জুলাই গণঅভ্যুত্থান: গ্রাফিতি থেকে শ্লোগানে শক্তি যখন প্রেরণার।
সাকিল সৈকত
‘স্বৈরাচারী হাসিনার পতন হয়েছে। আর সেই প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই ছাত্র-জনতাকে রাজাকারের সঙ্গে তুলনা করে। আর তার বিপরীতে ছাত্ররা স্লোগান ধরেছে। তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার সরকার। আর এটি শুধু স্লোগান হিসেবে থাকেনি। জায়গা করে নিয়েছে গ্রাফিতিতে। পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়া এই গ্রাফিতি আন্দোলনের শক্তি দ্বিগুন থেকে তিনগুন হয়েছে।‘
‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব’-বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুনে’ উপন্যাসের একটি সংলাপ। উপন্যাসের একেবারে শেষের দিকে ছাত্রদের নাম ধরে ধরে জেলখানায় ঢোকানোর সময় ডেপুটি জেলার সাহেব হাঁপিয়ে ওঠেন; এবং বিরিক্তর সঙ্গে বলেন, ‘উহু, এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়। জেলখানা তো এমনিতে ভর্তি হয়ে আসছে।’ প্রত্যুত্তরে পাশ থেকে ছাত্রদের মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে বলেন, ‘এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব’। জহির রায়হানের উপন্যাসের এই উক্তি চব্বিশের গণআন্দোলনের একটি শক্তি। আর এই শক্তি ছড়িয়েছে দেয়ালে দেয়ালে, ছড়িয়েছে গ্রাফিতিতে।
গ্রাফিতি একটি শক্তিরূপে ধরা দিয়েছে আন্দোলনে। মুক্তিরও মন্দিরও/ সোপানও তলে/ কত প্রাণ হলো বলিদান/ লেখা আছে অশ্রুজলে। মোহিনী চৌধুরীর লেখা ও কৃষ্ণচন্দ্র দের সুরে গানটি গাওয়া হয়েছিলো স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে। এমন অনেক গান রচিত হয়েছিলো তখন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে। যে গান আমাদের প্রেরণা যুগিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ধারণ করে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হতে। এরপর সেই প্রেরণায় আমরা নানা সময়ে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উজ্জীবিত হয়েছিলাম। নব্বইয়ের স্বৈরাচারী আন্দোলন থেকে ২৪ এর গণআন্দোলনে আমাদের প্রেরণা দিয়েছে এই গানগুলো। শুধু গান নয় কতশত কবিতা, পোস্টার, কার্টুন, গ্রাফিতি, দেয়াল লিখন ও স্লোগান আমাদের সংগ্রামের আগুনে বারুদের মতো জ্বলে উঠতে সাহায্য করেছে।
স্বৈরাচারী হাসিনার পতন হয়েছে। আর সেই প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই ছাত্র-জনতাকে রাজাকারের সঙ্গে তুলনা করে। আর তার বিপরীতে ছাত্ররা স্লোগান ধরেছে। তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার সরকার। আর এটি শুধু স্লোগান হিসেবে থাকেনি। জায়গা করে নিয়েছে গ্রাফিতিতে। পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়া এই গ্রাফিতি আন্দোলনের শক্তি দ্বিগুন থেকে তিনগুন হয়েছে। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’র মতো স্লোগান আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করতে এই জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। আর আমরা স্বাধীনতার আকাঙ্খায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি পরেও জ্বলে উঠেছি। ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী শাসক হাসিনার পতন ঘটিয়েছি। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছি। স্লোগানে স্লোগানে স্বৈরাচারী শাসনকে হটিয়েছি।
