‘বিশুদ্ধ লালন’: এমন কিছু কি আছে?
লালনকে কিভাবে বুঝলে ও চর্চা করলে তিনি এই কালে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন? এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা পেশ করব। তার আগে বলা দরকার ‘বিশুদ্ধ লালন’ বলে আসলে কিছু নাই। অর্থাৎ লালনের গানের, তত্ত্বের বা চর্চার কোন বিশুদ্ধ বা নির্ভুল ব্যাখ্যার জন্য যদি আপনি পেরেশান হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে স্বস্তি দেবার ক্ষমতা কারো নাই। তার মানে এই নয় যে আপনি আপনার মনমতো একটা ব্যাখ্যা দেবেন। লালনপন্থীদের গুরুপরম্পরা এবং নদিয়ার ভাবচর্চার ঐতিহ্যপরম্পরার মধ্যেই লালনের গান, তত্ত্ব ও চর্চার ব্যাখ্যা ও বোঝাবুঝি সীমিত। এরপর রয়েছে অধিকারীর প্রশ্ন। যিনি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তিনি যদি লালনের ঘরের কেউ না হন তাহলে ব্যাখ্যার অধিকার তার আছে কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন রয়েছে।
লালনপন্থীরা লালনের বিশুদ্ধ ব্যাখা খোঁজেন না, তাদের কাছে গুরুর কথাই শেষ কথা। লালন অনুরাগীরা গুরুর সন্ধান করে। গুরুর কাছেি ফণা তোলা সাপ মাথা নোয়ায়। যে সাপ ফণা তুলে বেড়ায় সে ছোবল মারতে ভালবাসে। মাথা নোয়াবার পর গুরুর ব্যাখ্যাই মানে, অন্য কারো ব্যাখ্যা নয়। আর লালনপন্থী সাধুরা সাধুসঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা ঐতিগ্যগত পরম্পরা তৈরি করেন। তাদের মধ্যে মত পার্থক্য আছে অবশ্যই। নিদিয়ার ভাবচর্চাকে তা গতিশীল ও জীবন্ত রাখে। কিন্তু সাধুসঙ্গে কিম্বা অন্যত্র তাঁদের মত পার্থক্য প্রকাশের একটা আদপ আছে, সেটা কূটতর্ক নয়, সেখানে অহংকার নাই। আমার কথাই সঠিক হতে হবে এমন কোন উগ্রতা নাই। কারণ সাধুকে চেনা যায় কাজে, তাঁর কথায় নয়। ফলে সেখানে তর্ক হয় না, কথার বিকিকিনি হয়, সাধু সঙ্গ হচ্ছে কথার বাজার, সেখানে কথার সওদাগরি চলে। সাধুরা বলেন, যদি কথাতেই সব হোত, তাহলে মিষ্টি বললেই মুখ মিষ্টি হয়ে যেত, মিষ্টি খেতে হোত না। তাঁরা মিষ্টি খেতে আগ্রহী। তাই মিষ্টি কী, কতো প্রকার, দেখতে কেমন এই সকল অনুমান ও ইলিউশানের জগত নিয়ে তাদের বিশেষ মাথাব্যাথা নাই। ফলে এখানে কথার চেয়ে যাঁরা কাজে আগ্রহী তাঁদের বিবেচনার জন্য কিছু কথা বলতে চাইছি।
লালন নিয়ে নতুন বিপদও তৈরি হয়েছে। বাজার ব্যবস্থায় সবকিছুই পণ্য হয়ে ওঠে, লালন ব্যতিক্রম কেউ নন। ফলে লালন সাধক ছিলেন বলে তাকে নিয়ে সিডি, ভিডিও বা সিনেমার ব্যবসা হবে না, এই গ্যারাণ্টি দেওয়া কঠিন। তাকে নিয়ে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য হচ্ছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নাই। লালন সাঁইজীকে বাজারের বিষয়ে পরিণত করার বিরোধিতা করেন অনেকে। অভিযোগ ওঠে লালন কর্পোরেট বাণিজ্যের বিষয়ে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন। আপত্তিকর মনে হয়। আপত্তি ওঠা স্বাভাবিক। ফলে ফকির লালন শাহকে বাজারের দূষণ থেকে বিশুদ্ধ রাখার একটা বাসনা ও চেষ্টা দানা বেঁধে উঠতেই পারে। লালন নিয়ে একটা বাজারি আগ্রহ যেমন তৈরী হয়েছে, ঠিক তেমনি তাঁকে বাজারের খপ্পর থেকে উদ্ধারের নৈতিক উদ্বিগ্নতাও আছে।
