আজ বৃহস্পতিবার, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ইওরোপিয়দের ভারতীয় গাছগাছড়া এবং চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞান লুঠ

।। বিশ্বেন্দু নন্দ ।।

।। বিশ্বেন্দু নন্দব ।

আয়ুর্বেদ, য়ুনানি-সহ প্রাচ্যীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ঔপনিবেশিক লুন্ঠন নিয়ে লিখছেন বিশ্বেন্দু নন্দ। প্রথমে থাকছে ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক আলাপ। পরের পর্বে থাকবে আমাদের এই নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থার ঔপনিবেশিক লুঠের ইতিবৃত্ত বিষয়ক আলাপ।

ইওরোপিয়দের ভারতীয় গাছগাছড়া এবং চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞান লুঠ (ধারাবাহিক)

বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানকে অক্সিডেন্টাল প্রতীচ্যবাদী বলা হাস্যকর। আমাদের প্রযুক্তি সারা বিশ্বের, বিশেষ করে চিনের প্রযুক্তির মূলসূত্রগুলো ধরেই তৈরি হয়েছে। অথচ আজকে জাপান থেকে নাইজেরিয়া যেখানেই দেখি সফল প্রযুক্তি মানেই পশ্চিমী প্রযুক্তি। আমাদের বিজ্ঞান অতীতের বিজ্ঞানের মৌলিকসূত্রগুলির সমাহার। আজকের পশ্চিমি বিজ্ঞানে মধ্যযুগের ইসলামিক বৈজ্ঞানিকদের প্রভাব অসামান্য। ইসলামিক বৈজ্ঞানিকেরা অতীতের গ্রিসিয় বিজ্ঞানীদের থেকে অনেক বেশি ধীশক্তিসম্পন্ন ছিলেন এবং দক্ষতায় উৎকর্ষে তাদের ছাড়িয়ে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। চিকিৎসাবিদ্যায় আলরাজি বা ইবনুল হাইথামের আলোকবিদ্যা অথবা অঙ্কে ওমর খৈয়াম অসামান্য দক্ষ আর জ্ঞানী। এই সব প্রখ্যাত জ্ঞানীর অধিকাংশ মূল কাজ আজ আর পাওয়া যায় না, যা দেখি তার অধিকাংশই ল্যাটিন অনুবাদ, যেগুলি অধ্যয়ন করেই পশ্চিমি বিজ্ঞান এতদূরে এগিয়েছে। আজকে বিশ্বের সর্বত্র পশ্চিমি পদ্ধতি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের রমরমা

লিন হোয়াইট, দ্য হিস্টোরিক্যাল রুটস অব আওয়ার ইকোলজিক্যাল ক্রাইসিস

সুদূর অতীত থেকেই ভারতবর্ষ-চিন-পারস্য-আরব অঞ্চলে চিকিৎসাবিদ্যা এবং চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত খনিজ, গাছগাছালি এবং পশুপাখি ইত্যাদির ফলিত জ্ঞানের চর্চা ধারাবাহিকভাবে হয়েছে। এশিয় জ্ঞানচর্চা লুঠেরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আগে মুঘল সাম্রাজ্যে চর্চিত এবং প্রয়োগ হয়েছে। এর সুফল দরবারি অভিজাত থেকে আমআদমিও লাভ করেছে।

শীতের দেশ পশ্চিম ইওরোপে বৈচিত্রপূর্ণ গাছগাছালি পশুপাখির সমারোহের অভাব পূরণ করতে বহুকাল ধরেই তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এশিয়ায় উপনিবেশ তৈরির ভাবনা। এশিয় মানিচিত্রে বসফরাস প্রণালী পেরিয়ে তুরস্কে প্রবেশ করলে কিছুটা সবুজের সমারোহ চোখে পড়ে; সে অঞ্চল পেরোলে বিস্তৃত মরুভূমি; তার পরে দক্ষিণ আর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত সবুজাভ এলাকা। আড়াই হাজার বছর আগে থেকেই এই সবুজ অঞ্চলে জীববৈচিত্রে ধনী ভারতবর্ষ, পারস্য এবং চিন ছিল বিশ্বের কারখানা। যারা কারিগর হকার চাষীদের তৈরি বিকেন্দ্রিত কারিগর উৎপাদন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রিত এশিয় জ্ঞানচর্চার পরিবেশ ধারণ করেছে, পালনও করেছে। বিকেন্দ্রিত জ্ঞানচর্চা শুধু দরবারি জ্ঞানীর ঘেরাটোপেই আটকে থাকেনি, মিশেগিয়েছিল সাধারণতম মানুষের জীবনচর্যাতেও। এই জ্ঞানচর্চার একাংশ ছিল চিকিতসা এবং স্বাস্থ্যচর্চা। আজও এর প্রত্নরেশ বাংলার মা দিদিমা নানি দাদি খালাম্মা চাচি ফুফারা পারিবারিক রোগ সারানোর টোটকা চিকিৎসা, রান্নাবান্না আর গ্রামীণ পরম্পরার চিকিৎসকদের চিকিৎসা দক্ষতায় থেকে গেছে।

আলেজান্ডারের আমল থেকে ইওরোপিয়রা দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় উপনিবেশ তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে। শুধু ধনসম্বল লুঠই নয়, জ্ঞান এবং প্রকৃতি লুঠেরও চেষ্টা চলেছে। আলেকজান্ডারের দক্ষিণএশিয় দখলদারি বাঙালির সামরিক শক্তির ভয়ে ব্যর্থ হলেও ১৭৫৭য় বাংলা থেকে ইওরোপিয় উপনিবেশের জয়যাত্রা শুরু হয়। আলেকজান্ডারের পরে আগ্রাসী ক্রুসেডে ইওরোপিয়দের ব্যর্থতায় এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক-বাণিজ্যিক শহর কন্সট্যান্টিনোপলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে সময়ে একমাত্র বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অঞ্চল, এশিয়ার দখলদারির স্বপ্ন বেসামাল হয়ে পড়ে। হার থেকে শিক্ষা নিয়ে পশ্চিম ইওরোপিয়রা নতুন পরিকল্পনা ভাঁজতে থাকে। এক ঝাঁক ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ উপসর্গের সনদী কোম্পানি তৈরি হওয়ার বেশ কিছু দশক আগে ইওরোপে রাজতন্ত্র এবং অভিজাতদের উদ্যোগে – লেভন্ট কোম্পানি, মস্কোভি কোম্পানি, এস্তাও দা ইন্ডিয়ার মত বহু লিমিটেড কোম্পানি তৈরি হয়। মুঘলেরা দক্ষিণ এশিয়ায় আসার আগেই সাম্রাজ্যবাদী ইওরোপিয় প্রতিনিধি পর্তুগিজেরা দক্ষিণ এশিয়ায় গোয়ায় গণহত্যা চালিয়েছে, চট্টগ্রাম দখল নিয়েছে বাংলাজুড়ে লুঠপাটের আসর বসিয়েছিল। পর্তুগিজদের পরে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ উপসর্গ নিয়ে এশিয়ায় আসে ব্রিটিশ ডাচ আর ফরাসি কোম্পানি। এদের সাথী হয়ে এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েন ইওরোপিয় জ্ঞান নথিকারেরা। কোম্পানিগুলোর দেখন উদ্দেশ্য বাণিজ্য হলেও ঘোমটা দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল এশিয়াজোড়া সাম্রাজ্য স্থাপন।

