।। নাদিয়া ইসলাম ।।
কালী তো শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বামীকে পদনত করার নারীচরিত্রের ভবিতব্য হিসাবে অপরাধবোধ আর লজ্জায় জিভ কাটার পরেও নগ্ন উগ্র ক্রোধে উন্মত্ত নারীমূর্তির ডাইকোটমিক চরিত্র নন, তিনি তার চাইতেও বড়। আমাদের বুঝতে হবে, শূন্যতার বোধ থেকে যে সময়চেতনার শুরু, সেই পরম মহাশূন্যের সামনে তাকে ডিলেমায় আক্রান্ত করা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাচর্চারই অংশ, তাকে ক্ষুদ্র বানানোর রাজনৈতিক খেলা। যুগ যুগ ধরে চলা নারীশক্তি দমনের আর্যীয় ক্ষমতাব্যবস্থায় কালী যেভাবে ক্ষমতা প্রদর্শণের পরেও ক্ষমতা হারান, তার পায়ের তলায় শব থেকে শিবে রূপান্তরের আশ্চর্য্য যাদুশক্তি থাকার পরেও তিনি যেভাবে লজ্জাবনত হন, বিশ্বজগতকে গর্ভে ধারণ করেও যিনি স্থান কাল পাত্রে আটকে পড়েন, মহাকালের রূপমোহিনী হয়েও যিনি দৈহিক সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞায় নাকচ হয়ে যান, তখন বুঝতে কষ্ট হয় না, সেই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাব্যবস্থা নারীশক্তি দমনে কী বিপুল পরিমাণের শ্রম দিয়েছে।
১
সপ্তাহখানেক আগের কথা। আমি আর আমার ইকোনমিস্ট বন্ধু আবেকু এলোলো ওউসুর সঙ্গে কথা বলছিলাম আমেরিকার নির্বাচন, ট্রাম্প আর বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে।
আবেকু এলোলো ওউসু গানার ছেলে, কিছুদিন আগেই মাইক্রোইকোনমিক্সে ওনার পিএইচডি শেষ করেছেন। আলাপের এক পর্যায়ে ব্লাক ইকোনমি, ডার্ক ওয়েব আর ব্লাকমেইল নিয়ে কথা বলতে উনি হঠাৎ করেই বললেন, “আচ্ছা খেয়াল করেছ, পৃথিবীর সব অসৎ জিনিসের- খারাপ জিনিসের উদাহরণই দেয়া হয় ‘কালো’ দিয়ে? কালো রাত, কালো বাজার, কালো তালিকা, কালো যাদু, কালো ভেড়া; খেয়াল করেছ, এইসবগুলি ক্ষেত্রেই খারাপ কিছু বোঝাতে ‘কালো’ ব্যবহার হচ্ছে?”
আমি হাই তুলতে তুলতে ওপর নিচ সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। এই তথ্য যুগান্তকারী নতুন কোনো তথ্য না।
কারণ শব্দের রাজনীতিও নতুন কিছু না। শব্দ দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শুরু, শব্দ দিয়ে জন্মের শুরু। শব্দ দিয়ে আমরা প্রেমে পড়ি, স্মৃতিকাতর হই, শব্দ দিয়ে আমরা ঈশ্বরকে খুঁজি, শব্দ দিয়ে অবিশ্বাস করি, শব্দ দিয়ে প্রতিবাদ করি, বিদ্রোহ করি, কবিতা লিখি। শব্দ আমাদের হাসায় এবং কাঁদায়, শব্দ আমাদের স্বপ্ন দেখায়, আবার শব্দই খড়খড়া বাস্তবের খড়খড়া ধূলির খড়খড়া ধরায় আমাদের কান ধরে টেনে নামিয়ে আনে। শব্দ দিয়ে আমরা শাসনও করি। রাজনীতি করি। আইন লিখি। শব্দ দিয়েই আমরা ব্রাহ্মণ আর শূদ্র, আশরাফ আর আতরাফ তৈরি করি। শব্দ দিয়েই নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য স্থাপন করতে স্ত্রীর বিপরীত লিঙ্গে আমরা ‘স্বামী’ নামক ‘প্রভু’টিকে বসাই।
কালো কেন খারাপ- এর খুব সরল এভোলুশনারি ব্যখ্যা আছে। যদি সরলভাবে দেখা যায়, তাহলে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না আমাদের ‘পূর্ব‘পুরুষ’ (হাহা) আদিম মানুষেরা কেন বিপদের সমার্থক শব্দ হিসাবে কালোকে দেখতেন। দিনের আলোতে বিপদের সম্ভাবনা কম, কিন্তু সূর্য ডোবার সাথে সাথে কালো অন্ধকারে বন্য প্রাণীর আক্রমণের ভয় থেকেই কালোর সাথে বিপদের যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল। সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞার সাথে আদিম মানুষের নিরাপত্তার বোধ জড়িত। যা কিছু বিপদমুক্ত, যা কিছু নিরাপদ, যা কিছু পরিচ্ছন্ন নীল আকাশ, যা কিছু গরম গ্রীষ্ম দিন, যা কিছু উদ্বৃত্ত খাদ্য, যা কিছু নিরাপদ সন্তান জন্মদান- তাই সুন্দর, তাই নির্মল, তাই পবিত্র। আর তার বিপরীতে যা কিছু অন্ধকার, যা কিছু অজানা, যা কিছু মৃত্যু, যা কিছু দীর্ঘ শীতের রাত- তাই ভয়, তাই বিপদ, তাই কালো। অন্ততঃ আদিম মানুষের জন্য তাই ছিল।
