আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

গাত্রবর্ণে, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে…

।। মিথুন নারায়ণ বসু ।।


ছোটো-বড়ো-কালো-ধলো— আমরা সকলে মিলে একটিই আছি রামধনু।
বাল্মীকির রাম নয়, বিজেপিরও না, কবীর আর তুলসীদাসের রাম ইনি
তবু যদি এমসিপি বলো, তবু যদি বলো মিসোজিনি,
সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে নিয়ে বলবো ‘রংধনু’।

রংধনু

প্রকৃতির আদি কথা হিংসা না কি জোট?
আদিকোষ মায়োসিস-মাইটোসিসে ভেঙে
তৈরি করেছে যেই প্রথম জাইগোট—
সে কি শুধু প্রয়োজন থেকে, না কি প্রেমে?
প্রথম লজ্জানত যে মানবী হেসেছিল
আলগোছে পুরুষের বলিষ্ঠ কাঁধ ভালোবেসে,
অথবা পুরুষ তার রমণীকে চুমু খেয়েছিল,
কেন করেছিল, বিনা কোনও প্রয়োজন লেশে?
বংশগতি প্রকৃতির দাবি, নর-নারী তাই বাইনারি।
তার অতিরিক্ত সবই প্রেম, মানুষেরই রচিত সবই তা—
চুম্বন আদিমতম সংগীত এ পৃথিবীর,
আলগোছে হেসে ওঠা পৃথিবীর প্রথম কবিতা।

তারই ছায়াবর্ণসম্পাত বিষম-সম-উভ কিংবা রূপান্তরকামে;
গাত্রবর্ণে, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে, জাতি-ধর্ম-ভাষাগত বিচিত্র বর্ণালী।
এইসব তুচ্ছ করা কোলাহল আসে যদি কানে,
বড়োজোর শভিনিস্ট বলে হেসে দিও দু’টো গালি।
ছোটো-বড়ো-কালো-ধলো— আমরা সকলে মিলে একটিই আছি রামধনু।
বাল্মীকির রাম নয়, বিজেপিরও না, কবীর আর তুলসীদাসের রাম ইনি;
তবু যদি এমসিপি বলো, তবু যদি বলো মিসোজিনি,
সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে নিয়ে বলবো ‘রংধনু’।

ওইটুকুই শিল্পকর্ম, ওইটুকুই প্রেম, ওইটুকুই রুনুরুনুঝুনু…


রোসেত্তা পাথর

যা-ই বলো স্পষ্ট ক’রে বলো,
এ-ই হ’ল তোমার গৌরব।
আমি কেন তবে কিছুই বুঝি না?
কেন মনে হয় বিদেশি ভাষায় যেন
কথা বলছো বিদেশিনী তুমি?
আর আমি যা-যা বলি, তার থেকে
অতি যত্নে অন্য মানে কীভাবে যে
বারেবার বের ক’রে আনো তুমি
অব্যর্থ কুশলী; আমি ভাবি। ভাবি,
প্রাকৃত ভাষায় কেন দড় নই,
কেন শৌরসেনী, মহারাষ্ট্রী,
এমনকী অর্ধ-মাগধী ছেড়ে
বারেবারে পৈশাচী ভাষায়
আমি কথা বলে চলি?
তোমার মুদ্রাগুলি ডেমোটিক হ’লে
কেন আমি সর্বদাই হিয়েরোগ্লিফিক,
তা-ই ভাবি; আর ভাবি
যদি গুগলের যথাযোগ্য ট্রান্সলেটর
থাকতো, কিংবা থাকতো আমাদেরই
নিজস্ব কোনও রোসেত্তা পাথর,
তবে হয়তো আমাদেরও
পরস্পর চিন্তাগুলি বিচ্ছিন্ন কতগুলি
দ্বীপ হ’য়ে থাকতো না এতখানি অসেতুসম্ভব।

দূর থেকে কথা বলো, সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়,
আমি শুধু কানে কিছু শুনতে পাচ্ছি না।

