আজ রবিবার, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নাথপন্থা ও গোরখ-শবদি

।। অভিষেক ঘোষ ।।

উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথেরা হিন্দুত্ববাদের ‘মতাদর্শ’ প্রচারে ভারতীয় উপমহাদেশের যোগসাধনার গুরত্বপূর্ণ ধারা নাথপন্থার ব্র্যান্ড ব্যবহারের চেষ্টা চালান। সঙ্ঘ পরিবারের ব্রাহ্মণ্যবাদী, মনুবাদী ও হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচার ও প্রসারে আদিত্যনাথ নিজের গোরক্ষনাথ পরম্পরাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতেও কুন্ঠাবোধ করেন না। কিন্তু গোরক্ষনাথ ও সামগ্রীক নাথপন্থের ইতিহাস ও দর্শন নিয়ে চর্চা করলে বোঝা যেতে পারে যে বর্তমান হিন্দু পরিচিতিবাদ এবং রাম উপাসক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাথে এই পন্থের সম্বন্ধ বা বিরোধ কতটুকু! আদৌ হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে নাথপন্থার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে এই লেখায়। বলে রাখা ভালো বঙ্গের ভাবান্দোলনে, বঙ্গের ভাবচর্চায়, কাব্যে নাথপন্থার নিবিড় যোগাযোগ। যেহেতু অবৈদিক নানা সহজ ধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে এবং সুফিদের সঙ্গে নাথেদের নিবিড় যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল এক সময়। তাই এই লেখার সঙ্গেই সংযুক্ত থাকছে গোরক্ষনাথ ও তাঁর সম্প্রদায়ের বেশ কিছু কালাম বা পদ বা প্রবচন, যাকে বলা হচ্ছে গোরক্ষ-শবদি।

মহেঞ্জোদরোয় প্রাপ্ত অসংখ্য শীলমোহরে ক্ষোদিত একটি বিশেষ মূর্তিকে অনেক গবেষক যোগী মূর্তি বলে অনুমান করেছেন। যদিও সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ায় এই বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা সম্ভব নয়। তাঁদের অনুমান যদি সত্য হয় তবে বেদপুর্ব যুগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে যোগ সাধনার বিকাশ হয়েছিল বলে অনুমান করা যেতে পারে।

 

বিভিন্ন প্রকৃতি উপাসক জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকেই যোগের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। যাগযজ্ঞ মূলক বৈদিক সাধনাও ছিল প্রকৃতি উপাসনার নামান্তর। তবে বৈদিকদের মধ্যেও গুহ্য সাধনার কথা জানা যায়। ক্রিয়াকাণ্ডবাদী যাজ্ঞিকরা সোম লতা ছেঁচে সেই রস আহুতি দিতেন এবং নিজেরাও পান করে অমরত্ব লাভ করবেন বলে ভাবতেন। কিন্তু বৈদিক গুহ্য সাধকেরা এই যজ্ঞ মদ্যপের আড্ডা বলে বিদ্রূপ করতেন। তাদের মতে যারা সোম লতার রস পান করে ভাবে সোম বা অমৃত পান করছে তাঁরা কখনই ব্রহ্মবিদ যে সোমকে জানেন তা লাভ করে না। বৈদিক যুগেই চার্বাক, সাংখ্য, যোগ, বৈশেষিক, ন্যা্‌য়, জৈন, বৌদ্ধ প্রভৃতি দর্শন বেদের প্রাধান্য এবং অপৌরুষেয়ত্বকে অস্বীকার করেছিল। এই সব দর্শনের মধ্যে সাংখ্য, যোগ, জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনের সাথে যোগ সাধনা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল। এইগুলি নাস্তিক দর্শন নামে পরিচিত ।

জৈনদের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথ বা আদিনাথ নামে পরিচিত, যিনি তেইশতম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ এবং চব্বিশতম তীর্থঙ্কর মহাবীরের চেয়ে বহু প্রাচীন। গৌতম বুদ্ধও তাঁর পূর্ববর্তী পাঁচজন বুদ্ধের কথা বলেছেন। তাদের নাম বিপসসী, শিখীন, বিশ্বভূ, ক্রকুৎসন্দ এবং কশ্যপ। পরবর্তীকালে নিগম অর্থাৎ বৈদিক সাধনার বিপরীতে অবৈদিক বা আগম ধারার মধ্যে প্রকৃতি উপাসনা এবং যোগধর্ম প্রবাহিত হয়েছিল। এই আগমের মূল পাঁচটি শাখা- শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, জৈন ও বৌদ্ধ, একত্রে পঞ্চাগম নামে পরিচিত। গাণপত্য আগম শৈব শাক্তের মধ্যে এবং সৌর আগম বৈষ্ণব আগমের অন্তর্ভূক্ত। আগমকেই পরিশুদ্ধ করে প্রকৃতি উপাসনা ও যোগ সাধনাকে ধরে তন্ত্র এসেছে। তাই যোগ সাধনার প্রাচীনত্ব নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু নবনাথ পরম্পরা সেই তুলনায় নবীন। নবনাথ চুরাশী সিদ্ধগন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। তা সত্ত্বেও নাথপন্থের ইতিহাস আলোচনা করা কঠিন, কারন সমগ্র নেপাল, তিব্বত ও ভারতীয় ধর্ম সাহিত্যে এদের নিয়ে কিংবদন্তি ও অলৌকিক কাহিনী  প্রচলিত। ফলত তাদের কাল নির্ণয় করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পরে এবং গবেষকগণ কখনোই একমত হতে পারেন না। তবে বিভিন্ন গবেষকের মত থেকে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে খৃষ্টীয় সপ্তম/অষ্টম শতাব্দী থেকে নাথ সিদ্ধ পরম্পরা নেপাল, তিব্বত-সহ পূর্ব, পশ্চিম ক্রমে দক্ষিণ ভারতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একই সময়ে তিব্বতে পদ্মসম্ভবের হাত ধরে বজ্রযানী বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করে। অনেকের মতে ভারতে মহাযান বৌদ্ধ তন্ত্রের অবক্ষয়ের যুগে নবনাথ পন্থের বিকাশ। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রথম এই সম্প্রদায়গুলিকে নাথপন্থী নামে উল্লেখ করেন। পূর্বে তাঁরা কৌল, সিদ্ধ, অবধূত সম্প্রদায় ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল।

নাথ সন্ন্যাসীরা গলায় নাদি বা সিংনাদ ও কানে কুণ্ডল ধারণ করেন। কারো কারো মাথায় জটা থাকে। কুণ্ডলের অপর নাম দর্শন। নাথ সম্প্রদায়ের বহু শাখার মধ্যে বর্তমান ভারতে গোরক্ষনাথ সম্প্রদায় এবং কানফাটা দর্শনীনাথ সম্প্রদায়ই অধিক পরিচিত। তাদের মধ্যে গোরক্ষনাথের প্রভাব সর্বাধিক। রাজমোহন নাথ উল্লেখ করেছেন যে অতীতে নাথযোগীরা শিবযোগী ও গোরক্ষযোগী নামক দুটি শাখায় বিভক্ত ছিলেন। শিবযোগীরা আঠেরো পন্থ ও গোরখযোগীরা বারো পন্থ, মোট তিরিশটি শাখা। কালক্রমে শিবযোগীদের ছয় ও গোরখযোগীদের ছয় পন্থ নিয়ে নতুন বারো পন্থের সৃষ্টি হয়। এই বারো পন্থের তালিকাও সম্প্রদায় ভেদে ভিন্ন।

