।। টোকন ঠাকুর ।।
বসন্তদিন
রহস্যপুর গল্পটা পড়া শেষ হয়নি
আমি সিরিয়াস পাঠক। পড়তে পড়তে পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা এগিয়ে যাই, তাকিয়ে দেখি গল্পের মধ্যে সোনার ঢেঁকি… পাড়ের শব্দও শুনি। ঠিক তক্ষুণি, পর্দাজুড়ে দৃশ্যমান, হাঁক দিয়ে চলে যাচ্ছে দইঅলা বলে একটা চরিত্র, আমি তার পিছু পিছু এগিয়ে যাই কয়েক পৃষ্ঠা, হঠাৎ সামনে পড়ে পোড়ো রাজবাড়ি, রাজবাড়িটা ভাঙা ভাঙা এবং ভৌতিক… ভীতিলুব্ধ সিঁড়িতে একটা প্রজাপতি, আমি প্রজাপতিকে লক্ষ করে উপরে উঠতে থাকি। প্রত্নকোঠার ছাদের কিনারে গিয়ে বলি, ‘প্রজাপতি, তোমার আত্মজীবনী আমি মুখস্থ করতে চাই’, শুনেই ডানাঅলা এই প্রায়পাখিটি উড়ে যায়। এবার আমিও উড়তে থাকি প্রায়পাখিটির সঙ্গে, পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা, বাক্যের পর বাক্য, শব্দের পর শব্দ, প্রয়োজনীয় নৈঃশব্দ… প্রজাপতি, আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তুমি কি কোনো বংশীবাদক, সুরের ফাঁদে ষড়যন্ত্র করছ? ট্র্যাপ করে পাহাড়ের দিকে টানছ?
রহস্যপুর গল্পের তেইশতম পৃষ্ঠায় সেই হাইডআউট লোকেশন, পাঠক যেখানে অসহায়, দুরু দুরু-সন্ত্রস্ত কিন্তু এগিয়ে যেতে উৎসাহী। প্রতিষ্ঠিত অন্ধকারে মুখোমুখি এক মায়াবী অধ্যায় : আলো হয়ে প্রকাশিত নারী। নারীর সর্বাঙ্গে সদম্ভ আগুন, অহোরাত্র নারীকে পড়তে গিয়েই আগুনে পুড়তে হয়… এই নিয়তি নির্ধারিত বলে, মন পুড়ে যায়। পোড়া মন চিকিৎসাধীন… নার্সও দেখতে প্রায়নারী, বেতন-ভাতায়।
আমি রহস্যপুর হাসপাতালে শুয়ে আছি, গল্পের মাঝামাঝি কোনো পৃষ্ঠায়। খুবই জানি, সুস্থ হলেই আবারও সেই ষড়যন্ত্র, প্রজাপতির। হয়তো আমারও খুব ইচ্ছে করবে, তার ডানার খোপের অন্ধকারে রঙ মেখে ঘুমিয়ে থাকি, জাগি। বোঝাই তো যাচ্ছে, এরপর গল্পে একটা খুন এসে যাবে। টিকটিকিরাও জানাচ্ছে, চিরকালই খুনের প্রেরণা নারী। সিরিয়াস পাঠক আমি, হিটলিস্টে আছি, সুতরাং খুন হয়ে যাব– এই ভয়ে অসুস্থ থাকি। হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে (জন্মদোষে) নার্স ও নারীর আন্তঃপার্থক্যটুকু ধরার চেষ্টা করছি, পড়ার চেষ্টা করছি… আমার পোড়ামন চিকিৎসাধীন
এদিকে বসন্তদিন…
খুব ভালো হতো
মনে করো সেই পার্বত্য কবিতাটি আমি বাংলায় লিখছি…
পাহাড়ি মেয়েটি ঝর্নার পাশে বসে খুব ভয়ে ভয়ে কাঁদছে। উপত্যকার যৌবন আর্তনাদে আর্তনাদে ফুঁপিয়ে উঠছে। এ সময় মনে হয়, আত্মার অব্যক্ত বিলাপনই মর্মর কবিতা…
কবিতার আগে রচিত হলো ঘটনা। যতদূর মনে পড়ে, ঘটনা সম্ভবত এরকম যে, পাহাড়ি ছেলেটি আলিঙ্গন ছিন্ন করে বলল, ‘যেতে দাও, যাই?’ মেয়েটি বলল, ‘আর একটু উত্তাপ দিয়ে যাও, বুকের, না হয় আজ আর যেও না…’ তবু পাহাড়ি ছেলেটি মেয়েটিকে দীর্ঘ এক চুমু খেয়ে বলল, ‘আসি?’