এই উদ্বিগ্নতা তৈরি হবার একটা বড় কারন হচ্ছে ছেঁউড়িয়ার কোন অনুষ্ঠান কোন প্রাইভেট কম্পানি স্পন্সর করেছে সেটা ছেঁউড়িয়াবাসী আগে দেখে নি। আজকাল দেখছে। এক সময় ছিল যখন শুধু ফকিরফ্যাকড়ারাই নিজেদের উদ্যোগে তাদের মতো করে তাদের নিজ নিজ গুরুকে নিয়ে পহেলা কার্তিকে ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠান কিম্বা ফাল্গুনি পূর্ণিমায় ছেঁড়িয়ার দোলের সঙ্গ করতেন। লালনের আখড়া ছিল ফকির মলম শাহের বাড়ি। সেই বাড়িতে কালিগঙ্গা নদীর তীরে সঙ্গ হোত। এরপর মলম শাহের বাড়ি – অর্থাৎ এখন যাকে ফকির লালন শাহের মাজার বলা হয় –সেটা তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। সরকার এখন এখানেই লালন একাডেমিএবানিয়েছে দালানকোঠা তুলেছে। এখন অনুষ্ঠানের আয়োজক লালন একাডেমি। একাডেমি মূলত চলে প্রশাসনের নির্দেশে। তার মানে স্থানীয় প্রশাসনই আসলে অনুষ্ঠানের আয়োজক।
বাংলা ১২৯৭ সালে (খ্রিস্টিয় ১৮৯০) লালন তিরোধান করেছেন। তিনি ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন। সেই হিশাবে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে বাংলা ১১৮১ সাল বা খ্রিস্টিয় ১৭৭৪ সালে। এই দিনে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় তাঁর ভক্ত, অনুসারী ও অনুরাগীরা ছোটখাট যে অনুষ্ঠান করতেন সেটা এখন লালন একাডেমির সরকারী অনুষ্ঠানে্র রূপ নিয়েছে। তিরোধানের দিন তো শোকের দিন। কিন্তু এখন সেটা আর শোকের দিন হিশাবে নয়, রীতিমতো উৎসব হিশাবে পালন করা হয়। এছাড়া ফকির লালন শাহ জীবদ্দশায় দোল পূর্ণিমায় যে ‘সাধুসঙ্গ’ করতেন সেই দিনটি সাধুগুরুরা সাধুসঙ্গ হিশাবেই পালন করে আসছিলেন। কিন্তু সেটাও এখন একটা মেলায় পরিণত হয়েছে। লালন একাডেমি দোলপূর্ণিমাতেও সরকারী ভাবে মেলা বসান। সাধুগুরুদের এখন কমই দেখি। পনের বিশ বছর আগেও ছোট ছোট দলে বিভিন্ন জায়গায় রাতভর গান আর তত্ত্বালোচনা দেখেছি। এখন হল্লা বেড়েছে। সাধুগুরুদের আগমন কমেছে। এলেও তাঁরা একদিন এক রাত থেকে চলে যেতে দেখি। তত্ত্বালোচনা একদমই হয় না, সেটা বলা যাবে না। কিন্তু তার মগ্নতা ও গভীরতা কমেছে, অন্যদিকে সেটা ক্রমাগত চাপা পড়ে যাচ্ছে কোলাহলে।
গত কয়েক দশকে নিজের চোখের সামনেই ছেঁঊড়িয়াকে বদলে যেতে দেখেছি। একই সঙ্গে দেখেছি লালনপন্থী সাধুগুরুদের মধ্যেও লালন চর্চার রূপান্তর। যে জীবন চর্চা আগে সম্ভব ছিল, গ্রামে সেই জীবন ধারণ এখন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। চর্চাও বৈষয়িক কারণে বদলে যাচ্ছে। লালনের গান চর্চার মধ্যেও রূপান্তর ঘটেছে। আগে শিল্পী গড়ে উঠত বিভিন্ন সাধুসঙ্গে গান গেয়ে, সাধুগুরুদের ভাবের পরিমণ্ডলে পরীক্ষা দিয়ে। এখন তারা উঠে আসতে চায় ‘বাংলাদেশ তোমাকে খুঁজছে’ ধরনের অনুষ্ঠানের বিচারকদের সন্তুষ্ট করে। শিল্পীর খ্যাতি বা সাফল্য