।। বিশ্বেন্দু নন্দ ।।
এই পর্বের ‘কেতাবি’ বিভাগে থাকছে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ব্যক্তিগত সচিব চন্দির ভান ব্রাহ্মণের ‘সাহিত্যকর্ম’, জীবনবৃত্তান্ত ও সেই সুত্রে তাঁর সমসাময়িক মুঘল শাসন ব্যবস্থার অন্তর্জগতের পর্যালোচনায় রাজীব কিনরার বই ‘রাইটিং সেলফ, রাইটিং এম্পায়ার- চন্দর ভান ব্রাহ্মণ এন্ড দ্য কালচারাল ওয়ার্ল্ড অব ইন্দো-পারসিয়ান স্টেট সেক্রেটারি’-এর পাঠপ্রতিক্রিয়া। লিখছেন অনুবাদক, প্রাবন্ধিক বিশ্বেন্দু নন্দ।
‘রাইটিং সেলফ, রাইটিং এম্পায়ার
-চন্দর ভান ব্রাহ্মণ এন্ড দ্য কালচারাল ওয়ার্ল্ড অব ইন্দো-পারসিয়ান স্টেট সেক্রেটারি’র পাঠপ্রতিক্রিয়া
রাজীব কিনরা অসাধারণ প্রায় দিকউন্মোচনী প্রচেষ্টায় আলোচনা করেছেন শাহজাহানের ব্যক্তিগত সচিব চন্দির ভান ব্রাহ্মণের জীবনকৃতি ও তাঁর সময় নিয়ে। ‘রাইটিং সেলফ, রাইটিং এম্পায়ার– চন্দর ভান ব্রাহ্মণ এন্ড দ্য কালচারাল ওয়ার্ল্ড অব ইন্দো-পারসিয়ান’ স্টেট সেক্রেটারি বইতে। মুঘল ইতিহাস চর্চায় চন্দর ভান ব্রাহ্মণের জীবন এবং কাজের গুরুত্ব অসামান্য। তিনিই অন্যতম উচ্চপদস্থ আমলা মুনসি, একাদিক্রমে দুজন (এবং কিছুটা জাহাঙ্গিরের সময়েও) মুঘল সম্রাটের প্রশাসনে কাজ করেছেন। মুঘল আমল নিয়ে যত কুকথা রটেছে ‘ঐতিহাসিক’ মহলে সে সবগুলিকে কিছুটা করেও আমরা ফিরে দেখতে পারি তাঁর সময়কাল এবং তাঁর জীবনী আলোচনায়। মুঘলদের অসহিষ্ণুতা, বেলেল্লাপনা, ধর্মান্ধতা ইত্যাদি অভিযোগ বিচারের অন্যধরণের প্রেক্ষিত পেয়ে যাই। চন্দর ভান ঐতিহাসিক নন, কিন্তু তাঁর রচনায় সময়ের অনপনেয় ছাপ লক্ষ্য করি। চন্দর ভান ফারসিতে লিখেছেন দরবারি স্মৃতিকথা ‘চাহার চমন’ (চার বাগান), বিভিন্ন জনকে লেখা ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ‘মুনশতইব্রাহ্মণ’– যে সংকলনে রয়েছে সম্রাট থেকে সাধারণ মানুষকে লেখা নানান কিসিমের চিঠি। কবি চন্দর ভানের লিখন শৈলী (ইনশা) কয়েক প্রজন্মের আদর্শ ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষে, অবসরের প্রায় দেড়শ বছর পরে ১৭৯৫ সালে, ফ্রান্সিস গ্লাডউইন রচিত এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত প্রাচ্যবিদদের অবশ্যপাঠ্য ফারসি পুস্তক, ‘দ্য পারসিয়ান মুন্সি’তে ‘চাহার চমন’ উদ্ধৃত হয়েছে।
‘চাহার চমন’ এবং ‘মুনশতইব্রাহ্মণ’-এ চন্দর ভান বিশদে ইন্দো-পারসি প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব চরিত্র ইত্যাদি বিষয়েই শুধু লেখেননি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, শিল্প সৃজনের সামাজিক মূল্য, জন জীবনে সাহিত্য, অতীন্দ্রিয়বাদের গুরুত্ব, জনজীবনকে আরও ভালভাবে সেবা দেওয়ার জন্য মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসনে কী কী পরিবর্তন আনা দরকার সে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও যথাযোগ্য মন্তব্য করেছেন। মুন্সি, উজির এবং প্রশাসকেরা তাঁদের কৃষ্টিগত ভূমিকা এবং নৈতিক দায় দায়িত্ব জানতে বুঝতে ইন্দো-পারসি কবিতা এবং নসিহত-নামা আঙ্গিকের যে সব পরামর্শ সাহিত্য জাতীয় পুঁথি অনুসরণ করতেন, ‘চাহার চমন’ সেগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুসরণযোগ্য ছিল।
