।। সম্পাদনা বিভাগ ।।
ফকির লালন শাহের ১৩০তম তিরোধাম দিবস পার হয়ে যাচ্ছে। ছোটলোক আর প্রান্তিক মানুষের গুরু তিনি। তাদের সাঁইজী’। ওপর মহলের বিস্মৃতির চাদরে কোন আলোড়ন তুলে, কোন ছাপ না ফেলে তিরোধান দিবসটি চলে যাচ্ছে। যথারীতি, আবার। আমরা ভুলি নি। আমার তাঁকে ভক্তি জানাই। লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবসে আমরা তাঁকে তাঁরেকরছি। এই দিনে কিছু কথা আমরা সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
লালনের কালামগুলো তাঁর শিষ্যরা তাদের সাধ্য মতো খাতায় লিখে রাখতেন। সেই খাতা ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে এনে ঠাকুর পরিবার নিজেদের কাছে গচ্ছিত রেখে দিয়েছেন। সেটা ভাল কাজ হয় নি। ফকিরদের খাতা ফকিরদের কাছে ফিরিয়ে দিন। ফিরিয়ে দেবার দায় বোধ না না করাটা অন্যায়।
ফকির প্রজার কাব্যের খাতা জমিদাররা কব্জা করে রাখবেন, এ আর এমন কী! এরপর জ্যোতিরিন্দ্র শিলাইদহে তাঁর বোটে কুমারখালির কোন্ এক লাঠি- হাতে বৃদ্ধ জবুথবু গায়কের একটা কুৎসিৎ স্কেচ করলেন, আর লিখে দিলেন ‘লালন’ । আর সেটাই হয়ে গেল লালন! নন্দলাল বসু এক বাউলের ছবি আঁকলেন। এটাই এখন ‘লালন’ হয়ে গিয়েছে। ছেঁউড়িয়ায় এখন তা ম্যূরাল হয়ে শোভা পাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ লালন ভক্ত আর অনুরাগীরদের ভদ্রলোকরা দাপটের সঙ্গে বোঝাচ্ছে আমরা উঁচু তলার সাহেববাবুরা ‘লালন’ নামে যা বানাই আর যে সকল প্রপাগান্ডা তৈয়ার করি, সেটাই ‘লালন’। জাতপাত শ্রেণীর লড়াই ভুলে গেলে চলবে না। সেটা জারি আছে।
মতিজান ও লালন
ফকির মলম শাহ আর তাঁর স্ত্রী ছিলেন ফকির মতিজান। কালিগঙ্গা নদীর তীরে বসন্তে আক্রান্ত লালনকে ঘরে এনে শুশ্রূষা করে বাঁচিয়েছেন এই দুই সাধক। আধুনিক কালের সাহেবসুবা ও বাবু সম্প্রদায় ইতিহাস থেকে এই দুটো মানুষকে মুছে দিতে পেরেছে সফল ভাবে। মতিজানের পালিত সন্তান হিশাবে লালন বেড়ে উঠেছেন। ফকির মতিজানের পাশেই তাঁর সন্তান ফকির লালন শাহের সমাধি। অতএব এই সমাধি ‘মতিজান-লালনের সমাধি’ । এই সমাধিকে যদি কেউ মাজার বলতে চান তাহলে বলুন, ‘মতিজান-লালনের মাজার’।
আর, ছেঁউড়িয়া ফকিরদের কাছে ‘সাঁইজীর ধাম’ । ফকিরদের নিজেদের ভাষায় ‘টাঁকশাল”। এভাবে বুঝুন। নদীয়া একসময় বাংলার সাধনা জগতের ‘টাঁকশাল’ ছিল । একে রক্ষা করুন। নিজেরা বাঁচবেন।
মেয়ে বলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মতিজানের নাম মুখে নিতে চায় না। অথচ মতিজান ছাড়া লালনের আবির্ভাব কল্পনা করা কঠিন। পুরুষ মনে করে পুরুষ থেকে নারী পয়দা হয়েছে। নারী তৈরি হয়। সেটা তারা বাস্তবিক অর্থে বলুক, কিম্বা বলুক পুরাণ কিম্বা ধর্মগ্রন্থের বয়ানে। আদম হাওয়ার গল্পের সূত্রে। পুরুষতান্ত্রিক তন্ত্র চর্চায় নারী পুরুষের ‘তুরীয়ানন্দ’ লাভের উপায় মাত্র। এর বিরোধিতা করলেন চৈতন্য। তারপর নিত্যান্দ, মাধব বিবি, বীরভহদ্র হয়ে ফকির লালন অবধি নদীয়ার ভক্তিবাদের রাজনীতি।
“নিগূঢ় খবর জানা গেল
পুরুষ হৈতে নারী হোল
তবে কেন এমন হোল
আগে রাধা পাচ্ছে কৃষ্ণ বলে!”