লালনপন্থী সাধুগুরুদের সন্তুষ্টি অর্জনের ওপর আর নির্ভরশীল নয়। লালনের গানের সঙ্গে লালনের জীবন ও ভাবচর্চার একটা গভীর বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে। ‘লালন গীতি’ নামে সাধকের জীবন চর্চা থেকে সাধকের গানকে আলাদা করে যে ছেদটা টানা হয়েছিল সেটা এখন পূর্ণ বিচ্ছেদে পরিণত হয়েছে। ‘লালন গীতি’ নামে একটা গানের ঘরানা তৈরী হয়েছে যার সঙ্গে সাধক জীবনের কোন সম্পর্ক নাই। ব্যান্ড শিল্পীরাও লালন গাইছেন। নাচাকুঁদা করছেন। নতুন মাধ্যম নতুন যে শ্রোতা-শ্রেণী তৈরী করেছে তাদের মনোরঞ্জনের ওপর সেই গীতির গায়কী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সাধুসঙ্গে যে গান ভাবচর্চার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে নিজের বিকাশ ঘটাত, সেই চর্চার পরিমণ্ডল থেকে গান আলাদা হয়ে গিয়েছে। আজকাল আবার ছেঁউড়িয়ায় দেখি হিন্দি গানের সুরে লালনের গান সুর করবার চেষ্টা। মোট কথা, পুরানা সম্পর্ক পুরানা প্রতিষ্ঠানগুলো সব ভেঙ্গে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে। শ্রুতি ও কণ্ঠনির্ভর সংস্কৃতির মধ্যে ভাবচর্চার যে ধারা এতোকাল বিকশিত হতে পেরেছে, অক্ষর, মূদ্রাযন্ত্র বা ডিজিটাল যুগে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা কঠিন। সেটা আদৌ সম্ভব কিনা, কিম্বা সম্ভব হলে তার চর্চার রূপ কেমন হবে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যার মীমাংসা হয় নি।
ছেঁউড়িয়ায় আগে খুব মানুষের সমাগম হোত তা নয়, কিন্তু এখন প্রচুর দর্শনার্থী আসছেন। খরচও বেড়েছে। খরচের সমস্যা সমাধানের জন্য আস্তে আস্তে সেখানে কর্পোরেট বাণিজ্য ঢুকে গিয়েছে। দেখা গেলো মোবাইল কম্পানিগুলো সেখানে তাদের বড় বড় বিলবোর্ড টানাচ্ছে, তাদের উদ্যোগেই অনুষ্ঠান হচ্ছে। এতে এলাকায় অস্বস্তি বেড়েছে, কারণ এরই হাত ধরে কর্পোরেট কালচার আরও জমে বসতে চাইছে। সাঁইজীর ধামের পরিবেশ যা কিছু ছিঁটেফোঁটা অবশিষ্ট আছে তা অন্তর্হিত হতে শুরু করেছে দ্রুত।
নিঃসন্দেহে বলা যায় ফকির লালন শাহের ধাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। সরকার একে পর্যটন এলাকা হিসাবে গড়তে চায়, লালনের অনুরাগী ও অনুসারীরা চাইছে ফকির লালন শাহের সাধনার ধারাবাহিকতা ছেঁউড়িয়া বজায় রাখুক এবং দেশে বিদেশে নেতৃত্ব দিক। এখানে বেশ বড় ধরণের দ্বন্দ্ব আছে। সাধারণ ভাবে নদিয়া এবং বিশেষ ভাবে ছেঁউড়িয়া নানা কারনে নানান ধরণের মানুষকে দেশবিদেশ থেকে আকৃষ্ট করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এটা বাড়বেই। অন্যদিকে জীবনযাপন চর্চা ও ভাবচর্চার যে রীতি ও প্রকরণ ফকির লালন শাহ রেখে গিয়েছে তার প্রতি তরুণদের বড় একটি অংশের আগ্রহ বাড়ছে। যে নাড়ীর সঙ্গে ঔপনিবেশিক কারণে বন্ধন ছিঁড়ে গিয়েছিল সেই নাড়ীর টান যে কোন সংবেদনশীল মানুষই এখন বোধ করে। তরুণদের ক্ষেত্রে সেটা আরও আবেগী আরও তীব্র হওয়াই স্বাভাবিক। এখানে একটা দ্বন্দের ক্ষেত্র রয়েছে যার রূপ আগামিতে কী দাঁড়াবে এবং তার মীমাংসার সঠিক পথ কি হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। দূরদর্শী হয়ে এর প্রতি সকলেরই মনোযোগী হওয়া ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো জরুরী।
