।। জেসমিন নাহার ।।
লকডাউন
খানকির পুত পুলিশগো হাতে টিয়া নাই, ওদের বউ ছেলেমেয়ে গো খাওয়ানির টিয়া নাই, হের লাইজ্ঞা অরা আমাগো মতন গরিবগো পুটকি মারতো আহে, রেড দিতো আইছে, এহন দৌড়ানি দিবো, রাস্তাত এ মাথা থাইকা ও মাথাত, শান্তি নাই, কুনোহানে হুইয়া শান্তি নাই, বইসা শান্তি নাই। তার ভিতরে দেশত আইছে মহামারি, ক্যানসার অয়, ডায়াবেটিস অয়, টিউমার অয়। কাগো অয়? বড়োলুকের বউগো অয়, আর গরিবগো অয় পচ্চিমে, মাথা ব্যতনা, বিষ করলে কয় থাউক, পচ্চিমে অয়ছে যাইবো গা। করোনা আনছে বড়োলুকেরা, করোনা মোগো অয় না। করোনা অয় বড়োলুকের, হেরা খায়, হাগে, মোতে আর খালি হুইয়া থাকে ফাঁক কইরা। তাগো জইন্যে মোগো জ্বালা। ভোগান্তির শ্যাষ নাইক্কা।
কথাগুলো বলে যাচ্ছে গ্রীনরোডের ফুটপাতে বসবাসকারী লুৎফা। বলছে খোলা আসমানকে উদ্দেশ্য করে। আক্ষেপ নাকি বিদ্বেষ বোঝা যাচ্ছে না। তবে চিৎকার করছে। কেউ একজন চিৎকার করে কিছু বলছে তা ফুটপাতের আশেপাশের সকলে শুনছে, কিন্ত তাতে আদৌ কেউ মনোযোগী কিনা বোঝা যাচ্ছে না। অথচ তার চিৎকারের মধ্যে করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বকথা ছিল, করোনা বড়লোকেরা এনেছে! ভাগ্যিস সেটা বিল গেইটসের কানে যায় নাই।
ফুটপাতে লুৎফারা বসবাস করেছে এর আগের পুরা লকডাউন জুড়ে। ফুটপাত তাদের নয়, সকলের স্বার্থে রাস্তা শেয়ার করতে হয়। লুৎফাকেও বসবাস করতে হয়েছে তাদের সাথে যারা সেই সময় তারই মতো লকডাউনের কারণে বস্তি থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এমনই বিতাড়ন যাতে বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণ করা যায় করোনাভাইরাস বস্তির হতচ্ছাড়া দীনহীন গরিবদের দ্বারাই সৃষ্ট হয়েছে। অতএব তাদের বস্তি থেকে বের হয়ে যেতেই হবে, কারণ করোনার দায় শুধু ফুটপাতের ঘরহারা বস্তি থেকে বিতাড়িত হওয়া লোকগুলার। পুলিশ রেইড দেয় দিনে তিনবার গ্রীনরোডে। তিনবারই তারা তাদের সামান্য জিনিস ফেলে একটা নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ চলে গেলে আবার ফিরে আসে। এই লুকোচুরি বৃন্দাবনে কৃষ্ণলীলার মতো। কারণ কখনো কখনো পুলিশের সাথে খাতির-পিরিতিও পাতায় তারা। তখন একসাথে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চা খায়।
লুৎফার রাগ পুলিশের উপরে না, পুলিশের বউ ছেলেমেয়েদের উপরে। এই ক্ষেত্রেও গুরুতর তত্ত্বকথা আছে। লুৎফা নিশ্চিত বউ ছেলেমেয়েদের জন্যই পুলিশ তাদের উপরে অত্যাচার করে। তাদের কষ্টের টাকা পুলিশ কখনো কখনো হাতিয়ে নেয়। কেন? বউ ছেলে মেয়েদের জন্যই। পুলিশের উপরে সরকারি দায়িত্ব আরোপিত থাকে, তারা বড়লোকের বল প্রয়োগের হাতিয়ার। এই কথা ইউনিভার্সিটির চ্যাংড়া পোলাপান তাদের বলে নাই যে তা না। বলেছে। কিন্তু তারা পুলিশের খাসলতের কারণে সেই সকল কঠিন কথা ভুলে যায়। কারন জীবন আরও জটিল এবং ফুটপাতের জীবন আরও উচ্চতর বিশ্ববিদ্যালয়।
পুলিশ দেখে ফুটপাতের গা ঘেঁষে বসা দোকান গুলো বন্ধ হয়ে যায় তড়িঘড়ি করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে। চারিদিকে রাস্তা দিয়ে চলমান গাড়ির হর্ণ, মানুষের কথাবার্তা ছাড়া ফুটপাত জুড়ে যে সকল লুৎফাদের বসবাস তাদের আর চিহ্ন পাওয়া যায় না। কোথায় উধাও। আধাঘন্টা পুলিশ আলিমের ফুচকা দোকানের পাশে গাড়ি থামিয়ে টহলের নামে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা সিগারেট এবং চা খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আয়েশে চলে যায়। লুৎফারা খবর পায়। কারণ শহরের বাতাসে টিকটিকি থাকে। তারা কখন কিভাবে লেজ নাড়ে লুৎফারা বুঝতে পারে। তারা আবার ধীরে ধীরে একে একে ফিরে আসে। নিজেদের জায়গায় বসে। অজানা উদ্দেশ্যে এলোপাথাড়ি বকে যায়, আবার যথারীতি নিজেদের কথার রেশ ফিরে পায়।
আধাঘন্টা কেটে যাবার পরও নিজ স্থানে বসে লুৎফার পুরানা কথার রেশ ধরে মরিয়ম বলে, মাঙ্গে কয় মাঙ্গের কথা, সোনাডা বোঝ তুমি আমার, মইজ্জারে আমি কই যে তুমি চুরি করে এনে খাওয়াও। হেইডা পুলিশ গো খাসলত।
লুৎফা আনমনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না। যেন সে তার কথায় অনড়। মরিয়ম হঠাৎ বলে ওঠে, চল লুৎফা একটু পানি আইনা থুই। মইজ্জা নাই, কাজো গ্যাছে। ময়মনসিংহ, আইতে রাত অয়বো। পানিডা আইজ আমি আইনা রাহি।
লুৎফা বলে, চ্যাত উঠে জাগা। আমি অহন যামু বাসাবাড়িত রাতের রান্না করতাম। হে কয় চল যাই যমুনাত। হেরা মোর মামু লাগে। দেরি করলে অইবো?