তাইতো? তাহলে মতিজান কিভাবে হারিয়ে গেল? আপনাদের ইতিহাস থেকে? আগে মতিজান তারপর লালন। মানবেন?
মতিজান ও মলম শাহের গৃহস্থ আবাসে লালন সারাজীবন তাঁর সাধক জীবন কাটিয়েছেন। সাসধকদের এই আবাবস বা আখড়াকে অনায়াসে সরকারী সম্পত্তি বানানো হোল, এরপর সেখানে বিল্ডিং হোল, ‘লালন একাডেমি’ বসানো হোল। সরকারের কি আর কোন জায়গা ছিল না। সাধকদের সাধনার ক্ষেত্রগুলো রাষ্ট্রের অধিকারে নিতে হবে কেন? সেখানে জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে হর্তাকর্তাবিধাতা। কিভাবে আখড়া বা মাজার চলবে তার সিদ্ধান্ত তিনি একাই নিয়ে থাকেন। একমাত্র তারই এখতিয়ার।
নানান কিসিমের গায়ক এবং আধুনিক ফোকিসরা ফকির লালনের ‘কালাম’ ইচ্ছামতো বিকৃত করে গাইতে পারেন, এ আর এমন কী! এটা বাবু, সাহেবসুবা, আধুনিক কালের মিস্টার্স কিম্বা মিসদের শ্রেণী আধিপত্যজাত অধিকার। এই জাত্যাভিমানী উঁচু তলার মানুষদের আমরা বলি, আপনাদের ক্ষমতা, আপনাদের বিনোদন আপনাদের আইন দিয়ে কিভাবে আপনারা প্রান্তিক মানুষদের গলা টিপে হত্যা করেন আপনারা নিজেরাও তা বুঝতে পারেন না। আপনারা ধরে নেন, কলকাতা-ঢাকার মেট্রোসেক্স্যুয়াল, মাচো, সেক্সি হট– ফোকিস, কোকিল সাজা কাউয়া বা কাগেরা অন্যের গানকে লালন গান বলে গাইতেই পারেন! লালনের কালাম’ তো মঞ্চে ধুন্ধুমার নৃত্যের সঙ্গে গাইবার জন্য লেখা হয় নি। এগুলো সাধন সঙ্গীত। তন্ত্রের দেহতত্ত্বকে লালনের বলে চালিয়ে প্রেমসাধনা, যুগলসাধনা, মানুষভজনাকে কামসাধনায় আপনারাই নামাতে পারেন! আহারে কসমিক সেক্স! পর্নোতে পর্যবসিত করলেও আপানাদের বিরুদ্ধে ফকিরকুল কিম্বা বাংলা ভক্তি আন্দোলনের সাধককুল কি করতে পারে? ফকিরিকে আপনারা ‘বাউল’ বানাতে পারেন, লালনকে ‘বাউল সম্রাট’ বলে নাচানাচি করতে পারেন! লালনকে সহজেই নিজের ইচ্ছা মতো জন্মসূত্রে কায়স্থ হিন্দু বানাতে পারেন আবার কেউ কেউ ভূয়া কাগজপত্র বানিয়ে তাঁকে জন্মসূত্রে মুসলমানও বানিয়ে দেন!! আর কত!
