রওশন আরা মুক্তা
কেমন আছেন? বছর শেষে আবার শুরু হলো অমর একুশে বইমেলা, জাতীয় জীবনে এই মেলার তাৎপর্য কী বলে?
জাতি হিসাবে আমরা কোন ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি নই, ফলে অমর একুশে বই মেলাও বিভক্ত, বিভাজিত ও নানা ভাবে খণ্ডিত রূপ নিয়ে হাজির হয়। তার তাৎপর্যও সেই প্রকার খণ্ডিত ও বিভাজিত মর্মের কথাই বলে। এটা এখনও একান্তই বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের অনুষ্ঠান হয়ে রয়েছে। সবার, সাধারণ মানুষের নয়।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য যাদের হাতে তৈরি ও বিকশিত হয়েছিল তারা প্রধানত উচ্চ বর্ণের হিন্দু । তারা ইংরেজের তাঁবেদারি করে পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছে। এটা ব্রাহ্মণ বা হিন্দুর কোন দোষ কিম্বা গুণের বিচার নয়। এটা ইতিহাস। কিন্তু একালে এর আপদের দিক হচ্ছে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সাহিত্য ও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত জাতীয়তাবাদের চরিত্রে অর্থাৎ বাঙালী জাতিবোধ ও চেতনার মধ্যে এখনও উচ্চ বর্ণের হিন্দুর ধ্যান ধারণাই রয়ে গিয়েছে। ফলে বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি চর্চার মধ্যে উচ্চ বর্ণের হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনারই প্রাধান্য। একেই আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা হিসাবে চর্চা করি। নতুন সময় ও নতুন ইতিহাস নির্মাতা হিসাবে নতুন কবি, লেখক সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এটা ভাঙতে না পারলে অমর একুশে বইমেলা ধরণের জাতীয় অনুষ্ঠানের তাৎপর্যও সেটাই হবে। ভিন্ন কিছু হবার কোন ঐতিহাসিক শর্ত হাজির দেখছি না।
এটা কাটিয়ে ওঠার উপায় কি?
প্রথম কাজ হচ্ছে সাহিত্য, শিল্প, ছবি ওয়ালা, সাংস্কৃতিক কর্মীদের সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠা। দেখবেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ লেখক, কবি, নাটুয়া, থিয়েটারওয়ালা, ছবি আঁকিয়ে ভাণ করে তারা সেকুলার অথচ এরা হাড়ে হাড়ে চরম সাম্প্রদায়িক। এটা বোঝার ছোট লিটমাস টেস্ট হচ্ছে আপনি ইসলাম নিয়ে কিম্বা মুসলামানদের পক্ষে কিছু বলুন সঙ্গে সঙ্গে তারা আপনাকে জামাতি বলে ট্যাগ দিতে শুরু করবে। আপনার কথায় যুক্তি কিম্বা তথ্য আছে কিনা তারা বিচার করে দেখবে না। একাত্তরে জামাতের ভূমিকা অবশ্যই নিন্দনীয়। সমীকরণ হচ্ছে এরকম যে ইসলাম মানেই জামাত আর জামাত মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা। অতএব ইসলাম নিয়ে কিম্বা মুসলমানদের স্বার্থ নিয়ে কিছু বলার অর্থই হচ্ছে জামাতী হয়ে যাওয়া।
এই উপমহাদেশে ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে। কখনও এন্টি-কলোনিয়াল এবং জমিদার-মহাজন জাত পাত বিরোধী – কখনও কখনও চরম সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা একাট্টা ইসলামের বিরোধিতা করে। অজ্ঞতা, মূর্খতা, ইসলাম ভীতি, ইসলাম বিদ্বেষ, ইতিহাস না জানা – ইতাদি নানান কারনে তারা এটা করে। এইসব কাটিয়ে উঠতে হবে। বাঙালি মুসলমানের জীবন ও জগত বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য বা সংস্কৃতির বিকাশ অসম্ভব।
ঢাকা বদলাচ্ছে দ্রুত। আর এক দশকের মধ্যেই তার রূপ আমরা দেখব। সমাজ, বাস্তবতা ও ইতিহাসের নিজের তাগিদেই সেটা বদলাবে। আমাদের কাজ হবে শ্রেণির প্রশ্নকে সবসময় সামনে রাখা; জাতপাত বিরোধিতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সকল নিপীড়িত জনগোষ্ঠির পক্ষে দাঁড়ানো এবং একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে উঠবার জন্য অনুকুল শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা করা।
বিশেষ ভাবে বলি, কোন দলের লাঠিয়াল না হওয়া। সাধারন মানুষের ভাষা, আবেগ, স্মৃতি, জীবন ও জগতকে দেখবার সহজ সরল পদ্ধতি আয়ত্ব করবার চেষ্টা আন্তরিক জারি থাকলেই আমরা মানুষের কাছে পৌঁছে যাবো।
এটা কি সম্ভব?
