।। তুহিন খান ।।
একদিন বিকালে, চুয়াডাঙ্গার সীমান্তবর্তী এক এলাকায়, বন্ধু শরিফের কবরটা দেখতে আমি গেছিলাম। ঘরের দাওয়ায় বসা শরিফের বাপ আমারে দেইখা নড়লেন না। শরিফের মা’রে কোথাও পাইলাম না। কেউ কিছুই বলল না। আমি একটা চেয়ার টাইনা সন্ধা পর্যন্ত বাড়ির উঠানে বইসা থাকলাম। এই বাড়িটায় প্রত্যেকটা জীবন এত বেশি স্থির, স্লো, মোশনলেস— আমি নিজের বাঁইচা থাকার ফিলটুকুও যেন পাইতেছিলাম না আর। মাগরেবের আজানের পরে হুঁশ ফিরল। শরিফের কবর কই, এইটা বন্ধু আশরাফুল আমারে জানাইল। গেলাম কবর দেখতে। শরিফের মা বইসা আছেন কবরের পাশে। চুলখোলা। মোশনলেস। ওই প্রথম আমি কোন বন্ধুর কবরের পাশে গিয়া দাঁড়াই। আমার বন্ধু শরিফ, যে কিনা সুইসাইড করে মারা গেছে, যার জানাজার নামাজ পড়তে ইতস্তত করতেছিল গ্রামের মানুষ, তারই কবরের পাশে দাঁড়াইছি আমি ঠিক মাগরেবের ওয়াক্তে, আমার গায়ে পাঞ্জাবি, আমার মাথায় শাদা টুপি, আমার পায়ে চামড়ার জুতা, আমার পকেটে মোবাইল, আমার হাতে একটা ২ জিবি মেমোরি কার্ড, কার্ডে শরিফের সাথে কোনো এক পিকনিকে তোলা ছবি আর কিছু ভিডিও …
সব ভালবাসা যার বোঝা হল…
আমার লাইফে খুব আর্লি দুইটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এত আর্লি যে, এখন প্রায় গায়েই লাগে না ব্যাপারগুলা। কেউ আত্মহত্যা করলে একটা চাপ ফিল করে জীবিত মানুশেরা, নানাভাবে চাপ রিলিফ করার চেষ্টা করে। তো ওইরকম একটা চাপের ফিল আমি পাইছিলাম, আজ থেকে প্রায় ৮-৯ বছর আগে, যখন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু চুয়াডাঙ্গার শরিফ আত্মহত্যা করে।
এই ঘটনা আমি জীবনে অনেকরে বলছি— চা খাইতে খাইতে, বিড়ি টানতে টানতে, শুইয়া, বইসা, দাঁড়াইয়া। আয়েশ কইরা একটা আত্মহত্যার গল্প বলার মইধ্যে এক ধরনের ক্রুয়েলটি আছে, স্বীকার করি। কিন্তু গল্প তো এইভাবেই বলা লাগে। তাই লেইখা এই ক্রুয়েল গল্পটা কখনও আমি প্রকাশ করি নাই। তবু, আজ।
সেইটা বোধহয় ২০১১-১২ সালের কথা। আমি তখন ঢাকার একটা কওমি মাদ্রাসায় কাফিয়া জামাতে পড়ি। দুনিয়াবিমুখ যাহেদ তালেবে এলেম বলতে যা বুঝায়, আমি ছিলাম মোটামুটি তাই— ফজরের জামাতে দেরি করা, আর মাঝেমাঝে সুন্নাতে মোয়াক্কাদা না পড়া-ব্যতীত, জগতের আর কোন পাপের সাথে তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না আমার। মোবাইল চালাই না, সারাদিন মাদ্রাসায় থাকি, পড়াশোনা করি, দুই ঈদের ছুটিতে মিযান ভাইর সাথে বাসায় যাই, মিযান ভাই আমারে বাপের একদম হাতে তুইলা দিয়া তারপরে নিজের দৌলতপুরের বাড়িতে যান— এই আমার নরমাল লাইফ। ঢাকা থাকি তখন প্রায় ৪ বছর হইছে, কিন্তু বাংলাবাজারই চিনি না, তখনও।
মিনার মাহমুদ আমার একজন প্রিয় গদ্যলেখক, উনিও ২০১২ সালে ঢাকার একটা আবাসিক হোটেলে সুইসাইড করেন। উনি লেখছিলেন: জিন্সের মতো জীবন। আমার জীবন জিন্সের মতো এত টাইটফিট চকচকা ছিল না, খুবই নরমাল একটা লাইফ। এতটাই নরমাল যে, জাপানি টরে কাপড়ের বিশাল জুব্বা ছাড়া আর কোন কাপড়ই চিনি না তখনও। জীবন মানে ট্রাংকে ভাঁজ দেওয়া দুইটা পাঞ্জাবিই কেবল। আস্তে আস্তে জীবনের ভাঁজ খোলে, ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধের মতন যৌবনের ঝাঁঝ লাগে নাকে।
কওমি মাদ্রাসায় পইড়া খাব কী— এই হইল আমার ব্যাপারে তখন মুরুব্বিদের প্রধান কনসার্ন। নিতান্ত বাধ্য হইয়াই জেডিসি পরীক্ষা দেওয়ার নিয়ত করি। জেএসসির আলিয়া ভার্শন আরকি। তো দিব ক্যামনে? যশোরের একটা আলিয়া মাদ্রাসায় চুপচুপ ভর্তি হয়ে যাই। কিন্তু ক্লাস তো করা হয় না, পড়ব ক্যামনে? কওমি মাদ্রাসায় এইসব বই পড়ার জো নাই। হুজুররা দেখলে খেল খতম। আলিয়ায় এক্সাম দেওয়া মানেই গোমরাহির দিকে এক পা বাড়ানো। শুরু হইল একটা সংগ্রামী লাইফ।
মাদ্রাসার সারাদিনের পড়ার চাপে, এইগুলা পড়ার টাইমও তেমন পাই না। আবার বিকালে তো আমি ক্রিকেট খেলতাম, প্রায় নিয়মিত। এই খেলাধুলা কুরবানি দিলাম। বিকাল হইলেই ঝোলার মইধ্যে আলিয়ার বইগুলা নিয়া চইলা যাইতাম দূরের মসজিদে। উপায় ছিল না। মসজিদে বইসা দুনিয়াবি পড়ালেখা করার গিল্ট ফিল হইত। মাঝেমাঝে উদাস হইয়া মসজিদের জালনা ধইরা কান্দাকাটি করতাম। খোদা, আমার তকদিরের খোদা!
