।। পাঞ্চালী কর ।।
আন্দোলনের চেনা ছবির থেকে, পরিচিত ইমেজারির থেকে এই কৃষক বিদ্রোহ কিছুটা আলাদা বটেই। এই বিদ্রোহ, বিক্ষোভ রীতিমতো কার্নিভালের চেহারা নিয়েছে। এখানে মানুষ শুধু স্লোগানে বা ফেসবুক পোষ্টে না, আক্ষরিক অর্থেই মানুষ মানুষের পাশে আছে, একে অপরের কমরেড হয়ে। একটি পরিবার স্যুপ বানিয়ে এনেছে ড্রামে করে; পরিবারের পুরুষেরা সবাইকে ডেকে ডেকে বলছেন: আ যাও, গরম গরম স্যুপ পিলো, মহিলারা পরম যত্নে হাতে হাতে স্যুপ দিচ্ছে। খানিক জোর করেই আমার হাতে এক কাপ গরম স্যুপ ধরিয়ে দিয়ে এক আন্দোলনকারী কৃষক বললেন, খেয়ে নাও, খুব ঠান্ডা এখানে। যার সঙ্গেই কথা হচ্ছে প্রথমেই প্রশ্ন করছেন ‘খানা খায়া’? অথবা ‘চায় পী লো’। চা নিতে গেলে পাস থেকে কেউ পাউরুটি এগিয়ে দিয়ে বলছে খালি পেটে চা খেতে নেই।
যে তিনটি কালাকানুনের বিরুদ্ধে দিল্লিতে ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ:
দিল্লির সিঙ্ঘু বর্ডার থেকে লিখছেন পাঞ্চালী কর
সবুজ দ্রোহের কার্নিভাল
গোটা বিশ্বেই এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে রাজধানী দিল্লির বুকে লাখো কৃষকের অবস্থান চলছে। চলছে ইনসাফের লড়াই। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের আনা কৃষি বিলের প্রতিবাদে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা থেকে আসা কয়েক হাজার কৃষক গত ২৬ নভেম্বর থেকে দিল্লির প্রবেশদ্বার সিঙ্ঘু বর্ডার এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে ধর্না দিচ্ছেন এবং বিল সম্পূর্ণ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে তারা বদ্ধপরিকর। এই আন্দোলনকে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। আমার সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করব, তার আগে সংক্ষেপে এই আন্দোলনের প্রেক্ষিত বা ভারত সরকারের কৃষিনীতি নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।
বিগত কিছু বছরে বিজেপি সরকারের কর্পোরেট-পদলেহনের আর্থিক নীতির কারণে ভারতের গণমানুষ, যেমন– কৃষিজীবী, কারিগরী সমাজ, অসংগঠিত শ্রমিক (এমনকি নানান সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরাও), ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী, নানাস্তরের চাকুরিজীবী মানুষ বিপাকের মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে কৃষিজীবীদের অবস্থা ভয়াবহ! ঋণ মুকুব না হওয়ার ফলে বহু হতদরিদ্র কৃষককে বেছে নিতে হয়েছে আত্মহত্যার পথ। কিন্তু বেশিরভাগ কৃষকই এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। ২০১৭ সালে তামিলনাড়ুর কৃষকদের পারফর্মেটিভ প্রোটেস্ট এবং ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্র থেকে শুরু হওয়া কিষান লং মার্চ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাদের জনবিরোধী অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র সরেনি, বরং যত দিন যাচ্ছে ততই তাদের গণবিরোধিতা ও পুঁজিপতিদের স্বার্থ চরিতার্থ করার নীতি আগ্রাসী চেহারা নিচ্ছে ব্যাপকভাবে। এরই পরম্পরায় নতুন সংযোজন অধুনা কৃষি বিল। যার ফলে কৃষকের অবস্থা তলানিতে এসে ঠেকবে এবং কর্পোরেট মুনাফা নিশ্চিত হবে।
২০২০ সালে ভারতে ৩টি কৃষি বিল আইনে রূপান্তরিত হয়েছে। এইগুলো হলো যথাক্রমে- ‘Farmers produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Act, 2020’ অর্থাৎ কৃষকের উৎপাদন ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার ও সুযোগ-সুবিধা) আইন ২০২০, ‘Farmers (Empowerment and Protection) Agreement of Price Assurance, Farm Services Act, 2020’, অর্থাৎ কৃষকের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) মূল্য নিশ্চয়তার চুক্তি, খামার পরিষেবাসমূহ আইন ২০২০, এবং ‘The Essential Commodities (Amendment) Act, 2020′, অর্থাৎ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন ২০২০। এই তিনটি আইন শুধুমাত্র কৃষকদেরই নয়, সাধারণ মানুষেরও চরম ভোগান্তির এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণ হতে চলেছে।