মরিয়ম বলে ওঠে, আমি সাতটাও যাই, আটটাও যাই, আমি ওরম আচোদা বাসায় কাম কাজ করি না যে এক্কেরে ঘড়ি ধইরা যাওন লাগবো। এরম আচোদা বাসার কাজের পুটকি আমি মারি না। কয়দিন বিশেষ প্রয়োজন আছিল, হেইডা হইলো আলাদা কতা।
মরিয়ম যে বাসা দুটোয় কাজ করে তারা তাকে চাপ প্রয়োগ করে না। সে নিজের মতো যায় আসে। তাদের দেওয়া কাজ গুলো দুপুরের আগে, রাতে ঘুমানোর আগে করে দিলেই হয়। সে তাই লুৎফার কাজের দায়িত্ব বোঝে না। লুৎফাকে নানান কথা মরিয়ম বলতেই থাকে, থামে না।
লুৎফা তাই বলে, অতা কতা কইস না মনডা ভালা না। দু বেলা কাম করি দিনো একশো বিশ টিয়া কইরা ধাইজ্জ। সামনে রুমজান, এহন জিনিসের দাম চড়া। কত্তব্যের সাথ কাম করলে ঈদো তারাদের বুনাস দিতো বাদবো না। লকডাউনে বেশ টিয়া ধার নিসি, দেওন লাগবো। কাম কইরা দশ হাজার টিয়া পাই আর বুনাস যদি হগলে দেয় পামু দশ,হেই দশ দিয়া কজ্জ মিটামু আর ছেলেমেয়ের নতুন জামা কিনমু।
ঈদের এখনো দেড়মাস বাকি লুৎফা ঈদের বোনাস নিয়ে ভাবছে। যতোটুকু কাজ তার চেয়েও একটু বেশি কাজ সে করে দিচ্ছে। সময়ের আগে গিয়ে হাজির হচ্ছে। বলে, জামাই থাইকাও নাই বাঁচছি, পুলাপানের লগে আমি ভালা আছি। জুতা ছিইড়া গ্যাছে এই দুখের কথা আমি কার লগে কমু!
আক্ষেপের ভাষা নাকি আহাজারির নাকি আশঙ্কার বোঝা মুশকিল। কিন্তু কোথাও নারীর সঙ্গে নারীর একটা নীরব বোঝাপড়া আছে। মরিয়ম চুপ করে শোনে।
লুৎফা তার স্বামীকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। তার কথাবার্তায় স্বামী থাকা ভালো নাকি মন্দ বোঝা যায় না। স্বামী না থাকায় যন্ত্রণাবোধ করে আবার না থাকাকে গুরুত্বপূর্ণও ভাবে না। বলে মরিয়ম, হ তর একটু বেশি বেশি সবতাত। হেই বেডার বাড়িত তুই যাস আবার থাকতো দিস না ঘরত। তয় রহিমে নাই, মইজ্জা নাই, আমার জাগাডাও ঠাণ্ডা আছে, আমার মুখডাও পবিত্র আছে, সোয়ামী থাইকলেও জ্বলন, না থাকলেও জ্বলন, কাছত হুইলেও জ্বলন না হুইলেও জ্বলন।
মরিয়মের কথা শেষ হলে লুৎফা দড়াম করে উঠে দাঁড়ায়, বলে, হ জ্বলন। চ্যাত উঠাস না, ল চাইন যাই তর পানি আনতো।
ফুটপাত পেরিয়ে আলিমের ফুচকার দোকান ছাড়িয়ে তারা সরকারি কোয়ার্টারের গলি দিয়ে হাতে দুটো পট নিয়ে হাঁটতে থাকে। গলিতে নামার আগে আলিম তাদের দিকে চিৎকার দিয়ে বলে, ‘খাইবাইন ফুচকা?’ দুজনের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। হঠাৎ তাদের উচ্চস্বরের কথাবার্তা ফিসফিসানিতে নেমে আসে। ফিসফিস করে বলে, মাইরালাইছে হেরে মাইরালাইছে। নয়তো মাতা ফাটবো না? শুধু হাতে আঁচড় লাগবো। পইড়াই মইরা যাইবো। উহু আহা করবো না।
এটা শহরের বড়লোকদের গল্প। উচ্চস্বরে বলা নিষিদ্ধ। জানলে বা বুঝলেও ফিসফিসের ঘরে জমা রাখতে হবে। যখন নিজেদের মধ্যে কথা ফুরায় তখন বড় লোকদের গল্পের আড়ত থেকে দুই একখানা কেচ্ছা তারা নিজেদের মধ্যে বলে। কিছুদিন আগে বিশাল এপার্টমেন্টের ওপর থেকে এক মেয়ের শরীর ফুটপাতে এসে পড়েছিল। মৃত না জ্যান্ত তারা জানে না। অনুচ্চ স্বরে এখন তা নিয়ে গবেষণা চলছে। কারন ফুটপাতের সেই জায়গাটা এখন তারা পার হতে যাচ্ছে। লুৎফাদের কথার মাঝে সাবিকুন্নাহার চলে আসে। সে মাত্র কাজ থেকে গলির পথেই ফিরছে। সে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল তার মেয়ের অসুস্থতার খবর শুনে। মেয়েকে সুস্থ করে পুনরায় কাজে ফিরেছে। পথে দুজনের ফিসফাস শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে, খারা লুৎফা। তরা সাত তলা বিল্ডিংয়োর ছাদের দিকে চাইয়া কি ফিসিরফিসির করস? কথা একটু চাবিয়ে তেমনি ফিসিয়ে ফিসিয়ে লুৎফা বলে, হুনা লাইগবো না।
সাবিকুন্না্র তাদের আরো নিকটে আসে। বলে, মাঙ্গের ঝিরা বাড়িত গ্যাছলাম দেইখ্যা কথা গোপন করস? গোপন করতাম কেলাই, খাড়াও মুইতা আহি, আইসা কমু যে।
