।। ফ্লোরা সরকার ।।
সিনেমার একটা মজার দিক হচ্ছে, কোন ঘটনা বা মুহূর্তকে নাটকীয় জায়গায় উত্তীর্ণ করা। ইংরেজিতে যাকে আমরা ড্রামাটাইজ করা বলি। সেটা যদি ইতিহাস বিখ্যাত কোন ঘটনা, মুহূর্ত বা উক্তি হয়, তাহলে সেই ঘটনা বা উক্তি জানা কোন দর্শক সিনেমার সেই ড্রামাটিক অংশটিকে আরও গভীর ভাবে উপলব্ধি এবং উপভোগ করতে পারে। মার্কস এবং এঙ্গেলস যখন বার থেকে বের হয়ে এলেন, অনভ্যস্ত মার্কস অতি মদ্যপানের কারণে, বমি করে। বমি করার পর, ঠিক সেই মুহূর্তে জগৎ বিখ্যাত সেই উক্তি মার্কসের মাথায় খেলে যায়, যা তিনি ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিসের এগারো নম্বর সংকল্পে লিখেছিলেন: ‘‘দার্শনিকরা এতোদিন দুনিয়াকে শুধু ব্যাখ্যাই করেছে, আসলে দরকার তাকে বদলে দেওয়া’’। সংলাপটা যত সহজ, বোধগম্য হওয়ার কথা, তত সহজ নয়। কারণ, পরবর্তীতে মার্কস অনুসারীরা এই কথাটার বা সংকল্পের অনেক ভুল ব্যাখ্যা করেছেন।
সিনে-আলাপ
দ্য ইয়াং কার্ল মার্কস (২০১৭)
পরিচালনা- রাউল পেক
চিত্রনাট্য- পাস্কেল বোনিৎজার ও রাউল পেক
অভিনয়ে- আগস্ট ডিহল, স্টেফান কোনারস্কে, ভিকি ক্রিপস প্রমুখ
সিনেমাটোগ্রাফি- কোলজা ব্র্যান্ড
এডিটিং- ফ্রেডেরিক ব্রুস
মিউজিক- আলেক্সি আইগুই
‘দ্য ইয়ং কার্ল মার্কস’ রাউল পেকের (Raoul Peck) ছবি। রাউল হাইতির বিখ্যাত ছবি মির্মাতা; রাজনৈতিক ভাবে তৎপরতা মানুষ। এক সময় হাইতির সাংস্কৃতিক মন্ত্রীও ছিলেন। ইতিহাস এবং নান্দনিকতার মিশালে নতুন ধারার ছবি তৈরির জন্য তিনি খ্যাত। ছবিটি ‘ডকুমেন্টারি’ বলা হয়, কিন্তু ঠিক ডকুমেন্টারি বলতে আমরা যা বুঝি তা নয়। যে কোনো সিনামার মতোই ‘দ্য ইয়ং কার্ল মার্কস’ গল্প নির্ভর একটি চলচ্চিত্র, যার উদ্দেশ্য তথ্য চিত্রের সীমা অতিক্রম করে যাওয়া। স্ক্রিপ্ট রাউল পেক ও পাস্কাল বনিতজার (Pascal Bonitzer) দুজনে মিলে লিখেছেন।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো ‘দ্য ইয়াং কার্ল মার্কস’ ছবিটা যারা দেখবেন, তারা যেন সেই সময়ের ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের পাশে রেখে দেখেন।তাহলে ছবির মর্ম আরও গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। যারা দেখেছেন তারাও সেটা উপলব্ধি করেছেন।
ছবিটা নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে প্রশ্ন করা যাক ‘ইয়াং হেগেলিয়ান’ কারা ছিল? তাহলে সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা করতে আমাদের সুবিধা হয়। কারণ, ‘আই অ্যাম নট ইউর নিগ্রো ( ২০১৬ )’ খ্যাত হাইতির চিত্রনির্মাতা রাউল পেক নির্মিত ‘দ্য ইয়াং কার্ল মার্কস’ ( ২০১৭ ) ছবির বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে এই ইয়াং হেগেলিয়ানদের দেখানো হয়েছে। যে সময়টা মাত্র তেইশ/ চব্বিশ বছর বয়সী কার্ল মার্কসকে আমরা দেখি। এই সময়টা মার্কসের ভবিষ্যতে ‘পুঁজি’ গ্রন্থটি লেখার প্রস্তুতিপর্ব । ১৮৩১ সালে যখন গিয়র্গ ফ্রেডরিক ভিলহেল্ম হেগেল মারা গেলেন ঠিক তার পরপরই জার্মানির বার্লিনে, এই ‘ইয়াং হেগেলিয়ান’ বা বাম হেগেলিয়ান নামে এক বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যারা হেগেলের দর্শনের অস্পষ্টতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তবে গল্পের পেছনে আরও গল্প থাকে; এই ইয়াং হেগেলিয়ানদের গড়ে ওঠার পেছনেও একটা ছোট্ট কিন্তু গভীর গল্পের রেখাপাতের আছে।