মুঘল, সাফাভি, উসমানীয় এবং বিস্তৃত চিন সাম্রাজ্যের নানান বিষয় নথিকরণ করতে গিয়ে ইওরোপিয় নথিকারেরা বুঝলো ইওরোপিয়রা জ্ঞানে ধনে মানে, সামরিক শক্তিতে এশিয় শক্তিগুলোর কাছাকাছি আসার যোগ্যতা রাখে না। তাই পরিকল্পনামাফিক আরও বড় জ্ঞানচর্চার উদ্যম শুরু হলো। স্বেন বেকার্টের এম্পায়ার অব কটন, তুলোর বিশ্ব ইতিহাস অনুবাদে আমি দেখিয়েছি ১৭০০র শুরুতেই ইওরোপিয়রা বস্ত্র উৎপাদন প্রযুক্তি নকল শুরু করে। ধরমপাল তার পাঁচ খণ্ডের চরনা সংকলনে দেখিয়েছেন জ্ঞান বিজ্ঞানের নানান শাখায় বিস্তৃত জ্ঞান নথিকরণ করতে থাকে ইওরপিয়রা। চন্দ্রকান্ত রাজুর নেতৃত্বে আর্যভট্ট দল দেখিয়েছিলেন কীভাবে কেরল থেকে জেসুইটদের হাত ধরে কলনবিদ্যা ইওরোপে যাচ্ছে এবং কোনও সূত্র না রেখে নিউটন, লিবনিতজ ইত্যাদিরা সে সব অঙ্ক চর্চা করছেন। এ বিষয়ে পরম পত্রিকা বিশদে কাজ করেছে। ধরমপালজীর কন্যা গীতা ধরমপাল ফ্রিক দেখিয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় আসা জেসুইট পাদ্রিদের নথিকৃত জ্ঞান, রোমের গ্রন্থাগার থেকে ইওরোপের নানান গ্রন্থাগারে নকল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

পর্তুগিজদের পরে প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তি উদ্যোগে ব্রিটিশ ডাচ এবং ফরাসিরা এশিয় জ্ঞান নথিকরণ শুরু করে, যার একটা বড় ধারা ছিল চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত জ্ঞান নথিকরণ। ইওরোপে দক্ষিণ বা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মত জীবকুল বৈচিত্র এবং সেই জ্ঞানচর্চার পরম্পরা থাকার কথাই নয়, তারা এই অঞ্চলে চিকিৎসাবিদ্যা এবং তারই উপজাত জ্ঞান হিসেবে গাছগাছড়ার সুফল ইত্যাদি নথিকরণ করেছে। এই কাজে তারা এশিয় জ্ঞানীদের বিদ্যা কাজে লাগায়। এটা খুব বড় উদ্যম ছিল। প্রসন্নন পার্থসারথী হোয়াই ইওরোপ গ্রিউ রিচ… বইতে এক ব্রিটিশ সমীক্ষা অনুসরণ করে বলছেন কোম্পানি আমলে দক্ষিণ এশিয়া থেকে বিভিন্ন গ্রন্থাগার থেকে ৩ কোটির বেশি বই লুঠ হয়ে ইওরোপে চলেগেছে। এই বিপুল নথিকরা জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই তারা বিশ্বজোড়া এককেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি করবে এবং উপনিবেশের ক্ষমতা বিকাশ করবে।

আলেকজান্ডারের পরে আগ্রাসী ক্রুসেডে ইওরোপিয়দের ব্যর্থতায় এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক-বাণিজ্যিক শহর কন্সট্যান্টিনোপলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে সময়ে একমাত্র বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অঞ্চল, এশিয়ার দখলদারির স্বপ্ন বেসামাল হয়ে পড়ে। হার থেকে শিক্ষা নিয়ে পশ্চিম ইওরোপিয়রা নতুন পরিকল্পনা ভাঁজতে থাকে। এক ঝাঁক ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ উপসর্গের সনদী কোম্পানি তৈরি হওয়ার বেশ কিছু দশক আগে ইওরোপে রাজতন্ত্র এবং অভিজাতদের উদ্যোগে – লেভন্ট কোম্পানি, মস্কোভি কোম্পানি, এস্তাও দা ইন্ডিয়ার মত বহু লিমিটেড কোম্পানি তৈরি হয়। মুঘলেরা দক্ষিণ এশিয়ায় আসার আগেই সাম্রাজ্যবাদী ইওরোপিয় প্রতিনিধি পর্তুগিজেরা দক্ষিণ এশিয়ায় গোয়ায় গণহত্যা চালিয়েছে, চট্টগ্রাম দখল নিয়েছে বাংলাজুড়ে লুঠপাটের আসর বসিয়েছিল। পর্তুগিজদের পরে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ উপসর্গ নিয়ে এশিয়ায় আসে ব্রিটিশ ডাচ আর ফরাসি কোম্পানি। এদের সাথী হয়ে এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েন ইওরোপিয় জ্ঞান নথিকারেরা। কোম্পানিগুলোর দেখন উদ্দেশ্য বাণিজ্য হলেও ঘোমটা দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল এশিয়াজোড়া সাম্রাজ্য স্থাপন।

ইওরোপিয়দের দক্ষিণ, দক্ষিণ-ইওরোপিয়দের দক্ষিণ, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার চিকিৎসা এবং গাছগাছালির জ্ঞান নথিকরণের কয়েকটি জরুরি এবং প্রায়োগিক উদ্দেশ্য ছিল- 

১) ইওরোপের চিকিৎসাবিদ্যা এবং স্বাস্থ্য জ্ঞানচর্চা যেহেতু তখনও বিকশিত নয়, তাই তাকে উন্নত করতে উপমহাদেশিয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং আনুষঙ্গিক নানান জ্ঞানচর্চা নথিকরণ প্রয়োজন ছিল।

২) ইওরোপের জলবায়ুতে কম প্রজাতির গাছগাছালি জন্মায়। দক্ষিণ, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বৈচিত্রপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ ইওরোপ এবং অন্যান্য উপনিবেশিক দেশের মাটিতে চাষের কাজে লাগানোর জন্যে নথিকরণ জরুরি ছিল।

৩) বিশ্ব লুঠের কাজে সমুদ্র পেশাদারদের স্বাস্থ্য বিধান জরুরি ছিল। কর্পোরেট জাহাজগুলো ইওরোপের নানান বন্দর ছেড়ে এশিয়া আফ্রিকা আমেরিকায় পৌঁছনোর আগেই এবং লুঠের সম্পদ ভর্তি ইওরোপের দিকে ফিরতি জাহাজে বিপুল সংখ্যক নাবিক সমুদ্রেই মারা যাচ্ছে বিচিত্র রোগেভুগে। এ সব রোগের নিদান ইওরোপিয় চিকিৎসাবিদ্যায় ছিল না; ফরাসীরা ভারতে/এশিয়ায় বড় বাণিজ্য শক্তি ছিল না। ১৬৬৪ থেকে ১৭৮৯র মধ্যে ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১২০০০০ হাজার বিভিন্ন স্তরের নাবিক, ব্যবসায়ী, আমলা সমুদ্রযাত্রা করেছে। এদের একতৃতীয়াংশ প্রায় ৩৫০০০ সমুদ্রেই প্রাণ হারাচ্ছে। ১৬৮৯এ বঙ্গোপসাগরে ডাক্তার, শল্যচিকিতসক সহ ৬০০ ফরাসি নৌসেনা দল কয়েক দিনের অসুখে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির মোট ব্যবসার মাত্র কয়েক শতাংশ ব্যবসা করা ফরাসী কোম্পানির যদি এই দুরববস্থা হয়, তাহলে বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করা পর্তুগিজ, ব্রিটিশ আর ডাচেদের নাবিকদের অবস্থা অনুমেয়।