মরিয়ম সাবিকুন্নাহারকে থামায়। আসলেই ওকে না বলার কি আছ? কিন্তু এখন তার মুতের বেগ পেয়েছে। সাবিকুনকে দাঁড়াতেই হবে। উপায় নাই। মরিয়ম প্রস্রাব করতে যায়। সাবিকুন্নাহার লুৎফাকে জিজ্ঞাসা করে, সেন্টারত আইজকা বিয়া কার? কার বিয়া ক্যামনে জানমু? ’জবাব দেয় লুৎফা। তারপরেই বলে, অইছে তাত্তাড়ি আহো, মশায় পুটকি মারবো। সাবিকুন্নাহার হো হো করে হাসে আর বলে, কামড়াইবো না, হে মুততে বয়া থাইক্কাই হাত পাও লাড়ে। মশা কামড়াইবো ক্যামনে? মুত্তে গিয়ে হাত পা নাড়ে বলে মশা মরিয়মের পুটকি মারতে পারবে না এই বিমল আনন্দে আসলেই তারা খ্যাক খ্যাক করে হাসে।
সরকারি কোয়ার্টারের ভেতরের কমিউনিটি সেন্টারের আলো এসে পড়েছে কোয়ার্টার সংলগ্ন সরু রাস্তায়। মহাসমারোহে পূর্ণ বিবাহ অনুষ্ঠানের অতিথিরা সংকীর্ণ রাস্তার দিকে তাকালেই দেখতে পাবে একজন মহিলা হাতে ছোট একটা বোতলের অর্ধেক বোতল পানি নিয়ে প্রস্রাব করতে বসেছে। মরিয়ম যে ড্রেনে প্রস্রাব করতে বসেছে সে ড্রেন দিয়ে বৃষ্টির পানি যায়। কিন্তু মরিয়ম এরকম কোন বিড়ম্বনায় পড়ে না। বিড়ম্বনায় পড়বে না যে সে জানে। দৃঢ়ভাবেই জানে। এরকম আনন্দঘন বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে কেউ পানিতে মল ভেসে যাওয়া ড্রেনের দিকে তাকায় না। বরং সেই তার চোখ দিয়ে ড্রেনের ধারে বসে লাল নীল বেগুনি আলোয় সজ্জিত কমিউনিটি সেন্টার দেখে। সে ড্রেনের ধার থেকে উঠার আগেই লুৎফা এবং সাবিকুন্নাহার তার পেছনে সোজা এসে দাঁড়ায়। দেখা যায় মরিয়মকে। মরিয়মও তাদের চেয়ে দেখে। কারো মুখে লজ্জার চিহ্ন নাই। এটা ওদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। মরিয়ম উঠে আসে। আরেকবার ড্রেনের দিকে তাকায়। সে যেখানে বসেছিল তার থেকে দূরে একটা ছোট বোতল দেখতে পায়। সে দৌড়ে গিয়ে সেটা তুলে আনে। রাস্তায় থাকে বলে, জীবন ওদের যেভাবে নিয়ে যায় সেইদিকে নিয়ে যেতে তারা রাজি থাকে। এক কেজি বোতল বেচে বিশ টাকা পায়। খালি বোতল এককেজি হতে অনেক বোতল লাগে তবুও যোগাড় করা চাই। লুৎফা এবং সাবিকুন্নাহারের পাশে এলে মরিয়ম বলতে শুরু করে, ‘রেশমার মা সেন্টারথন পোলাও আনছে, অরেও কইছে পোলাও আনতে। আমরা সেন্টারথন পোলাও আনছি চাইয়া। তারপর লুৎফা আইছে বাসাথন। কয় তোরা এডি কই থাইকা আনছোস? পরে গ্যাছে আনতে। লুৎফা যাইতাছিল। যেই এহানে আইছে হাঁটতো হাঁটতো অর সামনে ঢিপ কইরা পড়ছে হে চিল্লায়, অ মাইগো কি পড়লো কি পড়লো! পরে ছেড়ির মা বইন বাইর হইছে’।
দালান থেকে ঢিপ করে পড়েছে লুৎফার সামনে। লুৎফার ঘটনার বর্ণনা চলতে থাকে।
নূরজাহানের বোন, নুরজাহান গ্যাছে, হগলে পাঁজাকোলা করে গ্রীনলাইফ মেডিকেল কলেজো লইয়া গ্যাছে, কিচ্ছু অইছে না, রক্ত বের অইছে না। হাতের এইহানে খালি চোট পাইছে কিন্তু মইরা গ্যাছে। সাবিকুন্নাহার হায় হায় করে ওঠে, বলে গা মাথো কিচ্ছু ফাডে নাই? মরিয়ম বলে হের লেগাইতো কইতাছি মাইয়াডারে মাইরালাইছে। নয়তো মাতা ফাডতো বেলাড বের হইতো না! এই ঘটনার তদন্তের ভার মরিয়মকে দিলে সে খুব খারাপ করতো না। কিন্তু দালানের অধিবাসীদের নিয়ে ফুটপাত গল্প বলায় ছেদ পড়ল। হঠাৎ পরিবেশ বদলে গেল
মরিয়ম গালি দিয়ে ওঠে। বলে, মাঙ্গের ঝি দুধ বাইর কইরা ছেঁড়া প্যান্ট স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়া রাস্তাত হাঁটতো। হুনছি বাড়িওয়ালার ছেলে ডেস্টার্ব করতো। পুলিশ আইছিল,সাম্বাদিক আইছিল, আইলে পরে তাগোরে মাইয়ার ফুফুই কইছে এগুলা’]। মরিয়মের কি দুধ বাইর করা স্যান্ডো গেঞ্জির পরা মেয়েটির ওপর রাগ, নাকি মেয়ের ফুফুর ওপর গোস্বা , পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
সাবিকুন্নাহার বলে, তয় বুঝি হেয় পুলায় মাইরালাইছে মাইয়াডারে।
মরিয়ম তার মুখ চেপে ধরে বলে, চুপ যা মাগি, বড়োলুকগো কারবার। হুনলে রাস্তাথন বাইর কইরা দিবো। রাস্তার আবার মায়া কিয়ের?