ডেভিড স্ট্রাউস ( ১৮০৮-১৮৭৪ ) নামে জার্মান লিবারাল প্রোট্যাস্ট্যান্ট তাত্ত্বিক ১৮৩৫ সালে ‘দ্য লাইফ অফ জিসাস’ লেখার সময়েই, ইয়াং হেগেলিয়ান নামে একটা দলের উদয় ঘটে যাদের মধ্যে প্রথমবারের মতো পৃথক একটা গ্রুপ হিসাবে তাদের বইটার মর্ম তাদের ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়। জীবন ও জগতের তাদের নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে ভাবনা তীব্র হয়। প্রথমে ধর্ম এবং পরে তৎকালীন প্রুশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনায় তারা মেতে উঠে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন আগুস্ত সিয়েজকউস্কি ( ১৮১৪-১৮৯৪ ), যিনি এই দলের সাথে থাকলেও তাদের মতের সঙ্গে পুরোপুরি এক মত ছিলেননা এবং কার্ল মার্কসের সাথে যার বেশ ভালো সখ্যতা ছিল। হাবসবুর্গ মোনার্ক বা হাবসবুর্গ রাজতন্ত্র ( ১৪৩৮-১৮০৬ ) ছিল ক্যাথলিক। এই রাজবংশের সাথে ১৮০০ সালের দিকে রাজকীয় সংসদে ক্যাথলিক সংখ্যগরিষ্ঠরা যোগ দেয়। এর ফলে প্রুশিয়া ও হ্যানোভারের জার্মানির রাজকীয় সংসদে উত্তরাঞ্চলীয় প্রটেস্টেট্যান্টদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় ক্যাথলিকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মোটামুটিভাবে বলা যায় ১৮১৫ ১৮৪৮ সালের জার্মান ইতিহাস ছিল প্রতিক্রিয়াশীলের ইতিহাস। অস্ট্রিয়ার কুটনীতিক মেটারনিখের (১৭৭৩ – ১৮৫৯ ) প্রভাব ছিল প্রকট। ১৮১৩ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেপলিয়ানকে পরাজিত করার পর প্রুশিয়ার সরকার ‘টিয়ের’ শহর ফ্রান্স থেকে মুক্ত করে প্রুশিয়ার সাথে সংযুক্ত করে। এই শহরেই কার্ল মার্কসের জন্ম হয় ১৮১৮ সালে । শহরটিতে প্রুশীয় সরকার ইহুদী বিরোধী আইন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করে। কার্ল মার্কসের বাবা হেনরিক মার্কসকে ক্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা নিতে হয় চাকরি রক্ষার জন্যে এবং লুথারিয়ান হিসাবে নিজেকে ব্যাপটাইজ করেন ১৮১৭ সালে অর্থাৎ কার্ল মার্কসের জন্মের ঠিক আগের বছরে।
এখান থেকেই আমরা ধারণা করতে পারি, ইহুদি, খ্রিস্টান, প্রটেস্ট্যান্ট মিলিয়ে ধর্ম নিয়ে সেই সময় জার্মানিতে এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। যে কারণে কার্ল মার্কস তার ২৫ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৮৪৩ সালে ‘ইহুদি প্রশ্নে’ নামে একটি বই লেখেন যা প্রকাশিত হয় ১৮৪৪ সালে। বইটি লেখা হয়েছিল আধা-সামন্ত জার্মান দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাধারণ লড়াইয়ের অংশ হিসাবে। জার্মানিতে অন্যান্য জনগণের মতো ইহুদিদেরকেও একই নাগরিক অধিকার দেয়া হবে কিনা এই তর্ক সেই লড়াইয়েরই একটা পরিপ্রেক্ষিত ছিল। মার্কস তখন রাইন গেজেট পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। মার্কসের মূল ইচ্ছা ছিল, হার্মেস নামের একজনের খোলাখুলি ইহুদিবিরোধী প্রতিক্রিয়াশলীল লেখালেখির জবাব দেওয়া। হার্মেস ইহুদিদের বিচরণ সীমাবদ্ধ রেখে রাষ্ট্রের খ্রিস্টান ভিত অক্ষুন্ন রাখার কথা বলতেন। এই সময়ে ইয়াং হেগেলিয়ানদের মধ্যে বামপন্থী ঘরানার ব্রুনো বাউয়ের (১৮০৯ – ১৮৮২) দুটো লেখা লিখেন: ‘ইহুদি প্রশ্ন’ এবং ‘বর্তমান কালের ইহুদি আর খ্রিস্টানদের মুক্ত হবার সামর্থ্য’ । মার্কস বাউরের ছদ্ম র্যা ডিকাল দৃষ্টিভঙ্গির সাথে বাহাস করা বেশি জরুরি মনে করলেন এবং ‘ ইহুদি প্রশ্নে ’ বইটি লেখেন। বাউর ইহুদি সমস্যা দেখেছেন শুধু ধর্মের জায়গা থেকে, মার্কস সেখানে দেখেছেন দুনিয়াবি যে মানুষেরা ইহুদি নামে পরিচিত তাদের সমস্যার জায়গা থেকে। ফলে সেই বইয়ে মার্কস যথার্থই বলেছেন, “আমরা ইহজাগতিক প্রশ্নটাকে ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্নে পরিণত করি না, ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্নকেই ইহজাগতিক করে তুলি”। ব্রুনোর মতো ইয়াং হেগেলিয়ানদের মধ্যে আরও ছিলেন ডেভিড স্ট্রাউস ( যার কথা আগেই বলা হয়েছে ) , লুদভিগ ফয়েরবাখ (১৮০৪-১৮৭২), আর্নল্ড রুজ (১৮০২-১৮৮০), ম্যাক্স স্টিরনার (১৮০৬-১৮৫৬) এবং মার্কস-এঙ্গেলস সহ আরও অনেকে, যাদেরকে এই সিনেমায় আমরাআবির্ভূত হতে দেখি।