কিন্তু আগুন এবং বৈদ্যুতিক আলো আবিষ্কারের পর যুগ পাড় হয়ে গেলেও আর সমুদ্রের প্রাচীন তলদেশ দিয়ে মাইলের পর মাইল সাবমেরিন কেবল টেনে নিয়ে এক মহাদেশের সাথে আরেক মহাদেশ তথ্য দিয়ে যুক্ত করে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে মঙ্গল গ্রহে ঢিস্টিং ঢিস্টিং গাড়ি চালিয়ে জিনেটিক এনজিনিয়ারিং করে ল্যাবেরেটোরিতে নতুন প্রজাতির শক্তিশালী ধানের চারা আর ফ্লুরোসেন্ট ব্যাং আর কৃত্রিম হৃদপিণ্ড তৈরি করে মায়ের পেটের বাইরে কাচের বোতলে বাচ্চা জন্ম দিয়ে প্রাচীন নিরাপত্তার সংজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হুভার ড্যামের উপর থেকে পায়ের পাতায় দড়ি বেঁধে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে ঝড়ের রাতে জাহাজের মাস্তুলে দাঁড়িয়ে এ্যাঁকাব্যাঁকা মাতাল হয়ে ‘ইয়ো হো হো অ্যান্ড আ বটল অভ রাম’ বলে চেঁচিয়ে বিপদকে উদযাপন করেও প্রাচীন শব্দের রাজনীতি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। কালো তাই এখনও কুৎসিত, কালো তাই এখনও বিপদজনক, কালো তাই এখনও অবৈধ, কালো তাই এখনও ঋণাত্মক। অন্ততঃ সামগ্রিক অর্থে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি অবশ্য সেভাবে দেখি না। আমার কাছে কালো অর্থ কালী। যা কালের অতীত। এবং মহাকাল। এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি শক্তি। অন্যদিকে আধুনিক নারীবাদীরাও কালীকে যেভাবে পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার বিপরীতে বৈদিকীকৃত নাটকীয় ভঙ্গিতে স্বামী শিবের বুকের উপর এক পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা- গলায় নরমুন্ড পরা- নগ্ন নারীশক্তির উদ্ধত ও উদ্ভিন্নযৌবনা রূপ হিসাবে দেখেন, আমি ঠিক সেভাবেও তাঁকে দেখি না।
কীভাবে দেখি, তা ব্যখ্যা করতে খানিক ইতিহাস কচকচানো জরুরী।
প্রায় চার হাজার বছর ধরে প্রাক-অদ্বয়বাদ বৈদান্তিক পর্যায় থেকে অদ্বয়বাদ পরবর্তী পৌরাণিক পর্যায়ে ঈশ্বরের ধারণার পাশাপাশি হিন্দু বিচাপদ্ধতির রূপান্তরের সাথে সাথে অনার্য মাতৃরূপী কালী আর্য কালীর বর্তমান ভার্সানে পাল্টে যায়। আমি এই বর্তমান ভার্সানের কালীর কথা বলছি না।
এশিয়া মাইনরের উত্তরাঞ্চলের মেষপালক যাযাবর আর্য জাতির একাংশ ১৮০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন গান্ধার রাজ্যের তক্ষশীলায় (বর্তমান আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে) প্রবেশ করে অনার্য মানুষদের যুদ্ধে পরাস্ত করে এই অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে তোলেন। মজার বিষয় হচ্ছে, এই পরাজিত অনার্য মানুষদেরই পরবর্তীতে রাক্ষস এবং খোক্ষস নামে ডাকা শুরু হয়। কিন্তু এই আলাপে পরে আসা যাবে। তো, আর্যদের প্রবেশের আগে ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বে সিন্ধু উপত্যকা ও স্বরস্বতী নদীর তীরে কল্লি এবং ঝপ জাতি সহ সামগ্রিকভাবে হরপ্পা সভ্যতায় পোড়ামাটির ষাঁড়ের পাশে গয়না গায়ের ও পেট থেকে উদ্গত লতানো গাছের পৃথিবীর মাতৃরূপী যে নগ্ন নারী মূর্তির খোঁজ পাওয়া যায়, তাই পরবর্তীতে বৈদিক নৈঋতি দেবী- যিনি তারও পরবর্তী সময়ে কালী মূর্তিতে রূপান্তরিত হন বলে ধারণা করা হয়।