সম্রাট শাহজাহানের ব্যক্তিগত সচিব এবং দিনপঞ্জী লেখক(ওয়াকিয়ানবিশ) হিসেবে কাজ করার দরুণ, রাজ পরিবারের সদস্যদের গৃহস্থি, দরবার এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম ইত্যাদি বিষয়ে অসামান্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন চন্দর ভান। দরবারে কাজের সুবাদে দরবারি রাজনীতি, বিভিন্ন মুঘল অভিজাতের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কও দেখেছেন, দৌত্য এবং সামরিক অভিযানগুলিতে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতাও লিখেছেন। চাহার চমনে বিশ্লেষণ করেছেন রাজা টোডরমল্ল, আফজল খান শিরাজি, সাদুল্লা খান অথবা রাজা রঘুনাথের মত উচ্চপদস্থ আমলা হয়ে উঠতে গেলে কি ধরণের কৃষ্টিগত এবং প্রশাসনিক দক্ষতার মিশেল থাকা প্রয়োজন তার গুঢ় তত্ত্ব। তিনি বলেছেন প্রশাসনিক সাফল্য শুধু সামরিক কর্তৃত্বে (ইমারত) তৈরি হয় না, সঙ্গে জুড়তে হয় প্রশাসনিক দক্ষতা(উজিরত) এবং গভীর অতীন্দ্রিয়বাদ এবং সাহিত্যিক সংবেদনশীলতা (মারিফত) এবং স্ব-স্বার্থের ওপরে উঠে গভীরভাবে জনকল্যানকর্মে নজরদারি। উপনিবেশ বিরোধী চর্চায় চন্দর ভানের গুরুত্ব মুঘল সময়ের একটি বিশেষ সময়ের ইতিহাস পুনর্লিখনে। এই কাজটা জরুরি কারণ ঔপনিবেশিক ইতিহাস আকবর এবং দারাকে বাদ দিয়ে সামগ্রিক মুঘল সময়কে বন্ধ্যা, ধর্মান্ধদের কাছে আত্মসমর্পণের ইতিহাস হিসেবে বর্ণনা করে। রাজীব কিনরা দেখান একজন অমুসলমান পৈতে পরিহিত মুন্সি, নামের শেষে গর্বিত ব্রাহ্মণ শব্দটি যুক্ত করেও তথাকথিত মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণকারী সম্রাটের দরবারে উচ্চপদে এবং সম্রাটের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ করতে পারেন দীর্ঘকাল।
ভারত ইতিহাসের উপনিবেশিক কাঠামোর বয়ান জাহাঙ্গীর থেকে আরঙ্গজেব পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যে ইসলামিক মৌলবাদেরই পদধ্বনি শোনা গিয়েছে। কিন্তু এই তথ্য কতটা সঠিক? যদি আমরা ধরেই নিই, আকবরের সময়ের পর থেকে মুঘল সম্রাটদের ভাবনায় মৌলবাদ জাঁকিয়ে বসেছে, দরবারে গোঁড়া মৌলবিদের প্রভাব বাড়ছে এবং ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হচ্ছে, তাহলে কেন দরবারে কাজ করা প্রখ্যাত আমলার লেখায় সে বিষয়ে ইঙ্গিতটুকুও নেই? শুধু তাই নয়, ঔপনিবেশিক ইতিহাস বর্ণিত আপাত গোঁড়ামির সময়েই কিন্তু অন্যান্য মুসলমান আমলার মতো ব্রাহ্মণ চন্দর ভানের সঙ্গে সঙ্গে রাজা রঘুনাথের মতো মুন্সির পদন্নোতি ঘটছে এবং আমলাতন্ত্রে অমুসলমানেদের সংখ্যা বাড়ছে! রিচার্ড ঈটন জানাচ্ছেন, মুঘল আমলে ‘হাজার হাজার’, কারোর কারোর মতে ৬৪ হজার মন্দির ভাঙার ইতিহাস গালগল্পই। ধর্মীয় বিদ্বেষে কোনো মন্দির ভাঙ্গেনি এমন নয়, কিন্তু মন্দির মসজিদ ভাঙা ছিল ভারতীয় রাজাদের আগ্রাসী রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার। অড্রে ট্রুস্কে আওরঙ্গজেবের জীবনী রচনা করে যে ঐতিহাসিক কাজ করেছেন, ঠিক সেই দৃষ্টিতে রাজীব কিনরা চন্দর ভানকে সামনে রেখে, আরও গভীরে গিয়ে সে সময় নিয়ে ওঠা নানান ‘ঐতিহাসিক সত্য’ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছেন। সেই মুক্ত দৃষ্টির ইতিহাস চর্চাতেই পূর্বজকৃত পাপ অপনোদন এবং ইতিহাসের ঋণ শোধ হবে।