ক্রমেই প্রত্যয় হয়, বেশি ভালো বোবাকালা ভাষা…


ব্যক্তিগত নরক

নরকদর্শনের কথা মনে পড়ে। আমার দশ বছর বয়সে দেখা অশোককাকুর ঘরে বটতলা গ্লসি লিথো নরকযন্ত্রণার ছাপা ছবি। পাপের শাস্তিজনিত ভয়ে অভিভূত করে দেওয়া অবশ্যই শিল্পীটির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না, আমার কাছেও সবথেকে উত্তেজক ছিল যৌনতা ও হিংস্রতার অভাবিত, জম্পেশ মিশেল আর শূলেচড়া, তেলেভাজা, এমনকী কবন্ধ পাপীদের উলঙ্গ শরীর। ফিফটি শেডস অব গ্রে তখন কই? মার্কুই দে সাদের নামও তখন শুনিনি তবু জ্ঞানত বিডিএসএম করতে প্রথম আমি দেখি যমদূতদেরই। ছবির বেশিরভাগ জুড়ে পাপীরাই ছিল, আর ওপরের দিকে অল্প কিছু পুণ্যবান গরুদের ল্যাজ ধরে পার হচ্ছিল বৈতরণী নদী।

এর কয়েকদিন পর বদরহাটের কাছে গুমা গোবিন্দপুরে শেখেদের তাজিয়ার থেকে দুলদুল-বেশী টাট্টু একটা ঘোড়া কীভাবে যেন ইঁটের ভাটার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। তারপর ইঁটরঙা টেরাকোটা ঘোড়া অনেকেই রাত্রিবেলা ইঁটের ভাটার কাছে চরতে দেখেছে। নীলমাধবদাদা, ওর ভাই জগদীশ আর কানু, পদ্মাবতী, কলুদের আঁখিতারা বানো। আমিও দেখলাম।পূর্ণিমা রাতে চাঁদের গোলার নীচে দেখি ভাটার চিমনি বেয়ে উড়ে বেরিয়ে আসছে একটা পক্ষীরাজ ঘোড়া। তার ডানার ঝাপট আর উড়ালের শনশন আওয়াজ আমার মাথার মধ্যে পাক খেতে থাকে। জ্ঞান হারানোর আগে আমি দেখি কাদেরমামুর ঘরে দেখা বুরাকের মতো এই ঘোটকীরও মুখখানি মানবীর, আর মুখখানা চেনা। কার মুখ, কার মুখ ভাবতে, ভাবতে গিয়ে সেই যে আমি চৈতন্য হারালাম, তারপর কত জলপড়া, পীরের মাদুলি, মুশকিল আসানের কত চামরের শত বাড়ি খেয়েও কোনো লাভ কিন্তু কিছুই হলো না। সেইথেকে আজীবন আমি আবোদা হয়েই রয়ে গেছি। আর সেইথেকে প্রতি রাতে আমি বুরাকের ঘন, কালো লেজ ধরে পার হই বৈতরণী নদী, আব-এ-হায়াতের কালো নদী। স্বপ্নে দেখি জেপলিন উড়ছে, শেষে জলপ্রপাতের শব্দে অন্ধকার পিচ্ছিল প্রদেশে স্বপ্ন ভাঙে। সেইথেকে সিএফএনএম, বন্ডেজ,বেয়ারব্যাক, লিঞ্চিং সবকিছু চলে। আমাদের যৌথ স্বপ্ন জুড়ে আর কিছু নেই। কোনো হুরী নেই, গেলেমান নেই। এ’জীবনে আর কোনো শান্তি নেই, এর থেকে বড়ো কোনো পেরেশানি নেই।স্বর্গ-নরক নেই, জন্নাত নেই, জাহান্নম নেই।সেইথেকে আমার জীবনে ওই গোল চাঁদ আর উচ্ছ্রিত চিমনিটি ছাড়া কিছু নেই। প্রয়োজনও নেই, বৈতরণী পার হলে স্বর্গলোভী সাধক ও বিজ্ঞের দল যেকারনে কাঁদে। হায়াত নদী পার হলে দেখি জন্নাত নয়, আবার মর্ত্যভূম, আবার বন্ডেজ, স্লেভ, সিএফএনএম, সিএমএনএফ, মানুষেরই চামড়া পরা শত শত নুডিস্ট কলোনি…

