ফ্লোরা সরকার
মাইকেল মুরের ‘ফাহরেনহাইট নাইন ইলেভেন’ ছবির শুরুতে টুইন টাউয়ারে দ্বিতীয় প্লেনটা যখন আঘাত হানে, তখন ফ্লোরিডার একটা স্কুলে অবস্থানরত প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে তার নিরাপত্তা বাহিনীর একজন লোক এসে, ‘নেশন ইজ আন্ডার অ্যাটেক’ বলে খবরটা দিলে, বুশ সাত মিনিট চুপচাপ বসে যে ভাবনাগুলো ভেবেছিলেন, সেই ভাবনার ভেতরেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের বীজ রোপিত হয়ে গিয়েছিল। সারা ছবির এই সাত মিনিট আমরা বলবো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সাত মিনিটে একবিংশ শতাব্দীর দুর্বিসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাস রচিত হয়ে গিয়েছে। ম্যাজিক রিয়ালিজম উপন্যাসের মতো প্রেসিডেন্ট বুশ এই সাত মিনিটে ভবিষ্যত পৃথিবী রচনা করে ফেলেন। কী অসাধারণ তার দক্ষতা ! তবে আমামদের বোঝাবুঝির সবটা কৃতিত্ব পরিচালক মাইকেল মুরের। তিনি যদি এই সাত মিনিটের ফুটেজকে গুরুত্ব না দিতেন, আমরাও কখনো এর গুরুত্ব বুঝতে পারতাম না। ছবির শেষটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিষয়ে আমরা পরে আসবো। তার আগে দেখবো, মাইকেল মুর একটা প্রামাণ্যচিত্রকে কীভাবে নানান বাস্তব চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে কাহিনীচিত্রে রূপান্তরিত করেছেন।
ছবিটা শুরু হয়েছে ২০০০ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দিয়ে। যে নির্বাচনে নিশ্চিত বিজয়ী প্রেসিডেন্ট অ্যালগোরকে হারিয়ে দিয়ে বুশ প্রেসিডেন্ট হলেন। প্রশ্ন হলো, পরিচালক মুর, কেন এই সময় থেকে তার ছবি শুরু করেন। যেহেতু ছবিটা টুইন টাউয়ারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত, কাজেই সেখান থেকে শুরু না করে কেন তারও আগে থেকে শুরু করলেন। বির্তকের মধ্য দিয়ে বুশ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, এমনকি তার শপথ নেয়ার দিনও জনগণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। এই বিষয়গুলো ভবিষ্যত বুশ যে কত কত অঘটন পটিয়সি হবে তারই একটা ইঙ্গিত। মুর এই বিষয়গুলো তাই ডকুমেন্টারির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিশাবে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। শুধু তা-ই নয়, প্রেসিডেন্ট পদে বসেই বুশ চলে গেলেন ভ্যাকেসান অর্থাৎ ছুটিতে। তার ছুটি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, উল্টো বুশ জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কি জানো কাজ কাকে বলে’? একজন নিশ্চিন্ত, হাস্যোজ্জ্বল বুশকে আমরা দেখি এই সময়ে। এমন আদমি যিনি মাছ ধরে গাছ কেটে আর গল্ফ খেলে হেসেখেলে জীবনটা কাটান। এরপরেই আমরা দেখি, বুশ থেকে শুরু করে, কন্ডোলিসা রাইস, ডোনাল্ড রাম্সফেল্ড, ডিক চেনি প্রমুখ আমেরিকান সর্দাররা মেকআপ নিয়ে কোনকিছুর জন্য তৈরি হচ্ছেন। মেকআপের এই বিষয়টিও ছবির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই মেকআপের মধ্যে দিয়েই ছবির নামগুলো পর্দায় উঠতে দেখা যায়। তারপরেই কালো পর্দার উপর টুইনটাওয়ার বিস্ফোরণের বিকট শব্দগুলো শোনা যায়। শোনা যায় মানুষের চিৎকার ইত্যাদি। বুশকে তখন আমরা পাই ফ্লোরিডার স্কুলে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সাত মিটিটের সময়কে কেন্দ্র করে পরিচালক মাইকেল মুর ধারাভাষ্যের মাধ্যমে দর্শকের কাছে কতগুলো প্রশ্ন রাখেন:
– কি ভাবছিলেন তখন প্রেসিডেন্ট বুশ ? কাউন্টার টেরারিজমের কথা ?
