।। অর্জুনদেব সেনশর্মা ।।
দেবোত্তমের এই বই শিশুতোষ জীবনী নয়, তাঁর বই বিদ্যাসাগর মেলা নয়,তাঁর বই বিদ্যাসাগরের মূর্তিভাঙাও নয়, তাঁর বই, এই উপমহাদেশের ১৭৫৭’র পরের হিন্দুর পুনরাকারের একটি ইতিহাস। সে স্মৃতির নিগূঢ় থেকে আজকের হিন্দুত্বহীন হিন্দু-বাঙালির নৈতিক বিবর্তনের এক চিরকালীন ইতিহাসও বটে। বইটি আন্তর্জাতিক মানের। ইংরেজিতেই প্রকাশযোগ্য। বঙ্গপাঠী বাঙালি এই গুরুপাককে বলবে হয় নিন্দে অথবা “দেকোচো”।
বিদ্যাসাগর (নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান)
– দেবোত্তম চক্রবর্তী
কলাবতী মুদ্রা প্রকাশনী
সিদ্ধরস ভাঙার বই
দেবোত্তমবাবু আমার বন্ধু। ফলে তাঁর প্রতি আমার প্রীতিপক্ষপাত থাকলেও ,তিনি যে এই মূর্খ,আত্মরতিময়,পৃষ্ঠকণ্ডূয়নশীল বাঙালি নন, তাই অতি গৌরবের বিষয়। দেবোত্তম চক্রবর্তীর বইটিকে একটি যুগারম্ভ বললেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি বিদ্যাসাগরের জীবনী লিখেছেন। তিনি বিদ্যাসাগরের ডার্ক সাইড তুলে ধরেছেন ,এইকথা বললে, তাঁর মহিমময় গ্রন্থ সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। ভারতের বর্তমান সংস্কৃতি বড়ই সংলিপ্ত। সবাই সর্বত্র সিদ্ধরসকে সিদ্ধ বলে চালিয়ে যান। দেবোত্তম, সিদ্ধরস ভেঙেছেন। কীভাবে? বিদ্যাসাগর নিয়ে সিদ্ধরস দুটি। তিনি না জন্মালে, এদেশ অন্ধকারে থাকত। দ্বিতীয় সিদ্ধরস, তিনি উপনিবেশের দালাল।দেবোত্তম দুই সিদ্ধরসকেই ভেঙেছেন। প্রথম সিদ্ধরস ভাঙা সোজা। দ্বিতীয় সিদ্ধরস ভাঙা কঠিন। কিন্তু কঠিনও নয়। দালাল, নিজের সামান্য লাভের জন্য দালালি করে। কিন্তু বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ইংরেজের সম্পর্ক অন্য।
ইংরেজ তার নিজদেশ ও এতদ্দেশীয় একবিধি ও তার নিজের হিসেবে, সুশাসনের জন্য বিদ্যাসাগরকে পেয়েছিলেন এবং বিদ্যাসাগরও তাঁর প্রবল ইগো, প্রবল উচ্চাকাঙক্ষা, প্রবল মহৎ হওয়ার ইচ্ছের পূরণ, ঐ ইংরেজকে দিয়েই করিয়ে নিয়েছেন। বিদ্যাসাগরের এই মনোবৃত্তি অনৈতিক নয়। প্রথমত সাইকিয়াট্রি ক্রমশ ভ্যালুজাজমেণ্টকে বিদায় জানাতে বাধ্য হচ্ছে, দ্বিতীয়ত মহৎ হওয়ার প্রেরণা,আলোকায়নের দায়িত্ব গ্রহণ একটি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক বৃত্তি (নামটি জানতাম,ভুলে গিয়েছি।