আজকের পশ্চিম বাংলা এবং জীবনানন্দের ১৯৪৬-৪৭

আমাদের কথা

বৃহৎ বঙ্গের নদীমাতৃক বরিশাল জেলা থেকে কলিকাতায় এসেছিলেন মূলত জীবিকার কারণেই। কিন্তু ঔপনিবেশিক শহর কলিকাতা আর তার বাবুয়ানি ও শহুরে বাত্তি ঝলমলে পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি সেভাবে। তাঁর মন পড়েছিল জন্মভূমি বরিশালেই। কলকাতার রণরক্ত সফল নাগরিক জীবনে তিনি নানা কিছু চাক্ষুষ করেছেন, সেসব তাঁর কবিতায়, গদ্য সাহিত্যে ছাপ রেখে গেছে। আর কোথাও কোথাও তাঁর কাব্য, তাঁর সাহিত্য সময়ের প্রামাণ্য দলিল হয়ে আজও সাক্ষ্য দিচ্ছে ইতিহাসের। বড় বাংলার কবি জীবনানন্দের জন্মদিন আজ ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি। আমরা তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘১৯৪৬-৪৭’ পাঠের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের গলিঘুঁজি থেকে পর্যালোচনা করব আজকের সময়টাকে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যদি এই কবিতাটি পাঠ করি, অনায়াসে টের পাবো কীভাবে ১৯৪৬ ও ৪৭ এই দুইটি বছর কীভাবে উঁকি দিচ্ছে আজকের পশ্চিমবঙ্গের সমাজজীবনে, গণজীবনে।

বস্তুনিষ্ঠভাবে ইতিহাস পাঠ করলে, দলিল, তথ্যাদি পোস্টমর্টেম করলে আমরা অনায়াসে যা পেয়ে যাই, তা হলো ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ এই উপমহাদেশীয় রাজনীতির সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্দরে ঘাপটি মেরে থাকা হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে বিগত শতকের চল্লিশের দশকে অবিভক্ত বঙ্গের গণজীবনকে চুড়ান্তভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে মন্বন্তরে, দুর্ভিক্ষে, দাঙ্গায় এবং তার পর চিরবিচ্ছিন্ন করেছে বঙ্গভূমির গণঐক্যকে। ভাগ করেছে বাংলার মাটি। জয়া চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে হালফিলের জনম মুখোপাধ্যায়ের মতো সমাজতাত্ত্বিক ও ইতিহাস বিশ্লেষকদের একাধিক লেখায় এই সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত যে বাংলা ভাগের পিছনে মূল দায় উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদী হিন্দুত্ব। যে বর্ণবাদী হিন্দুত্ব বাংলায় আমদানি করা হয়েছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মাধ্যমে উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে। তারাই ব্রিটিশ প্রভুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় লাখো মানুষকে মন্বন্তর-দুর্ভিক্ষে শুকিয়ে মেরেছে। তারপর সংগঠিত করেছে ছেচল্লিশের দাঙ্গা। যার চূড়ান্ত পরিণতি বাংলা ভাগ।

১৯৪৬-এর পরে দীর্ঘ সময় কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা তাদের পুরানো পাপকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল একপ্রকার। কিন্তু ২০১৪ সালে ভারতের দিল্লির মসনদে দাঙ্গাবাজ মোদি ক্ষমতায় আসার পরেই নতুন করে পশ্চিম বাংলায় বর্ণবাদী হিন্দুত্বের রাজনীতি মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। এবং এই মুহূর্তে গোটা পশ্চিম বাংলায় ভদ্রবিত্ত, বাবু সমাজের একটা বড় অংশ ‘রামজাদা’ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি সব কিছু খারিজ করে উত্তরপ্রদেশ আর গুজরাতের ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আপন করে নিতে তারা প্রস্তুত। আত্মঘাতী খেলায় মেতেছে পশ্চিমবঙ্গের মাসমিডিয়া, চলচ্চিত্রের কলাকুশলীদের বড় অংশ। আরএসএস-বিজেপির হাতে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে দিয়ে হিন্দুত্ব রাজ, গুজরাতি-মাড়োয়ারি-হিন্দুস্থানি রাজ প্রতিষ্ঠা করতে তারা বদ্ধপরিকর। বোঝা যাচ্ছে, ৪৭ থেকে ২০১৯ অবধি (দ্বিতীয় দফায় মোদি-শাহ ক্ষমতায় এলেন যখন) সেক্যুলারিজমের আড়ালে বর্ণবাদী হিন্দুত্ব গোপনে লালন করেছে পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রবিত্ত বাবু সমাজের বড় অংশ।