লুৎফা অবশ্য সত্যবাদী হতে চায়। হাছা কথার লাগি বাইর কইরা দিলে ভিন রাস্তাত থাকবাম’, জবাব দেয় লুৎফা। কিন্তু বোঝা যায় ঘটনাটি তাদের কাছে পুরাপুরি এখনও কেচ্ছা হয়ে যায় নাই। কারন এই গল্প তারা বারবারই নানান ভাবে নানান জায়গায় কিছুদিন ধরেই বলে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না তারা কাকে দুষবে। মেয়েটিকে, নাকি তার ফুফুকে? ফুফু মেয়ে বটে, কিন্তু সমাজের বাপের শাসন দণ্ডের প্রতিনিধি। মেয়েরা ছেঁড়া প্যান্ট পরে স্যান্ডো গেঞ্জি পরে দুধ দেখাবে কি দেখাবে না ফুফু তার বিধানদাতা। কার পক্ষ নেবে তারা? দুই পক্ষেই মেয়ে।
কিন্তু তিনজনেই চুপ হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে কমিউনিটি সেন্টারের গেটে দাঁড়ায়। কমিউনিটি সেন্টারের দ্বাররক্ষী তাদের ঢুকতে দেয় না। কিন্তু তারা দুঃখিত হয় না। দারোয়ানের সাথে তাদের অন্যরকম সখ্যতা৷ শুধু নানান রঙের বাতির আলোয় আলোকিত বিবাহ অনুষ্ঠানের দিকে চেয়ে তারা ফিরে আসে। গ্রীনরোড এসে লুৎফা বলে, ‘যাইগা আমি। দেরি অইলে বকবো। হেরা আইজকা বাজার কইরা আনবো। কুটতে অইবো’। ‘ জাগা তুই তর পুটকি মারা কাজে জাগা’, জবাব দেয় মরিয়ম। কোমর থেকে পলিথিনে জড়ানো পান বের করে গালে দিয়ে চাবাতে চাবাতে হন হন করে হেঁটে লুৎফা লেকসার্কাস প্রথম লেন কলাবাগানের দিকে চলে যায়।
ঘটনা যেমন আকস্মিক, সাবিকুন্নাহারের কাছে তা তেমনই বিস্ময়কর। মরিয়ম গল্প বলতে থাকে, বলা তখনও থামে না। বলে, সব এই করোনার দুষ। মাইয়াডা মরবো দেইখ্যা করোনায় তার বাপে ব্রাঞ্চ (ফ্রান্স) থাইকা আইছে। কুটিপতি মাইয়াডার বাপে। এদেশে দু তিনটা ফেলাট, নিজেগো বাড়ি। ফেরনের সুমায় সব ভাড়া দিয়া দেইখা কারোরে চইলা যাইতে বলতো পারছে না। হের কপাল খারাপ, হে সেই লকডাউন থাইকা গ্রীনরোডের ওই বাসাত ফেলাট ভাড়া লইয়া থাকতাছে। বাড়িওয়ালার ছেলের লগে মনো হয় পেরেম হইছিল, মনো অয় মধু খাইয়া মোম ফালাইয়্যা গেছিল। হেই মোমো আগুন ধরছে আর নেভে নাই। হ্যাগো লগে কাইজ্জা কইরা মাইরালাইছে। ন, তুই ক সাদেকের মা হে কোন সাত তালাথন পড়ছে হেরতো পাচিলের উপ্রে পড়ার কথা আছিল। হে পড়ছে যে জায়গাত খারায় আছিলাম অনো। লুৎফার সামনো। তয় কই মনডা অইলো কাঁচের টুকরা, ফালাইয়া দিবি ভাইঙ্গা যাইবো।
তাদের গল্পও বাড়ে সন্ধ্যা কেটে গিয়ে রাতও বাড়ে। তারা যেখানে বসে গল্প করে সেখানে ফুটপাত আর কোয়ার্টারের দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে আছে রেশমা। তার মেয়ে ডালিয়া মাথার পাশে বসে কাঁদে। কান্নার কারণ সে আলিমের দোকানের চটপটি খেতে চায়। কিন্তু তার মা ভুট হয়ে ঘুমায়। সাবিকুন্নাহার, যাকে সকলে সাদেকের মা ডাকে, সাদেকের মা আর মরিয়ম দুজনে রেশমার পায়ের দিকে ভাঙা ইঁটে বসে গল্প করতে থাকে। জীর্ণ মলিন ধুলার স্তর পড়া একটা পলিথিন ঝুলানো। তার মধ্যে থেকে একটা চমচম বের করে খেতে দেয় মরিয়ম সাদেকের মাকে।
খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র বলে ওঠে, সাদেকের মা জাইগা বাসাত, বাজার কইরা দিয়া আসছি। যাইয়া রানমু। তাগো বাসায় লয়া গেছলাম পাতিল। হেরা নাই বাসাত। হেরা য্যান কই গ্যাছে। ঐ গলির মইদ্দ্যে ওই যে কোনায় পাতিল, যাইগা মরিয়ম।
সাবিকুন্নাহার চলে গেলে মরিয়ম তার সতীনের কাছে যায়। তার সতীন পান বিড়ি সিগারেট বিক্রয় করে সেন্ট্রাল হাসপাতালের সামনে বসে। বিলকিস বানু। সেখানে গিয়ে পাশে বসে মরিয়ম পাঁচ টাকা দিয়ে একটা পান কেনে। পান বটে গালে দিয়ে যেই কথা বলতে যাবে সতীন বলে ওঠে আমি এইহানে আসছি বেচাকেনা করতে। গল্প করতো আহি নাই। ওইহানে মইজ্জার দল ফ্রি আছে। ওইহানে বইসা গল্প করলেই হয়।
মরিয়ম অপমান বোধ করে। সে ভেবেছিল বর নাই সতীন ভালো ব্যবহার করবে। কিন্তু সতীন পাত্তা দিলো না। সে উঠবে এই সময় সতীনের ছোট ছেলে ল্যাংড়া আসে হাতে দুটো হালিমের বাটি নিয়ে। মরিয়মের বুঝতে বাকি থাকে না এই হালিমের জন্যই তাকে তাড়ানোর চেষ্টা। সে রাগে কারেন্টের খুটিতে লাথি দিয়ে বলে হেইলাজ্ঞাই এরম আচরণ। মইজ্জা আহুক, কইয়াম। টিয়া পয়সা কুনহানে যায়। বিলকিস বানু বলে, একটা নাতি মারমু। এনো মশার লাগি বসা যায় না। তরে কইছি কয়েল আনতো তুই আনছোস হালিম। তাই দেইখা মইজ্জার জন্য মাগির উডছে রাগ। কাইল্লা রাতো ঘুমাইতারছি না। বইসা কাজ করন কষ্ট, হে আইছে গল্প করতো!