ছুটিতে বাড়ি গেলে, আলিয়া মাদ্রাসায় ক্লাশ করার সুযোগ হইত। কোনো এক শুভদিনে, আলিয়া মাদ্রাসায় প্রথম ক্লাসটা করলাম। সেই কত কত কাল পরে, আবারও আমার, মা-বোনের বাইরে কোন নারীমুখ দর্শনের, তাদের সাথে বইসা গল্পগুজবের, সুযোগ হইল। যশোর ক্যান্টের ক্লাশ থ্রির মেয়েরা যেন আবার ১০ বছর পরে ফিরা আসল আমার জীবনে। ততদিনে আমি অবশ্য লম্বা জুব্বায় আবৃত এক শাদা দরবেশ; ছোটকালে পুলিশ হওয়ার ইচ্ছাটা আর নাই, পতেঙ্গা সৈকতে কেনা প্লাস্টিকের সানগ্লাশ পরা ছবিটাও তো হারাইছে বহুদিন! ফলে, পরিণত বয়সে মা-বোনের বাইরে দেখা এই প্রথম নারীদের মনে হইল আজনবি। মনে হইল, এদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক তো নাই আসলে! এরা কারা? ইগনোর করলাম নারীজাতিরে।
কিন্তু নারীজাতিরে ইগনোর করা যায় না। তারা জলের মত ঘুরেঘুরে একা ও সম্মিলিতস্বরে কথা কয়। গভীর রাত্রে বরিশালগামী লঞ্চ থিকা দেখা শাদা বিকনবাতির মতন তাদেরও তীব্র অস্তিত্ব টের পাই ঘুমের ভিতরেও। মাইলপোস্টের মত জীবনের মোড়ে মোড়ে দাঁড়াইয়া তারা পথের ক্লান্তি বাড়াইতে থাকে। তাদের তুমুল ইনোসেন্সের ক্যাছেও পরাজিত হইতে হয়; দরবেশের শাদা আলখেল্লায়ও আছড়াইতে থাকে তাদের, এমনকি ছোটখাটো নিঃশ্বাসের মুহূর্মুহু ঢেউ। নাটকীয়, কিন্তু বাস্তবতা নাটকীয় হইলে আমার কিছুই করার নাই। ২০১২ সালের কোন এক সকালে, আলিয়া মাদ্রাসার করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে, আমি আমার কৈশোরের ইনোসেন্স হারাইলাম। মা-বোনের বাইরেও যে নারীর তীব্র অস্তিত্ব আছে, টের পাইতে থাকলাম দমে দমে।
কিন্তু দম ফালানোর কি টাইম আছে আমার! ছুটি প্রায় শেষ। ঢাকা আসা লাগবে। তা তো খারাপ না। ঢাকা আমার আজীবন ভাল লাগে। আমার মাদ্রাসা, আমার বন্ধুরা, আমার উস্তাদগণ, আমার কিতাব-খাতা, আমার সব— এইসবই তো আমি ভালবাসছি আজীবন। জীবনে বারবার আমি, মাঝরাতে নিঃসঙ্গ পাড়ি দিতে চাইছি অন্ধকার পদ্মা; খুব ভোরে, ভুইলা যাওয়া নারীমুখের মত অস্পষ্ট কুয়াশা ভেদ কইরা, ঠাণ্ডা চান্দের আলোয় কাঁপতে কাঁপতে নামতে চাইছি গাবতলির কোনো ব্যস্ত হোটেলের সামনে, নাক ভরে নিতে চাইছি ঢাকার ধুলাবালি আর সদ্য তাওয়া থিকা উঠানো গরম নেহারির ঘোলা গন্ধ! কিন্তু সেইবার, যশোর ছাড়তে কষ্ট হইল অনেক। ট্রেন ছাড়ার আগে কার যেন রুমাল নড়তে থাকল পরানের গহীন ভিতর।
এইগুলাই হইছিল তখন। প্রথম প্রেমের ইতিবাচক ব্যাপারটা হইল, স্রেফ প্রেমে পড়ার মধ্যেই থাকে একটা আলাদা আনন্দ, যে আনন্দ দমে দমে টের পাওয়া যায়; একটা অদ্ভুত বিষাদ, যে বিষাদ সদলবলে সেলিব্রেট করা যায়। একটা ভয়াবহ চার্ম, একটা আনোখা অ্যারাউজাল, একটা দমনের অতীত বাসনা, একটা আত্মা উজালা করা বিভূতি, একটা উন্মাদ অ্যাডোলেসেন্স, শরীর, অন্তর ও আত্মা কাঁপাইতে থাকা এক আজিব ছা সুখ, শিথিলতা— এইত পয়লা পিরিতের ধোঁয়া ওঠা ফিলিংস-সকল। প্রথম প্রেমে পড়ার কাহিনী বলব, লোকের কি আমার অভাব! মাগফুর ভাই আছে, আছে আরো আরো বন্ধুরা। সারারাত আড্ডা দেওয়ার মতন লোকও দেদার আছে। তাদের সাথে চলল তুমুল আড্ডা। মাগফুর ভাইর সাথে কাটাইলাম বহু নির্ঘুম রাত্রি, দিলাম শত শত আড্ডা, মারলাম লাখো কোটি হাতি ও ঘোড়া, টপিক একটাই— প্রেমে পড়ছি।
