The Reluctant Fundamentalist যদি গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বা তারও আগে উপন্যাস আকারে লিখিত অথবা চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মিত হতো তাহলে ছবির নামটা হয়তো হতো The Reluctant Communist । কারণ সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্যে সাম্রজ্যবাদী দেশের কোনো না কোনো শত্রুর প্রয়োজন পড়ে। গত শতাব্দীতে যে শত্রুর নাম ছিলো ‘কমিউনিস্ট’ বা ‘সাম্যবাদী’ এই শতাব্দীতে সেই শত্রুর নাম হয়েছে ‘ফানডামেন্টালিস্ট’ বা ‘মৌলবাদী’। ইতিহাসের দিক থেকে মৌলবাদী অন্দোলনের উত্থান ঘটে প্রধানত ডারউইনের মতবাদকে কেন্দ্র করে। “Fundamentalist” শব্দটি প্রথম সম্ভবত ব্যবহৃত হয় ১৯২০ সালে ব্যাপটিস্ট ওয়াচম্যান একজামিনার পত্রিকায়। ১৯২০ সালে যাজক জন রোয়াচ স্ট্রাটন তার পত্রিকার নাম রাখেন Fundamentalist এবং পত্রিকাটি ডারউইনের বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করে। কারণ ফান্ডামেন্টালিস্ট বা মৌলবাদীরা তাদের ধর্মীয়গ্রন্থের বাইরে কোনোকিছু বিশ্বাস করতে রাজি নয়। খ্রিস্ট মৌলবাদীরা যেমন ঘোষণা করেন প্রকৃত খ্রিস্টান হতে হলে বাইবেলের (নতুন ও পুরোনো) অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব ও প্রেরণায় বিশ্বাস করতে হবে, ঠিক তেমনি মুসলমান, ইহুদি বা হিন্দু মৌলবাদের কথা: স্ব স্ব ধর্মীয়গ্রন্থের ওপর অবিচল বিশ্বাস এবং এসব গ্রন্থের, কোনো বাক্য তো নয়ই, কোনো শব্দ নিয়ে বিন্দুমাত্র বিতর্কের অবকাশ রাখা যাবে না। সভ্যতার সঙ্গে বিরোধের জায়গাটি এখানেই। এবং এই বিরোধ যত বাড়তে থাকে মৌলবাদের মুখটিও তত কদর্য হতে থাকে। আর তাই The Reluctant Fundamentalist-এর ছবির পরিচালক মিরা নায়ার Fundamentalist শব্দটা নিয়ে প্রথমে বেশ দ্বিধায় পড়েছিলেন। কারণ শব্দটা যেন বর্তমান সময়ের এক নিষিদ্ধ শব্দ, জানবো, বুঝবো কিন্তু উচ্চারণ করা চলবে না। যেমন আমরা এইডস, ক্যানসার রোগের নাম উচ্চরণ করতে ভয় পাই কিন্তু তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। অনেকটা সেইরকম। কিন্তু সাহস করে তিনি নামটা রেখে দিলেন তার ছবিতে।
মোহসিন হামিদের উপন্যাস The Reluctant Fundamentalist (২০০৭) অবলম্বনে নির্মিত, ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটিতে শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো এক ভিন্ন মৌলবাদীর গল্প। নিজের ইচ্ছার বাইরে একজন মানুষ কী করে মৌলবাদী হয়ে ওঠে বা হয়ে উঠতে বাধ্য হয় ছবিটি তারই অনুসন্ধান। বৈশ্বিক রাজনীতির ঘেরাটোপে আটকে পড়ে একজন তরুণ কী করে মৌলবাদী হয়ে উঠতে বাধ্য হয়, আবার বলছি ‘বাধ্য হয়’, তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে মিরা নায়ারের সাম্প্রতিক এই ছবি।
ছবির মূল চরিত্র ‘কাল’ বা ‘সময়’। বিশ্ব রাজনীতির সুনির্দিষ্ট কালপর্বের প্রেক্ষাপট সামনে রেখে গড়ে উঠেছে ছবির কাহিনী। আর এখানেই ছবির গুরুত্ব। কেন্দ্রীয় সময়কাল ৯/১১ হলেও, তার আগে এবং পরের সময়কালকে একটা মোটা দাগে মিরা নায়ার ভাগ করে দেন। দুই সময়ের পার্থক্য বুঝতে তাই দর্শকের মোটেও বেগ পেতে হয়না। ছবি শুরু হয়, ২০১১ সালের লাহোরে, লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান অধ্যাপক আনসে রাইনিয়ারের অপহরণকে কেন্দ্র করে। ছবির নায়ক চেঙ্গিজ খানের বাড়িতে কাওয়ালির গজলের আসর বসে। কাওয়াল ফরিদ আয়াজ এবং মোহাম্মদের সুমধুর যৌথ কন্ঠের কাওয়ালিয়ে দিয়ে ছবির শুরু, যার বুনোট ধ্রুপদি রাগের রাগে। একই সময়ে দেখা যায় অধ্যাপক রাইনিয়ার ও তার সঙ্গীকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে। গায়কের কণ্ঠ নিচু স্বর থেকে যত বাড়ে ছবির উত্তেজনাও বাড়তে থাকে এবং এক সময় অধ্যাপকের অপহরণ দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে। ছবির এই টান টান উত্তেজনা মিরা তার দক্ষ পরিচালনায় ছবির শেষ পর্যন্ত নিয়ে চলেন। অধ্যাপকের এই অপহরণ দিয়েই কাহিনীর শুরু।
