আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

যোগেন মণ্ডলের উত্তরকাণ্ড (১৯৪৭-১৯৬৮)

।। সৌরভ রায় ।।


পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী যোগেন মণ্ডলকে ‘মুসলিম-তফশিলি জোট রাজনীতির ব্যর্থ প্রচারক’ বলে বর্ণনা করে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক সক্রিয়তার ইতিহাসচর্চাকে খারিজ করতে হিন্দুত্ববাদীরা। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে মাত্র হাতে গোণা কয়েকজন লেখক, ইতিহাসবীদ, সমাজতাত্ত্বিক লেখালেখি করেছেন। হিন্দুত্ববাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যোগেন মণ্ডলকে নিয়ে প্রতিপক্ষে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন সৌরভ রায়। ‘যোগেন মণ্ডলের পূর্বকাণ্ড (১৯৩৭-৪৭)’ প্রকাশিত হবার পর আজ প্রকাশিত হলো ‘যোগেন মণ্ডলের উত্তরকাণ্ড (১৯৪৭-১৯৬৮)’।

দেবেশ রায়ের ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ আর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যোগেন মণ্ডলের একাকিত্ব’ এই দুটি লেখার কাঁধে ভর করে এর আগে আমরা পড়েছিলাম যোগেন মণ্ডলের পূর্বকাণ্ড (১৯৩৭-১৯৪৭)। এই পর্বে আমাদের সহায়ক অন্বেষা সেনগুপ্তের ‘Partition and Dalit Politics in Bengal: The Figure of Jogendra Nath Mandal’, দ্বৈপায়ন সেনের ‘The Decline of the Caste Question : Jogendranath Mandal and the Defeat of Dalit Politics in Bengal’। পাশাপাশি ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ হিসাবে এই পর্যালোচনায় উঠে আসবে ১৯০৯ সালের ‘প্রবাসী’ পত্রিকার পাতা থেকে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘নমশূদ্রের কথা’ আর বিনোদলাল ঘোষ বি.এল.-এর ‘নমঃশূদ্র জাতির প্রতি আমাদের কর্তব্য কি?’ দেবেশ রায়ের ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ আর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যোগেন মণ্ডলের একাকিত্ব’ এই দুটি লেখা।  এগুলোর মাধ্যমে আমরা যোগেন মণ্ডলের উত্তরকাণ্ড অর্থাৎ ১৯৪৭-১৯৬৮-এ প্রবেশ করব। কিন্তু এর আগে যোগেন মণ্ডলের এগারো বছরের কিসসা আমরা ব্যাখ্যা করেছি বলে এই বাইশ বছরের যোগেনপুরাণ যে খুব চটপট সেরে ফেলা যাবে তা নয়, কারণ আমাদের অনেক উলটপুরাণের সম্মুখীন হতে হবে। আমি এর আগের পাঠপ্রতিক্রিয়ায় যোগেনের নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ নির্মাণকাজের ঘোর ব্যর্থতার কারণ নিয়ে কিছু যুক্তিক্রম সাজিয়েছিলাম।  সেই রাজনীতির প্রাথমিক শর্ত ছিল নমঃশূদ্র হিসাবে নিজেদের পৃথক রাজনৈতিক পরিচয় তৈরি এবং মুসলিম-তফশিলি জোট রাজনীতির জমি প্রস্তুত করা। এই দুই সম্ভাব্য শক্তিবলয় তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির দাবার ছক উলটে দিতে পারলেও পারতো। যোগেন মণ্ডলের চোখধাঁধানো জয়, তাঁর পক্ষতলে নমঃশূদ্রদের এক বিরাট সংখ্যার সমর্থন, তাঁর মাথায় নানারঙের নানা বড় নেতাদের স্বতঃস্ফুর্ত প্রাথমিক আশীর্বাদ, সবই ছিল। এই যৌথঅভিজ্ঞান ও যূথশক্তিকে নিজের কবলে আনার জন্য তাঁর পালে নানা রকম বাঘ পড়া সত্ত্বেও তিনি ভুল নেতার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। বিবিধ আকচাআকচি থেকে সমদূরত্ব রাখার মাধ্যমে যোগেন মণ্ডল এমন এক রাজনীতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যা অতিসহজবোধ্য। কারণ “হিন্দুদের লড়াই তো একটা ফ্রন্টে – ব্রিটিশরাজের সঙ্গে। আর মুসলমানদের লড়াই তিন ফ্রন্টে – সামনে ব্রিটিশ, ডাইনে হিন্দুরা আর বাঁয়ে মোল্লারা।’ … তাইলে আমাগো, চাঁড়ালগো, শিডিউলগো, কয়ডা লড়াই? সামনে সাহেব। ডাইনে হিন্দু। আর বাঁয়ে মোল্লা? তাইলে মুসলমান আর চাঁড়ালগো লড়াই তো একডাই দাঁড়ায়।”( রায়, পৃষ্ঠা ২৬৯)।

আমাদের খুব চেনা ও বহুআলোচিত এই যুক্তিক্রম, ১৯৩২-এর ‘কম্যুনাল অ্যাওয়ার্ড’-এর অনেক আগেই পেকে উঠেছিল। সংখ্যা-রাজনীতির হিসাবকিতাবও উচ্চবর্ণের ভদ্রলোকরা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন, “পূর্ববঙ্গে মুসলমানগণের তুলনায় হিন্দুগণের সংখ্যা অতীব অল্প এবং হিন্দুগণের মধ্যে নমঃশূদ্রের সংখ্যাই অধিক। (যথা) ফরিদপুর জেলার সমস্ত অধিবাসীগণ মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা মাত্র শতকরা ৩৭ জন এবং ইহার মধ্যে উচ্চবর্ণের হিন্দুর সংখ্যা এত ক্ষুদ্র যে তাহাদের অস্তিত্ব একরূপ অণুবীক্ষণ দ্বারা উপলব্ধি করিতে হয়…”