প্রথম আইনটির ফলে রাজ্য অনু্মোদিত কৃষিপণ্য বাজার কমিটির বা এপিএমসি’র আওতায় থাকা ‘কৃষক মান্ডি’র বাইরে কৃষকেরা নিজের রাজ্যের বা অন্য কোনো রাজ্যের কর্পোরেট সংস্থার কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। আপাতদৃষ্টিতে লাভজনক মনে হলেও এই বিলের ফলে এপিএমসি চাষীদের যে সরকারের বেঁধে দেওয়া নূন্যতম বিক্রয় মূল্য বা এমএসপিতে পণ্য বিক্রির অধিকার দেয়, সেই অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হবেন। এই অধিকার ১৯৬০-এর দশকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে সবুজ বিপ্লবের ফলশ্রুতি, যা কৃষকরা হাতছাড়া করবেন। কৃষক মান্ডির বাইরে কর্পোরেটরা এমএসপির পরোয়া না করে অনেক কম টাকায় পণ্য কিনবে। অন্যদিকে মন্ডি ফী না পাওয়ায় রাজ্যের রাজস্ব ভাঁড়ারে টান পড়বে, যার ফলে বিকেন্দ্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক পরিকাঠামো বিনষ্ট হতে পারে।
দ্বিতীয় আইনে অনুযায়ী ক্ষুদ্র কৃষকেরা পণ্য উৎপাদন হওয়ার আগেই মধ্যস্থতাকারীদের এড়িয়ে সরাসরি বহুজাতিক সংস্থা, হোলসেলার, পাইকারি ব্যবসাদার, রফতানিকারক সংস্থা ইত্যাদির সঙ্গে প্রাক-সম্মত মূল্যে চুক্তি করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে মুখে বলা হচ্ছে, চুক্তি অনুযায়ী ন্যায্য মূল্য না পেলে কৃষকেরা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক কারণে শস্য উৎপাদনে ঘাটতি হলে যদি বহুজাতিক সংস্থা তাদের প্রাপ্য মূল্য দিতে অস্বীকার করে তাহলে কৃষকেরা বিক্রয় মূল্য বা এমএসপি’র সাহায্য তো পাবেই না, এবং বলাই বাহুল্য এর ফলে তারা আইনি লড়াই লড়ার অবস্থাতেও থাকবেন না। অর্থাৎ, চুক্তিভঙ্গকারী কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে যাতে সহায়সম্বলহীন কৃষক আদালতের দ্বারস্থ হতে না পারে, এই আইনে সেই রাস্তা খোলা রয়েছে।
তৃতীয় বিলটি অনুযায়ী খাদ্যশস্য, তৈলবীজ, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি অত্যাবশ্যক পণ্য হিসেবে গণ্য হবে না এবং এই সমস্ত পণ্য মজুত করার ক্ষেত্রে বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে কোনো সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে নেমে আসবে খাদ্যসংকট। মানুষ যখন খেতে পাবে না তখন বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থা তাদের গুদামে ভরে রাখবে চাল, ডাল, আলু, এবং চড়া দামে তা বাজারে ছাড়বে।
এইসব কৃষক বিরোধী তথা জনবিরোধী আইগুলির বিরুদ্ধে অবস্থান বিক্ষোভে বসেছে পঞ্জাব-হরিয়ানার লাখো কৃষক এবং এই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে দলে দলে সাধারণ মানুষ।
এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে দিল্লি পৌছাই ২৮ ডিসেম্বর ভোরে।
একটা বিশাল ব্যারিকেডের সামনে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দেয়। ব্যারিকেডের গায়ে লেখা ― “রাস্তা বন্ধ”। দূর থেকে মাইকের আওয়াজ ভেসে আসছে। কিছুদূর এগোতেই এক বৃহৎ অ্যাজিটেশনের সাক্ষী হয়ে রইলাম। প্রথমে একটি পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। আমরা ছবি তুলছি দেখে বড়রা পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্যটিকে বললো ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসতে। তারপর কুশল বিনিময়, কলকাতা থেকে এসেছি শুনে মনে করিয়ে দিলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা আর পঞ্জাবের ভূমিকা উপমহাদেশের অন্যান্য দেশীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য। আরো মনে করালেন, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ ফারাক নেই।
“Freedom of speech means freedom from rhetoric.”