রাজীব বলছেন, “Perhaps there is some kernel of truth to all this conventional wisdom. But if post-Akbar Mughal society really did witness such a “revival of a strident এবং uncompromising Islam,” then wouldn’t we expect to see at least some evidence of it in the testimony of a prominent Hindu who lived through this period? Would we not expect a Brahman like Chandar Bhan, who spent the better part of five decades interacting daily with Muslims in Mughal politics, administration, এবং society, to show at least some indication that he felt threatened by the “much more orthodox Muslim stance” of Akbar’s successors, harried at every turn by the growing influence of “conservative clerics . . . pushing non-Muslims [like him] to convert”? Wouldn’t the “social division এবং cultural insularity” of such a “re-Islamized Mughal society” make it impossible for a high-caste Hindu to move up the social ladder এবং forge such amicable professional relationships with so many Muslim denizens of the court, much less earn considerable literary fame among those very same networks? century suggests a rather different interpretation of the post-Akbar period. It may be just one voice, but it is a powerful one, এবং while Chandar Bhan’s life এবং experience by themselves may not be enough to undo generations of scholarly conventional wisdom, they will definitely force us to ask some hard questions concerning what we really know about the period”।
শুলইকূল, সহাবস্থানের নীতি গ্রহণের ফলে চন্দর ভানেদের মত মধ্যবিত্ত আমলার উথান এবং বিকাশ সহজ হয় এবং তাঁর জীবন এবং কাজকর্মের মধ্যে মুঘল আমলের বহুত্ববাদ, বৈচিত্রচর্চার স্পষ্ট আভাস পাই। চন্দর ভান ছিলেন সংস্কৃত শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ পরিবারের বংশপরম্পররার করণিক। তাঁর সামাজিক পরিচয় কিন্তু মুঘল রাজত্বের উচ্চপদ পেতে এবং পদন্নোতি ঘটার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়নি। মুঘল আমলাতন্ত্রে তাঁর পারিবারিক প্রতিনিধিত্ব ছিল। পিতার পরে চন্দ্র ভান, চন্দর ভানের তাঁর দাদা, চন্দর ভানের পুত্র সন্তানদের অমুসলমান পরিবেশে বড় হয়ে, পারিবারিক এবং ধর্মীয় চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখে মুঘল রাজত্বের প্রশাসনিক বিভাগে প্রবেশ করে ধ্রুপদী মুঘল কৃষ্টি আত্মীকৃত করতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি। নিউ কেম্ব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ার প্রথম খণ্ডের পঞ্চম পর্বে মুঘল রাজত্ব বিশ্লেষণে মুঘল বিশেষজ্ঞ জন এফ রিচার্ডস মুঘল প্রশাসনের স্বর্ণ সময়ে দাপিয়ে কাজ করা মুন্সি চন্দর ভানের মতো অমুসলমান আমলাদের গিরগিটি চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করছেন। তাঁর অভিযোগ, এই আমলারা আত্ম-চরিত্র বিসর্জন এবং আত্মসমাজের পরিচয় অবলুপ্ত করে মিশে যেতেন মুসলমান রাষ্ট্রে।