এটি ধর্মাচার্যদের থাকে। ডাঃ অনির্বাণ বসু বলেছিলেন। বর্তমানে একটু রেগে আছেন। তাই পরে বলে দেব।) । ঠিকমত সার্চ করলে গুগলে পাবেন। দেবোত্তম এভাবে লেখেননি। কিন্তু তাঁর অনতিক্রম্য বিদ্যাসাগর পড়লে,আপনার মনে হবেই এই তীব্র উচ্চলিপ্সার কারণ কী? আমাকে বলতেই হবে,বিদ্যাসাগর, তাঁর পিতা ও পিতামহ যে ব্রাহ্মণোচিত দারিদ্র্য বহন করেছিলেন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্মের থাকে আপদ্ধর্ম হিসেবে বৈশ্যধর্ম (বৃত্তি)কে গ্রহণ করেছিলেন। আপদ্ধর্মকে সাধারণ ধর্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করে,বিধবাবিবাহর যে তিনি যুক্তিবিভ্রাট করলেন, তাঁর মূলে কি আছে, এই বৃত্তিগত স্বকীয় পরিবর্তন? এবং তিনি হলেন আইকন। ব্রাহ্মণের বৈশ্যবৃত্তি ক্রমশ সাধারণ ধর্ম হল।
কিন্তু প্রশ্ন, বিদ্যাসাগরের এই আপদ্ধর্ম গ্রহণ বৈধ কিনা। বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবের আগেই বাংলাদেশে ব্রাহ্মণগণ ভূস্বামীত্ব নিয়েছেন। অর্থাৎ ক্ষত্রিয়বৃত্তি। কেন,অর্থলোভে।তা কিন্তু বৈধ নয়। বিদ্যাসাগর যখন দেখলেন, শাস্ত্রজীবী হয়ে সদ্যোত্থিত শূদ্রসমাজপতিসভায়(শোভাবাজারের দেব) তামাকুসেবন ছাড়া কর্ম নেই,তখন তিনি ইংরেজের অভিপ্রেত সংস্কারকর্মের ভারতীয় কম্প্রাদোর হয়েছেন। দেশের রাজা বৈশ্যাচারী। ফলে ব্রাহ্মণের আত্মরক্ষার উপায় কী। উপরন্তু তিনি বৈশ্যবৃত্তিতে গ্রন্থপ্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ও নিজের লেখা বই।ফলে তিনি যে নিজের গুরুত্ব থেকে পতিতও হয়েছেন তা নয়। আজ দ্বিশতবর্ষযাবৎ তাঁর বর্ণমালায় বাঙালির হাতে খড়ি। তিনি কিন্তু জমিদারী কেনেন নি। ক্ষমতা ছিল। এখন তাঁর জ্ঞানার্জনী ও কার্যকারিণী বুদ্ধি,তাঁর বিচারবুদ্ধিতে তাঁকে যা করিয়েছে, তিনি তাই করেছেন। ধৈর্য,সাহস, উদ্যম,অধ্যবসায় চারটিই ছিল। তাঁর শারীরিকী শক্তিও ছিল। তাঁর গদ্য,তাঁর চিত্তরঞ্জিনী বুদ্ধির প্রকাশ। সুতরাং বিরোধী বঙ্কিমচন্দ্রের মানদণ্ডে বিচার করলে, তিনি এক পূর্ণ মানুষ। এই পূর্ণ মানুষটিকে ইউরোপীয় স্ট্যাণ্ডার্ডে তন্নতন্ন করে দেবোত্তম আবিষ্কার করেছেন। তাঁর বই না পড়লে এত কথা আমি ভাবতাম না। তাঁর বই শিশুতোষ জীবনী নয়,তাঁর বই বিদ্যাসাগর মেলা নয়,তাঁ র বই বিদ্যাসাগরের মূর্তিভাঙাও নয়, তাঁর বই, এই উপমহাদেশের ১৭৫৭’র পরের হিন্দুর পুনরাকারের একটি ইতিহাস। সে স্মৃতির নিগূঢ় থেকে আজকের হিন্দুত্বহীন হিন্দু-বাঙালির নৈতিক বিবর্তনের এক চিরকালীন ইতিহাসও বটে। বইটি আন্তর্জাতিক মানের। ইংরেজিতেই প্রকাশযোগ্য। বঙ্গপাঠী বাঙালি এই গুরুপাককে বলবে হয় নিন্দে অথবা “দেকোচো”।