সি.আই.এ. ইনফরমার ববি লিনকনের ওপর দায়িত্ব পড়ে এই অপহরণের সুরাহা করার জন্যে। এবং যেহেতু আমেরিকা ফেরত চেঙ্গিজ খান লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেকচারার, যে কিনা পাকিস্তানে আমেরিকার অনধিকার প্রবেশে সোচ্চার, তাই লিনকন এবং লাহোরে অবস্থানরত সি.আই.এ.’র সদস্যদের সন্দেহ হয় চেঙ্গিজ আল-কায়দার একজন সদস্য এবং এই অপহরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। একটি রেস্তোরায় বসে শুরু হয় দুইজনের কথোপকথন। এই কথোপকথনের মধ্যে দিয়েই ফ্ল্যাশব্যাক আর ফ্লাশ ইনের মধ্য দিয়ে চেঙ্গিজের জীবন বৃত্তান্ত আমরা জানতে থাকি।
মাত্র সতর বছর বয়সে বাবা এবং মায়ের হাত ধরে আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিলো চেঙ্গিজ। বাবা পাকিস্তানের একজন বিখ্যাত কবি। মেধাবী এবং প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত চেঙ্গিজ পড়াশোনা শেষে ফিন্যানশিয়াল অ্যানালিস্ট হিসেবে আন্ডারউড স্যামসন নামে বিখ্যাত একটি ফার্মে যোগ দেয়। ঈর্ষা করার মতো উন্নতি ঘটতে থাকে চেঙ্গিজের। ইতিমধ্যে সুন্দরী এবং আকর্ষণীয়া আমেরিকান ফটোগ্রাফার এরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। একদিন চেঙ্গিজকে তার সুপারভাইজার জিম ক্রস যখন জিজ্ঞেস করে, দশ বছর পর চ্যানগেজ এই ফার্মের কোথায় পৌঁছাতে চায়, চেঙ্গিজের উত্তর, ম্যানেজিং ডিরেক্টার। ক্রস তাকে অবাক করে দিয়ে জানায়, দশ বছর পর কেনো, কেনো এখন নয়। অর্থাৎ তাকে এখনই এম.ডি. করা হবে। অতর্কিত এই আনন্দে চেঙ্গিজ চমকে ওঠে। বাকহীন হয়ে পড়ে।
আনন্দের এই চরম লগ্নে ঘটে ৯/১১’র টুইনটাওয়ারের ঘটনা। এই ঘটনার পর এডওয়ার্ড সাঈদ তার একটি প্রবন্ধে ( মার্কিন মূলুকে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য) লিখেছিলেন : “আমি এমন একজন আরব বা মুসলমানকে চিনি না, যিনি এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে নিজেকে শত্রু শিবিরের সদস্য হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন না। –শত শত আরব তরুণকে আটক করা হয়েছে এবং ফেডারেল গোয়েন্দা ব্যুরো ( এফবিআই) ও পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মুসলিম বা আরবী নাম হলে রক্ষা নেই। এমন নামের লোক বিমানবন্দরে উপস্থিত হলেই তার প্রতি সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয় এবং তাকে তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জামা-কাপড় খুলেও পরীক্ষা করা হয়”।
ছবটি সম্পর্কে মিরা নায়ারের নিজের ভাষ্য এখানে শুনতে পারেন
মিরা নায়ার তার ছবিতে যেন হুবহু বাস্তব এই দৃশ্যটি তুলে আনেন। তাই আমরা দেখতে পাই অফিসিয়াল কাজে ম্যানিলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পর বিমানবন্দরে চেঙ্গিজকে কীভাবে অপদস্ করা হয়। তারপর একের পর এক এরকম ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে তার পার্কিং করা গাড়ির দুটো চাকা নষ্ট করে দেয়া হয়, চেঙ্গিজ হতভম্বের মতো চাকার দিকে তাকিয়ে থাকলে একটু পরে তার পাশ দিয়ে একটি গাড়ি আসতে দেখা যায়, ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটি তাকে উদ্দেশ্য করে বলে ‘O Fuck you Osama’ । এমনকি তার আমেরিকান প্রেমিকাও বাদ পড়েনা। যখন তাদের বিয়ে এবং সন্তানের প্রসঙ্গ উঠলে এরিকা তাকে বলে, ‘O you are another । এভাবে একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে চেঙ্গিজ ক্রমশই ‘আদার’ হতে থাকে। এই বিচ্ছিন্নতা শেষ পর্যন্ত তাকে আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য করে। সে ফিরে আসে লাহোরে।