প্রেমে পড়া সোজা, সুন্দর, সুখ সুখ ব্যাপার; কিন্তু প্রেম করাটা তত সহজ সুখের না মনে হয়। লাজুক ফাজুক ছিলাম না আমি কোনদিনই, কিন্তু প্রেম ব্যাপারটার প্রকাশ্য ঘোষণা মেবি একটা যুক্তিহীন অদ্ভুত ঘটনা। একটা আশা-নিরাশার ইলজিকাল প্যারা; রক্ত-মাংশের একটা সাধারণ মানুশের কাছে স্বপ্নের মত কিছু চাইতে যাওয়ার বেহুদা মুজাহাদা। আমার অস্তিত্বের সাথে, আত্মার সাথে, অভ্যাসের সাথে, নৈমিত্তিকতার সাথে সম্পর্কহীন একটা মানুশরে গিয়া বলব: আই লাভ ইউ। মানে, এরচাইতে অর্থহীন আর এম্বারেসিং কাজ তো দ্বিতীয়টা নাই দুনিয়ায়। এই বলার অর্থ টর্থ কী, তাও অত পষ্ট না তখন। বুঝিই না ঠিকঠাক যে, লোকে ‘প্রেম করি’ যে বলে, আসলে কী কী করে ওইখানে!
ফলে, হাজার চেষ্টার পরেও সুমাইয়ারে আমি বলতে পারলাম না যে, আমি ওরে পছন্দ করি। হাজার লোকের কাছে বলা যায়, কিন্তু সুমাইয়ার কাছে না। বাট, আমি ছিলাম বাঙলা সিনেমার আদি ও আসল লয়াল প্রেমিক। ওয়ান সাইডেড, কিন্তু জিনিস খাঁটি। দিনরাইত এক কইরা সুমাইয়ারে ভাবতে থাকলাম। এমনকি এমনও হইল যে, পাশের বাসায় সুমাইয়া নামের বিরক্তিকর মেয়েটারেও হালকা নরম নজরে দেখলাম। আমার যে বইগুলা নিয়া ও আর ফেরত দেয় নাই, ওইসবের দাবি ছাইড়া দিলাম আজীবনের জন্য।
তবু সুমাইয়ার পাত্তা তো পাই না! পাব ক্যামনে? তার ব্যাপারে কিছুই জানি না তখনও। এক ক্লাসে পড়ি আমরা— এতটুকুই আমাদের দুইটি আজনবি অস্তিত্বের আনকোরা সম্বন্ধের মাঝে পোলসিরাতের মত ঝুলতে থাকা একমাত্র চিকন সুতলি! বন্ধুর সাথে মশওয়ারা করলাম। বন্ধু কইল: মফস্বলের প্রেমের প্রথম ধাপ হইল মেয়ের বাসা খুঁইজা বের করা। কোন এলাকার মেয়ে, এইটা আগে জানা লাগবে। দেন তার বাপরে চেনা, তার ছোট ভাই-বোন থাকলে তাদের লগে খাতির জমানো— এগুলা ইম্পর্ট্যান্ট। কড়া হোমওয়ার্ক করা লাগবে, নাইলে মুশকিল। আমি কাফিয়া জামাতের এক আলাভোলা হুজুর, এমনকি সাইকেলটাও চালাইতে পারি না, এই বিশাল যশোর শহরে তার বাড়িটা খুঁইজা বের করব ক্যামনে আমি! খালি জানি, তার বাড়ি অমুক জায়গায়। সেই জায়গাটা কই, কাউরে জিগানোর সাহসটাও নাই তখন। ফলে, আল্লাহই ভরসা। প্রতিদিন আসরের পরে পায়দলে বের হইতাম তার বাড়ি খুঁজতে। আমার বাসা থিকা চারটা রাস্তা চারদিকে চইলা গেছে। একেকদিন একেকদিকে যাই, ওই জায়গার নাম খুঁজি দোকানের বিলবোর্ডে, লোকেদের জিগেস করি। একেকদিন কই কই গেছি যে, তার কোন হিশাব আর নাই এখন। খুঁজতে খুঁজতে মাগরেবের আজান দেয়। আমি কাছের এক মসজিদে ঢুইকা নামাজ পড়ি। মোনাজাতে কই, আল্লাহ, তুমি বান্দার মনের আশা পুরা কর!
