আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

জিরো ডার্ক থার্টি অর্ধ-সত্য কিম্বা মার্কিন প্রপাগাণ্ডা সিনেমা

Author : ফ্লোরা সরকার

‘জিরো ডার্ক থার্টি’ ছবির প্রথম দিকে নির্যাতন সেলে সি.আই.এ.-এর একজন সদস্য ড্যান আল কায়দা বাহিনীর একজন কয়েদী আম্মারকে একটা সন্ত্রাসী আক্রমণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছিলো, উত্তরে ‘রবিবার’ ছাড়া ড্যান কোন উত্তর পেলো না। তখন ড্যান তাকে বলে, ‘তুমি কি জানো আংশিক বা অসম্পূর্ণ উত্তর, মিথ্যা হিসেবে ধরা হয় ?’ তারপরেই আম্মারকে আরও কঠিন শাস্তি হিসেবে ছোট একটা বাক্সে ভরে রাখা হয়। যেখানে কোন রকম নড়াচড়া করা যায়না।

কোন প্রশ্নের আংশিক উত্তরের অর্থ একটি মিথ্যের সমান। এই যদি যুক্তি হয় তাহলে আমরা কি বলতে পারিনা যে, একটি ঐতিহাসিক ছবি নির্মাণের সময় যদি সেই ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর কিছু সত্য শুধু প্রকাশিত হয় আর কিছু সত্য থাকে অপ্রকাশিত, তখন তা একই দোষে দুষ্ট? অর্থাৎ তা মিথ্যা বলারই সামিল? ‘জিরো ডার্ক থার্টি’ ছবিটি দেখার সময় ঠিক এরকম প্রশ্ন উঠে আসা খুব স্বাভাবিক। কেননা ছবির কিছু অংশে আমরা একদিকে যেমন ইতিহাস বা সত্যের ছায়া দেখি, ঠিক তেমনি দেখি আবছায়া। ছবিটার বিশ্লেষণে ক্রমাগতভাবে আমরা একের পর এক সেইসব অর্ধসত্যের দিকগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তার আগে বলে রাখা ভালো ছবিটা ২০১২ সালের ১৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের লস এনজেলেস এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় সীমিত আকারে এবং পরের বছর ১১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য দেশে বড় আকারে মুক্তি পায়। কিন্তু এক বছরের মাথাতেই ছবিটার বিষয়বস্তু চারিদিকে ছাড়িয়ে, এর ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক দিকগুলো ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করেছিল। পৃথিবীর বিখ্যাত সব জার্নাল, পত্রিকা এবং ব্লগে ছবিটির সমালোচনার সংখ্যা প্রায় একশ ছাড়িয়ে গেছে। কেননা ‘জিরো ডার্ক থার্টি’র কাহিনী এমন একজনকে নিয়ে নির্মিত যিনি এই শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র, আলকায়দার অবিসংবাদী নেতা ওসামা বিন লাদেন। যার পরিচিতি একজন সন্ত্রাসী হিশাবে। যে কারণে ছবির পরিচালক ক্যাথেরিন বিগলোকে (Kathryn Bigelow ) নিউ ইওর্কার পত্রিকায় বলতে দেখি, ‘ওসামা বিন লাদেনের হত্যা অভিযানের কাহিনী এই যুগের একটি মহাকাব্য। একটি পূর্ণ জীবনকালের কাহিনী। এই ধরণের মহাকাব্য এক বা দুই শ বছরে কেবল একবারই ঘটে’। মহাকাব্যের এই উপমা শুনে অনেকদিন আগে এইচ.এস.সি.র ইংরেজির সিলেবাসের অন্তভূর্ক্ত লেখক সাকির লেখা ছোট গল্প ‘মিসেস প্যাকেলটাইডস্ টাইগার’ এর কথা মনে পড়ে গেলো। মিসেস প্যাকেলটাইড যিনি লুনা বিমবার্টনের এগার মাইল উড়োজাহাজে উড়ে যাবার সংবাদ পেয়ে তিনিও বিস্ময়কর কিছু করে দেখাবার সখে মেতে উঠেন। যে সময়ের গল্প তখন কোন নারীর উড়োজাহাজে ওঠাই একটি খবর। সখ মেটাবার পরিপ্রেক্ষিতে মিসেস প্যাকেল্টাইড বাঘ শিকারের পরিকল্পনা করেন। গল্পের শেষে দেখা যায় প্যাকেলটাইড তার সেই সখের তৃপ্তির পূর্ণতা পেয়েছিলেন ঠিকই, অর্থাৎ বাঘ শিকার করে রাতারাতি খবরে পরিণত হয়েছিলে্‌ কিন্তু গল্পের আরেক চরিত্র লুইসা মেব্বিন একদিন যখন তাকে জানালো আসলে সত্যি কি ঘটেছিল লোকে যখন তা জানতে পারবে তখন কত মজাই না হব,! প্যাকেলটাইড তার কথার অর্থ জানতে চাইলে লুইসা তাকে বলে ‘মানে আমি বলতে চাচ্ছি, তুমি একটা ছাগলকে লক্ষ্য করে বন্দুক ছুঁড়লে আর তার বিকট শব্দে ভয়ে বাঘটা প্রাণ হারালো’। প্যাকেলটাইড আত্মবিশ্বাসের সুরে বললেন ‘এটা এখন আর কেউ বিশ্বাস করবে না’। উত্তরে লুইসা বললো ‘ লুনা বিমবার্টন (প্যাকেলটাইডের প্রতিদ্বন্দ্বী ) করবেন’। প্যাকেলটাইডের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। বিন লাদেন তার বয়সের ভারে, বিভিন্ন রোগে রোগাক্রান্ত হয়ে এমনিতেই নুয়ে পড়েছিলেন, এরকম একজন মৃত্যুপথযাত্রীর হত্যা অভিযানের ইতিহাস ‘মহাকাব্য’ হিশাবে রূপ নেয় কিনা সেটা সঠিক বলা না গেলেও তার অনুসন্ধান পর্বের ইতিহাস যে প্রায় একটা মহাকাব্যের কাছাকাছি তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটেই গড়ে উঠেছে ছবির কাহিনী, যদিও সেই ইতিহাসের কিছু অংশ রেখে কিছু অংশ রেখে-ঢেকে পেশ করা হয়েছে।