ঘুমাস না ক্যা? হেইডা মোর দুষ? ছেলে জবাব দেয়। আমি অসুস্থা মানুষ রাইতে কাওরান বাজার টহল মারি কিছু চুরি করন যায় কিনা, আর তুই ঘুমাস না।
মরিয়মকে উদ্দেশ্য করে ল্যাংড়া বলে, খাইবা তুমি হালিম। খাইলে কও আনি। চুরির পয়সা।
মরিয়ম শান্ত হয়। সে বুঝতে পারে তার সতীন ছেলে মিথ্যা বলছে না। কারণ, লুৎফার ভাই সেদিন তাকে বলেছে, মরিয়ম হুন আমার ভাইয়ে আমার মারে সকালে কইতাছে, মা ঐ যে মামার ছেলেডা না, ও কাওরান বাজার রাইতো হাঁটে।
সে চুপ করে আবার বসে পড়ে। তার সতীন তাকে বলে, আজাইরা প্যাঁচাল পাড়বি আর মানসের কাছে খালি চোদন খাবি। দেশেরতোন আইছি, ঘুম হইছে না, আমি অসুস্থ হয়া গেছি না, ঘাড়ে ব্যথা আছিল ডাক্তার দেহাইছি না।
ঠিক এই সময় সিগারেটের কাস্টমার আসে। কাস্টমার তাদের গল্প করতে দেখে অন্য দোকানের দিকে পা বাড়ায়। তাড়াতাড়ি মরিয়ম বলে ওঠে, এনো কী অইছে? এনতো লন না ক্যান?
লোকটা ফিরে আসে। তাদের কাছ থেকে সিগারেট কেনে। লোকটা সিগারেট কিনে চলে গেলে বিলকিস বানু বলে, এদিকে মইজ্জা নাই আমার ঔষধ আনান লাগবো। তারা দুই সতীন এক বাটি হালিম ভাগ করে খায়। আর ছেলে একবাটি। খেতে খেতে পাছা উঁচু করে মরিয়ম বায়বাতাস করে। ল্যাংড়া উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। হাসির দমকে তার গাল থেকে হালিম পড়ে যায় গালসি বেয়ে। বিলকিস বানু চারপাশে চেয়ে বলে, পাদ দিসে! এডি এমনি এমনি চুদায়। খানকি মাগি পা উঁচা করে পাদ দিসে।
ওদের সমাজ এরকমই। সমাজ এবং লজ্জা বলে কি কিছু আছে? যাকে মানুষ ভদ্র সমাজ বলে সেখানেও কি লজ্জা আছে? মরিয়মও হাসে, ল্যাংড়ার ন্যায়। হাসতে হাসতে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং হেঁটে হেঁটে ফুটপাতে নিজের বাসস্থানে এসে পৌঁছে।
নিজের বাসস্থানে ফিরে দেখে নুরজাহান গল্প করছে রাইসুলের সাথে। সে ‘নুরজি কেমন আছোস’ জিজ্ঞাসা করেই পুরানা ভাঙা এক ড্রাম থেকে পলিথিনে মোড়া চাল বের করে। চুলা ঠিক করে ধরায় কাঠের আগুনে চাল ধুয়ে বসায়৷ তরকারি কুটতে থাকে। নুরজাহান তার পাশে এসে বসে। আগুনের আঁচে গরম লাগায় উঠে পড়ে রেশমা। উঠা মাত্র মেয়ের পিঠে একটা চড় দেয়। খানকির ঝি এক্কেরে রাস্তাত ঘুমাইছে। মানসে পারা দিয়া যাইবো, বলে উঠে যায়। যেতে যেতে বলে রাস্তাত দিয়া মানুষ যাইবো, রাস্তা মোগো বাপের না— এ কথা বলেই লুৎফার বড়ো ছেলে রনিকে বলে, ও বেডা একটা পান খাওয়া চাইন।
রনি জবাব দেয়, হুদাত্তে, আমার কাছে বিশ টিয়া ভাঙতি আছে। দুইদিন ধরে বলে আয়ে না, যাইগা আমি।
রনি যাকে পছন্দ করে সে থাকে রায়েরবাজার বস্তিতে। রেশমা তাকে কথা দিয়েছে দুইদিন ধরে যে রতি আসবে কিন্তু আসে না কিন্তু ঘটক সেজে রেশমা এদিকে ঘুষ খেয়েই যাচ্ছে। আজ ঘুষের দরুন ক্ষোভ খায়, খেয়ে সোজা চলে যায়। ওদের প্রেম, প্রেমের আবেগ অন্যান্যদের মতো। কবি সাহিত্যিকরা যেমন লিখেছে তেমনই। ভালোবাসায় ভালোলাগায় মন উদাস করে দেয়। অপেক্ষায় ক্ষোভ বাড়ে, দেখে মন গলে যায়। রেশমা দূরে গেলে নুরজাহান বলে মরিয়মকেm রেশমার শইল্লো উডছে পরে এরম গন্ধ।
উঁহু! মরিয়ম জবাব দেয় দুইদিন অয় এল্লা গরমে গোসুল করে না। গদমি হে একটা।
— তারা নিজেদের সুখ দুখের গল্প করতে করতে রান্না করে। রেশমা তার গন্ধভরা শরীর নিয়ে চা পান বিক্রি করতে চলে যায়। রাইসুল ভ্যানে বসে ভিডিও দেখে হাসে। তাকে দেখে ফুটপাতে বসা ছেলেমেয়ে আর আবুল ফকির জড়ো হয় তার কাছে। তারা রেশমার বিবাহবার্ষিকী পালনের ছবি দেখে। আবুল ফকির তাই দেখে হতাশ হয়। বলে আমাকে দাওয়াত দিইনি ক্যান রাইসুল। এ রাইসুল এ পালন করলে কবে? রাইসুল সুনির্দিষ্ট তারিখ বলতে পারে না। উলটা পালটা তারিখ বলে।
রেশমা এবং তার বর বে-মানান। রেশমা মোটা আর তার বর চিকন। দুজনে ছবিতে বেশ বে-মানান লাগছে। ভিডিও তে দেখা যাচ্ছে বেশ বড়ো কেক। কেকের সামনে আট দশজন মানুষ দাঁড়ানো। খানিকটা ক্ষোভের সহিত আবুল ফকির বলে ফেলে গ্রীনরোড কলাবাগান পান্থপথের যতো চুর ছ্যাচড়া ছিনতাইকারী বাটপার আছে সব ঐ খানে রেশমা জড়ো করছে। রাইসুল তাকে ধমক দেয়, তবু আবুল বলে হ, এইছার লগে তেইছা, শুটকির লগে বেগুন। তারপর চারপাশ হালকা করতে বলে কখনো চুরি হইছে না কিচ্ছু আবুল। এই দ্যাখ এইহানে মোবাইল লুকায় রাহি, কিচ্ছু ন অয়।
তাদের সাথে চোর বাটপারদের খাতির আছে। তাদেরই বন্ধু ভাই তারা। সকলে রাতে মিশে যায়। কারো রূপ ধরা যায় না। বুয়া, ভ্যানচালক, ফুচকাওয়ালা, চা পান বিড়ি ওয়ালা, চোর, ছিনতাইকারী সকলে এক হয়ে একই ফুটপাতে ঘুমায়। গায়ের বর্ণ এক তাদের। ধরা মুশকিল জানান না দিলে। ভিডিও দেখা শেষ হলে রাইসুল ভ্যান ঠিক করে। তার রাখা ঠিক হয় না দেখে আবুল বলে ভ্যান যেগুলা আছে গলির ভিতরে ঢুকাইয়া দিবি, এইডা করবি যহনই পুলিশ রেড দিবো, ভ্যান জমা নিবি কুন সময় জানস? রাত নয়টার পরে। রাইসুল তার কথা শোনে কিনা বুঝা যায় না সে এক ভ্যানের তালা অন্য ভ্যানের সাথে লাগিয়ে তালা নিয়ে হাঁটা দেয়। আবুল চিৎকার করে— তুই তালা লয়া যাস কই, এই গাড়ির তালা ওই গাড়ির সাথে লাগায়ে! ক্রুদ্ধ হয় আবুল গালি দিয়ে বলে, এই বাঞ্চোত!