৪) এশিয় নথিকৃত প্রাণ বৈচিত্র সম্পদ নথিকরণ প্রয়োজন ছিল, এই গাছগাছালি লুকিয়ে পাচার করে ব্যবসায়িক বাগিচা ইত্যাদি তৈরি করে লুঠব্যবসার কাজে বিনিয়োগ করা ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য।

৫) ভারতবর্ষে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলোর চিকিৎসকদের চিকিৎসার কাজে নথিকরা জ্ঞান আর গাছগাছালির চরিত্র জানা দরকার ছিল।

দক্ষিণ এশিয়ায় ইওরোপিয় গাছগাছালির জ্ঞান লুঠের এই পর্বে প্রবেশ করার আগে আমরা দেখে নিতে চাই, মুঘল আমলে চিকিৎসা ব্যবস্থাটি। এটি নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের ডাকঘর প্রকাশনী প্রকাশিত পার্থ পঞ্চাধ্যায়ীর ব্রিটিশ ভারতে রাষ্ট্র ও দেশিয় চিকিৎসা ব্যবস্থা বই থেকে। এই পর্বে দেখব আয়ুর্বেদ, ইয়ুনানি এবং হেকিমি চিকিৎসাবিদ্যা সংশ্লেষী পথ অবলম্বন করে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল। 

ব্রিটিশপূর্ব সময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা

প্রাচীন যুগের শেষে আয়ুর্বেদের চিকিৎসা পদ্ধতি এবং তত্ত্বের লিখিত সংস্করণ তৈরি হয়েছিল। শাসকদের অনুমতিতে চিকিৎসক, সংহিতাকার, সম্পাদকেরা বছরের পর বছর প্রয়োজনীয় ওষুধগুলিকে চিকিৎসাশাস্ত্রে অঙ্গীভূত করার কাজ করেছেন। ভারতবর্ষে ১২০০ সনের পরে গ্রিসিয়-আরবিয় ইয়ুনানি চিকিৎসা ব্যবস্থার আগমন ঘটল। য়ুনানিরর তত্ত্বগুলি মিশর এবং গ্রিসের চিকিৎসা শাস্ত্র নির্ভর করে বিকশিত এবং বাগদাদী খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় আরব আর পারস্যে এসে সেটি একটি নির্দিষ্ট অবয়ব ধারণ করে। সে সময়ের পারস্য ভারত চিন মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির চিকিৎসা ব্যবস্থার জোরের দিকগুলি আহরণ করে আরবেরা চিকিৎসা ব্যবস্থাটিকে সমৃদ্ধ করে। পরের দিকে মুঘলেরা এটিকে আরও সুসংবদ্ধ করে। সে সময় ভারতবর্ষে দুটি চিকিৎসা ব্যবস্থার বন্ধুত্বপূর্ন সহাবস্থান ঘটেছিল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মিলের জন্য  – সংহিতা করণে গুরুত্ব দেওয়া, দৈহিক ধাত তত্ত্ব এবং চিকিৎসা জ্ঞানের হস্তান্তর। সে সময়ের রাজা, সুলতানেরা চিকিতসকেদের চিকিৎসার সংহিতা প্রকাশ করে চিকিৎসার জ্ঞানকে ছড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন। চিকিতসকেদের সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্র, রোগ নির্নয় কেন্দ্র তৈরি করেন তারা।

য়ুনানানির নানান সংকলনের মধ্যে মাদানু-শিফা সিকারশানি নামক পুঁথিতে য়ুনানি চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে বিশদে আলোচনা রয়েছে। এটিতে য়ুনানি এবং আয়ুর্বেদে ব্যবহৃত নানান ভেষজ থেকে তৈরি ওষুধের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। মনে হয়, এই সময়ের চিকিৎসকেরা তাদের অধীত জ্ঞান আর বিদ্যা উজাড় করে দিয়েছিলেন পুঁথি লেখার কাজে। অন্য চিকিৎসকেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা তো ছিল। এগুলো সেসময়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা – ওষুধ, ভেষজ, রোগের বিশ্লেষণ এবং ওষুধ রোগীর দেহে কিভাবে কাজ করছে সেই সবের সংহিতা। সে সময় এ ধরণের প্রচুর সংহিতা প্রকাশিত হয়েছে। দুটি ব্যবস্থারই চিকিৎসকেরা রাজ দরবারে স্থান পেয়েছন, ধনার্জন করেছেন, প্রখ্যাত হয়েছেন। সংহিতা তৈরির কাজ শুধু য়ুনানি অথবা হেকিমি চিকিৎসকেদের মধ্যেই আটকে থাকল না, ভারতীয় বৈদ্যরাও সংহিতা তৈরিতে জুড়ে গেলেন। মাঠেঘাটের অভিজ্ঞতার জ্ঞান সংহত করে তারা নতুন করে প্রাচীন চিকিৎসা শাস্ত্রকে নতুন করে লিখলেন। আয়ুর্বেদ আর য়ুনানি চিকিৎসকেরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চিকিৎসাবিদ্যার সংহিতাকরণের কাজ করতে থাকলেন।

দেহের ধাত বা রস(বডি হিউমার) সংক্রান্ত তত্ত্ব কিন্তু আয়ুর্বেদ এবং য়ুনানি এই দুই চিকিৎসাবিদ্যার ভিত্তি – পার্থক্য হলো রস বা ধাতের সংখ্যায়। হেকিমেরা টেট্রাহিউমরাল(চাররস) তত্ত্ব ভিত্তিতে চিকিৎসা করতেন, অন্যদিকে বৈদ্যরা নির্ভর করতেন ট্রিহউমরাল(তিনরস) তত্ত্বে। হেকিমেরা রসকে চার ভাগে ভাগ করতেন, রক্ত, কফ, হলুদ এবং কৃষ্ণ পিত্তরসে।

প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে য়ুনানির পার্থক্য করে দিল তার হাতে কলমে কাজের প্রয়োগবিদ্যার তাত্ত্বিকতা। ফিরোজ তুঘলকের সময়ে এ ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরম্পরার বাড়ি ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে চিকিৎসাবিদ্যার বিদ্যালয়ীকরণের উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে। মুঘল সময়ে ইরান এবং প্রতিবেশি দেশগুলি থেকে বহু বিশেষজ্ঞ চিকিতসক ভারতে আসেন। মুঘল রাজত্ব যে সব সেবা/রোগনির্নয়(ক্লিনিক) কেন্দ্র তৈরি করেছিল, সেগুলিতে এই চিকিতসকেদের পরবর্তী চার-পাঁচ প্রজন্ম সরাসরি যুক্ত ছিলেন। দুই চিকিৎসা ব্যবস্থা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় য়ুনানি এবং আয়ুর্বেদের জ্ঞানভাণ্ডার সংহিতাকরণ সম্ভব হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশের আগের সময় অবদি দুটি চিকিৎসাশাস্ত্রর সংহিতা করণের কাজ চলেছে।