অতি সামান্য স্থানে আমার একটি সাক্ষাৎকার আছে। সেটিতে ডামি কপিতে যে ভুল উদ্ধৃত হয়েছে,তা বলে দিই। ১. রঘুনন্দন নন, রাজা রাজবল্লভ বিধবাবিবাহের চেষ্টা করেন ও নবদ্বীপ প্রতিহত করে। ২. রাজবংশগুলির ইতিহাসে গুপ্ত রাজবংশে একটি ও কুলজী গ্রন্থে একটি বয়স্থা বিধবার বিবাহ পাওয়া যায়। ৩. অত্রৈবর্ণিক অর্থাৎ শূদ্রসমাজে হাজার বছর আগেও বিধবাবিবাহ প্রচলিত ছিল বলে কোনো কোনো গবেষণায় দেখেছি। কারণ শাস্ত্র শূদ্রের বিধবা-বিবাহ নিয়ে নির্দেশ দেননি। ব্রাহ্মণাদি, ত্রিবর্ণের অস্ফুটরজঃ অবস্থায় বিধবাবিবাহ বৈধ ছিল।শ্রুতি-উদাহরণে তা স্বগোত্রেই থাকার কথা।কিন্তু এই হাজার বছর আগের কথা বললে অবশ্যই আমাদের হর্ষের ভগিনী রাজ্যশ্রীর কথা মনে আসবে। তিনি ” সতী”হয়েছিলেন। অবশ্য হর্যক্ষ বংশ নিজেদের বৈশ্য পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু গুপ্তগণ শূদ্র ছিলেন। মৌর্য থেকে গুপ্ত,এবং ইংরেজ আসার ফলেই হিন্দুধর্মের পুনরবয়ব হয়, তা তো নয়,মুসলিম আসার পরেও হিন্দুধর্মের বিপুল পুনর্গঠন হয়। ব্রাহ্মণের স্মার্ত শাসন একদিকে চরম,অন্যদিকে ভঙগুর হতে থাকে। ফলে বৃহৎ নীতিবোধ থেকে পতিত হতে গেলে,ক্ষুদ্র নীতিগুলির উদারতাকে বন্ধ করে,একটি নীতির মুখচ্ছদ পরতে হয়। সেকারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণ (বৌদ্ধ প্রতিক্রিয়া–কেউ কেউ বলেছেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি। প্রথমত গৃহস্থের জন্য পৃথক বৌদ্ধ স্মৃতি নেই। কারণ ধর্মটি সন্ন্যাসমনা। দ্বিতীয়ত প্রতিক্রিয়ারও উদাহরণ নেই।) প্রবল হয়ে বিধবাবিবাহের সুযোগ অন্ত্যমধ্য ভারতবর্ষে বেশি দেখিনা বললেও কম হয়। তবে দেবোত্তমের কাজে,এ একেবারেই পার্শ্বিক ইস্যু। যে বিপুল শ্রমে তিনি ব্যক্তি বিদ্যাসাগরকে আবিষ্কার করেছেন, তার জন্য তাঁর বইয়ের সমকক্ষ বই বাংলায় আরেকটি-গোলাম মুরশিদের “আশার ছলনে ভুলি।” এই বিদ্যাসাগর কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের নয়,তা আমাদের সৌভাগ্য। দেবোত্তম ইংরেজি ভাষার শিক্ষক। তিনি নিজেই অনুবাদ করে ফেলুন।
অর্জুনদেব সেনশর্মা
লেখক, গবেষক। অসম বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক।
https://en.wikipedia.org/wiki/Messiah_complex