২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেরণাদায়ী স্লোগানের মধ্যে প্রথমেই যুক্ত হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সেই স্লোগান। যে স্লোগানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বাঙালিসহ সকল জাতিগোষ্ঠী জেগে উঠেছিলো। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। যে স্লোগান স্বৈরাচারী হাসিনার পতনে বারুদের মতো জ্বলে উঠেছে। আর ২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলন থেকে যে স্লোগান ছাত্র-জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। সেটি ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে প্রেরণার শব্দ হিসেবে যুক্ত হয়েছে। স্লোগানটি- ‘যদি তুমি ভয় পাও/ তবে তুমি শেষ/ যদি তুমি রুখে দাঁড়াও/ তবে তুমিই বাংলাদেশ’।
কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সরকার পতন। আন্দোলনের দাবিতে ও মিছিলের স্লোগানে ছাত্র-জনতা জ্বলে উঠেছে। শুরুটা হয়েছে কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে। ‘কোটা না মেধা? মেধা, মেধা’ ও ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ও একে তো কোটার বাঁশ, তার উপর প্রশ্ন ফাঁস।-স্লোগান স্ফুলিঙ্গের মতো ছাত্র-জনতাকে একত্রিত করেছে। ১৫ জুলাই রাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চার সঙ্গে তুলনা করায় ফুঁসে উঠে ছাত্র-জনতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে স্লোগান তুলে- তুমি কে? আমি কে?/ রাজাকার, রাজাকার / কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। স্লোগান ওঠে- ‘চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘লাখো শহীদের দামে কেনা/ দেশটা কারও বাপের না’। সারা বাংলায় খবর দে/কোটাপ্রথা কবর দে। জেগেছে রে জেগেছে/ ছাত্রসমাজ জেগেছে। লেগেছে রে লেগেছে/ রক্তে আগুন লেগেছে। আপস না সংগ্রাম? সংগ্রাম, সংগ্রাম। দালালি না রাজপথ? রাজপথ, রাজপথ। গোলামি না ইনকিলাব? ইনকিলাব, ইনকিলাব। অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন।
আওয়ামী লীগের পাণ্ডাদের মুখের স্লোগান ছিলো- ‘আছিস যত রাজাকার/ এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’- স্লোগানের পাল্টা স্লোগান তুলেছিলো মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা। তারা স্লোগান তুলে ‘স্বৈরাচার, স্বৈরাচার/ এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’। আওয়ামী লীগের ‘জনে জনে খবর দে/ এক দফা কবর দে’র পাল্টা স্লোগান তুলে ছাত্ররা- ‘জনে জনে খবর দে/ ছাত্রলীগের কবর দে’। দিয়েছি তো রক্ত, আরো দিব রক্ত। রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়। কোটাপ্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক। লাঠি, বোমা, টিয়ারগ্যাস, জবাব দিবে বাংলাদেশ। লড়াই, লড়াই, লড়াই চাই। লড়াই করে বাঁচতে চাই। একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠো আরেকবার। বাধা আসবে যেখানে, লড়াই হবে সেখানে। গুলি করে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না, যাবে না। জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো। কথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কি তোর বাপ-দাদার?