হরপ্পার অনার্য সংস্কৃতিতে শক্তিকে ঐশ্বরিক নারী রূপে দেখা হতো। এই নারীশ্বরের স্বামীর প্রয়োজন ছিল না, তিনি কারুর বাহুলগ্না বা কোমরলগ্না ছিলেন না, তিনি স্বাধীন, তিনি সম্পূর্ণ, তিনি একলাই পরম প্রতাপশালী, একলাই পরম শক্তিমান। তাঁর প্রজননক্ষমতাই তার শক্তি।
যদিও এই সিনারিও খুব দ্রুতই পাল্টে যায় আর্যদের পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব বিস্তারের সাথে সাথে। হরপ্পা টু গুপ্ত যুগে মাতৃতান্ত্রিক স্বাধীন দেবীরা তাঁদের প্রভাব এবং ক্ষমতা হারান এবং প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব স্টেটাস হারিয়ে আর্য দেবতাদের সঙ্গী (পড়ুন- স্ত্রী বা বেশ্যা) হিসাবে পরিচিত হন। এর সম্ভবতঃ একমাত্র ব্যতিক্রম নৈঋতি। পুরাণযুগে, অর্থাৎ ১০০০ খ্রিস্টপূর্বে শতপথ ব্রাহ্মণ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণে যে কালো রঙের, উদ্ভ্রান্ত চুলের দক্ষিণ থেকে আসা মৃত্যুর দেবী নৈঋতির উল্লেখ পাওয়া যায়, তিনি ছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ; তার কোনো আর্য পুরুষ সঙ্গীর প্রয়োজন ছিল না।
এবং সম্ভবতঃ এই কারণেই পরবর্তীতে নৈঋতি থেকে আর্য কালীর যেই আধুনিক ভার্সান তৈরি হয়, তার আরেক নাম হয় দক্ষিণাকালী। যদিও নৈঋতির মতো আর্য কালী একক গরিমায় সিঙ্গেল জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হননি, বরং ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ ব্যবস্থায় বা শাক্ত শাস্ত্রের বাদবাকি আর্য দেবীদের মত তাঁকেও স্বামী গ্রহণ করতে হয়েছিল। কারণ, অনার্য বিশ্বাসের বিপরীতে প্রকৃতিনির্ভর প্রাক ও মূল বৈদিক ধর্মে যেহেতু যাবতীয় ভৌত প্রাকৃতিক শক্তি যেমন আগুন, বাতাস, পানি প্রভৃতিকে ঐশীশক্তি অর্থাৎ পুরুষ দেবতা হিসাবে দেখা হতো, তাই এই অঞ্চলের অনার্যদের উপর আর্যীয় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলেন এই পুরুষ দেবতাদের ‘সাইডকিক’- তাঁদের নারী সঙ্গীরা। যে কারণে পার্বতী, সতী, গৌরী, মহাদেবী, অন্নপূর্ণা, দুর্গা এবং চণ্ডীর মত দেবীরা কেউ একলা থাকতে পারেননি, বরং তাঁদের সকলেই মহাদেবের সঙ্গী হিসাবে দেখা হয়েছে।
আর্য এবং অনার্যদের এই পুরুষতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক বিপরীতমুখী বিশ্বাসের যোগফল (এবং বিয়োগফলে) যখন নব্য-তন্ত্রসাধনার জন্ম নেয়, তখন কালীর বর্তমান ভার্সান তৈরি হয়। যদিও বজ্রযানী ও লোকায়ত নানাবিধ প্রাকৃত ধর্মে যে আদি তন্ত্রচর্চা প্রকৃতি ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানতত্ত্বের যে বিকাশ ঘটিয়েছিল, তা বৈদিকবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং প্রকৃতিনিবিড়। সেখানে পুরুষবাদের কোনোপ্রকার প্রভাব ছিল না। কিন্তু বঙ্গে বৈদিকবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের অনুপ্রবেশের সাথে সাথেই তন্ত্র বিকৃত হয়েছে। যে তন্ত্র ছিল প্রকৃতিকে জানার বা প্রাকৃতিক জ্ঞান অর্জনের নানাবিধ বিদ্যা, সেই তন্ত্রই ক্রমে হয়ে উঠেছে গুপ্ত ও গূহ্যচর্চা এবং দেহতত্ত্বের নামে ‘নারীদেহ’কে ‘উপায়’ হিসাবে চিহ্নিত করে তাকে এবিউজ করার পন্থা বিশেষ। তন্ত্রের কেন্দ্রভাগে চলে এসেছে ‘কামসাধনা’র নামে নারীদেহ এবিউজ করার বিষয়টি। যে কারণে শ্রীচৈতন্য তন্ত্রকে খারিজ করেছেন সুলতান যুগে।