চারদিনের দিন তার বাসাটা পাইলাম। এমন নাটকীয় ঘটনা বলতে শরম লাগতেছে সত্যি, কিন্তু জীবন আমার শরমের চাইতেও বেশি সত্য হয়া জানালায় টোকা মারে দিনরাইত। তারে ইগনোর করব, সেই সাধ্য আমার ছিল না। চিনলাম প্রেমিকার বাসা। প্রথম ধাপে সফল। এই সাফল্যে আহ্লাদিত আমি একদিন ক্লাশে আইসা শুনি, সুমাইয়ার প্রেম হয়ে গেছে। এবং যেইটা হয় আরকি টিভি-সিনেমায়, ঠিক সেইটাই আমার জীবনেও কেন হবে— সিনেমা তো অলমোস্ট মিথ্যা— ভাইবাই পাইলাম না। আমার সে সময়ের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু চুয়াডাঙ্গার এক সারের ডিলারের ছোট পোলা শরিফুলের সাথেই প্রেম হয়ে গেছে তার। প্রেমের দ্বিতীয় ধাপ অনেকের জন্য প্রপোজ, আমার প্রথম প্রেমের দ্বিতীয় ধাপেই শুরু হইল তুমুল বিরহ।
সেইসব দিন আর রাতগুলা যে কত ভারি ছিল, কত দীর্ঘ ছিল, কত ক্লান্ত ছিল, কত মলিন ছিল, কত মৌন ছিল, কত বিধুর ছিল, কত বিলীন ছিল, কত বিকল ছিল, কত বধির ছিল, কত আয়ুক্ষয়ী ছিল, কত জীবনবিনাশী ছিল, কত উদ্ভ্রান্ত ছিল, জিপসি মেয়েদের মতো কত কত অনিশ্চয়তায় ভরা বেদনার মত সৌন্দর্যে আর্দ্র ছিল— সেসব এখন আর রিকল করতে পারব না আমি, হয়ত ফিলই করতে পারব না। সেই ভয়াবহ জ্যান্ত হৃদয়, সূর্যের আলোয় মেলে দেওয়া সেই রক্তেভেজা হৃদপিণ্ড, আমি আর ফিরা পাব না কোনদিন। রাত তো জাগিই। ছ্যাকা খাইয়া কবি হওয়ার খায়েশ আমার জীবনেও ছিল না, ইন ফ্যাক্ট, কবিতা জিনিসটারেই হেইট করতাম। স্পেশালি উত্তরাধুনিক বাঙলা কবিতা। কিন্তু এই তথ্য সত্য যে, বহুদিন পরে ওই রাইতেই আমি একটা কবিতা লেখছিলাম, প্রায় ১০ বছর পরে লেখা প্রথম কবিতা। ও নিয়া আমার আর আফসুস নাই কোন। কপাল আমার, আমার খোদার হাতের লেখা!
দিন যায়, আসে রজনী। শরিফ-সুমাইয়ার প্রেম দেখতে দেখতে আমি হালকা বাপ্পারাজ বাপ্পারাজ ফিল পাই। বাঙলা মুভিতে বাপ্পারাজ হওয়া অন্তত কিছুটা হইলেও সুখের: দর্শক মহান ভাবে, লাস্ট সিনে মরার সময় সব ফোকাস থাকে বাপ্পারাজের উপ্রেই। কিন্তু আমারে ফোকাস করবে কে? বাস্তবতা কঠিন। ওদিকে, এটুক মাইনাই নিলাম যে, প্রেমের দৌড়ে বন্ধু শরিফরে বিট করা আমার কাজ না। এমএলএম বিজনেস তখন মফস্বলের চালু পোলাপানের চা বিড়ির টাকা উঠানোর একটা ভাল রাস্তা। ক্লাস এইটে থাকতে, ওই বয়সেই, শরিফুল সুমাইয়ারে বিয়া করার জন্য প্রায় ২০ হাজার টাকা ব্যাংকে জমাইছিল, এই এমএলএম কইরা। এহেন শরিফুলরে প্রেমে বিট দেওয়া আমার মত অকর্মার জন্য তখন পুরাপুরি ইম্পসিবল। ফলে, ব্যর্থতা জিনিশটারে হালকা সেক্রিফাইসের রুপ দিয়া, মনে মনে একটা পেসিমিস্ট, ম্যাসোকিস্ট সুখ নিয়া নিজের লাইফে মন দিলাম আমি।
কিন্তু, ওই তো, যা হয়। সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়। ক্রিকেট ইগনোর কইরা আসরের পরে মসজিদে গিয়া পড়াশোনা করা সোজা, কিন্তু সুমাইয়ারে ভুইলা থাকা কঠিন। আবার এইটাও ভাবলাম যে, লাইফে এই প্রথম একজনরে, একটা মেয়েরে পছন্দ করলাম, অথচ তারে জানাইতেই পারলাম না— এইটা কোনো কথা! এইটা কি সেক্রিফাইস, না অন্যকিছু? ভয়, লজ্জা, অক্ষমতা? কেন করব সেক্রিফাইস আমি, শরিফের জন্য? অক্ষমতারে সেক্রিফাইস ভাইবা আরাম নেব কেন? অক্ষমতা? আমি কি প্রেমের প্রকাশে অক্ষম? আমার হৃদয়ে প্রেমের যে নোনা দরিয়া, তা কি খালি আমার দিলটারেই নোনতা বানাইতে থাকবে হরদম? পিরিতের প্রবল বন্যায় জমতে থাকা যে নরম পলির আস্তর আমার অন্তরে, তা কি শুধু কাদা হইয়াই থকথকাইতে থাকবে আমার রগ ও রক্তে? আমি কি নারীর লগে কম্যুনিকেট করতে অপারগ কোনোভাবে? নাইলে আমি কেন সুমাইয়ারে ছিনাইয়া নিয়া আসতে পারব না? আর কেনই বা তা করব না আমি? আমি কি যোগাযোগ বৈকল্যে ভুগতেছি?