প্রকৃত পক্ষে ‘জিরো ডার্ক থার্টি’ ছবিটা সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের ছবি করতে যেয়ে, সন্ত্রাসকে যেন আরও উসকে দিয়েছে। ‘নির্যাতন বিরোধী’ ছবি করতে যেয়ে নির্যাতনকে যেন আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। কেননা কোন ঐতিহাসিক ছবি নির্মাণ কালে ইতিহাসের সত্যের দিকে নির্মোহ দৃষ্টি না রাখলে, সেই ছবি শুধু অসম্পূর্ণই থেকে যায় না, সেই সঙ্গে মিথ্যাচার আর প্রপাগান্ডার একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। যে প্রপাগাণ্ডা, সত্যের অপলাপের কারণে যা ঘটেনি তা ঘটতে সাহায্য করে। যা ঘটেছে তার পুরোটা প্রকাশিত না হওয়ায় তার আরও প্রকাশ হবার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে।


গত ২৫ মে ২০১২, সোশালিস্ট ওয়েবসাইটের ডেভিড ওয়ালস এর একটি লেখা থেকে জানা যায়, ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর ( ২ মে, ২০১১) ঠিক আট দিন পর অর্থাৎ ১০ মে ২০১১, ছবির লেখক মার্ক বোল (Mark Boal) সি.আই. এ.’ এর পাবলিক অ্যাফের্সে কর্মরত জর্জ লিটলকে একটা ই-মেইল পাঠান; সেখানে ছবি এবং ছবির পরিচালক বিগলো সম্পর্কে উল্লেখ করে জানানো হয়, তারা বিন লাদেনের এই মহান অভিযানকে কেন্দ্র করে একটি ছবি নির্মাণ করতে চান। ছবির সত্য যাতে কাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায় অর্থাৎ বাস্তবোচিতভাবে নির্মাণ করা যায় সেই লক্ষ্যে তারা সি.আই.এ. এবং তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য অফিসের সার্বিক সহায়তা কামনা করেন। শুরু হয় সহায়তা পর্ব। এবং এই কাজে ছবির লেখক বোল এবং পরিচালক বিগলো যুক্তরাষ্ট্রের সি.আই.এ., অফিস অফ পাবলিক অ্যাফের্র্স এবং পেন্টাগন সহ যারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ‘মহাকাব্য’ রচনা করেছিলেন তাদের সকলের কাছ থেকে প্রচুর সহায়তা পান। কিন্তু এই সহায়তা গ্রহণের সময় লেখক এবং পরিচালককে কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। তবে মূল বাধা ছিল ছবির পাণ্ডুলিপি সংক্রান্ত। একই লেখকের গত ১০ মে ২০১৩র লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, যেহেতু সি.আই.এ. এবং তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সমবেত সহযোগিতার ভিত্তিতে ছবির কাহিনী নির্মিত হতে যাচ্ছে, কাজেই তাদেরকে কিছু কিছু দৃশ্য পরিবর্তন করতে হবে, যাতে তারা এবং ওরা, অর্থাৎ দর্শকেরা , সিনেমা দেখার সময় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারেন। কর্তিত দৃশ্যগুলোর বিস্তারিত তথ্য নিচে দেয়া হলো।

