।। হাসান রোবায়েত ।।
*
কখনো বন্ধুবাড়ি গিয়ে
নিরলে পুছেছো, মরমিয়া
‘যে হাত ছুঁয়েছি একদিন
সে ছিল সুন্নি নাকি শিয়া—?’
তোমার জামের ফুলে রোদ
খাঁখাঁলীন বুকের হাওয়ায়
সারারাত ভেজে পৃথিবীতে
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়—
আমার গানের কথা বাকি
আজো একা আঙিনায় নিম
দাও নি মেঘের ছায়া যাকে
সে ছিল শুধুই মুসলিম—
*
কাউকে বোলো না তুমি আমাদেরও কথা হয়েছিল
হয়েছিল দেখা যেন, সান্দ্র সে দূরের কোথাও
গ্রিলের জানালা ধরে দুপুরের সেই রূপছায়া
সমস্ত খাঁখাঁ নিয়ে জলে ছায়া ফেলে চলে যাও—
তুমি যে বিষের পাশে রেখে ছিলে জলভরা গ্লাস
এমন বাগানে টানো যেখানে গাছের ছায়া নাই
পাখি জানে, সঙ্গিনী উড়ে গেলে তার কী যে হয়—!
বাতাসে ঘুমিয়ে পড়ে কবরের দূরে মরা ঘাস—
ফারসি ভাষার মতো তোমার দু চোখে কী যে মায়া—!
হিন্দুর মেয়ে তুমি, আমারও ধর্মে ছিল ভয়
আমার আঙিনা ফাঁকা থেকে গেল চিরকাল—দূরে
পা টিপে চলার মতো বৃষ্টি পড়ছে মনে হয়—
মানুষ যে কাকে চায়, কাকে করে বুকের মানিক
কার জন্যে ডুবে মরে, আজীবন কাকে দেয় ধিক—
*
সান্দ্র হাওয়া যাকে নিয়ে আসে
তাকে কি চাই আমি—? ভুলে গেছি—
সোনার সূর্যতে পাকে গম
সান্দ্র হাওয়া তাকে নিয়ে আসে
তারার সৌরভ কবে শেষ
লুপ্ত বাতাসেও ঝরে ফুল
সান্দ্র রাত যাকে নিয়ে আসে
তাকে কি চাই আমি—? ভুলে গেছি—
*
কোথাও মাঠের মধ্যে একাকী ট্রেন
কতকাল ধরে ভিজতেছে বৃষ্টিতে
জানালায় লেখা শিশুদের ডাকনাম
মরে গেছে যারা পয়তাল্লিশ-শীতে—
তবু ফ্লেমিঙ্গো উড়ে যায় পূরবীতে—
বরফে আচ্ছাদিত পাইনের গাছ
ঘুম-সুমসাম দুপুরের হিম-দূরে
আকাশে নিভছে রোদ্রের পাখোয়াজ
আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির পাতা উড়ে—
তবু যায় দিন উইন্ডমিল ঘুরে ঘুরে—
বেগুন ফুলের মতো হাওয়া এসে কাঁপে
বনপথজুড়ে হার্ট অব ডার্কনেসে
কেন ভুলে যাও, সিরিয়ার শিশুটারও
ছিল বাদামের বন তার গ্রামদেশে—
পানি কেটে কেটে চলে প্রপেলার শেষে—
আজো যে ভূগোল লাশবাহী বেদনার
ভূমিজরিপের কম্পাসকাঁটালীন
গ্রেনেডের খোলে গভীর জোৎস্না পড়ে
জলপাইফুলে ফুটছে ফিলিস্তিন—
তবু ঝিনাইয়ে যায় ভেসে যায় দিন—
হাওয়া চেনে নাই ঘুমন্ত ডালগুলো
এলিয়ে পড়ছে ইহুদি পাতার পাশে
পশ্চিম মেঘে অরণ্য পুড়ে যায়
কারো দেশ ছিল পপির শিশিরে, ঘাসে—
শুনো ডাকঘর আজো তবু চিঠি আসে—
তারা সমুদ্রে ভেসে গেছে একদিন
তার চলে গেছে মার রুটি পিছে ফেলে
তাদের মাতৃভূমি ছিল শুধু, পা—
আজও হাঁটতেছে, মুসলমানের ছেলে
আজো বেল বাজে আব্বার সাইকেলে—
আজো কুয়াশায় ঝিলমের থেকে দূরে
সেই ট্রেন আর হুইসেল থেমে আছে
হলোকাস্টের বদলেছে পরিচয়
বৃষ্টি পড়ছে কতকাল ওক গাছে—
তবু গমখেত পেকে ওঠে এস্রাজে—
আজো পশ্চিমে টারবাইনের রোদে
ঘোরে সালফার মেঘে ফিশানের ভঙ্গি
ফেলে নিউট্রন আমেরিকা ইয়োরোপ
নারঙ্গী-হাওয়া ভীত কাঁপে, শোনো, সঙ্গী
আমাকেই শুধু বলবে তুমিও জঙ্গি—?
*
আমার দাদা ছিলেন মোহাম্মাদী, আব্বাও—একটু সুন্দর ভাষায়, যেখানে সমুদ্রের দূরত্বকে বলা হয় নিঃসঙ্গ সাঁতার, সে ভাষা অনুযায়ী তারা ছিলেন আহলে হাদিস—তখন যমুনায় মাঝেমধ্যেই ভেসে আসতো নির্জন শালের কাঠ, হয়তো কারোর চিতার থেকে দূরে আগুনের সমস্ত নৈঃশব্দ্যকে খান খান করে পৃথিবীপাড়ের কোনো ছায়ায় চলে যেত তারা—আমার দাদী প্রায়ই বলতেন—‘মানুষের যাত্রা শেষ হয় না কোনদিনই, এই যে চিতার কাঠ, নিষ্পলক আলমারি, কাপড়ের পুরনো ভাঁজে ভাঁজে ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ, এখানেও কি ঘ্রাণ লেগে নাই তারও—?’