আবার ভাবি, এসব ক্ষেদের কথা, আক্ষেপের কথা। আমি বন্ধুকৃত্য করতে চাই আপাতত, হয়ত আমার জীবন একটা অন্ধকার নদীর বুকে একা একা রাত জাইগা তারা দেখার মতই এক্সেপশনাল, আউট অব ফোকাস বিউটি। সবার লাইফ কি এক হবে? সবাই কি পারবে, দুনিয়ার সবকিছু? পারবে না। পারা লাগবেই কি? তাও তো না। কেউ কেউ হারবে, ইচ্ছা কইরাই। তাতে কেউ না কেউ জিতবে৷ আর সে যদি হয় কাছের বন্ধুটি, তাতে ক্ষতি নাই তো কিছু।
ভাবি এইসব আজগুবি হিজিবিজি। বিকালের শীতল বাতাসে বুক ভিজে যায়, প্রচণ্ড কানতে মন চায় বৃষ্টির রাইতে। প্রেমের গল্প পড়তে কষ্ট লাগে, কষ্ট লাগে হৃদয়ঘটিত যেকোন কিছুই ফেস করতে। ভাল লাগে না বৃষ্টিদিনের বিকালবেলা পৃথিবীর ঘাসে-ফুলে-লতায়-পাতায় নাইমা আসা সবুজ মেয়েদের, এড়াইতে চাই ওদের আরো, ইগ্নোর করতে চাই আমি পৃথিবীর সমস্ত নারীরে। তবু সুমাইয়া, তবু কেন সুমাইয়ারে ভুলতে পারি নাই আমি তখন, নক্ষত্রের সমস্ত দোষ এক কইরাও কেন নিজের দুর্ভাগ্যরে আমি এক্সেপ্ট করতে পারি নাই, আজ আর সেসবের কোন সদুত্তর পাই না। কে যেন সারাদিন সারারাত কানের কাছে চুপেচুপে বলে: ‘ভোল না কেন, ভুলতে পার যদি?’
সুমাইয়া-শরিফ প্রেম করতেছে করুক, কিন্তু এটলিস্ট সুমাইয়ারে এইটা জানায়া দেওয়া তো কোনো ক্রাইম না যে, আমিও তারে পছন্দ করি! ‘ঘেন্না, লজ্জা, ভয় থাকিলে প্রেম হবে না/যে করে আত্মসমর্পণ, তার প্রেমে আর গোল বাঁধে না’— এই তো সাবমিশন! ভাবলাম। ডিসিশন নিলাম, নিজেরে সাবমিট করব৷ আমি যে তারে পছন্দ করি, এইটা তারে জানানো দরকার; তারে দেওয়া দরকার একটা এক্সেপশনাল লাভ লেটার, যেখানে প্রেম থাকবে, আবেগ ও আত্মনিবেদন থাকবে, মগ্নতা ও মুগ্ধতা থাকবে, আর থাকবে আত্মনিবেদনের পরে, অহমের প্রদর্শনীর পরে এক চূড়ান্ত আত্মলোপ, পরম বিলয়— এক্সিস্টেনশিয়াল বাকার পরেই এক ইটার্নাল ফানার রিপ্রেজেন্টেশন! চিঠির লাস্টে ওদের দুইজনের সুখী জীবনের জন্যে, এক টুকরা শুভকামনা জানানোর মত বাপ্পারাজিয় স্টাইলটাও ফলো করার চিন্তা করলাম। কমবয়সী কিশোরের একদমই ইনোসেন্ট একটা ডিসিশন ছিল এইটা— তখন ভাবছিলাম। আজ মনে হয়, এইটা ছিল এক বিপন্ন দ্বিধা-জড়জড় আত্মার ইনোসেন্স হারানোর, গন্দম খাওয়ার, অনন্ত পতনের গল্প; আলমে আরওয়ার অলৌকিক আদমসুরত ও মাসুমিয়ত হারাইয়া, বেদনানীল ইহজগতে তার অনিশ্চিত জার্নির স্টার্টিং হুইসেল!