– কিছুদিন আগে এফ.বি.আই. ( ফেডারেল বুরো অফ ইনভেস্টিগেশন ) এর তহবিল থেকে টেররিজম বা সন্ত্রাস দমনের জন্যে যে তহবিল রাখা হয়েছিল তার সংকোচনের কথা ?
– ২০০১ এর ৬ আগস্টে, নিরাপত্তা বাহিনীর বরাত দিয়ে তাকে সাবধানতার করা হয়েছিল, ওসামা বিন লাদেন বিমান ছিনতাইয়ের মাধ্যমে আমেরিকা আক্রমণ করতে পারে, সেই গোয়েন্দা বার্তার গুরুত্ব সেই সময়ে তিনি দেন নি, সেটার কথা ?
মুর প্রশ্ন করছেন, নাকি অন্য আরও কোন বিকল্প ভাবনায় বুশ মগ্ন হচ্ছিলেন। সেই ভিন্ন ভাবনাগুলো ছিল, ওপরের ভাবনাগুলো থেকেও আরও ভয়ঙ্কর, আরও ধ্বংসাত্মক। সেটা হচ্ছে:
– বুশ কি তবে ভাবছিলেন, কোন ভুল দঙ্গলের পাল্লায় তিনি পড়েছেন, যেমন তার বাবা সিনিয়র বুশের বন্ধু প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বা ইসলামি মৌলবাদী গোষ্ঠী অথবা সৌদি গোষ্ঠী ?
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই যে টুইন টাওয়ার ঘটনার পরেই সব ফ্লাইট বাতিল করা হলেও, মাত্র দুই দিনের মাথায় আমেরিকায় বসবাসরত লাদেন পরিবারের সবাইকে বিশেষ বিমানে করে সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রামাণ্যচিত্র দেখতে দেখতে আমরা ধীরে ধীরে শুধু কাহিনী চিত্রে প্রবেশ করিনা আমরা, নির্মাতা মুর গোয়েন্দ কাহিনীর ভেতরে আমাদের নিয়ে যেতে থাকেন।
ছবিতে আক্ষরিক ভাবেই ১৯৫৪ সালে নির্মিত ‘ড্র্যাগনেট’ ছবির ছোট্ট ফুটেজ দেখানো হয়। যেখানে আমরা দেখি একটা খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিভাবে পারিবারিক স্তরে জিজ্ঞাসাবাদ চলে। এখানে এসেই সাত মিনিটের বুশের ভাবনার শেষ ভাবনাটার কথা মুর আমাদের জানান:
– নাকি তিনি ( বুশ ) ভাবছিলেন খালেদ বিন লাদেন এবং খালিদ মাহফুজ নামে লাদেন পরিবারের সাথে তার যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, সেটা জেনে গেলে তাকে জনগণের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হবে!