আবুলের রাগ কমে গেলে রাইসুলের রাখা ভ্যানে সে বসে, টাকা গোনে, আলিম ফুচকা বেঁচে, মরিয়ম রান্না করে, নুরজাহান গল্প করে। ডালিয়া ফুটপাতের নোংরা বিছানায় নিশ্চিন্তে ঘুম যায়। লামিয়া আবুলের টাকা গোনা দেখে আর একা একাই বলে, আমি এনো টিয়া টুহা দিসিনা। নুরজিও আমারে কইতাছে টিহা টুহা দিতে পারুম না। আমি কই দিয়ালা। পাঁচ হাজার টিয়াই আর কয় টিহাই বা লাব দিতে অয়বো। হে কয় দিয়ালমু। তয় তার ছেলে মেয়ে নাকি বহে। শহরবানু এসে ‘এ আ’ করে তাকে কী যেন জিজ্ঞাসা করে সে বলে ওই যে ঘুমায়। বলে সে সোজা হাঁটতে থাকে। গিয়ে দাঁড়ায় বিলকিস বানুর কাছে।
তাকে দেখে বিলকিস বানু বলে ওঠে, মরিয়ম একটা শেয়াল। এইহানে আইছে গল্প করতো, হে জানে না, এহানে বহনের জায়গা নাই। জাগা পাল্টাতি তো পারো। হেইদিকে লইলে মানুষ আর আইবো না। শহর বানু বলে, তয় শেয়ালের জ্বলন সজ্জ করো।
এ কথা বলেই জবাবের প্রত্যাশা না করে তাদের স্থানে চলে আসে। দেখে ডালিয়া উঠে গেছে। তার বাপে তার পাশে। বাবার মোবাইল নিয়ে সে খেলা করে। লামিয়া ডালিয়ার বাপকে ডেকে বলে, দ্যাখ চাটতাছে মোবাইল ডা। ও নন্দাই দ্যাখ চাটে। ইউনুস লামিয়াকে পাশে ডাকে। লামিয়া একটু দূরে বসে, ক্ষোভ করে ডালিয়ার
বাপ তাকে বলে, তরে বইতে কইছি হেনো, তুই গেছস গা হেনো, উঠোস, আয় এনো। এ কথা বলে মেয়ের হাত থেকে মোবাইলটা নেয়। বলে মায়ের কাছে যামু, এতক্ষণ ফুন লয়া খাতির আছিল, আর না, এহন আমি দোকানো যামু। ডালিয়া কাঁদতে শুরু করে, মেয়ের কান্না দেখে ইউনুস বলে, কান্দিস ক্যা, মায়ার মার লগে রানগা যা। প্রয়োজন অপ্রয়োজনে ওরা একে অপরের। লামিয়া তখনো বিড়বিড় করে ওদিকে মরিয়মের রান্না শেষ হয়ে আসে সে নুরজাহানের সাথে ঝগড়া করে— হালা হকিন্নি মিছা কতা কস ক্যারে? তর লগে পান আনতে পারুম না, কাইল্লা এক কাপ চা লয়া তরে খুজ্জি, পাইলাম না। কই গেছিলি কারে যেন দিয়া দিইছি। দেহা হইছিল এনো তার সাথ।
খুব সাধারণ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করছে, আবার খুব সাধারণ বিষয় নিয়ে আনন্দের ঢেউ তোলে। যেন এদের জগত এখানে থমকে গেছে। ভ্যানের পাশ থেকে আবুল এসে তড়িঘড়ি লাগায়। বলে টিয়া গুনতো গুনতো চুপা বইসা গেছে। এহন পান চিবাইলে চাপা উঠব গা। নুরজাহান, লামিয়া এবং মরিয়ম তিনজনেই তাদের পান যেখানে সেখানে হাত রাখে। যেন যক্ষের ধন তাদের পান। লামিয়ার মাথার টাকার চিন্তা নিমিষেই পানে এসে ঠেকে। বলে অতা পান চিবানি কিয়ের? টিয়া থাকলেও কাউন লাগবো না থাকলেও কাউন লাগবো, অভ্যাস না! আল্লা যে কয়দিন হায়াৎ দিসে এভাবেই কাটবো, পান ডা শুধু খাই বেশি।
তাদের মাঝে হঠাৎ আনিসার মা এসে পড়ে। সে কোনো কথা ছাড়াই কাঁদতে থাকে। বস্তিওয়ালা তাদের সাথে খারাপ আচরণ করে। তাকে সান্ত্বনা দেয় নুরজাহান। বলে টিয়া অনুযায়ী হইলো গিয়ে কতা। যেমুন টিহা দিবি তেমনে সুহে থাকবি। হেগো কথা শুনতে যাবি কেলাই। টিহা না থায়ে রাস্তাত আইসা হুইয়া পড়বি। মরিয়ম বলে হ, টিহা দিয়া থাকমু যেমনে ভালা সেমনে থাকমু। হ, সেইডাই বলেই হন হন করে বাসার দিকে যায় নুরজাহান। যতই সামান্য হোক সকলে তার নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। মনে হতে পারে এদের এই নিম্নতর জীবন যাপন ছাড়া সকলে যাকে সমাজ বলে সে ভদ্র সমাজে যাতায়াত নাই। কিন্তু আছে। লুৎফা লেক সার্কাস, প্রথম লেন বশীরুদ্দীন জামে মসজিদ রোড, কলাবাগানের ১০০/১ নং বিল্ডিঙের তিন তলায় এবং কলাবাগান ডল্ফিন গলির দুটি বাসায় কাজ করে। এখন সে রাতের কাজ করতে বশীরুদ্দীন জামে মসজিদ রোডের বাসায় গেছে। বর্তমানে সে কাজের প্রতি বেশি দায়িত্ববান। দেশের পরিস্থিতি, সামনে ঈদ সব কল্পনায় রেখে। ১০০/১ এর যে ফ্ল্যাটে সে কাজ করে সে ফ্ল্যাটে স্বামী স্ত্রী দুজন আর তাদের এক সন্তান নিয়ে বসবাস। স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে কিন্তু সন্তান হবার পর থেকে বর্তমানে স্ত্রী বাসায় থাকে আর গত লকডাউনের পর থেকে গৃহকর্তাও বাসায় বসে