তবু দশচক্রে ভগবান কেন ভূত হয়েছিলেন? পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দোরোখা যুক্তি বলে যোগেন একই সাথে মুসলিম নেতৃমণ্ডলী ও তফসশিলি নেতৃমণ্ডলী দুই পক্ষেরই বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। “মুসলিম নেতারা মুখে যাই বলুন, এবং জিন্না যতই যোগেন মণ্ডলকে তুরুপের তাস হিসেবে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে চালাবার চেষ্টা করুন, মুসলিম লিগের বঙ্গীয় নেতারা কিন্তু তফসিলি জাতিদের আনুগত্যের ব্যাপারে মোটেই নিশ্চিত ছিলেন না। হারুন-অল-রশিদ সংকলিত মুসলিম নেতাদের চিঠিপত্র থেকে দেখছি, সোহরাওয়ার্দি ১৯শে মে ১৯৪৭ তারিখে লিয়াকত আলিকে বেশ উৎসাহের সঙ্গে লিখছেন, ”যোগেন মণ্ডলের সাথে দীর্ঘ কথা হলো। আমরা বোধহয় ওঁর সম্বন্ধে অনাবশ্যক হতাশ হয়েছিলাম। উনি বর্ধমান, খুলনা ও ২৪-পরগণায় খুব ভালো মিটিং করেছেন।  সেখানে তফসিলি জাতিদের শীঘ্রই আমাদের দিকে নিয়ে আসা যাবে বলে মনে হয়।” আবার মাত্র দু’দিন বাদে, ২১শে মে তারিখে, তিনি ঠিক উলটো কথা লিখছেন! অনুমান করা যায় অন্য সূত্রে ইতিমধ্যে খবর পেয়ে তাঁর আগের মত বদলাতে হয়েছে। এবার লিখছেন, ”একমাত্র বর্ধমান ডিভিশনে দুটো মিটিং ছাড়া আর কোথাও আমরা তফশিলি জাতিদের সঙ্গে মিটিং করতে পারিনি। তাছাড়া তাঁদের মধ্যে কিছুটা সাড়া জাগাতে সক্ষম হলেও তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সকলেই বাংলার পার্টিশনের পক্ষে ভোট দেবে। শুধু তাই নয়, ভারত-পাকিস্তান ভাগ নিয়েও এবার ঘোষণা হয়ে গেলে, বর্ণহিন্দু বা তপশিলি কারো মতই আমাদের পক্ষে থাকবে না। এই নিয়ে যদি মারামারি হয়, পশ্চিমবাংলার মুসলিমরা সম্পূর্ণ মুছে যাবে, কেউ তাদের বাঁচাতে পারবে না। একই ভাবে, পূর্ব বাংলার হিন্দুরা একেবারে মুছে যাবে। আমরা যতই বর্ণহিন্দু আর তফশিলিদের মধ্যে তফাৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করি না কেন, সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হলে কোনো তফাৎ বজায় থাকবে না। ক-দিন আগেই কুমিল্লা আর নোয়াখালীতে মুসলিমরা তফশিলি হিন্দুদের আক্রমণ করেছিল, ঠিক যেমন কলকাতা আর বিহারের হিন্দুরা কংগ্রেসি মুসলমানদেরও আক্রমণ করেছিল।” (চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৬৫) আবার এদিকে “তফশিলি সমাজের ভেতর বাংলা ভাগ নিয়ে বিতর্কে যোগেন্দ্রনাথ নিশ্চিতভাবে পরাজিত হলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি যুক্তি দিলেন, বাংলা যদি ভাগ হয় তাহলে পূর্ববঙ্গে বিত্তশালী বর্ণহিন্দুরা অনায়াসেই পশ্চিমে এসে নতুন করে বসবাস করতে পারবে, কিন্তু হতদরিদ্র তফশিলিরা কোথাও যেতে পারবে না। উচ্চবর্ণহীন পূর্ববঙ্গে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের হাতে মারা পড়বে। উত্তরে রাধানাথ দাস নোয়াখালির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে লিখলেন, আমরা যদি পশ্চিমবাংলার পক্ষ থেকে নোয়াখালির নমশূদ্রদের আহ্বান করি এদিকে চলে আসার জন্য, তাহলে যোগেনবাবু তাঁর স্বজাতির একজনকেও নোয়াখালিতে ধরে রাখতে পারবেন না। দরিদ্র তফশিলিরাই বরং অনেক সহজে নিজেদের বাসস্থান বদলাতে পারে, কারণ তাদের সম্পত্তি বলে কিছুই নেই।”(চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭) সর্বৈবভাবে ভয়ঙ্কর ভুল যুক্তি, কিন্তু সেটাই বহাল হয়ে গিয়েছিল, সেই সময়। কিন্তু দ্বৈপায়ন সেনের গভীর গবেষণা ও যুক্তিক্রম আমাদের দেখায় যে স্বাধীন পাকিস্তানের মন্ত্রীসভার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও যোগেনের সার্বিক পরাজয় ও অবহেলিত কপর্দকহীন মৃত্যু ইতিহাসের কঠোর রথচক্রের পেষণ, রাজনৈতিক কাকতাল, বা সামাজিক সমাপতন কোনটাই নয়। তা সংগঠিত প্রচেষ্টায় যোগেন মণ্ডল ও তাঁর রাজনীতির ওপর নামিয়ে আনা এক নিষ্ঠুর নিয়তি। কন্সপিরেসি থিওরি বা ট্র্যাজিক হিরোইজম বা মহান আত্মবলিদানের সহজবোধ্য ছকের বাইরে গিয়ে আমাদের এই নিষ্ঠুর নিয়তির বস্তুবাদী স্বরূপকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তার জন্য আমার আগের লেখায় স্বজ্ঞানে অথবা অজান্তে তৈরি কিছু প্রতিপাদ্যকে আমাদের ভাঙতে হবে। যেমন, আগের লেখায় একটা ঝাপসা প্রতিপাদ্য দেওয়া হয়েছে যে বাংলার নমঃশূদ্রের সত্তারাজনীতি চেতনা ১৯২৫-এর মতুয়াপন্থা হয়ে ১৯৩৭-পরবর্তী যোগেনপন্থার দিকে বয়ে যেতে চেয়েছিল, তার আগে নমঃশূদ্রের সত্তারাজনীতি সুষুপ্ত ছিল। আর মতুয়াপন্থার উদ্ভবের অর্থনৈতিক কারণ হিসাবে দেবেশ রায় দেখিয়েছেন বাংলায় পাটচাষের প্রচলন ও তৎসঞ্জাত মুষ্টিমেয় নমশূদ্রদের আর্থিক সমৃদ্ধি। কিন্তু ১৯০৯ সালের ‘প্রবাসী’-তে এক ‘হিতৈষী সমাজসচেতন’ সাবর্ণের বয়ানে আমরা পড়ি, “পূৰ্ববঙ্গের নমঃশূদ্রের সমস্যা প্রতিদিন কী আকার ধারণ করিতেছে তাহা সকলেই জানেন। (দ্বৈপায়ন সেন উল্লেখ করেন ১৮৭২ সালে নমঃশূদ্রদের সংগঠিত এক বর্ণহিন্দু বয়কট, পৃ ৬)…এই সমস্ত দলের সভা সমিতি কাগজ পত্রে একটা কথা – খুব স্পষ্ট দেখা যায় এই যে হিন্দু সমাজের সঙ্গে কোনোরকম বিরোধ করা তাহাদের উদ্দেশ্য নহে—ইহারই আশ্রয়ে একটু সম্মানের সহিত তাহারা থাকিতে চায়।… নমঃশূদ্রদের এই আন্দোলনকে যাহারা হুজুগ বলিয়া উড়াইয়া দিতে চান, তাদের এই পর্যন্ত বলিতে পারি যে তাদের মধ্যে যে উৎসাহ দেখা যায় তাহা অনেক শিক্ষিত ভদ্রসমাজেও দুর্ল্লভ।…মনে রাখা দরকার ইংরেজ আমাদিগকে চিরায়ত্ত রাখিবার জন্য আমাদের কোন ছিদ্র পাইলেই স্বভাবতই তাহার সুযোগটুকু লইবার চেষ্টা করে। মুসলমান ইতিপূর্বে তাহার হাতে ধরা দিয়াছে, এখন যদি আমরা নমঃশূদ্রদের ন্যায্য অধিকার লাভে বাধা দিই তাহা হইলে একদিন সময় বুঝিয়া তাহারাও হিন্দুসমাজকে আঘাত করিতে ছাড়িবে না।… প্রার্থনা যে তাহারা এই সমস্যাটিকে বিশেষভাবে মীমাংসা করিবার ভার লউন। পূর্ববঙ্গের স্থানে স্থানে অবস্থা ক্রমেই সঙ্কটাপন্ন হইয়া উঠিতেছে। আমরা স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি স্থানে স্থানে ভদ্রলোক ও নিম্নশ্রেণীর মধ্যে বিশেষ মন কষাকষি চলিতেছে, তবে এখনো তাহা কাজে প্রকাশ পায় নাই। নিজের ঘরেই যখন আগুন লাগিবার সম্ভাবনা তখন ঝগড়া করিয়া শক্তি এবং সময় নষ্ট করিলে এমনি কি লাভ হইবে?” (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়)

আমাদের খুব চেনা ও বহুআলোচিত এই যুক্তিক্রম, ১৯৩২-এর ‘কম্যুনাল অ্যাওয়ার্ড’-এর অনেক আগেই পেকে উঠেছিল। সংখ্যা-রাজনীতির হিসাবকিতাবও উচ্চবর্ণের ভদ্রলোকরা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন, “পূর্ববঙ্গে মুসলমানগণের তুলনায় হিন্দুগণের সংখ্যা অতীব অল্প এবং হিন্দুগণের মধ্যে নমঃশূদ্রের সংখ্যাই অধিক। (যথা) ফরিদপুর জেলার সমস্ত অধিবাসীগণ মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা মাত্র শতকরা ৩৭ জন এবং ইহার মধ্যে উচ্চবর্ণের হিন্দুর সংখ্যা এত ক্ষুদ্র যে তাহাদের অস্তিত্ব একরূপ অণুবীক্ষণ দ্বারা উপলব্ধি করিতে হয়। ১৯০১ সনে আদমসুমারী রিপোর্ট হইতে নিম্নে যে তালিকা প্রদত্ত হইল তাহা দ্বারাই পূর্বোক্ত উক্তির সত্যতা সম্যকরূপে প্রতীত হইবেক। জেলা ফরিদপুরে হিন্দুর সংখ্যা ৭৩ ৩৫৫,  ইহার মধ্যে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুর সংখ্যা, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ও বৈদ্য ১৪ ১৬৮, নমঃশূদ্রের সংখ্যা, ৩,২৪ ১৩৫ মুসলমান ১ ১৯ ৯৩৫৭। মোট জনসংখ্যা ১৯ ৩৭ ৬৪৪। ইহা হইতে স্পষ্টরূপে দৃষ্ট হইতেছে যে ফরিদপুর জেলার হিন্দুগণের প্রধান শক্তি নমঃশূদ্রগণ।” (শ্ৰীবিনোদলাল ঘোষ, বি. এল.) অর্থাৎ আমার আগের ঝাপসা প্রতিপাদ্য, বাংলার নমঃশূদ্রের পরিচিতিসত্তার রাজনীতি চেতনা ও তার বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সাবর্ণ পরিচিতিসত্তার রাজনীতি ১৯২৫ নাগাদ জেগেছিল তা ভুল। আমার আগের লেখার আরেকটি ঝাপসা প্রতিপাদ্য ছিল যোগেন মণ্ডলের অনুচ্চারিত বামপন্থা যা তাঁর সুভাষপ্রীতি ও বামপন্থী তাত্বিকতার মধ্যে দিয়ে উদ্ভাসিত। যদিও আমি লিখেছিলাম যে, যোগেন মনে করতেন না শ্যাখ-শুদ্দুর সহমতি শ্রেণীমৈত্রী। বামপন্থীদের মেধা ও তাঁদের তত্ত্বের প্রতি যোগেন বৌদ্ধিক ভাবে সশ্রদ্ধ ছিলেন, কিন্ত তাঁদের যুক্তি-অতিনির্ভরতা ও বর্ণ-অন্ধত্ব তাঁর নজর এড়ায়নি। কংগ্রেসের বকলমী হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে, কংগ্রেস-হিন্দুমহাসভার অঘোষিত জোটের অঘোষিত নেতা শ্যামাপ্রসাদের হিংসাবাদের বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে যোগেনপন্থাকে খাড়া করার সময় যদি আমরা শিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের সাথে বামপন্থীদের অঘোষিত জোটের স্বতঃসিদ্ধতা ধরে নিই, তা খুব ভুল হবে। কারণ  দ্বৈপায়ন সেনের গবেষণায় এই সত্য সম্যকভাবে লব্ধ যে, স্বাধীনতার আগে, পাকিস্তানের মন্ত্রী হওয়ার আগে যোগেন মণ্ডলের শিডিউল রাজনীতির পথরোধ ঠিক যে ভাবে করেছিল কংগ্রেসি-নিমকংগ্রেসি-হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি, পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পরে, উদ্বাস্তু রাজনীতির রণাংগনে পুনঃপ্রবেশ করার সময় তাঁর পথরোধ করে ঠিক সেইভাবেই দাঁড়ায় বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি। উদ্বাস্তু রাজনীতির বাজি জিততে বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি যে যেকোন নৃশংস মূল্য দিতে প্রস্তুত ছিল, এই প্রতিপাদ্য শুধু প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তীর-ই নয়,  দ্বৈপায়ন সেনেরও। তাহলে আমার এর আগে তৈরি দুটি ঝাপসা প্রতিপাদ্যকে – নমঃশূদ্রসত্তার রাজনীতি মতুয়াপন্থা-উদ্ভব-পূর্ববর্তী-অনস্তিত্ব ও শিডিউলপন্থা-বামপন্থার অঘোষিত সলিডারিটি ইত্যাদি নাকচ করে আমরা ফিরে যাব দেবেশ রায়ের ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’-এর শেষ পাতায়।