মন সহজে কি সই হবা
চিরদিন ইচ্ছা মনে আল ডিঙায়ে ঘাস খাবা তুমি
আল ডিঙায়ে ঘাস খাবা!
ডাবার পর মুগুর প’লে
সেই দিনে গা টের পাবা!!
‘পরিচয়বাদ’ বিরোধিতা এবং তিনের রাজনীতি
লালন জীবিতবস্থায় কোথাও তাঁর নিজের গোত্রপরিচয়, জন্মপরিচয়, বংশপরিচয় সাকিল গ্রাম কোন কথাই বলেন নাই । তাঁর সবচেয়ে কাছের পালক পুত্র ভোলাই শাহ কিম্বা কিম্বা অন্য কোন শিষ্য জানেনই না। তারা জানার প্রয়োজন বোধ করেন নি। কিন্তু আপানাদের জানতেই হবে, তিনি হি্নদু নাকি মুসলমান! তাঁর পরিচয় তাঁর শিষ্যকুল কেউই জানলো না– কিন্তু আপনারা জানলেন! লালন জানতেন পরিচয়বাদ ও সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন সমাজে আপনারা এই কুকর্মটুকু করবেনই। মানুষকে মানুষ হিশাবে না চিনে তাকে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান শূদ্র ব্রাহ্মণ আশরাফ আতরাফ ইত্যাদি আপনারাই বানাবেন। তাই নিজের পরিচয় আগেই তিনি মুছে ফেলেছেন। ফকির লালন শাহের কোন পরিচয় নাই। তিনি তাঁর ভক্তদের কাছে স্রেফ ‘সাঁইজী”। গুরুশিষ্য পরম্পরায় এই সম্বোধন নদীয়ার ফকিরি ধারায় প্রচলিত রয়েছে। এই সম্বধন্টুকুর তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করুন। তিনি জল থেকে উঠে এসেছেন। কালীগঙ্গার তীরে বসন্তে আক্রান্ত যে কিশোরটিকে তাদের পরিবার ফেলে দিয়ে গিয়েছিল, সে সেখানেই মরে গিয়েছে। মতিজান আর মলম শাহ যাকে ঘরে তুলে আনল, তিনি কে কোথা থেকে এসেছেন কেউ জানে না। ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, চামার মুচি করিম রহিম হিন্দু মুসল্মান সকলেরই ‘সূচনা’ জলে। পানিতে বা রজোবীজে। মানুষ আসে। অনন্তকাল ধরেই মানুষ জলে ভেসে এসেছে। আসছে। আসবে…। ফকিরদের এই ভাবটুকু দয়া করে নষ্ট করবেন না।
নিজের পরিচয় লালন গোপন করে গিয়েছেন। পরিচয়বাদের উর্ধে থাকতে চেয়েছেন তিনি। এমনকি নিজের কোন ছবি বা চিহ্নও রেখে যান নি। সারা জীবন জীবন্ত মানুষ ভজনার কথা বলেছেন, কারণ ভাবের বিকাশ গুরু-শিষ্য পরম্পরায় জীবন্ত মানুষের সজীব ও সক্রিয় জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে পরিবাহিত হয়ে চলেছে। এই প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ চর্চার মাঝখানে কোন আগাম অনুমান, মতাদর্শ কিম্বা বেদ-বিধান নাই, আইন কিম্বা রাষ্ট্র নাই। যখন জীবন্ত সম্বন্ধ চর্চায় ঘাটতি পড়ে, তখনই মানুষের জীবনে ও সমাজে জঞ্জাল তৈরি হয় তখনই আগাছার মতো অন্য সব কিছু গড়ে ওঠে। মানুষ মরে যায়, তার কংকাল্গুলো আশপাশে ঘোরা ফেরা করে। তাই অনুমানের ধার ধারে না নদীয়ার ফকিরী। তারা অনুমানের জগতে বাস করে না, বর্তমানের জগতে তারা সপ্রাণ ও ‘বর্তমান’ থাকতে চান। সেখানে শ্রুতি, কন্ঠ ও জীবন্ত দেহই সত্য। নদীয়ার ফকির বেদ, শাস্ত্র, বিধিবিধান কিম্বা গ্রন্থের দাস নয়। তারা মুক্ত।