জীবনের বড় অংশই নানান উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে নদিয়ার ভাব ও জীবনযাপন চর্চার সঙ্গে কাটিয়ে এসেছি। সবসময়ই ভেবেছি, ফকির লালন শাহ এখন তিরোহিত, তিনি যখন জীবদেহে স্বয়ং হাজির নাই, তখন তাঁর ডাকনাম কেন্দ্র করে নানান ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হবে এবং হচ্ছেও বটে। তাঁকে বাউল বা ‘বাউল সম্রাট’ আখ্যা দিয়ে স্টেরিওটাইপ ব্যাখ্যা তো আছেই। প্রশ্ন হচ্ছে লালন কি এখন কেবলি সামাজিক, নৃতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়? তিনি কি কেবলি আমাদের পেছনের ইতিহাসের একটি সংবেদনশীল, কিন্তু গৌণ মুহূর্ত? এমন এক পর্যায় যা আমরা ফেলে এসেছি, আর ফিরে যাবার কোন প্রয়োজনীয়তা নাই। অথচ তিনি তো মোটেও পুরানা আমলের কেউ নন, আধুনিক কালের মানুষ। তিনি কি একালে আমাদের চিন্তা ও চিন্তার চর্চাকে প্রভাবিত করবেন না? কিম্বা করছেন না? বলাবাহুল্য, উত্তর হবে, হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু কিভাবে তিনি আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত ও সক্রিয় রাখছেন সে ব্যাপারে আমরা এখনও অস্পষ্ট। আমরা লালনের গান শুনি বটে, ফকির ফ্যাকড়াদের প্রতি আমরা যারপনাই উৎসুক আছি, সন্দেহ নাই। কিন্তু ফকির লালন শাহ চিন্তা বা ভাবচর্চার পরিমণ্ডলে কোথায় মৌলিক এবং একালে তাঁর চিন্তার উপযোগিতা কোথায় সেই বিষয়ে আমরা বিশেষ ভেবেছি বলে মনে হয় না। সেই দিক থেকে নদিয়ার ভাবের বিকাশ ঘটাতে চাইলে বাংলার ভাবান্দোলনের অভিমুখ নিয়ে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে, সেই অভিমুখ কোনদিকে ফেরালে তাঁকে ‘বর্তমান’ করে তোলার সম্ভাবনা তৈরী হয় বা হতে পারে। এখানে সে বিষয়েই কিছু কথা বলব।
লালনকে নানান দূষণ থেকে রক্ষা করে বিশুদ্ধ রাখার বাসনার প্রসঙ্গ টানছি এই অভিমুখ নির্ণয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করবার জন্য। কিন্তু বলে রাখা ভাল ‘বিশুদ্ধ লালন’ বলে কিছু নাই। এই ইলিউশান থেকে মুক্ত হতে হবে। লালন সাধকরাও ‘বিশুদ্ধ লালন’ নামক চোখে দেখা যায় না, তর্ক সাপেক্ষ খামাখা কোন কিছুর অনুমান করেন না। গুরু এখানে মুখ্য। ভাষা মানেই বহু প্রকার অর্থ ও দ্যোতনা তৈরি করে। লালনের গান ও তার ব্যাখ্যাও নানান তরিকা ও মত তৈরি করবে। কিন্তু গুরুবাক্যই বা গুরুর কথাই শেষ কথা। সে কারণে গুরুপরম্পরা কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর রয়েছে লালন সাধকসহ আরও বিভিন্ন ধারার সাধকদের ঐতিহ্যগত পরম্পরা। ঐতিহ্যগত পরম্পরা আর গুরুশিষ্য পরম্পরা এক নয়। লালনপন্থি বা লালন অনুসারীদের জন্য গুরুপরম্পরার ঐতিহ্যই সবকিছুর নির্ণায়ক, এই ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত পরম্পরা গুরু পরম্পরার অন্তর্গত। লালনের ডাকনামে কোনকিছু দাবি করলে সেটা কে কিভাবে দাবি করছেন তার কর্তৃত্ব নির্ণয়ের প্রকরণ রয়েছে। অভিমুখ নির্ণয় সেই আলোকে হলে তা মজবুত হবে। এসব মনে রেখে তাই যাঁরা অভিমুখ নির্ণয়ে আগ্রহী তাঁদের বিবেচনার জন্য কিছু কথা পেশ করছি।