বিভিন্ন গবেষকের মত থেকে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে খৃষ্টীয় সপ্তম/অষ্টম শতাব্দী থেকে নাথ সিদ্ধ পরম্পরা নেপাল, তিব্বত সহ পূর্ব, পশ্চিম ক্রমে দক্ষিণ ভারতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একই সময়ে তিব্বতে পদ্মসম্ভবের হাত ধরে বজ্রযানী বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করে। অনেকের মতে ভারতে মহাযান বৌদ্ধ তন্ত্রের অবক্ষয়ের যুগে নব নাথ পন্থের বিকাশ। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রথম এই সম্প্রদায়গুলিকে নাথপন্থী নামে উল্লেখ করেন। পূর্বে তাঁরা কৌল, সিদ্ধ, অবধূত সম্প্রদায় ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল।             

নবনাথ ও চুরাশি সিদ্ধ  

নবনাথ ও চুরাশি সিদ্ধ সাধারণত মৎস্যেন্দ্রনাথ, গোরক্ষ, জালন্ধর, চর্পটি, কানিফানাথ, ভর্তৃহরি, রেবন, গহীনি, গোপীচন্দ্র প্রভৃতি নয়জন নাথ এবং চুরাশিজন সিদ্ধকে বোঝায়। উত্তর ও দক্ষিন ভারতের নাথ পন্থের বিভিন্ন শাখায় অবশ্য এই নামগুলি বিভিন্ন যথা লোকনাথ, আইনাথ, ধর্মনাথ, সত্যনাথ, কপিলনাথ, নাগনাথ(নাগার্জুন)ইত্যাদী।  নবনাথেদের উৎপত্তি নিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন কিংবদন্তি আছে। সন্ত জ্ঞানেশ্বরের মারাঠি গ্রন্থ যোগীসম্প্রদায়াবিষ্কৃতিতে নবনাথের উৎপত্তির কাহিনী এই – দ্বাপরের শেষে ঋষভ রাজার নবপুত্র কবিনারায়ন, করভাজন নারায়ণ, অন্তরিক্ষ নারায়ণ আদি নবনারায়ণের জন্ম হয়। নারদের পরামর্শে তাঁরা কৈলাশে শিবের কাছে যান। তাঁরা মৎস্যেন্দ্রনাথ, গোরক্ষনাথ, জ্বালেন্দ্র, গহনিনাথ, কানিফনাথ, চর্পটনাথ, রেবননাথ, নাগনাথ, ভর্তিহরিনাথ ও গোপীচন্দ্রনাথ নামে পরিচিত হলেন। এখানেও দশজন সিদ্ধের কথা বলা হল। মৎস্যেন্দ্রনাথ ও জ্বালেন্দ্র হলেন শিবশিষ্য, গোরক্ষ, চর্পট ও রেবননাথ মৎসেন্দ্রনাথের শিষ্য, গহনি, নাগনাথ ও ভর্তৃহরি গোরক্ষের শিষ্য, কানিপা এবং গোপীচন্দ্র জ্বালেন্দ্রনাথের শিষ্য। হটযোগপ্রদীপিকা অনুসারে   

শ্রীআদিনাথ মৎস্যেন্দ্র সারদানন্দ ভৈরবাঃ।
চৌরঙ্গী  মীন  গোরক্ষ  বিরূপাক্ষ  বিলেশয়াঃ।।
মন্থানভৈরবযোগী সিদ্ধবোধশ্চ কন্থড়ী।
কোরণ্ডকঃ সুরানন্দ   সিদ্ধপাদশ্চ চর্পটী ।
কণেরিঃ পূজ্যপাদশ্চ নিত্যনাথ নিরঞ্জনঃ।।
কাপালি  বিন্দুনাথশ্চ কাকচণ্ডীশ্বরোময়ঃ ।
অক্ষয়ঃ  প্রভুদেবশ্চ ঘোড়াচুলী চ টিণ্টিনী।
ভল্লটির্নাগবোধশ্চ খণ্ডকাপালিকস্তথা।।

এই মহাসিদ্ধগণ হঠযোগ প্রভাবে যমদণ্ডকে খণ্ডন করে ব্রহ্মাণ্ড মধ্যে বিচরণ করছেন। সর্বমান্য নাথ সিদ্ধদের সংখ্যা নয় জনের অধিক। ফলে নয় জন নাথের বিষয়টি পরবর্তীতে কল্পিত মনে হয়। একথা বলা যেতেই পারে যে আদিনাথ ও মৎস্যেন্দ্রনাথ থেকে অষ্টম শতাব্দীতে যে নতুন নাথ পরম্পরা সৃষ্ট তাই নতুন বা নবনাথ সম্প্রদায় নামে পরিচিত হল। এই আদিনাথ আর তীর্থঙ্কর ঋষভনাথ যে এক ব্যক্তি নন তা বলাই বাহুল্য। চুরাশি সিদ্ধর ক্ষেত্রেও আমরা একই সিদ্ধান্ত করতে পারি। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুরাশি জনের তালিকা পাওয়া যায় না। অনেকের মতে চুরাশিটি যোগ সমাধির রূপকে চুরাশি সিদ্ধের কল্পনা। তবে কোন কোন তালিকায় কবিশানন্দ সিদ্ধ, বাগানন্দ সিদ্ধ, বাঞ্ছারাম সিদ্ধ, গোরানন্দ সিদ্ধ প্রভৃতি চুরাশি সিদ্ধের নাম পাওয়া যায়।

তিব্বতি চতুরশীতি সিদ্ধ প্রবৃত্তি তালিকায় মীনপা, গোরক্ষ, চৌরঙ্গ বা চৌরঙ্গীনাথ, শবরিপা বা শবরানন্দ, জালন্ধরপা বা জালন্ধরনাথ, কাহ্নপা বা কানিফনাথ, শবর, ভর্তৃহরি, চপ্পটি প্রভৃতি নাথ সিদ্ধদের উল্লেখ পাওয়া যায়। দশম শতাব্দীর তামিল সিদ্ধদের তালিকায় পঁচিশ জন সিদ্ধের নাম পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে তিন জন চীন দেশের, দুজন সিংহলী ও একজন মিশর দেশের। তিব্বতি চতুরশীতি সিদ্ধ প্রবৃত্তি অনুসারে লুই পা এবং শান্তিপা রামেশ্বর গেছিলেন, বিরূপা দক্ষিন ভারত থেকে পূর্ব ভারতে আসেন, লীলাপা দক্ষিন দেশে যাত্রা করেছিলেন। তামিল সিদ্ধদের তালিকায় মচ্ছমুনির নামও উল্লেখযোগ্য যিনি পেশায় ছিলেন ধীবর।