ছবির প্রথম দৃশ্যে প্রায়ান্ধকার একটা ঘন বনে কিছু গরীব লোকদের ডালপালা কুড়াতে দেখা যায়, ধারাভাষ্যে আমরা শুনি “সবুজ বনভূমি সংগ্রহ বা বৃদ্ধির জন্যে কিছু ডাল ছেঁটে ফেলে দিতে হয়। কিন্তু শুকনা-মরা ডাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে সম্পত্তি থেকে কিছুই বিয়োগ হয়না। এসব ডাল ইতিমধ্যে আলাদা হয়েই আছে, তবু এসবকে সম্পত্তি হিসাবে গণনা করা হয়। এসব জানা সত্ত্বৈও দুটোকেই চুরি বলে অভিহিত করা হয় এবং সেজন্য শাস্তি দেয়া হয়”। এর পরেই ফরাসী বিচারক এবং রাজনৈতিক দার্শনিক মঁতেস্কোর ( ১৬৮৯-১৭৫৫) বিখ্যাত কথাটা ভয়েস ওভারে শোনা যায়: “মঁতেস্কো দুই ধরণের দুর্নীতির কথা বলেছেন — এক. যখন মানুষ আইন পর্যবেক্ষণ করেনা , দুই. যখন আইন তাদেরকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। আসলে তোমরা চুরি এবং সংগ্রহের মধ্যকার তফাৎ মুছে দিয়েছো। মানুষ শাস্তিটা দেখে, অপরাধটা দেখেনা।”
সামান্য এই ভূমিকার মধ্যে দিয়ে আমরা বুঝে নেই ভবিষ্যত কার্ল মার্কস সম্পত্তি, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, মালিকানা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করবেন। ঠিক তার পরেই, আমরা ১৮৪৩ সালের এপ্রিল মাসের কোলন শহরের পত্রিকা অফিসে মার্কস এবং স্টির্নারকে দেখি মার্কসের লেখালেখি নিয়ে কথা বলতে। মার্কস বেশ তৃপ্তির সাথে বলেন, তিনি তার লেখা নিয়ে খুব সন্তুষ্ট কারণ, তার লেখার একটা প্রভাব ইতিমধ্যে সবার মধ্যে পড়ে গেছে এবং প্রুশিয়ান সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক চেহারাটা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে ব্রুনো বাউর ও আর্নল্ড রুজকেও দেখি যোগ দিতে এবং সবাইকে তর্ক করতে। তর্কের এক পর্যায়ে মার্কস ব্রুনো বাউরকে জানিয়ে দেন উনি ইয়াং হেগেলিয়ানদের নিয়ে ভীষণ বিরক্ত এবং তাদেরকে রীতিমতো ঘৃণা করেন। আমরা জেনে যাই ঐ বছরেই অর্থাৎ ১৯৪৩ সালেই ‘ইহুদী প্রশ্নে’ বইটা লিখবেন, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সময়ের জার্মানি এক আতঙ্কের জার্মানি ছিল। মত প্রকাশের স্বাধীনতা তো ছিলই না এবং যখন তখন পুলিশ যে কাউকে ধরে নিয়ে যেতো। এই দৃশ্যেও আমরা দেখি কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ আসে এবং সবাইকে ধরে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
ছবির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট আমরা খেয়াল করি এবং সেটা হলো,কার্ল মার্কস ‘মার্কস’ নামে আমাদের কাছে পরিচিত হলেও, মার্কসকে সেই সময়ে তার আশেপাশের সবাই ‘কার্ল’ নামেই অভিহিত করতেন। যেহেতু জার্মানিতে বসে এতো কড়াকড়ির ভেতর কিছু করা যাবেনা, এসব ভেবে পুলিশের বেষ্টনির মধ্যে থেকেও গাড়ির ভেতর আর্নল্ড রুজ, মার্কসকে ফিসফিস করে একটা প্রস্তাব দেন এবং সেটা হলো, প্যারিসে যেয়ে নতুন পত্রিকা প্রকাশ করার। আমরা বুঝে যাই, জার্মানির থেকে তাড়া খেয়ে মার্কসকে প্যারিস যেতে হবে।