১৯৪৬-এ দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতায় শহুরে মানুষের মানবিক অধঃপতন চাক্ষুষ করে জীবনানন্দ লিখেছিলেন,

অনেকেরই ঊর্ধ্বশ্বাসে যেতে হয়,তবু
নিলেমের ঘরবাড়ি আসবাব-অথবা যা নিলেমের নয়
সে-সব জিনিস
বহুকে বঞ্চিত ক’রে দু-জন কি একজন কিনে নিতে পারে।
পৃথিবীতে সুদ খাটে: সকলের জন্যে নয়া ।
অনির্বচনীয় হুন্ডি একজন দু-জনের হাতে ।
পৃথিবীর এইসব উঁচু লোকদের দাবি এসে
সবই নেয়,নারীকেও নিয়ে যায় ।


দেখা যাচ্ছে আজও সেই ভাগ বাঁটোয়ারা, অন্যকে ঠকিয়ে, গণমানুষকে প্রতারিত করে কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের শহর অঞ্চলের সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত মানুষেরা লুঠেরাদের দল বিজেপির ছাতার তলায় ভিড়ছে।

আর এই লুঠেরা, প্রতারক, বর্ণবাদী মানুষের ক্ষমতা ও লুম্পেন পুঁজির চাপে যারা হারিয়ে যায়, যারা ভূমিচ্যুত হন, সেইসব হতভাগ্যের জন্যে জীবানন্দ লিখেছেন,

বাকি সব মানুষেরা অন্ধকারে হেমন্তের অবিরল পাতার মতন
কোথাও নদীর পান উড়ে যেতে চায়,
অথবা মাটির দিকে- পৃথিবীর কোনো পুনঃপ্রবাহের বীজের ভিতরে
মিশে গিয়ে পৃথিবীতে ঢের জন্ম নষ্ট হ’য়ে গেছে জেনে,তবু
আবার সূর্যের গন্ধে ফিরে এসে ধুলো ঘাস কুসুমের অমৃতত্বে কবে
পরিচিত জল,আলো আধো অধিকারিণীকে অধিকার-ক’রে নিতে হবে:
ভেবে তারা অন্ধকারে লীন হয়ে যায়…

এইসব ছোটছোট মানুষেরা অকাতরে হারিয়ে যায়। তাদের পিছু পিছু ধাওয়া করে বাংলাভাগ, কিংবা মরিচঝাঁপি, নন্দীগ্রাম, নেতাই-এর গণহত্যা এবং অতঃপর এনআরসি আর সিএএ… নিজ ভূমি, নিজমাটি থেকে তাদের উচ্ছেদ করার প্রক্রিয়া জারি থাকে।

যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে
ব’লে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ-
আর তুমি?’ আমার বুকের ‘পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে শুধাবে সে- রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে
বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালির-‘
কোথাকার কেবা জানে; জীবনের ইতর শ্রেণীর
মানুষ তো এরা সব; ছেঁড়া জুতো পায়ে
বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে;
সৃষ্টির অপরিক্লান্ত চারণার বেগে
এই সব প্রাণকণা জেগেছিলো- বিকেলের সূর্যের রশ্মিতে
সহসা সুন্দর ব’লে মনে হয়েছিলো কোনো উজ্জ্বল চোখের
মনীষী লোকের কাছে এই সব অণুর মতন
উদ্ভাসিত পৃথিবীর উপেক্ষিত জীবনগুলোকে।

বাংলা ভাগের বলি হয়েছিল মতুয়ারা, নমঃশূদ্ররা, প্রান্তিক হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে থেকে যাওয়া বাঙালি মুসলিম স্মাজ। আজ আবার নাগরিকত্ব সংশোধনীর দোহাই দিয়ে, অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানোর দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রীয়সত্তা পরীক্ষা করার জন্যে বাংলায় হাজির হতে চায় বহিরাগত হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি স্লোগান তোলা বর্গীর দল। ওরা অসমে ১৭ লাখ বাঙালিকে ভূমিচ্যুত করেছে এনআরসির মাধ্যমে। এবার টার্গেট বাংলা। বর্গীদের হানার মুখে কাগজ খুঁজতে ব্যস্ত রয়েছে পশ্চিম বাংলার গ্রামগুলোর সরল মানুষগুলো। তাদের প্রমাণ দিতে হবে তারা আদৌ ভারতীয় কিনা। তারা চিন্তায় ডুবেছে প্রয়োজনীয় কাগজ খুঁজে পাবে কি না, নথি জোগাড় করতে পারবে কি না তা নিয়ে।

বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল।
সূর্য অস্তে চ’লে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার
খোঁপা বেঁধে নিতে আসে- কিন্তু কার হাতে?
আলুলায়িত হ’য়ে চেয়ে থাকে- কিন্তু কার তরে?
হাত নেই- কোথাও মানুষ নেই-, বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন
আলপনার, পটের ছবির মতো সুহাস্যা, পটলচেরা চোখের মানুষী
হ’তে পেরেছিলো প্রায়; নিভে গেছে সব।

অথচ বৃহৎ বঙ্গদেশ একদিন স্বাধীন ছিল। পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, ঈশানবঙ্গ, মানভূম ও ধলভূম নিয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসারিত ছিল সোনার স্বাধীন বঙ্গদেশ। ছিল পাল ও সুলতান আমলের স্বর্ণযুগ।

এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে;
নতুন চালের রসে রৌদ্রে কতো কাক
এ-পাড়ার বড়ো মেজো ও-পাড়ার দুলে বোয়েদের
ডাকশাঁখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত…

উপনিবেশবাদ ও সেই সূত্রে আমদানি হওয়া পশ্চিমা আধুনিকতা আমাদের সব অর্জন আত্মসাৎ করে নিয়ে গেছে। বাংলা ভাগ হয়েছে। পূবের বাংলার গণমানুষ রক্ত দিয়ে ফের স্বাধীনতা ও স্বাধীন রাষ্ট্র করলেও ভুবনায়ণ এবং দিল্লির বর্গীদের থ্রেটের মুখে পড়েছে নতুন করে। আর পশ্চিম বাংলা ও তার কেন্দ্র কলকাতা নতুন করে ১৯৪৬-৪৭-এর বাস্তবতায় হাজির। এই অবস্থায় বড় বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক ও আত্মিক মেলবন্ধন আমাদের হয়তো বা নতুন কিছুর হদিশ দিতে পারে। আমরা জীবনানন্দের জন্মদিনে মনে রাখব সেই কথাগুলো-

ওখানে চাঁদের রাতে প্রান্তরে চাষার নাচ হ’তো
ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ফেলে মাঝি বাগ্‌দির
ঈশ্বরী মেয়ের সাথে
বিবাহের কিছু আগে- বিবাহের কিছু পরে- সন্তানের জন্মাবার আগে.
সে-সব সন্তান আজ এ-যুগের কুরাষ্ট্রের মূঢ়
ক্লান্ত লোকসমাজের ভিড়ে চাপা প’ড়ে
মৃতপ্রায়; আজকের এই সব গ্রাম্য সন্ততির
প্রপিতামহের দল হেসে খেলে ভালোবেসে- অন্ধকারে জমিদারদের
চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে চড়কের গাছে তুলে ঘুমায়ে গিয়েছে।
ওরা খুব বেশি ভালো ছিলো না; তবুও
আজকের মন্বন্তর দাঙ্গা দুঃখ নিরক্ষতায়
অন্ধ শতছিন্ন গ্রাম্য প্রাণীদের চেয়ে
পৃথক আর-এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিল।

পড়ুন-

১৯৪৬-৪৭

দিনের আলোয় ওই চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা:
পথে ঘাটে ট্রাক ট্রাম লাইনে ফুটপাতে;
কোথাও পরের বাড়ি এখুনি নিলেম হবে-মনে হয়,
জলের মতন দামে।
সকলকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে র্পৌছুবে
সকলের আগে সকলেই তাই।

