আজ বৃহস্পতিবার, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বৃক্ষমালা, জলরাশি, আসমান

।। অতনু সিংহ ।।

আমি সর্বত্রই আছি
কারণ প্রেম আমারে পাগল বানায়েছে
তুমিও সর্বত্র কারণ তুমি এই দুনিয়ার ‘দয়ালচাঁন’
আমাদের ভরসার মালিক তুমিই
তুমিই এই প্রকৃতি আমার, এই বেলা-অবেলা,
এই কবিতার বাক্যের ভেতর তুমিই রুহু
আর বৃক্ষমালা, জলরাশি, আসমান,
একান্তে আমাদের আয়নামহল…

শ্রাবণ

গঞ্জের প্রাচীন প্রবাদে বৃষ্টি আসছে
আর এই ঘর ও দালান তুমি হয়ে গেছ
আহা দিনরাত…
এইবার নীরবে যাই,
এইবার হেডফোন ঘিরে গান
আলো নিভে যায়
আলো জ্বলে
ভিতরের জোনাক পোকায়

(জুলাই, ২০১৯)

কথোপকথন

একদিন টেলিফোনের ভিতর বৃষ্টি ফুরিয়ে যায়, এমনকি হাওয়ার রুমাল, উড়োচুল, ট্রাকে করে পরপর সিনেমার ফ্রেম, আলোর উৎস… গলির ভিতরে রোদের আঁকিবুকি, ব্যাস্ত ভিআইপি রোড থেকে অনেক চিৎকার ঠেলে স্নানের গল্প বলা… একদিন টেলিফোনের ভিতর জানলা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ভিতরের জেগে থাকা- গান হয়ে, ফিসফিস হয়ে, নরম হলুদ হয়ে

ঘুমকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ঘুম। একদিন, টেলিফোন… আলোছায়া টেলিফোন।

(সেপ্টেম্বর, ২০১৭)

পূব ও পশ্চিম

বৃষ্টি ও যমুনায় পূবের সজল
দেখিয়াছি এইবার দেশের বাংলায়
যেন ঘুম থেকে উঠে
স্নানিয়ে নিয়েছেন কিশোরী
শাকান্ন নিয়ে ব্রিজ পার হয় ট্রাক
জুম্মার আজানে ভিজছে শরৎ
আজ উমা আসবেন সন্ধ্যায়
রেলের জানলা দিয়ে
উমা নদী দ্যাখে
জল বহে, মিঠাপানি বয়ে যায়
আমাদের উমা বৃষ্টি ও যমুনা—
যমুনার রাধারানী—

সেই মুখ দেখিয়াছি এইবার
নাম তার ফতেমা
ফতেমা নবীর মেয়ে
ফতেমা আম্মা আমাদের বাংলা,
গিরিরাজ কন্যা বাংলার উমা
এই দেশ তার নোলকের
তাহার খেলনাবাটির
এই দেশ অন্নপূর্ণা
বৃষ্টিতে আসবেন উমা
নৌকার গান হয়ে,
পূব মেখে আমিও ফিরে যাই আমার
পশ্চিম বাংলায়

(অক্টোবর, ২০১৮)

