।। হুমায়ূন শফিক ।।
আমাদের চোখগুলো অতি-আধুনিক! আগের চোখের চেয়ে পাওয়ারফুল! আগে যা যা দেখতে পেতেন না, এখন সেসবও দেখতে পাবেন!
নির্দিষ্ট একটি শহরে ভয়ানক মহামারির উপদ্রব দেখা দিল। শহরের জনসংখ্যা ছিল ১৩ হাজার। ছোট শহর। সুন্দর ছিমছাম। ফেব্রুয়ারির দুই তারিখ থেকে সমস্যাটি শুরু হলো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মজিদ ব্যাপারি লক্ষ্য করল সে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অথচ ঘুমানোর আগে দিব্যি চোখে পরিষ্কার দেখেছে। মজিদ ব্যাপারির পরের দিন তারই বন্ধু খলিল খানেরও একই অবস্থা। তার কয়েকদিন পরে মজিদ ব্যাপারি ও খলিল খানের ফুল ফ্যামিলির একই অবস্থা হলো। তখন শহরের লোকজন একটু নড়েচড়ে বসলো। যেন ছোঁয়াচে রোগ। কিন্তু এই রোগের কারণ কেউ ধরতে পারল না। বাঘা-বাঘা বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করে দিলো। মজিদ ব্যাপারিকে গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া হল। প্রায় ২০দিন পরে তাকে ফেরত দিয়ে খলিল খানকে নিলো। কিন্তু ততদিনে আরো অনেকেই সংক্রমিত হয়েছে। মাত্র ৩০দিনের মাথায় ৫০০ জন অন্ধ হয়ে গেল। চোখ কেউ যেন কোটর থেকে তুলে নিয়েছে, এমনই ভয়ংকর এই রোগ। খলিল খানকেও ফেরত দিয়ে গেল বিজ্ঞানীরা। এতদিনেও কোনো সুরাহা হলো না। সেই শহরটা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো অন্যান্য শহর থেকে। যাতে অন্য শহরে এই রোগ না ছড়ায়। কিন্তু এর একটা বিহিত তো করা লাগে। শহরে তখন হাজারের উপরে অন্ধ হয়ে গেছে। তাদেরও চোখের আলো ফিরিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু কে কী করবে! সেই দেশের সরকার শহরের লোকজনের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে তাদের সাহস দিলো, কিন্তু কথাই তো চিঁড়ে ভিজে না। শহরের লোকজন আতঙ্কে ঘর থেকে বের হয় না। তাদের খাবার বিশেষ এক ধরণের পোশাক পরে সেচ্ছাসেবীরা পৌঁছে দেয়।
এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পরে সেই শহরের এই রোগ কমার বদলে ভয়ানকভাবে বেড়ে গেল। প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে গেল। তখনও কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলো না। অনেকের ধারণা, এই রোগ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। এই ধারণার ফলে সেচ্ছাসেবীরাও খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিল। হেলিকপ্টার করে খাবার উপর থেকে ফেলা হল। কিন্তু তখন লেগে গেল গোলযোগ। খাবার সবারই দরকার। যার শক্তি বেশি সে-ই অন্যকে মেরে বেশি করে খাবার নিয়ে গেল। দেখা গেল কয়েকজন অন্ধও তাদের সাথে শামিল হয়ে যায়। এতে করে অন্যদের সংক্রমণের ভয় থাকে। অন্ধদের দেখে কেউ সামনে না আগালেও বাতাসের মাধ্যমে ঠিকই সংক্রমিত হয়। শহরের লোকজন এইটা নিয়ে বিশাল একটা মিটিং বসায়। কিন্তু কোনোরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যেখানে বড় বড় বিজ্ঞানীরাই ফেইল তো তারাই বা কী করবে?
প্রায় দেড় বছর পরে সেই শহরে কোনো রকম প্রোটেকশন না নিয়ে তিনজন যুবক এসে হাজির হলো। শহরবাসীকে জড়ো করে বলল, আমরা আপনাদের সাহায্য করতে এসেছি। যারা চোখ হারিয়েছেন, তাদেরকে চোখ দেওয়া হবে। চোখ বিতরণ কর্মসূচি শুরু হবে। চিন্তার আর কিছু নেই।
এই কথা শুনে শহরবাসী খুবই খুশি। সেই খুশিতে শহরের কেউ এই তিনজন যুবক কে বা কারা বা কোথা থেকে এসেছে কিছুই জিজ্ঞেস করল না।
১ম যুবক তারপরে বললো, “কিন্তু একটা শর্ত আছে”।
মতি মিঁঞা বললো, “কী শর্ত?”