আইন ও শ্রমমন্ত্রী হয়ে পাকিস্তান গেলেন বর্ণহিন্দুর ঘৃণা-আইকন ‘যোগেন মোল্লা’। সেই বর্ণহিন্দু যারা “হিংসুটে, তালেবর, ছুঁকছুঁকে, সবজান্তা, গোঁড়া, হাফ-স্বদেশী, এন্টি-মুসলিম কিন্তু… চাকরির সুবাদে এন্টি-হিন্দুও, নিঃসংশয়ে ঘুষখোর… এরাই সেই নতুন শ্রেনী… যাদের ওপর বাংলার রাজনীতি নির্ভর করছে বা করবে” (রায়, পৃষ্ঠা ৪১১)। তারপর? অন্বেষা সেনগুপ্তের ‘Partition and Dalit Politics in Bengal: The Figure of Jogendra Nath Mandal’-থেকে তুলে নেব আমরা কিছু সার অংশ। যোগেন মণ্ডলের স্বতন্ত্র রাজনীতি নির্মাণপ্রচেষ্টাকে যে তখনকার প্রতিষ্ঠিত সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিই হয় ‘ধোবি-কা-কুত্তা-না-ঘরকা-না-ঘাটকা’ বা ভোটরাজনীতির সাংখ্যযৌগিক টোটকা হিসাবে দেখেছিল, সেই সত্য আরও মর্মান্তিক ভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর পাকিস্তানপর্বের দিকে চোখ রাখলে। সেখানেও তিনি সদ্যোজাত ইসলামিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের সোনার পাথরবাটি সেকুলারত্ব প্রমাণ করার এক ‘হিন্দু’ টোকেন। তাঁর চিহ্নশক্তি বা সিম্বলিক ক্যাপিটাল জিন্নাতন্ত্রের কাছে এতটাই দামী যে পাকিস্তান মন্ত্রীসভার প্রথম অধিবেশনের পৌরোহিত্য করতে তাঁকে আহ্বান করা হয়, তাঁর জন্মদিন ‘যোগেন মণ্ডল দিবস’ (১৯ জুন, ১৯৪৯) হিসাবে পালিত হয় মহাসমারোহে – রাষ্ট্র জুড়ে, রাষ্ট্রীয় প্রেরণায়, সরকারি তহবিলের খরচায়। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ তপশীলী জাতিভুক্ত – অতএব তাঁদের আনুগত্য, ভোট ও পাকিস্তানের জমিতে স্থিতি বজায় রাখতে যোগেনের মত জোরালো অভিজ্ঞান কিছু হতে পারত না।

কিন্তু একের পর এক দাঙ্গা উদ্ঘাটিত হল সদ্যোজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রের তথাকথিত সেকুলার বিবেকের সামনে, আর যোগেন মণ্ডলের কাছে উত্তরোত্তর দুরূহ হয়ে উঠলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের অমুসলিম হিতৈষণার ম্যাসকট-এর চরিত্রে অভিনয় করা। আম্বেদকরের আশীর্বাদ এ কারণে তিনি পান নি। বিশেষত ১৯৫০-এর ফেব্রুয়ারীতে খুলনার রায়টে যখন মুসলমানদের আক্রমণের নিশানা হল নমঃশূদ্ররা, চুপ থাকা অসম্ভব হয়ে উঠলো তাঁর পক্ষে। শ্যাখ-শুদ্দুর সলিডারিটির স্বপ্ন তখন সুদূরপরাহত। মন্ত্রীসভার সদস্য হয়ে রাষ্ট্রের মুখরিত নিন্দার স্পর্ধা দেখানোয় ধীরে ধীরে কোনঠাসা হতে হলো তাঁকে। জিন্নার মৃত্যুর পরে তাঁর পাকিস্তানের চোখের মণি থেকে চক্ষুশূল হবার পদ্ধতি আরও ত্বরান্বিত হলো, মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের অনিবার্যতা স্পষ্ট হলো। মুসলিম লীগ কংগ্রেসকে ‘বর্ণহিন্দুদের আখড়া’ বলে চিরকাল গালি দিয়ে এসেছে, ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর তফশিলী জনতার অধিকার প্রসঙ্গে নিজেদের অনেক উদার ও উন্নত প্রমাণ করতে চেয়েছে, এবং তাকে শুধু বাগাড়ম্বর বলা অন্যায় হবে। অন্বেষা সেনগুপ্ত পর্যালোচনা করে দেখান যে অস্পৃশ্যতা কে আইনতঃ দন্ডনীয় ঘোষণা করা বা তফশিলীদের জন্য আলাদা ইলেক্টরেট ঘোষণা করা অন্ততঃ কাগজে-কলমে করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে হিতের চেয়ে তার বিপরীতই হয়েছিল বেশি।

পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের বর্ণহিন্দু ও নমশূদ্রদের মধ্যে ভেদরেখা আরও গভীর হয়েছিল। এর মধ্যেই মণ্ডলের ডানা ছাঁটার জন্য যোগেন মণ্ডল-বিরোধী তফশিলী রাজনীতির প্রতিনিধি দ্বারকানাথ বারোড়ি তড়িঘড়ি নিয়োজিত হলেন সংখ্যালঘু দপ্তরের মন্ত্রী হিসাবে। বারোড়ি পাকিস্তানের তফশিলী-স্বার্থের নবভাগ্যবিধাতা হিসাবে তাঁর নিয়োজনের প্রতিদান দিলেন যোগেন মণ্ডলের পদত্যাগের সময় পাঁচ পাতার এক বয়ান লিখে। সেখানে যোগেন মণ্ডলের দ্বারা নমঃশুদ্রদের জান-মাল-জমি রক্ষা করার সমস্ত সরকারি প্রচেষ্টাকে আঙুল-ফুলে-কলাগাছ এক নিচুজাতীয়ের তাঁর  নিজের জাতভাইদের বেআইনী ভাবে ত্রাণের টাকা পাইয়ে দেবার এক নোংরা প্রচেষ্টা বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। মণ্ডলকে ‘হিন্দুমহাসভার চর’ বলতেও বারোড়ি রেয়াত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। পাকিস্তান থেকে ভগ্নমনোরথ হয়ে ফিরে আসার পরে হিন্দুস্তানের নেতৃবৃন্দ যোগেন মণ্ডলকে সম্বর্ধনা দেবার বদলে যে হিংস্র উল্লাসপূর্ণ ধিক্কারে মেতে উঠবে তা বলাই বাহুল্য। নেহরু বলেন, ভারতের গভীর দুর্দশার কালে যে মানুষ আগাগোড়া পাকিস্তানের পাশে থেকেছেন, তাঁর প্রতি দেশবাসীর যে এক বিন্দু আস্থাও বাকি নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি সমসাময়িক ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, নমঃশুদ্র উদ্বাস্তুদের মধ্যেও নাকি তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা চিড় খেয়েছিল। ফেরার পরে শিয়ালদা স্টেশনে উদ্বাস্তুদের মিছিলের আগে দেওয়া এক ভাষণে তিনি যখন বলেন দেশভাগ বর্ণহিন্দুদের আতঙ্কের ফল কিন্তু তা ভুগছে নমঃশুদ্ররা, তাতে নাকি সমবেত শ্রোতাদের থেকে সম্মিলিত বিরক্তিসূচক প্রতিক্রিয়া আসে যা মিছিলের দানা বেঁধে ওঠা প্রায় ভেস্তে দেয়। পরে বি.পি.আই ও ইউ.সি.আর.সি-র নেতারা এসে সেই ক্ষোভ প্রশমিত করে মিছিল তয়ের করেন।