যদিও লাদেন পরিবারের সাথে বুশের সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলনা, সেটা ছিল, তার ঘনিষ্ট ব্যবসায়িক বন্ধু জেমস আর বাথের সঙ্গে। বাথ এবং বুশকে ১৯৭২-এ মিলিটারি ট্রেনিং থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তারপরই দুই বন্ধু মিলে হারকেন, স্পেকট্রাম নামে বিভিন্ন কম্পানি খুলে ব্যবসা শুরু করেন এবং উল্লেখিত লাদেন পরিবারের দুইজন সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এই বন্ধুর নামও প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০৪ সালে, মিলিটারি রেকর্ড থেকে কালো কালি দিয়ে মুছে দেন। কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মাইকেল মুর ২০০৪ এর আগেই সেন্সরহীন কপিটা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, সেখানে জেমসের নাম ছিল এবং জেমস ছবির গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্র। এভাবেই আমরা ছবির গতির সাথে, লাদেন পরিবারের সাথে বুশের সম্পর্ক এবং বুশের বাণিজ্যিক বিস্তারের সাথে পরিচিত হতে থাকি।
২০০৩ সালে, ‘কর্পোরেট ক্রাইম রিপোটার্র’ পত্রিকায় ড্যান ব্রাইয়োডির লেখা ‘দ্য আইরন ট্রাইঅ্যাঙ্গেল : ইনসাইড দা সিক্রেট ওয়ার্লন্ড অফ কার্লাইল গ্রুপ’ বইটাকে কেন্দ্র করে লেখকের একটা সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। সেখানে বইয়ের নামকরণ ‘দ্য আইরন ট্রাইঅ্যাঙ্গেল’ কেন রাখা হয়েছে জিজ্ঞেস করা হলে ড্যান ব্রাইয়োডি চমৎকার একটা উত্তর দেন: “১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট উইট আইজেনহাওয়ার হোয়াইট হাউজ হাউজ ত্যাগ করার সময় দেশের মিলিটারি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের গঠনপ্রকৃতির প্রতি খুব দামি একটা সাবধানবানী করেছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, মিলিটারি বাণিজ্যের প্রতিরক্ষা শিল্পপ্রতিষ্ঠান দেশের যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্রমেই প্রভাব বিস্তার করবে যা কিনা দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিবে, কারণ যুদ্ধের প্রয়োজনের চেয়ে যুদ্ধের আর্থিক লাভটা বেশি আকর্ষণীয়”।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমরা আজ ঠিক সেই চিত্রটাই দেখছি। যা মাইকেল মুর তার ছবিতে আরও স্পষ্ট করেছেন। যে কার্লাইল গ্রুপের কথা ড্যান ব্রাইয়োডি বলেছেন, সেই গ্রুপ প্রথমে ছিল কৃষিযন্ত্রপাতির কম্পানি। ক্রমে সেই কম্পানি ফুলে ফেঁপে এতো বড় হয় যে, সেটা আর সেই জায়গায় থাকেনা। সেখানে যুদ্ধাস্ত্র স্থান দখল করতে থাকে। কম্পানির অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন, জর্জ বুশের বাবা সিনিয়র বুশ। এই কার্লাইল গ্রুপের কথা ছবির অনেকটা অংশ জুড়ে দেখা যায়। ড্যান ব্রাইয়োডির সাক্ষাৎকার সহ, পত্রিকার শিরনাম হিসেবে আমরা দেখি: “কার্লাইল গ্রুপের ইউনাইটেড ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি, ৯/১১র পরে সেই বছরের ডিসেম্বরে শুধু একদিনেই ২৩৭ মিলিয়ন মূল্যমানের শেয়ার বিক্রি করেছে”। আরও মজার বিষয় হলো, এই কম্পানির হিসাব নিকাশ কখনোই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়না। সম্পূর্ণ ব্যক্তি পর্যায়ে চলে এই কম্পানি, যার প্রধান সর্দাররা হলো আমেরিকান, ব্রিটিশ এবং সৌদি। ছবিতে আমরা দেখি ইউনাইটেড ডিফেন্স ইন্ডস্ট্রিতে সিনিয়র বুশের সংযুক্ত থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, উত্তরদাতা এড়িয়ে যান।