১. সি.আই.এ.র কর্মকর্তা হিসেবে চরিত্র মায়া, যিনি ছবির একচ্ছত্র নায়িকাই শুধু নন, সেই সঙ্গে পুরা অপারেশান কর্মের একমাত্র বুদ্ধিমতী নারী। মায়া ছাড়া লাদেনের ধরা পড়া ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতো। ছবির প্রথম দিকে দেখা যায় মায়া যান নির্যাতন সেলে, যাকে নরম ভাষায় বলা হয় ‘উন্নতমানের জেরা কৌশল’। সেই সেলে তখন ‘ওয়াটারবোডিং’, অর্থাৎ কয়েদীর মুখের ওপর মোটা কাপড় বেঁধে ক্রমাগত পানি ঢালার ভয়ংকর শাস্তি ব্যবস্থা। নিঃশ্বাসের কষ্টে যাতে অপরাধী মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব করতে পারে)। এই বীভৎস শাস্তির দৃশ্যটা আরও নরম করে উপস্থাপনের কথা বলা হয়। বলাই বাহুল্য ছবিতেও আমরা ঠিক সেভাবেই দেখতে পাই। কারণ ও.পি.এ.(অফিস অফ পাবলিক অ্যাফের্স) এর কর্তাবৃন্দদের নাখোশ করে ছবিটা নির্মাণে বোল বা বিগলো কেউই রাজি ছিলেন না।

২. মূল পাণ্ডুলিপিতে কুকুর দিয়ে ভয় দেখাবার দৃশ্যটাও, যেসব দৃশ্য বিভিন্ন পত্রিকা এবং গণমাধ্যমে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছিল, বাদ দিতে বলা হয়। বিগলো এবং বোল কায়মনোবাক্যে তাই মেনে নেন। ছবিতে এই ধরণের কোন দৃশ্য আমরা দেখতে পাই না।

৩. মূল পাণ্ডুলিপিতে একজন সেনা অফিসার মদ খাবার পর এ.কে.৪৭ রাইফেল দিয়ে বাতাসে গুলি ছুঁড়ে উল্লাসের কথা থাকলেও ছবিতে আমরা সেই দৃশ্য দেখতে পাই না। কেননা সি.আই.এ.র অভিমতে এই ধরণের দৃশ্য বাস্তবে দেখা যায় না।

৪. একটি দীর্ঘ দৃশ্য থাকার কথা ছিল, যেখানে মায়া একটি ভিডিও ফুটেজ দীর্ঘ সময়ের জন্যে দেখবে। নির্যাতন সেল বা মৃদু ভাষার সেই ‘উন্নততর জেরা কৌশল’-এর সেলে ওয়াটারবোর্ডিং সহ বিভিন্ন ধরণের বিকৃত শাস্তির ফুটেজ যেখানে দেখানোর কথা ছিল। সেই দৃশ্যটাও কেটেছেটে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেন পৃথিবীর বৃহৎ শক্তির অতিবৃহৎ গোয়েন্দা বাহিনীর দল। তাদের অনুগত শিষ্য হিসেবে বোল এবং বিগলোও সেই দৃশ্য ছেঁটে দেন। আর তাই ছবির অনেক সমালোচক ছবিটাকে ‘প্রো-মিলিটারি’, প্রো-‘সি.আই.এ.’ নামেও অভিহিত করতে দ্বিধা করছেন না।