বিশাল একটা লাভ লেটার লেখলাম পরে এক রাইতে। হাতে কলমে ক্যামনে ২৯ পৃষ্ঠার ওই লেটার আমি লেখছিলাম, লেখার পরে ক্যামনে হাতের চামড়া কাইটা ‘S’ খোদাই করছিলাম, ক্যামনে বন্ধু আলামিনরে দিয়া সেই চিঠিটা পাঠাইছিলাম আর সুমাইয়া সেই চিঠি আদৌ পাইছিল বা পইড়া দেখছিল কিনা— কিছুই আমি জানি না। ওই চিঠির সাথে সাথে সুমাইয়ারে আমি আমার আনকনশাসে ঠেইলা দিলাম, ফ্রয়েড ছাড়া আর কারুরই সাধ্য নাই এবার তারে ওইখান থিকা উদ্ধার করে।
সুমাইয়ারে আমি প্রায় ভুইলাই গেছিলাম তারপরে। আমি প্রিটেন্ড করি, আমি সুখী হইতে চাই। আমি জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্তে ভান ধইরা হইলেও আগাইতে চাই আরো একটু সামনের দিকে। মাঝে যেটুক স্মৃতি, ওইটুক তো সুখস্মৃতিই আমার, বলা যায়। প্রেমের স্মৃতি কখনো দুঃখের হয় না, আমার তো এমনই ধারণা। ওদিকে এইটের এক্সাম হইছে ততদিনে, আমি যশোর জেলায় ফার্স্ট হইছি, গোল্ডেন পাইছি, মাদ্রাসায় কদর বাড়ছে, অফিসে গেলেই স্টাফরা হাসিমুখে চা খাইতে দেয়, হালপুরসি করে। আমার লাইফে তো সুখ। ফলে, আমার প্রথম প্রেমের এই কমেডিটা এইখানেই শেষ হইতে পারত। কিন্তু ট্রাজেডি ছাড়া কমেডি পুরা হয় না নাকি। সেইজন্যেই বোধহয়, এক গরমের ছুটিতে যশোর গিয়া শুনলাম, শরিফ সুইসাইড করছে।
নিউজটা শোনার পরেই ওই চাপটা ফিল করলাম, যেইটা যেকোন জীবিত মানুষ কারুর সুইসাইডের নিউজ শুনলে ফিল করে। এইটার জন্য আমি দায়ী না তো? সুমাইয়ারে যে চিঠি দিছিলাম, তার সাথে কি এই ঘটনার কোনভাবে কোন কানেকশন আছে? নাকি এইটা নিছকই সুমাইয়ার পরিবার ওদের সম্পর্কের ব্যাপারটা জাইনা যাওয়া ও তৎ-পরবর্তী ঘটনাবলীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? আমি যুক্তি সাজাইতে লাগলাম, নিজের পক্ষে ও বিপক্ষে। নিজেরে দায়ী করতে থাকল আমার আনকনশাস, কিন্তু আমার ইগো আমার পক্ষে খাড়া করতে থাকল নানাবিধ লজিক্যাল আর্গুমেন্ট। প্রচণ্ড চাপে আমি নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছাইড়া দিলাম। ক্লাসে যাই, বরাবর ওইপাশের বেঞ্চে বইসা সুমাইয়া, মাঝেমাঝে শব্দ কইরাই, কান্দে। স্যার ধমক দেয়। বন্ধুরা আমারে ইশারায় বলে সুমাইয়ার লগে প্রেমের ব্যাপারটা আগাইতে, এইগুলা অলমোস্ট অসহ্য লাগে আমার। বন্ধুদের সাথে কোন কথাবার্তা বলার সাহস বা ইচ্ছাশক্তি খুঁইজা পাই না। জিগাইতেও পারি না কী হইছিল। আজ অবধি আমি কাউরে জিগেশও করি নাই। এমনকি সুমাইয়ারেও না।
তারপর একদিন বিকালে, চুয়াডাঙ্গার সীমান্তবর্তী এক এলাকায়, বন্ধু শরিফের কবরটা দেখতে আমি গেছিলাম। ঘরের দাওয়ায় বসা শরিফের বাপ আমারে দেইখা নড়লেন না। শরিফের মা’রে কোথাও পাইলাম না। কেউ কিছুই বলল না। আমি একটা চেয়ার টাইনা সন্ধা পর্যন্ত বাড়ির উঠানে বইসা থাকলাম। এই বাড়িটায় প্রত্যেকটা জীবন এত বেশি স্থির, স্লো, মোশনলেস— আমি নিজের বাঁইচা থাকার ফিলটুকুও যেন পাইতেছিলাম না আর। মাগরেবের আজানের পরে হুঁশ ফিরল। শরিফের কবর কই, এইটা বন্ধু আশরাফুল আমারে জানাইল। গেলাম কবর দেখতে। শরিফের মা বইসা আছেন কবরের পাশে। চুলখোলা। মোশনলেস। ওই প্রথম আমি কোন বন্ধুর কবরের পাশে গিয়া দাঁড়াই। আমার বন্ধু শরিফ, যে কিনা সুইসাইড করে মারা গেছে, যার জানাজার নামাজ পড়তে ইতস্তত করতেছিল গ্রামের মানুষ, তারই কবরের পাশে দাঁড়াইছি আমি ঠিক মাগরেবের ওয়াক্তে, আমার গায়ে পাঞ্জাবি, আমার মাথায় শাদা টুপি, আমার পায়ে চামড়ার জুতা, আমার পকেটে মোবাইল, আমার হাতে একটা ২ জিবি মেমোরি কার্ড, কার্ডে শরিফের সাথে কোনো এক পিকনিকে তোলা ছবি আর কিছু ভিডিও, আমি হুজুর, আমি ভাল মানুষ, গিয়া দাঁড়াইছি এক পাপীর কবরের সামনে, মাগরেবের ওয়াক্তে!