ছবির এই পর্যন্ত এঙ্গেলসের দেখা আমরা পাইনা। এর পরের দৃশ্যে দেখি, ইংল্যান্ডের ম্যানচেষ্টারের বিশাল এক কাপড়ের কারখানায় এঙ্গেলসের বাবা, শ্রমিকদের বকাঝকার মধ্যে দিয়ে কুকুর বলে গালি দিচ্ছেন। এর প্রতিবাদে একমাত্র যে শ্রমিকটি প্রতিবাদী হয়ে উঠেন উনি আর কেউ নন, এঙ্গেলসের ভবিষ্যত জীবনসঙ্গী লিজি বার্নস। এরপর এঙ্গেলস শ্রমিকদের বস্তিতে যায় লিজির সাথে দেখা করতে এবং সেখানেই আমরা জানতে পারি, এঙ্গেলস তার বিখ্যাত ‘দ্য কন্ডিশান অফ দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’ (১৮৪৫ ) বইটা লিখবেন এবং সেই কারণেই তার বস্তিতে যাওয়া। এরপরেই পরিচালক আমাদের নিয়ে যান ১৮৪৪ সালের জুলাই মাসের প্যারিস নগরীতে, যেখানে মার্কসের সাথে ফরাসি অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্বিক, পেটি বুর্জোয়া তত্ত্ব প্রবক্তা এবং নৈরাজ্যবাদের আদি তাত্ত্বিকদের একজন বলে পরিচিত পিয়ের জোসেফা প্রুধোঁর (১৮০৯-১৮৬৫)উন্মুক্ত সম্মেলনের মাঠে। যেখানে মার্কস এবং তার বউ জেনির সাথে প্রুধোঁর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে।
প্রুধোঁর চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্মাতা রাউল পেকের মাস্টারি স্বীকার না করে পারা যাবেনা। ছবিতে প্রুধোঁকে দেখলে পরিস্কার বোঝা যায়, অর্থনীতি এবং সমাজতত্ত্বের দুনিয়ায় সেই সময়ে প্রুধোঁ বিশাল এক বলয় তৈরি করেছিলেন এবং তার প্রবল প্রভাব ছিল। সবাই তাকে ভীষণ শ্রদ্ধার সাথে সম্মানের আসনে বসিয়েছে। এবং প্রুধোঁও সেই সম্মানের গর্বে গর্বিত হয়ে সারা ছবিতে বিচরণ করেন। অথচ প্রথম সাক্ষাতেই মার্কস ‘সম্পত্তি’ র প্রশ্নে প্রুধোঁকে জর্জরিত করে ফেলেন। শুধু তাই না, কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা দেখতে পাই প্রুধোঁর অর্থনীতি বিষয়ক অন্তঃসারশূন্যতা ধরতে মার্কসের খুব বেশি দেরি হয় নাই।১৮৪৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রুধোঁর লেখা ‘দারিদ্রের দর্শন’ বইটার জন্যে রুশ উদারনৈতিক জমিদার ও সাহিত্যিক পাভেল ভাসিলিয়েভিচ আন্নেকভকে (১৮১২-১৮৮৭) ব্রাসেলস থেকে লেখা এক চিঠিতে তুলোধোনা করতে ছাড়েন নাই। যদিও ছবিতে চিঠির এই অংশ আমরা পাইনা, কিন্তু এই চিঠি পড়লে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, ইতিহাস সময়ে সময়ে কতো অন্তঃসারশূন্য বিদ্বানদের আকাশচুম্বী জনপ্রিয় করে রাখে। সেই চিঠির বিভিন্ন অংশে মার্কস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রুধোঁর অর্থনৈতিক আলোচনা নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন, এখানে তার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
মার্কসের ভাষ্য হলো, প্রুধোঁ সামাজিক বিকাশ এবং ব্যক্তিগত বিকাশের পৃথকীকরণের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক বিকাশকে ভুল ভাবে দেখেছেন, ধারণা এবং বস্তুকে একত্রিত করে দেওয়ার ফলে, নতুন উৎপাদিকা শক্তি অর্জনের সাথে সাথে উৎপাদন পদ্ধতির যে পরিবর্তন হয় এবং এই পরিবর্তনে মানুষের অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলিও যে পরিবর্তিত হয়ে যায় সেটা প্রুধোঁ ধরতে পারেন নাই, মালিকানা সম্পর্ককেও প্রুধোঁ ভুল ভাবে দেখেন, কারণ এই মালিকানাকে প্রুধোঁ স্বাধীন ভাবে দেখার ফলে, বিভিন্ন যুগের মালিকানা, সামন্তযুগের মালিকানা ইত্যাদি যে পৃথক পৃথক সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এটা প্রুধোঁ ধরতে ব্যর্থ হন। মার্কস প্রুধোঁর ভুলগুলি ধরে ধরে তার চিঠিতে আন্নেকভকে জানান।
প্রুধোঁর পরেই আমরা ছবিতে দেখি মার্কসের সঙ্গে এঙ্গেলসের প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্য। দৃশ্যটা বেশ মুন্সিয়ানায় নির্মাতা রাউল পেক নির্মাণ করেছেন। আর্নল্ড রুজের বাড়িতে এঙ্গেলস আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন। মার্কসের ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিস নিয়ে আর্নল্ড এবং এঙ্গেলসের মধ্যে কথা হয়। অর্নল্ড মার্কসের লেখালেখি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কৌতুক