বাজার এখন সর্বব্যাপী, পুঁজিই এই যুগে ধর্ম। ফলে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে ফকির লালন শাহের একটা বদল ঘটবে। ঘটছেও। কিন্তু সবকিছুকে পণ্যে রূপান্তরের প্রক্রিয়া তীব্র হবার কারণেই ফকির লালন শাহের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কথাটা পুরাপুরি সত্য নয়। বাজার ব্যবস্থা সর্বব্যাপী হয়ে ওঠার আগেও বদল ঘটছিল। যদি রাষ্ট্রের দিক থেকে দেখি তাহলে দেখব অনেক আগে থেকেই প্রথমে পাকিস্তান আমলে ১৯৬৩ সালে মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের প্রস্তাব অনুযায়ী ‘লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র’’ এবং পরে ১৯৭৬ সালে তার নাম বদল করে ‘লালন একাডেমি’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মতিজান-লালনের কবর ও স্মৃতিক্ষেত্র থেকে ফকিরদের উৎখাত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ।
গুরুবাদী ফকির লালন শাহ কবর পূজারি ছিলেন না। তাঁর শিষ্যদেরও তিনি গুরুভজনা করতে বলেছেন, মৃত গুরুর কবর পূজা করতে বলেন নি। কিন্তু যেখানে তিনি দেহ রেখেছেন সেটা এখন ‘মাজার’ হয়ে গিয়েছে। এখন দেখি আরবি লেখা গিলাফ দিয়ে মতিজান ও তাঁর সমাধিও মাঝেমধ্যে ঢাকা হয়। লালনের জীবদ্দশায় মলম শাহের বাড়িটিই ছিল তাঁর আখড়া। লালনের তিরোধানের পরে তাঁর শিষ্যদের মধ্যে চর্চার ধারার মধ্যেও স্বাভাবিক ছেদ পড়েছিল। তাঁর দুই শিষ্য মনিরুদ্দিন ও ভোলাই শাহের মধ্যে মতপার্থক্য ও আখড়ার মালিকানা নিয়া ঝগড়াবিবাদের ইতিহাস আমাদের জানা। ফকির লালন শাহের নামে তার শিষ্যরা যা টিকিয়ে রেখেছেন তাদের প্রত্যেকে ফকির লালন শাহকে যে যেমন বুঝেছেন তেমনি চর্চা করেছেন। তাঁরাও তাদের মত করেই বাংলার সাধনা বা ভাবচর্চার ধারায় অবদান রেখেছেন। অর্থাৎ লালনের শিষ্যদের মধ্য দিয়ে লালনের বিশুদ্ধ কোন ধারা বহাল থাকে নি। এই বিশুদ্ধতার অনুমানে ফকির লালন শাহ নিজেও সায় দিতেন না।
কেন দিতেন না তা বোঝবার জন্য লালনের একটি পরিচিত গান থেকে উদ্ধৃতি দেব। আখেরি নবী সম্পর্কে তাঁর নিজের একটা গান এই রকম:
নবির সঙ্গে ছিল ইয়ার চারজন
চারকে দিলেন নবি চারমত যাজন
নবি বিনে পথে গোল হোল চার মতে
ফকির লালন বলে যেন গোলে পড়িস নে।।
নবির চার সাহাবাকে নবী চার রকম যাজন বা শিক্ষা দিয়েছিলেন। নবির তি্রোধানের পর চারজন চার ভাবে নবিকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই গোলমালে পড়া যাবে না। এটা তো ফকির লালন শাহ সম্পর্কেও সত্য। তার তিরোধানের পর তাঁর শিষ্যরা যে যেমন বুঝেছেন তেমনি করেই লালনকে ব্যাখ্যা করবেন, তাঁর শিক্ষা ও নির্দেশাবলী চর্চা করবেন, এটাই স্বাভাবিক, এটাই হবার কথা। তেমনি করেই তারা চর্চা করেছেন। যতটুকু তাঁরা বুঝেছেন ততোটুকুই তাঁরা তাঁদের জীবনে ফকির লালন শাহকে ‘বর্তমান’ করে তুলেছেন। তাহলে ‘বিশুদ্ধ’ লালন সন্ধান করার মানে হচ্ছে যা নাই তাকে খুঁজে বেড়ানো।
