্গে অনাবাদী ক্ষেত্রের হালহকিকত— অর্থাৎ প্রকৃতির অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা নির্ণয় করতে যারা সক্ষম। এই জ্ঞানচর্চা এবং নারীমূলক কর্তার উদ্বোধন নারী থেকে নারীতে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। মা থেকে মেয়ে, বোন থেকে বোন, পাড়া-প্রতিবেশীরা জন্ম পরম্পরায় শেখে।

বাংলায় সময়ের ধারণার নিজস্ব তাৎপর্য রয়েছে। যার সঙ্গে ঘড়িতে টিকটিক করে সময় চলে যাওয়া বা শেষ হয়ে যাওয়া যেমন বোঝায় না, তেমনই সময় সরল রেখার মতো অনন্ত থেকে এসে আবার অনন্তের দিকে চলে যায় না। আমাদের ভাষার মধ্যে এই ধারণা নিহিত রয়েছে। যাকে আমরা ‘ঋতু’ বলি। ঋতুর যে ভাব বা ধারণা কৃষি সংস্কৃতিতে প্রবল সেখানে সময় কখনই শেষ হয়ে যায় না, কিংবা আবার নতুন শুরুও হয় না, একই ঋতু বারবার ফিরে আসে। চিত্রা নক্ষত্রের রাশি চক্র অতিক্রম করে যাবার সময়টা চৈত্রের সংক্রান্তি, কিন্তু নভোমণ্ডলে নিজের কক্ষ পরিভ্রমণ শেষে সেই একই চিত্রা ফিরে আসবে আবার আগামী চৈত্রে। নতুন নক্ষত্র নয়, পুরানা নক্ষত্রই ফিরবে। চক্রাবর্তে প্রত্যাবর্তনের এই ধারণা সংক্রান্তিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংক্রান্তিতে তাই মানুষের সম্বন্ধ গ্রহ নক্ষত্রের সঙ্গে সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই।

‘চৌদ্দ’ সংখ্যাটা প্রতীকী। আসলে বেশী পাওয়া গেলে আরও ভাল। তবে চৌদ্দ রকম শাক পাওয়াই এখন কঠিন হয়ে গেছে। চৈত্রসংক্রান্তিতে কৃষক মেয়েকে খবর নিতে হবে ‘পুরুষ’ সারাবছর যে ‘চাষ’ করল তাতে অনাবাদি জাতি বা প্রজাতির হাল হকিকতের কি দাঁড়াল? ‘চাষ’ করার অর্থ আবাদি ফসলের দিকে মনোযোগ দেওয়া, কিন্তু অনাবাদি ফসলের বিশাল ক্ষেত্র যেন তাতে নষ্ট বা কৃষি ব্যবস্থায় গৌণ না হয়ে পড়ে তার জন্যই চৌদ্দ রকম শাক তোলা ও খাওয়ার রীতি চালু হয়েছে।

চৌদ্দ রকমের অনাবাদী কুড়িয়ে আনা শাকের মধ্যে সাধারণত থাকে হেলেঞ্চা, নেটাপেটা শাক, কচুশাক, তেলাকুচা, থানকুনি, গিমা শাক, কলমিশাক, ঢেঁকি শাক, খেতাশাক, মোরগশাক, নুনিয়াশাক, ইত্যাদি। তার সাথে থাকতে পারে মিষ্টি কুমড়া পাতা, লাউ শাক, পাট শাক ইত্যাদি। কিছু ফসল যেমন মিষ্টি কুমড়া, লাউ, পাট ইত্যাদি আবাদ করা হয়। কিন্তু পাতা এই আবাদের প্রধান উদ্দেশ্য না। কিন্তু এক পর্যায়ে এর পাতা শাক হিশেবে খাওয়া হয় সেটাকেও গ্রামের নারীরা কুড়িয়া পাওয়া হিশেবেই গণ্য করেন। তবে আদর্শ হলো যত বেশী অনাবাদি শাক আশে পাশে আলানে পালানে পাওয়া যায় ততো বেশী তা ছহি বা আদরণীয় বলে গণ্য হয়। এই শাক যারা আবাদ করেন না, তাঁরাও যদি অন্যের বাড়ি থেকে তুলে আনেন এই দিনে সাধারণত কেউ আপত্তি করে না। সব শাক সব এলাকায় একইভাবে পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইলে এবার গিমা শাক খুব ভাল পাওয়া গেছে কিন্তু পাবনা এবং নাটোরে এবার গিমা শাকে দেখা নেই। এই অঞ্চলে গভীর নলকুপ ব্যবহার করে অতিরিক্ত খরা সৃষ্টি হয়েছে যার কারণে অনেক শাক দেখা যাচ্ছে না।

