আজ বৃহস্পতিবার, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

স্বপ্ন ও গোপন ঘূণপোকা

।। বেনজীন খান ।।

অতঃপর প্রায় দুই’শ বছরের লাগাতার আঘাতে ফাটল ধরে খানদানের অন্তর মহলে। বিভক্ত হয়ে পড়ে ভাই-বোনে, আলী আর কালীতে। ফাটল ধরে সর্বোত্র— জলে আর পানিতে, সম্পর্কে, ধর্ম ও মন্ত্রে!

স্বপ্ন ও গোপন ঘূণপোকা

যতদূর জানা যায়, চিকন আলীর পূর্বপুরুষরা ছিলো সুবাদার। দক্ষিণের সাগর থেকে উত্তরের মেঘ-লাগোয়া পাহাড় অবধি ছিলো তাদের আবাসভূমি।

সে বহুকাল আগের কথা! শুকর, গরু, সাপ, হনুমান, বেজি, পেঁচা আর ময়ূর সব কিছু নিয়েই ছিলো চিকন আলীর খানদানদের সুখের আবহাওয়া। শৌর্যবীর্য আর আভিজাত্য নিয়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপে দাঁড়িয়ে থাকা এই খানদানের ইতিহাস ছিলো অন্তত বারো’শ বছরের কম নয়।

কিন্তু বস্তু বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী এই খানদানেরও স্থিতিস্থাপকতা একসময় প্রকাশ হতে থাকে। কিছু কুলাঙ্গার যে এখানে জন্মায়নি তা হলফ করে বলা যাবে না। অবশেষে ঠিক তাদেরই ঘাড়ে পা রেখে, মেঘ-লাগোয়া পাহাড়ের পূর্ব পাদদেশ ঘেঁষা আমবাগানের বুকচিরে, দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত এক ঝড়ে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছিলো, চিকন আলীর পূর্ব পুরুষের খানদান।

সে আজকের কথা নয়। এখন থেকে প্রায় আড়াই’শ বছর আগের কথা। কত যে চেষ্টা করেছিলো চিকন-খানদান ঝড়ে উড়ে যাওয়া তাদের আসবাবপত্র, কড়ে-বরগা আর খুঁটি সংগ্রহ কোরে পুনরায় ঐতিহ্য মেরামতের!
কিন্তু না।
আর তা মেরামত হলো না। হবে কি করে?
ঝড়ে তো শুধু বাস্তুভিটা-ই উড়ে যায়নি। বরং উপড়ে গেছে ঝড় প্রতিরোধক আম্রকানন সহ সকল বন-জঙ্গল।

সেই থেকে খুব সহজেই ঈশান কোনে জমাট বাঁধা ছোটোবড়ো যেকোনো কালো মেঘ, উত্তরে খাড়া আকাশ-ছোঁয়া পাহাড়ে আঘাত খেয়ে, অনায়াসে তা পূর্ব দিকে গড়িয়ে গিয়ে, দক্ষিণের অরক্ষিত বাগান ভেদ কোরে তা লণ্ডভণ্ড কোরে দিতে থাকে চিকন আলীর পূর্ব পুরুষদের সকল প্রচেষ্টা সমূহ।

অতঃপর প্রায় দুই’শ বছরের লাগাতার আঘাতে ফাটল ধরে খানদানের অন্তর মহলে। বিভক্ত হয়ে পড়ে ভাই-বোনে, আলী আর কালীতে। ফাটল ধরে সর্বোত্র— জলে আর পানিতে, সম্পর্কে, ধর্ম ও মন্ত্রে!

সে-ও আজকের কথা নয়, আজ থেকে প্রায় ৭৩ বছর আগের ঘটনা। পূর্বপুরুষের শৌর্যবীর্য, স্মৃতিচিহ্ন, অবদান এবং সম্পদ সমূহের সিংহভাগ-ই হারিয়ে ইতস্তত, বিক্ষিপ্ত, ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ে চিকন আলীর খানদান। দারিদ্র্যের কশাঘাতে ন্যুব্জ হতবিহবল চিকন আলীর ছিন্নভিন্ন বাপ-চাচারা বুকের ভিতর বহমান বেদনার স্রোতে পাথর চাপা দিয়ে চেষ্টা করে বাঁচার।
কিন্তু ওই যে—!
বিধির নিয়ম অনুযায়ী সব পরিবারেই সময়ে সময়ে জন্ম নেয় কিছু কুলাঙ্গার, এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।

অতএব চিকন আলীর বাপ-চাচারা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি কখনো। তারা মেতে উঠলো পরস্পরে, হাড়ি আর চুলা পৃথকীকরণের মরণ কসরতে। ধর্ম-রক্তের সম্পর্ক চুকিয়ে দেয়ার কসরতে।

সে-ও আজ থেকে ৪৯ বছর আগের কথা। আর তখনই দূর আত্মীয় কালীর বংশধর বলরাম, বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত, অতি দরদী একটি বাঁশ।
বললো, ধরো। এ-হবে তোমাদের নতুন ঘরের খুঁটি।

চিকন আলী দেখেছিলো, খুঁটিতে সাতটি গোপন ঘূণপোকা। সে এ-ও বুঝেছিলো, এই ঘুণপোকা তার ঘরের অপর সমস্ত খুঁটিগুলোকে একটার পর একটা খেয়ে অকার্যকর কোরে ফেলবে। কিন্তু পরিস্থিতির উল্লোঘুল্লো ঝাপটা বাতাসে ‘সাহায্য’কে অগ্রাহ্য করতে না পারার বেদনায় বাঁশটি হাতে নিতেই মূর্ছা যায় চিকন আলী।

বলরাম ঠিকই বুঝেছিলো, এই মূর্ছা যাওয়ার হেতু; কিন্তু বোঝেনি চিকন আলীর সাঙ্গপাঙ্গরা!

জ্ঞান ফিরে চিকন আলী ভেবেছিলো, এ-যাত্রা পার হলে সময়-সুযোগ মতো ধীরে ধীরে ঘুণে ধরা খুঁটিটি বদল কোরে নিবে সে। কিন্তু বিধিবাম! চিকন আলীর ভাগ্যে সে-সুযোগ আর এলো না।

অথচ চিকন আলীর বংশধররা এখন শুনছে— আসলে ওই ‘বাশঁ’টি নাকি ‘সাহায্য’ ছিলো না, ছিলো ‘ঋণ!’ আর সেই ঋণের পরিমাণ আজ সুদে-আসলে, ফুলে-ফেঁপে এতটাই বিকট রূপ ধারণ কোরেছে যে, চিকন আলীর বংশধরদের এখন পরম্পরায় শুধু জন্ম নিতে হবে আর বেঁচে থাকতে হবে—
কেবল মাত্র ‘ঋণ’ শোধরাতে!

খবর হলো: অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে বংশধররা সেই ঋণ অনন্তকাল ধরে শোধ কোরেই চলেছে। কিন্তু কেউ-ই জানেনা, চিকন আলীর আত্মা উত্তরসুরীদের এহেন ‘চেতনা’ দেখে তৃপ্ত কি না!

বেনজীন খান

লেখক, চিন্তক ও সমাজকর্মী। যশোরের বাসিন্দা।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top