অফিস করে। সপ্তাহে দুদিন অফিসে যেতে হয় অন্যান্য দিন বাসায় বসে কাজ করতে হয়। লকডাউনের দু মাস পরে আরো দুমাস তাকে বাদ দেয়া হয়েছিল। সে সময়ের করুণ অবস্থার কথা ভাবলে তার চোখে জ্বল আসে। চারমাস পরে কাজে ফিরেছে কিন্তু কাজগুলোতে আগের মতো আনন্দ নাই। বাসার মালিক মালকিনের আচরণ বদলে গেছে। যেন তারা গৃহকর্মী কে টাকা যতো পারে কম দিতে পারলে বাঁচে আর কাজ যতো পারে বেশি করিয়ে নিতে পারলে আনন্দবোধ করে। লুৎফার এই বাসার গৃহকর্তী বেশ শান্তশিষ্ট ছিল। কিন্তু চারমাস পরে সে হয়ে গেছে খিটখিটে। রান্নাঘরে কাজ করলে এটা কর সেটা কর, এইটা করনি কেন, এমনে খালি টাকা নিবেন, গৃহকর্তা বলে এই বুয়া তুমি কাজ পরিস্কার করে করো না কেন? বলেই ল্যাপটপে চোখ গুজে আর কিছুক্ষণ পর পর বলে ইয়েস বস, ইয়েস। ব্যস্ততার দিনগুলোতে তারা যেন সুখী ছিল। ঘরোয়া ব্যস্ততায় তারা অসুখী হয়ে উঠেছে। রান্নাঘরের যাবতীয় কাজ সহ প্রতি ঘরের মেঝে, কাপড় আর ওয়াশরুম ধোবার পরে যখন সে তাদের কাছে অনুমতি চাই চলে আসবার জন্য তারা অযথাই কথা শোনায়। লুৎফা তখন এদের আগের রূপ কল্পনা করে, মেলাতে পারে না এই রূপের সাথে সেই রূপ। কখনো তার সম্মুখে নাফিস সাহেব এবং তার স্ত্রী রাকিবা ঝগড়াঝাটি করে। স্ত্রী বলে সময় দাও না তুমি আমাকে আর আমার মেয়েকে, স্বামী বলে সারাদিন তো আমি তোমাদের সম্মুখেই থাকি, কাজ করি, কথা বলি এর পরেও কোন সময় চাও। একই সঙ্গে বাসায় থেকেও তারা যেন সঙ্গীবিহীন। লুৎফা যন্ত্রের মতো কাজ করে বকা খায়, চলে আসে বস্তিতে। সে রাতের জন্য রুটি বেলছে আজ বেলন দিয়ে। বড়ো বড়ো মাছ এনেছে নাফিস সাহেব বাজার থেকে, গোশতো সহ প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যও এনেছে। যেন সাত আটদিনের বাজার একসাথে। রাকিবা তাকে সব কিছুই কাটার নির্দেশ দিয়েছে৷ তার ইচ্ছে করেছে জিজ্ঞাসা করে, বাজার তো আইনা রাহেন না, সদ্য বাজার খাইতে ভালোবাসেন কিন্তু বলবার সাহস হয় না। সে মুখ বুজে কাজ করে যায়। সব কাটা হলে, কাজ শেষ হলে সে যখন অনুমতি চায় বস্তিতে ফিরবার জন্য রাকিবা তাকে বলে বুয়া কাল থেকে এক সপ্তাহ লকডাউন। আপনি একসপ্তাহ আসবেন না। আর একসপ্তাহ পরে যদি লকডাউন বাড়ায় তো তখনকার হিশাব তো তখন বোঝা যাবে। আপাতত সাতদিন এসো না।
লকডাউনের কথা শুনে লুৎফার আত্মা কেঁপে ওঠে। সে কিছু বলে না, আইচ্চা আপা বলে গেট খুলে বের হয়ে আসে। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় সে হাউমাউ করে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে সে আল্লাহর সাথে ঝগড়া করে। কেন তাকে গরিব ঘরে জন্ম দেয়া হয়েছে, আর সে তো এ জীবন মেনে নিয়েছে। তবে কেন এই জীবন চলে যাবার আগে মহামারি দিয়েছে? লুৎফা বলে, আমি গরিব,আমার হাল আমি মাইনা লয়া সুখ খুঁজি। বড়োলুকের ঘরো দুনিয়ার কাম করি, আর দেয় মাঙ্গের টিয়া। আর মাঙ্গে উপরে বয়া মোগো কষ্ট দেইখ্যা হাসো। বাঁচাইয়া রাইখ্যা তুমি পাডাইছো রুগ। রুগতো মোগো অয় না। যাগো অয়, তারা কামে যাইতো বারণ করছে। খুশি তো অহন তুমি। গরিবের পেডো লাথি দিয়া জন্মের সুখ তুমি দাও তাগো। রাস্তায় তার ঝগড়া শুনে দোকান থেকে কেউ কেউ উঁকি মেরে চায় এবং তার চিৎকারকে পাগলের প্রলাপ বলে আখ্যায়িত করে।
লুৎফা পৌছে যায় আধাঘণ্টার মধ্যে গ্রীনরোড গ্রীনলাইফ হাসপাতালের বিপরীতে মরিয়মদের বাসস্থানে। সে হাউমাউ করে কাঁদে। মরিয়ম, শহরবানু, বিলকিস বানু এবং রেশমা কেউ বুঝতে পারে না তার কান্নার কারণ। তারা এতোক্ষণ খোশগল্পে মেতে ছিলো৷ অকস্মাৎ তাদের গল্পে ছেদ পড়ে।
লুৎফা তাদের জানায়, কাইল্লা থাইকা লকডাউন।
হঠাৎ যেন জোঁকের মুখে লবণ পড়ে। তারা বলে, দূর যা, লকডাউন হইলে মোগো কামের বাসাত মানসেরা কইতো না। লুৎফা বলে, হ, এক সপ্তাহের, বাড়তেও পারে। কেউ আর কো্নো কথা বলে না, এইটা তাদের জন্য যেন শোকবার্তা। লুৎফা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির পথ ধরে। তার সমিতি আছে, আছে কিছু দেনা। সেসবের কথা নিজের সন্তানদের খাওয়া পরা আর বাসাভাড়ার কথা চিন্তা করে, কাঁদে ডুকরে ডুকরে।