মেয়েটি কাঁদছে: সে আমাকে রেখে যখন চলে গেল, ঝিরিপথে প্রচুর নুড়ি থাকায় কিছুদূর যেতেই আমি তার পা’র গোড়ালি আর দেখতে পেলাম না। আমি তাকে পেছন থেকে এতো করে ডাকলাম, তবু এই ঝর্নার শব্দে শব্দে সে আমার ডাক শুনতে পায়নি। কুয়াশাও চায়নি আমি তাকে বহুদূর পর্যন্ত দেখি, তাই আর কিছুদূর যেতেই সে আমার দৃষ্টিসীমানা ডিঙিয়ে গিয়ে পাহাড়ের ওপারে চলে গেল
কিছুক্ষণ পর, উপত্যকায় গুলির শব্দ হলো। ছেলেটি আর ফিরল না। পাহাড়ি মেয়েটি তাই ঝর্নার পাশে বসে খুব ভয়ে ভয়ে কাঁদছে যদি ঝর্নাজলে ভেসে আসা এই রক্ত তার প্রণয়ের রক্ত না হতো, খুব ভালো হতো, খুব ভালো হতো, খুব ভালো হতো
সব কবিতার শিরোনাম লাগে না
রোদ তুই ছন্দ জানিস? মাত্রা মানিস?
সামান্য ফাঁক-ফুটো পেলেই ঢুকে পড়িস?
রোদ তোর আসার পথে দেখা হয়েছে কার কার সঙ্গে, বল?
মেঘরা ছিল কোন বৃত্তে, কথা হয়নি আমাকে নিয়ে?
পরিপার্শ্বের হাওয়া, কার কাছে তুই অক্ষরবৃত্ত শিখে হয়েছিস হিম?
কোন ছন্দে পাতা ঝরে? বলদ এবং বাঙলা বিভাগের
বিরাট অধ্যাপকের মধ্যে যবে এত অনুপ্রাস তবে এত মিল?
গান তুই হাওড়ের মাঠে শুয়েছিলি শীতকালে
তোর উস্তাদ কোন কুলাঙ্গার খাঁ?
ধান তুই আমার শব্দে বোনা ফসল
মহাজন সাহিত্য সম্পাদক?
রোদ আজ সব খুলে বল, আমি তো তোকে জানি-
ড ফুলস্টপ না করেও তুই কেমনে কবিতা লিখিস
অচেনা ম্লান-মুখে?
জোশ জোশ!
চটি পড়েনি, কী নিরক্ষর!
থ্রি এক্স দ্যাখেনি
কী গ্রাম্য!