চন্দর ভান এবং অন্যান্য প্রখ্যাত মুন্সির জীবন কর্ম আলোচনা করতে গিয়ে রাজীব জন এফ রিচার্ডসের তত্ত্বের মৌলিকত্বটিকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তাঁরা কেউই চাকুরি এবং সাহত্যিক জীবনে ব্রাহ্মণ বা তাদের কৌলিন উপাধি এবং জাতিগর্ব বিসর্জন দেন নি। এঁরা অমুসলমান(হিন্দু) জেনেই সাহিত্যিক, প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকেরা, তাঁদের সঙ্গে সজ্ঞানে কাজ করেছেন এবং তাঁদেরকে সেইভাবেই গ্রহণ করেছেন। তাঁদের ধর্মমত পরিবর্তনের চেষ্টার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কোনও ইঙ্গিত, ধর্মমত পরিবর্তনের কোনও চাপ সৃষ্টিরও ইঙ্গিত পাচ্ছি না। পদন্নোতির জন্যে তাঁরা ধর্মমত লুকোননি সেটাও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। দক্ষিণ এশিয়ার উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসে অমুসলমানেদের ধর্ম পরিবর্তন করানোর অভিযোগে মুঘল রাজত্ব বার বার নিন্দিত হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক মেট্রোপলিটনিয় ঐতিহাসিকদের কাজে। সেই নিন্দিত রাজত্বে চন্দ্রর ভানের মতো মুনসির উত্থান চোখ ধাঁধানো প্রায়। আগেই বলেছি চন্দর ভান ব্রাহ্মণ পাঞ্জাবের এক সাধারণ আমলা ঘরের সন্তান। করণিক হিসেবে মুঘল প্রশাসনে কাজ শুরু করেন। শাহজাহানের সময় তিনি অভিজাততম মুন্সি পদ অলঙ্কৃত করেন। ইতিমধ্যে তিনি সরকারিস্তরের বিভিন্ন পদে বিশেষ করে সম্রাটের ব্যক্তিগত সচিব এবং পঞ্জিকারক্ষক বা ওয়াকিয়ানবিশ হয়েছেন। ব্রাহ্মণ উপাধি নিয়েই, চন্দর ভান মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষমতা এবং প্রভাবের স্বর্ণ শিখরে অবস্থান কালে অবাধে সম্রাটের শোবার ঘরে, তাঁর গৃহস্থালিতে, দরবারি সমাজের অভ্যন্তরে, মুঘল প্রশাসনের হৃদিঅক্ষে প্রবেশ করেছেন।
মুঘল প্রশাসনে বহু অমুসলমানই ছিলেন। আওরঙ্গজেবের সময় অড্রে ট্রুস্কের হিসেবে সংখ্যাটা ৩৩%। তাঁদের মধ্যে অনেকে লেখালিখিও করে বিখ্যাত হয়েছেন চন্দর ভানের মতো। তাঁর ‘চাহার চমন’-এর মতো সাহিত্যকর্ম অথবা ‘মুনশতইব্রাহ্মণ’-এর মতো ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের সংকলনে মুঘল সাম্রাজ্যের অনন্য হৃদি-অক্ষের পরিচয় পাই। ‘চাহার চমন’ যে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মানুষকে প্রভাবিত করেছিল তার প্রমান পাই পাকিস্তান হয়ে বাংলা হয়ে আজকের বাংলাদেশ এবং বিশ্বের বহু দেশে বইটির নকল পাওয়া যাওয়ায়। বিশেষ আঙ্গিকের গদ্য রচনা, ইনসা নামক মুন্সি সাহিত্যিক কর্মটি সে সময়ের আমলাতন্ত্রে কাজের স্বপ্ন দেখা যুবাদের অনুকরণীয় আঙ্গিক ছিল। মুঘল আমল অন্তে কোম্পানির