অন্বেষা সেনগুপ্ত বলেন যে, বাংলার বুকে জাতের রাজনীতি তখন উদ্বাস্তুদের ঝেড়েবেছে আলাদা করার কাজে বেশী লাগসই ছিল, নমশূদ্রদের এককাট্টা করার জন্য নয়। এখানে আমাদের মনে করতে হবে প্রফুল্ল চক্রবর্তীর পূর্বপাকিস্তানাগত বাঙালী হিন্দু উদ্বাস্তুদের তিন শ্রেণীবিভাজন – প্রথম, উচ্চবিত্ত যারা অনেককিছু খোয়ালেও তাদের বাকি সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আগের জীবনমান ফিরে পেয়েছে, দ্বিতীয়, মধ্যবিত্ত যারা দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দখলীকৃত কলোনির একটুকরো ছাদ ও জীবিকা খুঁজে পেয়েছে, তৃতীয়, নিম্নবিত্ত যারা বাংলার বাইরের রিফুজী ক্যাম্পে চালান হয়েছে – পালিয়ে এসেছে – লড়েছে – হেরে গেছে। তাদের বাস্তুহারা স্বত্ব তখন বামপন্থী শ্রেনীচেতনায় সংরক্ত, জাতের হিসেব মুছে গেছে।  দেবেশ রায় তাঁর ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ কেতাবে আম্বেদকরকে প্রায় অদৃশ্য রাখেন যোগেন মণ্ডলের কাহিনীনায়কত্ব বজায় রাখতে। কিন্তু দ্বৈপায়ন সেনের ‘The Decline of the Caste Question : Jogendranath Mandal and the Defeat of Dalit Politics in Bengal’ -এ আম্বেদকর যোগেন মণ্ডলের রাজনৈতিক পূর্বজ (অল ইন্ডিয়া শিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা) হিসাবে পর্বে পর্বে উপস্থিত। যদিও মণ্ডল-আম্বেদকর তুলনামূলকতা বিশ্লেষণী যন্ত্র হিসাবে দ্বৈপায়ন সেনের তর্কক্রমের ক্ষেত্রে খুব জরুরি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান দলিত রাজনীতির জমি বুঝতে তা হয়তো পদে পদে অতটা জরুরি নয়। কিন্তু বাংলায় দলিত রাজনীতির বর্তমান নিরালম্বতা – দেশের সবচেয়ে বেশী দলিতপ্রধান রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও – যে বর্ণহিন্দু রাজনীতির বিভিন্ন বিপ্রতীপ ইডিওলজির সংহত প্রচেষ্টার সচেতন সাধনার ধন, শ্রীসেনের সেই প্রতিপাদ্য আমাদের অনুধ্যানের বিষয় – বাংলার মাটিতে গেরুয়াবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির অবকাঠামোয় দলিত রাজনীতির অবস্থান কোথায় তা বোঝার জন্য।  দ্বৈপায়ন সেনের বইয়ের একটা বড় অংশ দেবেশ রায়ের গবেষণার সমান্তরাল, বিশেষতঃ যোগেনের পূর্বকাণ্ড ও তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।

পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের বর্ণহিন্দু ও নমশূদ্রদের মধ্যে ভেদরেখা আরও গভীর হয়েছিল। এর মধ্যেই মণ্ডলের ডানা ছাঁটার জন্য যোগেন মণ্ডল-বিরোধী তফশিলী রাজনীতির প্রতিনিধি দ্বারকানাথ বারোড়ি তড়িঘড়ি নিয়োজিত হলেন সংখ্যালঘু দপ্তরের মন্ত্রী হিসাবে। বারোড়ি পাকিস্তানের তফশিলী-স্বার্থের নবভাগ্যবিধাতা হিসাবে তাঁর নিয়োজনের প্রতিদান দিলেন যোগেন মণ্ডলের পদত্যাগের সময় পাঁচ পাতার এক বয়ান লিখে। সেখানে যোগেন মণ্ডলের দ্বারা নমঃশুদ্রদের জান-মাল-জমি রক্ষা করার সমস্ত সরকারি প্রচেষ্টাকে আঙুল-ফুলে-কলাগাছ এক নিচুজাতীয়ের তাঁর  নিজের জাতভাইদের বেআইনী ভাবে ত্রাণের টাকা পাইয়ে দেবার এক নোংরা প্রচেষ্টা বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। মণ্ডলকে ‘হিন্দুমহাসভার চর’ বলতেও বারোড়ি রেয়াত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। পাকিস্তান থেকে ভগ্নমনোরথ হয়ে ফিরে আসার পরে হিন্দুস্তানের নেতৃবৃন্দ যোগেন মণ্ডলকে সম্বর্ধনা দেবার বদলে যে হিংস্র উল্লাসপূর্ণ ধিক্কারে মেতে উঠবে তা বলাই বাহুল্য।

যোগেনের জীবনের শেষ বাইশ বছর (১৯৪৭-১৯৬৮) আমাদের পাঠচক্রের উদ্দেশ্যের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বছরগুলির বৃত্তান্ত পতন-মূর্চ্ছা-ও-মৃত্যু এই ঘটনাক্রম দিয়ে সারা যায় না, কারণ তিনি এই সময়সীমায় সব অবসাদ ঝেড়ে ফেলে প্রতিকুল রাজনৈতিক সমুদ্রে গুণ টেনে নিজের রাজনীতির আরেক অভিজ্ঞান তৈরি করেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ যোগেনের রাজনৈতিক জীবনের পূর্বকাণ্ডের এক ভিন্নপাঠ, যা দ্বৈপায়ন সেন বহুপরিশ্রমে তৈরি করেন – যেখানে তাঁর অন্যতম সহায়ক যোগেন মণ্ডলের আত্মজীবনীর অপ্রকাশিত খসড়া।  দ্বৈপায়ন সেনের ভিন্নপাঠের সবচেয়ে মহার্ঘ প্রাপ্তি, অন্তত আমার মতে, এক ইতিহাসভিত্তিক আশাবাদ। অদ্যাবধি আমাদের নৈরাশ্যবাদী পাঠ যে বর্ণবাদীও বটে তা দ্বৈপায়ন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখান। আমার আগের লেখাও তাতে সমাকীর্ণ। যেমন এই উদ্ধৃতি – “কিন্তু সংখ্যার রাজনীতিকে সদর্থক ভাবে ব্যবহার করে মুসলমান-তপশিলি জোট বেঁধে ‘শক্তিসাম্যের নিয়ামক ও বাংলার ভাগ্যনির্ণায়ক’ (পৃষ্ঠা ৫৮৯) হবার দূরদৃষ্টি বলাই বাহুল্য বাকি ৩০ জন তপশিলি নেতার ছিল না। বর্ণহিন্দু প্রভুজাতি ‘তু’ বললে ছুটে যাওয়ার মজ্জাগত অভ্যাস, ও এই সুযোগে জাতে ওঠার লোভ তো ছিলই – যদিও যোগেন তাঁদের মনে করিয়ে দেয় যে বহু সচ্ছল নমশুদ্র বহু প্রজন্ম ধরে পইতে পরে ও বামুনদের দান করেও জাতে উঠতে পারেনি – তার থেকেও বেশী ভয় ছিল বর্ণহিন্দু প্রভুজাতি্দের ‘না’ বলার স্পর্ধা দেখালে তার ফলাফল কি হবে।” সাদা ভাষায় বললে ‘কুকুরের-পেটে-কি-ঘি-সয়’ মার্কা এই যুক্তিক্রম আমাদের নৈরাশ্যবাদী পাঠের ভিত্তি যা গড়া আমাদের বর্ণহিন্দু ঘৃণা থেকে- নমশূদ্রদের রাজনীতি আর কতই বা দূরদর্শী হবে, দলিত-মুসলিম নিজেদের কায়েমী স্বার্থ ছেড়ে কতই বা সলিডারিটি গড়বে, বেচারা দলিতরা বর্ণহিন্দুদের কুটিল ব্রাহ্মণ্যবাদের শিকার তো হবেই, চিৎকৃত হিংসক হিন্দুত্ববাদ তো গলার জোরে-গায়ের জোরে জিতবেই ইত্যাদি।  দ্বৈপায়ন সেন খুব সঠিক ভাবেইীর মাঝে এম.এন.শ্রীনিবাসের তথাকথিত তর্কাতীত সমাজবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ‘স্যাংস্ক্রিটাইজেশন’-এর দীর্ঘ ছায়া দেখেন।