আমি কী করব? মেমোরি কার্ডটা ফালাইয়া দিলাম দূরে, জঙ্গলে। শরিফের আম্মা আমারে দেইখা মাথায় কাপড় দিয়া বাড়ির দিকে গেলেন। আমি ফাতেহা পড়লাম, পাশের জমিন থিকা এক মুঠ মাটি উঠাইলাম, কবরের উপরে সেই মাটিটুক রাখলাম। তারপর এশা পর্যন্ত বইসা থাকলাম সেই নির্জন নিস্তব্ধ কবরের পাশে। বন্ধুর কবরের পাশে বইসা আমার নিজেরে খুব অসহায় মনে হইল।
রাতে খাওয়ার সময় সব গল্প শুনলাম ওর বাপের মুখে। দাওয়ায়ই খাইতে বসছিলাম আমরা, কলার মোচা আর মুরগির সালুন। শরিফের মা রানছে। যশোরে মেস নিয়া থাকত শরিফ, সেদিন সন্ধায় সব গোছগাছ কইরা আইসা পড়ছিল। শরিফের আব্বা সারের ডিলার; ইন্ডিয়া থিকা ভাল ভাল সার নিয়া আসে দেশে। সেই সারের গোডাউনে ঢুইকাই নাকি ফজরের ওয়াক্তে কীটনাশক খাইছিল শরিফ। খাওয়ার পরেও চেতনা হারায় নাই, অন্তত রান্নাঘর পর্যন্ত আইসা ওর মা’রে কইতে পারছিল: মা, আমি তো কীটনাশক খাইছি। এই পর্যন্ত বলার পরে, শরিফের মায়ের উদাম কান্না শোনা গেল। শরিফের বোনটারে দেখলাম না কোথাও, জিগেসও করলাম না ওর ব্যাপারে কিছু। আমি কেন জিগেস করব? আমি কে?
শরিফের ভাইয়ের হিরো হুন্ডা আজরাইলের সাথে বাজি ধইরা হাসপাতাল পর্যন্ত যাইতে পারে নাই। মওতের চাইতে দ্রুতগামী, সর্বগ্রাসী কোনো হুন্ডা তো তৈয়ার হয় নাই। চুয়াডাঙ্গার একটা সাধারণ হাসপাতালে, ২০১২ সালে, আমার প্রিয় বন্ধু শরিফ মারা যায়। মৃত্যুর সময় তার আশেপাশে আমরা কেউই ছিলাম না। তার এই সুইসাইডের কারণ নিয়া কেউ কোন তদন্ত করে নাই। ‘মেয়েছেলের কেস’— এইভাবেই এই অতি সাধারণ মৃত্যুটা লিপিবদ্ধ হইছে ওই গ্রামের মানুষের কালেক্টিভ কনশাসে।
চুয়াডাঙ্গা থিকা ফেরার পরে আমার জ্বর আসে। জ্বরের ভিতরে আমার মাথায় অনেক অপরিচিত মানুশের মুখ ভাসে। মানুষের জীবনটা আসলে কী ও কেন, বাঁচার বা মরার ফায়দাই বা কী, কী অর্থ তৈরি করে একটা প্রেম বা প্রেমেরও অধিক একটা মরন— এইসব হুদাই মাথায় ঘোরে আমার। জ্বর বাড়ে। আমি নিয়ত করি, আর যশোর থাকব না। ছুটি চলাকালীনই, ঢাকা আইসা পড়ি। জ্বর ভাল হওয়ার পরে পড়াশোনায় মন দিই। মনে হয়, শরিফের মৃত্যু ছিল আমার অল্টার ইগোর মৃত্যু, আমার কামনা ও বাসনার নিদান, আমার প্রেম ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাণ। ওই ঘটনার পর, আমার প্রথম যৌবনের সেই সর্বগ্রাসী, দাউদাউ, লেলিহান আনন্দ ও বেদনার সমস্ত অনুভূতিটুকু স্রেফ একটা মুর্দার সাথে দাফন হয়ে যায় চিরদিনের জন্য।
এই পুরা ঘটনার একমাত্র চাক্ষুশ সাক্ষী আমার বন্ধু আশরাফুল এখন সরকারি গোয়েন্দা সংস্থায় চাকরি করে। পত্রবাহক আলামিনরে ওই ঘটনার পরে অনেক খুঁইজাও আর পাই নাই আমি। তারা যশোর ছাইড়া গেছে গা। সুমাইয়ার সাথে আর কথা হয় নাই আমার, কোনোদিন। এই মাত্র দুই বছর আগে এক রাতে সে আমারে নক দিছিল, ফেসবুকে। যে সুমাইয়া সরাসরি একটা কথাও কোনদিন আমার সাথে বলে নাই, সে আমারে নক দিয়া অনেক গল্প বলল। তার বিয়ের কথা, সংসারের কথা। একটা ছেলে হইছে তার— সেই কথা। ‘আপনি অনেক পাগল ছিলেন, বুচ্ছেন? ওইভাবে কেউ হাত কাটে?’— এইসব আরো কত কথা। সুমাইয়া—আমারে—৮ বছর পর। আমার মনে পরে কবিতা— ‘আট বছর আগের একদিন’। আমি কিছুই বলি না। আমি কে? কী বলব সুমাইয়ার সাথে আর? কেন?