জীবন্ত মানুষ ভজনার কথা ভুলে গিয়ে মানুষ কবর, ছবি, মূর্তি, মুরাল কিম্বা কোন না কোন চিহ্ন কে লালন বানাবে, লালন তা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, হয়তো। কিম্বা আমরা এখন তাই তো দেখতে পাচ্ছি। অথচ এইসব পরিচয়বাদের উপরে উঠে লালন ‘মানুষ ভজনা’র পথ দেখিয়েছেন। ‘মানুষ ভজনা’ আর ‘সেক্যুলার মানবতাবাদ’ এক না। বুর্জোয়া সমাজের বিকাশের ফলে ‘মানব’ নামক যে রোমান্টিক চিরায়ত বা শাশ্বত সত্তার ধারণা তৈয়ার হয় সেই কল্পিত জগতে ফকির বাস করে না। আমাদের মতো পেটি বুর্জোয়াদের খাসিলত দেখেই ফকির সেটা বোঝে।
আমরা বুঝি না। ভাবি, আমরা একেকজন বিল গেইটস , কিম্বা একদিন বিল গেইটস হব। না। আমরা আর বিল গেইটস এক না। অর্থাৎআমাদের দেশের ধনী শ্রেণী আর আমাদের মতো পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী কোন মতেই একই ‘মানব’ নয়। সর্বহারা দীনহীনের কথা বাদই দিলাম। বাস্তব অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ক্ষমতার অসাম্য ভুলে গিয়ে ‘মানব’ নামক রোমান্টিক ধারণা মূলত পুঁজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখবার মতাদর্শ। কিন্তু পেটি বুর্জোয়া দাবি করে, আমরা একই, আমরা ‘মানব’। অথচ ‘পুঁজিতন্ত্র , পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন কিম্বা বিল গেইটসদের চোখে আমরা স্রেফ তাদের পণ্যে ভোক্তা মাত্র। অর্থনৈতিক শোষণের কথা আপাতত উহ্য থাক।
ঠিক আছে। কল্পনায়, কন্সটিটিউশানে, আইন-আদালতের বয়ানে বলতেই পারেন আইন ও রাষ্ট্রের চোখে সকলে এক। ফকির মুচকি হেসে শুধু বলবে, তাই নাকি? তারপর গান গাইবে:
আছে কোন মানুষের বসত কোন দলে
ওরে ‘মানুষ’, ‘মানুষ’ সবাই বলে !
ভাববেন না ঔপবেশিকতার ঔরসে গড়ে ওঠা নদীয়ার ফকিররা ধনি ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর পারভারশান, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিকৃতিগুলো বোঝে না। আধুনিকতার জগতে এই শ্রেণী সেক্সুয়ালি অবদমিত, সেটাও তারা বোঝে। অতএব এই শ্রেণী তাদের সকল অবদমিত সেক্সুয়াল পারভারশান বাউলদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। না, এটা করবেন না। এটা ঠিক না। ফকির সবই বোঝে। এটাও আমরা ভাবি যে ফকিরদের কোন রাজনীতি নাই। তারা খালি ডুগডুগি আর গান করে বেড়ায়। উদাসীন। তাদের পরিবার নাই। যৌনাচারই তাদের একমাত্র চর্চা। এই এক অদ্ভূত ব্যাপার! সকল জীবেরই যৌন আচার বা সংস্কৃতি আছে, জীব হিশাবে মানুষ তার ব্যতিক্রম নয়। নদীয়াতেও আছে। নদীয়া যুগল ভজনায় বিশ্বাসী। তার ‘জোড়’ ভালবাসে। জোড় ভাঙ্গতে পছন্দ করে না। বাউল ও ফকিরদের সম্পর্কে যে সকল আজগবি প্রচার রয়েছে সেই সকল কেচ্ছা কাহিনী থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