মূলত রাজনৈতিক অন্ধত্ব এবং ওবামা প্রশাসন বা সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসনের প্রতি অবিচল আনুগত্যের কারণে বোল এবং বিগলো ইতিহাসের অনেক পাতা থেকে কিছু পাতা তুলে নিয়ে ছবিটা নির্মাণ করেছেন। চিত্রনির্মাতা অ্যালেক্স গিবনী তাই হাফপোস্টের একটি এনন্টারটেইমেন্ট ব্লগে (২১.১২.২০১২) লিখতে বাধ্য হন, “ সি.আই.এ.’র নির্যাতন সেল অর্থাৎ সেই উন্নততর জেরা কৌশলের’ ইতিহাসের দিকে যদি আমরা দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখবো আবু জুবায়দা এবং খালিদ শেখ মোহাম্মদ নামের দুজন কয়েদীকে যথাক্রমে ৮৩ এবং ১৮৪ বার সেই কুখ্যাত ‘ওয়াটারবোর্ডিং-এর’ শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল”। তাছাড়া আবু গরিব কারাগার, গুয়ান্তানামো বে ডিটেনশান সেন্টার’, সি.আই.এ.’র ‘ব্ল্যাক সাইট’ নামক কুখ্যাত সব দুর্বিসহ অত্যাচারের ইতিহাস কিন্তু ছবির কোথাও পাওয়া যায় না। যদিও সেসব অত্যাচারের বেশকিছু ফুটেজ জোস রোদ্রিগুয়েজ নামক কর্মকর্তা কর্তৃক আগেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছিল। তাছাড়া ছবিটির শুরুর সময়কাল ২০০৩ সাল হলেও কোথাও আমরা জর্জ.ডাব্লিউ.বুশ জুনিয়ারকে পাইনা, পাইনা তার তিন বিখ্যাত (কুখ্যাত?) সহযোগী কন্ডোলিসা রাইস, ডোনাল্ড রাম্সফেল্ড এবং ডিক চেনিকে। তার পরিবর্তে দেখি প্রেসিডেন্ট ওবামার হাস্যজ্জ্বল টিভি ফুটেজ। আমেরিকার প্রশাসন এবং গোয়েন্দা বাহিনীর কিছু ইতিহাস না পেলেও পাওয়া যায় সেসব ইতিহাস যেসব ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে ‘জিরো ডার্ক থার্টি’র পরিচালক-লেখক আমেরিকান গোয়েন্দা বাহিনীর নির্যাতনকে জায়েজ করেছেন। যেসব ইতিহাসের প্রেক্ষাপট দেখে দর্শক মনে মনে স্বীকার করবেন লাদেন বাহিনী বা আলকায়দা বাহিনীর এরকম শাস্তিই প্রাপ্য ছিল। ছবির শুরুতে অন্ধকার পর্দায় শুধু শব্দ পাওয়া যায়, যে শব্দ শুনে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়না ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বারের ঘটে যাওয়া টুইন টাওয়ার ধ্বংসের শব্দ। তারপর একে একে আমরা ইতিহাসের পাতার পর পাতায় দেখি ২০০৪ সালের ২৯ মে সাউদি আরবে দুটো তেল ক্ষেত্র এবং একটা অ্যাপার্টমেন্ট যেখানে বিদেশীরা অবস্থান করতো তার উপর সন্ত্রাসী কর্মযজ্ঞ হতে, ২০০৫ সালের ৭ জুলাইয়ের লন্ডনে বোমা ফেলার ঘটনা, ২০০৮ সালের ইসলামাবাদের ম্যারিয়েট হোটেলের বোমা বিস্ফোরণ (যেখানে স্বয়ং ছবির নায়িকা উপস্থিত ছিলেন) এবং ২০০৯ এর আফগানিস্তানের আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ, ইত্যাদি। যে কারণে ছবির একজন উচ্চতর গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে টেবিল চাপড়ে বলতে দেখি ‘তারা আমাদের ভূমির উপর আঘাত হেনেছিল ১৯৯৪ এ। ২০০০ সালে আক্রমণ করলো আমাদের সমুদ্রে আর ২০০১ সালে উড়োজাহাজের মাধ্যমে। ওরা ঠান্ডা মাথায় আমাদের ৩০০০ নিরীহ জনগণকে হত্যা করেছে। আর আমরা এখন পর্যন্ত কিছুই করতে পারিনি’। সংলাপটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে যেকোন ইতিহাস সচেতন ব্যক্তির ইরাক যুদ্ধের লক্ষ্য লক্ষ্য নিরীহ জনগণের ওপর যে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চলেছিল, সেইসব দৃশ্য মুহূর্তেই ভেসে উঠবে, ভেসে উঠবে আফগানিস্তানের নিরীহ জনগণের উপর মার্কিন বোমার আঘাত ; কৌতুক বোধ করবে এই ভেবে যে মাত্র ৩০০০ ( কোন সংখ্যাই নগণ্য নয়, তবু যুক্তির জন্যে বলা হলো) মানুষের জন্যে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া সহ অন্যান্য দেশের কোটি কোটি মানুষের হত্যাযজ্ঞ তাদের কাছে কোন মূল্যই রাখে না। বিগলোর ভাবখানা এমন যে আমেরিকার জনগণই কেবল মানুষ, অন্য দেশের বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে কিছু বানর ছাড়া আর কিছু বাস করেনা। ছবির একটি দৃশ্যে উন্মুক্ত এক নির্যাতন কারাগারে মুখোমুখি দুটো বড় বড় বেশ কয়েকটা খাঁচা দেখা যায়, যার এক পাশের খাঁচায় কিছু বানর এবং অন্য পাশের খাঁচায় কয়েদীদের আটক করে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ আর বানর এখানে একই গোত্রের হওয়ায় একই রকম খাঁচায় তারা বন্দী হয়ে আছে। ছবির নায়িকা মায়া যেভাবে অবলীলায় পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে ঘোরাঘুরি করে, দেখে মনে হয় দেশদুটো সে একাই দখলে নিয়ে ফেলেছে। তার কোন বন্ধু নেই, পরিবার নেই, কেউ নেই। তার শুধু একজন আছে আর তার নাম হচ্ছে অ-মে-রি-কা।