দেয়ালের আঁকা এলোমেলো কোনো চিত্রকেই মূলত গ্রাফিতি বলা হয়। এই গ্রাফিতি দেশে দেশে আন্দোলনের গতি সঞ্চার করে নিমিষে। কারণ দেয়ালে এই গ্রাফিতি দেয়ালের মতো মানুষের মননেও দাগ কাটে। গ্রাফিতির অবশ্য রয়েছে লম্বা ইতিহাস। প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের সময়কাল থেকে মূলত গ্রাফিতির প্রচলন শুরু হয়। এটি একটি প্রতিবাদী শিল্পকর্ম বলা যায়। যে শিল্পকর্ম প্রচলিত রীতিনীতিকে প্রতিরোধ করে গড়ে ওঠে। গ্রাফিতিতে উঠে আসে সমাজের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও রাজনৈতিক অরাজকতার চিত্র। আন্দোলন-সংগ্রাম ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে শিল্পিতভাবে প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের মাধ্যম এটি। গ্রাফিতির মাধ্যমে দেশে দেশে আমরা দেখেছি দেয়ালে চিত্রায়িত বিপ্লবের চিত্র। এই চিত্রে প্রকাশ পায় প্রতিবাদ ও মুক্তচিন্তার প্রতিফলন। গিয়েছিল ফ্রান্সে আটষট্টির ছাত্র বিপ্লবেও এ গ্রাফিতির বিপ্লব ছিলো উল্লেখযোগ্য। গ্রাফিতির জনক ফরাসি চিত্রশিল্পী ব্লেক লে প্যারিসের দেয়ালে দেয়ালে এঁকেছিলেন নানা অসংগতি ও রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র। আর এবার বাংলাদেশের বিপ্লবে দেশের পথে-প্রান্তরে দেয়াল থেকে দেয়ালে গ্রাফিতির চিত্র উঠে এসেছে। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের গতি প্রকৃতি এরকম। আনাড়ি হাতে আঁকা, হেঁড়ে গলায় গাওয়া, তাতক্ষনিক প্যারোডি করা-এসবই সংগা্রম প্রতিরোধের অংশ। হাই আর্ট বা প্রাতিষ্ঠানিক লেন্স থেকে দেখলে একে বোঝা যাবেনা। দেশে দেশে নানা সময়ে প্রবল প্রতাপ ক্ষমতা বা মতাদর্শের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ এমন গেরিলা কায়দায়ই হয়েছে ও হচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতেও হবে।
২০১৭ সালে হঠাৎ রাজধানীর আগারগাঁও ও মিরপুরের কয়েকটি দেয়ালে শোভা পায় ‘সুবোধ’-এর গ্রাফিতি। এই গ্রাফিতির চরিত্র ‘সুবোধ’ ছিলো বোধ জাগ্রত হওয়ার প্রতীক। এগুলোতে লেখা ছিল— ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই’, ‘সুবোধ এখন জেলে, পাপবোধ নিশ্চিন্তে বাস করছে মানুষের মনে’, ইত্যাদি। যা আরব বসন্তের প্রেক্ষাপটে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গ্রাফিতির বিপ্লব হয়েছে বলা যায়।
‘বিকল্প কে? আমি, তুমি, আমরা’ কিংবা ‘হামার বেটা মারলু ক্যানে’ -খুব সহজবোধ্য লাইনগুলো অগ্নিগর্ভ হয়ে ফুটেছে দেয়ালের গ্রাফিতি হিসেবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষ থেকে প্রথম ২৯ জুলাই দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি কর্মসূচি দেওয়া হয়। স্কুল, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেয়াল লিখন আর গ্রাফিতির কাজ করেছে তখন। তারা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। পুলিশ আতঙ্ক, স্বৈরাচারের দোসর ছাত্র সংগঠনের হামলা, হেলিকপ্টার থেকে গুলির শঙ্কা নিয়েই শিক্ষার্থীরা রঙ তুলি ও স্প্রে নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। যাদের আর্ট নিয়ে তেমন কোনো ধারণাই ছিল না, তারাও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ লেখে দেয়ালে দেয়ালে। সুযোগ ও হামলার আশঙ্কায় এর বেশিরভাই ছিল সাদামাটা আনাড়ি হাতের দেয়াল লিখন। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ডিজিটাল আর্ট। প্রফেশনাল গ্রাফিক ডিজাইনার ও কার্টুনিস্টরাও এতে অংশ নেন।