তাহলে ‘মানবতাবাদ’ বা ‘মানবধর্ম’ বলতে যে সকল রোমান্টিক আজগবি ধারণা রমরমা রয়েছে ফকির লালন শাহের ‘সহজ মানুষ’ সেটা না। বজ্রযান সহজযান কুলকুণ্ডলিনী ইত্যাদি দিয়ে সেটা বোঝার দরকার নাই। সহজ বিষয় সহজ ভাবে ভাবুন। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে অসম। ধনি আর নির্ধন এক না। বড়োলোক আর ছোট লোকের ফারাক পুঁজিতন্ত্রে আরও প্রাতিষ্ঠনিক রূপ নিয়ে মানুষকে গ্রাস করে। শিক্ষা, টেকনলজি, ব্যবসায়িক বুদ্ধি, আমলাগিরি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মন্যবাদ বা বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে শ্রী চৈতন্য যে তিনটি আদর্শ সামনে রেখে ভক্তি আন্দোলন নদীয়ায় নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্যকে নিয়ে শুরু করেছিলেন, সেই তিনের দিকে এখন ২০২০ সালে আমাদের আসতে হবে। হবেই। কারণ ইতিহাসে তিনের মীমাংসা হয় নি।
এক: জাত পাত নির্মূল হোক। প্রাচীন কিম্বা আধুনিক বর্ণাশ্রম প্রথার অবসান ঘটুক। অক্ষর/নিরক্ষর, শিক্ষিত/অশিক্ষিত, আধুনিক/অনাধুনিক এইসব বাইনারি থেকে বেরিয়ে পড়ুন। সেইসকল অনুমান, পরাবিদ্যা ও সম্পর্ক ভাঙুন, যা এই সব বাইনারি টিকিয়ে রাখে।
দুই: নারী/পুরুষ বিভাজন এবং পুরুষতন্ত্রের সকল প্রকার ক্ষমতার সম্বন্ধ , প্রকাশ, কিম্বা চর্চা বন্ধ করুন। পুরুষদের প্রতি ফকিরদের উপদেশ একটাই: ‘ল্যাংটি’ পরুন । আপনার ‘দণ্ড’ নিয়ে সমস্যা আছে। তাকে বাগে রাখুন। আর মেয়ে হবার সাধনা করুন। নদীয়া বলবে আপনার শরীর বদলাবে না, বটে, তবে এই সাধনায় আপনার পুরুষতান্ত্রিক স্বভাব বদলাবে। গুরু সহায়।
তিন: ধনি/নির্ধন অর্থনৈতিক ভেদ রেখার নিকুচি করুন। পুঁজিতন্ত্র এবং পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের গোড়ায় সজোরে আঘাত হানুন। বিশ্ব সমাজ গড়ে উঠবার বাস্তব শর্ত তৈরি হোক। দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান। গোড়ায় আঘাত হানুন। যদি সামাজিক ভেদ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখেন, তাহলে লালনের গান গেয়ে কি করবেন?
তন্ত্র এবং দেহ
‘তন্ত্র’ এবং ‘দেহ’ এই দুটি শব্দ ও ধারণার বিবর্তন ঘটেছে নানান সময়ে, নানান ভাবে। কিন্তু এখন ‘তন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি, তা তন্ত্রের একাট্টা বয়ানে পরিণত হয়েছে। সেটা হোল নারীকে নিছকই সাধনযজ্ঞের ‘উপায়’ হিসাবে পর্যবসিত করা। তন্ত্রের এই অধঃপতনের ফলে দেহতত্ত্বের আধুনিক ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে। যার সার কথা নারী ভোগ্যা কেবল। শুধু পুরুষের সামাজিক-পারিবারিক জীবনে নয়, পুরুষের তথাকথিত সাধনার জগতেও। নারীকে পুরুষের তুরিয়ানন্দের ‘উপায়’ মাত্র করে তোলার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন চৈতন্য। তিনি বললেন, আমার অন্তরে কৃষ্ণ , বহিরঙ্গে রাধা। দেহ ভগবানের আবাস। সেই দেহের অমর্যাদা কিভাবে সম্ভব? হোক তা আমাম্র কিম্বা নারীর?