এ তত্ত্ব বলে যে, নীচুজাত যখন জাতে ওঠার চেষ্টা করে তখন তারা মাছি-মারা-কেরানীর মত অন্ধভাবে উঁচুজাতের নকল করে, কারণ ‘মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা’। অতএব তাদের দশা অনেক সময়ই ময়ূরপুচ্ছধারী কাকের মত শোচনীয় হয়। যদিও  সম্প্রতি অভিজিত গুহ এম.এন.শ্রীনিবাসের এই তত্ত্বের ভিত যে ক্ষেত্রসমীক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে তার মান নিয়ে প্রশ্নের ঝড় তুলেছেন (https://www.epw.in/journal/2018/17/special-articles/scrutinising-hindu-method-tribal-absorption.html)। সে ঝড় থেকে দূরে দাড়িয়েও দ্বৈপায়ন সেন আমাদের দেখান যে যোগেন মণ্ডলের রাজনীতির শক্তি এতটাই প্রবল ছিল যে সেই প্রচেষ্টাকে দমন করতে তার বর্ণহিন্দু প্রতিপক্ষকে কত বছর ধরে, কত ভাবে, কত শক্তি ব্যয় করতে হয়েছিল। আর এই রাজনীতির শক্তি শুধু শ্রীমণ্ডলের ব্যক্তিমায়ায় নিহিত নয় – তাঁকে ট্র্যাজিক নায়ক কিংবা আদিপুরুষের রোম্যান্টিক সিংহাসনে বসালে শুধু ঐতিহাসিক সত্যের অপলাপই হয় না, ভবিষ্যতের আশাবাদী জোটরাজনীতিকেও অঙ্কুরে উন্মূলন করা হয়। যোগেনবিরোধী শক্তির ইতিহাসের এই বাখানকে কন্সপিরেসি থিওরি বা ভিক্টিমাইজেসন তত্ত্বের ছত্রছায়া থেকে বের করে আনার জন্য লেখক বর্ণহিন্দু রাজনীতির দলিত রাজনীতি-প্রতিক্রিয়াকে শুধু কায়েমী স্বার্থচালিত অন্ধত্ব বা সুবিধাবাদী অনৃতভাষণেরও বেশী কিছু – এক কগনিটিভ ডিসোনেন্স বা অচেতন অপ্রত্যভিজ্ঞ বলেছেন। যেমন আজও ভারতের ইতিহাসের মূলধারা নির্দ্বিধায় পাকিস্তান-উদ্ভবকে জিন্না নামক এক কুচক্রী, উন্মাদ, ব্রিটিশতোষী ব্যক্তির করা এক গণবশীকরণের ফল বলে মনে করে। বা বাংলা কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ পুনা প্যাক্টের সব সিদ্ধান্ত সজ্ঞানে সমর্থন করে ফিরে এসে দাবি করেন যে তাঁদের বিনাপরামর্শে এ সব করা হয়েছে। আম্বেদককরের দেওয়া তথ্যপ্রমাণ সব অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হয়। এই সুবিধাবাদী বিস্মরণ অংশতঃ ব্যক্তিমানবমনের দ্বারা অপ্রিয় স্মৃতির স্বাভাবিক অবদমনপ্রবণতার এক সামাজিক রূপ। ভারতের উচ্চবর্ণের নেতৃবৃন্দের জাতিবিভাজিত মানসলোকে নিম্নবর্নের সমানাধিকার অকল্পনীয়, তাঁদের দাবিসনদ এক উন্মাদের পাঠক্রম, কিন্তু সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে তারা বহু জন ও তাঁদের চাহিদা কান টেনে শক্তিতন্ত্রের মাথা হেলিয়ে আনে।যেমন কংগ্রেস নেতা শরতচন্দ্র বোস বলেছিলেন যে, “শিডিউল আইডেনটিন্টি এতো অবাস্তব আর ভুয়ো যে তা কোন আলোচনার যোগ্যই নয়।” (পৃ ৭৭) এই দুঃসহ ভুঁইফোঁড় স্পর্ধা সোনামুখে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সহ্য করা  অচেতন অপ্রত্যভিজ্ঞতার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়, ঠিক যেমন ব্রিটিশরা স্বশাসনাকাঙ্খী ভারতীয়দের আবেদনের প্রতিক্রিয়ায় করেছিলো। অতএব দেশভাগের নারকীয় তাণ্ডব, যা দলিতদের বাঁচাকে সবচেয়ে গভীরভাবে ঘা দিয়েছিল, তা দলিত রাজনীতির নির্মাণকে নিঃশেষে ভেঙ্গে ফেলার সুবর্ণসময় ছিল। বাংলার বুকে জাতপাতের অরাজনীতিকরণ উচ্চবর্ণের সম্মিলিত চেতন-অবচেতন ঈপ্সা দিয়ে গড়া।

দেবেশ রায়-লিখিত যোগেনের জবানিতে আমরা যে শুনি – “৩৭ থিক্যা এই ৪৬ নয়-দশ বছর জুইড়্যা পায়ের তলার চামড়ার ফোস্কা ফ্যালাইয়া ছাওয়াল-পাওয়ালগ লাইগ্যা দুইডা-একডা হস্টেল আর তাগ বাবাগ লাইগ্যা নিম্নপ্রকারের চাকরির সামান্য শতাংশ রিজার্ভ কইরতে মাত্র পারা গিছে।”(পৃষ্ঠা ১০২৩) তা সমুদ্রপ্রমাণ সম্ভাব্য পরিবর্তনের – চাষমালিকানার পরিবর্তন যা মুসলিম-নমশুদ্র সংহতি জোরালো করতে পারতো, শিডিউলদের জন্য শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা সংরক্ষণ – সবকিছুর গোস্পদ-পরিণাম কারণ পদে পদে সে সব কর্মকাণ্ডের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধশক্তি – একসাথে লড়াই করতে করতে বাকি শিডিউল কাস্ট নেতাদের যুদ্ধোদ্যমের দেউটি নিভে গেছে – হারাধনের একটি ছেলের মত লড়ে মরেছেন যোগেন। প্রবীণ তফশিলী নেতা মুকুন্দবিহারী মল্লিক (মেম্বার অফ লেজিসলেটিভ কাউন্সিল)-এর ১৯৩২ সালের এক মেমোরান্ডাম-এ দেখা যায় লাল ফিতের ফাঁসে জড়িয়ে মন্ত্রীসভার উচ্চবর্ণ সদস্যরা কিভাবে যোগ্য শিডিউল কাস্ট প্রার্থীদের ১৯২০ থেকেই সভা থেকে দূরে রেখেছেন আর তুলে এনেছেন অযোগ্য, অশিক্ষিত, পেটোয়া শিডিউল কাস্ট প্রার্থীদের – যেমন নিরক্ষর এক মেথরকে – যারা সভাজনের মাঝে হাস্যাস্পদ করবে নিম্নবর্ণের বামন হয়ে ক্ষমতার চাঁদে হাত দেবার উচ্চাশাকে। ধীরে ধীরে যাতে এই প্রতিপাদ্য গড়ে ওঠে, ওরা চাকরি করবে কি ওদের তো যোগ্যতাই নেই। মণ্ডল কমিশন থেকে আজতক সেই ‘মেরিট আর্গুমেন্ট’-এর ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। এখানে মনে পড়ে দেবেশ রায়ের বয়ানে সেই নমশূদ্র কন্সটেবলটির কথা যে চাকরির প্রথম দিনে উচ্চবর্ণের সহকর্মীদের কাছ থেকে একজোটে ভাত রান্না করায় বাধা পেয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। এই রকম কাণ্ড হামেশাই ঘটতো, পদে পদে বাধা পেত নিম্নবর্ণের নতুন জীবন গড়ার আশা। কম্যুনাল এওয়ার্ড ও পুনা প্যাক্টের পরে বর্ণহিন্দুর সুযোগ ও ক্ষমতা হারানোর দিশেহারা ভয় উপচে পড়ত একচেটিয়া ভাবে বর্ণহিন্দু পরিচালিত বাংলাদেশের বাংলা ও ইংরিজি কাগজের পাতায় পাতায়। শিডিউল ঘৃণা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, সমাজতাত্বিক গবেষণা, প্রাজ্ঞজনের অভিমত ইত্যাদি নানা ছদ্মবেশে ছাপা হত সেখানে। জনমতের চাপ এতটাই জোরালো ছিল যে তার বিরুদ্ধে লিখতে চেয়েও রবীন্দ্রনাথ সাহস করে তা লিখে উঠতে পারেননি (পৃ ৫০)। এবং তপশীলি নেতৃবৃন্দ – আম্বেদকর ও অন্যরা এই ঘৃণার বিরুদ্ধে যথা সম্ভব সরব ছিলেন। অতএব আমাদের ইতিহাস যখন বলে যে মুষ্টিমেয় গোঁড়া হিন্দুরা বা হিন্দুত্ববাদীরা এই ঘৃণার বাতাস বইয়েছিলেন, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।  লেখক একে এক সর্বব্যাপী বর্ণহিন্দু বিরোধিতার পাঁচিল বলে বর্ণনা করেছেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত সময়ের বাংলার শিডিউল রাজনীতি নিয়ে মূলধারার ইতিহাসবিদদের মতামত যে তা ছিল সম্পূর্ণ ভাবে বর্ণহিন্দুতোষী, সুবিধাবাদী। এখানে আমরা আবার দেখি দ্বারকানাথ বারোড়ি দ্বারা যোগেন মণ্ডলের চরিত্রহননের চেনা ছক যা ‘স্যাংস্ক্রিটাইজেশন’ তত্ত্বের সাথে খাপে খাপে এঁটে যায়। এমনকি দেবেশ রায়ের নভেলের যুক্তিক্রম মোটামুটি এই পথ ধরেই চলে। কিন্তু তথ্যভিত্তিক গবেষণা অন্য সত্য তুলে আনে। তার মানে এই নয় যে বাংলার শিডিউল রাজনীতির মধ্যে বর্ণহিন্দুতোষণ বা সুবিধাবাদ ছিল না, কিংবা যোগেন মণ্ডলের প্রচেষ্টার মান অসাধারণ ছিল না। তার মানে এই যে যোগেন মণ্ডল আগাগোড়া ঘরেবাইরে একা কুম্ভ ছিলেন না, তিনি এক বৃহত্তর রাজনীতির উজ্জ্বলতর জ্যোতিষ্ক ছিলেন। বাংলার শিডিউল রাজনীতির শুরু ও শেষ তাঁহাতে নয়। যেমন যে ল্যান্ড রিফর্ম বিল বাংলার লাখ লাখ নমশূদ্র চাষীদের ভাগ্য বদলে দিতে পারত ও তাঁদের সাথে মুসলমান চাষীদের শ্রেণীমৈত্রী জোরালো করতে পারত, সেই বিল পাশ করতে বাংলার শিডিউল সাংসদরা অক্লান্ত ছিলেন। বা ১৯৩৭ সাল এক বাজেট উদ্বৃত্ত বছর ছিল, এবং সেই উদ্বৃত্ত ধনকে প্রস্তাবিত শিডিউল উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ করার জন্য পুলিন বিহারী মল্লিকের মত লোকেরা চেষ্টার কোন কসুর করেন নি।  শিডিউল চাকরির বরাদ্দ কোটা যাতে কোনমতেই খালি না থাকে সে ব্যাপারেও তাঁদের চেষ্টার অন্ত ছিল না। কিন্তু সর্বস্তরে সর্বপ্রকারে গভীর অনাগ্রহের বাধা ঠেলে কোন কাজই বেশী দূর এগোতে পারেনি। যোগেন মণ্ডলের নিজের গ্রাম আগইলঝরায় নমশূদ্রদের জন্য ভেগাই মণ্ডল একাডেমি নামে স্কুল খোলার সময় মর্মে মর্মে টের পেয়েছিলেন সর্বাত্মক বিরোধিতা কী বিষম বস্তু, বিশেষ করে জোটঘোঁটরাজনীতিতে সচেতনভাবে কারোর দাবার ঘুঁটি হতে না চাইলে। দলিতদের সস্তা, নিঃশর্ত শ্রমের মালিকানা ছেড়ে, তাঁদের লেখাপড়া শিখিয়ে বাবু বানানোর আহাম্মকি করে বর্ণহিন্দুসমাজ নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়ুল মারতে একেবারেই রাজি ছিল না।