একথা বলা যেতেই পারে যে আদিনাথ ও মৎসেন্দ্রনাথ থেকে অষ্টম শতাব্দীতে যে নতুন নাথ পরম্পরা সৃষ্ট তাই নতুন বা নবনাথ সম্প্রদায় নামে পরিচিত হল। এই আদিনাথ আর তীর্থঙ্কর ঋষভনাথ যে এক ব্যক্তি নন তা বলাই বাহুল্য। চুরাশি সিদ্ধর ক্ষেত্রেও আমরা একই সিদ্ধান্ত করতে পারি। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুরাশি জনের তালিকা পাওয়া যায় না। অনেকের মতে চুরাশিটি যোগ সমাধির রূপকে চুরাশি সিদ্ধের কল্পনা। তবে কোন কোন তালিকায় কবিশানন্দ সিদ্ধ, বাগানন্দ সিদ্ধ, বাঞ্ছারাম সিদ্ধ, গোরানন্দ সিদ্ধ প্রভৃতি চুরাশি সিদ্ধের নাম পাওয়া যায়।

নাথ সাধনা  

বজ্রযান সিদ্ধাচার্যদের প্রভাবে নবনাথ, চুরাশি সিদ্ধ, কৌলমার্গ, শৈবাগম ইত্যাদী সম্প্রদায় প্রায় একই সময়ে বিকাশ লাভ করেছিল। নাথ সম্প্রদায় কায়া সাধক। কায়া সাধনার মাধ্যমে দিব্য দেহে শিবত্ব লাভ নাথ সম্প্রদায়ের লক্ষ্য। নাথ সৃষ্টিতত্বে শূন্য বা নিরঞ্জন থেকে জগতের সৃষ্টি। নিরঞ্জন লক্ষ্যের অতীত তাই তিনি অলখ।

সে-ই অলেকনাথ আছয়ে শুশ্বর। নাই আদ্য অনাদ্য না ছিল ধর্ম্মেশ্বর।
না ছিল বর্ম্মা বিষ্ণু শিব গঙ্গেশ্বর। না ছিল চন্দ্র-শূর্য্য শর্গে ইন্দ্রেশ্বর।।
না ছিল আকাশ পাতাল ধরণী পবন। না ছিল অগ্নি পানি না ছিল হুর্ত্তাসন।।
না ছিল দরিয়া সাগর কুলাকুল। না ছিল পূর্ব্ব পছিম তিন কুল।। (অথ অনাদ্য চরিত্র)   
শঙ্করে বলেন দেবি শুন তত্ববাত। আদ্যনাথের গুরু যে অনাদির নাথ।।  
অনাদি নিরঞ্জন আকার নেই তার। রূপরেখা নেই নিরঞ্জন নৈরাকার।।
লীলায় সকল সৃষ্টি করয়ে সৃজন। জ্যোতির্ময় নিরঞ্জন অনাদি কারণ।।
নবীন মেঘেতে যেন বিদ্যুৎ আকার। নিরঞ্জন রূপ সেই সংসারের সার।।
কিরূপে সৃষ্টি সেই করিলা অপার। মায়ারূপে সৃষ্টিতে হৈলরে অবতার।।
(হাড়মালা)

বজ্রযানের শূন্যের সাথে এই নিরঞ্জনের ধারনার ঐক্য পাওয়া যায়। অনেকের মতে তন্ত্রের প্রভাবে বজ্রযান, শৈব ও শাক্ত মতের সমন্বয়ে নাথ ধর্মের উৎপত্তি। বাংলার নাথ সাহিত্যে হাড়মালা, গোরক্ষবিজয় ইত্যাদি থেকে নাথ ধর্ম ও সাধনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। গোরক্ষ বিজয়ে যে সাধন পন্থার ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার সাথে পরবর্তী কালের বাংলার বাউল-ফকির মহাজনপদের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারচন্দ্র ভেদ।   

আদ্য চন্দ্র, নিজ চন্দ্র       উন্মত্ত গরল চন্দ্র
চারিচন্দ্র সকল সংসার।
শরীরেতে আদ্য চন্দ্র     দম বহে নিজচন্দ্র
সাধে বসি উজানিনগরে

আদ্যচন্দ্র কর স্থিতি        নিজচন্দ্র সমাইতি
উর্ধচন্দ্র করিবা যে ধ্যান।।
তিন চন্দ্র সম্বুরিয়া          ক্ষেমারে ভান্ডারী দিয়া
তবে সে সকল রক্ষা পায়।।            
(গোরক্ষ বিজয়)

খাদ্যবস্তু থেকে প্রাপ্ত রসের সপ্ততম সার হল শুক্র। যোগ শাস্ত্রে বলা হয়েছে শুক্র বা বিন্দু পাতে মরণ এবং ধারণে জীবন। বিন্দু ক্ষয়ে আয়ু, স্বাস্থ্য ক্ষয় হয়, চিত্ত সর্বদা চঞ্চল থাকে। বিন্দু ধারণে আয়ু ও স্বাস্থ্য লাভ হয়, চিত্ত সমাধিবান হয়। তাই বিন্দু ধারণ সাধকের পক্ষে অবশ্যপালনীয়। গোরক্ষ বিজয়-এ গোরক্ষ নাথ আত্মবিস্মৃত গুরু মীনকে বজ্রোলী মূদ্রা সাধনায় বিন্দু ধারনের কথা বলছেন-

‘নারীর সংহেতে যেমন ঢেউ তুলে পানি।
ইন্দ্রনালে তুলে গুরু আজু-জুয়া পানি।।
আজুজুয়া পানির মধ্যে সপ্ততম সার।
সাধিয়া রাখিবা গুরু কায়া আপনার।।
সিদ্ধির লক্ষণ এই জানিও নিশ্চয়।
শরীর যুবক হয়-পাপ হয় ক্ষয়।।

হাড়মালা পুঁথিতে শিব পার্বতীকে দেহে মধ্যে চন্দ্র-সূর্য, পঞ্চ পীঠ, দশ বায়ু, ষটচক্র, বাহাত্তর হাজার নাড়ী নির্ণয় শিক্ষা দিচ্ছেন।

ডানে বামে গতাগতি করে দুই নারী
ইঙ্গিলা পিঙ্গিলা আছে সুষুম্নারে বেড়ি।।

শঙ্কর বলেন দেবী শুন সাবধানে।
ষড়চক্র ভেদ কথা কহি তব স্থানে।।।
..
সরুয়া শঙ্খিনী ভেদী স্বঘরেতে বসি।
গগন মন্ডলে বন্দী কর রবি শশী।।

বিন্দু ধারণ, উল্টা সাধন, চারিচন্দ্র ভেদ, ওঙ্কার ও হংস মন্ত্র, অজপা সাধন, কুণ্ডলিনী. যোগ, ষটচক্র ভেদ, অনাহত নাদ শ্রবণ ইত্যাদির মাধ্যমে শূন্য সমাধি বা নিরঞ্জন অবস্থা প্রাপ্তি নাথপন্থার মূল সাধনা।   