‘হামার বেটা মারলু ক্যানে?’, ‘ছাত্র যদি ভয় পাইতো বন্দুকের গুলি, উর্দু থাকতো রাষ্ট্রভাষা, উর্দু থাকতো বুলি’, ‘দেশ স্বাধীন হলে আমরা আবার ছাদে উঠব’, ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প’, ‘লোহার টুপি মানুষের মগজ খায়’, ‘মেধা শহীদ’, ‘আমি মেট্রোরেল হতে চেয়েছিলাম, খোদা আমাকে ছাত্র বানালো’, ‘বায়ান্ন দেখিনি চব্বিশ দেখেছি,’ ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে স্বৈরাচার’, ‘ভাই পানি লাগবে কারো, পানি?’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তের বিচার চাই,’ ‘আসছে ফাগুন আমরা দ্বিগুণ হবো’, ‘জেন-জি’, ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ ‘খুনি হাসিনার বিচার চাই’, ‘চেটে নয়, খেটে বড় হও’, ‘নাটক কম কর পিও’, ‘ছাত্র খুনি’ ইত্যাদি গ্রাফিতি শোভা পেয়েছে দেয়ালে দেয়ালে। যে শক্তিতে আন্দোলন ছড়িয়েছে দাবানলের মতো।
দেয়ালে শোভা পেয়েছে প্রতিবাদী কবিতার লাইন, গানের লাইন, অভ্যুত্থানে শহীদদের জন্য শোকগাথা, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি ঘুষ-দুর্নীতিবিরোধী, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা, সুন্দর একটি দেশ গড়ার কথা। খুবই পরিশীলিত ভাষায় অসাধারণ সব ভাষার বিস্তার হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রে নতুন করে সুন্দর ভাষায় গ্রাফিতির অঙ্কন দেখা গেছে। যেমন সাদা দেয়ালে উদীয়মান লাল সূর্য। সেই সূর্যের কেন্দ্রে পতাকা বাঁধা একটি মুষ্টিবদ্ধ হাত। আর হাতের দুই পাশে মসজিদ-মন্দির-প্যাগোডা-চার্চ। কোথাও আবার এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন দেশের প্রধান চার ধর্মের চারজন মানুষ। দেয়ালে দেয়ালে ফুটে উঠেছে অভ্যুত্থান পরবর্তী এমন সাম্যের বার্তা। তরুণ-তরুণীরা এ সব সাম্যের বার্তা নিয়ে গ্রাফিতি অঙ্কন মন দিয়েছেন। এ সব গ্রাফিতিতে লেখা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদদের প্রতি-‘আমরা তোমাদের ভুলব না’, কোনোটিতে লেখা হয়েছে-‘চা-শ্রমিকের বেতন বাড়াও, গণহত্যার বিচার কর’। কোথাও উঠে এসেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ শিরোনামের গানের লাইন। কোথাও কল্পনা চাকমার ছবি এঁকে লেখা, ‘আমরাই কল্পনা চাকমা’। দেয়ালে দেয়ালে এমন গ্রাফিতি সাম্য, প্রতিবাদ ও দেশপ্রেমের বার্তা দিচ্ছে। আর দেয়ালে যে গ্রাফিতি জ্বল জ্বল করেছে-রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে।
এখনও চলছে পোস্টার, ফেস্টুন অপসারণ করে সৌন্দর্ বাড়াতে দেয়ালে দেয়ালে লিখন। দেয়াল লিখন বা রং তুলিতে আঁকা চিত্রগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত। তাদের আঁকি বুকি আর লেখায় আছে প্রাণের গহীন তল থেকে উঠে আসা ভালোবাসা আর আবেগ। কচি হাতের ছোঁয়া যেন অন্যরকম সৌন্দর্যমন্ডিত।। ছাত্র সমাজের রং তুলির আঁচড়ে বদলে গেছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের গুরুত্বপূর্ণ দেয়াল। ছাত্রসমাজ দেশের স্থানীয় অধিবাসীদের সংষ্কৃতি, আন্দোলন ও অধিকার তুলে ধরার পাশাপাশি সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিভিন্ন দিক তুলির রঙে তুলে ধরেছে।
শিক্ষার্থীদের রং তুলির আঁচড়ে বর্তমান প্রজন্মের মেধা ও বুদ্ধিদীপ্ত চেতনা দেয়ালগুলোতে ফুটে উঠেছে। দেশপ্রেম ও দায়িত্বের জায়গা থেকে এই কাজে অংশ নিচ্ছেন সবাই। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে রয়েছে অভিভাবকরাও। তরুণদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের জনগণ। মেট্রোরেল স্টেশনের দেয়াল ও পিলারে পিলারে গ্রাফিতির শিল্পকর্মের ছোঁয়া লেগেছে। প্রতিটি পিলার যেনো এক একটি জীবন্ত শিল্প। যাতে দেশ সংষ্কারের নানা স্লোগান লিখা হয়েছে। শুধু মেট্রোরেলের পিলার নয় রোড ডিভাইডারেও শিক্ষার্থীরা আঁকছেন দেশ সংষ্কারের গ্রাফিতি। বিভিন্ন স্লোগান লিখে তারা আঁকছেন গ্রাফিতির এ সব শিল্পকর্ম। এই শিল্পকর্ম স্নিগ্ধতা ও সচেতনতার শৈল্পিক বার্তা পৌছে দিচ্ছে সবার মনে নতুন এক বাংলাদেশের প্রত্যয়ে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি যেনো পূর্বের ও পরের বাংলাদেশে চেতনার রঙে মহীয়াণ হয়ে উঠেছে।