আন্দোলনের চেনা ছবির থেকে, পরিচিত ইমেজারির থেকে এই কৃষক বিদ্রোহ কিছুটা আলাদা বটেই। এই বিদ্রোহ, বিক্ষোভ রীতিমতো কার্নিভালের চেহারা নিয়েছে। এখানে মানুষ শুধু স্লোগানে বা ফেসবুক পোষ্টে না, আক্ষরিক অর্থেই মানুষ মানুষের পাশে আছে, একে অপরের কমরেড হয়ে। একটি পরিবার স্যুপ বানিয়ে এনেছে ড্রামে করে; পরিবারের পুরুষেরা সবাইকে ডেকে ডেকে বলছেন: আ যাও, গরম গরম স্যুপ পিলো, মহিলারা পরম যত্নে হাতে হাতে স্যুপ দিচ্ছে। খানিক জোর করেই আমার হাতে এক কাপ গরম স্যুপ ধরিয়ে দিয়ে এক আন্দোলনকারী কৃষক বললেন, খেয়ে নাও, খুব ঠান্ডা এখানে। যার সঙ্গেই কথা হচ্ছে প্রথমেই প্রশ্ন করছেন ‘খানা খায়া’? অথবা ‘চায় পী লো’। চা নিতে গেলে পাস থেকে কেউ পাউরুটি এগিয়ে দিয়ে বলছে খালি পেটে চা খেতে নেই।
কিছু স্টলে কৃষক আন্দোলনের পুস্তিকা বিক্রি হচ্ছে। একটি টেবিল থেকে একটি ব্যুকলেটের পাতা উল্টে দেখছি। কিনবো, কিন্তু সেই টেবিলে কোনো বিক্রেতা নেই; পাশের টেবিলের বিক্রেতা বললেন, এমনিই নিয়ে যাও, টাকা দিতে হবে না, কিন্তু নিয়ে যাচ্ছ যখন ফেলে রেখো না, পড়ে দেখো।
এক বয়স্ক ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, কলকাতায় কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে যে মিছিল হয়েছে সেখানে লোকজনের অংশগ্রহণ কেমন ছিল! কোলকাতার মিছিলের ভিডিও দেখলেন আমার ফোনে, খুশি হলেন। দুটি অল্পবয়সী ছেলের সাথে আলাপ হলো, যারা একে অন্যের পাগড়ি বেঁধে দিচ্ছিলেন। আমরা আমতা আমতা করে পাগড়ি পরার আবদার করতেই বলতেই রাজি হয়ে গেল, শুধু বললো কেশরী পাগড়ি পরে কী কী নিয়ম মানতে হবে। আমার বন্ধুর মাথায় যখন গেরুয়া পাগড়ি বাঁধছে ছেলেটি, অনেক বছর পর প্রথম মনে হলো: গেরুয়া রঙ বিজেপির বাপের সম্পত্তি নয়।
এরই সাথে সাথে একই সাথে রয়েছে অনর্গল বক্তৃতা, স্লোগান, গান, শিখ ধর্মের প্রার্থনা, ছোটো থেকে মাঝারি মিছিল, পোস্টার লেখা, কুশপুত্তলিকা দাহ… চারিদিকে অসংখ্য লঙ্গরখানা, অজস্র মেডিক্যাল ক্যাম্প, ডেন্টাল ক্যাম্প। এখানে রাজনীতি আর জীবন একই বুনোটে বাঁধা পড়েছে ছত্রে ছত্রে।
২৯ তারিখ সকাল সকাল ফের চলে এসেছি প্রোটেস্ট সাইটে। সলিডারিটির দায়ে নয়, সলিডারিটির টানে এসেছি। এই টান এক অদ্ভুত ভালোলাগার। এই বিক্ষোভ উদযাপনের মধ্যে যে যাপনটা আছে তা বিক্ষুব্ধ কৃষকদের কথায়, হাসিতে, চোখের চাহনিতে অনায়াসে ধরা পড়ে। সম্ভবত এই অনায়াস ভালোলাগাই কমরেডশিপের মূলে থাকে, যেখানে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হয় না যে আমি তোমার কমরেড। প্রত্যেকটি মানুষ যথাসাধ্য কন্ট্রিবিউট করছে আন্দোলনে ― ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত বিজ্ঞাপনের গিমিক নেই, সেই সুযোগই নেই। এই অনায়াস ভাবই এই আন্দোলনের মূল শক্তি। তাই বলে কী এই আন্দোলনে স্ট্র্যাটেজি নেই, কৌশল নেই, শুধু আবেগ আছে? একেবারেই না। অত্যন্ত সুকৌশলী না হলে এতবড় আন্দোলন এতদিন ধরে সংগঠিত করে রাখা যায়না। কৌশলের সঙ্গে অনায়াস ভাবের কোনো বৈরিতা নেই। আবেগ আর যুক্তিশৃঙ্খলার মধ্যে শত্রুতা নেই,বরং তারা একে অপরের পরিপূরক: এই আন্দোলন তারই একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
কেন কৃষি আইন গণবিরোধী কেন বিজেপি আর তার হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি এজেন্ডা ও নয়া-উদার অর্থনীতির বাস্তবায়নের কর্মসূচী সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকারক সেই্সব নিয়ে অহরহ এই বিক্ষোভ-বিদ্রোহের কার্নিভাল প্রাঙ্গনে আলাপ-আলোচনা চলছে, একই সঙ্গে চলছে চাঁচাছোলা বক্তব্য। সোশ্যল মিডিয়া এবং শহুরে রাজনৈতিক স্পেসের একচেটিয়া শব্দচয়নের ভার কাটিয়ে তা হয়ে উঠছে ল্যাঙ্গুয়েজ অফ পাব্লিক। উম্বার্তো একোর কথা মনে পড়ে যায়; ফ্যাসিবাদ প্রসঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে তিনি তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন “freedom of speech means freedom from rhetoric.” ― বাকস্বাধীনতার মনে বাগাড়ম্বরতা থেকে স্বাধীনতা।
ছবি সূত্র: ইন্টারনেট ও লেখক।
পাঞ্চালী কর
থিয়েটার ও সমাজকর্মী। দীর্ঘ এক দশক লৈঙ্গিক রাজনীতি বা জেন্ডার পলিটিক্সের ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম নিয়ে কাজ করছেন ।