বাংলার যোগী বা নাথ জাতির বিশ্বাস একাদশ রূদ্র থেকে যোগনাথ, মৎস্যেন্দ্র, গোরক্ষনাথ ক্রমে নাথ জাতির উৎপত্তি। তাই তাঁরা রূদ্রজ ব্রাহ্মণ, শিবগোত্র। সামবেদিয় ক্রিয়া কর্ম, অশৌচ, পিণ্ডদান প্রভৃতি বৈদিক ক্রিয়াকর্মের অধিকারী। এই প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মত বাংলার যোগী জাতি নাথ সম্প্রদায়ের। এরা বাংলার রাজাদের গুরু ছিলেন। ব্রাহ্মণেরা সমাজপতি হবার পর এঁদের গুরুগিরি কেড়ে নিয়েছে ফলে তাঁরা এখন পৈতা ধারণ করে ব্রাহ্মণ হবার চেষ্টায় আছেন। বংশপরম্পরায় নাথ যারা তাদেরকে বিন্দুজ এবং নাথ গুরুর কাছে দীক্ষিত নাথকে নাদজ বলা হয়। রাজমোহন নাথ প্রভৃতি অনেক গবেষক বৈদিক দর্শন ও সাধনার সাথে নাথ সম্প্রদায়ের সম্পর্ক খুঁজেছেন। পূর্বে ব্রহ্মার পঞ্চমুখ ছিল। কন্যাগমনের অপরাধে শিব ব্রহ্মার পঞ্চম মাথাটি কেটে দেন। ফলে পঞ্চম বেদ লিখিত হয় না। নাথপন্থীরা এই পঞ্চম বেদকে বলেছেন নীলানীলবেদ, অনিলবেদ বা  সুষমবেদ (সুক্ষ্মবেদ)। পীতাম্বর দাস বড়থ্বাল অবশ্য তার সম্পাদিত ‘গোরাখ বানী’তে সষম্বেদ শব্দটির অনুবাদ করেছেন স্বসংবেদ। 

‘চারিবেদ পড়িলে ব্রহ্মা না জানিলে আঞ্জি।
আঞ্জি জানি পঞ্চম অনিল বেদ ব্রহ্মা লও পরিমাণি।।

যতি গোরখ বলন্তি ব্রহ্মা না ভাঙ্গিও বেদ।
এহারে বলি সশম্বেদ। সশম্বেদে শ্রীনাথ উনমতি।।’
(অথ সুষম্বেদ)

বাংলার যোগী বা নাথ জাতির বিশ্বাস একাদশ রূদ্র থেকে যোগনাথ, মৎস্যেন্দ্র, গোরক্ষনাথ ক্রমে নাথ জাতির উৎপত্তি। তাই তাঁরা রূদ্রজ ব্রাহ্মণ, শিবগোত্র। সামবেদিয় ক্রিয়া কর্ম, অশৌচ, পিন্ডদান প্রভৃতি বৈদিক ক্রিয়াকর্মের অধিকারী। এই প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মত বাংলার যোগী জাতি নাথ সম্প্রদায়ের। এরা বাংলার রাজাদের গুরু ছিলেন। ব্রাহ্মণেরা সমাজপতি হবার পর এঁদের গুরুগিরি কেড়ে নিয়েছে ফলে তাঁরা এখন পৈতা ধারন করে ব্রাহ্মণ হবার চেষ্টায় আছেন।

লোককথায় নাথযোগীদের কাহিনী  

বাংলায় প্রচলিত নাথপন্থের প্রাচীন বাংলা পুঁথির মধ্যে গোরক্ষবিজয়, মীনচেতন, গোপীচন্দ্রের গান, শূন্যপুরাণ ইত্যাদি থেকে বাংলায় গোরখনাথের জনপ্রিয়তার আভাস পাওয়া যায়। নাথেদের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের আদিগুরু আদিনাথ স্বয়ং শিব। গোরক্ষবিজয় অনুসারে শিবের দেহ থেকে চার সিদ্ধা অর্থাৎ হাড় থেকে হাড়িপা, কান থেকে কানুপা, জটা থেকে গোরক্ষ এবং নাক থেকে মীনাইের উৎপত্তি। শিবের আদেশে দেবী তাদের পরীক্ষা করলেন। দেবীর ছলনায় গোরক্ষ বাদে সকলেরই পতন হলো। দেবীর দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে মীন গেলেন কদলীর দেশে এবং হাড়িসিদ্ধ গেলেন ময়নামতীর দেশে। কদলী রাজ্য নারীশাসিত। সেখানে মীননাথ ষোলশো কদলির মোহে আবদ্ধ হয়ে ধর্ম ভুলে গেলেন। কানুপার কাছে সংবাদ পেয়ে গোরক্ষ গেলেন গুরুকে উদ্ধার করতে। নর্তকীর বেশে গোরক্ষ মীনকে যোগ শিক্ষা দিয়ে কদলীদেশ থেকে উদ্ধার করলেন। কল্যানী মল্লিক উল্লেখ করেছেন মহারাষ্ট্রের দিকে ‘মায়ামচ্ছিন্দর’ নামে ছায়াচিত্র প্রচলিত যেখানে গোরক্ষের অহঙ্কার দূর করার জন্য মৎস্যেন্দ্রনাথ এরূপ মায়া রচনা করেন যার ফলে গোরক্ষ মনে করেন গুরু পতিত হয়েছেন। তাই তিনি গুরুকে উদ্ধারের জন্য শিক্ষা দেন কিন্তু শিক্ষান্তে মৎস্যেন্দ্র সহসা অন্তর্হিত হন ও গোদাবরী তীরে প্রকাশ হন। গোরক্ষও তাঁর ভুল বুঝতে পারেন।  

হাড়িপা বা জালন্ধর ছিলেন মীনের শিষ্য। তিনি দেবীর অভিশাপে ময়নামতীর দেশে ঝাড়ুদার হিসাবে নিযুক্ত হন। গোরক্ষ শিষ্যা ময়নামতি রাজা মাণিকচন্দ্রের স্ত্রী এবং রাজা ভর্তৃহরির বোন। তিনি স্বামী মানিকচন্দ্রকে যোগ শিক্ষাও দিয়েছিলেন কিন্তু রাজা তাঁর কথা অমান্য করে মৃত্যুমুখে পতিত হন। ময়নামতী গোপীচন্দ্রের  জীবন রক্ষার জন্য তাকে হাড়িপার কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করান। কিন্তু অনিচ্ছুক গোপীচন্দ্র বারো বছর সাধনা শেষে ফিরে এসে অলৌকিক বিভূতি দেখাতে থাকেন। তাতে হাড়িপা অসন্তুষ্ট হলে স্ত্রীদের পরামর্শে গোপীচন্দ্র হাড়িপাকে মাটিতে পুঁতে ফেলেন। গোরক্ষের কাছে কানুফা এই সংবাদ পেয়ে ময়নামতির সঙ্গে গুরুকে উদ্ধার করেন। কৌশলে গুরু হাড়িপাকে ক্রোধ মুক্ত করে গোপীচন্দ্র সন্ন্যাস নেন। পঞ্জাবের কাহিনী অনুযায়ী রাজা ভর্তৃহরি একদা রানী পিঙ্গলাকে নিজের মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদ প্রেরণ করেন। রানী পিঙ্গলা শোকে অভিভূত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। গোরক্ষনাথ রানী পিঙ্গলার জীবন ফিরিয়ে দিলে ভর্তৃহরি গোরক্ষের শিষ্য হন। উত্তর ভারতের যোগী সম্প্রদায়ের গায়কেরা অদ্যাবধি সারেঙ্গী সহকারে ভর্তৃহরি ও গোপীচন্দ্রের গান গেয়ে থাকেন। বাংলা থেকে ছডিয়ে বিহার, পাঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাট সহ সমগ্র উত্তর ও মধ্যভারতে গোপীচন্দ্রের কাহিনি জনপ্রিয়।  রংপুরের মুসলমান পালা গায়করা মানিকচন্দ্র, ময়নামতী ও গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাসের গানে প্রসিদ্ধ। কল্যানী মল্লিকের মতে মীনের জন্ম ও পতন কাহিনীকে উপকথা জাতীয় বলা যায় কিন্তু গোপীচন্দ্রের উপাখ্যানের মূলে বাস্তবতা আছে।    

