।। ফাতেমা রিয়া ।।
শেফালি বরকত পাওয়ার আশায় এখন ফিটফাট থাকে, বোরকা পরে ট্রেনের কোনো একটা বগিতে ওঠে, তারপর ‘বাপ আজহারউদ্দিনের ব্লাড ক্যান্সার, অতি দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন’ লেখা কাগজ সবার হাতে দিয়ে দেয়। আর একটা চকলেট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকা খুব বেশি ওঠে না, কেউ কেউ টাকা না দিয়েই চকলেট খেয়ে ফেলে, কাগজ ফেলে দেয়। তখন সেটা লস। শেফালির রাগ হয়, মন খারাপ হয়। গরীবের সাথে এ কেমন প্রতারণা? আর কাগজে যেমন লেখা আছে সে তার চেয়েও গরীব। বাপের ক্যান্সার তো দূরের কথা, তার বাপই নাই, তাহলে তাকে এই মানুষগুলো টাকা দেয় না কেন?
শেফালি
শেফালি বেগমের আসল নাম ময়না। তার আগেপরে কিছু নাই। বাবা-মা জন্মের পর তার দিকে অত খেয়াল দেয় নাই। হয়তো কোনো একদিন হামাগুড়ি দেয়া বাচ্চাটাকে দেখে মনে হয়েছে একটা নাম দেয়া দরকার। নামটা হয়ে গেল ময়না। অনেক বছর পর একদিন এনজিওর লোক আসলো, নাম জিজ্ঞাসা করলো। শেফালির তখন দশ-এগারো বছর বয়স হবে, সে নির্বিকার হয়ে উত্তর দিল, ময়না।
এনজিওর লোকটা জিজ্ঞাসা করলো, ময়নার পরে কী?
– কিছু নাই।
এনজিওর লোক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরবর্তী বাচ্চাটার কাছে চলে গেল। তাতে শেফালির কিছু যায় আসে না। তার বাবা ভাসমান কৃষক, মা গেরস্তবাড়ির ঠিকা ঝি, নামের আদিখ্যেতা না করলেও চলে। জানটা বেঁচে আছে সেটাই বড় কথা। তারও অনেকদিন পরে শেফালি বেগমের বিয়ে হল, তখন তার বয়স ষোল-সতের হবে। ছেলে ভালো পাওয়া গেছে। রাজশাহী সদরে রিকশা চালায়। কারেন্টের রিকশা। শেফালির জনমদুখিনী মা পাত্র জোগাড় করে এনেছেন, খুব সাদামাটা বিয়ে হল। শেফালি তার ময়না নামের পিছনে বেগম বসায়, কিছু একটা লাগাতে হয় এটা সে জেনেছে, অবশেষে সে পরিপূর্ণ নাম পেল।
বিয়ের রাতে তার স্বামী তাকে জোর-জবরদস্তি করলে শেফালির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তাতে কিছু আসে যায় না, দুদিন পর ঠিক হয়ে সে সাংসারিক কাজে মন দিল। পরপর দুটো বাচ্চা হয় শেফালির । তৃতীয়টা পেটে থাকতে স্বামী অন্য এক মহিলা নিয়ে ঘর-সংসার শুরু করলো। সে এক কঠিন দিন গেছে…
শেফালি রাজশাহী ছেড়ে নাটোরে আশ্রয় নেয়। রেলস্টেশনেই থাকেতে শুরু করে। সাথে দুটি বাচ্চা। পেটেরটা নিজেই নষ্ট করে ফেলেছে। শরীরটা খারাপ ছিল, আস্তে আস্তে ঠিক হচ্ছে। তার বাবা মোখলেস মিঞা মারা গেল কিছুদিন আগে, মায়ের সাথে যোগাযোগ করলে মাও তার সাথে জুটবে সেই ভয়ে আর করলো না। কোথাও হয়তো ভিক্ষা করে খাচ্ছে, তাই খাক। দুইদিনের দুনিয়াতে কে কার…