করে এঙ্গেলসকে বলেন, “মার্কসের প্রবন্ধ কখনো শেষ হয়না, সে শুধু সংশোধন করে চলে”। ছবিতে যে ইয়াং মার্কসকে আমরা দেখতে পাই, ভীষণ অস্থির এবং চঞ্চল চরিত্রের এক যুবক, যে সেই সময়ের জার্মানি সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন নিয়ে ভীষণ অসন্তুষ্ট এবং রাজনৈতিকঅধিকার সহ অন্যান্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অস্থির চিত্ত এক টগবগে তরুণ। একটু পরে মার্কস আর্নলন্ডের ঘরে আসে, তার দুটো প্রবন্ধের টাকা নেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এবং আর্নল্ডকে পারিবারিক অর্থকষ্টের কথা জানায়। এঙ্গেলসের সাথে পরিচয় হলে, জানা যায় দুজনের আগেই সাক্ষাৎ হয়েছিল বার্লিনে। এঙ্গেলস, মার্কসকে জানায় যে সে তার, ‘এ কন্ট্রিবিউশান টু দ্য ক্রিটিক অফ হেগেলস ফিলোসফি অফ স্পিরিট’ বইটা পড়েছে। সেই সাথে এঙ্গেলস এটা জানাতেও ভুলেনা যে, মার্কস, হেগেলকে সোজাপায়ে মাথা উপরে রেখে সটান হাঁটিয়েছেন। সংলাপটা প্রতীকী হলেও, মার্কস মূলত হেগেলের চিন্তা প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিকে ধোঁয়াশা মুক্ত করে চিন্তা ও বাস্তবতার সম্বন্ধ বিচারের কাজে নিয়োগ করেছিলেন। হেগেল যেখানে দেখিয়েছেন চিন্তা নিজেই মানুষের মধ্যে দিয়ে, সমাজের মধ্যে দিয়ে, ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ মানুষ চিন্তার মালিক না হয়ে চিন্তা মানুষের মালিক হয়ে গেছে। মার্কস এই জায়গায় এসে উদ্দেশ্য আর বিধেয়কে — চিন্তা আর বাস্তব মানুষের সম্বন্ধ নতুন করে বিচার করে চিন্তা ও বাস্তবতার সম্বন্ধ সম্বন্ধ বিচারের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলেন। এই পর্যালোচনার পদ্ধতি পরবর্তীতে মার্কসের ভাষায় ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ পর্যালোচনার ধারা হিশাবে বা অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা হিশাবে গড়ে ওঠে। ইয়াং হেগেলিয়ানদের সাথে মার্কসের বিচ্ছেদের এটাও অন্যতম একটা কারণ ছিল, যা ছবির বেশ পরে দেখা যায়।
এসব কথোপকথোনের মধ্যে দিয়ে মার্কস-এঙ্গেলসের অন্তরঙ্গতা বাড়তে বেশি সময় লাগেনা এবং দুজন আরও কথা বলার জন্যে বেরিয়ে পড়েম এবং একটা রেস্তোরাঁয় যেয়ে বসেন। চলচ্চিত্র মাধ্যমের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, দীর্ঘ সময়কে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে নিতে হয়, ফলে ঘটনাগুলোকে খুব দ্রুত সাজিয়ে নিয়ে দেখানো হয়, বাস্তবে যা ঘটতে দীর্ঘ সময় লাগে। এখানেও তাই আমরা দেখতে পাই খুব সহজে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে দুজন দুজনকে বুঝে ফেলেন। এঙ্গেলস মার্কসকে অর্থনীতি পড়ার পরামর্শ দেয়। বিশেষ করে ক্ল্যাসিকাল অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো প্রমুখদের লেখা। তবে এঙ্গেলসের সংশয় ছিল আইনের ছাত্র হয়ে মার্কস অর্থনীতির ভাষা বুঝতে কতটা সময় নেবে?, মার্কস খুব চমৎকার করে বলেন, ‘আই অ্যাম এ ফাস্ট লার্নার’। মার্কস কতটা ফাস্ট লার্নার সেটা আমরা পরবর্তী সময়ে দেখেছি, এই অর্থনীতি, বিশেষ করে তার ‘পুঁজি’ পুস্তক দিয়ে গোটা বিশ্বকে তিনি কাঁপিয়ে দিয়েছেন। পৃথক কোন তত্ত্ব দিয়ে নয়, স্রেফ স্মিথ, রিকার্ডো সহ ক্ল্যাসিকাল অর্থনীতিবিদদের অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলির আলোচনা এবং পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে তিনি সেটা করেছেন।
সিনেমার একটা মজার দিক হচ্ছে, কোন ঘটনা বা মুহূর্তকে নাটকীয় জায়গায় উত্তীর্ণ করা। ইংরেজিতে যাকে আমরা ড্রামাটাইজ করা বলি। সেটা যদি ইতিহাস বিখ্যাত কোন ঘটনা, মুহূর্ত বা উক্তি হয়, তাহলে সেই ঘটনা বা উক্তি জানা কোন দর্শক সিনেমার সেই ড্রামাটিক অংশটিকে আরও গভীর ভাবে উপলব্ধি এবং উপভোগ করতে পারে।