মৎস্যেন্দ্রনাথ    

বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত গ্রন্থে বিভিন্ন অলৌকিক কাহিনীর সমাবেশ থাকলেও একটি বিষয়ে সবাই সম্মত হচ্ছেন যে গোরক্ষনাথের গুরু ছিলেন আদিনাথ শিষ্য মৎস্যেন্দ্রনাথ, মচ্ছিন্দর, মচ্ছন্দ, মোচন্দর বা  মীননাথ। মৎস্যেন্দ্রনাথের জন্মকাহিনী অলৌকিক। শৈশবে পিতামাতা কর্তৃক নদীতে পরিত্যক্ত হলে একটি মাছ  তাকে গিলে নেয়। শিব উমাকে যোগ শিক্ষা দেওয়ার সময় দেবী ঘুমিয়ে পরেন কিন্তু মাছের পেট থেকে সেই বালক শিক্ষা লাভ করেন। শিব জানতে পেরে তাকে উদ্ধার করেন এবং তার নাম হয় মৎস্যেন্দ্রনাথ। নেপাল, বাংলা এবং উত্তর ভারতীয় ঐতিহ্যে মোটামুটি এই তার জন্ম কাহিনী। তিব্বতী কাহিনীতে তিনি কামরূপের  এক ধীবর যাকে মাছ গিলে  নিয়েছিল। মাছের পেট থেকে তিনি শিবের শিক্ষা শ্রবণ করে বারো বছর সাধনায় সিদ্ধ হন ও পরে অপর এক ধীবর দ্বারা উদ্ধার হন। আবার নেপালি তেঙ্গুরে মীননাথ মৎস্যেন্দ্রনাথের সন্তান। তিব্বতি চতুরশীতি সিদ্ধ প্রবৃত্তি অনুসারে মীনপার অপর নাম বজ্রপাদ ও অচিন্ত্যপাদ। তাঁর গুরু মহাদেব মহেশ্বর ও উমাদেবী। চৌরঙ্গ এবং গোরক্ষ অচিন্ত্যপার শিষ্য। অঙ্গহীন চৌরঙ্গকে পাহারা দেওয়ার জন্য অচিন্ত্যপা এক রাখাল বালককে নিয়োগ করেন। পরে অচিন্ত্যপা সেই রাখাল বালককে অভিষেক দান করেন। তাঁর নামকরণ হয় গোরক্ষ। এই মত অনুসারে গোরক্ষের জন্ম কামরূপে। তিব্বতি ঐতিহ্যে তাঁর বৌদ্ধ নাম অনঙ্গবজ্র। অপরাপর ঐতিহ্যে কেউ বাংলায় কেউ নেপালে আবার কেউ পঞ্জাবে গোরক্ষের জন্ম বলে মনে করেন।   

মৎস্যেন্দ্রনাথকৃত কৌলজ্ঞাননির্ণয়, অকুলবীর তন্ত্র, কুলানন্দতন্ত্রম, জ্ঞানকারিকা ইত্যাদি কিছু সংস্কৃত গ্রন্থ পাওয়া যায়। এইসব গ্রন্থে গোরক্ষনাথের উল্লেখ নেই। কৌলজ্ঞাননির্ণয়-এ মৎসেন্দ্র শিবাবতার। তিনি কামরূপে যোগিনী কৌলমার্গের প্রতিষ্ঠাতা। কৌলজ্ঞাননির্ণয় অনুযায়ী মৎস্যেন্দ্রনাথের জন্মস্থান চন্দ্রদ্বীপ। চন্দ্রদ্বীপের অবস্থান যে বাংলায় ছিল এবং তিনি কামরূপে ধর্মপ্রচার করে ছিলেন এ বিষয়ে অধিকাংশ ঐতিহাসিক একমত হয়েছেন। তন্ত্রালোকে অভিনব গুপ্তও শিবতূল্য বলে মচ্ছন্দবিভূ বা মৎস্যেন্দ্রনাথের বন্দনা করছেন। আবার অনেকের মতে মীননাথ ও বৌদ্ধ আদি সিদ্ধাচার্য্য লুইপাদ অভিন্ন। লুইপার রচিত চর্যাপদ এবং বজ্রযানের কিছু গ্রন্থ পাওয়া যায়। বৌদ্ধ বজ্রযান, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব সব পরম্পরাতেই মৎসেন্দ্রনাথ সিদ্ধের মর্যাদাভুক্ত। গোরক্ষপন্থীদের মধ্যে ছাড়া মীনের পতনের কাহিনী অন্য কোন সম্প্রদায়ে পাওয়া যায় না। মৎস্যেন্দ্র সম্প্রদায়ের সাথে গোরক্ষ সম্প্রদায়ের বিরোধের কারনে গোরক্ষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করার জন্যই সম্ভবত এই কাহিনীর অবতারনা।

পীর মৎস্যেন্দ্রনাথের সমাধি

মৎস্যেন্দ্রনাথের জন্মকাহিনী অলৌকিক। শৈশবে পিতামাতা কর্তৃক নদীতে পরিত্যক্ত হলে একটি মাছ  তাকে গিলে নেয়। শিব উমাকে যোগ শিক্ষা দেওয়ার সময় দেবী ঘুমিয়ে পরেন কিন্তু মাছের পেট থেকে সেই বালক শিক্ষা লাভ করেন। শিব জানতে পেরে তাকে উদ্ধার করেন এবং তার নাম হয় মৎস্যেন্দ্রনাথ। নেপাল, বাংলা এবং উত্তর ভারতীয় ঐতিহ্যে মোটামুটি এই তার জন্ম কাহিনী। তিব্বতী কাহিনীতে তিনি কামরূপের  এক ধীবর যাকে মাছ গিলে  নিয়েছিল। মাছের পেট থেকে তিনি শিবের শিক্ষা শ্রবণ করে বারো বছর সাধনায় সিদ্ধ হন ও পরে অপর এক ধীবর দ্বারা উদ্ধার হন। আবার নেপালি তেঙ্গুরে মীননাথ মৎস্যেন্দ্রনাথের সন্তান। তিব্বতি চতুরশীতি সিদ্ধ প্রবৃত্তি অনুসারে মীনপার অপর নাম বজ্রপাদ ও অচিন্ত্যপাদ। তাঁর গুরু মহাদেব মহেশ্বর ও উমাদেবী।