১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ছবি হয়ে ওঠে প্রতিরোধ আর বিপ্লবের প্রতীক। আন্দোলনকারীরা শহীদ আবু সাঈদের প্রেরণা বুকে ধারণ করে স্লোগান তুলে- ‘আমার খায়, আমার পরে/ আমার বুকেই গুলি করে’। এছাড়া আরও স্লোগান তুলে- ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর’। শোনা যায়, ‘আমার ভাই কবরে, খুনিরা কেন বাইরে’, ‘আমার ভাই জেলে কেন’ ,‘গুলি করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’। ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’।
আবু সাঈদ ও মুগ্ধের মৃত্যু স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যের শিকার ছাত্রদের আরও জাগিয়ে তুলে। কোটা আন্দোলন তখন রুপ নেয় সরকারের বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক মুক্তির আকাঙ্খায়। পাল্টা স্লোগান উঠে ‘তোর কোটা তুই নে/ আমার ভাই ফিরিয়ে দে’, ‘লাশের ভিতর জীবন দে/ নইলে গদি ছেড়ে দে’। লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারোর বাপের না। আমার ভাই মরল কেন? প্রশাসন জবাব দে? বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর। ছাত্র যদি ভয় পাইতো, বন্দুকের গুলি/উর্দু থাকতো রাষ্ট্রভাষা, উর্দু থাকতো বুলি। আমার খায়, আমার পরে/আমার বুকেই গুলি করে। আমার ভাইয়ের রক্ত/ বৃথা যেতে দেব না। পা চাটলে সঙ্গী/ না চাটলে জঙ্গি। মোদীর সন্তানেরা/সীমান্তে ফিরে যাও।
হাসিনাশাহীর ল্যাসপেন্সাররা বলে- আওয়ামী লীগের বিকল্প দেখান। এর বিরুদ্ধেও ছাত্র-জনতার স্লোগান ছিলো- ‘তুমি কে? আমি কে? বিকল্প, বিকল্প’। তুমি কে? আমি কে? বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। স্লোগান ওঠে- স্বৈরাচার/ এই মুহূর্তে গদি ছাড়। আইয়ুব থেকে হাসিনা/ স্বৈরাচার মানি না। লাশের ভেতর জীবন দে/ নইলে গদি ছাইড়া দে। লাখো শহীদের রক্তে কেনা/ দেশটা কারোর বাপের না। আমার ভাই কবরে, খুনিরা কেন বাইরে? আমার ভাই জেলে কেন? প্রশাসন জবাব দে। গুলি করে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না, যাবে না। জাস্টিস জাস্টিস/উই ওয়ান্ট জাস্টিস। সেইম সেইম ডিক্টেটর। অনাস্থা অনাস্থা, স্বৈরতন্ত্রে অনাস্থা।
২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতার সংগ্রামী স্লোগান- ‘আপস না সংগ্রাম?/ সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘দালালি না রাজপথ? রাজপথ, রাজপথ’। ‘কে এসেছে? কে এসেছে? পুলিশ এসেছে/ কী করছে? কী করছে?/ স্বৈরাচারের পা চাটছে’। পুলিশের উদ্দেশ্যে একটাই স্লোগান ওঠে- ভুয়া, ভুয়া। স্লোগান ওঠে-পুলিশ ছাড়া মাঠে নাম/ ভুলিয়ে দিব তোর বাপের নাম। লাশের হিসাব কে দিবে? কোন কোটায় দাফন হবে?।
শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে সরাসরি স্লোগান ওঠে। যে স্লোগানে শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত হতে চায়। আমি নই, তুমি নও/রাজাকার,রাজাকার / কে রাজাকার? কে রাজাকার? তুই রাজাকার, তুই রাজাকার গোপালগঞ্জের গোলাপি, আর কত জ্বালাবি? ছিঃ ছিঃ হাসিনা/লজ্জায় বাঁচি না। শেখ হাসিনার গদিতে/ আগুন লাগাও একসাথে। আমাদের সংগ্রাম/ চলছে, চলবে। স্লোগানে উঠে আসে-কথা ক আওয়াজ উডা।