ফকির লালন শাহের এখন যে খ্যাতি বা পরিচিতি সেটা তাঁর নিজের কিম্বা তাঁর শিষ্যদের জীবন ও ভাবচর্চার খ্যাতি নয়। লালনের খ্যাতির জন্য তাঁর গানের ভূমিকা মুখ্য। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও কথা আছে। লালনের গান এর আগে খোদা বক্স, মকসেদ আলীসহ আরো অনেকে গেয়েছেন। তাদের একটা পরিচিতিও রয়েছে। লালনকে জীইয়ে রাখার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু শহরের মধ্যবিত্তের মধ্যে তাঁরা বিশেষ কোন আবেদন তৈরী করতে পারে নি। এমনকি আবদুল আলিম যখন লালনের গান বেতারে গাইলেন এবং তুলনামূলক ভাবে অধিক জনপ্রিয় করলেন তখন সেই গানগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণী ‘পল্লীগীতি’ হিশাবেই শুনেছে। পল্লীগীতি হিশাবেই কিছু শ্রোতা আবদুল আলিম তৈরী করতে পেরেছিলেন। যেমন, ‘ও যার আপন খবর আপনার হয় না’, ‘কে কথা কয়রে দেখা দেয় না’, ‘চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি’, ‘এই দেশেতে এই সুখ হোল’ ইত্যাদি গান তার মারফত পল্লীগীতি হিশাবে জনপ্রিয় হয়েছিল।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ‘লালনগীতি’ নিজের পরিচিতি নিয়ে হাজির হওয়া শুরু করে স্বাধীনতার পর ফরিদা পারভিনের গলা ও গায়কী ধরে। কিন্তু এর কৃতিত্ব শুধু ফরিদা পারভিনের গলা আর গায়কীর নয়। এর আরো নানা কারন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহুরে মধ্যবিত্ত প্রাণে বাঁচবার জন্য হলেও গ্রামে পালাতে ও গ্রামের মানুষের কাছে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফলে গ্রামের সবকিছুই যে পশ্চাতপদ নয়, আর লালনের গানকে যে ঠিক ‘পল্লীগীতি’-র শ্রেণীতে ফেলা যাচ্ছে না, সে সম্পর্কে খানিক ধারণা তারা পেতে শুরু করে। স্বাধীনতা সংগ্রাম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বড় পরিসর সম্পর্কে জানবার আগ্রহও তৈরী করে। নিজেদের সম্পর্কে জানবার নতুন আগ্রহ। এই সময় টেপ ও ক্যাসেট রেকর্ডারও ভূমিকা রেখেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে লালন জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারন ব্যাখ্যা করতে এই সবকিছু বিবেচনায় রেখে তা নির্ণয় করতে হবে।
ফকির লালন শাহের বিশুদ্ধতা রক্ষার বাসনা শেষাবধি প্রতিক্রিয়ায় পর্যবসিত হয় কিম্বা পর্যবসিত হবার বিপদে পড়ে। এই বাসনা ত্যাগ করা দরকার। লালন যখন জীবিত ছিলেন তখনও তাঁকে কিম্বা তার চর্চা ও গানকে বিভিন্ন জাত ও শ্রেণী নিজের নিজের জায়গা থেকেই ব্যাখ্যা করেছে। লিঙ্গভেদে লালনের তাৎপর্যও ভিন্ন হয়েছে। তাহলে বিশুদ্ধ লালনকে খুঁজব কোথায়? অর্থাৎ জাত, শ্রেণী ও নারীপুরুষ ভেদের দিক থেকে বিভিন্ন লালন তো আছেই তার ওপর বাজার লালনের যে ভূত নির্মাণ করে সেটা যেমন আপত্তির, ঠিক একই ভাবে তার বিপরীতে লালনকে ‘বিশুদ্ধ’ ভাবে পাঠ ও হাজির করবার বাসনাও সমান মুশকিলের।