গ্রামের মেয়ে, বউ, নানী বা দাদী শাক তুলতে যান দল বেঁধে। চৈত্রসংক্রান্তিতে অনাবাদি শাক তুলতে যাওয়া নিয়ে টাঙ্গাইলে্র গ্রামে নারীদের গাওয়া একটি গান এরকম:

শাক তুলবার গেছিলাম
উবুত হইয়া পড়ছিলাম
দেখলি ছেরি ধরলি না
ফালদা উঠলাম ডুলিতে
ডুলি করে কটমট
নওশা মিয়ার কোনঘর
উচা-নিচা টিনের ঘর
হাত-পা ধুইবার খড়ম দেও
বদনা খানি পানি দেও
হাতে একটা রুমাল দেও।

এই গানের তালে তালে শাক তোলা হয়। তাদের ধারনা শাক তোলার সময় এ গুলো বললে অনেক শাক তুলা যায়। গ্রামের মেয়েরা অল্প বয়স থেকেই মায়ের সাথে গিয়ে শাক তুলতে শিখে যায়। আজকাল মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, কিন্তু তাহলেও শাক তোলার প্রয়োজন হলে তারা শাক তুলে দিয়ে তারপর স্কুলে যায়।

স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির প্রয়োজনেও গ্রামের নারীরা শাক তোলেন । শাকে ভিটামিন আছে এই কথা সবাই জানেন। এবং বিশেষ শাকের বিশেষ গুণ সম্পর্কেও তাঁরা ওয়াকিবহাল আছেন। যেমন গিমা শাক তিতা হলেও বাচ্চাদের খাওয়াতে হবে, এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। মুখে রুচি বাড়ে। মায়েরা বাচ্চাদের জন্যে একটু আলু-বেগুন মিশিয়ে রান্না করে খাওয়ান। বাচ্চারা খেতে না চাইলে নানা গল্প বলে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়াতে চেষ্টা করেন। থানকুনি খেলে গ্যাস হয় না, পেটের অসুখের জন্যে ভাল। তেলাকুচা পাতা ডায়াবেটিস নিরাময়ের জন্যে উপকারি।

চৌদ্দ রকমের অনাবাদী কুড়িয়ে আনা শাকের মধ্যে সাধারণত থাকে হেলেঞ্চা, নেটাপেটা শাক, কচুশাক, তেলাকুচা, থানকুনি, গিমা শাক, কলমিশাক, ঢেঁকি শাক, খেতাশাক, মোরগশাক, নুনিয়াশাক, ইত্যাদি। তার সাথে থাকতে পারে মিষ্টি কুমড়া পাতা, লাউ শাক, পাট শাক ইত্যাদি। কিছু ফসল যেমন মিষ্টি কুমড়া, লাউ, পাট ইত্যাদি আবাদ করা হয়। কিন্তু পাতা এই আবাদের প্রধান উদ্দেশ্য না। কিন্তু এক পর্যায়ে এর পাতা শাক হিশেবে খাওয়া হয় সেটাকেও গ্রামের নারীরা কুড়িয়া পাওয়া হিশেবেই গণ্য করেন। তবে আদর্শ হলো যত বেশী অনাবাদি শাক আশে পাশে আলানে পালানে পাওয়া যায় ততো বেশী তা ছহি বা আদরণীয় বলে গণ্য হয়।