প্রকৃত পক্ষে ‘জিরো ডার্ক থার্টি’ ছবিটা সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের ছবি করতে যেয়ে, সন্ত্রাসকে যেন আরও উসকে দিয়েছে। ‘নির্যাতন বিরোধী’ ছবি করতে যেয়ে নির্যাতনকে যেন আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। কেননা কোন ঐতিহাসিক ছবি নির্মাণ কালে ইতিহাসের সত্যের দিকে নির্মোহ দৃষ্টি না রাখলে, সেই ছবি শুধু অসম্পূর্ণই থেকে যায় না, সেই সঙ্গে মিথ্যাচার আর প্রপাগান্ডার একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। যে প্রপাগাণ্ডা, সত্যের অপলাপের কারণে যা ঘটেনি তা ঘটতে সাহায্য করে। যা ঘটেছে তার পুরোটা প্রকাশিত না হওয়ায় তার আরও প্রকাশ হবার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে। বুঝতে হবে পৃথিবী আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। এখন যে কোন তথ্য এক মুহূর্তে সবার কাছে পৌঁছে যায়। সত্যের সচলতার গতি আগের চাইতে দ্রুততর হয়েছে। কোন কিছ্ইু এখন আর গোপন থাকে না। আগেও থাকতো না। কিন্তু আগের পৃথিবী্তে সত্য প্রকাশে যতটা কালক্ষেপণ হতো, বর্তমান পৃথিবীর সচল সত্যের হাতে কালক্ষেপণের সময় কম। ইন্টারনেটের যেকোন জানালা দিয়ে সত্যকে দ্রুত বের করে আনার সক্ষমতা মানুষ অর্জন করেছে। এক স্থানে ব্যর্থ হলে অন্য স্থান থেকে সে সত্য সংগ্রহ করতে শিখেছে। কাজেই মার্ক বোল, ক্যাথেরিন বিগলোরা যদি মনে করে থাকেন, বিজয়ীর পক্ষেই ইতিহাসের সত্যতা থাকে, তাহলে অত্যন্ত ভুল করবেন। সত্যের মাউজ এখন বিজয়ী এবং বিজিত উভয়ের হাতে প্রসারিত। সেই প্রসারিত সত্যের ইতিহাস একদিন যেমন বিন লাদেনকে ক্ষমা করেনি তেমনি অর্ধ সত্যের নির্মাণকারীরা ও তার সহযোগিরা ক্ষমা পাবেন না। উৎপীড়ক এবং উৎপীড়িত, ইতিহাসের সত্য এবং মিথ্যার দুটো দিকই সমানভাবে উন্মোচন করে যেকোন সৃষ্টিশীল কাজ করা হলে, তা পূর্ণ সত্যের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top