বঙ্গে শ্রীমতী রাধিকা প্রেমের মহাজন। ভগবান রাধিকাকে নিজের বাম উরুতে বসিয়ে কুঞ্জে নিজের মনোমত সাজালেন। সেই মুখচ্ছবির স্বাদ নিলেন দেহ মন প্রাণ জুড়ে। তারপর রাধিকার চরণে চিরকালের জন্য লিখে দিলেন, ‘আমি কৃষ্ণ দাস চরণে রহিলাম’। প্রকৃতির দাসত্বের মধ্যে পুরুষের পরমার্থ নিহিত। এই দাস্য রসেই ফকিরের আনন্দ। এরই সূত্র ধরে চৈতন্য বঙ্গে ‘রাধা ভাবে উপাসনা’রপ্রবর্তন করলেন। এই এবাদতের সারকথা হচ্ছে মানুষের ‘দেহ’ ঈশ্বরের আবাস। দেহ পুরুষের উপায় মাত্র নয়। সেদিন থেকে সকল প্রকার নারী নির্যাতন, ধর্ষণ সহিংসতা, যৌন বিকৃতির অবসান হবার কথা। কিন্তু নবদ্বীপের তন্ত্রবাদী ব্রাহ্মণকুল চৈতন্যকে নদীয়া ছাড়তে বাধ্য করে। সেই ইতিহাস আমরা ভুলে গিয়েছি। চৈতন্য নবদ্বীপে আর ফিরে আসেন নি।
চৈতন্যের এই ভাবকে ধারণ করে বয়ে চলেছে নদীয়ার ফকিরদের ধারা। লালন সেই ধারার শিরোমনি। তাঁরাও বললেন আল্লা আদম সৃষ্টি করেছেন অবশ্যই, কিন্তু ‘মাঝখানে হাতনে কল দিয়ে সৃষ্টকর্তা বসলেন নিজেই খোদ লুকিয়ে গেলেন আদমের মধ্যে। হৃদপিণ্ডের আওয়াজ সেই জন্যই।
“আনিয়ে জেদ্দার মাটি
গঠলেন বোরখা পরিপাটি
মিথ্যা নয় সে কথা খাঁটি
কোন চিজে তার গঠলেন আত্মা?
সেহি আদমের ধড়ে
অনন্ত কুঠুরী গড়ে
মাঝখানে হাতনে কাল জুড়ে
কীর্তিকর্মা বসলেন সেথা
আজানতে হয় আদম শফির আদ্য কথা।।
তাহলে ‘আদম কথাটার আসল মানে বুঝতে হবে। সেটা হোল সৃষ্টিকর্তা নিজে যে আবাস তৈরি করে তাকে নিজের আবাস হিশাবে বেছে নিয়েছেন। নিজেই তিনি যেখানে লুকিয়ে গেলেন সেই মানুষের মধ্যেই তাঁকে সন্ধান করতে হবে। যে দেহে তাঁর আবাস তাকে তাই ‘উপায়’ গণ্য করা যায় না। বরং মানুষ ভজনা করার মধ্য দিয়েই তাঁকে পাওয়া যেতে পারে।
এখানেও আমরা দেখি মানুষকে শুধু ‘দেহ’ গণ্য করা, বিশেষত নারীকে সাধনার ‘উপায়’ হিশাবে পর্যবসিত করার বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান রয়েছে। সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টা আছেন, কিন্তু তিনি নিরন্তর গায়েব কিংবা অনুপস্থিত। তাঁকে একমাত্র এশেকে পাওয়া যায়। ফকিরদের ভাষায় ‘নিহেতু’ প্রেমে তিনি লভ্য। অর্থাৎ যে প্রেমের কোন হেতু নাই । প্রেমের জন্য প্রেম, এশেকের জন্য আশেকানি। প্রেমই সব। প্রেম এখানে যুগপৎ উপায় এবং উদ্দেশ্য। নদীয়া এই নতুন কথা আমাদের শোনাল। এখনও শুনিয়ে যাচ্ছে। যে প্রেমে মানুষ মূর্ছা যায়, আল্লাহ তাঁদের কাছেই আনন্দ স্বরূপ সচ্চিদানন্দ হয়ে ধরা দেন। নদীয়া এভাবে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে গেল। নীরবে।