নেহরু বলেন, ভারতের গভীর দুর্দশার কালে যে মানুষ আগাগোড়া পাকিস্তানের পাশে থেকেছেন, তাঁর প্রতি দেশবাসীর যে এক বিন্দু আস্থাও বাকি নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি সমসাময়িক ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, নমঃশুদ্র উদ্বাস্তুদের মধ্যেও নাকি তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা চিড় খেয়েছিল। ফেরার পরে শিয়ালদা স্টেশনে উদ্বাস্তুদের মিছিলের আগে দেওয়া এক ভাষণে তিনি যখন বলেন দেশভাগ বর্ণহিন্দুদের আতঙ্কের ফল কিন্তু তা ভুগছে নমঃশুদ্ররা, তাতে নাকি সমবেত শ্রোতাদের থেকে সম্মিলিত বিরক্তিসূচক প্রতিক্রিয়া আসে যা মিছিলের দানা বেঁধে ওঠা প্রায় ভেস্তে দেয়। পরে বি.পি.আই ও ইউ.সি.আর.সি-র নেতারা এসে সেই ক্ষোভ প্রশমিত করে মিছিল তয়ের করেন।

১৯৩৮-এ কৃষক-প্রজা পার্টি-মুসলিম লিগের ফজলুল হক মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে তাঁর নো-কনফিডেন্স মোশন ভাষনের ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে যোগেন মণ্ডলের এই উপলব্ধি যা মার্ক্সসীয় ভাষ্যে আকীর্ণ। কিন্তু মুসলিম চাষা আর নমশূদ্র চাষা যতই সহ-প্রলেতারিয়েত হোক না কেন সরকারি চাকরির কোটার অংশ নির্ধারণের সময় মুসলিম চাকুরীপ্রার্থী আর নমশূদ্র চাকুরীপ্রার্থী যে প্রতিদ্বন্দ্বী, এবং সে সলিডারিটির গুড়ে যে বালি তা ১৯৪০-এর বাজেট বিতর্কের সময় থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। ১৯৪১-এর হিন্দুবাদ দ্বারা বিকৃত জনগণনা যার সম্বন্ধে পূর্বকাণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে, যা বাংলায় দলিতদের সংখ্যাকে ১৯৩১-এর থেকে অনেক কম দেখাতে সমর্থ হয়েছিল, ছলে বলে কৌশলে দলিতদের সেন্সাস কর্মীদের কাছে বর্ণহিন্দু পরিচয় দিতে বাধ্য করে তা শিডিউল রাজনীতির পায়ের তলার শেষ জমি – সংখ্যাতাত্বিক গরিষ্ঠতা – অনেকটাই ছিনিয়ে নিতে সফল হয়। আর সুভাষ বোসের ১৯৪১-এর মহাভিনিষ্ক্রমণ এবং শরত বোসের কংগ্রেসে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া যোগেন মণ্ডলের পালের হাওয়া অনেকটাই কেড়ে নেয় কারণ এই দুই ভাই রাজনীতিগত বিভেদ সত্ত্বেও মণ্ডলের যথাসাধ্য হিতকারক ছিলেন। দলিত স্বাধিকারের লড়াই মুসলিম ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’-এর নকলনবিশি বলে তাকে সার্বিক ভাবে দমন করার পথ আরও প্রশস্ত হল। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ ব্যয় হয় বাংলায় আম্বেদকরবাদী অল ইন্ডিয়া শিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের শাখা গড়ে তোলায় যা শেষ পর্যন্ত আম্বেদকরকে কন্সটিটিউশন কমিটি অবধি পৌঁছে দিয়েছিল, কংগ্রেসের সার্বিক অপচেষ্টা সত্ত্বেও।

বাকি ভারতের মত অস্পৃশ্যতা যে বাংলায় দলিতদের মূল সমস্যা নয় এবং অস্পৃশ্যতাকে কুমিরছানা করে গান্ধীজি যে মন্দিরপ্রবেশের ‘আধ্যাত্মিক সমানাধিকার’-এর খেলা খেলেন আর বাংলায় বর্ণহিন্দুরা যে ‘অস্পৃশ্যতা-নেই-তাই-বাংলায়-জাতিভেদ’ খেলা খেলেন, সেই দুই ব্যাপারেই মণ্ডল বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল ছিলেন ও দলিতদের শিক্ষা-চাকরির দাবিতে সদামুখর ছিলেন, ল্যান্ড রিফর্ম বিল তখনও বিশ বাঁও জলে । মে ১৯৪৩-এ এ.আই.এস.সি.এফ বাংলায় স্থাপনের পর অক্টোবর ১৯৪৩-এ তাঁদের মুখোমুখি প্রথম দেখা হয়। যদিও বাংলার অন্য নমশূদ্র নেতারা আম্বেদকরের সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন, দলিতদের রাজনৈতিক স্বাধিকারের জন্য যে কোন বাজি রাখা – এমনকি দরকার হলে কংগ্রেস বা হিন্দু মহাসভা যোগ দেওয়া – এই বেপরোয়া আততি ভীমরাও-ই যোগেনের মধ্যে সঞ্চার করেন। আর তার ফলে সুবিধাবাদী বেহায়া দল-বদলু হিসাবে দুজনকেই যথাক্রমে সর্বভারতীয় ও সর্ববঙ্গীয় প্রেসের তৈরী নিরন্তর কুৎসার ঝড়ের মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু তখন নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভার সদস্য হিসাবে দলিতদের অধিকার ও সুবিধা আদায়ের জন্য মণ্ডল সমানে লড়ে যাচ্ছেন আর তাঁর আর্জির দায়সারা জবাব পেয়ে যাচ্ছেন। ওদিকে নমশূদ্র চাকুরীপ্রার্থীদের নানা ছ্যাঁচড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী কায়দায় ইন্টারভিউতে পরাস্ত করা চলছে (যেমন ‘হিন্দু শ্রাদ্ধে কালো তিল কেন লাগে, সাদা তিল কেন লাগে না?’)। এমনকি যোগেন মণ্ডলের প্রতি মন্ত্রীপদে অযোগ্যতার অভিযোগ-ও ওঠানো হচ্ছে। এর মধ্যেই মণ্ডল কর্তৃক শ্যামাপ্রসাদের ঘৃণাছড়ানো বিরাট সম্মেলন রুখে দেওয়ার ঘটনা ঘটে যা নিয়ে আগের লেখায় আলোচনা হয়েছে। এপ্রিল ১৯৪৫-এ গোপালগঞ্জে অনুষ্ঠিতব্য ‘নিখিল বঙ্গ তপশীল জাতি মহাসম্মেলন’-এর এক ইস্তেহার থেকে দেখা যায় যে  এ.আই.এস.সি.এফ-এর দাবিসনদ অত্যন্ত বাস্তববাদী ও সুচিন্তিত ছিল। (পরের পাতায়) আম্বেদকরের বাংলায় যাওয়া আসা বাড়তে লাগলো ও  এ.আই.এস.সি.এফ-এর ছাত্র সংগঠন, মুখপত্র এবং দলের থেকে ‘আগাছা’ উন্মূলনের কাজ চলতে থাকল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না, গোপালগঞ্জে অনুষ্ঠিত ‘নিখিল বঙ্গ তপশীল জাতি মহাসম্মেলন’-এ আম্বেদকরের আসা বাতিল হল, সম্মেলনের আগের দিন নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভার পতন, আম্বেদকরের কাছে দাঙ্গার রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে নানা বেনামী চিঠি, ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পুলিশের দায়িত্ব নিতে অরাজী হওয়া এসব নানা কারণে। কমপক্ষে ৫০,০০০ লোক হবার কথা ছিল এই সম্মেলনে (১৯২৭-এর মাহাড় সম্মেলনে লোক ছিল ১৫০০, ১৯৩০-এ নাসিকের কালারাম সত্যাগ্রহে ১০০০০)। মঞ্চে উঠে আম্বেদকরের অনুপস্থিতি ঘোষণা করতে গিয়ে যোগেন মণ্ডল কেঁদে ফেলেন। কিন্তু আম্বেদকরবাদী রাজনীতিই যে বাংলার নমশূদ্রদের পথ তা ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। 