এই তন্ত্রসাধনার মূল রীতি অনার্য কৌম সমাজের লোকাচার নির্ভর, পুরুষতান্ত্রিক ধর্মের চোখ রাঙানির দুই লাইন বাইরে। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদ তন্ত্রকে যেভাবে বিকৃত করেছে তাতে তন্ত্র আবার তার বাইরেও নয়। কিন্তু আবার পুরোপুরি বাইরেও নয়। পঞ্চদশ থেকে ষষ্ঠদশ খ্রিস্টাব্দে আগমবাগীশের তন্ত্রসার সংকলনে এবং পরবর্তীতে মহানির্বাণতন্ত্রে আর্য অনার্য সংমিশ্রণের এই কালীর বর্ণনা পাওয়া যায়। এই কালী নগ্ন, উদ্ভিন্নযৌবনা, মহারৌদ্রী, ঘোরদ্রংষ্টা, শ্মশানবাসিনী। এই কালীর গায়ের রঙ মেঘের মত কালো, তার চার হাত, গলায় মুণ্ডমালা, মাথাভর্তি এলোমেলো চুল, চোখে ভয়ংকর দৃষ্টি, এক পা শিবের বুকের উপর দেয়া। তার বামদিকের এক হাতে সদ্যচ্ছিন্ন রক্তাক্ত পুরুষ মাথা, অন্য হাতে খড়গ। ডানদিকের একহাতে অভয় আর অন্য হাতে বর।
নব্য-তন্ত্রসাধকেরা বহু বছর তাদের গুহ্যসাধনার অংশ হিসাবে গোপনে এই কালীর পুজা করেছেন। এরপর সপ্তদশ শতকে সম্ভবতঃ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মাধ্যমে কার্তিক ও মাঘের অমাবশ্যাচতুর্দশীতে প্রকাশ্যে কালীপুজার প্রচলন শুরু হয়।
কিন্তু ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, আর্যীয়করণ করা হলেও কালী বৈদিক আর বেশিরভাগ দেবী থেকে আলাদা। অনার্য মাতৃরূপী যে ঈশ্বরের ধারণা থেকে কালীর জন্ম, তাঁকে পুরুষতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদের মাধ্যমে আর্যীকৃত ডমিস্টিকেটেড করার চেষ্টা হলেও, তাঁকে স্বামী গ্রহণ করতে হলেও তিনি সেই পুরুষতন্ত্রের বুকে লাথি দিয়ে স্বগৌরবে স্বমহিমায় লজ্জাহীনভাবে আপোষহীনভাবে ক্ষমাপ্রার্থণা না করেই নিজের মাতৃরূপ নিয়েই, গায়ের ‘ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী’হীন কালো রঙ নিয়েই, সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞা নিরাপত্তার সংজ্ঞাকে কাঁচকলা দেখিয়েই এক মাথা তেলহীন চিরুনীহীন লাল নীল ফিতাহীন এলেমেলো চুল নিয়ে যজ্ঞাগ্নির উগ্রমূর্তি জিহ্বার মত মেরুদণ্ড সোজা করে নিজের সমস্ত নারীত্ব সমেত দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি সিস্টেমের ভেতরে থেকেও সিস্টেমকে নাকচ করে দিচ্ছেন। তাঁর হাতভর্তি মানুষের রক্ত, যেই রক্ত দিয়ে তিনি বিপ্লবের সূচনা করছেন।
আহা, রক্ত ছাড়া কী বিপ্লব হয়?
তবে আমি কালো বলতে এই কালীকেও বুঝি না। এই কালী সেক্সি, এই কালী থার্ড ওয়েভ নারীবাদী, এই কালী বিপ্লবী, এই কালী মাতৃরূপী- সন্দেহ নাই; এই কালী একইসঙ্গে তথাকথিত নারীবৈশিষ্ট্য ও পুরুষবৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছেন- সন্দেহ নাই; উপনিষদের “কালী করালি চঃ মনঃজবা চঃ, সুলোহিতা যা চঃ সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গীনি বিশ্বরুচি চঃ দেবী, লেলায়মানা ইতি সপ্তজিহ্বাঃ” শ্লোকের বর্ণনার মতই তিনি তেজস্বী, তিনি ভয়ংকর- সন্দেহ নাই; মহাভারতের পাণ্ডব শিবিরে দেখা যাওয়া শক্তির মত তিনি একইসাথে প্রাণসংহারি ও প্রাণদাত্রী- সন্দেহ নাই; কিন্তু মার্কেন্ডিয় পুরাণ থেকে শুরু করে উপপুরাণ বা তন্ত্রাদি বা এমনকি বাণভাট্টের কাদম্বরীতে কালী যেভাবে বিবর্তিত হয়েছেন, যেভাবে বিপরীত রমণে পুরুষ শক্তিকে বধ করার উদগ্র বাসনা তার ভেতর চিত্রিত হয়েছে, তাঁকে খানিক ‘ডেসপারেট’ বলেই আমার মনে হয়।
ডেসপেরেশান সমস্যার বিষয় না অবশ্যই। আর ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরোহিততান্ত্রিক পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ প্রভুর বিরুদ্ধে একলা যুদ্ধে নামতে ডেসপেরেশান আবশ্যিক। কিন্তু এই ডেসপেরেশান কালীকে তাঁর মাহাত্ম্য থেকে খাটো করে বলেই আমি বিশ্বাস করি। অতীতের অনার্য ঈশ্বরকল্পনাকে সমন্বিত করে যে কালীকে তৈরি করার চেষ্টা ছিলো, তা কালীর এই সাকার রূপের মাধ্যমে নাকচ করে দেয়। কৌম সমাজের লোকাচার নির্ভর জাতিভেদহীন ব্রাত্যধর্ম আদি তন্ত্র থেকেও কালী বিচ্ছিন্ন