এই ধারণার ওপর দাঁড়ালে সৃষ্টি বা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পরিবর্তন করতে আমরা বাধ্য। প্রকৃতিকে ‘জয়’ করা মানুষের লক্ষ্য হতে পারে না। প্রকৃতি সৃষ্টি করে যাকে নিজের আবাস বানিয়েছেন তাঁকে সন্ধান করে যাওয়াই মানব জীবনের পরমার্থ। যখন তাঁর দেখা পাওয়া দুঃসাধ্য হয়, তখন তা আর্তনাদে রূপ নেয়।
সে আর লালন একখানে রয় লক্ষযোজন ফাঁক রে
আমি একদিনও না দেখলাম তারে।।
লালন ধর্মপ্রাণ মানুষ, ধর্ম নিরপেক্ষ নন। ‘ধর্ম’ বললে আমরা পাশ্চাত্যের ‘রিলিজন’ বাংলায় অনুবাদ করে বুঝি। এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ‘ধৃ’ থেকে ধারণ>ধর্ম। মানুষ যা ধারণ করে সেটাই ‘ধর্ম’। তাহলে আমরা কে কি ধারণ করি তর্কটা সেখানে। আমামদের যাপিত জীবনের সঙ্গে প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের নিত্য এবং অনিত্য নানাবিধ সম্বন্ধের চরিত্র , প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের ‘আমি’ কিম্বা কর্তার সম্বন্ধ — ইত্যাদি বিচার করেই বোঝা যায় আমরা কে কী ধারণ করি। ধর্ম নিরপেক্ষতা হচ্ছে আধুনিক পরিচয়বাদের জাল থেকে বাইরে থাকবার একটা কৌশল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমরা ঠিকই, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি পরিচয় পোষণ করি। বাইরের পোশাক বা ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ দিয়ে সেই পরিচয় ঢেকে রাখতে চাই। পলিটিকালি কারেক্ট থাকতে চাই। বাংলার ভক্তি আন্দোলন এই চালাকিগুলো অপছন্দ করে।
ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মের কোন বিরোধ নাই। কিন্তু ধর্ম যখন জন্মসূত্রে কিম্বা সঙ্গ দোষে পরিচয় মাত্র হয়ে ওঠে, কিম্বা ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা হয়েযখন স্রেফ বিধান ও আইনে রূপ নেয়, হৃদয়বৃত্তির বিকাশ না ঘটিয়ে হৃদয় হৃদয় নষ্ট করে – নদীয়া তাকে ধর্ম বলে মানে না। সেটা ‘রিলিজিয়ন’ হতে পারে, কিন্তু ধর্ম না। – ধর্ম মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত হৃদয়বৃত্তির বিকাশে বাধা তৈরি করে না। অপরকে ভালবাসতে, জিকির কিম্বা নাম কীর্তনে মূর্ছা যেতে কাউকে বাধা দেয় না, গুরু কিম্বা মুর্শদের প্রেমে মত্ত হওয়া নিজের জড়তা থেকে মুক্তিও বটে। মানুষ তখনই মানুষ হতে শুরু করে যখন ভাণ্ড এবং ব্রহ্মাণ্ডের অভেদ সে শুধু বুদ্ধি দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়েও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।
নদীয়ায় চৈতন্যের হাত ধরে যে ফকিরি ধারার উদ্ভব ঘটেছে সেই ধারা ইসলামকে ধারণ করেছে জাত পাত বর্ণাশ্রম প্রথা থেকে মানুষেকে মুক্তি করবার জন্য। আরবদের রক্তবাদ, বংশবাদ, গোত্রবাদ ও কোরেশদের আভিজাত্যের অহংকার চূর্ণ করে আল্লার সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধ রচনার যে লড়াই নবী করিম (সা.) শুরু করেছেন সেই জিহাদ থেকে নদীয়া শিক্ষা নেয়। নবী করিম (সা.) নদীয়ার ভাবান্দোলনের গোড়ায় রয়েছে রক্ত, বংশ, গোত্র, ভূখণ্ড, ভূগোল, ভাষা, সংস্কৃতি সব কিছুর উর্ধে যিনি সৃষ্টির রহমত হিশাবে হাজির, তাঁকে হৃদয়ে ধারণ করা।