এতোকিছুর পরেও ছবির শুরু এবং শেষে ( লিনকনের টেপরেকর্ডারে) চেঙ্গিজকে বলতে শোনা যায়, ‘I am a lover of America’। অন্যদিকে লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার সময় চেঙ্গিজ ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বলে, ‘যখন আমেরিকায় ছিলাম তখন তাদের হয়ে কাজ করেছি। এখন নিজের দেশে পাকিস্তানের হয়ে কাজ করবো’। অর্থাৎ চেঙ্গিজের এক অন্তর্নিহিত সততার পরিচায় আমরা এখানে পাই। কিন্তু তার কিছু পরেই এক আচমকা বিস্ময় যেন দর্শকের জন্যে অপেক্ষা করে থাকে, যখন চেঙ্গিজের সঙ্গে মুজাহিদ দলের এক নেতার সঙ্গে দেখা হয়। সেই নেতা তাকে মুজাহিদ দলে যোগ দিতে অনুরোধ করে এবং বলে, ‘আমাদের একটা লক্ষ্যই অর্জন করতে হবে আর তা হলো, কোরআনের মৌলিক সত্য প্রতিষ্ঠা করা’, ঠিক সেই মুহূর্তে চেঙ্গিজের মনে পড়ে যায় তার সেই ফার্মের কোনো এক বক্তৃতার অংশ যেখানে বলা হয়েছিলো, ‘আমরা সেই কাজগুলোই করি যা মৌলিক’। চ্যামগিজকে দ্বিধান্বিত দেখায়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির মৌলবাদ এবং ধর্মীয় মৌলবাদ – দুটোকেই মিরা নায়ার মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেন। সময়ের এক ক্রান্তিলগ্নে এসে দুই ‘মৌলবাদ’-এর মধ্যে যেন কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না আর। ধর্মীয় মৌলবাদের মতো পুঁজিতান্ত্রিক মৌলবাদও এক স্থির, অনড় এবং অবিতর্কত সমাজব্যবস্থা। ধর্মীয় মৌলবাদ যেমন সব বির্তকের উর্দ্ধে, পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতিও ঠিক যেন সব তন্ত্রের উর্দ্ধে। দুই মৌলবাদ যেন একে অপরের সঙ্গে অসমাপ্ত যুদ্ধের খেলায় মত্ত। কিন্তু সব যুদ্ধেরই অবসান আছে, থাকতে হয়, নাহলে মানব সভ্যতা টিকে থাকতে পারেনা। আর তাই ছবির শেষে যখন রেইনারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ চরমে ওঠে এবং সামির নামের একটি ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় চ্যানগিজ তাকে কবর দেয়ার সময় অনেকটা শপথের সুরে বলে, “আমরা যেন অনধিকার প্রবেশকারীদের কাছ থেকে মুক্ত থাকতে পারি। মুক্ত থাকতে পারি অত্যাচারী এবং স্বৈরশাসকদের কাছ থেকে —সূর্যের মহান আলো যেন আমাদের ওপর বর্ষিত হয়, আমরা যেন তার আলোয় বেড়ে উঠতে পারি, যে সূর্যের আলোর নিচে পৃথিবীর সব মিশ্রজাতির বসবাস”। ছবিটি তাই মৌলবাদ এবং চরম জাতীয়তাবাদ – এই দুটোকেই প্রত্যাখ্যান করে। প্রত্যাখ্যানের নমুনা স্বরূপ অনেক চরিত্রের সমাবেশ এখানে ঘটে। ববি লিনকন নামের সাংবাদিক, যার সঙ্গে চেঙ্গিজকে সন্দেহ করতে যেয়ে সখ্যতা গড়ে ওঠে; নিউ ইয়র্কের রাস্তায় ছোট্ট একটি বাঙালি চরিত্র, যার ৯/১১র ঘটনায় মাথা নষ্ট হয়ে যায়; তুরস্কের এক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কবি, যে কবি চেঙ্গিজের বাবার কবিতা ইংরেজি থেকে তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করে, প্রেমিকা এরিকা, যে চেঙ্গিজকে প্রচণ্ড ভালোবাসা সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদের নোংরা রাজনীতির শিকার হয়, এরিকার সঙ্গে আর ঘর বাঁধা হয়ে ওঠেনা। এভাবেই বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন চরিত্রের সমাবেশে ছবিটি এ কালে কেন তরুণরা মার্কিন বিরোধী হয়ে উঠছে তার একটা বয়ান খাড়া করে। এভাবেই মিরা নায়ারের ছবি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের কালে ‘মৌলবাদ’ সংক্রান্ত তর্কবিতর্কে নিজের জায়গা করে নেয়।
…………………
আগ্রহীরা ছবিটি নীচের লিঙ্কে ইউটিউবে ছবিটি দেখতে পারেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।
https://www.youtube.com/watch?v=xjnft0ewE0c