সে সময় আয়ুর্বেদ চিকিৎসাজ্ঞানশাস্ত্রও বিকশিত হয়েছে। আয়ুর্বেদের ধর্মীয় ঝোঁক শাসকদের খুশি করে নি। তারা পারস্য থেকে হেকিম নিয়ে আসেন। পরের দিকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছেড়ে বৈদ্যরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং নব্য ব্যবস্থার নানান চরিত্র আত্তিকরণে প্রবৃত্ত হন। আয়ুর্বেদ অতীতের গোঁড়ামি রক্ষণশীলতার খোলস ছেড়ে য়ুনানি চিকিতসাবিদ্যার প্রভাবে এগোতে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা। সমাজে চিকিৎসা ব্যবস্থা আর চিকিৎসকের প্রতিষ্ঠা, সম্মানও বাড়ল।

ইলতুতমিসের(১২৯৬-১৩২১খ্রি) সময়ে প্রচুর য়ুনানি চিকিৎসক রাজদরবারে কাজ পায়। তারা সেবা/রোগনির্নয় কেন্দ্র তৈরি করে অসুস্থদের নিদান দিতেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক বিকাশের ফলে সেই সময় প্রচুর পারস্য থেকে চিকিতসক ভারতবর্ষে আসেন। আলাউদ্দিন খিলজি(১২৯৬-১৩২১)র রাজত্বে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসালয়ে এবং দরবারে অন্তত ৪৫ জন চিকিৎসক কাজ করতেন।

পরের সময়েও চিকিৎসকেদের ভারতবর্ষে আসায় ছেদ পড়েনি। চিকিতসকেরা বহু চিকিৎসা সংহিতা রচনা করেন। মাজমা-ই-জিয়ে মহম্মদ তুঘলকের সময়ে সংহিতাকৃত হয়। এই কৃতিটি সেই সময়ের জ্ঞান এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, যার ভিত্তি ছিল ভারত-আরব মিলিত চিকিৎসা শাস্ত্র। মহম্মদ বিনতুঘলকের সময়ে শুধু দিল্লিতেই ৭০টির বেশি চিকিতসাকেন্দ্রে ১২০০ চিকিৎসক যুক্ত ছিলেন।

চিকিৎসা জ্ঞানের প্রণালীবদ্ধ হওয়ার এই প্রচেষ্টা আয়ুর্বেদিয় ব্যবস্থাকেও জুড়ে নিল। মহম্মদ তুঘলকের পরে ফিরোজ তুঘলক চিকিতৎসকেদের শাস্ত্র লিখতে উতসাহ দিলেন। তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী এবং হাড়জোড়া ডাক্তারও ছিলেন এবং চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা করতেন। মহম্মদ শাহের চিকিসক আল মাহুমুদ ভগভট্টের রসরত্নসমুচ্চয়ঃ পারসিকে অনুবাদ করেন। নাম হয় টিব্বইফিরোজ শাহী। সংস্কৃত এবং আরবি নানান গ্রন্থ ফারসিতে অনুবাদের জন্য গুজরাটে অনুবাদ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। অনুবাদ গ্রন্থগুলোর মধ্যে তারিখইবনখালিকান এবং মিশকাতশরিফ প্রখ্যাত হয়।

শাহ সিকন্দর লোদির সময়ে প্রখ্যাত দরবারি চিকিৎসক বাওয়া বিন খাওয়াস, সুশ্রুত, চরক সংহিতা, রসরত্নাকর, শ্রাঙ্গধর, মাধবন, চিন্তামন এবং চক্রদত্তের আয়ুর্বেদিয় সংহিতা নির্ভর করে টিব্বইসিকান্দরি সংকলন করেন। ১৪৮৯-এ বাহালুল লোদির মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসা সিকান্দর লোদি চিকিৎসক মিয়াঁ ভোয়াকে রাজদরবারে নিযুক্ত করেন। ১৫১২তে ভোয়া প্রকাশ করেন মদন-উল-শিফা সিকন্দর শাহী। যেখানে বলা হয় ভারতবর্ষীয় মানুষদের জন্য য়ুনানি ব্যবস্থা উপযুক্ত নয়, কেননা এই বিদ্যায় ব্যবহৃত ভেষজজগুলি গ্রিস বা আরবের জ্ঞানচর্চা থেকে নেওয়া। তাই ফারর্সিতে আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসা, ঔষধ ইত্যাদির নির্যাস নিয়ে বই লিখতে হবে। ভোয়া সহায়ক হিসেবে বেশ কিছু হেকিম নিযুক্ত করেন। বিধিবদ্ধ চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরি করে হেকিমদের সেই কেন্দ্রে চিকিৎসা বিদ্যা ঝালিয়ে নেওয়ার কাজ দেওয়া হল। এদের মধ্যে কয়েকজনের ব্যক্তিগত চিকিৎসাকেন্দ্রও ছিল। এই সময়ে শাসকেরা আয়ুর্বেদের জ্ঞান কাজে লাগাতে উদ্যোগী হলেন। পরের সময়ে দেখা যাবে যখন আয়ুর্বেদ তত্ত্ব মোটামুটি দেওয়া নেওয়ার মধ্যে দিয়ে য়ুনানিতে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে।

প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে য়ুনানির পার্থক্য করে দিল তার হাতে কলমে কাজের প্রয়োগবিদ্যার তাত্ত্বিকতা। ফিরোজ তুঘলকের সময়ে এ ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরম্পরার বাড়ি ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে চিকিৎসাবিদ্যার বিদ্যালয়ীকরণের উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে। মুঘল সময়ে ইরান এবং প্রতিবেশি দেশগুলি থেকে বহু বিশেষজ্ঞ চিকিতসক ভারতে আসেন। মুঘল রাজত্ব যে সব সেবা/রোগনির্নয়(ক্লিনিক) কেন্দ্র তৈরি করেছিল, সেগুলিতে এই চিকিতসকেদের পরবর্তী চার-পাঁচ প্রজন্ম সরাসরি যুক্ত ছিলেন। দুই চিকিৎসা ব্যবস্থা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় য়ুনানি এবং আয়ুর্বেদের জ্ঞানভাণ্ডার সংহিতাকরণ সম্ভব হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশের আগের সময় অবদি দুটি চিকিৎসাশাস্ত্রর সংহিতা করণের কাজ চলেছে।

মুঘল আমলে চিকিৎসা ব্যবস্থা

বাবরের সময়ের হাকিম ইয়ুসুফ বিন মহম্মদ, আয়ুর্বেদ আর য়ুনানির মূল কাঠামো সংহত করে চিকিৎসাশাস্ত্র লেখেন। তিনি আয়ুর্বেদ আর য়ুনানির স্বাস্থ্যবিধি, রোগ নির্নয় পদ্ধতি এবং চিকিৎসাকর্মরমত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংকলন করেন। বাবরের সেনাবাহিনীতে বহু দক্ষ চিকিৎসক এবং শল্য চিকিৎসক ছিলেন।