তদ্দিনে চুয়াডাঙ্গার শরিফের এই করুণ মৃত্যুর ঘটনাটা আমি ভুইলা গেছি। জীবনে অনেকগুলা মুরগি আর কলার মোচাও খাইয়া ফেলছি, শরিফের বাড়িও আর কোনোদিন যাই নাই। আমি কেন যাব? কার সাথে দেখা করতে যাব? শরিফ মইরা গেছে। তার কবরের মাটিও মেবি এখন মিশা গেছে রাস্তার সাথে। তার বোনের হয়ত বিয়া হইছে, মা আর বাপ বাঁইচা আছে বা মইরা গেছে। আমি জানি না।
একজন মানুষ স্বেচ্ছায় মইরা গেলে কী করা লাগে, আমি জানি না। কারে দোষ দেওয়া লাগে, জানি না। নাকি নিজের মাথা পাইতাই নিতে হয় সব দোষ? নিজের কাছে আত্মসমর্পণ, পরম ফানায়ই কি শেষ হয় প্রতিটা প্রেম ও দ্রোহ? আত্মবিলোপেই কি মুক্তি পায় লোভী আত্মা? রুহ কি শুদ্ধ হয় মরনের স্মৃতিচারণেই? নাকি এসব আমার অযাচিত গিলটি ফিলিংস, অহেতুক অসংলগ্ন বিভ্রম? নাকি শরিফের মৃত্যুর পরেও আমি ছাড়তে পারতেছি না আমার সেই ম্যাসোকিস্ট মহত্বের লোভ, আমি আবারও সেক্রিফাইস কইরা মহৎ হইতে চাইতেছি, মৃত শরিফরেও বানাইছি নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী? আমার কি ভুইলা যাওয়া উচিত ছিল সব, সুমাইয়ার চোখের পানি মুইছা ওরে পরম আদরে জড়াইয়া ধরা উচিত ছিল? ‘যে করে আত্মসমর্পণ, তার প্রেমে আর গোল বাঁধে না!’ আমি কি অ্যাবসলুট সাবমিশনের তবকায় যাইতে পারছি? যদি পারি, তাইলে কেন আমার সব বাসনা তাড়িত হবে একটা মওতের নস্টালজিয়ায়? কেন ঢাকনা-আঁটা আমার কলবের চারপাশে উথলায়ে উঠবে ভাতের মাড়ের মতো প্রেমের বলক? জানি না।
প্রত্যেকটা মানুষই কারুর না কারুর মরনে গিল্ট ফিল করে, চাপ ফিল করে। আমি আর কোনোদিনই, কারুর মরনে গিল্ট ফিল করতে চাই না। ছেলে হারানো কোনো বাপের গল্প শুনতে শুনতে, তার মা’র হাতের রান্না খাইতে চাই না। সুমাইয়ার নেকাব-আঁটা লাল চোখ মনে পড়ে আমার, মনে পড়ে ওর চোখে-পরা কাজলের অবিন্যস্ততা, ওর হাসির শাদা শব্দ, ওর টোলের আলতো ধূসর গন্ধ! সুমাইয়ার নীচুকণ্ঠের কথাগুলা মনে পড়ে। আহা, সুমাইয়া, কত চাইতাম আমি তোমারে, কত! কেন মওতের দেনা জীবনের সবটুকু দিয়া শোধ করা লাগে, কেন? নাকি তুমি মৃত্যু পার হয়ে আসতে চাইতা এই পাড়ে, নাকি তুমিই ছিলা আমার অ্যাবস্যলুট সাবমিশন, নাকি আমি আবার জিততে গিয়া হাইরা গেলাম, হারাইলাম তোমারেও, নাকি তুমি…নাকি আমি…! না, আমি প্রিটেন্ড করি। আমি সুখী হইতে চাই। আমি চাই জিততে, তারপরেও। আমি ভুলতে চাই, দাফন দিতে চাই সমস্ত অতীত। তবু আমি আগাইতে চাই আরেকটু সামনের দিকে, জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে তবু আমি ফিল করতে চাই বাঁইচা থাকার আনন্দ, শুনতে চাই হৃদপিণ্ডে আয়ুর ধুকপুকানি, ফুসফুসে বায়ুর আসা যাওয়া। আমি ভুলতে পারি দুনিয়ার তাবত সুমাইয়ারে, কবরে শোয়াইতে পারি দুনিয়ার তাবত শরিফের লাশ৷
তাও একেকটা সুইসাইডের খবর কানে তো পশে। পুরান চাপটা আবার ফিরা আসে। মনে হয় আমি শাদা পাঞ্জাবি আর টুপি পইরা, ঠিক মাগরেবের ওয়াক্তে দাঁড়ায়ে আছি কোন কবরের সামনে। কবরের ওইপাশে নেকাব-আঁটা কাজল লেপ্টানো দুইটা চোখ, সে-চোখের ভাষা মৃত্যুর চাইতেও জটিল ও রহস্যময়। আমি সেই চোখের লোগাত উপেক্ষা কইরা ক্রমাগত পইড়া যাইতেছি দুনিয়ার সমস্ত এসমে আজম, সকল ফাতেহা; আমার রুহ সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে, ওজনশূন্য হয়ে ঘুরতেছে শূন্যে— মহাশূন্যে। যে মরছে, তার চেহারা চিনি না, নাম ধাম জানি না। খালি আমার শূন্য রুহে তার যাবতীয় বাসনার প্রতিধ্বনি টের পাইলেই, আমার দুনিয়ার সব কলার মোচা একসাথে খাইয়া মইরা যাইতে ইচ্ছা করে।
তুহিন খান
জন্ম ১৯৯৫ সনে। জীবনের মৌলিক শিক্ষা ঢাকার মাদ্রাসাতুল কাওসার আল ইসলামিয়ায়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ সোশাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চে অধ্যয়নরত। রাজনীতি ও নন্দনের গোপন আঁতাতে আগ্রহী; ধর্ম, ইতিহাস ও সাহিত্যের ছাত্র। প্রকাশিতব্য অনুবাদ: ইতালো কালভিনোর ‘ইনভিজিবল সিটিজ’।