হয়ে বৈদিক ধর্মের প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে যান। সপ্তদশ শতকে শাক্তদের মাধ্যমে সংকলিত আদি তন্ত্র যখন একাদশ শতকে ব্রাহ্মণীকৃত হয়ে তাঁর মূল সুর পাল্টে ফেলতে বাধ্য হন এবং প্রকৃতিকে জানার উপায় হিসাবে তন্ত্রের ডিসকোর্সকে কিছুটা বদলে ব্রহ্মলাভই তন্ত্রসাধনার প্রধান লক্ষ্য বলে আচারবিহীন তন্ত্রকে বেদকেন্দ্রিক করে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়, তখনই কালী আধ্যাত্মবাদ বা অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি বা দর্শণের জায়গা থেকে সরে গিয়ে নিছক ঐহিক প্রাপ্তির চক্রে আটকে যান।
অথচ যদি ফর দা সেইক অভ আর্গুমেন্ট- ব্রহ্মলাভকেই নব্যতন্ত্রের অভিপ্রায় বলে দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে মহানির্বাণতন্ত্র থেকে উপনিষদ সবজায়গাতেই ব্রহ্মের বর্ণনায় এক, অদ্বিতীয়, নিরাকার, সর্বত্র বিরাজমান, অসীম ক্ষমতাধর, সত্য, সম্পূর্ণ, সুন্দর- এই কথা বলা হয়েছে। এবং এই বর্ণনা আপাতভাবে আব্রাহামিক একেশ্বরবাদের চর্চার সঙ্গে মিলে যায়। যদিও মনে রাখা দরকার, আদি শঙ্করাচার্য ব্রহ্মকে নিরাকার ও পরম সত্য বলতে গিয়ে তিনি জগৎ ও তার রূপবৈচিত্র্যকেই খারিজ করছেন। তিনি বলছেন, ‘জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য।’ জগৎকে মিথ্যা বলে একমাত্র ব্রহ্মকে সত্য বললে অস্বীকার করা হয় মানুষকে, জীবকে। কিন্তু আদি বজ্রযানী কিংবা লোকায়ত তন্ত্র বলুন, অনার্য সনাতন ধর্মবৈচিত্র্যের অথবা ইসলামকে উদাহরণ করে যদি আব্রহামিক একেশ্বরবাদের পর্যালোচনা করা যায়, দেখা যাবে, এগুলোর কোথাও মানুষকে বা মনুষ্যজগতকে অস্বীকার করা হয় নাই। ইসলাম নিয়ে আমার বা আপনার নানারকম ক্রিটিক্যাল পোজিশন থাকতেই পারে, কিন্তু যখনই বলা হচ্ছে, বিসমিল্লহির রাহমানির রাহিম তখন কিন্তু পরমসত্ত্বাকে ‘দয়ালু’ বলা হচ্ছে। এবং তিনিই পরম প্রতিপালক। প্রতিপালকের কথা উঠলে প্রতিপালিতের কথাও আসবে। প্রতিপালক ও প্রতিপালিত যথাক্রমে নিরাকার ও তাঁরই রূপময় লীলাচিহ্নের রূপান্তর। অতএব মানুষের জগৎ কখনোই ‘মিথ্যা’ নয়। যাইহোক, অনার্য ভূমিমানুষদের কালীকে তার কালহীন নিরাকারের জায়গা থেকে সরিয়ে বাক্সবন্দী বিপ্লবী জাস্ট ফর দা সেইক অভ ইট-এ রূপান্তরের ন্যারেটিভটাও আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদ কর্তৃক নিরাকার ব্রহ্মের প্রাকৃত টোটেমিয় রূপের রূপান্তর, কেননা ভূমিজ অনার্যদের মূর্তি ব্যবস্থা তো আরবিক কেন্দ্রীয় পৌত্তলিক ব্যবস্থা নয় বরং এখানকার রূপজগৎ আসলেই প্রকৃতির মেটাফর, টোটেম, তাই এই অঞ্চলে বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রসারে নিরাকার এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মের বহু খণ্ডণ করছে প্রাকৃতিক টোটেমের মধ্যে ব্রহ্মভাব আরোপ করে তা নিয়ে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে। এবং যে মূর্তিগুলো ছিল প্রাকৃতিক টোটেম, সেই মেটাফরগুলো ক্রমে হয়ে উঠেছে অধিবিদ্যক চিহ্ন! এই জায়গা থেকে সময়ের আদি কালীর রূপান্তর ঘটছে ব্রাহ্মণ্যবাদী নব্যতান্ত্রিকদের হাত ধরে। এই বিষয়টি দেখলে তা ভালো লাগার কথা না।
২