লুৎফা যাবার পূর্বে মরিয়মরা তেলের পিঠা নিয়ে গল্প করছিল। তারা তেলের পিঠা খেতে চায় কিন্তু নিজেরাই বলে তেলের পিডা তৈয়ার করতো ঘর দরজা লাগে। বিলকিস বানু তাকে জবাবে বলে আমি তেলের পিডা নষ্ট কইরালাই। মরিয়ম সতীনকে হারাতে বলছিল সোডা দিলে তেলের পিডা নষ্ট অয় না৷ কিন্তু তার সতীনকে হারাবার আনন্দ নিমিষে মিটে যায়। বরং সতীনকে তার হঠাৎ অসহ্য মনে হয়। সে বলে যাওনা ক্যা? রাত নডা বাজে। বিলকিস বানু তার স্বামীর অপেক্ষা করে, মরিয়ম সেটা বুঝতে পারে বলে মইজ্জার আইতে দেরি অয়বো তুমি যাওগা। আমি হুইয়া পড়মু। উল্টা কথা কইয়ো না যে, মন খারাপ অয়ছে হগলডির। আমার কাম কাজের ক্ষতি অয়বো বেশি। মরিয়ম বলে, উলটা কথা কনু, মাঙ্গের কথা কনু? ক্যান জিগাইলেন মাঙ্গের কথা। হে কি ময়লা কুড়াবার গ্যাছে এহনই আয়া পড়বো নিয়া। হে গ্যাছে কাজো। দেরি অইবো হে কি হাইট্টা আইতাছে? রাস্তা ভাঙ্গা? তাদের দুই সতীনের ঝগড়ার মধ্যস্থতা করে বিলকিস বানুর ছেলে ল্যাংড়া। বলে বাসে আইতাছে, হাইট্টা আইবো! পাগল নাকি?
কিন্তু তারা আর অপেক্ষা করতে পারে না। একে একে যে যার স্থানে পাটিতে চৌকিতে ভ্যানে ঘুমিয়ে পড়ে। সকলেই লকডাউনের চিন্তা করতে করতে শুয়ে থাকে কিন্তু ঘুমায় না। গত বছরের অভাবের কথা মনে করে তারা সকলে কষ্ট পায়। কিন্তু কষ্টের বোঝা এক পর্যায়ে ঘুম তাদের মন থেকে নামিয়ে দেয়। তারপরও জেগে থাকে কেউ কেউ। সকালে উঠে প্রত্যেকে তাদের কাজে যায় সময়ের আগে। মরিয়ম ব্যাচেলর দের সকালের নাস্তা বানায় দেয়, সেখানে দারোয়ান তাকে ফেরত দেয়, গেট খোলে না। আরেক বাসায় নির্দ্বিধায় কাজ করে আসে। কিছুই বলে না। গেটেও দারোয়ান নাই। সে যখন দ্বিতীয় বাসায় কাজ করে তৃতীয় বাসায় ঢুকবে এরকম সময় তার কাছে ফোন আসে খালা আমাদের রুটি বানায়ে দিয়ে যান। লকডাউন কেউ মানছে না। গেটে এখন সমস্যা নাই। সে তাড়াতাড়ি ছুটে যায়।
লুৎফা অফিসার্স কোয়ার্টারের কাজ শেষ করে যখন ডলফিন গলির বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় তখন নাফিস সাহেব তাকে ফোন করে বলে, খালা আপনি আমাদের বাসায় আসেন। কাজ করলে সমস্যা নাই। লুৎফা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে ফেলে হ, চারপাশো সব খোলা ভায়া। বিকালে লামিয়া, লুৎফা, মরিয়ম, শহরবানু, নুরজাহান সব এক হয়ে ফুটপাতে বসে গল্প করে আর হাসে। নুরজাহান বলে কাইল্লা কি ভয় ডা পাইছি, সকালে ঘুম থেকে উডা মাত্তর আনিসের মায়ে বলে, ও আপনের বোন,দোতালার খুদেজা কাইল্লা হারা রাইতো বইসা আছিল, কাঁদছিল। লামিয়া বলে ভয়ো ছয়ডা বাজে উডছি, মুখ ধুইয়া সাইরা সাতডা বাজো যাইয়া দেহি বাসন পাতিল ভাসে, হাতটা বেতনা করতাছে, ভয়ো কাজ বেস্তি কইরালাইছি। লকডাউন কেউ মানে না, আরো হেরা তাগো বোনের বাসার লাগি কাজের বেডি খুঁজে। মরিয়ম রে কইছি হে নিইছে না৷ লুৎফা বলে, হ, তর কাজের বাসার মহিলা আমারে গত কাইল্লা বিয়ানে জিগাইছিল, বুড়িরে নিবে? আনিসের মারে দিবে? লামিয়া বলে, না।
লকডাউন দেয়া হয় মানুষ কে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু লকডাউন কখনো কখনো উপরওয়ালার নির্দেশেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরা তাদের নিজেদের জীবন যাপনের কঠিন অবস্থা কল্পনা করে তার সাথেই ঝগড়া করে, কাঁদে।
আপাতত একটা ব্যর্থ লকডাউনের আনন্দে ফুটপাত খুশিতে ডগমগ। শহরের ফ্ল্যাটগুলোতে লকডাউনে বন্দী বাসিন্দারা তার কিছুই টের পায় না। এমনকি পুলিশের গাড়িটিও না। তারা টহল দিতে এসে কি জানি কি বুঝে ফিরে যায়।
জীবন সুন্দর!
ছবি- ইন্টারনেট
জেসমিন নাহার
ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। বাড়ি যশোহর জেলার শার্শায়। গোড়পাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম। চিশিতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। মা রওশানারা বেগম। গল্প লেখক। উপন্যাসও লিখছেন।