অনেকেরই ঊর্ধ্বশ্বাসে যেতে হয়,তবু
নিলেমের ঘরবাড়ি আসবাব-অথবা যা নিলেমের নয়
সে-সব জিনিস
বহুকে বঞ্চিত ক’রে দু-জন কি একজন কিনে নিতে পারে।
পৃথিবীতে সুদ খাটে: সকলের জন্যে নয়া ।
অনির্বচনীয় হুন্ডি একজন দু-জনের হাতে ।
পৃথিবীর এইসব উঁচু লোকদের দাবি এসে
সবই নেয়,নারীকেও নিয়ে যায় ।
বাকি সব মানুষেরা অন্ধকারে হেমন্তের অবিরল পাতার মতন
কোথাও নদীর পান উড়ে যেতে চায়,
অথবা মাটির দিকে- পৃথিবীর কোনো পুনঃপ্রবাহের বীজের ভিতরে
মিশে গিয়ে পৃথিবীতে ঢের জন্ম নষ্ট হ’য়ে গেছে জেনে,তবু
আবার সূর্যের গন্ধে ফিরে এসে ধুলো ঘাস কুসুমের অমৃতত্বে কবে
পরিচিত জল,আলো আধো অধিকারিণীকে অধিকার-ক’রে নিতে হবে:
ভেবে তারা অন্ধকারে লীন হয়ে যায়

লীন হ’য়ে গেলে তারা তখন তো-মৃত।
মৃতেরা এ-পৃথিবীতে ফেরে না কখনো,
মৃতেরা কোথাও নেই; আছে ?

কোনো-কোনো অঘ্রাণের পথে পায়চারি শান্ত মানুষের
হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই ব’লে মনে হয়;
তাহলে মৃত্যুর আগে আলো অন্ন আকাশ নারীকে
কিছুটা সুস্থিরভাবে পেলে ভালো হ’তো।

বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল।
সূর্য অস্তে চ’লে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার
খোঁপা বেঁধে নিতে আসে- কিন্তু কার হাতে?
আলুলায়িত হ’য়ে চেয়ে থাকে- কিন্তু কার তরে?
হাত নেই- কোথাও মানুষ নেই-, বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন
আলপনার, পটের ছবির মতো সুহাস্যা, পটলচেরা চোখের মানুষী
হ’তে পেরেছিলো প্রায়; নিভে গেছে সব।

এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে;
নতুন চালের রসে রৌদ্রে কতো কাক
এ-পাড়ার বড়ো মেজো ও-পাড়ার দুলে বোয়েদের
ডাকশাঁখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত;
এখন টু শব্দ নেই সেই সব কাকপাখিদেরও;
মানুষের হাড় খুলি মানুষের গণনার সংখ্যাধীন নয়;
সময়ের হাতে অন্তহীন।

ওখানে চাঁদের রাতে প্রান্তরে চাষার নাচ হ’তো
ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ফেলে মাঝি বাগ্‌দির
ঈশ্বরী মেয়ের সাথে
বিবাহের কিছু আগে- বিবাহের কিছু পরে- সন্তানের জন্মাবার আগে.
সে-সব সন্তান আজ এ-যুগের কুরাষ্ট্রের মূঢ়
ক্লান্ত লোকসমাজের ভিড়ে চাপা প’ড়ে
মৃতপ্রায়; আজকের এই সব গ্রাম্য সন্ততির
প্রপিতামহের দল হেসে খেলে ভালোবেসে- অন্ধকারে জমিদারদের
চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে চড়কের গাছে তুলে ঘুমায়ে গিয়েছে।
ওরা খুব বেশি ভালো ছিলো না; তবুও
আজকের মন্বন্তর দাঙ্গা দুঃখ নিরক্ষতায়
অন্ধ শতছিন্ন গ্রাম্য প্রাণীদের চেয়ে
পৃথক আর-এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিল।

আজকে অস্পষ্ট সব? ভালো ক’রে কথা ভাবা এখন কঠিন;
অন্ধকারে অর্ধসত্য সকলকে জানিয়ে দেবার
নিয়ম এখন আছে, তারপর একা অন্ধকারে
বাকি সত্য আঁচ ক’রে নেওয়ার রেওয়াজ
রয়ে গেছে; সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে।

সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়- দ্বেষ।
সৃষ্টির মনের কথা : আমাদেরি আন্তরিকতাতে
আমাদেরি সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা
খুঁজে আনা। প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল
ঝর্নার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে
দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল
হ’য়ে আছে ব’লে বাঘ হরিণের পিছু আজো ধায়;
মানুষ মেরেছি আমি- তার রক্তে আমার শরীর
ভ’রে গেছে, পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে
বধ ক’রে ঘুমাতেছি- তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে
মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্রতী
সকলকে আলো দেবে মনে ক’রে অগ্রসর হ’য়ে
তবুও কোথাও কোনো আলো নেই ব’লে ঘুমাতেছে।