কিন্তু তা সত্বেও প্রশ্ন থেকে যায়, ১৯৪৬-এ ব্রিটিশ ভারতের শেষ নির্বাচনে এ.আই.এস.সি.এফ-এর ভরাডুবি হল কেন? সাধারণ বুদ্ধি ও গড়পরতা ঐতিহাসিক গবেষণা বলে যে, তুঙ্গ হিন্দু-মুসলিম মেরু করণের কালে শ্যাখ-শুদ্দুর রাজনীতির এ হাল তো হবেই। কিন্তু দ্বৈপায়ন সেনের উৎখনন তুলে আনে অন্য সত্য – মুসলিম স্বত্ব রাজনীতির সঙ্ঘবদ্ধতা আর বহু দলিতের হিন্দুত্ববাদী ছাতার তলায় আসার সত্য মেনে নিয়েও। ১৬ আগস্ট ১৯৪৬-এর ডাইরেক্ট একশন ডে দিয়ে শুরু ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’ দিয়ে দেখানো হয় যে বেপরোয়া জিন্নার পাকিস্তানপিপাসা কতদূর গেছিল যা দেশবিভাগ অনিবার্য করে তোলে। এমনকি শ্যাম বেনেগালের ২০১৪-য় রাজ্য সভা টিভির জন্য বানানো সংবিধানের ইতিহাস ‘সম্ভিধান’ এই যুক্তিকে চিত্রায়িত করে তাকে আরও একবার রাষ্ট্রীয় মান্যতা দেয়। রদ হয়ে যাওয়া গেরুয়াবাদী ‘ক্যালকাটা কিলিংস’ (২০১৭) ছবির মত অত নগ্নভাবে না হলেও। রাজনৈতিক ভাবে  এ.আই.এস.সি.এফ জিন্নার ‘ডাইরেক্ট একশন ডে’ ডাকের পক্ষে ছিল কারণ সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ভাবে একজোট থাকার গুরুত্ব ছিল তাঁদের রাজনীতির অঙ্গ। এই আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেস ও তাদের পেটোয়া হিন্দু মহাসভা যে যেনতেনপ্রকারেণ জেতার চেষ্টা করবে ও তাতে বিপুল অর্থ এবং ক্যাডারশক্তি নিয়োজিত হবে তা যোগেন আগে থেকেই বুঝেছিলেন ও সরকার বাহাদুরকে সতর্ক করেছিলেন আর হয়েছিলও ঠিক তাই – নমশূদ্রদের ভোট দেওয়া থেকে রোখা শুরু করে দলিত ভোটের ভুল গণনা, সব কিছুই, কংগ্রেসের বিজয়ী নমশূদ্র প্রার্থীদের কাউকেই মন্ত্রীসভায় ডাকা হয় নি – মাথায় চড়ে বসা ছোটলোকদের সবক শেখানোর জন্যে। কিন্তু তারও আগে যে এই হিংসালীলা হবে তা কেউই আন্দাজ করতে পারেনি। শুধু আম্বেদকরের বাংলা থেকে সংবিধানসভা ও যোগেন মণ্ডলের তাতে নিবেদিতপ্রাণ হবার বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন কুৎসা ক্যাম্পেন নয়, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসে ‘মুসলিম লিগের দালাল মন্ত্রী’ হয়ে জাতভাই হিন্দুদের কোতল করানোর জন্য কংগ্রেসের সব অভিযোগের তীর ছিল যোগেনের দিকে। খুনের হুমকিও বাদ ছিল না। কিন্ত যোগেনের এই সব কুৎসার উত্তরে প্রদত্ত প্রেস বিবৃতি ছাপে না কোন কাগজই। যোগেন বলেছিলেন ঐ কয়েক বছরে তাঁর প্রতি লক্ষ্য করে বাতাসে যে পরিমাণ বিষ ঢালা হয়েছিল, তাতে তাঁর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সব নীল হয়ে যাবার কথা। যোগেনের বিবৃতি ক্যালকাটা কিলিংস নিয়ে দুই ঐতিহাসিক তথাকথিত স্বতঃসিদ্ধের মূলে কুঠারাঘাত করে – যে এই হত্যালীলা মুসলিমদের কাণ্ড ও তাতে নমশূদ্ররা মুসলমানদের ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনী। যোগেনের মতে এই দাঙ্গা রাজনৈতিক – বাংলার বুকে জমি দখলের জন্য কংগ্রেস ও লিগের শেষ মরিয়া লড়াই যাতে ধর্মের রং লাগানো হয়েছে। আর যে পরিমাণ নমশূদ্র এই দাঙ্গায় মারা গেছে, তা ভাড়াটে গুন্ডাতত্ত্ব সরা সরি নাকচ করে দেয়। ধর্মবাদী জোয়ারের বস্তুবাদী বিশ্লেষণে একবগগা থাকার খেসারত যে তাঁকে বাকি জীবন ধরে দিতে হবে তা মণ্ডল জানতেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্ণহিন্দু জনমতের ওপর এই মহাদাঙ্গা নিরঙ্কুশ হিন্দুত্ববাদী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করলো। আর বাংলার অন্তর্বর্তী মুসলিম লিগ সরকারের আইনমন্ত্রীপদে বৃত হয়ে সেই জনমতের কাছে যোগেন মণ্ডল পাকাপাকি ভাবে ‘যোগেন মোল্লা’ হয়ে গেলেন। শিডিউল উন্নয়নের ব্রত তাঁর আগের মতই বহাল রইল। এ সময় মাউন্টব্যাটেন যখন তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেন, “মিঃ মণ্ডল, আপনার মুখ থেকে শিডিউল কাস্টের সোশ্যাল আপলিফটমেন্ট ছাড়া আর কিছু কথা শোনা যায় না কেন?” উত্তরে যোগেন বলেন, “সার, আর কেউ আপনাকে এ কথা বলার নেই বলে তাই, যেদিন থেকে মিঃ নেহরু আপনাকে এ নিয়ে কথা বলবেন, সেদিন থেকে আমিও অন্য কথা বলবো।” এই উত্তর শুনে নাকি মাউন্টব্যাটেন হেসে ফেলেছিলেন। কিন্তু এর পরে পূর্ববঙ্গে পর পর যা যা দাঙ্গা হয়, মণ্ডল তাদের অরাজনৈতিক, নিপীড়ন ও প্রতিহিংসামূলক গুণ্ডামি বলে শনাক্ত করেছিলেন। মধ্য জানুয়ারী ১৯৪৭-এ ঢাকা থেকে ছাপা এক ইশ্তেহার ক্যালকাটা কিলিংসে কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে ‘জিন্না দ্বারা মুসলিম উস্কানি’ এই বিশ্লেষণকে চুনাউতি দেয়। কিন্তু হিন্দু মহাসভার ১৯৪৭-এর তারকেশ্বর সম্মেলন দেশভাগের ডাক হিন্দুদের জন্য আরও উঁচু তারে বাঁধে, যার বিরুদ্ধে যোগেনের দল অখন্ড বাংলার স্বপক্ষে আর্জি জানাতে থাকে, হাজার হাজার দলিতদের নিয়ে সভা হতে থাকে বাংলার নানা জায়গায়। কিন্তু ততদিনে নিয়তি নির্নায়িত হয়ে গেছে।