লালনকে বাজারের বিষয়ে পরিণত করার বিরোধিতা মাত্রই নেতিবাচক নয়। তবে ইতিবাচক বিরোধিতার বাসনা ভিন্ন। সেই বাসনা বিশুদ্ধ লালন সন্ধানের আকুতির মধ্যে নাই। বরং ইতিবাচক বিরোধিতার আকুতি বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতিরোধ ও রূপান্তরের বাসনার মধ্যে। এই বাসনার চরিত্র রাজনৈতিক হতে বাধ্য। সেই বাসনার দিক থেকে দেখলে বাংলার ভাবচর্চার দরকারি অভিমুখটা শনাক্ত করা সহজ হয়। এই পথেই লালনকে বর্তমান করে তুলবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এই অভিমুখটা স্পষ্ট হলে ফকির লালন শাহ জীবনযাপন ও ভাবচর্চার মধ্য দিয়ে যে-জগতটা তৈরী করবার সাধনা করেছেন তাকে চেনা, জানা ও বোঝার চেষ্টা অনেক বেশী ফলপ্রসূ হতে পারে। নইলে ফকির লালন শাহ এবং তার অনুসারী ও অনুরাগীরা বড়জোর নৃতাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় হয়ে উঠবেন; বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রান্তিক অনুষঙ্গ হিশাবে থাকবেন তারা। বাউল ফকির হিশাবে বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে তাদের অন্তর্গত করে নেবার জন্য লালনকে একটি মৃত ও পুরানা ঐতিহ্যে পর্যবসিত করা হবে। এর অধিক কিছু হবে না। যে সমাজে ‘ফকির’ একটি সামাজিক-দার্শনিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে টিকে ছিল, সেই সমাজের ভাঙনের ফলে তাকে পুরানা কায়দায় টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। বাংলার ভাবচর্চার ধারা তাতে শুকিয়ে যাবে সেটা ভাববার কোন কারন নাই। প্রশ্ন হচ্ছে একালে নদিয়ার ভাবের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? এটা পরিষ্কার বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতিরোধ ও রূপান্তরের বাসনা থেকে কাজ করা না হলে এখনকার লড়াই সংগ্রামে ফকির লালন শাহ প্রাসঙ্গিক হবেন না। বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতিরোধ ও রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক করে তোলাকেই আমরা তাঁকে ‘বর্তমান’ করে তোলা বলছি।
এই দিকগুলো মনে রাখলে লালনকে বিশুদ্ধ রাখার চিন্তার মুশকিল আমরা ধরতে পারব। আসলে ফকির লালন শাহ তাঁর গানের জন্য যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন সাধক ও ভাবুক হিশাবে প্রতিষ্ঠা পান নি বললেই চলে। এই অভাবের কথা মনে রেখেই প্রশ্ন তোলা যায় ফকির লালন শাহকে কেন্দ্র করে বাংলার ভাবান্দোলনের যে-চর্চা এখন জারি আছে, তার অভিমুখ কোনদিকে ফেরালে তাঁকে ‘বর্তমান’ করে তোলার সম্ভাবনা তৈরী হয় বা হতে পারে। সোজা কথায় সংক্ষেপে প্রশ্ন: লালনকে কিভাবে বুঝলে ও চর্চা করলে তিনি এই কালে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন?
[লেখাটি ২০১১ সালে ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস সামনে রেখে লেখা হয়েছিল। কিছুটা পরিমার্জনা করেছি ও কিছু নতুন কথা যোগ করেছি]
২৫ আশ্বিন, ১৪১৮/ ১০ অক্টোবর, ২০১১
শ্যামলী, ঢাকা