দক্ষিণ এশিয় আমলাদের শিক্ষার জন্যে ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন বইটি ‘দ্য পার্সিয়ান মুনসি’ শীর্ষকে ১৭৯৫তে প্রকাশ করেন। চন্দর ভান মুঘল প্রশাসকদের পরিচয়, বিভিন্ন দৌত্যকার্য এবং সামরিক অভিযানের বর্ণনা অসামান্য পারসিক গদ্যেই লেখেননি, তিনি এর সঙ্গে বিশদে আমলাতন্ত্রের দার্শনিক জায়গাটুকুও আলোচনা করেছেন, বিশেষ করে একজন মুনসির কাছ থেকে মুঘল সাম্রাজ্য কী চাইতে পারে, সেটাও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন সাহিত্যকৃতির মাধ্যমে। চন্দর ভানের সফল জীবনকর্ম শুধু ব্যক্তিগত উত্থানের গল্প বলে না, তাঁর সঙ্গে জুড়ে থাকেন এক ঝাঁক ইন্দো-পারসিক মুনসির সফল উত্থানের গল্প। তাঁর লেখায় আমরা পাই রাজা টোডর মল্ল(প্র ১৫৮৯), আফজল খান শিরাজি(প্র ১৬৩৯), সাদুল্লা খান(প্র ১৬৫৬) এবং রাজা রঘুনাথের(প্র ১৬৬৪)মত উচ্চপদস্থ আমলাদের প্রশাসনিক দক্ষতা এবং দূরদর্শিতার বর্ণনা। তিনি উজিরদের কাজে সামরিক দক্ষতা বা ইমারতের সঙ্গে প্রশাসনিক দক্ষতা বা উজিরত মিলিয়ে, ব্যক্তিগত স্বার্থের ওপরে উঠে সর্বজনসুখের আধ্যাত্মিক বা মারিফত লক্ষ্য নির্দিষ্ট করতে বলছেন।
এইটুকু বলব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী তাত্ত্বিকেরা মুঘল প্রশাসন বুঝতে তার লেখার আশ্রয় নিয়ে তাঁর সাহিত্যকে গুলদস্তা (ফুলের একটা তোড়া যা চাহার চমন বা চারটি বাগান থেকে তোলা) ‘কোয়াইদলসুলতানত’ (প্রশাসনিক মূল নীতিসমূহ) নাম দিয়েছিলেন। ‘চাহার চমন’-এ তিনি শুধু শাহজাহানাবাদের শহরের বাজার, বাগান, চাঁদনি চক ইত্যাদির রূপ রস গন্ধ বা আজকের পুরোনো দিল্লি, বৃহত্তর দিল্লি, আজকের নিজামুদ্দিন নিয়েই আলোচনা করেননি, তিনি কখনো বিশদে গল্প করার ঢঙে আবার কখোনো চুম্বকে কয়েক বাক্যে মুঘল রাজত্বের মূল শহরগুলি যেমন আগরা, লাহোর, মুলতান, কাশ্মীর, কাবুল, থাট্টা, আহমেদাবাদ, দক্ষিণ, মালওয়া, আজমেঢ়, আবধ, এলাহাবাদ, বিহার, বাংলা, ওডিসা, কান্দাহার, বলখ এবং বাদকশনের বেশ কিছু শহর নিয়ে আলোচনা করেন। কাশ্মীর থেকে পাঞ্জাবে ফেরার পথে তিনি শাহজাহানের সঙ্গে শেখ মিঞা মীরের সাক্ষাৎকার বিশদে বর্ণনা করেন। চাহার চমনকে সুনীল শর্মা(শেলডন পোলকের সম্পাদনায় Forms of Knowledge in Early Modern Asia_ Explorations in the Intellectual History of India and Tibet, 1500–1800 সুনীল শর্মার প্রবন্ধ “If There Is a Paradise on Earth, It Is Here”: Urban Ethnography in Indo-Persian Poetic and Historical Texts) বর্ণনা করেন সে সময়ের আরবান এথনোগ্রাফি হিসেবে যা পরের দিকের সাহিত্য দরগা কুলি খানের মুরাক্কাইদিহলির সঙ্গে তুলনীয়। তিনি একটা অসামান্য কাজ সেরে যান যা পরের দিকের ইতিহাসকারেরা এই সময় বুঝতে এটিকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেন।
মুঘল আমল বুঝতে, দক্ষিণ এশিয়ায় মুঘল আমলের সময় বুঝতে চন্দর ভাব ব্রাহ্মণের জীবন আমাদের অন্যতম সহায়ক হয়। রাজীব কিনরাকে কৃতজ্ঞতা জানাই যে তিনি এই মানুষটার জীবনকৃতি রচনা করে আমাদের এক অসামান্য ধরতাই ধরিয়ে দিয়েছেন।