।। জহির হাসান।।
আব্বার কবর
পৃথিবীর যেই গ্রামে যাই
নীরবতা মোড়ানো আব্বার একখান গোর
জাগি উঠতে দেখি সহসাই
হাইনজাবেলার মুখবন্ধ আব্বার কবর!
সোনালু গাছের নীচে জঙ্গলের ঝিঁঝি পোকা
শিশির ঘাসেরা মিলিমিশি কাওয়ালি গায়
সবলরা এখনও মার চরম দিতেছে ধোঁকা
এ জগতে কোন বা ছুতায়, উনারে জানাই!
আমার বেদনা যদি ভাষা পায়
রক্তারক্তি কানায় কানায়
রোজ-কেয়ামত বাঝাই দিবেনে, ভয় নাই-
আব্বাজির কবরের নীরবতাগুলি আমারে থামায়!
অস্তিত্ব একটা ঝোপ তারে বুঝি কোপ দেয়া
বড়ই কঠিন বুঝলা জহির, কাটো তো এবে জাবর
সন্ধ্যাবেলায় কবর পাশ ফিরি শোয় আব্বার ভিতর!
দ্বিপদী
আকাশ ও মাঠ
আকাশ ও মাঠ বিশাল দুখান বই
চোখ বুজি খুঁজি পৃষ্ঠার নম্বর কই?
কবর
রঙের লীলারে শেষ টানতে সময় লাগছে ঢের
লাশ পাইলো যেই বিরহ কাটল তক্ষণি কবরের।
লাশ
লাশ হয়েছো তোমরা এখন খোয়াব দেখা বাদ
রাত সাজছে গভীর তমা হারাই তোমার চাঁদ।
বীজ
লাশটা আমরা রাখি গেলাম উঠবে জাগি এই ভরসায়
বীজটা পুতি রাখছি আশা চারাটা জাগবে আসছে বর্ষায়।
রুহু
ছামাটা আমার কোথায় গেল নদীর লগে ঘুরতে
লাশটা আছে অপেক্ষাতে রুহুর সাথে জুড়তে!
আল্লাহর রুটি
বুয়া রুটি ব্যালে
মাত্র দুইটা রুটি গোল হয় ভাগ্যগুণে
সেই দু-রুটি সে আমারে দেয় প্রতিদিন!
আমি একটা রুটি খাই। আরেকটা গোল রুটি
পোস্ট বক্সে প্রতিদিন ফেলাই দিতাম যদি কোনোদিন তিনি পান
যিনি কেন্দ্রের একমাত্র দাবিদার!
অথচ খিদায় কাতর মোড়ের কুকুরটারে কেন্দ্রসহ
ঐ গোল রুটিটা দিতাম যদি
অন্য আরেকটা অর্থ হইত!
গোলের ভিতর তো কম বসবাস করলা না জহির!
কোন অর্থটা তোমার জন্য নির্ধারিত যদি একটু জানতা!
না হয় সেইটারে অন্যগুলার সাথে ছাতুর মতো মিশাইতাম না
ঝাউতলে
তুমি আমার এত কাছে আসি পইড়ো না!
শেষে তোমারে জড়ায়ে ধরি!
তোমারে জড়ায়ে ধরলে
তুমি থাকবা না
তুমি জাহির হই যাবা
তুমি তখন তুমি ছাড়া
আমি একা হই যাবো!
মোর লগে আমার যে বসবাস তাতো পরবাস-ই!
চলো, ঝাউতলে বসি
তুমি আমার চোখের নিচে যতক্ষণ থাকবা
না হয় অশ্রু হই থাইকো!
তুমি কুয়াশার মতো দূরে যাও যদি
ঐ যে আমাদের নদীর কিনারদি
যে ঝাউগাছগুলি ঐ পর্যন্তই যাইও
ঐ পর্যন্তই পৃথিবীর সীমানা!
ঝাউঝাড় পার হয়া গেলে
তুমি আমার পৃথিবী পার হই যাও!
হারানোর আগে অন্তত
আমাদের একটা সীমা থাকা উচিত!
বৃষ্টি শেষে তমালডালে ঝোলা দু-বৃষ্টি ফোঁটার সংলাপ
যেন আমরা যেন হারাই যাওয়া সাথি
যেন আমরা যেন কাটাইসি সহস্র রাতি ॥
যেন একের ভিতর দুই রুইছি কবে
যেন জনম জনম আমরা অনুভবে ॥
যেন কদমরেণু গাঁথছি তুঁহু সনে
যেন হুহু কাঁদি চাইনি অন্য জনে ॥
যেন হোগলাবনে ডাহুক ডাকা ভোর
যেন কেন নাই কাটে যুগলঘোর ॥
যেন কেন আমরা হুহু মৌনভার
যেন আমারাতেই দামিনীর বিস্তার ॥
যেন কেন কাছে পাইয়েও হারাই রে
যেন অন্তর্গূঢ় বাষ্পরাশি সে ॥
যেন চিরবন্ধু পাতা একটা ফাঁদ
যেন মহাশূন্য আমাগের ছাদ ॥
যেন মেঘমন্দ্র আপনাহারা শ্লোক
যেন কাতর নিঃশ্বাস আমাগোরই হোক ॥
যেন চক্ষুকোণে জাহ্নবীর তীর
যেন অশ্রুবাষ্পভরা আঁখির ॥
যেন কেতকীর বেড়া জম্বুবনচ্ছায়া
যেন স্বপ্নে প্যাঁচদি বেড়াই ধরে তারা ॥
যেন মেঘরূপে ফিরি নাই দেশে দেশে
যেন আমরাই কামনার মেঘ অবশেষে ॥
যেন বিরহবিকার যেন কাতর-নিঃশ্বাস
যেন প্রবাসী শুধুই নিজমনেতে প্রবাস ॥
যেন আমরা বসি আছি অকূল উদ্দেশে
যেন বৃষ্টি হইলে ঝুলি বৃষ্টিফোঁটা বেশে ॥
আলাপ চলুক জনম জনম দু-বৃষ্টি ফোঁটার
রচিয়া অসীম তমাল ডালেই বিরহ অপার ॥
প্রচ্ছদের ছবি: জহির হাসান
জহির হাসান
জন্ম: ১৯৬৯, যশোর জেলায় মাতুলালয়ে।
প্রকাশিত কবিতার বই: পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে (২০০৩), গোস্তের দোকানে (২০০৭), ওশে ভেজা পেঁচা (২০১০), পাতাবাহারের বৃষ্টিদিন (২০১২), খড়কুটো পাশে (২০১৪), আয়না বিষয়ে মুখবন্ধ (২০১৬) ও আম্মার হাঁসগুলি(২০১৭), বকুলগাছের নিচে তুমি হাসছিলি(2018), আমমার আরও হাঁস(2019)।
অনুবাদ : এমে সেজেরের সাক্ষাৎকার ও আধিপত্যবাদ বিরোধী রচনাসংগ্রহ (২০১১) । সাক্ষাৎকার পুস্তিকা (কবি উৎপলকুমার বসুর সাক্ষাৎকার) : কথাবার্তা (সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৬)