ভারতীয় উপমহাদেশ অঞ্চলের নারীবাদের সাথে পশ্চিমা নারীবাদের খুব মৌলিক কিছু জায়গায় পার্থক্য আছে। ‘ওয়েভ’ দিয়ে পশ্চিমা নারীবাদ এবং তার সময়কালকে যেভাবে খুব সহজেই ভাগ করে ফেলা যায়, এই অঞ্চলের নারীবাদকে সেভাবে ব্যখ্যা করা যায় না। মোটাদাগে ফার্স্ট ওয়েভ পশ্চিমা নারীবাদ যদি নারীর রাজনৈতিক অধিকার আন্দোলন, সেকেন্ড ওয়েভ যদি অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং থার্ড ওয়েভ যদি নারীর শরীরের অধিকার আদায়ের আন্দোলন হয়, তাহলে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারব কোথায় কোথায় আমাদের অঞ্চলের সাথে পশ্চিমা নারীবাদের বিপুল পার্থক্য আছে। খেয়াল করলে এবং এমনকি খেয়াল না করলেও দেখা যাবে, এই অঞ্চলে কিছুক্ষেত্রে নারীরা এখনো, এই মূহুর্তে অর্থাৎ ২০২০ সালেও তাদের রাজনৈতিক, কিছুক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুক্ত আছেন। অর্থাৎ এই উপমহাদেশে এখনো যুগ্মভাবে পশ্চিমা ফার্স্ট ও সেকেন্ড ওয়েভের নারীবাদী আন্দোলন চলছে। খুব সামান্য তথাকথিত ‘উন্নত’ অঞ্চলে খুব সামান্য উচ্চ-মধ্যবিত্ত ‘শিক্ষিত’ শ্রেণিতে থার্ড ওয়েভের ব্যতিক্রম শুরু হয়েছে, যেখানে নারীরা নিজের শরীরের অধিকার, যৌন স্বাধীনতা, নিজের সঙ্গী নিজে নির্বাচনের ক্ষমতা নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন।
ভারতীয় উপমহাদেশ নামক মেল্টিং পটে যে গত পাঁচ হাজার বছর ধরে একগাদা শাসকের অধীনে একগাদা জাতিবর্ণগোত্র তৈরি হয়েছে, অল দা কালার্স অভ রেইনবো নিয়ে যে একগাদা ধর্মের একগাদা বিশ্বাসের একগাদা ধারা উপধারা উপউপউপধারা দিয়ে মানুষ বিভক্ত এবং একও হয়েছেন, তার কারণেই ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য বেশিরভাগ ‘বাদের’ মতো নারীবাদকেও সরলরৈখিক সময়সীমায় ভাগ করা যায় না। তাই পশ্চিমা রীতিতে এই অঞ্চলে নারীবাদের এক ওয়েভ শেষ করে অন্য ওয়েভে ঢোকার দাবী জানানো হলে, বা ‘সেকেন্ড ওয়েভের দাবী আদায়ের আগে থার্ড ওয়েভ নিয়ে কথা বলা যাবে না’ বলে হাত পা ছড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করলে তা বেশিরভাগ অর্থেই অকালকুষ্মাণ্ডীয় অর্বাচীন অনর্থক কথা বলা হয়। এই অঞ্চলের নারীরা জন্মগতভাবে প্রতিবাদী, বিদেশী শাসন থেকে শুরু করে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বা নিরস্ত্র প্রতিবাদের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ভাষা ছিল। ঔপনিবেশিকবাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক শক্তির সামনে এই অঞ্চলের পুরুষরা তাদের বিদেশী জামা প্যান্টে গুঁজে বকলেস আটকিয়ে মৃদুস্বরে মিঁউমিঁউ করলেও নারীরা তাদের শাড়ী চুরি ছেড়ে দেন নাই, তাদের লোকাচার ত্যাগ করেন নাই। তারা ম্যাজিক আর যাত্রা দেখতে সমবেতভাবে রাত্রিবেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে ঘোড়ায় চড়ে সেই আঠারশ শতকেই স্বামীদেবতার বিরুদ্ধে খোরপোশের মামলা করে তাদের জেলের ভাত খাইয়ে ১৮৭০-এ ‘নারী’ পত্রিকা বের করে উচ্চকণ্ঠে নিজের প্রেমের কথা জানিয়ে রাস্তায় ডাকাতি করে খুন করে ব্রিটিশ রাজের অস্ত্রাগার বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে পরপুরুষের সাথে হাস্যকৌতুক আর নৃত্যাদি নামের ‘স্বেচ্ছাচার’ করে নিজ মহিমায় নিজ জীবন যাপন করেছেন। আবার একই সময়ে তার উল্টাভাবে, তারা আজকের দিন পর্যন্ত ঘরে ঘরে ধর্ম সমাজ এবং কেন্দ্রিয় পুরুষ মস্তিষ্ক দিয়ে নির্যাতিত নিষ্পেষিত অবহেলিত হয়েছেন, গায়ে কেরোসিন ঢেলে গলায় ফাঁস দিয়ে পানিতে ডুবে আত্মহত্যাও করেছেন।