দ্বিতীয় যুবক উত্তর দিলো, “চোখের বিনিময়ে আমরা আপনাদের সবচেয়ে মজার স্মৃতিগুলো নিয়ে যাবো”
এই কথা শুনে সবাই হাসলো। কয়েকজন হেসে গড়াগড়ি খেলো। যেন এটাই সবচেয়ে তাদের মজার স্মৃতি। একজন বলল, বেশ মজা তো। এইরকম জিনিস চাইলে আমরা আরো দিতে প্রস্তুত। কিন্তু অন্ধ হতে চাই না।
তৃতীয় যুবক তখন বলল, আর কিছুর দরকার নেই। এইটুকু হলেই হবে। আমরা চাচ্ছি, যারা অন্ধ হয়েছেন তারা তো চোখ নিবেনই এখনও যারা অন্ধ হন নি, তারাও নিন। এতে করে আপনাদেরই মঙ্গল। আর আমাদের চোখগুলো অতি আধুনিক। আগের চোখের চেয়ে পাওয়ারফুল। আগে যা যা দেখতে পেতেন না, এখন সেসবও দেখতে পাবেন।
শহরবাসী এতে সহজেই রাজি হয়ে গেল। তাদের এক কথা, চোখ ফেরত পেলেই হলো। কিন্তু চোখ কি সত্যি কাজ করবে? এমন প্রশ্নও একজন করল। তখন আবার ১ম যুবক বলল, প্রথম যিনি অন্ধ হয়ে গেছেন, তাকে নিয়ে আসুন। প্রমাণ করে দেই।
কয়েকজন গিয়ে মজিদ ব্যাপারিকে নিয়ে আসল। তৃতীয় যুবক ব্যাগ থেকে একটি ছোট বাক্স বের করল, সোনার আঙটি যেরকম বাক্সে রাখা হয় তার দ্বিগুণ সাইজ। সেটা খুলতেই দেখা গেল দুটি চোখ চকচক করছে। কেউ যেন আলো জ্বালিয়ে রেখেছে। যুবকটি একটি তাবু ফেলতে বলল। সবাই মিলে একটি তাবু বানিয়ে দিল। তৃতীয় যুবকটিই তাবুর ভিতরে ঢুকে গেল, দ্বিতীয় যুবকটি তাবুর সামনে দাঁড়িয়ে রইল এবং প্রথম যুবকটি একটি খাতা নিয়ে সেখানে অন্ধদের নামের লিস্ট করা শুরু করল। মজিদ ব্যাপারিকে তাঁবুর ভিতরে ঢুকানো হলো। দশ মিনিট পরে মজিদ ব্যাপারি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরে আসল। সে সবাইকে বলল, সে দেখতে পাচ্ছে। এবং স্পষ্ট। আগে তার চোখে একটু সমস্যা ছিল, সেই সমস্যাও এখন নেই বলেই তার মনে হচ্ছে। সবাই শুনে খুব আশ্বস্ত হলো। একে একে সব অন্ধদের নিয়ে আসা হলো। সবাই তাদের চোখ ফিরে পেয়ে খুব খুশি। কিন্তু যারা অন্ধ হয় নি, তারা একটু দ্বিধায় পরে গেল। ভাল চোখ দিবে কিনা? অন্ধরা সুস্থ হয়ে তাদের চোখের ব্যাপারে এতই প্রশংসা করতে লাগল, শেষ পর্যন্ত তারাও রাজি হয়ে গেল। এবং একে একে সকলেই চোখ বদল করল। এবং দেখল সত্যি তারা আগের চেয়ে ভাল দেখতে পাচ্ছে। এবং এমন কিছু দেখছে যা তারা আগে দেখে নি। যেমন অতি-ক্ষুদ্র জীবণুও তাদের চোখে ধরা পড়ছে। ভাবল এতে ভালই হয়েছে, ভাইরাস থেকে সাবধান থাকা যাবে।
যুবক তিনজন তখন বিদায় জানানোর উদ্দেশ্যে সবাইকে বলল, আপনাদের আনন্দ দেখে আমাদের ভাল লাগছে। আপনাদের আনন্দেই আমরা আনন্দিত। তবে আপনাদের সবচেয়ে মজারস্মৃতিগুলো আমরা নিয়ে নিয়েছি। অবশ্য আমরা জানি, আপনাদের মজার-স্মৃতি আরো জমে যাবে। ভাল থাকুন সবাই, আমাদের বিদায় জানান। আরেক শহরে এই একই উদ্দেশ্যে যেতে হচ্ছে। ধন্যবাদ সবাইকে।
সবাই তাদেরকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিল। এবং গণসংবর্ধণা দিয়ে তাদের বিদায় জানানো হলো। কিন্তু তখনও কেউ তাদের পরিচয় জানতে চাইল না।
যুবক তিনজন যখন চলে গেল। তাদের কারো মুখে কোনো হাসি নেই। সবাই কেমন যেন চুপসে গেল। এর কারণও তারা বুঝতে পারল না। তারও কিছুদিন পরে আরেক সমস্যা দেখা গেল, তাদের চোখে পাওয়ার এতই বেড়ে গেছে কোথাও বসে থাকাও ঝামেলা। বসলেই দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার পোকা বা ভাইরাস জাতীয় কিছু তাদের চারপাশে কিলবিল করছে। এটা হল আরেক মুসিবত। যদিও তারা সেরকম ব্যবস্তা করেই নিল। তারা স্পেশাল পোশাক বানিয়ে নিলো। খাবার তৈরির জন্য স্পেশাল রান্নাঘর বানাল। এতে করে তাদের স্বাস্থ্য আরো ভাল হয়ে গেল। কিন্তু একটা জিনিসও তখনও তাদের প্রবলেম থেকেই গেল। সেটা হল, যুবক তিনজন যাওয়ার পরে তারা আর কোনোদিন হাসেনি।
অলঙ্করণ: বৈশালী
লেখক পরিচিতি:
হুমায়ূন শফিক
জন্ম ১৯৯৪ সালে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নবাবগঞ্জে। পড়ালেখা করছেন টেক্সটাইলে। গল্প, উপন্যাস লেখেন, অনুবাদ করেন।