বাংলাদেশ বিস্তর এগিয়ে গিয়েছে। আমি নিশ্চিত আর এক দশকের মধ্যেই ঢাকা আরও বদলাবে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ, ফলে ঢাকা তো কলোনিয়াল কলকাতা কিম্বা দিল্লীর অধীনস্থ পরাধীন পশ্চিম বাংলা হবে না। ঢাকাই বাংলাভাষীদের রাজধানী।
একাত্তরের পর বাঙালী জাতির বাইরে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতি সত্তার অধিকার যেমন অস্বীকার করা হয়েছে, তেমনি এদেশের সাধারণ মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি, আবেগ, ইতিহাস ইত্যাদির প্রতিও চরম বিরূপ ভাব দেখানো হয়েছে। বাঙালি জাতীয়াতাবাদের সাম্প্রদায়িক ও বিপজ্জনক চরিত্রটা এখানেই নিহিত। তার বাঙালি হবার সাধনার মধ্যে কোন অসুবিধা নাই। সেই সাধনা করতে গিয়ে সে কাকে কাকে এবং কী কী বাদ দিতে চায় তার দ্বারাই তার সাম্প্রদায়িক মতলব ধরা পড়ে। ফলে একটা বিভাজন রয়ে গিয়েছে। এটা জাতপাত ও শ্রেণি প্রশ্নের সঙ্গে যেমন জড়িত তেমনি একাত্তরে তো আমরা ইসলামকে পরাজিত করেছি অতএব আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতিতে মুসলমানি কিছু থাকবে কেন? — এই ধরণের মনমানসিকতার চরম মূর্খামিও কাজ করে।
এই বিভক্তি ও বিভাজন কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখার কথা ছিল সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মীদের। কিন্তু বাংলা একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ছবির হাট, চারুকলা – অর্থাৎ যে সকল প্রতিষ্ঠান কিম্বা সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি ইত্যাদির আশে পাশে আছে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে আওয়ামি লীগের লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে কাজ করে। একদা যেমন এইসব এলাকায় ইসলামাবাদের দালালদের দৌরাত্ম দেখতাম, এখন দিল্লীর আনসার বাহিনীদেরই তো দেখি! সৃষ্টিশীলতার বৈচিত্র ও বহুগামিতা এতে রুদ্ধ হয়ে রয়েছে। এগুলো সাহিত্য ও সংস্কৃতি আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ভাঙতে হবে। ভাঙবে। অবশ্যই।
আপনার বইমেলা নিয়ে অভিজ্ঞতা কেমন?
খারাপ না। কারন আমার বই তো বিক্রি হয়, পাঠকও মনে হয়, কম না। তবে আমি ব্যস্ততার জন্য খুব একটা যেতে পারি না। তবে ঢাকায় থাকলে একবার দুইবার যাবার চেষ্টা করি।
বইমেলার আয়োজন নিয়ে আপনার নিজস্ব চিন্তা আছে কি কোনো?