প্রাচ্যীয় নারীবাদের এই রোলারকোস্টার রাইডকে সময় দিয়ে তাই ভাগ করা যায় না। তাই প্রাচ্যের নারীবাদে কালীর ভূমিকা শুধু মাতৃরূপে দেখলে চলে না, শুধু ব্যক্তি পুরুষের বিরুদ্ধে বা কেন্দ্রিয় পুরুষ মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে বা পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যোনিনির্ভর একক উগ্র নারীশক্তি হিসাবে দেখলে চলে না, তাই এই অঞ্চলের নারীবাদ বুঝতে হলে মহাকাল অতিক্রম করে কালীর চিন্তার দর্শন- তার নারী শরীরের বাইরের নিরাকার কালেক্টিভ আনকনশাসনেসের আধ্যাত্মবাদ ধারণ করতে হয়। যেই কালী থেকে সৃষ্টির চেতনা শুরু, যেই কালী থেকে সময়ের সৃষ্টি, যেই কালী থেকে সমগ্র সৃষ্টিজগতকে গর্ভধারণ, সেই কালী তো শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বামীকে পদনত করার নারীচরিত্রের ভবিতব্য হিসাবে অপরাধবোধ আর লজ্জায় জিভ কাটার পরেও নগ্ন উগ্র ক্রোধে উন্মত্ত নারীমূর্তির ডাইকোটমিক চরিত্র নন, তিনি তার চাইতেও বড়। আমাদের বুঝতে হবে, শূন্যতার বোধ থেকে যে সময়চেতনার শুরু, সেই পরম মহাশূন্যের সামনে তাকে ডিলেমায় আক্রান্ত করা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাচর্চারই অংশ, তাকে ক্ষুদ্র বানানোর রাজনৈতিক খেলা। যুগ যুগ ধরে চলা নারীশক্তি দমনের আর্যীয় ক্ষমতাব্যবস্থায় কালী যেভাবে ক্ষমতা প্রদর্শণের পরেও ক্ষমতা হারান, তার পায়ের তলায় শব থেকে শিবে রূপান্তরের আশ্চর্য্য যাদুশক্তি থাকার পরেও তিনি যেভাবে লজ্জাবনত হন, বিশ্বজগতকে গর্ভে ধারণ করেও যিনি স্থান কাল পাত্রে আটকে পড়েন, মহাকালের রূপমোহিনী হয়েও যিনি দৈহিক সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞায় নাকচ হয়ে যান, তখন বুঝতে কষ্ট হয় না, সেই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাব্যবস্থা নারীশক্তি দমনে কী বিপুল পরিমাণের শ্রম দিয়েছে।
তাই পুরুষতন্ত্রের মাধ্যমে হাতে ধরিয়ে দেয়া ললিপপ চুষতে চুষতে যদি সেই ললিপপকেই জীবনের মোক্ষ বলে ভাবার ভুল থেকে যদি সেই ললিপপকে স্বাধীনতা ভাবার ভুল থেকে উপমহাদেশের নারীবাদের বেরিয়ে আসতে হয়, তাহলে কালীর আদি ধারণার পুনর্জন্ম প্রয়োজন।
৩
গায়ের রঙ কালো বলে আমার মা আমাকে ছোটবেলায় কালী বলে ডাকতেন। এই সম্বোধনে আমার কোনোদিন আপত্তি ছিলো না, আমি এই সম্বোধনকে ঋণাত্মকভাবেও কোনোদিন দেখিনি। মা সেইসময় না জানলেও আমি জানতাম, কালো থেকে না, বরং কাল থেকেই কালীর উৎপত্তি। যদিও কালো থেকে কালী আসলেও তাতেও কোনো সমস্যা হতো না।
আদিম মানুষের জিনেটিক মেমোরি আমরা আমাদের শরীর এবং মনে বহন করি সত্য, কিন্তু আমরা সেই অনর্থক ভয়ের স্মৃতিকারতা থেকে চাইলে বেরও হয়ে আসতে পারি। কালো শব্দের যে প্রাচীন কনোটেশান, যেই বাইনারিতে সাদা কালোর ভাগ, সুন্দর অসুন্দরের ভাগ, নির্মল অপবিত্রের ভাগ- তার বাইরে সচেতন ভাবে বের হলে আমরা হয়তো কালোকে ভয় পাবো না, হয়তো ব্ল্যাক হোলের শূন্যতায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশংকা আমাদের তাড়া করবে না, হয়তো মৃত্যুকে আমাদের অজানার বিষয় বলে মনে হবে না। হয়তো আমরা বুঝবো, শূন্যতাই পরিপূর্ণতাকে পরিপূর্ণ শূন্য করে, কালোই সাদাকে সাদার মত কালো করে, সময়হীনতাই সময়কে সময় এবং সময়হীনতার সংজ্ঞা দেয়। হয়তো আমরা দেখতে শিখবো, পৃথিবীতে সত্য অসত্য বলে কিছুই নাই, পৃথিবীতে শুধু একান্তভাবে সত্য এবং একান্তভাবে মিথ্যা বলে কিছু হয় না, হয়তো দেখবো, বিশ্বাস অবিশ্বাসের ধারণাও মেটান্যারেটিভকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের সংজ্ঞার বিশ্বাস অবিশ্বাসের ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে। তাই আমরা যা বিশ্বাস করি, যা অবিশ্বাস করি, যা বিশ্বাস করি বলে ভাবি, যা অবিশ্বাস করি বলে ভাবি, যা ভাবি বলে ভাবি, তার সবই আমাদের নিজেদের মাথার ভিতর তৈরি করা জগতের এবং মাথারও ভ্রম। তবে ভ্রম হলেও যেহেতু জীবনের ভেতর দিয়ে আমাদের যেতে হয়, ইস্কুলে ব্রিটিশ রাজের সময়কাল আর পিথাগোরাসের