হুমায়ুনের দরবারের দার্শনিক-চিকিৎসক ছিলেন মৌলানা মহম্মদ ফজল। তাঁর পার্ল অব সায়েন্স– ১২টি জ্ঞানের রত্নপেটিকা, এর মধ্যে চিকিৎসা শাস্ত্র অন্যতম। আকবর সংহিতার কাজে জ্ঞানীদের উৎসাহিত করেন। তার রাজত্বকাল বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং সামাজিক বিষয়ে বিকাশের কাজের জন্য চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের বিকাশে অনুবাদকর্মকে এতই গুরুত্ব দিতেন যে তার রাজত্বে আলাদা করে অনুবাদ এবং সংহিতা বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয়। হুমায়ুনের রাজত্বকালে ফাওয়াইদঅলইনসান সংহিতা লেখা হয়। এটায় ভারত ইরানের খাদ্যাভ্যাস, ওষুধ ব্যবহার এবং চিকিৎসায় ওষুধের প্রভাব নির্নয় করা হয়েছে। মুঘল সাম্রাজ্যে আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসাব্যবস্থা উপেক্ষিত ছিল না। পারসিক চিকিসক ছাড়াও আকবর হিন্দু চিকিৎসক নিয়োগ করেছিলেন। আকবরের সময়ের আরেকটি চিকিতসা সংক্রান্ত পুঁথি তাবাকত-ই-আকবরিতে দরবারের বেশ কিছু হিন্দু চিকিৎসকের নাম আছে। তারা খাজঞ্চিখানা থেকে সরাসরি মাইনে পেতেন। আকবরের রাজত্বে য়ুনানি, আয়ুর্বেদ সব থেকে বেশি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে।

জাহাঙ্গীরের সময়ে হাকিম রুহুল্লা আয়ুর্বেদের স্বাস্থ্যবিধি অনুবাদ করেন। তিনি দুধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চিকিৎসকেরা কী ধরণের পদ্ধতি এবং রীতিনীতি অনুসরণ করবেন সে বিষয়ের পুস্তক রচনা করেন। জাহাঙ্গীর চিকিৎসা শাস্ত্রে এতই পটু ছিলেন যে নিজে রোগের দাওয়াই নিদান দিতে পারতেন। জাহাঙ্গীরের পরে শাহজাহানের সময় ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা উন্নতির চরম শৃঙ্গে আরোহন করে। দেশ জুড়ে হাসপাতাল তৈরি হয়। শল্যচিকিৎসক, মাসিউজ্জামানহাকিম নুরুদ্দিন মহম্মদ আবদাল্লা, আকবর, জাহাঙ্গীর আর শাহজাহানের সময়ে য়ুনানি এবং ভারতবর্ষীয় শল্য চিকিৎসা এবং চিকিতসকেদের নিয়ে কয়েকটি সংহিতা প্রণয়ণ করেন। শাহজাহান দিল্লিতে বড় হাসপাতাল তৈরি করেন। এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা হত। শাহজাহানের সময়ে আমানুল্লা খান, হাকিম নুর আল বিন মহম্মদের মত কিছু চিকিৎসক খ্যাতির চরম শিখরে ওঠেন। আকবর শাহজাহানের সময় সম্রাট এবং অভিজাতদের নানান পুস্তকে দরবারি চিকিৎসকেদের সংখ্যা ছিল – আকবরের সময় পারসিক চিকিৎসক ছিল ১৪, ভারতীয় ১২, অন্যান্য ১৩ মোট ৩৯, শাহজাহানের সময় এই সংখ্যাটি ছিল যথ্যাক্রমে ৭, ৩, ১, মোট ১১।

এরপরে দরবারি চিকিৎসকদের পৃষ্ঠপোষণা ক্রমাগত কমেছে। আজ আমরা জানি যে মুঘল রাজত্বে চিকিৎসা এবং আরোগ্য কেন্দ্র তৈরি করার উতসাহ দেওয়া হত এবং সেখানে অসুস্থদের সুস্থ করে তোলা হত। তাছাড়া হয়ত এরপরে সম্রাটেরা বুঝতে পারলেন চিকিৎসকেদের বেশি দরবারে না রেখে বিভিন্ন সংগঠনে নিয়োগ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাদের চিকিৎসা করতে দেওয়া উচিত যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হতে পারেন। পরের দিকে আমরা দেখেছি এই কেন্দ্রগুলি, চিকিৎসক আর অন্যান্য পেশাদারদের জন্য বিশেষ অর্থ সাহায্য পেত।

আওরংজেবের সময়ে য়ুনানি চিকিৎসাবিদ্যায় বিপুল সংখ্যক প্রকাশনা হয়েছে। এই সময়টা য়ুনানি চিকিৎসাবিদ্যা নতুন উৎকর্ষ লাভ করে। তবে আয়ুর্বেদকে তিনি যে নির্বাসনে দিয়েছিলেন, এমন কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। এধরণের পদক্ষেপ নিলে কোন না কোন চিহ্ন থেকেই যেতই এবং তার সিংহাসনে বসার সময়ে আমরা দেখেছি, দুটি চিকিতসা ব্যবস্থাই মুঘল রাজত্বে একইভাবে বিকশিত হয়ে এসেছে। আওরঙ্গজেব মফস্বল, ছোট শহর এবং এমন কি গ্রামেও চিকিৎসা কেন্দ্র(হাসপাতাল) তৈরি করেন। প্রখ্যাত লেখক-চিকিৎসক, নবাব খয়ের আন্দেশ খানের চিকিৎসাকেন্দ্রে হাকিম এবং বৈদ্যরা একসঙ্গে চিকিৎসা করতেন এবং রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হত।

এটাও পরিষ্কার যে স্থানীয় মুসলমান শাসকেরাও হাকিম এবং বৈদ্যদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। মুঘল সম্রাটেরা চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের জন্য “আকুয়াফ” নামক বিশেষ অনুদান বরাদ্দ করতেন। এই বরাদ্দ চিকিৎসা কেন্দ্র, তার চিকিৎসক এবং কর্মচারীর জন্য ব্যয় হত। মাদ্রাসাগুলি যাতে ঠিকমত চলে, তার জন্য মুঘল সাম্রাজ্য বিপুল বরাদ্দ করেছিল। য়ুনানি শিক্ষাকেন্দ্র সম্পর্কে রাজকীয় বরাদ্দের যথেষ্ট প্রমান পাওয়া যাচ্ছে, যদিও আয়ুর্বেদিয় শিক্ষা কেন্দ্র সম্বন্ধে এ ধরণের উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে না, তবুও মনে হয় সেই পরিমানটা খুব নগণ্য ছিল না।