নবী দ্বীনের রসুল
ঐ নাম ভুল করিলে পড়বি ফেরে হারাবি দুই কূল
ও তুই হারাবি দুই কুল।।
যেন রক্তবাদ, বংশবাদ, গোত্রবাদ ইত্যাদি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে আর দূষিত না করে।নবীকে তাই সবসময় দরকার। সহজ ভাষায় নদীয়া আল্লার নিকটবর্তী হতে চায়’ যার কাছ থেকে মানুষ ছিটকে বেরিয়ে এসেছে তার মধ্যেই আবার লীন হবার তীব্র বাসনা পোষে। সে বাসনা চরিতার্থ করবার পথ হচ্ছে নবির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে চলা।
নদীয়া শাস্ত্র বিরোধী, বেদ বিরোধী। ধর্মগ্রন্থের দোহাই দিয়ে মানুষকে গোলাম করা রাখা কিম্বা আধুনিক কালে ধর্ম চর্চার বিকৃত রূপ হিশাবে ‘রাষ্ট্র’ নামে যা গড়ে উঠেছে তার বিরোধী, ইত্যাদি। । যে রূপে ধর্ম মাত্রই ‘আইন’ ও মানুষকে গোলাম বানানোর অধিক কিছু নয়। সমাজ ব্যবস্থাপনা তো নয়ই। ‘সমাজ’ তাকেই বলা যায় যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ প্রেম ভালবাসা স্নেহ মমতা দয়া ইত্যাদির ওপর দাঁড়ায়। পুলিশে লাঠি আর হ্যামলেট হাতে যে আধুনিক সোসাইটি সেটা মানুষের সমাজ না। আধুনিক রাষ্ট্র ধর্ম মাত্রই আইন, নজরদারি ও শাস্তি – এই ধারণার ধারাবাহকতা কেবল। প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব থেকে তার ফারাক সামান্যই।
নদীয়া দ্বন্দ্ব আইন বা বিধিবিধানকে মানুষের পরমার্থ গণ্য করে না। তাই ফকির ধর্মতত্ত্ব থেকে ধর্মের মুক্তি চায়। মানুষ ‘সহজ’, তাকে ‘সহজ’ ভাবে তার সকল বৃত্তি সহ বেড়ে উঠতে দাও , এটাই নদীয়ার রণকৌশল। ক্ষমতার সঙ্গে সহজ মানুষের সংঘাত অনিবার্য। নদীয়া এই সত্য এড়িয়ে যায় না। তার জন্য নদীয়া তলোয়ার হাতে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না। কিন্তু বাস্তব জীবনে পরাস্ত হয়ে কিম্বা পাশ কাটিয়ে গিয়ে ডুগডুগি বাজানো দিনগুলোর অবসান চায়। এখন আসল কাজে ফের, সব্বাই। এটাই হোল একালের রণধ্বনি।
জীবমূলক যে কামনা বাসনা মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির দ্বন্দ্ব তৈরি করে, নদীয়া সেই দ্বন্দ্ব মোচনের জন্য নিজের জীবন যাপনকে বদলায়, সমাজ পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করে না। পরবর্তন শুরু করতে হবে আজই। নিজের জীবন বদলানো থেকে অবিলম্বে শুরু করতে হবে। এখনই।
লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবসে তাঁরকে স্মরণ করি আবার। তাঁর জয় হোক।