উপপাদ্য মুখস্ত করে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডিগ্রি নিয়ে একটা বিয়ে করে গোটা দুই শিশু জন্মদানকল্পে দিনের বেলা ন’টা-পাঁচটা চাকরি আর রাতের বেলা মশারির নিচে শব্দহীন যৌন সঙ্গম করে পাঙ্গাস মাছের ঝোল আর মিষ্টি কুমড়ার ফুলের বড়া আর সোনামুগের ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে নাক ডেকে ঘুমাতে ঘুমাতে একদিন মরেটরে যেতে হয়, এবং চোখ বন্ধ করলেই যেহেতু সেই পাঙ্গাস মাছিয় ভ্রমকে এড়ানো যায় না, তাই হয়তো মহাকালের কালীকে আমাদের কালের সীমারেখায় টেনে আনতে হয়। হয়তো তাই অসীমকে বুঝতে আমাদের নির্দিষ্ট গণ্ডিতে ঢুকতে হয়। তাই হয়তো শূন্যতা উপলব্ধি করতে আমাদের ঘর বাড়ি আলমারি সুটকেস ট্রাংক ফ্রিজ কিচেন ক্যাবিনেট দেয়ালের তাক অদরকারী জিনিসে পূর্ণ করতে হয়। হয়তো কালী সেকারণেই দ্বিধার প্রতীক হিসাবে ধরা দেন। হয়তো তাকে সেই দ্বিধা থেকে বিচ্ছিন্ন করলে আমরা আমাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাবো না, হয়তো দশমহাবিদ্যার নয় রূপে আবির্ভাব হওয়া মাতৃমূর্তি দেবীকে মৃত্যুর দেবীতে রূপান্তর করে অমাবশ্যা তিথিতে প্রদীপ না জ্বালালে আমরা জীবনকে উপভোগ করতে পারবো না। হয়তো মৃত্যুকে ভয় না পেলে জীবনকেও ভালোবাসা সম্ভব হবে না।
কালীর পোস্টমডার্ন ডিলেমা তাই আমাকে স্পর্শ করে। আমি জানি না, আমি যা সঠিক বলে ভাবি, তা আদৌ সঠিক কিনা। আমি জানি না, আমি যা ভুল বলে ভাবি, তা আদৌ ভুল কিনা। আমি জানি না, আমি যা ভাবি বলে ভাবি, তা আদৌ ভাবি কিনা। তাই এ্যাকটিভিজমের গায়ের জোরে কালোকে সাদা বানানোর প্রয়াস থাকলেও, আর্যকৃত কালীকে অনার্য কৃষিজমিতে ভূমিপুত্রকন্যাদের গানের লিরিকে আর ঘরের চৌকাঠে টেনে আনতে চাইলেও, সাকারকে নিরাকারে ভাবার কল্পনা করলেও মনে হয় কালী থাকুক না তাঁর দ্বিধা নিয়ে! তাঁর গর্ভ থেকেই যদি কালের সৃষ্টি আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়, তো তিনি কি কালের উর্ধ্বে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দ্বিধা উপলব্ধি করেন না? তিনি কি তার সৃষ্টি মানুষের দ্বিধা উপলব্ধি করেন না? নাকি আমরা কেউ কারুর সৃষ্ট না, বরং তিনিই আমরা এবং আমরা সবাই কালী, সবাই মহাকাল, মহাকালের অংশ?
আর মহাকালের কি দ্বিধা থাকে না?
লেখক পরিচিতি
নাদিয়া ইসলাম
লেখক, গবেষক, ভিগান, অজ্ঞেয়বাদী, বিড়ালপ্রেমিক, নারীবাদী এবং কনস্পিরেসি থিওরির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্ম ১৯৮৫ সালে।
চমৎকার ভাবে বলেছেন।
অনেক ধন্যবাদ!
very well written..you are such an erudite person
Thank you ever so much for your comment. But no, I am nowhere near an erudite, I don’t believe in erudition, I consider myself as a student who is still searching for what needs to be searched.
ভালো লেখা।
thank you 🙂
মুগ্ধপাঠ।অনেক কিছু জানলাম।ধন্যবাদ নাদিয়া চমৎকার লেখার জন্য।। শুভকামনা
জোর করে পুরুষ তন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নি, স্বাভাবিক ভাবেই হয়ছে। বহু সন্তান ধারণ এবং লালনে মহিলাদের জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় হয়। ফলে অর্জিত সম্পদের বেশির ভাগ চলে যায় পুরুষের হতে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে নারীদের উপর নিয়ন্ত্রন জরুরি হয়ে দেখা দেয়। পুরুষের মনে প্রশ্ন জাগে তার স্ত্রীর গর্ভে জন্মানো সন্তান তারই কিনা ? কাকে সে সম্পদ দিয়ে যাবে! ফলে নারীকে অবরুদ্ধ হতে হয়। ব্যক্তিগত সম্পদের পূর্বে এই জটিলতা ছিল না।