কিন্তু এখানেও বা কীভাবে চলবে? রাতে বিভিন্ন মানুষ তাকে আজেবাজে ইঙ্গিত করে, হোটেলে নিয়ে যেতে চায়, সে বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে শক্ত করে বসে থাকে, কিন্তু জড়িয়ে ধরলেই বা বাচ্চাদের চলবে কেন… তারা খাবার চায়, দিনরাত ট্যাট্যা করে। মাঝে মাঝে সে বাচ্চাদের নিয়ে ট্রেনে ভিক্ষা করে, কিন্তু কুলিয়ে ওঠে না। মান-সম্মান বিকানোর পথেই হাঁটতে হবে মনে হচ্ছে।
এরই মধ্যে একদিন তার সাথে পরিচয় হল মোতাহার ভাইয়ের। তার নাটোর স্টেশনে পান-বিড়ির দোকান আছে। এর বাইরেও মোতাহার ভাইয়ের নানান সাইড বিজনেস, ট্রেনের টিকেট ব্লাকে বিক্রি করা, ভিক্ষুক গ্যাং চালানো, অত্যন্ত চালু মানুষ। খাটো, কালো এক লোক, চোখ দুটো ছোট ছোট, কি ভাবছে বোঝা যায় না। উনি একদিন শেফালিকে ডেকে পাঠালেন।
–কিরে, তোর নাম কি?
–ময়না।
– এখানে বইয়া থাকস, আমার পোলাপানরে টাকা দেস না কেন?
– টাকা নাই, থাকলে কি আর এহানে ভিক্ষা করে খাই?
মোতাহার ভাই চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, ছেমড়ির ত্যাজ আছে দেখি।
শেফালি চুপ করে রইলো, তারপর মোতাহার ভাইয়ের বদান্যতায় সে ভিক্ষুক গ্যাংয়ে যুক্ত হল, মোতাহার ভাই তার বিভিন্ন ভিক্ষুক কর্মীকে বিভিন্ন কাজে লাগান, পুরো রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল ঘিরেই তার নেটওয়ার্ক। শেফালির কাজ পড়ল, বাবার ক্যান্সারের কথা কাগজে লিখে ভিক্ষা করা। একটু ভদ্র ভিক্ষুক। এটা মোতাহার ভাইয়ের চিন্তা, তিনি নিজেও ফিটফাট থাকেন, আর বলেন, গরীব হইলেই যে পাগল-ছাগল হইতে হবে এটা সত্য না, ভদ্র গরীব হওয়া যায়। আল্লাহ বরকত দেয়।
শেফালি এখন স্টেশনের পাশে ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে। সেখানে মাঝে মাঝে মোতাহার ভাই আসে। সব শুনে বলে, ধৈর্য ধর ময়না। ধৈর্য।
শেফালি ধৈর্য ধরতে পারে না, অবশেষে তার দুটো বাচ্চার সামনেই তাকে জড়িয়ে ধরে মোতাহার। শেফালি বাধা দেয় না। বাচ্চারা তাদের একটু দেখে আবার খেলায় মন দেয়, পথের বাচ্চারা অনেক কিছুই দেখে অভ্যস্ত, কোনো কিছুই তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না সেভাবে।
শেফালি আস্তে আস্তে গোঙায়, বাচ্চাদের দিকে তাকায়। তার ছেলেমেয়ে দুটো বড় হচ্ছে অথচ আক্কেল মোটেও নাই, মেয়েটার বয়স হল পাঁচ, ছেলেটার তিন। কদিন পর মেয়েটারো তার মত পরিণতি হবে, পথের মানুষ ছিড়েখুড়ে খাবে। মোতাহারের তীব্র আলিঙ্গনে পিষ্ট হতে হতেই শেফালি ভাবে, মেয়েটার ভালো বিয়ে দিতে হবে, এখান থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে। টাকা জমাতে হবে তাই।
টাকার কথা ভাবতেই সে মোতাহারের দিকে তাকায়। লোকটাকে জন্তুর মত দেখাচ্ছে এখন, তবুও শেফালি তাকে জড়িয়ে ধরে।