হিন্দু ইসু নিয়ে সরকার বাহাদুরের কান কংগ্রেস ছাড়া আর সবার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। জনতার মতামত নেওয়ার দরকার ততদিনে ফুরিয়ে গেছে। সরকারি নথি ছাড়াও এই বিভাগবিরোধী রাজনীতির  ভিত যে কত গভীর তা চমকে দিয়েছিল লতিকা ঘোষ নামে এক কংগ্রেসকর্মীকেও। (পৃ ১৭৮-১৭৯) যিনি গ্রামে গিয়ে বুঝেছিলেন যে শহরে সংবাদপত্রের তৈরী করা চিৎকৃত বর্ণহিন্দু জনমতের থেকে গ্রামে গ্রামে সংখ্যাগরিষ্ঠ নমশূদ্র জনমত কতটা আলাদা। কিন্ত তাতে কান দেবার দরকার বাকি সবার ততদিনে ফুরিয়ে গেছে। হিন্দু ভারত ও মুসলমান পাকিস্তান তৈরি হবার জন্য পাশার দান পড়ে গেছে। আর দেশভাগের হাড়িকাঠে গলা পড়ে গেছে লাখ লাখ গরিব নমশূদ্রের- হিন্দুস্তানে তারা মুসলিম-দরদী, পাকিস্তানে তারা হিন্দু – জনগণমতের ভাগ্যনিয়ন্তা হবার বদলে তারা হলেন জনগণমতের শিকার।  এই পরিস্থিতিতে খামোশ-করে-দেওয়া নমশূদ্রের স্বার্থ ছাড়া আর সব বৃহত্তর কায়েমী স্বার্থের পথের কাঁটা ছিলেন যোগেন। তাঁকে হারতেই হত। এরপর সেপ্টেম্বর ১৯৪৮-এ বাংলার সরকার নির্মীয়মান ভারতীয় সংবিধান থেকে ‘শিডিউল কাস্ট’  কথাটাই তুলে দেবার নানা চেষ্টা হয়েছিল, যাতে বাঁশের সাথে বাঁশী বাজার সম্ভাবনাও বরবাদ হয়ে যায়। তার বিরুদ্ধতা ও উদ্বাস্তু দলিতদের পুনর্বাসনের কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন যোগেন। সবচেয়ে ব্যথিত করেছিল তাঁকে পাকিস্তানের মন্ত্রী হিসাবে পাকিস্তানের দলিতদের দেশে থেকে যাওয়ার মত ভরসা দিতে না পারা। সেই বিবেকের পীড়ন তাঁকে মন্ত্রীপদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছিল। ভারত যে উদ্বাস্তু দলিতদের পুনর্বাসনের কাজ পাকিস্তানের থেকে বেশী ভালো করতে পেরেছিল তা নয়। কিন্তু যোগেন বিশ্বাসঘাতের তিরি বলে পরিগণিত হলেন – ভারতের বর্ণহিন্দুদের, পাকিস্তানের মুসলমানদের আর দুপারের দলিতদের। আর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে উদ্বাস্তু বর্ণহিন্দু ও উদ্বাস্তু নমশূদ্রদের মধ্যে নিপীড়ন-সঞ্জাত এক ঠুনকো শ্রেণীমৈত্রী গড়ে উঠেছিল, যা পৃথক দলিত স্বত্বরাজনীতির স্বপ্ন আরও দাবিয়ে দিল। ১৯৫০ থেকে ১৯৬৪-র উদ্বাস্তু রাজনীতির ঠিকুজী কুষ্ঠি আমরা প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তীর ‘প্রান্তিক মানুষ – পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুজীবনের কথা’ মানুষেই পড়েছি। কিন্তু তার থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবার আমরা মনে করে নেব – তা হল বামপন্থী উদ্বাস্তু-রাজনীতির সচেতন মধ্যবিত্ত উদ্বাস্তু-পক্ষপাত আর উদ্বাস্তু নমশূদ্রদের বাংলার মাটি থেকে ধীরে ধীরে নিঃশেষে মুছে যাওয়া।  উদ্বাস্তু বর্ণহিন্দু ও উদ্বাস্তু নমশূদ্রদের মধ্যে নিপীড়ন-সঞ্জাত ঠুনকো শ্রেণীমৈত্রী যথারীতি টেঁকেনি। বাংলার বুকে দলিত রাজনীতির কফিনে সেটা সর্বশেষ ও সবচেয়ে নিদারুণ পেরেক। কিন্তু ১৯৫০-এ পাকিস্তান থেকে ভগ্নমনোরথ হয়ে ফিরে এসেও যোগেন মণ্ডল আত্মপীড়ায় অন্তেবাসী হন নি। যেকোনো সময় খুন হয়ে যাবার ঝুঁকিকে অগ্রাহ্য করে, পুলিশের চেতাবনীকে পাশ কাটিয়ে আবার উদ্বাস্তু নমশূদ্রদের জন্য রাজনীতির আসরে নামেন তিনি। বিভিন্ন উদ্বাস্তুরাজনীতি সংস্থার মধ্যে বিরাট সংখ্যক উদ্বাস্তু জনতার আনুগত্য পাওয়া নিয়ে তখন ছেঁড়াছিঁড়ি চলছে। দ্বৈপায়ন সেন এখানে প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তীর প্রতিপাদ্যকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। বামপন্থীরা উদ্বাস্তুদের রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে বাগে পেতে বেশী উদগ্রীব ছিল, তাঁদের জীবনের সমস্যার সমাধান করতে নয়। মণ্ডল সি.পি.আই সমর্থিত এস.বি.বি.এস (সারা বাংলা বাস্তুহারা সমিতি)-এর সাথে কাজ করতে শুরু করলেও ধীরে ধীরে তাদের বর্ণ-অন্ধতার প্রতি বিরক্ত হতে থাকেন তিনি। আর শ্রীচক্রবর্তী ইউ.সি.আর.সি-র যে গান্ধী-মাও-মিশেল দেওয়া রাজনীতির জয়গান গেয়েছেন, তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে সচেতন হতে থাকেন তিনি। উদ্বাস্তু নমশূদ্রদের জন্য বার বার কয়েদ হতে রাজী ছিলেন তিনি, হয়েওছিলেন। কিন্তু এই ধরা দেওয়া-ছাড়া পাওয়া-ধরা দেওয়ার নাটকে যে আখেরে কিছু লাভ হয় না তা স্বাধীনতাপূর্ব কংগ্রেসী রাজনীতির সাথে গভীর পরিচয় তাঁকে বুঝিয়েছিল। কিন্তু এর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ই.আই.আর.সি (ইস্ট ইন্ডিয়া রিফিউজি কাউন্সিল) যখন তিনি গড়লেন, তাতে সাথে দাঁড়ানোর জন্য পুরোনো পাপী ও পুরনো শত্রু হিন্দু মহাসভার এন.সি.মজুমদার ছাড়া পাশে কাউকেই পেলেন না। তাও স্রেফ বাম-বিরোধিতার কারণে। কিন্তু তাতে কাজ থেমে থাকল না। আর বিধান রায়ের কাছে তাঁর উদ্বাস্তু নমশূদ্রদের পুনর্বাসনের জন্য ক্রমাগত দরবার ও প্রত্যাখ্যান বুঝিয়ে দেয় যে বাকি সব বর্ণহিন্দু রাজনীতিকদের মতই তাঁর উদ্বাস্তুজনদরদ মধ্যবিত্ত বর্ণহিন্দু-তক সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি যোগেন মণ্ডল হিসেব কষে এক দীর্ঘ রিপোর্টে বিধান রায়কে এও দেখিয়েছিলেন যে উদ্বাস্তু পিছু ছয় একর বরাদ্দ অনাবশ্যক ভাবে বেশী। এই বরাদ্দ তিন একর করলে তা মাথাপিছুও যথেষ্ট হবে আর সব উদ্বাস্তু তাতে বাংলার মাটিতেই কুলিয়ে যাবে, কাউকে দ্বিতীয়বার উদ্বাস্তু হতে হবে না। এতে রায় কর্ণপাতও করেননি। আবারও মূলধারার ও মূল বিরোধী ধারা দুয়েরই কায়েমি স্বার্থের রাজনীতির পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালেন যোগেন। উদ্বাস্তু নমশূদ্রদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করা বন্ধ করতে ও তাঁদের বাংলার মাটিতে চাকরি আর চাসের জমি দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন তিনি ও আবার সরকারি পদ পাবার চেষ্টা শূন্য থেকে শুরু করলেন। সাথে সাথে শেষ করার দরকার হল আবার দানা-বেঁধে-ওঠা নমশূদ্র স্বত্বরাজনীতি। কংগ্রেস ও বাম দুদলেরই কথা-কাজের ফারাক বেপর্দা করে দিচ্ছিল যোগেনপন্থার রাজনীতি। ১৯৫২-য় নির্দল প্রার্থী হিসেবে ভোটে হারলেন তিনি, ১৯৬৪-তেও শিডিউল জোটের সাথে দাঁড়িয়ে ভোটে হারলেন তিনি। তবু হার না মেনে টালিগঞ্জের বস্তিতে এক ছুতোরের আশ্রয়ে তাঁর কারখানার এক কোণে থাকতে থাকতে তাঁর ৬২-তম বয়েসে লেখা আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছে বামদলগুলির তথাকথিত সমানাধিকারের বুকনির প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা। তখন তাঁর দারিদ্র্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অনুগত কেউ কালি-কাগজ কিনে না দিলে লেখা বন্ধ রাখতে হত। আর ঠিক ১৯৬৮-র অক্টোবরে আর.পি.আই (রিপাব্লিকান পার্টি অফ ইন্ডিয়ার) সমর্থনে তৃতীয়বার ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি যখন জোরকদমে চলছে, ধীরে ধীরে জাগছে আশার চর, মনে হচ্ছে এবার হলেও হতে পারে সেই বহুকাঙ্খিত জয়, তখনই হঠাৎ মারা যান যোগেন মণ্ডল। তাঁর ছেলে এই মৃত্যুর অস্বাভাবিকতা নিয়ে নিশ্চিত এবং তাঁর মতে খুব সম্ভবতঃ বিষপ্রয়োগে এই হত্যা হয়েছিল। পাথুরে প্রমাণ যদিও তার কিছুই নেই। দায়সারা হৃদরোগজনিত মৃত্যুর শোকবার্তা লিখে কাজ সারল খবরের কাগুজেরা। আশীষ নন্দী যে বাংলার সমাজকে এক লেখায় ‘মোস্ট কাস্টিস্ট সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’ বলেছেন, সেই সমাজে যোগেন মণ্ডলের রাজনীতিকাহিনীক্রমের নটেগাছটি এভাবেই মুড়লো। কিন্তু সেই রাজনীতি গাছের বীজ কিভাবে এখনও শিকড় ছড়াচ্ছে পশ্চিমবাংলার দলিত রাজনীতিতে? মুসলিমদের স্বত্বরাজনীতির সাথে তার গাঁটছড়া না হলেও বামরাজনীতির সাথে হতে পারে কি? তার অনেকটাই নির্ভর করছে এই উত্তরকাণ্ডের কতটা দলিতদের কৌমচেতনায় বেঁচে আছে।

যোগেন মণ্ডলের পূর্বকাণ্ড (১৯৩৭-১৯৪৭)

সৌরভ রায়

বাংলা ও ইংরিজি এই দুই ভাষার লেখালেখিতে রত আছেন সৌরভ রায়, এছাড়া বাংলা থেকে ইংরাজিতে নিয়মিত নানা কিছু তিনি অনুবাদ করে থাকেন। তাঁর প্রথম দিকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। প্রায় এক দশক বিজ্ঞাপনী জগতে চাকরি করেছেন। তার পরে চিত্রবিদ্যায় দুটি স্নাতক (Dr. Bhau Daji Lad Museum – Mumbai 2012-13, School of Arts & Aesthetics, Jawaharlal Nehru University – New Delhi , 2014-16) করেছেন এবং Tasveer Ghar Fellowship 2017-18 পেয়েছেন। বর্তমানে দুটি গবেষণাপ্রকল্পের (স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের সেক্যুলারিজম বিষয়ক চিত্রজগত, আন্তর্জালে ভারতীয় Queer পুরুষদের চিত্রজগত) সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া লন্ডনের Stimulus -> Respond Magazine-এর সাহিত্য সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top