কোরআন অর্থাৎ যা পঠিত হয়

তোমার চিহ্ন ছড়ায়ে আছে আমার সকল ঘরে
আমি পাঠ করি তোমারে এইবার
বসন্ত ফুরায়ে আসার সময়
একটি বিচ্ছিন্ন দুপুরে
আমবাগান হতে বাতাস বইছে,
স্নান সেরে নিতে হবে ব’লে
স্যান্ডেল খুলে রেখে
আমি যাই স্থির ওই জলাশয়ে
আমারে তো তুমিও দ্যাখো
হে আকাশ ও পানির ঈশ্বরী আমার
হে চরাচর, তোমারে মন্ত্রমুগ্ধ পাঠ করি
তুমিও পরখ করো আমায়
তোমার-আমার পাঠোদ্ধারে বসন্তে বারবার
সবুজ হয় বনাঞ্চল, আম্রমুকুলের সুবাস
ছড়ায়ে যায় আমাদের ঘর ও দুয়ারে, প্রতিবেশে,
শান্তিকল্যান গেয়ে ভোরবেলা দুয়ারে দাঁড়ায় ফকির
চিহ্নের জগত বাঙ্ময় হয়
মগ্নচৈতন্যে আমরা গেয়ে উঠি আয়াত,
পাঠ করি ত্রিভূবন…
গোসলের পানি লেগে থাকে আয়নায়!
মক্তব হতে ভেসে আসে পাঠ,
মিছিলে জিন্দাবাদ ধ্বনি…
আমি সর্বত্রই আছি
কারণ প্রেম আমারে পাগল বানায়েছে
তুমিও সর্বত্র কারণ তুমি এই দুনিয়ার ‘দয়ালচাঁন’
আমাদের ভরসার মালিক তুমিই
তুমিই এই প্রকৃতি আমার, এই বেলা-অবেলা,
এই কবিতার বাক্যের ভেতর তুমিই রুহু
আর বৃক্ষমালা, জলরাশি, আসমান,
একান্তে আমাদের আয়নামহল…

(মার্চ, ২০২০)

মারেফত

ধরো চিত্রবহুল
এই সংসার,
তাঁবুর সিনেমা ভোর-ভোর
মারেফত হয়ে গেছে
তার নুপুরে
তন্দ্রা ঘনায়
আলো হয় উঠোন
তার নৈঋতে ডাক ওঠে
ডাকচিঠি
আলাপ ছোঁয়ার
তার জানালা আওয়াজ
ছায়াঘর ফিসফিস
বন্দুক রাখা রাজকীয়
সঙ্গীত ওঠে ধরো
খঞ্জনি
সানাই সানাই নহবত
আর চুপচাপ
চিলেকোঠা
ঘুমরাতে যেমন
জলের স্বভাব

(নভেম্বর, ২০১৯)

‘বিদেশ’

দ্যাখো এইবার যে আলোয়
ফুটেছে ভোরের নাম
তার কোনো কথা নেই
নিশ্চিন্ত স্নানের ভিতর
জলের শব্দে কেবল
ঘরের স্মৃতি ব্যঞ্জনা হয়ে ওঠে!
লাগেজের চাকায়
ঘুম ফুরায়ে যায়,
তার আলো পেরিয়ে যাবে
নদীনালা, বর্ষার ঢেউ,
কেউ কোনো কথা বলবে না আর
টিকিট কাটা হবে,
পিছনে থাকবে পড়ে
তোমাদের রাস্তাঘাট, অলিগলি…
আসলে সেসব আমার নয়
হয়তো তোমার ছিল
কিংবা বিদেশবিভুঁই
ঘটনা যেমন
ভেবে নিতে হবে না-কথায়
নেহাত সবই ‘বিদেশী’-যাপন

(জুলাই, ২০১৯)

ছাই

কেননা মানুষেরই কোনো দাম নেই
তাই সে যা উচ্চারণ করে
গলাভর্তি জলে ডুবে
তাই সে সূর্যোদয় দেখে পাহাড়ে যে
গোপনে ওড়ার কথা বলে
কিম্বা স্বপ্নের ভিতর নক্ষত্রস্নানের দৃশ্য
দেখে সে যখন সবুজ সবজির কাঙ্খা
আর বনাঞ্চলে কিশোরীর গানের ভিতর
বৃষ্টি নামার আশা নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে,
কিছুই চায় না তবু শ্বাসের আড়ালে থাকা
পরমার্থের খোঁজে সে যখন
উচ্চারণ করে ধ্বনিমধুরিমা
সেটুকুই কবিতা কি না কিম্বা
জানলার রোদ ত্বক স্পর্শ ক’রে গেলে
মনে পড়ে, বৌদ্ধমঠের দিকে ধেয়ে আসা
বৈকালিক পাখীদের ঝাঁক কিম্বা নেহাত
ওষ্ঠের স্বাদ, গ্রীবার তন্দ্রা, নাভির আখ্যান—
হয়তো কবিতা হতে পারে
যেভাবে জগতের সমস্ত মঙ্গল ঝরে পড়ে বর্ষামঙ্গলে—
সেসবের কি বা মূল্য অবশিষ্ট আছে
মূল্যের অধিক তো কিছু নাই
এমনকি আমাদের রাত্রিজাগরণ— ‘বাবু ঘুমায়ে যাও আমি জেগে আছি,
তোমার ঘুমের পাশে, জ্বরের শিয়রে…’
— রূপাকাঠি দিয়ে লেখা এমন উচ্চারণ
আর কিছু বাকি আছে নাকি!
মানুষেরই দাম নাই আর
মানুষের লেখা কবিতা তাও কবেই
আত্মধ্বংসের চিৎকার হয়ে পুড়ে গ্যাছে
সুতরাং কবিতা লেখার কোনো মূল্য চাইনি এখানে
বাছারা তোমরা লেখো দিস্তাদিস্তা
ছাপাও, পিঠ চাপড়াও একে অপরের
আমি দেখি বনাঞ্চলে ছাই উড়ে যায়
গাছেদের, হরিণের, বাঘের, এমনকি
মানুষেরও ছাই…
ছাপানো-কবিতাটবিতা আমার এখন ছাইপাঁশ মনে হয়!