গোরক্ষনাথ

গোরক্ষের জন্মকাহিনীও অলৌকিক। গোরক্ষ বিজয় অনুযায়ী শিবের জটা থেকে মতান্তরে আদিনাথের খুলি থেকে গোরক্ষের জন্ম। নেপালের কাহিনী অনুসারে এক নিঃসন্তান রমণী সন্তানকামনা করলে শিব তাকে ভস্ম খেতে দেন। সেই নারী ভস্মটিকে ঘৃণাভরে গোময়ে নিক্ষেপ করে। বারো বছর বাদে শিব গোময়ের ভিতর থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করেন। তার নাম হয় গোরক্ষ। প্রায় একই কাহিনী আমরা পাই মহারাষ্ট্রীয় গ্রন্থ ‘নবনাথ ভক্তিসার’ থেকে। এই গ্রন্থ অনুযায়ী মৎস্যেন্দ্রনাথের প্রদত্ত বিভূতি রমণী দ্বারা গোরক্ষা বা আবর্জনা ফেলার স্থানে নিক্ষিপ্ত হয় ও পরে  মৎস্যেন্দ্রনাথ তাঁকে উদ্ধার করেন। গোরক্ষনাথের সময় নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকে তার কাল দশম একাদশ শতাব্দী নির্ণয় করেছেন। কিন্তু তিনি শঙ্করাচার্যের কিছু পূর্বে বর্তমান ছিলেন। এই হিসাবে তাঁকে অষ্টম শতাব্দীর বলা যেতে পারে।  

মহারাষ্ট্রের সন্ত জ্ঞানেশ্বরের মারাঠি গ্রন্থ ‘যোগীসম্প্রদায়াবিস্কৃতি’ অনুযায়ী গোরক্ষনাথ গোদাবরী প্রদেশের চন্দ্রগিরি নামক নগরে বশিষ্ঠ গোত্রজ ব্রাহ্মণ দম্পতির সন্তান। তাঁর পিতার নাম সূরজ এবং মা সরস্বতী দেবী। মৎস্যেন্দ্রনাথের কৃপায় সরস্বতী সন্তান লাভ করেন। প্রাক যৌবনেই গোরক্ষনাথ মৎসেন্দ্রনাথের কাছে দীক্ষা নিয়ে গৃহত্যাগ করেন। জ্ঞানেশ্বর রচিত ভাগবত গীতার ভাষ্য জ্ঞানেশ্বরী অনুযা্য়ী – “ক্ষীর-সিন্ধুর ধারে শ্রীত্রিপুরারি পার্বতীর কর্ণকুহরে যাহা বলিয়াছিলেন তাহা ক্ষীরসমুদ্রের কল্পোলের অভ্যন্তরে মকরের উদরে গুপ্ত ছিল, তাহাই তিনি (মৎস্যেন্দ্রনাথ) প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, সেই মৎস্য হইতে উৎপন্ন মৎস্যেন্দ্রনাথ সপ্তশৃঙ্গ পর্বতের উপর আসিলে ভগ্নাবয়ব চৌরঙ্গীনাথ তাহাকে দেখিয়া সর্ব অবয়বে পরিপূর্ণ হইয়াছিলেন, অব্যয় (অটল) সমাধির সুবাস ভোগ করিবার জন্য মৎসেন্দ্রনাথ শ্রীগোরক্ষনাথকে সেই জ্ঞানরহস্য দান করিয়াছিলেন। তিনি (গোরক্ষনাথ) যোগরূপ কমলিনীর সরোবর ও বিষয়বিধ্বংসকারী বীর ছিলেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ তাহাকে সর্ব অধিকার প্রদান করিয়া আপন (যোগৈশ্ব্যর্যের) পদে অধিষ্ঠিত করিলেন” (জ্ঞানেশ্বরী। জ্ঞানেশ্বরের গুরু ছিলেন তাঁর দাদা নিবৃত্তিনাথ। নিবৃত্তিনাথ গোরক্ষ শিষ্য গহিনীনাথের কাছে দীক্ষা লাভ করেন।  

গোরক্ষনাথ নিজেকে আদিনাথের নাতি ও মৎস্যেন্দ্রনাথের পুত্র বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি হঠযোগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বাংলার কাহিনী অনুযায়ী ছলনায় গোরক্ষকে ভোলাতে না পেরে দেবী এক নারীকে গোরক্ষের সাথে বিবাহের আশির্বাদ দেন। কিন্তু গোরক্ষ শিশু রূপ পরিগ্রহন করে স্ত্রীর কাছে স্তন্যপান করতে চাইলেন। স্ত্রী তাঁর এইরূপ দেখে কাঁদতে লাগলেন। গোরক্ষ তাকে বললেন তিনি নারী-পুরুষ লিঙ্গ পরিচয়ের অতীত হয়েছেন, তাঁর শরীর কাষ্ঠবৎ শুষ্ক, দেবী তাকে বর দিয়ে প্রতারণা করেছেন। ইন্দ্রিয় সংযম গোরক্ষনাথের মতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইন্দ্রিয় সংযমের অভাবে সিদ্ধগণেরও পতন হতে পারে। কাম সংযম, বাক সংযম, খাদ্য সংযম ইত্যাদীর কথা বারবার গোরক্ষের পদে পাওয়া যায়। কিন্তু শরীরকে কষ্ট দিয়ে তীব্র কৃচ্ছসাধনার বিরোধী ছিলেন তিনি। দেহে শিকল বা পায়ে বেড়ি ধারণ, নগ্নতা, উপবাস বা দুধ আহার, মৌনতা অবলম্বন ইত্যাদির দ্বারা যোগে উৎকর্ষতা লাভ করা যায় না।

গোরক্ষের রচনায় তিনি সশক্তি শিবের বন্দনা করেছেন কিন্তু বজ্রযানী সিদ্ধ, কৌল তান্ত্রিক বা বাউলদের মতো যুগল সাধনার কথা গোরক্ষের রচনায় পাওয়া যায় না। গোরক্ষপন্থায় নারীকে কামিনী বলে সম্বোধন করে বারবার পুরুষ সাধকদের সাবধান করা হয়েছে। তান্ত্রিকের মদ্য, মৎস্য, মাংস, মূদ্রা ও মৌথুন – এই পঞ্চ ম’কারের সাধনা বা মারণ-উচাটনাদি গোরক্ষ মতে নিষিদ্ধ। তন্ত্রে সাধনার তিনটি পর্যায়কে ভাবত্রয় বলা হয়। ভাবত্রয় হলো পশুভাব, বীরভাব ও দিব্যভাব। পশুভাবের মধ্যে পরে বেদাচার, বৈষ্ণবাচার, শাক্তাচার, শৈবাচার ও দক্ষিণাচার। বীরভাবে বামাচার ও সিদ্ধান্তাচার এবং দিব্যভাবে কৌলাচার। পশুভাবের সাধনা সংযম প্রধান, সাধক তখনো ‘পাশ’ মুক্ত হতে পারেননি, তাই সেখানেও পঞ্চ-মকারাদি নিষিদ্ধ। তন্ত্রের দৃষ্টিতে গোরক্ষ মতকে তাই পশ্যাচার বলা যেতে পারে। গোরক্ষ সম্প্রদায়ে প্রচলিত গোরক্ষ সংহিতা, শিব সংহিতা, ঘেরন্ড সংহিতা, হটযোগ প্রদীপিকা প্রভৃতিতে যম, নিয়ম, আসন, মূদ্রা, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা ধ্যান, সমাধি ইত্যাদীর বর্ণনা আছে। হটযোগ ও রসরসায়নের মাধ্যমে দেহকে অজরামর করার কথা বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত আছে। গোরখ শবদিতে ছ’মাস অন্তর কায়া পালটানোর নির্দেশ আছে এবং এক্ষেত্রে সাপ, ব্যাঙ ও বনষ্পতির উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। গোরক্ষ মতে হঠযোগ প্রভাবে সিদ্ধগন জরা-মৃত্যুকে স্থগিত করে অজরামর দেহে ব্রহ্মাণ্ডে বিচরণ করছেন। অপরদিকে একটি চর্যাপদে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য সরহপা বলছেন যার জন্ম মৃত্যুর আশঙ্কা আছে সেই রসরসায়ন করে। যে তৃষ্ণায় চরাচরে ভ্রমণ করে সে কখনোই অজরামর হতে পারে না।      