অনুবাদ এবং সংহিতাকরণ এবং য়ুনানি এবং আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসার ইতিহাস নিয়ে যে আলোচনা করলাম তাতে পরিষ্কার ব্রিটিশ পূর্ব সময়ে চিকিৎসার জ্ঞান প্রাতিষ্ঠানিকতার দিকে এগোচ্ছিল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের হেকিম আয়ুর্বেদিয়, য়ুনানি চিকিৎসাশাস্ত্র আর চিকিৎসার জ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রচুর প্রকাশনা করছেন। চিকিৎসাশাস্ত্রের গতিশীলতার আরেকটা প্রমান হল রস(পারদ) শাস্ত্রের বিকাশ। ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে চিকিৎসা জ্ঞানে পারদ বিষয়ক শাস্ত্রের প্রবেশ এই শাস্ত্রটিকে অনেক দূর এগিয়ে দিতে সাহায্য করেছে। এই সময়ে নাড়ি পরীক্ষাও চিকিৎসায় অন্যতম আবশ্যিককর্ম হয়।

হেকিম ইসকান্দার য়ুনানি এবং হেকিম শরিফ খানের মতো দুজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক, পরিকল্পিতভাবে ভারত জুড়ে য়ুনানিবিদ্যা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেছেন। প্রথম জন উনবিংশ শতে দাক্ষিণাত্যে যান। হায়দার আলি এবং টিপু সুলতান ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে উতসাহিত করেছেন। টিপু এবং তাঁর বাবা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। সে সময়ে অনেকগুলি তামাদি হয়ে যাওয়া বা ভুলে যাওয়া বই ফার্সিতে অনুদিত হয়। গ্রিকো-আরব চিকিৎসকেদের কাছে দাক্ষিণাত্য বরাবরের জন্য পরিচিত এলাকা। শরিফ খানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ শারা-ই-হুমিয়ত-ই কানুন এবং ইলাজ অল-শরিফি। য়ুনানির প্রচারে তালিফ ই-শরিফি, ইসকান্দর য়ুনানির শেষ বৌদ্ধিক কাজ। সাধারণ মানুষের পড়ানোর জন্যে তিনি এটিকে স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। শরিফ খান খানদান-ই-শরিফি নামক য়ুনানি চিকিৎসকের পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। পরিবারের শেষ প্রখ্যাত চিকিৎসক হেকিম আজমল খান। তিনিনি পরিবারের পরম্পরার বয়ে নিয়ে সারা দেশে য়ুনানি চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রচার করেছেন।

ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে দাক্ষিণাত্য য়ুনানি চর্চার বড় অঞ্চল ছিল। এই অঞ্চলে লেখক-চিকিৎসকেরা বিপুল পরিমান য়ুনানি চিকিৎসা এবং জ্ঞানচর্চা নথিকরণ এবং প্রচারের কাজ করেছেন। আসিফ জা এবং সিকন্দর জাএর রাজত্ব চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজকর্ম উতসাহ দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিল। দাক্ষিণাত্যের ভেষজের বিশদ বিবরণ ইয়াদগারইরাজাই এই সময়ের লেখা। দস্তুরিআমসিকন্দরজাহি, মুজারিবাত-ই জামাল য়ুনানি পদ্ধতিতে রোগ নির্নয়, নাড়ি এবং মুত্র পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা এবং সভাসদেদের চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণার উল্লেখ করেছে। ওয়ালাজাহির সময়ে দাক্ষিণাত্যে কিভাবে চিকিৎসা হত, জামাল তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।

য়ুনানি আর আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ব্যবস্থা, তাত্ত্বিক একতা আর রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য একই পথ ভ্রমন করেছিল। হয়তো রাজাদের মনে হয়েছিল দুই চিকিৎসা ব্যবস্থা তাদের স্থিতির পক্ষে ক্ষতিকারক নয় তাই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। হাতে গোণা হেকিম ছাড়াও, মুঘল ভারত বিপুল সংখ্যায় বৈদ্যশাস্ত্রীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। মুঘল মধ্যবিত্ত মনসবদারের বাহিনীতে বৈদ্যরা চাকরি করেছেন। মনসবদারদের বাহিনীর শিফাখানায় চিকিতসকেরা চাকরি করতেন রাষ্ট্রীয় বেতনে। রাষ্ট্র এবং মনসবদারেরা তাদের বাহিনীতে বৈদ্যদের সেবাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করত। তবে এটা হয়ত সত্যি যে আয়ুর্বেদের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা খুব জরুরি শর্ত ছিল না। মনসবদারদের বাহিনীর সঙ্গে যে সব চিকিৎসক থাকতেন তাদের কাজ ছিল যুদ্ধে বা অসুস্থ সেনার চিকিৎসা। সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর যুদ্ধের গতি বজায় রাখার জন্য তাদের সেবাটা জরুরি ছিল। কোন কোন সময় ছোট শহরে হাসপাতালে হেকিম আর বৈদ্যর চাকরি হত। ছোট ছোট শহরে যে সব হাসপাতাল চলত সেগুলি চালানোর দায় যার নাম “আলতামঘা” ছিল অভিজাত এবং জায়গিরদারদের ওপর। খান বলছেন, যদিও বৈদ্যরা সরকারিভাবে মনসবদার বা সরকারি সেবাকেন্দ্রে চাকরি করতেন, – রাজ্য স্তরে হেকিমি আর বৈদ্যদের সংখ্যা ছিল বিপুল।

এ সময়ে দুধরণের চিকিৎসক ছিলেন, একদল রাজারাজড়া মনসবদার এবং অভিজাতদের সঙ্গে কাজ করতেন, অন্যদিকে আরেক প্রকার গ্রামে গ্রামে বিপুল সংখ্যায় চিকিৎসক রাষ্ট্রীয় সাহায্য ছাড়াই চিকিৎসা করতেন। রাজ দরবারে, রাজসভায় কাজ করতেন তারা থলিভরা সম্মানজনক মাইনে পেতেন, এদের অধিকাংশ ফারর্সি জানিতেন, ধনবান, তাদের প্রভূত সামাজিক পদমর্যাদা ছিল। তাদের কেউ কেউ সত্যিকারের ধনী হয়েছেন, কেউ কেউ এত ধনী আর খ্যাতি পেয়েছেন যে কেউ কেউ অভিজাত পরিগণিত হয়েছেন, তবে মোট চিকিৎসক জনসংখ্যার খুবই ভগ্নাংশ এরা।

সে সময় ভারতবর্ষে বিভিন্নস্তরের চিকিৎসক ছিলেন – কিছু রাজদরবারে অভিজাতদের সেবা দিতেন, কিছু মনসবদারদের অধীনে চাকরি করতেন এবং শেষে বিপুল সংখ্যক রাষ্ট্রের সাহায্য ব্যতিরেকে রাজ্যস্তরে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং সমাজে সেবা দিতেন। চাকরির সুযোগ সীমিত ছিল। এই তথ্য থেকে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে স্থানীয় গ্রাম/ছোট শহরস্তরে চিকিতসকেদের চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা বিপুল ক্ষেত্রে রাজসভা নির্ভর ছিল না। হয়ত তারা সেই এলাকাতেই প্রশিক্ষিত হতেন এবং সেখানেই তাদের সেবা দিতেন।

এবারে আমরা মুঘল সময়ের চিকিৎসা তাত্ত্বিকদের মধ্যে একজনকে বেছে নিয়ে তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা করব।