মার্কস এবং এঙ্গেলস যখন বার থেকে বের হয়ে এলেন, অনভ্যস্ত মার্কস অতি মদ্যপানের কারণে, বমি করে। বমি করার পর, ঠিক সেই মুহূর্তে জগৎ বিখ্যাত সেই উক্তি মার্কসের মাথায় খেলে যায়, যা তিনি ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিসের এগারো নম্বর সংকল্পে লিখেছিলেন: ‘‘দার্শনিকরা এতোদিন দুনিয়াকে শুধু ব্যাখ্যাই করেছে, আসলে দরকার তাকে বদলে দেওয়া’’। সংলাপটা যত সহজ, বোধগম্য হওয়ার কথা, তত সহজ নয়। কারণ, পরবর্তীতে মার্কস অনুসারীরা এই কথাটার বা সংকল্পের অনেক ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। কথাটা বোঝার জন্যে, আমরা গৌতম দাস অনুদিত ‘জার্মান ভাবাদর্শ’বইয়ের ভূমিকায় ফরহাদ মজহারের ‘কার্ল মার্কস ও জার্মান ভাবাদর্শ’ বইটি থেকে কিছু অংশ তুলে দিলে হয়তো আমাদের বুঝতে আরও সুবিধা হবে।
“এই সংকল্প বা ঘোষণা ( দার্শনিকরা এতোদিন দুনিয়াকে শুধু ব্যাখ্যাই করেছে, আসলে দরকার তাকে বদলে দেওয়া ) থেকে জগৎ বদলে দেয়ার গুরুত্ব আমরা বুঝি সহজেই। কিন্তু চিন্তার জগৎকেও যে তিনি জগতের বাইরের কোন ব্যাপার গণ্য করেন নি, জগতেরই বিষয় গণ্য করেছিলেন, সেই দিকটা নজরে আনা হয় নি।যদি চিন্তা ও বাস্তবতাকে আমরা আলাদা দুটো জগৎ অনুমান করি, কেন বিশেষ সময়ে, বিশেষ কালে বা বিশেষ অবস্থায় বিশেষ একটা মত দানা বাঁধল ও প্রকাশিত হোল, তাকে চিন্তার ভেতরে থেকে শুধু নয়, চিন্তার বাইরে হাজির বাস্তব জগতের বাস্তবিক অবস্থার আলোকেও বিচার করতে হবে। বুঝতে হবে ভেতর বাইরের সম্পর্ক দিয়ে — মার্কসের পরিভাষায় যা ‘ উৎপাদন সম্পর্ক ’ নামে পরিচিত। অর্থাৎ বিদ্যমান মতাদর্শগুলোর সমালোচনা-পর্যালোচনা শুধু নয়, বরং যে-জাগতিক অবস্থা, সম্পর্ক বা বাস্তবতার মধ্যে মতগুলো –এমনকি চিন্তা করবার বিশেষ ধরনও গড়ে উঠেছে তাকে জানা, বোঝা ও পর্যালোচনার দারকার আছে। বদলটা বাইরে যেমন দরকার, ভেতরেও জরুরি। আর দুটো মিলেই ‘জগৎ বদলানো’ কথাটার মানে দাঁড়ায়। মার্কসের কাছে যা উৎপাদন সম্পর্কের বদল। জগৎ বদলানো মানে যেমন শুধু চিন্তার বদল হতে পারে না, ঠিক তেমনি চিন্তার বাইরে হাজির জগৎ বদলানোও শুধু নয়। দুটোই। দুটো নিয়েই জগৎ। যদি দুইয়ের সম্পর্ক বদলে যায়, উভয়েরই বদল ঘটে”।
ব্যাখ্যাটা একটু দীর্ঘ হলেও, আমাদের বোঝার সুবিধার জন্যে এখানে তুলে ধরা হয়েছে।এরপরেই আমরা সিনেমাতে দেখি মার্কস এবং এঙ্গেলস জার্মান ভাবাদর্শ লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং মার্কসের স্ত্রী জেনি খুব সহজে বুঝে নিয়ে একটা সংলাপ ছুড়ে দেন: ‘ক্রিটিক অফ ক্রিটিকাল ক্রিটিক’। লেখার পাশাপাশি মার্কস তখন লাইব্রেরিতে যেয়ে ভীষণ মনোযোগের সাথে অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো চর্চা করছেন। ক্যামেরার ক্লোজে রিকার্ডোর ‘পলিটিকাল ইকনোমি অ্যান্ড ট্যাক্সেশন’ বইয়ের একটা বাক্য দেখানো হয়, ‘লেবার দ্য ফার্স্ট প্রাইস’ । আমরা বুঝে যাই, পরবর্তীকালের মার্কস এই শ্রম বা শ্রম তত্ত্ব নিয়ে বিশদ কাজ করবেন।
যুবক কালের কার্ল মার্কসের চরিত্র সিনেমাতে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে মনে হয়, সেই বয়সে মার্কস অত্যন্ত চঞ্চল এক যুবক ছিলেন যা আগেই বলা হয়েছে। যিনি খুব দ্রুত দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতির সমস্যাগুলো ধরে ফেলতে পারছেন, পারছেন জগতকে বুঝতে, ঐ চব্বিশ/ পঁচিশ বছরের মধ্যেই।