গোরক্ষনাথ ও নাথপন্থের প্রভাব    

সুফিরা মধ্যযুগে অসংখ্য সংস্কৃত যোগগ্রন্থ ফার্সী ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। বাবা ফরিদের সঙ্গে গোরক্ষপন্থীদের যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়। মধ্যযুগে বাংলাভাষায় রচিত জ্ঞানপ্রদীপ, যোগ কলন্দর প্রভৃতি সুফি সাহিত্যের মধ্যে নাথ যোগের স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলার বাউল ফকির সম্প্রদায়ের সাধন সঙ্গীতেও এর প্রভাব লক্ষ্যনীয়। পীতাম্বর দাসের মতে গোরক্ষ হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের সেতু রচনা করেছিলেন।

ভারতে গোরক্ষনাথ ও গোরক্ষপন্থীদের প্রসিদ্ধি পুর্ববর্তী সব মতবাদকে অতিক্রম করেছিল এবং পরবর্তীকালে উদ্ভূত বিভিন্ন সম্প্রদায়কেও সমান ভাবে প্রভাবিত করেছিল। কিছু পরে উদ্ভূত শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদী জ্ঞানমার্গ ও গোরক্ষ প্রবর্তিত নাথ ধর্মের যোগমার্গ পরস্পরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। মধ্যযুগের সন্ত মত বিশেষ করে কবীর পন্থ, নানকপন্থ ইত্যাদী সম্প্রদায়ের মধ্যে গোরক্ষনাথের বিশেষ প্রভাব ছিল। গোরখ সম্প্রদায়ের মধ্যে দত্তাত্রেয় এবং কবীর উভয়ের সাথে গোরক্ষনাথের তর্কের প্রসঙ্গ আছে। ঐতিহাসিক ভাবে যা অসম্ভব কারন দত্তাত্রেয় পৌরাণিক চরিত্র এবং কবীর ষোড়শ শতাব্দীর। সুফিদের ওপরেও নাথ পন্থার গভীর প্রভাব পড়েছিল। বাবা রতননাথ পাঞ্জাব অঞ্চলে বহু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে নাথ পন্থায় দীক্ষিত করেছিলেন। গোরখ শিষ্য গুগা পীরের কথাও জানা যায়। সুফিরা মধ্যযুগে অসংখ্য সংস্কৃত যোগগ্রন্থ ফার্সী ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। বাবা ফরিদের সঙ্গে গোরক্ষপন্থীদের যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়। মধ্যযুগে বাংলাভাষায় রচিত জ্ঞানপ্রদীপ, যোগ কলন্দর প্রভৃতি সুফি সাহিত্যের মধ্যে নাথ যোগের স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলার বাউল ফকির সম্প্রদায়ের সাধন সঙ্গীতেও এর প্রভাব লক্ষ্যনীয়। পীতাম্বর দাসের মতে গোরক্ষ হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের সেতু রচনা করেছিলেন।  গোরখ শবদিতে পাই –

হিন্দু ধ্যাঁবে দেহরা মুসলমান মসিত।
জোগী ধ্যাবৈ পরমপদ জঁহা দেহরা ন মসীত।।
হিন্দু আখৈ রাঁম কৌ মুসলমান খুদাই।
জোগী আখৈ অলখ কৌঁ, তঁহা রাম আছৈ ন খুদাই।।

হিন্দুরা মন্দিরে এবং মুসলমানরা মসজিদে উপাসনা করে। কিন্তু যোগী পরমপদের ধ্যান করেন যেখানে মন্দির, মসজিদ নাই। হিন্দু রাম ভজনা করে, মুসলমানেরা খোদা। যোগী অলখ নিরঞ্জনের ধ্যান করে যেখানে রাম বা খোদার অস্তিত্ব নেই। কবীর, নানক প্রভৃতি সন্তদের রচনায় একই বিষয়ের প্রতিফলন দেখা যায়।   

নাথপন্থ এবং গোরক্ষনাথের প্রভাব ভারতের ধর্মীয় ইতিহাসে প্রবল; রাজনৈতিক প্রভাব সপ্তম, অষ্টম শতাব্দী থেকে অদ্যবধি চলে আসছে। পশ্চিমে বালুচিস্তান থেকে পূর্বে বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, উত্তরে তিব্বত থেকে দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত গোরক্ষনাথের প্রভাব বিস্তৃত ছিল। নাথ ধর্মও এই দীর্ঘ সময়কালে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। অবৈদিক এবং সমাজের নিম্ন বর্ণের মানুষদের মধ্যে সৃষ্ট হয়ে বর্তমানে তাঁরা হিন্দু শৈব যোগী বলে পরিচিত। ভর্তৃহরি, গোপিচন্দ্র প্রভৃতি রাজারাও গোরখনাথের শিষ্য হয়েছিলেন।

বর্তমানে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসীন তার অন্যতম মুখপাত্র গোরখপুরের গোরক্ষ মঠের মোহান্ত যোগী আদিত্যনাথ, যিনি বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। গোরখপুর মঠ গোরখনাথপন্থীদের অসংখ্য মঠের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়। এই মঠ স্বয়ং গোরক্ষনাথের সাধন ক্ষেত্র বলা হয়। এই মঠের সবচেয়ে প্রাচীন যে মোহান্তর নাম জানা যায় তিনি হলেন বীরনাথ। তাঁর পর যথাক্রমে অমৃতনাথ, পিয়ারনাথ, বালকনাথ, মনসানাথ, সন্তোষনাথ ও মেহেরনাথ মোহান্ত হন। মেহেরনাথের উত্তরাধিকারী ছিলেন গোপালনাথজী। এই গোপালনাথজীর অন্যতম  শিষ্য ছিলেন গম্ভীরনাথ। অক্ষয়কুমার বন্দোপাধ্যায়ের ‘গম্ভীরনাথ-প্রসঙ্গ’ গ্রন্থ অনুযায়ী-বিংশ শতাব্দীর ভারত বিখ্যাত নাথ যোগী ছিলেন গম্ভীরনাথ। গম্ভীরনাথজীর বহু বাঙালি শিষ্য ছিল। ভারত সেবাশ্রম সংঘের  প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দের অন্যতম গুরু ছিলেন তিনি। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সাথেও তাঁর ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। গম্ভীরনাথজীর যে বর্ণনা এবং ফটোগ্রাফ পাওয়া যায় তাতে তাঁকে শ্বেতবস্ত্রে দেখা যায়। তিনি গেরুয়া পরিধান করতেন না।