আছে। আমি মনে করি প্রকাশকদের বই প্রচার ও বিক্রির মেলা প্রকাশকদের উদ্যোগে আলাদা করা উচিত, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনের বাইরে। বাংলা একাডেমির উচিত লেখক ও গুরুত্বপূর্ণ বই পরিচিত করিয়ে দেবার দায়িত্ব নেওয়া। বইয়ের ভিড়ে লেখকরা হারিয়ে যায়।
বই বিক্রির দোকানদারি করা বাংলা একাডেমির কাজ নয়। বরং তার কাজ ভাল প্রকাশকদের চিনিয়ে দেওয়া, পুরষ্কৃত করা এবং সম্ভব হলে ভাল বই প্রকাশের জন্য লেখক ও প্রকাশকদের অনুদান দেওয়া। যেমন, তরুন লেখক তাঁর পাণ্ডুলিপি জমা দিতে পারে বাংলা একাডেমিতে। বাংলা একাডেমিকে তা নিজে প্রকাশের দায়িত্ব নিতে হবে এমন নয়, বরং তার উচিত লেখককে লেখা প্রকাশের জন্য অনুদান দেবার ব্যবস্থা করা। ইত্যাদি।
কোন লেখক কিছু লিখবার ধারণাপত্রও জমা দিতে পারে। সেটা হতে পারে উপন্যাস, কবিতা, নাটক, দর্শন, অনুবাদ বা অন্য কিছু। তাকে এক থেকে তিন বছরের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা বাংলা একাডেমির কাজ।
লেখকদের নিজের কাজ পাঠকদের কাছে তুলে ধরা, কবিদের কবিতা পাঠ, বিভিন্ন বিষয়ে সমাজে যাঁরা চিন্তা ভাবনা করছে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরা, ইত্যাদি নানান অনুষ্ঠান বাংলা একাডেমির বিভিন্ন মঞ্চে একুশের সারা মাস ব্যাপী হতে পারে। বইয়ের বাজার না বসালে ভিড় ভাট্টা কম হবে। অর্থাৎ আমি চাই একে একটা সাহিত্য উৎসবে পরিণত করা হোক। অর্থাৎ ফালতু বইয়ের বাজার না বানিয়ে তাকে সাহিত্যের বাজারে পরিণত করা হোক। যেন বিভিন্ন গোষ্ঠি, ধারা, চিন্তা ও ভাবের মানুষের একটা জমজমাট ভাবের বাজার তৈরি হয়। বাংলা একাডেমি বস্তা পচা বাজে বই বিক্রির আখড়া হয়ে উঠুক এটা আমার কাম্য না। বরং সাহিত্য উৎসব যেন সারা বছর বই কিনবার প্রণোদনা জোগায়। শুধু এক মাসের নয়। বাংলা একাডেমি এভাবেই সাহিত্য, গবেষণা ও বই প্রকাশনাকে উৎসাহিত করতে পারে।
তরুণ কবিদের প্রতি আমার বিশেষ পক্ষপাত আছে। আমি মনে করি যারা আসলেই কবিতা রচনাকে ব্রত হিসাবে নিয়েছে তাদের প্রতি সদয় হবার দায় আছে বাংলা একাডেমির। তাদের জন্য বৃত্তি দাবি করি আমি।
বই নিয়ে আপনি কী ভাবেন? বই কি আসলে প্রোডাক্ট?
পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বই মানেই পণ্য। শুধু বই নয় ধর্মগ্রন্থসহ সব কিছুকেই পুঁজি পণ্যে পর্যবসিত করে। সচেতন লেখককে এর সঙ্গে লড়াই করেই লিখতে হয়, যা তার লেখার শৈলী, বিষয়, উপস্থাপনার ভঙ্গি বহু কিছুকেই সজ্ঞানে অজ্ঞানে প্রভাবিত করে। হুমায়ূন আহমেদ এই ক্ষেত্রে খুবই শিক্ষণীয় হতে পারে। বাজারের জন্য বই লিখব না বা বই প্রডাক্ট না জাতীয় চিন্তা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রোমান্টিক সুড়সুড়ি তৈরি করে, কিন্তু শিল্প কিম্বা ব্যবসা কোনটিরই কাজে আসে না। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা অপছন্দ হলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ান, রাজনীতি করুন – সেটা ভিন্ন কাজ। জনপ্রিয় বইও সচেতনতার কাজ করতে পারে।
বাংলাদেশে প্রোডাক্ট হিসাবে বই কিনে পড়ার মতো পাঠক আছে? লেখকরা কি সে চাহিদা পূরণ করতে পারছে?