পুলিশ ও আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের হামলায় প্রাণ যায় হাজারও মানুষের। যতই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হয় আন্দোলনের গতিও বাড়ে তীব্র গতিতে। তখন আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতন আন্দোলনে। ৪ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে আন্দোলনকারীরা গণভবন ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্যে লংমার্চের ডাক দেন। স্লোগান ওঠে, ‘ঢাকায় আসো জনতা/ ছাড়তে হবে ক্ষমতা’। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে স্লোগান ওঠে- ‘পালাইছে রে পালাইছে/ হাসিনা পালাইছে’।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসন বাঁচিয়ে রাখতে ছাত্র-জনতার উপরে নির্বিচারে গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছে। এই গণহত্যা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার জনতার ঐক্য হয়েছিলো। এই ঐক্যে স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করেছে জ্বালা ধরানো স্লোগান। যে স্লোগানে ছিলো বারুদ। ছিলো সাহিত্য ও সঙ্গীতের সংমিশ্রণ। ছিলো চলচ্চিত্র, নৃত্যকলা ও চিত্রকলা। এই আন্দোলনের আগুনে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে জহির রায়হান। জহির রায়হানের উপন্যাস আরেক ফাল্গুনের এই উক্তি ‘চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন, এই ফাগুনেই হবে দ্বিগুণ’। স্লোগানটি স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়েছে, দ্রোহে আগুন লেগেছে সংগ্রামী জনতার।
জহির রায়হানের উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুনে’র একেবারে শেষ দিকে ছাত্রদের নাম ধরে ধরে জেলখানায় ঢোকানোর সময় ডেপুটি জেলার সাহেব হাঁপিয়ে ওঠেন এবং বিরিক্তর সঙ্গে বলেন, ‘উহু, এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়। জেলখানা তো এমনিতে ভর্তি হয়ে আসছে।’ প্রত্যুত্তরে পাশ থেকে ছাত্রদের মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে বলেন, ‘এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।
দ্রোহের অনুপ্রেরণায় জহির রায়হানের এই উপন্যাসের উক্তি ছড়িয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বারুদ হিসেবে। সাহিত্য দিয়েছে স্লোগান। স্লোগান উঠেছে- ‘তবে তাই হোক বেশ, জনগণই দেখে নিক এর শেষ’, ‘আমরা আম-জনতা, কম বুঝি ক্ষমতা’, ‘তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে’।
সঙ্গীত দিয়েছে স্লোগান। স্লোগান উঠেছে- ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড় জোরে’, ‘ফাইট ফর ইওর রাইটস’, ‘নিউটন বোমা বোঝো মানুষ বোঝো না’। কবিতা দিয়েছে স্লোগান, ছড়া দিয়েছে স্লোগান।
ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের সাড়া জাগানো ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ থেকে ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমিই বাংলাদেশ’। স্লোগানগুলো ২০২৪ সালে জেনজিদের আন্দোলনে এসেছে কালের পরিক্রমায়। যেই কালের ধ্বনি শুনতে শুনতেই এগিয়ে যাওয়া যায়। সেই কালের ধ্বনিতে, স্লোগানে স্লোগানে, মুক্তির আকঙ্খায় দ্রোহের আগুনে স্লোগান মানুষের হৃদয়ে থেকে যায়, থেকে যাবে। ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে বাজে, বাজবে। মানুষ ভালোবাসবে, দ্রোহের আগুনে পুড়বে। স্লোগানে স্লোগানে নিজের অধিকার আদায় করেই ছাড়বে।
সাকিল সৈকত লেখক, নির্মাতা ও সংস্কৃতিকর্মী