তারপর, জলপাইবাগানের হাওয়ায় একদিন ভেঙে গেল সব—গৃহবাড়িঘর, গরুর পালান ভরা দুধ, খেসারির সান্দ্র বিতান—আশ্বিনের সন্ধ্যার মতো তৃণপ্রান্তর পার হয়ে দাদারা চলে এলেন অন্য গাঁয়ে, সে গাঁয়ের মসজিদে জোরে আমিন বলার অপরাধে তাদেরকে বের করে দিয়েছিল মুসল্লিসমাজ—তখন সমস্ত হাওয়ায় থমথম করছিল তৌহিদী জনতার মতো মেঘ—
বাইরে বৃষ্টির মতো আকাশ, যেন বহুকাল ধরে ভিজতে থাকা একাকী স্টেশনের দূরে একটি গাছ কুয়াশার জীর্ণতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে—এমন বি¯্রস্ত দিনে আমাদের গ্রীষ্মরাত্রি ম্লান হয়ে আসে ধীরে—কোথাও কাদিয়ানীরা নামাজ পড়ছে পুলিশের ছায়ায়, কার্তিকের হলুদ পাতা উড়ে যাচ্ছে পোস্টঅফিসের দিকে—কী যেন পড়তে পড়তে দাদা বলে উঠলেন, ‘কাদিয়ানীরা অবশ্যই মুসলমান নয়’—বিজন পোস্টবাক্সের লাল ক্রমশ রক্তাভ হতে হতে মিশে যাচ্ছে গমখেতের ছায়ায়—
তল্লাবাঁশের বেড়ায় আমাদের মসজিদ, সেপারার পাতায় ঘুমানো রোদ, আমার হানাফী মায়ের করা মহররমের রুটি প্রতিদিন উড়ে যেতে যেতে সুবিল-তালতলা-ধরমপুর পার হয়ে মিশে যাচ্ছে কতদূর সালাফীরোদের পাশে—তোমাকে, এসব নাও বলা যেত—অথচ, কুশারের পাতায় যে রোদ প্রতিদিন ধুয়ে দিত সরলিয়ার আওয়াজ, চিতার কাঠে বানানো আমাদের আলমারি, সেখানে পড়ে আছে স্তব্ধতার বিল—আমি যাকে প্রতিদিন ডেকে উঠি ‘মুসলমানের ছেলে’—
তারপর, জলপাইবাগানের হাওয়ায় একদিন ভেঙে গেল সব—গৃহবাড়িঘর, গরুর পালান ভরা দুধ, খেসারির সান্দ্র বিতান—আশ্বিনের সন্ধ্যার মতো তৃণপ্রান্তর পার হয়ে দাদারা চলে এলেন অন্য গাঁয়ে, সে গাঁয়ের মসজিদে জোরে আমিন বলার অপরাধে তাদেরকে বের করে দিয়েছিল মুসল্লিসমাজ—তখন সমস্ত হাওয়ায় থমথম করছিল তৌহিদী জনতার মতো মেঘ—
বাইরে বৃষ্টির মতো আকাশ, যেন বহুকাল ধরে ভিজতে থাকা একাকী স্টেশনের দূরে একটি গাছ কুয়াশার জীর্ণতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে—এমন বি¯্রস্ত দিনে আমাদের গ্রীষ্মরাত্রি ম্লান হয়ে আসে ধীরে—কোথাও কাদিয়ানীরা নামাজ পড়ছে পুলিশের ছায়ায়, কার্তিকের হলুদ পাতা উড়ে যাচ্ছে পোস্টঅফিসের দিকে—কী যেন পড়তে পড়তে দাদা বলে উঠলেন, ‘কাদিয়ানীরা অবশ্যই মুসলমান নয়’—বিজন পোস্টবাক্সের লাল ক্রমশ রক্তাভ হতে হতে মিশে যাচ্ছে গমখেতের ছায়ায়—
তল্লাবাঁশের বেড়ায় আমাদের মসজিদ, সেপারার পাতায় ঘুমানো রোদ, আমার হানাফী মায়ের করা মহররমের রুটি প্রতিদিন উড়ে যেতে যেতে সুবিল-তালতলা-ধরমপুর পার হয়ে মিশে যাচ্ছে কতদূর সালাফীরোদের পাশে—তোমাকে, এসব নাও বলা যেত—অথচ, কুশারের পাতায় যে রোদ প্রতিদিন ধুয়ে দিত সরলিয়ার আওয়াজ, চিতার কাঠে বানানো আমাদের আলমারি, সেখানে পড়ে আছে স্তব্ধতার বিল—আমি যাকে প্রতিদিন ডেকে উঠি ‘মুসলমানের ছেলে’—
প্রচ্ছদের ফটোগ্রাফ: মোহাম্মদ রোমেল
হাসান রোবায়রেত
জন্ম ১৯ আগস্ট, ১৯৮৯; বগুড়া। শিক্ষা : পুলিশ লাইন্স হাইস্কুল, বগুড়া। সরকারী আজিজুল হক কলেজ; বগুড়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত বই — ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৬] ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে [ভারতীয় সংস্করণ, বৈভাষিক, ২০১৮] মীনগন্ধের তারা [কবিতা; জেব্রাক্রসিং, ২০১৮] আনোখা নদী [কবিতা; তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৮] এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে [কবিতা; ঢাকাপ্রকাশ, ২০১৮] মাধুডাঙাতীরে [কবিতা; ঐতিহ্য, ২০২০] ই-মেইল : hrobayet2676@gmail.com