এঙ্গেলসকে তুলনামূলক ভাবে শান্ত চরিত্র হিসাবে আমরা দেখতে পাই। জেনি যে ভীষণ মমতাময়ী, ধৈর্যশীল এবং অফুরান ভালোবাসার ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ একজন সংসারি নারী ছিলেন, যার ছায়ায় থেকে মার্কস নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করতে পেরেছেন, রেস্তোরাঁয় বসে থাকা মার্কস এবং এঙ্গেলসের কথোপকথনের সময়, মার্কসের একটা বাক্য দিয়ে পরিচালক আমাদের ধরিয়ে দেন, “ইউ ডোন্ট নো হাউ লাভিং শি ইজ”। জেনির সাথে একদিন হাঁটার পথে, জেনিকে এঙ্গেলস বলেন, মার্কসকে বলো, সে যেন শান্ত হয়ে সব কাজ করে। তাছাড়া জেনি যে একজন মহীয়সী নারী উল্লেখ করতেও ভুলেন না জেনি ধনী পরিবার থেকে এসে মার্কসের সঙ্গে নানান অর্থকষ্টের মধ্যে থেকেও এক অসাধরণ সুখী জীবনযাপন করছিলেন। জেনি তখন একটা চমৎকার উত্তর দেয়, “সুখী হতে হলে বিদ্রোহী হতে হয়”। দুর্দান্ত সংলাপ ! ছোট্ট এই সংলাপ থেকে তারা কথায় কথায় পুরানো পৃথিবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার এবং তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার আলোচনায় রপ্ত হয়ে যায়, যা মার্কস, এঙ্গেলস এবং জেনি — এই তিনজনের মধ্য দিয়ে ঘটতে যাবে। ছবির গতি বেশ কিছুদূর যাবার পর, সেই বিদ্রোহের বিষয়টাই আমরা দেখতে পাবো।
ইতিমধ্যে মার্কস এবং এঙ্গেলসের সাথে প্রুধোঁর আবার দেখা হয়, মতের মিল-অমিল শুরু হয়ে যায়। শ্রমিকদের মাঝে বক্তৃতারত মার্কসকে আমরা দেখি। শ্রমিকরা কীভাবে তাদের জীবন উৎসর্গ করছে তাদের মালিকদের কাছে, শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে বুর্জোয়ারা কতটা স্বাধীন এবং শ্রমিকেরা কতটা বাধ্য, বুর্জোয়ারা যে স্বাধীনতার বাণী শোনায় এবং সেই স্বাধীনতা যে শুধু বুর্জোয়াদের জন্যে বরাদ্দ ইত্যাদি তার ভাষণে তুলে ধরেন মার্কস। এখানেই মার্কসের সাথে জার্মান রাজনৈতিক কর্মী এবং সমাজতাত্ত্বিক ভিলহেলম্ ওয়েটলিঙ ( ১৮০৮-১৮৭১ ) এর সাথে দেখা হয়। পরবর্তীকালে মার্কসের ১৮৪৪ এর প্রবন্ধে এর কাজের কথা মার্কস উল্লেখ করেছেন, জার্মান শ্রমিকদের মাঝে একজন তীব্র ও উজ্জ্বল সাহিত্যিক হিসাবে।ওয়েটলিঙের তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক প্রতিভাকে মার্কস তুলনা করেছেন, ‘অর্থনৈতিক’ দিক থেকে তার ঝোঁক ইংরেজ শ্রমিক শ্রেণিদের প্রতি এবং ‘রাজনৈতিক ’ দিক থেকে ফরাসি শ্রমিক শ্রেণি ভিত্তিক। তবে ওয়েটলিঙের সাথে মার্কসের সখ্যতা পরবর্তীতে আর থাকে নাই, সেটা ছবির বেশ পরে আমরা দেখতে পাবো। এই সমাবেশেই এঙ্গেলস মার্কসকে জানান যে তিনি লণ্ডন চলে যাচ্ছে্ন। মার্কসকে পুলিশি নজরদারি থেকে এঙ্গেলস সাবধান থাকার কথা জানিয়ে দিয়ে যান। ঠিক এর পরেই আমরা দেখি, মার্কসের বাড়িতে পুলিশ এসে তাকে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে প্যারিস ছাড়ার নোটিশ দেয়। অন্যদিকে জেনি জানায় সে আবার অন্তঃসত্তা। সব বিপদ আসলে একসঙ্গেই আসে। মার্কস প্যারিস ছেড়ে ব্রাসেলসে যেতে বাধ্য হন।
১৮৪৫ এর ব্রাসেলসের প্রথম দিকের দিনগুলি মার্কসের জন্য ছিল এক তীব্র সংগ্রামী জীবন। একদিকে বেকার জীবন, সংসারের টানাপোড়েন আর অন্যদিকে ব্রাসেলসে পৌঁছেই সবরকম রাজনৈতিক কাজ নিষিদ্ধ করার কাগজে দস্তখত করতে হয়। যদিও এই সময়টাতে এঙ্গেলস মার্কসকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। ছবিতেও সেটা আমরা দেখি। এদিকে লীগের এক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্যে এঙ্গেলস তাকে লণ্ডন যাবার জন্যে আমন্ত্রণ জানালে ১৮৪৬ এ মার্কস সেখানে যোগ দেন। সম্মেলন শেষে এঙ্গেসলের বাবার এক বুর্জোয়া বন্ধুর সাথে মার্কসের উৎপাদন সম্পর্ক নিয়ে কথা হবার সময়, মার্কস যখন তাকে উৎপাদনের মুনাফা নিয়ে প্রশ্ন করেন, ভদ্রলোক উত্তরে বলেন, “দেখো উৎপাদনে