হেকিম ইসকান্দার য়ুনানি এবং হেকিম শরিফ খানের মতো দুজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক, পরিকল্পিতভাবে ভারত জুড়ে য়ুনানিবিদ্যা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেছেন। প্রথম জন উনবিংশ শতে দাক্ষিণাত্যে যান। হায়দার আলি এবং টিপু সুলতান ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে উতসাহিত করেছেন। টিপু এবং তাঁর বাবা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। সে সময়ে অনেকগুলি তামাদি হয়ে যাওয়া বা ভুলে যাওয়া বই ফার্সিতে অনুদিত হয়। গ্রিকো-আরব চিকিৎসকেদের কাছে দাক্ষিণাত্য বরাবরের জন্য পরিচিত এলাকা। শরিফ খানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ শারা-ই-হুমিয়ত-ই কানুন এবং ইলাজ অল-শরিফি। য়ুনানির প্রচারে তালিফ ই-শরিফি, ইসকান্দর য়ুনানির শেষ বৌদ্ধিক কাজ। সাধারণ মানুষের পড়ানোর জন্যে তিনি এটিকে স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করেন।

নুরুলদিন শিরাজি,ইলাজাতইদারাশিকো

মুঘল শাহজাদা দারাশিকোর প্রতি চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ক এই বইটি উৎসর্গ করেন মুঘল আমলের প্রখ্যাত চিকিৎসক নুরুলদিন শিরাজি। বইটির অন্য দুটি নাম টিবইদারাশিকো, দাহরাই দারাশিকো। বইটিতে সে সময় মুঘল রাজত্বে চিকিতসাশাস্ত্রীদের জ্ঞান সংকলন করা হয়েছে।

নুরুলদিন মহম্মদ আবদুল্লা সিরাজি সপ্তদশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসক। জন্ম ভারতবর্ষে। যতদূর সম্ভব তাঁর পিতা ছিলেন ইরাণী হাকিম আয়ানুলমুলক শিরাজি(মৃ ১৫৯৫)। মায়ের দিকেরটা ছিল ইরাণের প্রখ্যাত দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক জালালুদ্দিনের(১৫০২) পরিবার। আয়ানুলমুলক শিরাজি ছিলেন আকবরের দরবারের হেকিম, চক্ষুবিশারদ। নুরুলদিন শিরাজির মা আয়ানুল মুলক শিরাজির স্ত্রী ছিলেন আকবরের দরবারের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক আবুলফজল আল্লামি এবং কবি ফৈজির বোন।

নুরুলদিন শাহজাহানের সময়ে মুঘল দরবারে আসেন। সেখানে তাঁর পিতার উপাধি হয় আয়ানুলমূলক। আওরঙ্গজেবের সময় তিনি আগরার দেওয়ানইবুউতাত, রাজ প্রাসাদগুলির কর্মাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। চিকিৎসাশাস্ত্রের নানান বই লেখা ছাড়াও তিনি রুকাওয়াতই আবুলফজল এবং ফৈজির চিঠিপত্রের সংকলন প্রকাশ করেন। এছাড়াও একেশ্বরবাদের তত্ত্ব তৌহিদ বিষয়ে পুস্তক মীরাটিবঅলউজুদও লেখেন।

ইলাজাতই দারাশিকো ছাড়াও তিনি ফারসিতে শাহজাহানকে উৎসর্গ করে লেখেন আলফাজঅলাদওয়িয়া – সে সময়ের প্রচলিত ওষুধের বিশদ বিবরণ। বইটির হাতিমা অধ্যায়ে চা, কফি এবং চিনা শেকড়বাকড় নিয়ে তৎকালীন সময়ের যা জ্ঞান ছিল, সে সবও লিখিত হয়। উনবিংশ শতক পর্যন্ত এর অনেকগুলি সংকলন প্রকাশিত হয়। সিরাজির অন্য একটি বইএর নাম আনিসআলমুয়ালিজান, চিকিৎস বিষয়ক বিষয়ক সকলন। এ ছাড়াও আরবি আর পারসিক চিকিৎসাবিদ্যাবিষয়ক লব্জগুলি নিয়ে একটি সংকলন লেখেন কোয়াস্তাসঅলআটিব্বা, এটি তিনি আমানুল্লা খানকে উৎসর্গ করেন।

শিরাজির কাজ ইওরোপিয়দের নজর এড়ায় নি। ইওরোপিয় মেটিরিয়া মেডিকা তৈরির সময়য়ে শিরাজির বহু সংস্করণ ছাপা হয়। শিরাজির পুস্তক আলফাজ… প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন ১৭৯৩ কলকাতায়, বাজারে এটির প্রথম মূল ফারসি সংস্করণ ছাপা হয়ে আসার বহু আগে। তিনি মুখবন্ধে লেখেন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মেডিক্যাল বোর্ডের নির্দেশে, ‘কোম্পানির ব্যবহারের জন্যে’ এই কাজটি করেছেন।

১৮৩১ত-এ মেজর ডেভিড প্রাইস ইলাজাতইদারাশুকো থেকে নাসিরইহুসরোর সম্পাদিত অংশ মানবদেহের সেন্স, সময় ও বস্তু নিয়ে কাজ অনুবাদ করেন। মুখবন্ধে তিনি লেখেন, a work of no common magnitude or importance […] and contains treatises, or discourses, not only on all the diseases […] but also on almost every subject within the compass of the human understanding. এই মুখবন্ধে বলা হয় সুরাটের ফরাসি কুঠিয়াল এম M. Bruys ফ্রান্সের রাজার গ্রন্থাগারের জন্যে জন্যেও এটি নকল করেন। যে পুঁথিটি কুঠিয়ালের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল, সেটি ১৮০২ সালে বিবলিওথেক ন্যাশিওনাল দা পারিতে নিয়ে নেওয়া হয়।

শিরাজির ইলায়াজা… মুঘল আমলের সব থেকে ব্যাপ্ত চিকিতসাশাস্ত্র বিষয়ক কাজ। পারস্যের চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে এলগুড লেখেন, a gigantic work which rivals in quantity, if not in quality, the Canon of Avicenna or the Thesaurus of al-Jurjani। তার আকারের তুলনায় এই কাজটি খুব কম সময়ে সম্পাদন করেন শিরাজি। শিরাজি ইলায়াজা… লেখা শুরু করেন ১৬৪২-৪৩ সনে এবং এটি চার বছরের মধ্যে ১৬৪৬ সনে শেষ হয়। এই বইতে তার চিকিৎসা জীবনের নানান অভিজ্ঞতাও উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে তার সময়ের আগের সময়ের জ্ঞানীদের কিছু জ্ঞানও তিনি লিপিবদ্ধ করেন। Fabrizio Speziale, The Encounter of Medical Traditionsএ বলছেন, এই প্রবন্ধটি লেখার সময় তাঁর ইলায়াজা…র একটি সংস্করণ দেখেছেন তেহরানের মজলিশ গ্রন্থাগারে। এই বইতে বেশ কিছু ছবি আঁকা আছে, বিশেষ করে representations of the human body indicating the spots for cupping, phlebotomy and cauterization