এবারের চৈত্র সংক্রান্তির সময় রমজান মাস চলছে। মুসলিম পরিবারগুলোতে দিনের বেলা শাক রান্না হবে না। কিন্তু গ্রামের কৃষক নারীরা জানিয়েছেন তাঁরা ইফতার এবং সেহরীতে শাক রান্না করে অবশ্যই খাবেন।এটা পরিষ্কার গ্রামীণ জনগোষ্ঠির কাছে সাংস্কৃতিক ও ভাবগত তাৎপর্য ছাড়াও চৈত্রসংক্রান্তির সঙ্গে জীবন যাপনের সম্পর্ক অনেক গভীর। একটি বছর যখন পার হয়ে যায়, আবার বছর ঘুরে আরেকটি বছর ফিরে আসে, তখন সবকিছুই একই রকম থেকে যায় না। থাকার কথাও নয়। যেহেতু আমাদের গ্রামীণ পরিবেশ ও জীবের জীবন মূলত কৃষির সাথে যুক্ত, তাহলে কৃষির পরিবর্তনের সাথে আমাদের চাষাবাদে ও খাদ্যব্যবস্থায় কিছু না কিছু পরিবর্তন হবার কথা। তাই প্রকৃতির সঙ্গে সারা বছর কী আচরণ করলাম তার বিচারের দিন চৈত্রসংক্রান্তি। প্রতিবছর কৃষির অবস্থা এক থাকছে না। আবাদ করার অর্থ আমাদের প্রয়োজন ও চাহিদা মেটাবার জন্য প্রকৃতিতে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যা থাকবার কথা তার বদলে নিজেদের চাহিদা মেটাবার জন্য খাদ্য উৎপাদন। চৈত্র সংক্রান্তিকে তাই বলা যায় সারাবছরব্যাপী আবাদি ফসলের কারণে অনাবাদি প্রকৃতির ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনের দিন। সেই জন্যই চৈত্রসংক্রান্তিতে আলান পালান জঙ্গল মাঠ পতিত জমি থেকে লতা পাতা শাকশব্জি কুড়িয়ে খাবার বিধান। কোন জাত বা প্রজাতির অভাব ঘটলে কৃষক নারী বুঝতে পারে কৃষি চর্চায় একটা দোষ ঘটেছে যার সংশোধন দরকার। চৈত্রসংক্রান্তি কৃষির ভুল সংশোধনের দিন।

আমাদের দেশের কৃষি নীতিতে পরিবর্তন হচ্ছে, আসছে প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি। তাহলে চৈত্রসংক্রান্তিতে কৃষক যখন তার আলানে পালানে মাঠে ময়দানে কি আছে আর কি নাই তার হিসাব নিতে বেরোয় তখন অনাবাদি শাকের অভাব আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় খাদ্য উৎপাদন করার কথা বলে ক্ষতিকর প্রযুক্তি কিভাবে প্রকৃতি ধ্বংস করে। আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার ওপর কিভাবে বড় ধরনের আঘাত হানা দিচ্ছে!

চৈত্র সংক্রান্তি স্রেফ ঐতিহ্য বা আবগের বিষয় না — এইটুকু অন্তত কৃষক মেয়ের কাছ থেকে যেন আমরা শিখি। চৈত্রসংক্রান্তি আমাদের মনে করিয়ে দিক জীবন ব্যবস্থার চরিত্রের সঙ্গে প্রকৃতি সুরক্ষার প্রশ্ন জড়িত। বর্তমান কৃষি ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো যেন আমাদের চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ফরিদা আখতার

নারী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, সমাজকর্মী, লেখক ও চিন্তক। প্রাণ ও প্রকৃতির লড়াইয়ে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘Depopulating Bangladesh:Eassays on the Politics of Fertility(1996)’, ‘Seeds of Movement (2007)’, বিকৃত বীজ (২০০৯), ইত্যাদি।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top