গোপালনাথজির পর মোহান্ত হন তাঁর শিষ্য ও গম্ভীরনাথজীর জ্যেষ্ঠ গুরুভাই বলভদ্রনাথ।  বলভদ্রনাথের মৃত্যুর পর গম্ভীরনাথজীর অনুপস্থিতিতে বলভদ্রনাথের শিষ্য দিলবরনাথকে মোহান্ত পদ দেওয়া হয়। নাথ সম্প্রদায়ে গম্ভীরনাথজীর বিপুল প্রসিদ্ধি এবং বলভদ্রনাথজীর কোন উপযুক্ত শিষ্য না থাকা সত্বেও সুন্দরনাথকে মোহান্ত পদে বরণ করা হয়। গম্ভীরনাথজী মোহান্ত পদ নিতে অস্বীকার করেন। সুন্দরনাথ তাঁর মোহান্তপদের ক্ষমতায় মঠের দেবোত্তর সম্পত্তির অপব্যবহার শুরু করেন এবং গোরক্ষ মঠে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। সুন্দরনাথ তাঁর দাদুগুরু তূল্য গম্ভীরনাথের বিরুদ্ধে মিথ্যা আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টাও করেন। কালক্রমে সুন্দরনাথ নামেমাত্র মোহান্ত হয়ে ওঠেন এবং মঠের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতেন গম্ভীরনাথজী।    

গম্ভীরনাথজীর মৃত্যুর পর গোরক্ষ মঠের এই অরাজকতা এবং মঠের সম্পত্তি নিয়ে আইনি বিবাদ চলতে থাকে। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর সুন্দরনাথকে সরিয়ে মোহান্ত হন ব্রহ্মনাথ। ১৯৩২ সালে ব্রহ্মনাথের মৃত্যুর পর এই পদে অধিষ্টিত হন তাঁর শিষ্য দিগ্বিজয়নাথ। তিনি ছিলেন সেন্ট অ্যান্ড্রুজ কলেজের স্নাতক। ১৯২২ সালে তিনি গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন। তাঁর উপস্থিতিতে চৌরাচৌরিতে ২৩ জন পুলিশকে হত্যার ঘটনায় তিনি গ্রেপ্তার হন। সহিংসতার কারণে গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করলে তিনি গান্ধী বিরোধী হয়ে ওঠেন। ১৯৩২ সালে মোহান্ত হবার পর ১৯৩৭ সালে সাভারকরের প্রচেষ্টায় তিনি অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভায় যোগদান করেন। স্বাধীনতার পর গান্ধীকে হুমকি দিয়ে তিনি কারারুদ্ধ হন। ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদে রামসীতার মূর্তি স্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনি রাম জন্মভূমি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা করেন। তার পরবর্তি মোহান্ত অবৈদ্যনাথ ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগদান করেন। রাম জন্মভূমি আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। দিগ্বিজয়নাথ ও অবৈদ্যনাথ দুজনেই লোকসভার সদস্য হয়েছিলেন। বর্তমান মোহান্ত যোগী আদিত্যনাথ তাঁর দুই পূর্বসূরির মতই ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের অন্যতম প্রতিনিধি।

গোরক্ষের নামে প্রচলিত বহু সংস্কৃত যোগ গ্রন্থ পাওয়া যায়। তার মধ্যে গোরক্ষ সংহিতা, সিদ্ধসিদ্ধান্তপদ্ধতি, গোরক্ষ শতক, গোরক্ষ কল্প ইত্যাদী উল্লেখ যোগ্য। সিদ্ধাচার্যরা সংস্কৃতর পাশাপাশি মৌখিক ভাষায় দোঁহা, শবদি, গীতিকা ইত্যাদি রচনা করেছেন। গোরক্ষও তার ব্যতিক্রম নয়। মীন, জালন্ধর এবং কাহ্নর নামে প্রচলিত বাংলা চর্যাপদ পাওয়া যায় কিন্তু গোরক্ষের কোন বাংলা পদ পাওয়া যায় নি। গোরক্ষের নামে প্রচলিত পুরাতন হিন্দি ভাষায় গোরক্ষ কে বচন, গোরক্ষ কে গোষ্টি, গোরক্ষ বোধ নাথপন্থীদের মধ্যে প্রসিদ্ধ। পীতাম্বর দাস বড়থ্বাল তাঁর ‘গোরক্ষ বানী’তে গোরক্ষের শবদি, পদ, শিষ্য দরশন, প্রাণ সংকলি, নরবৈবোধ, আত্মবোধ, অভৈমাত্রা যোগ, পন্দ্রহ তিথি, সপ্তবার, মচ্ছিন্দ্র গোরখ বোধ, রোমাবলী, জ্ঞান-তিলক, পঞ্চমাত্রা ইত্যাদী সংকলন করেন। তাঁর মতে গোরক্ষনাথের নামে প্রচলত অধিকাংশ রচনা পরবর্তিকালে রচিত, একমাত্র শবদিগুলি গোরক্ষের সবচেয়ে প্রামাণিক রচনা। বর্তমান গোরখ শবদি গুলি ‘গোরক্ষ বানী’ থেকে অনুবাদের প্রচেষ্টা করা হয়েছে।     

গোরখ শবদির বিষয়ে এত কথা বলার কারণ গোরক্ষনাথ ও তার পন্থের ইতিহাস ও দর্শন নিয়ে চর্চা করলে তা থেকে বর্তমান হিন্দু পরিচিতিবাদ এবং রাম উপাসক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাথে এই পন্থের সম্বন্ধ বা বিরোধ কতটুকু সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে। তাই পাঠকদের সুবিধার্থে সামান্য পরিসরে নাথ সম্প্রদায়ের সম্পর্কে সাধারন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

পড়ুন:  গোরক্ষ শবদির অনুবাদ 

তথ্যসূত্র

১। কল্যানী মল্লিক, নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস, দর্শন ও সাধনপ্রণালী। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪৬
২। প্রফুল্লচরণ চক্রবর্তী, নাথ ধর্ম ও সাহিত্য। ১৯৫৫
৩। রাজমোহন নাথ, বঙ্গীয় নাথপন্থের প্রাচীন পুঁথি। আসাম বঙ্গ যোগী সম্মিলনী, ১৯৬৪
৪। অলকা চট্টোপাধ্যায়, চুরাশি সিদ্ধর কাহিনী। প্যাপিরাস, ১৯৬০
৫। শ্রী গিরিশ চন্দ্র সেন, জ্ঞানেশ্বরী(সন্ত জ্ঞানেশ্বরের ভাগবত গীতার ভাষ্য জ্ঞানেশ্বরী-র অনুবাদ)। সাহিত্য একাডেমী, নিউ দিল্লী, ১৩৬৩ 
৬। পীতাম্বর দাস বড়থ্বাল, গোরখ বানী। হিন্দী সাহিত্য সম্মেলন, প্রয়াগ।
৭। কুলাবধূত সৎপুরানন্দ, বজ্রযান পরিচয়, তিব্বতের যোগী ও তান্ত্রিকদের সান্নিধ্যে, অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ( আলেকজান্দ্রা ডেভিড নীলের My Journey to Lahsa গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ)। প্রাচী প্রকাশনী। 
৮। অক্ষয়কুমার বন্দোপাধ্যায়, গম্ভীরনাথ-প্রসঙ্গ। শ্রী মণীন্দ্রচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ফেনী হাইস্কুল, নোয়াখালী, ১৩৩২ বঙ্গাব্দ। 

অভিষেক ঘোষ

স্বাধীন গবেষক, কবি, যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বাসিন্দা।

Share

2 thoughts on “নাথপন্থা ও গোরখ-শবদি”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top