(মে, ২০১৮)

অতনু সিংহ  

শূন্য দশকের কবি ও গদ্যকার। জন্ম ১৯৮২ সালের ২২ আগষ্ট। স্থায়ী বসবাস পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। পড়াশুনা, পেশা ও বন্ধুসঙ্গের কারণে নানা সময় অস্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন কলকাতার যাদবপুর অঞ্চলে এবং ঢাকার মিরপুরে। ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা ছিলেন প্রায় দুই বছর। এখনও মিরপুর-সহ গোটা ঢাকা শহরটাকে তিনি তাঁর নিজের শহর বলেই মনে করেন। কবিতা ও ভাব-যাপনের দিক থেকে অতনু বৃহৎ বঙ্গের। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্রবিদ্যা বিষয়ে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণজ্ঞাপন (মাসকমিউনিকেশন) বিষয়ে স্নাতকোত্তর। কিছুদিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশুনা করেছেন। এখন অবধি কবিতার বই মোট ৪টি। ‘নেভানো অডিটোরিয়াম’(২০০৯ সাল, ‘লালন’ প্রকাশনা, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ), ‘ঈশ্বর ও ভিডিও গেম’ ( ২০১৪ সাল, ‘হুডিনির তাঁবু’ প্রকাশনা, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ), ‘বন-পাহাড় থেকে সে কেনই-বা ফিরবে এ কারখানায়’ (২০১৭ সাল, ‘কবীরা’ প্রকাশনা, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ) এবং অবধি সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ঘুমের চেয়ে প্রার্থনা শ্রেয়’(২০১৯ সাল, ‘বেহুলা বাংলা’ প্রকাশনা, ঢাকা, বাংলাদেশ)। কবিতা লেখার পাশাপাশি নানা বিষয়ে নিয়মিত গদ্য লেখালেখি করেন। একটি ছোটগল্প সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে প্রায় এক দশক আগে, নাম ‘অপর লিখিত মনোলগ ও কয়েকটি প্যারালাল কাট’ (‘হুডিনির তাঁবু’ প্রকাশনা, ২০১০ সাল) কাব্যচর্চার পাশাপাশি চলচ্চিত্রচর্চা ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। ২০১২ সালে নির্মাণ করেন ‘প্রিয় মরফিন’ নামক পূর্ণদৈর্ঘ্যের একটি স্বাধীন চলচ্চিত্র। এক সময় কবিতা পত্রিকা ‘লালন’-এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে অনলাইন ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। আরেকটি পরিচয়, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় একজন সমাজকর্মী। পেশা মূলত সাংবাদিকতা। আগ্রহ বঙ্গের ভাবান্দোলন পরম্পরায়।

Share

3 thoughts on “বৃক্ষমালা, জলরাশি, আসমান”

  1. অনেক ভালোবাসা জানবেন ভাইয়া। আপনার কবিতা ভীড়ের থেকে পৃথক দাঁড়িয়ে থাকে।কেউ ভালোবাসবে, কেউ বাসবে না কিন্তু এর উপস্থিতি কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারবে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top