চড়ুই সেক্স করছে মহাসুখে…
পরিস্থিতির ধারাবিবরণী
শব্দে নদী ধরে আনি
নদীর মধ্যে মাছ, মাঝিমাল্লা, নৌকা ধরা পড়ে
সম্পর্ক ধরতে গিয়ে
বারবার দূরত্বের গল্প তৈরি হয়
আর পাঠকের সঙ্গে নৈকট্য বাড়ে
ধরা বড় মুশকিল, মেঘ
মেঘ ধরতে গিয়ে দেখি
কবিতার খাতা ভিজে যাচ্ছে
মাথা ভিজে যাচ্ছে
আমি গগনশিরিষের পাশে দাঁড়িয়ে আছি
আরেকটু উচ্চতার সন্ধানে
আমি পতন শব্দটি লিখব বলে
পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসেছি
কে আজ কার চোখ আয়না ভেবে তাকিয়ে আছে
কে আজ কার হয়ে উঠছে বা উঠছে না
দিগন্তের দিকে কোনো লাল ঘোড়া ছুটছে কি ছুটছে না
সেই দৃশ্য ধরতে গিয়ে সিনেমার মধ্যে ঢুকে পড়েছি
আর মনে হয় কবিতা আমাকে ধরতে পারবে না
আমি ধরতে পারব না কবিতাকে
এতকাল ঘুমানো বালিশের মতো ভালোবাসতাম যাকে
মনে হলো
অক্টোবরকেই মনে হচ্ছিল, ফেব্রুয়ারি মাস
কেন, তা তদন্ত হলেই সব বেরিয়ে আসবে
বসন্তের হাওয়া আসছিল ভেন্টিলেটর দিয়ে
মনে হচ্ছিল, কবিতা লেখার আর প্রয়োজন নেই
নদীর ধারেই বা কেন যাব
কোনও বাড়িঘর নেই
সমস্ত শহর এক জঙ্গল
গাছ আর পাখি
মনে হলো, আমি পাখির দলেই থাকি
কেন?
আমার চোখও পাখির মতো চোখ
আমার ঠোঁটও পাখির ঠোঁটে গাঁথা
মনে হলো, তুমিই পদাবলি, মধ্যযুগের বাংলা কবিতা
কেন?
আমাকে রিমান্ডে নিলেই সব রহস্যের মীমাংসা হবে
আমি কি পোড়াচ্ছি আমাকে
কোনও ডাইনিকে ভালবেসে ফেলেছি তবে?
টোকন ঠাকুর
কবি ও চলচ্চিত্রকার
জন্ম: ১ ডিসেম্বর ১৯৭২, ঝিনাইদহ
পড়ালেখা : গাড়াগঞ্জ সরকারি প্রাইমারি স্কুল, গাড়াগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শৈলকুপা, ঝিনাইদহ; ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজ; প্রাক
বিএফএ, খুলনা আর্ট কলেজ; বিএফএ-এমএফএ, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশনা : অন্তরনগর ট্রেন ও অন্যান্য সাউন্ড (১৯৯৮), দূরসম্পর্কের মেঘ (১৯৯৯), আয়ুর সিংহাসন (২০০০), কবিতা কুটিরশিল্প (২০০১), ঝাঁ ঝাঁ ঝিঁ ঝিঁ (২০০৩), নার্স, আমি ঘুমোইনি (২০০৮), কুরঙ্গগঞ্জন (২০১০), তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না (২০১০), ভার্মিলিয়ন রেড (২০১১), রাক্ষস @মসধরষ.পড়স (২০১১), শিহরণসমগ্র (২০১১), আমি রিলেটিভ, মেসো (২০১১), এক ফর্মা ভালোবাসা (২০১১), প্রেমের কবিতা (২০১১), ঘামসূত্র (২০১২)
গল্পগ্রন্থ প্রকাশনা : জ্যোতি চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিল (২০১১), সুঁই ও ব্লেড (২০১১), মি.টি.মি.অ. এন্ড মিসেস মেঘের গল্প (২০০৮)
উপন্যাস প্রকাশনা : চরৈবেতি (২০১১), কুয়াকাটা (২০১১), মমি (২০০৯)
সম্পাদিত স্মারকগ্রন্থ : একবার পায় তারে (চিত্রকলা বিষয়ক, ২০০৪), ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী ((চিত্রকলা বিষয়ক, ২০০৫)
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র : তরমুজ, শালিক দিবস, দি গ্রেট অস্কার, শুধু শুধু, ওয়ানস আপন আ টাইম, স্প্রিং উইদাউট স্ক্রিপ্টম ব্ল্যাক আউট।
কাঁটা নামক একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র নির্মাণরত।
পুরস্কার : এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ লেখক পুরস্কার, ২০১০