আফগানিস্তান বিশেষ করে ইরাক আক্রমণ করার অজুহাত হিসেবে, ‘সন্ত্রাস’ এবং ‘পারমাণবিক অস্ত্র’ রাখা নিয়ে জনগণের চোখে কীভাবে ধুলা ( ছবিতে ধোঁয়া শব্দটার প্রয়োগ চমৎকারভাবে দেখানো হয়) দেয়া হয় রাজনীতিবিদ জিম ম্যাক ডেরমোটের সাক্ষাৎকার থেকে আমরা আরও পরিষ্কার বুঝতে পারি: “জনগণকে ভয় দেখাবার জন্যে তুমি যা খুশি করতে পারো। —– তার চারপাশে এমন একটা আবেষ্টন তৈরি করবে যে সে অনন্ত ভয়ে শিহরিত হতে থাকবে”। ছবিতে আমরা দেখি, সন্ত্রাসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের লিফলেট, যেমন কোথাও লেখা:
এলেভেটেড: সিগনিফিকেন্ট রিস্ক অফ টেরারিস্ট অ্যাটেক
হাই: হাই রিস্ক অফ টেরারিস্ট অ্যাটাক
গার্ডেড: জেনারেল রিস্ক অফ টেররিস্ট অ্যাটাক ইত্যাদি।
ফক্স নিউজের শিরনাম: ‘ওয়ার অন টেরর’। বুশ টেলিভিশনে বলছেন: ‘৯/১১র পরে পৃথিবী আর আগের মতো নাই। কারণ আমরা নিরাপদ নই’ । অর্থাৎ আমেরিকা নিরাপদ না থাকলে গোটা পৃথিবীটাই অনিরাপদ হয়ে যায়। জিম সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, “জনগণ হলো ট্রেনিং দেয়া কুকুরের মতো। তাদের বসতে বললে বসে, উঠতে বললে উঠে। আর এভাবেই আমেরিকাবাসী ধোঁকার সম্মুখীন হয়”। ঠিক এরপরেই আমরা সেই মেকআপের দৃশ্য দেখি। প্রেসিডেন্ট বুশ টেলিভিশনে ইরাক আক্রমণের ঘোষণার জন্য সাজগোজ করছেন, মনে তার অসীম আনন্দ। কারণ যুদ্ধ মানেই আইজেনহাউয়ার কথিত আর্থিক লাভ। এরপরেই ইরাক যুদ্ধে ভয়াবহ কিছু ফুটেজ দেখানো হয়। ধারাভাষ্যে বলতে শুনি: “এমন একটা দেশকে আমেরিকা আক্রমণ করছে, যে দেশ কোনদিন আমেরিকা আক্রমণ করে নাই। কোনদিন আমেরিকার একটা নাগরিককে খুন পর্যন্ত করে নাই”।
যুদ্ধ রাষ্ট্রপ্রধান আর তার সঙ্গীসাথিদের আর্থিকভাবে লাভবান করে দিলেও, শেষ পর্যন্ত সব থেকে ক্ষতি যাদের হয় তারা হলো দেশের নিরীহ জনগণ। ইরাক আর আফগানিস্তানের জনগনের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমেরিকান জনগণও এই ক্ষতি থেকে রেহাই পায় নাই। তাই ছবির শেষে ইরাক যুদ্ধে সন্তানহারা এক মাকে বলতে দেখা যায়: “ আমি ভেবেছিলাম আমি বোধহয় সব জানি। আসলে কিছুই জানতে পারি নাই। এই হলো রাষ্ট্র। এই হলো আল কায়দা”।
একেবারে শেষে যে বিস্ময়কর তথ্যটা দিয়ে মাইকেল মুর ছবিটা শেষ করেন, সেটা হলো ৫৩৫জন সিনেটারের মধ্যে একজন ছাড়া আর কোন সিনেটারের সন্তান যুদ্ধে যায় নাই। তাদের সন্তানকে কেন যুদ্ধে পাঠানো হয় নাই জিজ্ঞেস করার জন্যে মাইকেল মুর ছুটে গেলে, কৌশলে সিনেটাররা সরে পড়েন। প্রেসিডেন্ট বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের যে আতঙ্কের ধোঁয়া তুলেছিলেন, এই ধোঁয়ার নিচে লক্ষ লক্ষ জনগণ চাপা পড়ে গেলেও বুশ এবং পরবর্তী বুশদের জন্যে এটা হয়ে থাকবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত বাণিজ্যিক যুদ্ধ ।