নিজেকে এইসব ভালো-না-বাসানো ছাড়া টিঁকবার আর কোনও উপায়ই ছিল না…


গ্লোব

হীরের আংটির মতো
পুরো গোল নয়
বেঁকে তুবড়ে গেছে সোনা
আঙুলেও কড়া পড়ে গেছে
বেশিক্ষণ পরে থাকলে
তবু লাগে
তাই অনামিকা বদল করি
ডানহাতে-বাঁহাতে

পাতা মুড়ে রাখা বইটার মতো
খামোখাই একটা পৃষ্ঠায়
তেরচাভাবে নাম লিখেছিলে
পদবি বদল করে নিয়ে
এক কোণে
পরের পাতায় আমি নিজে
পদবি বদলে যায়
একদিন
তোমার-আমার

আলমারির কোণে রাখা
ক্ষয়ে যাওয়া
ন্যাপথলিন বলটার মতো
ক্ষয়ে যাচ্ছে, তবু
আরও কিছুদিন
গন্ধ থেকে যাবে
নেশাগন্ধ, পোকাদের
মরবার নেশা
থেকে যাবে

ভাঙাচোরা গ্লোবটার মতো
অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর
এশিয়ার খানিকটা-সহ
কত মহাসাগরের জল
খাবলা দিয়ে তুলে গেছে কারা
তুমি গেছ
সেইসব জল আনতে
ঘোমটা দিয়ে
কলসী নিয়ে কাঁখে

একা-একা
নদীটির মতো…


গ্রহণ

তুই মাটি খাস, চক খাস, সাঁইবাবার বিভূতি
আর ছাইপাঁশ আরও কী-কী খাস।
আমি অত্যন্ত বিরক্তি-সহ রোজ দেখি।
বিরক্তির স্রোত বিপদসীমার বহু উঁচু দিয়ে বয়।
বাঁধ ভেঙে গেলে শেষে জোর করে বলি,
“দেখা মুখ, পোড়ামুখী! কী খেয়েছিস, দেখা, মুখ দেখি?”
মুখ খুলে দেখি, গ্রহ-তারা-কোয়াসার বেমালুম খেয়ে নিচ্ছিস।
খেয়ে নিচ্ছিস স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে লিঙ্গ-পুরুষ, একবচন-দ্বিবচন, সর্বখাকী!
আমি সব দেখে নিচ্ছি দেখে তুই লজ্জায় জিভ কাটছিস একহাত,
অথচ খাওয়ার নেশা শরীরে কাপড়টুকু রাখতে দিচ্ছে না।
আমি আর কী করব, চেনা ছেলে মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়ে গেলে,
কিংবা রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলে চেনা চায়ের দোকানী,
মানুষ যেভাবে তার প্রতিক্রিয়া দেয়,
সেরকমই নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে আসি।
শুয়ে পড়ি শব হয়ে, তুই এসে বুকে চড়ে দাঁড়া।

“সমাজপাড়ায় গিয়ে স্থান-কাল কত খাবি, খা—“,
মুখে বলি, “বুকের কাপড় আগে ঠিক কর মাগী,
বেশি দেখি যদি ঢ্যামনামি, মেরে গাঁড় ভেঙে দেবো বাঁড়া… “

প্রচ্ছদের ছবি: অরূপ ঘোষ

মিথুন নারায়ণ বসু

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কবি। জন্ম:১৯৮১, ১৪ মার্চ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, ‘লীলাবিলাখেলা’, (২০১১), পুনর্মুদ্রণ ২০১৭)। অনুবাদ করেছেন ফির্নান্দু পেসোয়া (২০১৬)। পেশায় শিক্ষক।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top