ঘুমাতেছে।
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে
ব’লে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ-
আর তুমি?’ আমার বুকের ‘পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে শুধাবে সে- রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে
বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালির-‘
কোথাকার কেবা জানে; জীবনের ইতর শ্রেণীর
মানুষ তো এরা সব; ছেঁড়া জুতো পায়ে
বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে;
সৃষ্টির অপরিক্লান্ত চারণার বেগে
এই সব প্রাণকণা জেগেছিলো- বিকেলের সূর্যের রশ্মিতে
সহসা সুন্দর ব’লে মনে হয়েছিলো কোনো উজ্জ্বল চোখের
মনীষী লোকের কাছে এই সব অণুর মতন
উদ্ভাসিত পৃথিবীর উপেক্ষিত জীবনগুলোকে।
সূর্যের আলোর ঢলে রোমাঞ্চিত রেনুর শরীরে
রেনুর সংঘর্ষে যেই শব্দ জেগে ওঠে
সেখানে সময় তার অনুপম কণ্ঠের সংগীতে
কথা বলে; কাকে বলে? ইয়াসিন মকবুল শশী
সহসা নিকটে এসে কোনো-কিছু বলবার আগে
আধ-খণ্ড অনন্তের অন্তরের থেকে যেন ঢের
কথা ব’লে গিয়েছিলা; তবু-
অনন্ত তো খণ্ড নয়; তাই সেই স্বপ্ন, কাজ, কথা
অখণ্ড অনন্তে অন্তর্হিত হ’য়ে গেছে,
কেউ নেই কিছু নেই- সূর্য নিভে গেছে ।

এ-যুগে এখন ঢের কম আলো সব দিকে, তবে।
আমরা এ-পৃথিবীর বহুদিনকার
কথা কাজ ব্যথা ভুল সংকল্প চিন্তার
মর্যাদায় গড়া কাহিনীর মূল্য নিংড়ে এখন
সঞ্চয় করেছি বাক্য শব্দ ভাষা অনুপম বাচনের রীতি।
মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো
না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল
জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে।
অনেক বিদ্যার দান উত্তরাধিকারে পেয়ে তবু
আমাদের এই শতকের
বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু- বেড়ে যায় শুধু;
তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই ব’লে অর্থময়
জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।

এ-যুগে কোথাও কোনো আলো- কোনো কান্তিময় আলো
চোখের সুমূখে নেই যাত্রিকের; নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার
রাত্রির মায়ের মতো : মানুষের বিহ্বল দেহের
সব দোষ প্রক্ষালিত ক’রে দেয়- মানুষের বিহ্বল আত্মাকে
লোকসমাগমহীন একান্তের অন্ধকারে অন্তঃশীল ক’রে
তাকে আর শুধায় না- অতীতের শুধানো প্রশ্নের,
উত্তর চায় না আর- শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন
অন্ধকারে ঘিরে রাখে, সব অপরাধ ক্লান্তি ভয় ভুল পাপ
বীতকাম হয় যাতে- এ-জীবন ধীরে-ধীরে বীতশোক হয়,
স্নিগ্ধতা হৃদয়ে জাগে; যেন দিকচিহ্নময় সমুদ্রের পারে
কয়েকটি দেবদারুগাছের ভিতরে অবলীন
বাতাসের প্রিয়কণ্ঠ কাছে আসে- মানুষের রক্তাক্ত আত্মায়
সে-হাওয়া অনবচ্ছিন্ন সুগমের- মানুষের জীবন নির্মল ।
আজ এই পৃথিবীতে এমন মহানুভব ব্যাপ্ত অন্ধকার
নেই আর? সুবাতাস গভীরতা পবিত্রতা নেই?
তবুও মানুষ অন্ধ দুর্দশার থেকে স্নিগ্ধ আঁধারের দিকে
অন্ধকার হ’তে তার নবীন নগরী গ্রাম উৎসবের পানে
যে অনবনমনে চলেছে আজো- তার হৃদয়ের
ভুলের পাপের উৎস অতিক্রম ক’রে চেতনার
বলয়ের নিজ গুণ র’য়ে গেছে ব’লে মনে হয়।

Share