বেশি খরচ হলে, মুনাফা থাকবেনা আর মুনাফা না থাকলে অর্থনীতিও থাকবে না এবং অর্থনীতি না থাকলে সমাজও থাকবেনা”। মুনাফার এই সংজ্ঞার বিপরীতে মার্কস একটা মাত্র বাক্য ছুড়ে দেন, “আপনারা যাকে মুনাফা বলেন, আমরা সেটাকে বলি এক্সপ্লয়টেশান” এই “এক্সপ্লয়টেশান” শব্দের মধ্যে দিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ কার্ল মার্কসের “পুঁজি” পুস্তকের একটা আভাস পেয়ে যাই। কিন্তু সেটা আর নিছকই ‘শোষণতত্ত্ব’ থাকে নি সম্মেলন শেষে মার্কস ব্রাসেলসে ফিরে আসেন, শ্রমিক আন্দোলন তখন ব্রাসেলসেও বেশ তীব্র আকারে দানা বাঁধা শুরু হয়েছে।
ঐ আন্দোলনের একটা পর্যায়ে মার্কসের সাথে পাভেল আন্নেকভের সাথে দেখা হয়, যার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরেই আমরা দেখি লীগে প্রুধোঁকে যোগদান করার তোড়জোড় শুরু করে মার্কস এবং এঙ্গেলস মিলে। প্রুধোঁ খুব কৌশলে ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে যান এবং তার বিখ্যাত “দারিদ্রের দর্শন” বইটা লেখেন, যে বই নিয়ে মার্কস পাভেলকে লেখা চিঠিতে প্রুঁধোর তীব্র সমালোচনা করে চিঠি লেখেন, যে চিঠির কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে ইয়াং হেগেলিয়ানদের সাথে মার্কস এবং এঙ্গেসের মতবিরোধ তীব্র হতে থাকে। যার একটা দীর্ঘ সিকোয়েন্সের মধ্যে দিয়ে নির্মাতা রাউল পেক অত্যন্ত সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। সেই বিতর্কের পর ইয়াং হেগেলিয়ানদের সাথে মার্কসের একরকম বিচ্ছেদ ঘটে যায়। শ্রমিক আন্দোলন এবং অন্যান্য নানা কারণে মার্কসকে শেষ পর্যন্ত ব্রাসেলসও ছেড়ে চলে যেতে হয়। আমরা জানি মার্কস শেষ পর্যন্ত লন্ডনে গিয়ে স্থায়ী বসবাস গড়েন। ১৮৪৭ এর নভেম্বরে লন্ডনের রেড লায়ন্স হোটেলে লীগের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানেই লীগের পুরো নাম, “কংগ্রেস অফ দ্য লীগ অফ জাস্ট” স্থির করার মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়ে যায়। সেই সম্মেলনে প্রুঁধোর লিখিতর ‘দারিদ্রের দর্শন’-এর পাল্টা জবাব আকারে, মার্কসের সদ্য প্রকাশিত ‘দারিদ্রের দর্শন’ পাঠ করে সবাইকে শোনানো হয়।
১৮৪৮ এর জানুয়ারি মাসের কোন এক সুন্দর দিনে মার্কস এবং এঙ্গেলস তাদের পরিবার নিয়ে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়ে দুই বন্ধু মিলে স্থির করে পার্টির জন্যে একটা ইশতেহার তৈরি করা খুব জরুরি। ছবি প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে আসে। পরের দৃশ্যে আমরা দেখি বিশাল একটা টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইপত্র, কাগজপত্রের মাঝে বসে মার্কস, এঙ্গেলস, জেনি এবং লিজি তুমুল গবেষণারত অবস্থায় আছে। কার্ল লেখেন সেই বিখ্যাত প্রথম বাক্য, “ইউরোপ ভূত দেখছে —– ”। শুরু হয়ে গেল লেখা “ম্যানিফেস্টো অফ দ্য কমিউনিস্ট পার্টি”। ধারাভাষ্যে শোনা যায়, ইশতেহার লেখার এক মাস পরেই ১৮৪৮ এর বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে, ভবিষ্যতে এই কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো বহু পঠিত এবং অনুদিত হবে, এমনকি আমাদের এই কাল পর্যন্ত।
আর কার্ল মার্কস ভবিষ্যতে তার বিখ্যাত ‘পুঁজি’ গ্রন্থটা লিখবেন। ছবি শেষ হয়।
লেখক পরিচিতি:
ফ্লোরা সরকার
অর্থনীতির অধ্যাপক (অর্থনীতি), অভিনয় শিল্পী ও লেখক। শিল্প-সংস্কৃতির নানা বিষয়ে লেখালেখি করেন। বিশেষত চলচ্চিত্র। সমাজ, রাজনীতি ও দর্শনে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। ‘চিন্তা পাঠচক্র’র সক্রিয় সহযোদ্ধা। যুক্ত রয়েছেন ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার সঙ্গেও।
অসামান্য ❣️