না। পারছে না। তরুণদের বলি, বাজারের জন্য বা জনপ্রিয় বই লেখার মধ্যে কোন লজ্জা নাই। আমার প্রিয় বন্ধু আহমেদ ছফার সঙ্গে আমার বড় একটা সময় হুমায়ূন আহমেকে ডিফেন্ড করতে ব্যয় হয়েছে। তরুণদের বলি, পাঠক পড়ে এমন বই লিখুন। বই লেখাকে জীবিকা করুন। আসলে লেখা তো জীবিকাও বটে। অস্বীকার করি কী করে!
আমি গবেষক হিসাবে যা করি সেটাও তো লেখালিখিই বটে। তাহলে লেখালিখি সম্পর্কে রোমান্টিক ধ্যান ধারনাগুলো ভেঙ্গে ফেলা দরকার।
বছর বছর অনেক বই বের হয়, নানা ধরণের পুরষ্কার আছে বইকে কেন্দ্র করে, পুরষ্কার নিয়ে আপনি কি ভাবেন?
কিছুই না। কোন মূল্য দেই না।
এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই আসছে?
একটা কবিতার বই আসছে: ‘তুমি ছাড়া আর কোন্ শালারে আমি কেয়ার করি’।
আসলে “অনন্ত যুদ্ধের কালে আমি পদ্য লিখছি মেশিন গান ও বন্দুকের নলে, টমাহক ও ট্যাংকের গালে এবং সর্বোপরি বুশ ও ব্লেয়ারের পাছায়” – এই আর কী! গত এক দশকে বাংলাদেশে বুশ ব্লেয়ারের যেসব আণ্ডা বাচ্চারা আমাকে গালিগালাজ করেছে তাদের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছি কবিদের সহবত অনুযায়ী। কুকুর কামড়ালে তো আপনি গিয়ে গিয়ে কুকুরকে কামড়াতে পারেন না, তাই না? অতএব কবিতা লিখেছি।
“কবিতা আস্তিকতা নাস্তিকতার ধার ধারে না। সে জালিমের বিরুদ্ধে যখন জিহাদি তখন খোদার কসম তার হাতে এসে যায় হজরত আলীর জুলফিকার। কারন সে তখন জগজ্জননী মা ফাতেমার সন্তান। উত্তরাধিকার সূত্রে জালিমের বিরুদ্ধে সকল তরবারিতেই তার অধিকার। এমনকি নাস্তিক ও কমিউনিস্টদের খঞ্জরগুলোও উত্তরাধুনিক কালে তাদের খোদ মালিকের খোঁজ শুরু করে। তাদের আমি গ্রহণ করেছি”।
— এই ধরনের কবিতা। বোধ হয় শাহবাগীদেরও ভাল লাগবে।
আমার কিছু কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ করেছে এমন সব বাজে, সাম্প্রদায়িক ও ইসলাম বিদ্বেষি হীনমন্য ব্যাক্তি যাদের আমি একদা শিল্পী ভেবেছিলাম। দুঃখ রয়ে গেলো প্রকাশকের ক্ষতি হবে ভেবে সেইসব প্রচ্ছদ আমি এবার পাল্টাতে পারলাম না। তবে পরের সংস্করণে বুশব্লেয়ারের ছানাপোনাদের চিহ্ন আমি বহন করবো না।
এছাড়া আছে প্রবন্ধের বইঃ ‘ব্যাক্তি, বন্ধুত্ব ও সাহিত্য’। কিছু জনপ্রিয় কবিতার বইয়ের পুনর্মুদ্রণও আছে । যেমন, ‘কবিতার বোনের সঙ্গে আবার’, ‘অসময়ের নোট বই’ ইত্যাদি।
বাতিঘর ‘জগদীশ’ বইটি পুনর্মুদ্রণ করবার কথা। কিন্তু আমি দেরি করে ফেলেছি একটি নতুন পরিশিষ্ট লিখব বলে। তবে দুই একদিনের মধ্যে হয়ে যাবে, আশা করি।