ইলাজাত… সে যুগের জ্ঞানচর্চার অন্যতম সংশ্লেষী উদাহরণ। সে সময় ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রলোকের যে ইন্দো-পারসি জ্ঞানভাণ্ডারগুলি জীবিত ছিল, সেইগুলি পুঁথিতে সঙ্কলিত হয়েছে। মুঘল শাহজাদা দারাশুকো ভারতীয় সুফি পরম্পরার অন্যতম কারিগর এবং উৎসাহী মানুষ। তাঁর উদ্দেশ্যেই বইটি উতসর্গিত হয়েছে। দারাশুকো উপনিষদের পারসিক অনুবাদে উৎসাহ দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি পারসিক ভাষায় লেখা সুফি সাধনার মুসলমান এবং হিন্দু তত্ত্ব পরম্পরার তুলনামূলক আলোচনার পুঁথি লেখেন। শিরাজির পরিবারও ভারতীয় জ্ঞানচর্চার অন্যতম ধারক-বাহক ছিলেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় ফৈজী ১৫৮৭য় ভাষ্করের লীলাবতী অনুবাদ করেন আকবরের উৎসাহে। এছাড়াও বেদান্ত দর্শন বিষয়ে সারিকঅলমারিফাত লেখেন ইশরাকি ধর্মতত্ত্ব ভিত্তি করে। আকবরের নির্দেশে অথর্ববেদ অনুবাদের যে প্রকল্প নেওয়া হয় ফৈজী সেটির সঙ্গেও জড়িয়েছিলেন, কিন্তু সে কাজ যতদূর সম্ভব শেষ হয় নি। আকবরের নির্দেশে মহাভারতের ফারসি অনুবাদের ভূমিকা লেখেন আবুলফজল এবং আইনিআকবরিতে ভারতীয় নানান পরম্পরার পরিচয় দেন তিনি।

মুঘল ভারতে ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে বিপুল পারসি পুঁথি রচিত হয়। সুলতানি সময় থেকে এই কাজটি উর্দু ভাষায় শুরু হয় এবং ধারাবাহিকভাবে চলে ব্রিটিশ আমলের আগে পর্যন্ত। উর্দু আর ফারসি ভাষায় ইসলাম-পূর্ব সময়ের চিকিৎসা শাস্ত্র এবং বিজ্ঞান বিষয়ক শাস্ত্র অনুবাদ মুঘল আমলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণকর্ম বলে আজও বিবেচিত হয়। বিশেষ করে চিকিৎসা শাস্ত্র/জ্ঞান অনুবাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় ভাষায় বিদেশি ওষুধ, গাছগাছড়ার প্রতিস্থাপনের দেশিয় জ্ঞান অর্জন। ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ে পারসি পুঁথি লেখেন শিরাজীর সমসাময়িক চিকিৎসক আমন আল্লা হান। তিনি মদনবিনোদএর অনুবাদ করেন। কয়েকটিতে ঔরঙ্গজেবের নাম জোড়া হয়, যেমন দারউইস মহম্মদের চিকিতসাশাস্ত্র বিষয়ে কাজ টিবইআউরঙ্গশাহী।

ইলাজাত…এর আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল ইসলামের ধার্মিক ও অধার্মিক পরম্পরার জ্ঞান ঐতিহ্যের পারস্পরিক সহাবস্থান। নুরুলদিন তার পুঁথিতে, নবি উল্লিখিত হাদিত(একটি শারীর বিজ্ঞান অন্যটি ধর্ম সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান) এবং ইসলামপূর্ব ইমাম এবং ধর্মতাত্ত্বিকদের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। এই পুস্তকে তিনি অষ্টম শিয়াপন্থী ইমাম আলিঅলরিদার সময়ে লিখিত রিসালাঅলদাহাবিয়া থেকেও উদ্ধৃতি তুলেছেন। যোগীরা কিভাবে নিঃশ্বাসের কাজকর্ম করেন, সে উল্লেখও শিরাজী করেছেন তার পুঁথিতে। সুফির কোন পন্থে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন তার উল্লেখ নেই যদিও, পরিষ্কার যে তিনি দারার অনুগামী ছিলেন।

ইলাজাত… সে যুগের জ্ঞানচর্চার অন্যতম সংশ্লেষী উদাহরণ। সে সময় ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রলোকের যে ইন্দো-পারসি জ্ঞানভাণ্ডারগুলি জীবিত ছিল, সেইগুলি পুঁথিতে সঙ্কলিত হয়েছে। মুঘল শাহজাদা দারাশুকো ভারতীয় সুফি পরম্পরার অন্যতম কারিগর এবং উৎসাহী মানুষ। তাঁর উদ্দেশ্যেই বইটি উতসর্গিত হয়েছে। দারাশুকো উপনিষদের পারসিক অনুবাদে উৎসাহ দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি পারসিক ভাষায় লেখা সুফি সাধনার মুসলমান এবং হিন্দু তত্ত্ব পরম্পরার তুলনামূলক আলোচনার পুঁথি লেখেন। শিরাজির পরিবারও ভারতীয় জ্ঞানচর্চার অন্যতম ধারক-বাহক ছিলেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় ফৈজী ১৫৮৭য় ভাষ্করের লীলাবতী অনুবাদ করেন আকবরের উৎসাহে। এছাড়াও বেদান্ত দর্শন বিষয়ে সারিকঅলমারিফাত লেখেন ইশরাকি ধর্মতত্ত্ব ভিত্তি করে। আকবরের নির্দেশে অথর্ববেদ অনুবাদের যে প্রকল্প নেওয়া হয় ফৈজী সেটির সঙ্গেও জড়িয়েছিলেন, কিন্তু সে কাজ যতদূর সম্ভব শেষ হয় নি। আকবরের নির্দেশে মহাভারতের ফারসি অনুবাদের ভূমিকা লেখেন আবুলফজল এবং আইনিআকবরিতে ভারতীয় নানান পরম্পরার পরিচয় দেন তিনি।

সূত্র

১] ব্রিটিশ ভারতে রাষ্ট্র এবং দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা – বিশ্বেন্দু নন্দ; ডাকঘর প্রকাশনা, রংপুর
২] কপিল রাজ, রিলোকেটিং মডার্ন সায়েন্স

চলবে

বিশ্বেন্দু নন্দ
বিশ্বেন্দু নন্দ

লেখক, গবেষক, সংগঠক, প্রকাশক। উপনিবেশপূর্ব সময়ের সমাজ অর্থনীতিতে  কারিগরদের ইতিহাসের খোঁজে সর্বক্ষণের কর্মী। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। বাংলায় পরম্পরার উৎপাদন বিক্রেতাদের বিষয়ে লিখেছেন নিরন্তর। বাংলার উপনিবেশপূর্ব সময়ের পরম্পরার চাষী-হকার-কারিগর-ব্যবস্থা বিষয়ে খোঁজ করছেন। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। ‘পরম’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব, ম্যান এন্ড দ্য মিথ, স্বেন বেকার্ট এম্পায়ার অব কটন, যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেসন, আহকমই আলমগিরি অনুবাদ করেছেন। পলাশীপূর্বের বাংলার ৫০ বছর, পলাশীপূর্বের বাংলার বাণিজ্য দুটি মৌলিক পুস্তকের রচয়িতা। 

Share

1 thought on “ইওরোপিয়দের ভারতীয় গাছগাছড়া এবং চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞান লুঠ”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top